ভালোবাসার অন্যরূপ পর্ব-০৩

0
1012

#ভালোবাসার_অন্যরূপ🍁

#লেখিকা:- Nishi Chowdhury

#তৃতীয়_খণ্ড

আরিশা কন্টিনিউয়াসলি ফোন দিচ্ছে অভির নাম্বারে। প্রতিবারের মতোই নট রিচেবল দেখাচ্ছে ফোনটা। রাগে-দুঃখে ফোনটা বেডের ওপরে আছাড় মারল। হাতটা সরিয়ে আনতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুলে ডায়মন্ডের এঙ্গেজমেন্ট রিং টা জ্বলজ্বল করছে। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগের ঘটনা।

🌺 🌸 🌺

তখন আহনাফ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরিশা মাথা নিচু করে ফেলেছিল। আহনাফ এর পাশে বসা তার মা উঠে এসে আরিশার হাত ধরে নিজের পাশে নিয়ে গিয়ে বসালেন। ভদ্রমহিলা যে প্রচন্ড খুশি হয়েছেন তার মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। আরিশার দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে থাকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

— কি হলো কথা বন্ধ হয়ে গেল কেন তোমার? কালতো কত কথা বললে? ছেলেমানুষ না বুঝে কি করে ফেলেছে। আমাদেরকে গিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু আমি জানি আমার ছেলে কেমন? ছেলের পছন্দ কেমন?

আহনাফের আব্বু আমতা আমতা করে বললেন,

— এখন এগুলো বলে কেন আমাকে লজ্জা দিচ্ছো তুমি? আসলে এখনকার ছেলেমেয়েদের মতিগতির ঠিক নেই। ভয় হয়। কিন্তু এখন দেখছি। এমন মেয়ে আমরা হাজার খুঁজলেও পেতাম না। সাবাস বেটা….! আমার যোগ্য উত্তরসূরী। (আহনাফের কাধ চাপড়ে বললেন।)

আহনাফের আম্মু গর্বের সাথে বললেন,

প্রথম থেকেই আমি আমার ছেলের উপর পুরোপুরি ভরসা করেছি। কখনো ঠকতে হয়নি আমাকে। আর এখন দেখছি এই ব্যাপারটাতেও আমি ঠকিনি। বরং লেটার মার্ক পেয়ে পাশ করেছি। একেবারে আমার মনের মত একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে আমার ছেলেটা।

আরিশার হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আহনাফের আম্মু বললেন,

— তোমার নাম কি মামনি?

সৌজন্যতার খাতিরে হালকা হেসে ভদ্রতার সাথে বলল

— আসলামুআলাইকুম আন্টি। আমার নাম আরিশা, আরিশা আনজুম নিশি।

— ওয়ালাইকুম আসসালাম। মাশাল্লাহ…! তোমার নামটা তো দেখছি তোমার মতোই খুব মিষ্টি মামনি। তুমি হয়তো এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ আমরা এখানে কি জন্য এসেছি। তুমিতো জানতে না। আসলে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ ছিল। আমি তোমার আম্মুকে বলেছিলাম তোমাকে যেন কিচ্ছু না জানাই। তোমাকে আগে থেকে জানালে তুমি টেনশন করবে তার থেকে বরং একেবারে এসে সারপ্রাইজ দিয়ে তোমার হাসিখুশি চমকে যাওয়া মুখটা দেখব আমরা। সারপ্রাইজ টা কেমন লাগলো মামনি? আহ্ কিন্তু এখন তোমাকে দেখার পর কি মনে হচ্ছে জানো?

— কি আন্টি?

— এখন মনে হচ্ছে তোমাকে আর একটু চমকে দিয়ে একেবারে বউ করে নিয়ে আমার বাড়ি চলে যাই। এরকম পুতুলের মতো মেয়েটা কে সাথে করে নিয়ে না গেলে তো আজ আমার বাসায় গিয়ে মন টিকবে না। কি মামনি যাবে নাকি এখন আমার সাথে?

প্রতিউত্তরে আরিশা মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেলল।

আহনাফের আম্মু মুচকি হেসে বললেন,

— এবার এসো তোমাকে এদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

বলে এক এক করে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখনই আহনাফের চাচাতো ভাই আরাফ তার মেজ মাকে (আহনাফের আম্মু) কে বলে উঠলেন,

—আরে মেজ আম্মু আমি তোমার মেজো ছেলে তোমার এই চাওয়াটাও পূরণ করে দিচ্ছি। আরে মিয়া বিবি রাজি তো বিয়ে পড়াবে এই কাজী (নিজের শার্টের কলার ঝাকা দিয়ে বলল)

ওর কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। আরিশার আম্মু সবার উদ্দেশ্যে বললেন,

— তোমাদের যার যা ইচ্ছে আছে সব পূরণ করবে কিন্তু দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর। আসুন আপনারা সবাই। কিছু আপ্পায়ন এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগে খাওয়া-দাওয়া করে নিন তারপর জমিয়ে সবার সাথে আলাপ হবে।

তারপর দুপুরের সবাই একসাথে বসে হইচই করে দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ করল । আহনাফদের পরিবার আরিশার পুরো পরিবারকে সাথে নিয়ে খেতে বসেছে। তারা বলেছে,

—- কিছুদিন পর আমরাও আপনাদের পরিবারের সদস্য হয়ে যাব তাই এত ফরমালিটি দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই আসুন আমরা সবাই একসাথে খেতে বসি।

আহনাফের পরিবারের এমন ব্যবহারে আরিশা মুগ্ধ হয়েছিল।কিন্তু পুরোটা সময় আরিশা চুপচাপ ছিল। শুধু তার কাছে যে দু একটা প্রশ্ন করা হয়েছে তারই উত্তর দিয়েছে সে। আহনাফের পরিবার এই ব্যাপারটাতে তেমন কোন গুরুত্ব দেননি কারণ লজ্জা নারীর ভূষণ। আর হঠাৎ এভাবে কোন মেয়েকে দেখতে আসলে তার মুখের কথা এমনিতেই আটকে যাবে।

এরপর আসরের নামাজ শেষে দুই পরিবারের পূর্ণ সম্মতিতে তাদের এঙ্গেজমেন্ট সম্পন্ন হয়। আহনাফ পুরোটা সময় মুগ্ধ দৃষ্টিতে শুধু আরিশাকেই দেখে গিয়েছে। কিন্তু আরিশা ভুলেও আর একবারও আহনাফের দিকে তাকাই নি। কিন্তু আরিশা আহনাফের দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পেরেছে এই ব্যাপারটা যা আরিশাকে আরো বেশি অবাক করে দিয়েছে।

মাগরিবের নামাজ শেষে চা নাস্তা খেয়ে আহনাফ ও তার পরিবার বিদায় নিয়েছে আরিশার পরিবার থেকে। আরিশার পরিবারের সবাই খুব জোর করেছিল রাতের খাওয়াটাও তাদের সাথে খেয়ে যেতে কিন্তু তারা আপত্তি জানিয়ে বললো।

— একবার যখন আত্মীয়তা হয়ে গেছে আসা-যাওয়া তো লেগেই থাকবে। প্রতিবার না হয় এক বেলা করে খেয়ে যাব। প্রতিউত্তরে সবাই হেসে আহনাফের পরিবারকে বিদায় দিয়েছিল।

🌺 🌸 🌺

পুরো ঘটনা মনে পড়তেই রাগে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরলো আরিশার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার কিন্তু তার কোন উপায় নেই। বাসাভর্তি তার তার পরিবারের লোকজন। চুলের ভেতরে আঙ্গুল চালিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে খাটের পাশে বসে পরল। এভাবে কিছুক্ষণ চোখের জল ফেলে বিছানার উপর থেকে হাত ধরে ফোনটা হাতে নিয়ে আবার ডায়াল করলো অভি নাম্বারে। কিন্তু আবার সেই একই কথা। নট রিচেবল।

আরিশার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। নিজের মনের কথা গুলো না পারছে নিজের পরিবারকে বলতে। আর এই দিকের ঘটনা গুলো অভিকে না জানাতে পারছে । টেনশন করতে করতে মাথা যন্ত্রণা করছে আরিশার । শেষে না পেরে খাট ঘেসে বসে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে সে। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার।

অভি অন্তত যদি ফোনটা রিসিভ করতো তাহলে সে এখনই অভিকে এই বাড়িতে আসতে বলতো। আরিশার বিশ্বাস যে ওর মা- বাবা একবার অভিকে দেখলে দ্বিমত করতে পারবে না তাদের ব্যাপারটা। কারণ অভি ওয়েল এডুকেটেড এবং স্টাবলিস্ড একটি ছেলে, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ও ভালো ওর জানা মতে । মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিটা মা-বাবা নিঃসন্দেহে এমন ছেলেকে পছন্দ করবে।

আরিশা চাইছে অভিকের সাথে নিয়েই ওর মা-বাবার সামনে তাদের একে অপরের পছন্দের কথাটা জানাবে। কিন্তু অভির ফোন তো বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। যানে কে কোথায় কি করছে? এরকম তো বন্ধ কখনো থাকে না। আর ওর পরিবারের তেমন কোনো মানুষের সাথে ও আরিশার পরিচয় নেই যে তার কাছে ফোন করবে কারণ তাদের সম্পর্কটা মাত্র 1 বছরের। তাই এতটাও একে অপরের পরিবার সম্পর্কে জেনে উঠতে পারেনি কেউই।

মাইগ্রেনের ব্যথা টা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে আরিশার। মনে হচ্ছে মাথার ভিতরে কেউ চিবিয়ে চিবিয়ে ছিড়ে ফেলছে সবকিছু। মাথাটা হাঁটুর উপর ভর দিয়ে চোখ বন্ধ করে উবু হয়ে শুয়ে আছে আরিশা। মাথার উপর হঠাৎ কারণ হাতের স্পর্শ পেতে হালকা কেঁপে উঠে মাথা তুলে তাকায় সে। মাথা তুলতে দেখতে পায় তার মা এক গ্লাস পানি ও মাইগ্রেনের ওষুধ টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আরিশার আম্মু তার পাশে বসে ওষুধের পাতা থেকে একটা ওষুধ বের করে আরিসার হাতে দিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলো খেয়ে ফেলতে। সেও তাই করল। পানির গ্লাস পুরো ফাঁকা করে পাশে থাকা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে সোজা হয়ে বসলো। মাথাটা এখনো খাটের সাথে হেলান দিয়া আছে। এতটাই ভার মনে হচ্ছে যে মাথা উঁচু করে রাখার ক্ষমতা আরিশার নেই।

আরিশার আম্মু নিরব দৃষ্টিতে কিছুক্ষন মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে তেলের বোতলটা হাতে নিয়ে এসে বিছানায় বসে একটু একটু করে মেয়ের মাথায় তেল দিতে শুরু করলেন। আরিশা চুপ করে বসে রইল মায়ের সামনে। মাথায় তেল দিতে দিতে আরিসার আম্মু বললেন,

একটা কথা কি জানিস। এই পৃথিবীতে সুসময়ে বন্ধুর কোনো অভাব নেই। কিন্তু দুঃসময় যে পাশে থাকে সেই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধু। আর যেটা অনেক ভাগ্য করে পাওয়া যায়। সেই প্রকৃত বন্ধুর হাত ধরেই বাকি জীবনটা একসাথে চলতে পারাই হচ্ছে জীবনের সার্থকতা।

সেদিন আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেও কিন্তু সেন্সলেস হয়ে যায়নি। হাসপাতালে করা তোর সেই পাগলামো গুলো সবই নিরব দৃষ্টিতে দেখেছিলাম। সারা হাসপাতাল জুড়ে তো কত মানুষ ছিল কিন্তু কারোর মনে একটুও দয়া সৃষ্টি হয়নি এই মা মেয়ের জন্য।

সবাই যে যার তালে ব্যস্ত ছিল। একটা কথা চিন্তা করে দেখেছিস সেদিন যদি আহনাফ না থাকতো তাহলে আমাকে একা রেখে তোর পক্ষে হাসপাতালে ছোটাছুটি করা সম্ভব হতো? আর যতই আমার থেকে লুকাস না কেন আমি জানি সেই দিন আমার মিনি স্ট্রোক হয়েছিল।

আরিশার মনে পড়ল সেদিনকার ঘটনা। এটা একদম সত্যি যে সেদিন যদি আহনাফ না থাকতেন তাহলে সেদিন মাকে নিয়ে একদম অথৈ সাগরে পড়বার মতো অবস্থা হতো তার। অপারেশন থিয়েটারের পোশাক পরিহিত অবস্থায় দৌড়ে এসে সব ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে ওর মাকে ভর্তি করেছিল আহনাফ। আনিসার আম্মু মেয়ের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন,

— আমি নার্সের কাছে শুনেছি আমাকে তো ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল কিন্তু তোর আর কোনো অভিভাবক ওখানে উপস্থিত না থাকার কারণে বারবার আহনাফ এসে দেখে গেছে তোকে। কতটা দায়িত্ববান ছেলে ভাবতে পারছিস।

কথাগুলো বলে আরিশার আম্মা কিছুক্ষণ থামলেন। আরিশা ও চুপ্টি করে বসে মায়ের সব কথা শুনছে। ডান পাস থেকে চিরুনি তুলে মেয়ের চুলে আঁচড়ে দিতে দিতে বললেন,

— চুলগুলোর মোটেও যত্ন নিস্ না। কত জট পাকিয়ে ছিস চুলগুলোতে। তেল দিয়েও ঠিক করতে পারছিনা। সমস্যা নেই চুলের জট আমি ছাড়িয়ে দিচ্ছি আর তার সাথে সাথে তোর মনের মধ্যে বেঁধে থাকা সকল প্রশ্নের জট ও খুলে দেবো।

আরিশা চমকে উঠলো! কি বলল তার মা এগুলো? আমার মনের ভেতর জট খুলে দেবে মানে। মা জানলে কি করে আমার মনের ভিতরে কিছু প্রশ্নের জট পাকিয়ে আছে । আরিশা পেছনে ঘুরতে চাইলেও তাকে ঘুরতে দিলো না আরিশার মা। তিনি মেয়েকে ঠিক করে বসিয়ে বললেন,

— উহু নড়িস না দেখছিস না আমিতো চুলের জট ঝরাচ্ছি। এত নড়লে কি কাজ করা যায়।

মায়ের এমন শীতল কন্ঠ শুনে আরিশার রক্ত হিম হয়ে আসতে চাইল। কিছু শুকনো ঢোক গিলে চুপচাপ বসে থাকলো মায়ের সামনে। আরিশার মা আবার বলতে শুরু করলেন,

— জানিস মেয়েরা মা হওয়ার পরে না মেয়েদের মধ্যে একটা অন্যরকম সিক্রেট পাওয়ার চলে আসে। যা দ্বারা সে তার সন্তানের সবকিছুর অনুভব করতে পারে। মুখে না শুনেও চোখ দেখেই মায়েরা সন্তানের মনের কথা বলে দিতে পারে আবার তার সন্তানের দিকে দেওয়া মানুষের নজর গুলো কোনটা সুনজর আর কোনটা কুনজর সেটাও বুঝতে পারে। সেদিন হসপিটালে আহনাফের তোর প্রতি দায়িত্বগুলো আমার খুব ভাল লেগেছিল। আমি দেখেছিলাম সেদিন বারবার তোকে দেখছিল। মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সোজা নয়। কিন্তু তোর প্রতি ওর দৃষ্টি কুলুষিত ছিলনা। বরং তাতে ছিল একরাশ মুগ্ধতা।

ভয়ের ভিতরেও কিঞ্চিৎ লজ্জা অনুভব করল আরিশা মাথা নিচু করে ফেলল সে। মনে মনে ভাবল এদিকে ও মায়ের দৃষ্টি পড়েছিল। তাহলে কি মা সবকিছু জেনে গেছে।

বেনুনি করা কমপ্লিট করে আরিশার কাঁধে এলিয়ে দিয়ে মাথার দুপাশে চেপে ধরে বললেন,

— তোর মাথা ব্যথা কমেছে আম্মু?

এতক্ষণে আরিশার খেয়াল হলো যে তার তীব্র মাথা ব্যাথা করছিল। সত্যিই ব্যাথাটা ৯০ শতাংশ কমে গেছে। আনিসার আম্মু খাট থেকে নেমে হাতে থাকা অবশিষ্ট তেলটুকু নিজের মাথায় ঘষে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— একটা জিনিস ভেবে দেখেছিস আম্মু তুই সে দিন যার বেশি সান্নিধ্য চেয়েছিলি সেই তোর বিপদের সময় এগিয়ে আসেনি। বারবার ফোন দিয়েছিলি ফোনটাও রিসিভ করেনি। পরে যখন রিসিভ করল তখন অজুহাত দেখিয়ে কেটে পরল। বিপদের সময় যে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে এভাবে হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায় তাকে অন্তত ভালোবাসার মানুষ বলে প্লিজ আমাকে অন্তত বোঝাতে আসিস না। কারণ এই ব্যাপারটাতে তোর থেকে আমার জ্ঞান বেশি আছে।

আরিশা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

— ক্ কার কথা ব্ বলছ আম্মু।

আরিশার মা মুচকি হেসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— যার সাথে রাত দুটোর সময় ফোনে কথা বল? ফোন আসলে নাস্তার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ো। ভার্সিটি শেষে পাশের কফিশপে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করো, যাকে তুমি বারবার ফোন করো কিন্তু সে তোমাকে প্রয়োজন ছাড়া একবারও ফোন করে না, তার কথা বলছি। অভি…! আমি অভি আহমেদ এর কথা বলছি।

আরিশার এমনিতেই চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। মায়ের মুখে এই কথা শোনার পরে মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

আরিশার আম্মু মেয়ের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন,

মা এটাকে ভালোবাসা বলেনা। মানুষ হাজার ব্যস্ত থাকলেও সেই ব্যস্ততার ফাঁকফোকর দিয়ে তার প্রিয় মানুষকে একটু হলেও ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করে যে সে কি করছে বা তার দিনটা কেমন যাচ্ছে?

একটা স্টাবলিস্ট প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে রাত দুটোর সময় তার প্রেমিকার সাথে কখন ফিসফিস করে কথা বলে জানো,

* যখন তার বিছানায় তার পাশে তার বউ শুয়ে থাকে। যদি বউ শুনে ফেলে তখন তো কেলেঙ্কারি বেধে যাবে।

তোমাদের তো এক বছরের সম্পর্ক। ওর পরিবার সম্পর্কে কি জানো আমাকে বল। কার সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়েছে আমাকে বল। তুমি চেনো তো ওর পরিবারের লোকজনকে? চেননা। অভি যদি তোমাকে সত্যি ভালোবাসতো অভি তার পরিবারকে নিয়ে এতদিনে একবার হলেও আমাদের বাড়ি চৌকাঠে আসতো। তোমাকে চাওয়ার জন্য। যেমন আহনাফ তার পরিবারকে নিয়ে এসেছে।

মায়ের কথায় আরিশা জমে পাথর হয়ে গেছে। সত্যিই তো অভির মুখে শুধু শুনেছি ওর পরিবারের কথা। তাছাড়া আমিতো তার পরিবার সম্পর্কে কিছু জানি না। শুধু এটুকু জানি ওর বোন রাজশাহী থাকে। কিন্তু পরিবারের বাকি সদস্যরা আর কোথায় থাকে কি করে কিচ্ছু বলেনি ও আমাকে।

অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট তুমি । আমি অনেক আগে থেকে তোমার সম্পর্কের ব্যাপারটা জানতাম। আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো ধরতে পারবি ব্যাপারটা।

কিন্তু না আমার মেয়েটা বুঝতে পারেনি। এটাই স্বাভাবিক কারণ একজন মানুষের সাথে সংসার করেও সারা জীবন তাকে বুঝতে পারা যায় না। সেখানে তো মাত্র এক বছরের তোমাদের সম্পর্ক।

কিন্তু মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় না।তোমার ওপর অভির দৃষ্টি কুলুষিত দূষণীয় ছিল।
আমি ঠিক বুঝে গিয়েছিলাম অভি তোমার জন্য উপযুক্ত নয়। আর কখনো হতেই পারেনা। কারণ আমার এই হীরের টুকরো মেয়ের জন্য কারোর ব্যবহৃত কোন কাঁচের টুকরো চাইনা, হীরের টুকরো ই চাই। আর তা আমি পেয়ে গেছি।

তাই আগামী শুক্রবার তোমাদের ঘরোয়াভাবে বিয়ে পরিয়ে রাখব বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এক সপ্তাহ গিয়ে ওই বাড়িতে থাকবে তুমি। সবার সাথে পরিচিত হবে। তারপরে আবার তুমি এই বাড়িতে ফিরে আসবে এবং তোমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করবে।

আরিশা তার মায়ের দিকে নিরব দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

তা দেখে আরিশার আম্মু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— জন্ম মৃত্যু বিয়ে সবই উপরওয়ালার হাতে রয়েছে। সঠিক সময়ে তোমার সামনে এসে হাজির হবে। তুমি চাইলেও এই তিনটে জিনিস ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই এত চিন্তাভাবনা না করে তুই তোর মত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আয়। আর যে ছেলেকে জীবন সঙ্গিনী হিসাবে পাচ্ছিস তুই, তাকে অনেক ভাগ্য করে পাওয়া যায়। তাই আর দ্বিমত করিস না।

আর চোখের পানি মুছে ফেল। ওই বেয়াদব টার জন্য তোর মূল্যবান জিনিস টা তুই নষ্ট করিস না। জমা রাখ নিজের কাছে। যেখানে গেলে এর যথাযথ মূল্য পাওয়া যায় সেখানে গিয়ে খরচ করিস। যার জন্য ফেলছিস সে মূল্যবান নয় অতি তুচ্ছ নগণ্য একটি কীটপতঙ্গ। ঘরে বউ থাকতে বাইরের মেয়েদের দিকে নজর দেয়। ছিহহহ….

ওই বেয়াদবটা আর ফোন ধরবে না। কারণ ও জানে আমি সব জেনে গেছি আর আমি তোকে সব বলে দেবো তাই ফোন বন্ধ করে রেখেছে। তোকে আর কখনো ফোন করবে না। কিন্তু তুই এখন আবেগের বশবর্তি হয়ে অনেক কিছু করতে পারিস

তাই এই এক সপ্তাহ তোর ফোন আমার কাছে থাকবে। আমি তোর স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছি না। তোকে ভালোবাসা আর মরীচিকার মধ্যে পার্থক্যটা বোঝাচ্ছি। আশা করি এ একসপ্তাহে তার প্রমাণ পেয়ে যাবি।

কথাগুলো বলে ফোনটা নিয়ে মেয়ের রুম ত্যাগ করলেন আরিসার আম্মু।

মা চলে যেতেই আরিশা ধুপ করে খাটের উপর বসে পরলো। এবং ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

— আমি মানুষ চিনতে এত বড় ভুল করলাম। এত বড় ভুল……….!

#চলবে…..🌼🌼

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে