ভালো লাগে ভালোবাসতে-পর্ব ১১

2
2019

তত
#ভালো লাগে ভালোবাসতে
#পর্ব-১১
Writer:ইশরাত জাহান সুপ্তি

সন্দেহপ্রবণ স্ত্রীর যাবতীয় গুণ আমার মাথার কোন ফোকর দিয়ে প্রবেশ করলো ব্যাপারটা ভাবনার বিষয়।এখন আমি কি শুধু ভাববো না সন্দেহ করবো এই কনফিউশনও আমাকে আরেক ভাবনায় ফেলে দিল।ইদানিং আমি খুবই সন্দেহে ভুগছি।নিদ্র আনমনে একটু মুচকি হাসলো তো আমার সন্দেহ হয়,ল্যাপটপে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলো তো আমার সন্দেহ হয়।এই সন্দেহের পোকা তা দেখি ভালো ভাবেই আমার মাথায় নিজের রাজত্ব বিস্তার করে চলেছে!
একে দ্রুতই কীটনাশক দিয়ে বিলুপ্ত করতে হবে।কিন্তু কিভাবে?নিজের কাছে ভাবতেও অবাক লাগছে যে আমি কিনা মনে মনে একশবার ঐ মেয়ের পায়ে ধরে রাজী হবার জন্য আকুতি মিনতি করেছি সেই আমিই কিনা এখন সেই মেয়ের রাজী হয়ে যাওয়া নিয়ে ভয়ে মরছি।ইদানিং নিদ্র বেশিই ল্যাপটপটা টিপাটিপি করে আর মুচকি মুচকি হাসে।একটু যে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবো তারও কোনো উপায় নেই লক দিয়ে রাখা।কই আগে তো কখনও দেয়নি।এখন আমার বেশ ভয় হচ্ছে ঐ মেয়ের সাথে তার প্রেম গড়ে উঠেনি তো!হুট করে নবীন প্রেম যুগল আমার সামনে এসে বলবে না তো ‘আমি আমার ইচ্ছেকন্যাকে পেয়ে গেছি ইচ্ছে পূরণ করার জন্য।’তুমি এবার ফুটো তোমার কাজ শেষ।’

ব্লাক শার্টের উপর ব্লু ব্লেজার স্যুট পড়ে নিদ্র তার ঘন কালো চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।আবার পারফিউমও লাগাচ্ছে।এত পারফিউম লাগানোর কি দরকার আর এত ফিটফাট হয়েই বা অফিসের যাওয়ার কি!সে অফিসে কাজ করতে যাচ্ছে নাকি অডিশন দিতে যাচ্ছে।তাকে যে কি পরিমাণ সুন্দর লাগছে সেদিকে কি তার কোনো খেয়াল আছে!
আচ্ছা ঐ মেয়েটার সাথে আবার দেখা করতে যাচ্ছে না তো?

-‘আজকে ভার্সিটি আওয়ারের পর আমি তোমাকে পিক করতে আসবো।হসপিটালে যেতে হবে।

-‘হসপিটালে কেন যাবো?ঐ মেয়ে কি ডাক্তার?

আমার হঠাৎ উদ্বিগ্ন গলায় চেঁচিয়ে বলা কথা শুনে নিদ্র হাতে ঘড়ির বেল্ট লাগানো বন্ধ করে ভ্রু ভাঁজ করে বলল,’কোন মেয়ে ডাক্তার?কি বলছো?’

নিজের উদ্ভট কথার ধরণ বুঝতে পেরে আমি হকচকিয়ে বললাম,’না না কিছু না,আমি বলছিলাম যে হাসপাতালে কেন যাবো?’

-‘কদিন ধরে যে বলছো তোমার মাথা ব্যাথা হচ্ছে তার জন্য একটি চেকআপ করাতে?’

-‘আরে ওটা তো এমনিই মাইগ্রেনের সমস্যা।আমার ছোটোবেলা থেকেই আছে।এর জন্য আবার ডাক্তার দেখানোর কি দরকার।’

-‘যা বলছি শুনো।এতো কথা বলো না।’

-‘কিন্তু আজকে আমি যেতে পারবো না।আমার এক্সট্রা ক্লাস আছে।’

নিদ্র ল্যাপটপটা অফিস ব্যাগে ভরে যেতে যেতে বলল,’ওকে,তবে কালকে যাবো।’

নিদ্র চলে গেলে পাশ থেকে কুশন টা কোলের উপর উঠিয়ে আমি একরাশ বিরক্তিতে মুখ ফুলিয়ে রইলাম।হসপিটালে যেতে আমার একদম ভালো লাগে না।নিদ্র যে এমন করে না!একটু কিছু থেকে কিছু হলেই ডাক্তার ডাকো,হসপিটালে চলো।মুখে বিরবির করে বললাম,ভালো লাগে না।

এর মাঝে রহিমা খালা একটি লাল বালতি আর ন্যাকরা নিয়ে এসে সরাসরি ফ্লোর মুছতে মুছতে বলল,’কি ভাল লাগে না ভাবী সাব?’

মধ্যবয়স্কের রহিমা খালাকে আমরা খালা বলে ডাকলেও সে ছেলে মানেই ভাইজান আর মেয়ে মানেই সবাইকে ভাবী সাব বলে ডাকবে।এদিক দিয়ে মাকে যেমন ভাবী সাব বলে ডাকে আবার আমাকেও ভাবী সাব বলে ডাকবে।
আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রহিমা খালাকে বললাম,’কিছু না।’
নাহ্!এত ইনসিকিউরিটি নিয়ে থাকা যায় না।কি করে জানবো ঐ মেয়ে রাজী হয়ে গেল কিনা?
সামনে তাকিয়ে দেখি রহিমা খালা একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে ঘষে ঘষে ফ্লোর পরিষ্কার করছে।যেন ঐ মেঝে তার পরম শত্রু, এর পিঠের ছাল তুলতে না পারলে রহিমা খালার আজ নিস্তার নেই।
কথায় আছে ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে।এই মুহুর্তে আমার রহিমা খালাকে মনে হচ্ছে একজন জ্ঞানী খড়কুটো।এই পরিস্থিতি বিষয়ে রহিমা খালার থেকে একটু বুদ্ধি নিলে মন্দ হয় না।রহিমা খালা ফ্লোর মুছতে মুছতে আমার কাছেই এসে পড়েছে,আমি সোফার উপর দুই পা তুলে গুটিশুটি মেরে একটু ঝেড়ে কেশে বললাম,

-‘আচ্ছা,রহিমা খালা ধরো একটির মেয়ের স্বামী বিয়ের আগে অন্য একটা মেয়েকে পছন্দ করতো..ঐ মেয়েটা তখন মানে নাই…তারপর…তারপর ঐ ছেলেটা ঐ মেয়েকে বিয়ে করে কিন্তু তাদের বিয়েটাও একটু অন্যরকম ভাবে হয়েছে তারপর এখন আবার আগের মেয়েটা রাজী হয়ে গেছে এখন তাহলে ঐ মেয়েটা মানে ছেলেটার স্ত্রী এখন কি করবে?’

আমি আমার অগোছালো ভাঙা কথাগুলো কোনোমতে প্রকাশ করে রহিমা খালার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।তাকে বোঝাতে পারলাম কিনা কে জানে!
রহিমা খালা তার শত্রুর পিঠের ছাল তোলা বন্ধ করে বিজ্ঞের মত গভীর দৃষ্টিতে আমার কথা শুনে যাচ্ছে।আমার কথা শেষ হলে সে তার বাজখাঁই গলায় বলল,’কোন মাইয়ার কথা কইতাছেন ভাবী সাব?’

-‘আহা খালা!কোন মাইয়া সেটা জানতে হবে না,তোমাকে ধরতে বলছি ধরো।’

ভাবীসাব ঐ মাইয়াডা এহন কি আর করবো ওর জামাইরে আটকায় রাখবো।’
আমি বিমর্ষ গলায় বললাম,’তুমি বুঝতে পারছো না খালা,তাদের বিয়েটা তো একটু অন্যরকম….

খালা আমাকে মাঝ পথে থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,’আমি ওতো বুঝি বা ভাবী সাব,আমার সোয়ামী যদি এমন করত তাইলে আমি আমার সোয়ামীরে তো আটকাইতামই,সাথে ঐ শাকচুন্নিরেও ঝাটা পিটাইয়া খেদাইতাম।বিয়া এমনে হোক আর ওমনে,বিয়া তো বিয়াই।এইডা কি পুতুল খেলা।আমি থাকতে আমার সোয়ামী অন্য মাইয়ার কাছে যাইবো কেন!আমি হের বিয়া করা বউ।’

গম্ভীর গলায় কথাটা বলেই রহিমা খালা আবার তার শত্রুর পিঠের ছাল তোলায় মনোযোগ দিলেন।তার কথায় আমি বিষ্ময়ে হতবাক।
এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে তার হাত থেকে এই ঘর মোছার ন্যাকড়া ফেলে দিয়ে তাকে কোনো প্রফেসরের চেয়ারে বসিয়ে দেই।কি সুন্দর কথাটাই না বললেন!
সত্যিই তো আমি কেনো তাদের মাঝে থেকে সরে যাবো।আমি নিদ্রর বিয়ে করা বউ।বিয়েটা কি ছেলেখেলা নাকি!আমাকে বিয়ে করার আগে নিদ্রর ভাবা উচিত ছিল।এখন বিয়ে যখন করেছে তাই আমিও আর নিদ্রকে ছাড়ছি না।আর ঐ শাকচুন্নিকেও কিছুতেই ফিরে আসতে দিব না।কিছুতেই না….

খুব সুন্দর একটি লাল রঙের শাড়ি পড়ে আমি বেরিয়েছি নিদ্রর অফিসের উদ্দেশ্য।আজ একটু সাজগোজও করেছি।উদ্দেশ্য নিদ্রকে চমকে দেওয়া।ড্রাইভার আঙ্কেলের ডাকে আমি বাইরে তাকিয়ে দেখলাম অফিসে চলে এসেছি।বিশাল বড় অফিস।রিসিপশনিস্ট মোয়েটির কাছে জেনে নিলাম নিদ্রর কেবিন কোনটা।কেবিনের দরজা খুলতেই দেখলাম,একটি অতি সুন্দরী মেয়ে নিদ্রকে পুলি পিঠা অফার করছে আর বলছে আমি নিজের হাতে বানিয়েছি।ন্যাকা!
মেয়েটি নিদ্রর পি.এ। আমি বুঝি না অফিসের পি.এ কি সবসময় সুন্দরী মেয়েরাই হয়!
আচ্ছা এই মেয়েটাই যদি নিদ্রর পছন্দ করা মেয়েটা হয়!
আমি আশঙ্কাজনক ঢোক গিলে দ্রুত বেগে ছুটে নিদ্রর পিঠা ছোঁয়ার আগেই ওর সামনে গিয়ে আমি পিঠা হাতে নিয়ে নিলাম।আর তাড়াতাড়ি খেতে খেতে একটু বিব্রতকর হাসি দিয়ে বললাম,
‘আমার পুলি পিঠা খুব পছন্দ।’
এরপর পুরো টিফিন বক্সটাই হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।
আমার এই অদ্ভুত কর্মকান্ডে পিছনে নিদ্র ভ্রু কুঁচকে আর সামনে পি.এ সুন্দরী হা করে রয়েছে।
আমি আরেকটু টেনে হাসি দিয়ে বললাম,
‘পিঠাটা মোটামুটি ভালোই হয়েছে।নেক্সট টাইমও আমাকেই দেবেন,আপনার স্যার পিঠা খায় না।’

মেয়েটি হতবিহ্বল হয়ে ঘাড় নাড়িয়ে চলে গেল।আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে পিছনে ঘুরতে গিয়ে নিদ্রর বুকে মৃদু্ ধাক্কা খেলাম।আমি এক পা পিছনে গেলে নিদ্র দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে ভ্রু ভাঁজ করে বলল,
-‘তোমাকে কে বলেছে আমি পিঠা খাই না?’
আমি একটু চোরের ভঙ্গিতে হেসে বললাম,’আপনাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল।’
সে পিছনে ঘুরে টেবিলে থাকা ফাইলগুলো একত্রিত করতে করতে আফসোসের সুরে বলল,’হায় রে আমার কপাল!অন্যের বউরা অফিসে আসে স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে আর আমার বউ অফিসে এসে তার স্বামীর খাবার খেয়ে ফেলে!
তার কথায় আমারও নিজের গালে একটা চড় মারতে ইচ্ছা করলো।চড় না মারলেও অন্তত একটা গালি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,সত্যিই তো কিছু একটা বানিয়ে নিয়ে আসতাম নিদ্রর জন্য নিজের হাতে।নিদ্র টিফিন বক্সের ঢাকনাটা খুলে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত।আমি একটু একটু মুচকি হেসে মাথা নিচু করে লাজুক ভঙ্গিতে বলতাম,’আমি নিজের হাতে বানিয়েছি।’
নিদ্রও আমার প্রতি মুগ্ধ হয়ে মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করত।ব্যপারটা কতটা রোমান্টিক হতো!

নিদ্র আমায় মাথায় একটা টোকা দিয়ে আমাকে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনলো তারপর স্বভাবমতই ভ্রু কুঁচকে বলল,’আজকে এমন নতুন বউ সেজে আসা!ব্যাপার কি?’
আমি বিরবির করে বললাম,’আমি তো নতুন
বউ-ই।’
-‘কি?
-‘না কিছু না।আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?’
সে ফাইলের থেকে মুখ না তুলেই বলল,’যেমন তুমি দেখতে তেমনই।’
আমি এত সুন্দর করে সেজে এসেছি আর তার এমন ঠিক মতো না দেখেই ঠান্ডা মার্কা কথা শুনে আমার মেজাজটাই চঙ্গে উঠে গেল।এই সুন্দর মানুষরা কি একটু অন্যের প্রশংসাও করতে পারে না।
আমি রাগ চেপে বললাম,’ভালোই লাগছি দেখতে।আমি নিজের প্রশংসা নিজেই করতে পারি।আমি তো আপনার মতো আর ধলা লম্বুশ না যে প্রশংসা করতেও মুখ ব্যাথা করবে।’

এবার সে ফাইল থেকে মুখ তুলে বলল,’তুমি আমাকে কি বললে! আমি ধলা লম্বুশ?
এর জন্যই বলি তুমি বাংলা ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট হয়েও শব্দের সঠিক ব্যবহার করতে পারো না,এটাকে বলতে হয় টল,হট,হ্যান্ডসাম।তোমার কোনো আইডিয়া আছে কতগুলো মেয়ে আমার জন্য পাগল হয়ে আছে?’

তার শেষোক্ত কথাটুকুতে আমার প্রাণপাখি পাখা ঝাপটানো শুরু করে দিল।সুন্দর ছেলে বিয়ে করার জ্বালা এবার আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।একারণেই বলতাম সুন্দর ছেলে বিয়ে করবো না।কিন্তু কপালে জুটলো তো জুটলো শুধু সুন্দর না চরম সুন্দর!এখন ভুগো!
এতগুলো মেয়ের মাঝে সে কোন মেয়ের জন্য পাগল তা আমি জানবো কিভাবে!

আচমকা কিছু মনে পড়ার ন্যায় সে বলল,
-‘সুপ্তি তুমি আজকে ভার্সিটি যাওনি।আমাকে যে বললে তোমার এক্সট্রা ক্লাস আছে আজ হসপিটালে যেতে পারবে না।তার মানে মিথ্যা বলেছো?

আমি রেগে মুখ ফুলিয়ে বললাম,বেশ করেছি মিথ্যা বলেছি।আরো একশবার বলবো।আমাকে নিয়ে আপনার কিছু বলতে হবে না।আপনি আপনার পিছনে পাগল মেয়েদের নিয়ে ভাবুন।’

কথাটি বলে দুমদাম করে ভাব নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু আর ভাব নিতে পারলাম কই!
শাড়ির সাথে পা পিছলে পিছনে সোজা নিদ্রর উপরে পড়লাম।আবার ঠিক হয়ে হাঁটা দিতে যাবো বলে সামনে আগাতেই চুলে টান পড়ল।আমি আহ বলে চোখ ঘুরিয়ে বুঝতে পারলাম তার শার্টের বোতামে আমার চুল আঁটকে গেছে।আজকেই শ্যাম্পু করেছিলাম,চুলগুলো এখন বেজায় সিল্কি হয়ে পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে।এদেরকে থামানো যে এখন মুশকিল।নিজে নিজেই চুল ছাড়ানোর মহা চেষ্টা করলাম কিন্তু পিছন দিক থেকে উল্টা হওয়ায় পারলাম না।এদিকে নিদ্র মহাশয় নির্বিকার ভঙ্গিতে টেবিলের সাথে দু হাত ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মুখে শিস বাজিয়ে যাচ্ছে।তার সামনে তার বুক সমান লম্বা একটি অসহায় মেয়ে যে তার কালো সুগন্ধি কেশ নিয়ে আটকা পড়েছে এদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই।

আমি বিরক্তি ছাপিয়ে বললাম,’একটু ছাড়িয়ে দিচ্ছেন না কেনো?চোখে দেখছেন না নাকি!’

সে মারাত্মক ডেম কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,’কেনো তুমিই তো বলেছো তোমাকে নিয়ে আমাকে কিছু না ভাবতে,তাই তো কিছু করছি না।আমাকে ডিস্টার্ব করো না তো,আমি এখন আমার পেছনে পাগল মেয়েদের নিয়ে ভাবছি।’

তার মুখে আবারো মেয়েদের কথা শুনে আমি রেগে বসলাম।কিছু মুহুর্ত সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম।ভাবলাম সে নিজেই বিরক্ত হয়ে ছাড়িয়ে দেবে।কিন্তু এখন দেখি তার মধ্যে কোনো ভাবান্তরই নেই।তার আগের ভাবটাই বিরাজমান।নিদ্রর পুরো কেবিন গ্লাসের হওয়ায় বাইরে থেকে সবকিছু আবছা দেখা যায়।এদিকে আমাদের দুজনকে এভাবে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাইরে স্টাফরা মুখ টিপে মুচকি মুচকি হাসছে যা আমার চোখ এড়ালো না।
আমি লজ্জায় চোখ মুখ লাল করে নরম গলায় বললাম,প্লিজ ছাড়িয়ে দিন না।আমি কি এভাবে সারাজীবন দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি!

-‘থাকলে থাকতে পারো।আই অন্ট মাইন্ড।’

-‘বাইরে সবাই দেখে হাসছে আপনার কি একটুও লজ্জা শরম নেই?’

-‘নাহ্!আমার ওতো লজ্জা শরম নেই।’

-‘পরিস্থিতির কোনো গতিবেগ না পেয়ে আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগলাম,’প্লিজ চুল ছাড়িয়ে দিন।আর কখনো ওভাবে কথা বলবো না।’

এবার বোধহয় তার একটু মায়া হলো,আলতো হাতে তার শার্টের বোতাম থেকে আমার চুল ছাড়িয়ে দিল।আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
একটু গলা কেশে বললাম,’দেখুন,এখন থেকে কোন মেয়ে কিছু দিলে আপনি খাবেন না।’

নিদ্র আমার দিকে একটু ঝুঁকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,’কেনো?কোনো মেয়ের হাতের কিছু খেলে তোমার কি?’
আমি একটু ঢোক গিলে তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে কাঁচুমাচু গলায় বললাম,’আমার আবার কি?’

-‘তাহলে আমিও খাবো।’

আমি আবারো রাগ করে বললাম,-‘না,আপনি খাবেন না।’

-‘আর যদি খাই।তবে?’

আমি কোনো প্রতিউত্তর খুঁজে না পেয়ে উত্তর হাতরাতে হাতরাতে শেষমেষ বললাম,’তবে…তবে আমি এখন এখানে চিৎকার দিব।’
কথাটা বলে চিৎকার দিতে উদ্যত হলেই নিদ্র দ্রুতবেগে আমার মুখ চেপে ধরে বলল,’তোমার মাথার তার কি আজকে ছিঁড়ে গেছে?’

এই বলে নিদ্র আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেল।অফিসের সবকয়টা সুন্দরী মেয়েগুলো চোখ গোলগোল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।সবার সামনে নিদ্রর আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ায় আমি তো মহা খুশি।এতটুকু প্রায়োরিটিতেই যেন আমি খুশির প্লাবনে ভেসে গেলাম।

নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি বরাবরই মানুষের টান বেশি থাকে।আমার জন্য এখন রান্নাঘর নিষিদ্ধ জেনেও এই মুহুর্তে রান্নাঘরের প্রতি আমার প্রচুর ঝোঁক বেড়ে গেছে।মাথায় হাত খোপা করে রান্নাঘরের কড়াই,খুন্তি নাড়িয়ে চারিয়ে কঠিন মনোযোগ নিয়ে আমি খিচুড়ি রান্না করছি,নিদ্রর জন্য।অফিসে খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতে না পারায় বাসায় সেই ক্ষতিপূরণের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।আর বর্ষার রাতে খিচুড়ির চেয়ে শ্রেষ্ঠ খাবার কিছু হতেই পারে না।খিচুড়ি প্রায় শেষের দিকেই।উত্তেজনায় আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি।বারবার চেক করছি সবকিছু ঠিকঠাক মতো দিলাম কিনা।কি সুন্দর সুঘ্রাণ বেরিয়েছে!
আমি এখনো চেখে দেখিনি।সবাই আগে খাবে তারপরই আমি খাবো।যদিও কৌতুহল বারবার উপচে পড়ছে কেমন হয়েছে জানার জন্য।স্নিগ্ধ টেবিলে বসে বসে প্লেট নাড়াচাড়া করছে।আমার রান্নার জন্যই আজকে সবার খাওয়ায় একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় নিদ্র নিচে এসে রান্নাঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বলল,’আজকে এটা কে রান্না করছে?খেতে পারবো তো!’
আমি একটা ভেংচি কেটে পড়নের লাল পেড়ে অ্যাশ রঙের সুতি শাড়ীর আচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলাম।তারপর গ্যাস বন্ধ করে খিচুড়ি নামানোয় মনোযোগ দিলাম।
খিচুড়ি রান্না করতে গিয়ে তেলের ছিটেয় হাতটাও খানিক পুড়ে ফেলেছি।সেই হাত সামলিয়েই
গরম গরম খিচুড়ি সবাইকে নিজ হাতে বেড়ে দিলাম।মা আমাকেও বসতে বলল কিন্তু আমি পরে খাবো বললাম।
খিচুড়ির প্রশংসা সবাই করলো কিন্তু আমার দুটি কর্ণ যার শ্রবনের অপেক্ষায় আছে সে নিশ্চুপ।চুপচাপ মাথা নিচু করে শুধু খেয়ে যাচ্ছে।আমি বারবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখ তুলে তাকাবার অপেক্ষা করতে লাগলাম কিন্তু তার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।একসময় খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেল।আমার চোখ ছলছল করে উঠল।মা আমাকে এবার খেতে বলল,’আমি চলে আসলাম।খিদেটাই যে মরে গেল!

একটু আগে বৃষ্টি হলেও এখন মেঘ সরিয়ে আকাশে চাঁদ উঁকি দিয়েছে।একগুচ্ছ চাঁদের আলোর চারিপাশে তবুও মেঘের ছড়াছড়ি।গম্ভীর আকাশের মুখে যেন চাঁদ এঁকে দিতে চাইছে এক চিলতে হাসি।আকাশের বিষন্নতা কাটানোর জন্য তবুও তো চাঁদ আছে কিন্তু আমার বিষন্নতা কাটবে কি করে।একরাশ বিষন্নতা যে আমায় জেঁকে ধরেছে।
একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে রেলিংয়ে রাখা হাতের উপর দৃষ্টি দিতেই চোখে পড়ল একটি সুন্দর হাত আমার হাতের উপর তার স্পর্শ এঁকে দিল।হাত থেকে চোখ উঠে মুখের দিকে চলে যেতেই এই আবছা অন্ধকারেও বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা নিদ্র।
ঠিক সেই সময়েই আমার হাত খোপাটাও খুলে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে গেলে।যেন সেখানে আগে থেকেই কঠিন বন্দোবস্ত করে রাখা নিদ্র এলেই তাকে বাঁধন ছেড়ে উন্মুক্ত হতে হবে।
আমার হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আলতো স্পর্শে পোড়া স্থানে মলম লাগিয়ে দিতে লাগল।কিছুক্ষণ একরাশ নিস্তব্ধতা কাটিয়ে হাত ছেড়ে বলে উঠল,
-‘আমার মন পুড়িয়ে পেটকে শান্তি দিতে চাই না,বুঝেছো!’
কেন যেন মনে হল তার চেহারায় এই মুহুর্তে এক অদ্ভুত আবেগ খেলা করছে।যা এই আবছা আলোয় এই মুহুর্তে আমি ধরতে পারছি না।

আমি কিছু বলতে যাবো কিন্তু তার আগেই হাতের উপর একগুচ্ছ কদম ফুল রেখে তিনি বলে উঠলেন,’বর্ষায় রমণীর হাতর খিচুড়ির চাইতেও তার হাতে একগুচ্ছ কদমফুল দেখতেই যে আমি বেশি ভালোবাসি।’

কথাটি বলে বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে তিনি নেমে যেতে লাগলেন।বাইরে আবারো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই তিনি বাগানে মেশানো রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।চাঁদকে ঢেকে মেঘেরা আবারো পুরো আকাশে নিজেদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছে।বর্ষার আকাশের হাব ভাবের কোনো ঠিক নেই যেমনটি ইদানিং আমার মনের।

চলবে,

2 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে