ষাট সেকেন্ডে গল্প

1
3898
নীল চুড়ি ও একটি ঠিকানাবিহীন চিঠি। …………………………………………… তুমি শেষ দিনটিতে আমার কাছে সময় চেয়েছিলে।বিদায়ের সেই দিনটিতে আমার কাছে মাত্র কটা বছর চেয়েছিলে ।বলেছিলে আমি এই মুহূর্তে এক পলকেই যা পাচ্ছি তা তুমি এনে দিতে পারবে ,সত্যি পারবে।তুমি সেই সময়টাই চেয়েছিলে।অশ্রুসিক্ত তুমি তোমার উপর বিশ্বাস রাখতে বলেছিলে। আমি সময় দেইনি ,বিশ্বাস রাখিনি।আমার দুচোখে তখন ঝা চকচকে ভবিষ্যতের স্বপ্ন।আমার চারপাশের মানুষগুলোর সদুপদেশের মায়ায় আচ্ছন্ন আমি তোমায় সময় দেইনি।তুচ্ছ মানুষ মনে হয়েছিল তোমাকে তখন ।অথচ দেখ আজ আমি কতটা তুচ্ছ হয়ে আছি নিজের কাছে।
জানো শাফকাত সাহেব বৃষ্টিতে ভেজা পছন্দ করেন না। দামী গাড়ির কাচঁ খুলে হাওয়ায় চুল ওড়া তার অপছন্দ। রিকশায় হাতে হাত রেখে ঘোরা তার কাছে বিরক্তিকর , এক কাপে দুজনে চুমুক দিয়ে চা খাওয়াটা তার কাছে গা ঘিনঘিনে ব্যাপার। তার কাছে আমার সব কিছুই মিডলক্লাস সেন্টিমেন্ট।কিন্তু আমি তো সেই সময়টাতেই আটকে থাকি ইদানীং। ঝুম বৃষ্টিতে আমার শুধু তোমার কথাই মনে হয়। খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকালে আমি ভয়ে তোমার বুকে মিশে যেতাম।তুমি তাই সবসময়ই বৃষ্টির সময় বিদ্যুৎ ই চাইতে।জানো, আমি আজ একা একা বৃষ্টিতে ভিজি আর বিদ্যুৎ চমকালে আমি চিৎকার করে কাঁদি।আমার কান্নার শব্দ আড়াল করার জন্য যেন দ্বিগুণ শব্দে বিদ্যুৎ চমকায়। তোমার সব কিছুতেই নীল রং ভীষণ পছন্দ ছিল।একবার টিউশনির টাকা দিয়ে আমাকে নীল শাড়ি, নীল চুড়ি আর নীল টিপ কিনে দিলে।জন্মদিনে সেই শাড়ি পরা আমাকে দেখে কি বিমুগ্ধ তুমি।ফুল কেনার টাকা ছিলনা তোমার।ঝিল থেকে লাল শাপলা নিয়ে গুঁজে দিয়েছিলে আমার খোপায়।সব নীল কম্বিনেশন সাজে লাল শাপলা খ্যাত লাগছে বলে কি লজ্জা দিয়েছিলাম তোমাকে। আজ আমার খোপায় কত দামি ফুল কড়া পারফিউমের গন্ধে নিজের গন্ধ হারায়।অথচ ফেসবুকে দেখি তোমার বৌ সেই নীল কম্বিনেশনে খোপায় লাল শাপলা গুজে কি সুখী সুখী ছবি আপলোড দেয়।লাল শাপলার হালকা মিষ্টি গন্ধটার সাথে সে তোমার গন্ধে জড়িয়ে পরিপূর্ণ থাকে।আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সেই ছবি দেখি আর মাঝেমধ্যে সব ভুলে গিয়ে নিজেকে সেখানে বসিয়ে অশ্রুসিক্ত হই আবার বাস্তবে ফিরে এসে ভীষণ কষ্টে নীল হই বারবার। তুমি কি সেই সাজে আবার আমায় খোঁজো? কি জানি?
তুমি কটা বছর সময় চেয়েছিলে।আমি দেইনি।কিন্তু সময় তোমাকে সময় দিয়েছে, সব দিয়েছে।সেদিন এক পলকে আমি যা পেয়েছিলাম আজ তুমি সব পেয়েছ।আমি চিত্রপটে নেই শুধু।আমি নীল চুড়ি পড়তে পারিনা।আমার জীবন সেটা অনুমতি দেয়না। আমার হাতে সোনা,হীরার শিকল থাকে।সেগুলো শক্ত হয়ে এঁটে বসে থাকে।আমি তোমার আকাশে উড়তে চাই আবার..বারবার ।পারিনা। আমি কারও আকাশপথে আটকা পড়ে বিশ্ব ঘুরি। বিশাল রাজপ্রাসাদের রাজরাজেশ্বরী আমি। সব দিক থেকে কি সাকসেসফুল আমি…সবাই তাই বলে।সারাক্ষণ সুখী সুখী ভাব নিয়ে ঘোরা আমি নিজের ভিতর কতটা একা আমি।কতটা নিপাট ভালবাসার কাঙ্গাল আমি।আমার ভীষণ শুন্যতা তুমি আবার আমার শুন্যতা উপশমের দাওয়াও তুমি। কি অদ্ভুত না।তোমার অদৃশ্য এক অধিকার এখনও রয়ে গেছে আমার মাঝে। এই চিঠিটার প্রত্যেকটি লাইন আমার মুখস্থ।প্রায়ই একই চিঠি লিখি।কখনও ছিঁড়ে ফেলি, কখনও পুড়িয়ে ফেলি কখনও বা বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দেই আদরের ডিঙ্গা বানিয়ে।তোমার দেয়া ফাউন্টেন পেনে লেখা চিঠির কালিগুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যায় কিন্তু আমার কষ্টগুলো ধুয়ে যায়না আরও চেপে বসে। গভীর রাতে রাজপ্রাসাদের বারান্দায় দাড়িয়ে তোমার কথা ভেবে দিশাহারা হই।তুমি কি ভীষণ অসহায় হয়ে কেঁদেছিলে বিদায় বেলায় অথচ আমি ঘুরেও তাকাইনি সেটা ভেবে আমি অসহায় হই আজ। তুমি আমায় অভিশাপ দাওনি কিন্তু আমি শাপিত হয়েছি নিজের শাপে।তোমায় শ্রদ্ধা করি।হয়তো তোমায় পেলে জীবনের টানাপোড়নে এই শ্রদ্ধাটুকু নাও থাকতে পারতো।সবসময় যেরকম ভালোবেসেছি সেটা নাও থাকতে পারতো।এই স্বান্তনা নিয়ে বেঁচে থাকি।তুমি ভালো থেকো।খুব ভালো থেকো। …….নীল চুড়ি হাতে পড়া শাম্মা আবারও চিঠিটা ছিঁড়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল।কিছু কিছু চিঠির কখনোই কোন ঠিকানা থাকেনা।থাকতে হয়না। মিশা মালিহা মিমু

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে