হৃদয়ের একূল ওকূল পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

1
561

#হৃদয়ের_একূল_ওকূল (৩) শেষ পর্ব
*****************************
রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা সম্ভব না, তা-ও আবার প্রেমের কথা। তার ওপর মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। কী বলতে, কী বলব ঠিক নেই। পরে দেখা যাবে, শুরুর আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। জিনিয়াকে বললাম, ‘কালকে তোমার সময় হবে?’

‘কখন?’

‘যে কোনও সময়। যখন তোমার সুবিধা হয়, তখনই দেখা করতে চাই।’

জিনিয়া চিন্তা করে বলল, ‘আমার ক্লাস শেষ হবে বারোটায়। তারপর দেখা করতে পারব।’

‘ঠিক আছে, আমি তোমার ভার্সিটির কাছে থাকব। তুমি বের হয়ে আমাকে ফোন কোরো।’

‘ঠিক আছে। আমি এখন যাই।’

‘আচ্ছা। কালকে দেখা হচ্ছে কিন্তু। মিস করো না যেন। আমার কিছু জরুরি কথা বলার আছে।’

‘না, মিস করব না। আপনি সময়মতো চলে আসবেন। যাই এখন।’

‘আমি আসব তোমার সঙ্গে?’

‘কোথায় আসবেন?’

‘বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিই?’

জিনিয়া ওর ভুবন ভোলানো হাসিটা দিল। যে হাসি দেখলে, আমি বারবার এলোমেলো হয়ে পড়ি। হেসে বলল, ‘আপনার আসতে হবে না। এই পথ আমার সারাজীবনের চেনা। আমি যেতে পারব।’

‘আমি সেজন্য বলিনি।’

‘কাল দেখা হচ্ছে। বাই।’

কথাটা বলেই জিনিয়া উলটো দিকে ফিরে হাঁটা দিল। আমি ততক্ষণ তাকিয়ে রইলাম, যতক্ষণ ওকে দেখা যায়। এরপর বাসায় ঢুকলাম। বাসায় যে, যার কাজে ব্যস্ত। বড়ো ভাই আর বাবা, টিভিতে খেলা দেখছে। মা আর ছোটো ভাবী রাতের খাবারের জোগাড়ে রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। বাকিরা হয়ত তাদের রুমে আছে। আমি সোজা নিজের রুমে চলে আসলাম। মাথাটা কাজ করছে না। আমি বাইরে চলে যাওয়ার জন্য মোটামুটি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছি। এরমধ্যে জিনিয়া এসে, সব গুবলেট করে দিল। আমি কী করব? বাবাকে গিয়ে বলব, আমি বিদেশ যেতে পারব না? বাবা কী কথাটা সহজভাবে নেবেন? বাবা হয়ত কিছু বলবেন না অথবা হালকা-পাতলা বকাঝকা করবেন; কিন্তু অন্যদের কথার জ্বালায় আমার এই বাড়িতে টেকা মুশকিল হয়ে পড়বে। আবার যদি বাধ্য ছেলের মতো ফ্রান্সে চলে যাই, আমি জিনিয়াকে হারিয়ে ফেলব। এত দীর্ঘ অপেক্ষার পর, জিনিয়া আজ হ্যাঁ বলেছে। শুধুমাত্র বিদেশ যেতে হবে দেখে, আমি জিনিয়াকে হারিয়ে ফেলব? অসম্ভব, জিনিয়াকে আমি হারাতে পারব না। মনে মনে কথা গুছিয়ে নিলাম। একবার ভাবলাম, বাবাকে আমার রুমে ডেকে এনে, সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিই। আবার মনে হলো, বড়ো ভাইয়ের সামনে বলাই ভালো হবে। যা হওয়ার, এখনই হয়ে যাক।

রুমের বাইরে এসে হঠাৎ মনে হলো, বাবার যে এতগুলো টাকা খরচ হলো, সেটা আমি ভুলে যাচ্ছি কেন? আমি না গেলে তো পুরো টাকাটাই নষ্ট হবে। টাকা তো আর ফেরত আসবে না। বাবার এত কষ্টে জমানো টাকা আমি এভাবে নষ্ট করে ফেলব? মাকে আগেই বলেছিলাম, আমাকে কিছু টাকা দিলে, আমি ব্যবসা শুরু করতাম। মা যদি আমার কথাটা শুনতেন, তাহলে আজ এই জটিলতায় পড়তে হতো না। মা’র ওপর প্রচন্ড অভিমানে চোখে পানি চলে এল। রুমে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে মাথার ওপর বালিশ চাপা দিয়ে রাখলাম। আমার এখন কোনোকিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না। ভেবে তো কোনোকিছুরই কূল-কিনারা করতে পারছি না। বালিশটাকে চেপে ধরে, সবকিছু থেকে নিজের আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।

—————————-

আমি বারোটা বাজার বেশ আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। ঠিক বারোটায় জিনিয়া ফোন দিল। এর পাঁচ মিনিট পরই ওকে ভার্সিটির গেট দিয়ে বেরোতে দেখলাম। জিনিয়াকে লাল-কালো রঙের ড্রেসটায় অসম্ভব সুন্দর লাগছে। আমার অবশ্য ওকে সবসময়ই সুন্দর লাগে। জিনিয়া কাছে আসতেই হার্টবিট বেড়ে গেল। জীবনে আজকে প্রথমবার কোনও মেয়ের সঙ্গে এভাবে দেখা করতে এসেছি। এতক্ষণ বুঝিনি; কিন্তু জিনিয়া কাছাকাছি আসতেই বুঝলাম, আমার ভীষণ নার্ভাস লাগছে।

জিনিয়া আমার সামনে এসে বলল, ‘আপনাকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে।’

সত্যি কী হ্যান্ডসাম লাগছে? কাল রাত থেকে আসার আগ পর্যন্ত শুধু চিন্তাই করে গেছি, আজকে আমি কী পরব? পাঞ্জাবি নাকি শার্ট? কতবার যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি আর শার্ট নিয়ে ট্রায়াল দিয়েছি, তার কোনও হিসেব নেই। শেষমেশ শার্ট পরেই আসলাম। মনে হচ্ছিল, পাঞ্জাবি পরলে, একটু বেশি বেশি হয়ে যাবে।

জিনিয়া বলল, কোথায় যাওয়া যায়, বলেন তো?’

‘তুমি যেখানে যেতে চাও, আমরা সেখানেই যাব।’

‘রাস্তার ওপারে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, ওখানে বসা যায়।’

জিনিয়াকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকলাম। ভার্সিটির সামনে অবস্থান হওয়ায়, রেস্টুরেন্টটা বোধহয় সবসময়ই জমজমাট থাকে। জমজমাট হলেও, একেবারেই কোলাহলবিহীন। সবাই নীচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। একটা টেবিল খালি পেতেই, আমরা ওখানে গিয়ে বসলাম। জিনিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনার কী নার্ভাস লাগছে।’

‘কেন?’

‘সেটা তো আপনি ভালো বলতে পারবেন। কোনোকিছু নিয়ে কী টেনশনে আছেন?’

‘না তো।’

‘আপনি জরুরি কথা বলতে চেয়েছিলেন। কোনও সমস্যা?’

”হুম, অনেক বড়ো সমস্যা।’

জিনিয়া চোখ বড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে হয়ত সমস্যাটা বুঝতে চেষ্টা করছে। ওর তাকানো দেখে আমার এত মন খারাপ হচ্ছে, কী বলব! যখন আমি তার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম, তখনই সে আমার কাছে এল! যদিও এখানে আসার আগ পর্যন্ত কী কী বলব, সেই কথাগুলো গুছিয়ে রেখেছিলাম; কিন্তু জিনিয়ার মুখোমুখি বসে, সব কথা গুলিয়ে যাচ্ছে। কোনটা আগে, কোনটা পরে বলব বুঝতে না পেরে শেষে বলে ফেললাম, ‘জিনিয়া, আমি চলে যাচ্ছি।’

জিনিয়া অবাক হয়ে বলল, ‘এখানে বসতে সমস্যা হচ্ছে? অন্য কোথাও বসবেন?’

‘না, না। সেটা বলিনি। আমি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি।’

‘দেশের বাইরে মানে? কোথায় যাচ্ছেন?’

‘ফ্রান্সে।’

‘ফ্রান্সে? ওখানে কেন?’

‘এখানে চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করলাম, কিছুই হলো না। তুমি তো জানোই আমাদের দেশের চাকরির অবস্থা।’

‘আপনি সত্যি যাচ্ছেন?’

‘হুম।’

‘অন্য কিছু করতে পারতেন।’

‘অন্য কিছুও করতে পারলাম কই? বাসা থেকে পারমিশন দিল না।’

‘আপনার চলে যাওয়া কী ফাইনাল হয়ে গেছে?’

‘হুম। টিকিট কাটা হয়ে গেছে।’

এরপর কিছুক্ষণ কেউ, কোনও কথা বলতে পারলাম না। জিনিয়া হয়ত এমন কিছু শোনার আশা করেনি। আমি বললাম, ‘মাসের শেষে চলে যেতে হবে।’

জিনিয়া বলল, ‘তাহলে?’

আমি নিজেই তো জানি না, তাহলে এখন কী হবে। আমি জিনিয়াকে কী উত্তর দেবো? জিনিয়া বলল, ‘সত্যি যাচ্ছেন?’

‘হুম। জিনিয়া, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?’

‘মনে হচ্ছে আপনি মজা করছেন।’

‘এটা মজা হলে, আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। একটা কথা বলব?’

‘কী?’

‘তুমি এতটা সময় নিলে কেন? যদি আর কিছুদিন আগে তুমি এই কথাটা বলতে, তাহলে আমি কিছুতেই বাইরে যেতাম না। কিছুতেই না।’

‘আমি আপনাকে বলেছি। আমি নিজেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার জন্য ভীষণ কঠিন কাজ ছিল।’

জিনিয়াকে কথাটা বলা ঠিক হবে কি না, জানি না; কিন্তু তবুও কথাটা বলে ফেললাম। এত অপেক্ষার পর, যার সম্মতি মিলেছে, তাকে এভাবে হারিয়ে ফেলতে মন চাইছে না। ‘জিনিয়া একটা কথা বলব?’

‘বলেন না। বারবার পারমিশন নিচ্ছেন কেন?’

আমি জিনিয়ার হাতের ওপর হাতটা রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জিনিয়া, তুমি কী আমার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করবে?’

জিনিয়া চোখ নামিয়ে কিছু একটা ভাবল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কতদিনের অপেক্ষা?’

‘খুব বেশি হলে, দেড় বছর। বাবার অনেকগুলো টাকা চলে গেছে। আমি চাই ঐ টাকাটা বাবার হাতে ফেরত দিতে৷ বিদেশে যাওয়ার বা থাকার কোনও ইচ্ছা আমার কখনোই ছিল না। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে যেতে হচ্ছে। ঐ টাকাটা রোজগার করা হয়ে গেলেই, আমি ফিরে আসব।’

খুব আশা নিয়ে জিনিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আর এক মুহূর্ত পরই হয়ত জিনিয়া আমার মন ভেঙে দিয়ে চলে যাবে। ওর উত্তরের আশায়, আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।

অবশেষে জিনিয়া মুখ খুলল। ‘আপনার যেহেতু ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাইরে যেতে হচ্ছে, তার ওপর আংকেলের টাকার কথা বললেন। আপনি কী সত্যি ফিরে আসবেন? মন থেকে বলছেন কথাটা? নাকি এখন একটা কিছু বলতে হবে, তাই বলে দিলেন?’

‘আমি ফিরে আসবই। বিশ্বাস করো জিনিয়া। আমার জায়গা ছেড়ে, আমি বেশিদিন দূরে কোথাও থাকতে পারব না। আসবই আমি।’

জিনিয়া আমার হাতটা ধরে বলল, ‘বিশ্বাস করলাম আপনার কথা। আমি আপনাকে দুই বছর সময় দিলাম। দুই বছর আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।’

‘সত্যি অপেক্ষা করবে?’

‘প্রমিস। সময়টা কিন্তু শুধু দুই বছর। আপনার বলা সময়ের চেয়ে ছয়মাস বেশি।’

‘আমি আসবই। প্রমিস।’

এরপর হঠাৎ করেই সবকিছু খুব সহজ হয়ে গেল। এতক্ষণ বুকের ভেতর যে চাপা কষ্টটা আমাকে কথা বলতে দিচ্ছিল না, সেই কষ্টটা সরে যাওয়ায়, আমি অনবরত কথা বলতে লাগলাম। আমার বাইরে চলে যাওয়ার কথা শুনে, জিনিয়াও শুরুতে চুপসে গিয়েছিল। সে-ও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল।

————————-

আমি বাইরে চলে যাচ্ছি বলার পর থেকেই, আমাদের দলটা কেমন যেন মনমরা হয়ে গিয়েছে। আড্ডায় এসে জিনিয়ার সম্মতির কথাটা জানাতেই, ঝিমানো দলটা হঠাৎ সরব হয়ে উঠল। জিনিয়া কী কী বলল, কীভাবে এটা সম্ভব হলো, আমরা কোথায় গেলাম, কী করলাম, আরও কত প্রশ্ন একেকজন! তপু বলল, ‘এইবার তাহলে তোর বিদেশ যাওয়া ক্যান্সেল হয়েই গেল। খুব ভালো হয়েছে। আমাদের কথা তো শুনছিলি না। এবার একদম ঠিক হয়েছে। জিনিয়াকে রেখে তোর যাওয়া হবে না।’

মুরাদ জিজ্ঞেস করল, ‘যাচ্ছিস না তাহলে?’

‘আমি তো বলিনি, আমি যাব না। যেতে তো হবেই দোস্ত।’

আমার কথা শুনে, আবারও সবাই হাউকাউ শুরু করে দিল। শোভন বলল, ‘সবকিছু যখন ঠিক হয়েই গেছে, আমার মনে হয়, বসন্ত তুই একবার ঘুরেই আয়। যদি মন বসে যায়, ওখানে থেকে গেলি, নয়তো ফিরে আসবি। আংকেলের টাকাটা অন্তত উঠে আসুক।’

শোভন তো আমার মনের কথাটাই বলল! খুব ভালো লাগল ওর কথা শুনে৷ মনে অনেক জোর পেলাম। দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনেকটাই কমে এল। বন্ধুরা বোধহয় এমনই হয়। এক বন্ধু, অপর বন্ধুর সুখ-দুঃখ, বন্ধুর সবরকম অনুভূতিগুলো খুব সহজেই বুঝতে পারে। আমার এখন আর আগের মতো মন খারাপ লাগছে না।

তপুকে বললাম, ‘শোন, ফিরে তো আমি আসবই। তুই কিন্তু ব্যবসার কথাটা ভুলে যাস না। ফিরে এসে আমরা দুইজন একসঙ্গে ব্যবসা করব।’

তপু বলল, ‘ভুলব কেন? আমি তো ভাইয়ার সঙ্গে কাজ করে ব্যবসার ভালো-মন্দ বোঝার চেষ্টা করছি। তুই আসার পর দুইজন মিলে ব্যবসা শুরু করব।’

এরপরের দিনগুলো চোখের পলকে চলে গেল। জিনিয়ার সঙ্গে অল্প সময়ের প্রেম, একইসঙ্গে আমার মনোবল বাড়াচ্ছিল এবং আমাকে দুর্বলও করে দিচ্ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে বেশি করে সময় কাটিয়ে, এদিক-ওদিক বেড়িয়ে, আমি বাইরে গিয়ে ভালো থাকার রসদ সঞ্চয় করে নিচ্ছিলাম।

আজ রাতে আমি চলে যাব। কিছুক্ষণ আগে জিনিয়ার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করে এসেছি। তার প্রমিসের কথাটা মনে করিয়ে দিতেই জিনিয়া বলেছে, সে তার প্রমিস ঠিক রাখবে। তার ধারণা, আমিই আমার প্রমিস রাখতে পারব না।

বাবাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাঁর মন খারাপ। দুইদিন ধরে বাবা কারও সঙ্গেই খুব একটা কথা বলছেন না। বাবা সামনে এলে, আমার চোখে পানি চলে আসছে, তাই আমিও তাঁর সামনাসামনি হতে পারছি না। গতকাল থেকে মা-ও কান্নাকাটি শুরু করেছেন। আজকে অনেক রকম শুকনো খাবার, লাগেজে ভরতে ভরতে মা বললেন, ‘এগুলো খাস। বাইরে তো এসব পাবি না। ওখানে কেউ তোকে সেধে খাওয়াবে না। সময়মতো খেয়ে নিস।’ কথাটা শেষ করেই মা চোখ মুছলেন।

আমি বলতে চাইলাম, ‘এতই যদি আমার জন্য কষ্ট হচ্ছে, তাহলে তুমি আমাকে জোর করে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছ কেন, মা?’ কিন্তু মা’র ওপর প্রচন্ড অভিমানের কারণে, আমি একটা কথাও বলতে পারলাম না। আমার চলে যাওয়া উপলক্ষে বাড়িতে আজ ভালো ভালো খাবার রান্না হয়েছে। দুপুরে সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করল। আজকের সবগুলো খাবার আমার অনেক পছন্দের; কিন্তু আমি ঠিকমতো খেতে পারলাম না। গলা দিয়ে খাবার নামলই না।

দুই ভাই এয়ারপোর্টে যেতে চেয়েছিল; কিন্তু ওদেরকে নিষেধ করেছি। মুরাদদের গাড়িতে করে ওরা সবাই আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে। বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে দেখে বড়ো ভাই আর কিছু বলল না।

নিজের ঘরটাকে শেষবারের মতো দেখে নিলাম। আমি জানি, যখন আমি ফিরে আসব, তখন এই ঘরটা আর আমার থাকবে না, অন্য কারও হয়ে যাবে। বাসার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চললাম নতুন ঠিকানার খোঁজে।

——————————–

প্যারিসে পা রেখেছি দুইদিন হলো। কামাল ভাইয়ের ভায়রা শাকিল স্যার, ত্রিশ বছর ধরে প্যারিসে আছেন। হোটেল ম্যানেজারের কাজ দিয়ে তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। এখন তিনি ছোটোবড়ো মোট পাঁচটা হোটেলের মালিক। বলতে গেলে বিশাল অবস্থা তাঁর! এখানে আসার পর বুঝলাম, কামাল ভাইয়ের পরিচিত বলেই, তিনি আমাকে কাজের সুযোগ দিয়েছেন। নইলে বাংলাদেশ থেকে এসেই হুট করে এভাবে কাজে ঢুকে পড়া যেত না। শাকিল স্যার অসম্ভব ভালো মানুষ। আমার মতোন আনকোরা, অদক্ষ একজন ছেলের সঙ্গে তিনি যেভাবে কথা বললেন, তাতে আমার ভয় অনেকটা কেটে গেল। তিনি বলেছেন, প্রথম একমাস আমাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি আমি টুকটাক কাজ করব। এক তারিখ থেকে কাজে জয়েন করতে হবে।

হোটেল থেকেই আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাকে যে রুমটায় থাকতে দেওয়া হয়েছে, সেই রুমটা আমাকে আরও পাঁচজনের সঙ্গে শেয়ার করতে করতে হবে। রুমে ঢুকে দেখি, দুইপাশে দুইটি তিনতলা বিছানা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার ব্যবস্থা রয়েছে। আমার জায়গা হলো একদম নীচের তলায়। রুমের বাসিন্দাদের সবাই রুমেই ছিল। পাঁচজনের মধ্যে চারজন বাংলাদেশী আর একজন পাকিস্তানি। এই হোটেলের ম্যানেজার আলমাস ভাই সবার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয়ের পর সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি আসার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চারজন বাইরে চলে গেল। বাকিজন কম্বল মুড়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমার জন্য নির্ধারিত কেবিনেটের সামনে লাগেজটা রেখে, আমি নিজের বিছানায় বসলাম।
আমি শুধু ভাবছি, এমন পরিবেশে, অপরিচিত এতগুলো মানুষের মধ্যে আমি থাকব কী করে? এরা কেউ আমার সঙ্গে মিশবে বলে তো মনে হচ্ছে না।

আমার ধারণা ভুল প্রমানিত হলো। দুইদিনের মধ্যেই তারা সবাই আমাকে আপন করে নিল। মাকসুদ ভাই এখানে সবার মুরুব্বি। তাঁর বয়স পঞ্চাশের মতো হবে। তিনি শুধু আমাদের রুমেরই না, পুরো হোটেলের সব স্টাফেরই মুরুব্বি। সবাই তাঁকে খুব মান্য করে। কারও কোনও সমস্যা হওয়া মাত্রই মাকসুদ ভাইয়ের কাছে হাজির হয়ে যায়। আর মানুষটাও যেন অন্যকে সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকেন। সদাহাস্যজ্বল আর পরোপকারী এমন মানুষ আমি আগে আর দেখিনি। চিরকুমার মাকসুদ ভাই পরিবারের ওপর অভিমান করে, দেশান্তরি হয়েছিলেন আটাশ বছর আগে। এরপর তিনি আর দেশে ফিরে যাননি। পরিবারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগও রাখেননি। নিজের কষ্ট ভুলে থাকতেই বোধহয় তিনি অন্যদের কষ্ট দূর করার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেন সবসময়।

—————————-

আমি খুব দ্রুত কাজ শিখে নিচ্ছিলাম। দেশে থাকতে আমি আর শোভন, শখের বশে ফ্রেঞ্চ ভাষা শিক্ষার একটা কোর্স করেছিলাম। তবে অনুশীলনের অভাবে অনেক কিছু ভুলেও গিয়েছিলাম। এখানে আসার পর, অল্প কিছুদিনের চেষ্টায়, ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো স্মরণে চলে এসেছে৷ এই ভাষা শেখাটা আমাকে কাজের ক্ষেত্রে অনেকটুকু এগিয়ে দিয়েছিল। ধীরে ধীরে কাজে আমার মন বসছিল। সপ্তাহে পাঁচদিন যন্ত্রের মতো কাজ করি। কাজ শেষে রুমে ফিরে সবাই সঙ্গে একসঙ্গে খাই। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বারান্দায় গিয়ে, প্রথমে আধঘন্টা জিনিয়ার সঙ্গে কথা বলি। এরপর গ্রুপ কলে পাঁচ বন্ধু মিলে আড্ডা দেওয়া হয়। ওদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় মনেই হয় না, আমি দূরে কোথাও আছি। বাসায়ও ফোন করি দুইদিন অন্তর অন্তর। বাবা-মা’র সঙ্গেই কথা হয় বেশি। ভাইদের সঙ্গে সপ্তাহে একদিন কথা হয়। সবার একই কথা, মন দিয়ে যেন কাজ করি। দেশে ফেরার চিন্তাও যেন না করি। এত সুযোগ-সুবিধা আমি আর কোথাও পাব না। দেশে তো না-ই। আমি শুধু সবার কথা শুনি। কারও কথার উত্তর দিই না।

মাকসুদ ভাইকে একদিন বলেছিলাম, বছরখানেক থেকেই আমি দেশে ফিরে যাব। মাকসুদ ভাই ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘দেশে যাবা ক্যান? কী আছে দেশে? দেশে কাজ পাওনাই দেইখাই তো এখানে আসছ। এখানেই থাকো। ভালো মতোন কাজকর্ম করো। তারপর একদিন ভালো দেইখা একটা বিয়া করাই দিমু।’

মাকসুদ ভাইকে জিনিয়ার কথা বলতেই উনি বলেছিলেন, ‘কোনও সমস্যা নাই। বউ তো রেডিই আছে। একফাঁকে দেশে গিয়ে বিয়া কইরা আইসা পরবা। তারপর কাগজপত্র কইরা তারে নিয়া আসবা।’

এখানকার কাজে আমার মনে বসে গিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু এখানে থিতু হওয়ার কথা আমি কিছুতেই ভাবতে পারি না। দেশের কথা, বন্ধুদের কথা বলতে বলতে, যখন আমার গলা ধরে এসেছিল, মাকসুদ ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘এখনও ছোটো মানুষ আছ, শরীর থেইকা দেশের মাটি গন্ধ যায়নাই। তাই এত কষ্ট পাইতেছ। কয়টা দিন যাক। দুনিয়াদারি একটু শিখা নাও। তারপর দেখবা এই আবেগ কখন জানি হারায়ে গেছে। আমারে দেখো না, আমার তো কোনোদিন দেশের কথা মনে পড়ে না। দেশের জন্য মন পুড়ে না।

আমি মনে মনে বলি, ‘দেশের জন্য, বন্ধুদের জন্য আমার ভীষণ মন পোড়ে, মাকসুদ ভাই। দুনিয়ার তাবৎ সুখ এনে দিলেও, দেশের টান আমি ছাড়তে পারব না।’

————————–

কাজ করি আর টাকা জমাই। এভাবে দেড় বছর পার হয়ে গেল। জিনিয়া আমাকে দুই বছর সময় দিয়েছে। সেই হিসেবে আমার হাতে আর ছয়মাস সময় আছে। এরমধ্যেই বাবার টাকা, ওনার একাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারপরও আমার হাতে বেশ কিছু টাকা রয়েছে। আগামী ছয়মাসে আরও কিছু টাকা জমানোর ইচ্ছা আছে। দেশে গিয়ে বিয়ে করব, ব্যবসা শুরু করব। টাকা তো লাগবেই। বাসায় কাউকে এখন পর্যন্ত জিনিয়ার কথা বলিনি। আমার মনে হলো, আগে থেকে তাঁদেরকে কিছুটা জানানো দরকার। জিনিয়ার বিষয়টা মা’কে জানাতেই, মা হায় হায় করে উঠলেন। আমাকে অনেকভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, এই মুহূর্তে দেশে চলে আসলে, সেই তো আগের অবস্থাতেই ফিরে যেতে হবে। পাগল না হলে, কেউ লাখ টাকা বেতনের চাকরি ছাড়ে নাকি?

আমিও মা’কে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। আমার সব কথা শুনে মা বললেন, জিনিয়ার সঙ্গে বিয়ের বিষয়টা তিনি চিন্তা করে দেখবেন; কিন্তু চার বছরের আগে যেন আমি কিছুতেই বিয়ের চিন্তা না করি।

মা’র সঙ্গে কথা হওয়ার পরদিন দুই ভাবী আমাকে ফোন দিল। তারা নানাভাবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, জিনিয়া কিছুতেই এই বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য না। এরচেয়ে অনেক ভালো পরিবারের, ভালো মেয়ে আমি পাব।

ভাবীদেরকে কঠিন কথা বলতে চাইনি; কিন্তু বলতে বাধ্য হলাম। বড়ো ভাবীকে বলে দিলাম, আমার বিষয় নিয়ে তারা যেন চিন্তা না করেন। ভালো ফ্যামিলির, ভালো মেয়ের আমার দরকার নেই। আমি শুধু জিনিয়াকে চাই।

আমি বুঝতে পারছিলাম, জিনিয়ার কথা বলার পর থেকে, বাড়ির লোকজন আমার ওপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে আছে। তারচেয়ে বেশি বিরক্ত হয়ে আছে জিনিয়ার ওপর। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। জিনিয়া আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমি তাকে ফিরে যাব বলে কথা দিয়েছি।

—————————-

সবাইকে সারপ্রাইজ দেবো বলে দেশে আসার কথাটা কাউকে জানাইনি। শুধু শোভন জানত। ও আমাকে নিতে এয়ারপোর্টে এসেছে। এতদিন পর ওকে দেখে, নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। শোভনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। শোভন আমার কাঁধ চাপড়ে বলল, ‘আসলি শেষ পর্যন্ত!’

‘বলেছিলাম তো, আসবই। তোদের সবাইকে ছেড়ে থাকতে পারলাম না। কেমন আছিস, বল।’

‘খুব ভালো আছি। আগে তো বাসায় যাবি, নাকি জিনিয়া সঙ্গে দেখা করবি?’

‘বাসায় যাব। আজকে শুক্রবার না?’

‘হুম। ভুলে গেছিস?’

‘খুশিতে সব ভুলে যাচ্ছি। আমার আসার কথা তুই কাউকে বলিসনি তো?’

‘আরে না। সবাইকে চারটার সময় চৌরঙ্গীর মোড়ে আসতে বলেছি। চল, গাড়ি এসে গেছে। যেতে যেতে কথা বলি।’

কলিংবেলের শব্দে বাবা গেট খুললেন। সামনে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বোধহয় প্রথমে চিনতে পারেননি। ঘোর কাটতেই, আমাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কেঁদে ফেললেন। আমি আর শোভন মিলে লাগেজগুলো নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। সবাই বোধহয় এখনও ঘুমাচ্ছে। সবার রুমের দরজা বন্ধ। বাবাকে নিয়ে সোফায় বসলাম। বাবা বললেন, ‘আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। তুই একটা ফোন তো করবি?’

‘তোমাদের সারপ্রাইজ দেবো বলে ফোন করিনি।’

‘দাঁড়া, তোর মা’কে ডাকি।’

‘থাক না। এখন ডেকো না। একটু পর তো উঠেই যাবে। তুমি একটু আমার পাশে বসো। তুমি কেমন আছ বাবা?’

‘খুব ভালো আছি রে। তোরা চা খাবি?’

‘তুমি চা খাচ্ছিলে? তোমার চা তো ঠান্ডা হয়ে গেল।’

‘সমস্যা নাই। তোরা বস। আমি চা করে আনি।’

‘বাবা, তুমি বসো। আমি চা আনছি। তোমরা কথা বলো।’

বাবাকে আর শোভনকে বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে চলে এলাম। ইশ, কতদিন পরে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছি। কী যে শান্তি লাগছে চারদিকে চোখ বুলিয়ে।

আমরা চা খেতে খেতেই একে একে সবাই ওঠে গেল। মা এসেই হৈচৈ শুরু করে দিলেন। না জানিয়ে কেন এসেছি, বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।

———————–

আমার রুমটা আর আমার নেই। বড়ো ভাইয়ের দুই বাচ্চা এখন ওখানে থাকে। আমার সব জিনিসপত্র আপাতত বাবা-মা’র রুমেই রেখেছি। পরে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। ফ্রেশ হয়ে এসে, সবার সঙ্গে নাস্তা করে, জিনিয়াকে ফোন করলাম। ছুটির দিন হওয়ায় সে এখনও ঘুমাচ্ছিল। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে, হঠাৎ চিৎকার করে উঠক, ‘এই তুমি কোথায়?’

‘আমার এখন কোথায় থাকার কথা? আমি আমার হোটেলেই আছি।’

‘উঁহু, তুমি এখানে। আমি তরকারিওয়ালার ডাক শুনেছি।’

‘ভুল শুনেছ।’

‘না, ভুল শুনিনি। ঐ যে আবার শুনলাম! বসন্ত, তুমি কখন এসেছ?’

‘এই তো আসলাম, ঘন্টাখানেক হলো। তোমার বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে চলে এসেছি।’

‘জিনিয়া অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কখন দেখা হবে তোমার সঙ্গে?’

‘এখনই হতে পারে। চলে আসি তোমাদের বাসায়?’

‘না, না। আমি একঘন্টা পর আসছি। তুমি রাস্তার মোড়ে থেকো।’

জিনিয়া আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিল। এদিকে মা রুমে এসে, আমাকে ঘুমানোর জন্য জোরাজুরি করতে লাগলেন। মা’কে এটা-ওটা বুঝিয়ে একঘন্টা পর ঠিকই বেরিয়ে এলাম জিনিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য।

জিনিয়ার সঙ্গে দেখা হতেই, এতদিনের জমে থাকা আবেগ উথলে উঠল। রাস্তাঘাট না হলে, ওকে অনেকক্ষণ বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে রাখতাম। এতদিন পর আমাকে পেয়ে, জিনিয়া কথার ঝাঁপি খুলে বসেছে। তার উচ্ছ্বাস, তার আনন্দ চোখমুখ ঠিকরে বেরোচ্ছে। আমরা রিকশায় করে ঘন্টাখানেক বেড়ালাম। জিনিয়াকে বললাম, আমার বাসা থেকে ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাই। সে যেন বাসায় কথা বলে রাখে।

জিনিয়া ওর আম্মাকে, আমাদের বিষয়টা আগেই জানিয়েছিল। সে অনেক কান্নাকাটি করে তার আম্মাকে রাজি করিয়েছে। ওর আব্বা অনেকটা আমার বাবার মতোই, নিরিহ ধরণের মানুষ। জিনিয়া আমাকে আশ্বস্ত করল, যেহেতু আম্মা রাজি হয়েছেন, এখন আর কোনও টেনশন নেই।

তিনদিন পর রাতে খেতে বসে, জিনিয়ার কথা সবাইকে বললাম। মাকে বললাম, জিনিয়ার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে। মা রাগ হয়ে বললেন, ‘তোর মাথায় কী বিয়ে ছাড়া কিছু ঘুরে না? তোকে তো বলেছি, আর কিছুদিন যাক। বেড়াতে এসেছিস। বেড়িয়ে চলে যা। দরকার হলে, আমরা এনগেজমেন্ট করে রাখলাম।’

‘আমি তো বেড়াতে আসিনি, মা। এক কথা আর কতবার বলব?’

বড়ো ভাই বলল, ‘আবার কী সেই আগের জীবন শুরু করবে? বসে বসে খাওয়া আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারা? এভাবে জীবন চলবে?’

‘আমি প্ল্যান করেই ফিরেছি। আমি আর তপু ব্যবসা শুরু করব। তপু অলরেডি শুরু করে দিয়েছে। ওদের গ্রামে আমরা ফুলের চাষ করব, বিদেশি ফুল। তিন বিঘা জমি তৈরি করে, সেখানে বিজ ফেলা হয়েছে, কিছু গাছের বাল্ব লাগানো হয়েছে। এটা আস্তে আস্তে আরও বাড়বে।’

‘ফুলের চাষ? এটাও একটা ব্যবসা হলো?’

‘এটা এখন অনেক বড়ো ব্যবসা।’

‘তোমার যা ইচ্ছা সেটাই করবে? আমাদের কথার কোনও দাম নেই?’

‘বড়ো ভাই, তোমরা সবাই তো নিজের ইচ্ছাতেই জীবন কাটাচ্ছ। তাহলে আমি কেন পারব না? আমি তোমাদের কারও কাছে কোনোরকম সাহায্য চাই না। আমি শুধু নিজের মতো করে জীবনটা শুরু করতে চাই।’

এরপর কেউ কোনও কথা বলল না। সবাই নিরবে খাওয়া শেষ করে উঠে গেল।

এতবার বলার পরও বাসা থেকে জিনিয়াদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর কারও কোনও আগ্রহ দেখছি না। মা’কে আরও দুইদিন কথাটা বললাম। শেষে বাধ্য হয়ে বললাম, ‘তোমরা যদি এ বিয়েতে রাজি না থাকো, আমাকে সরাসরি বলে দাও। আমি নিজের মতো করে ব্যবস্থা করে নেব।’

‘তুই একাই বিয়ে করে ফেলবি।’

‘প্রয়োজন হলে করব।’

‘এখন বিয়ে করে আনলে, মেয়েটা থাকবে কোথায়? রুম তো ফাঁকা নেই।’

‘সেসব নিয়ে তোমরা একদম ভেবো না, মা। আমি আলাদা বাসা নিয়ে নেব। তোমাদের কোনও সমস্যা হবে না।’

————————–

আজকের আড্ডাটা মুরাদের বাসায় হচ্ছে। বন্ধুরা বলল, ‘তোর বাসায় রাজি না হলে সমস্যা নাই। আমরা তোর বিয়ে দেবো। তুই শুধু বল, কী করতে হবে?’

‘এভাবে একা একা বিয়ে করতে চাই না রে। জিনিয়ার বাসায়ও ব্যাপারটা মানবে না।’

শোভন বলল, ‘তোর বাসায় মানছে না, জিনিয়ার বাসায়ও মানবে না। আবার বলছিস ওর বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। তুই তাহলে এখন কী করবি?’

‘দেখি আরেকবার শেষ চেষ্টা করে।’

আড্ডা থেকে বাসায় ফিরে আসার পর, বাবা বললেন, ‘বসন্ত, তুমি জিনিয়াকে জানিয়ে দাও, আমরা ওদের বাসায় যেতে চাই। কবে গেলে তাঁদের সুবিধা হয়, তেমন একটা তারিখ দিতে বলো। জিনিয়ার বাবার সঙ্গে আজকে কথা হয়েছে। আমি ওনাকে সরাসরি বিয়ের কথা বলেছি। তুমি যে আর ফিরে যাবে না, এখানে ব্যবসা করবে, সবই বললাম। ভদ্রলোক আমার সব কথা শুনে বললেন, তোমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে তাঁদের আপত্তি নেই।’

হঠাৎ এমন কিছু হবে, আমি ভাবতেই পারিনি। দেশে আসার পর থেকে এই বিষয়টা নিয়ে প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণায় ছিলাম। বাবার এই কথাটা আমার সমস্ত যন্ত্রণা দূর করে দিল। জিনিয়ার সঙ্গে কথা বলে, শুক্রবার বিকেলে সবাইকে নিয়ে ওদের বাসায় গেলাম। আমি বাবাকে বলেছিলাম, খুব বড়ো করে অনুষ্ঠান করতে চাই না। বরং ঐ টাকা দিয়ে সংসারটা সাজিয়ে নিতে চাই। জিনিয়াদের বাসায় গিয়ে বাবা কথাটা বলার পর, তাঁরাও খুব একটা আপত্তি করলেন না।

আমি ছোটো একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। জিনিয়া আর বন্ধুদেরকে সঙ্গে নিয়ে ফার্নিচার কিনে, ফ্ল্যাটটাকে মোটামুটি সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলেছি। বিয়ের পর জিনিয়াকে নিয়ে সরাসরি এখানে আসব। বাসা থেকে যেহেতু একত্রে থাকার বিষয়ে কেউ কোনও কথা বলেনি, তাই আমিও নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নিয়েছি। এতে আমার একটু মন খারাপ হয়েছে; কিন্তু কাউকে তা বুঝতে দিইনি। এক জীবনে তো একসঙ্গে সবকিছু পাওয়া যায় না। হৃদয়ের এূকল-ওকূল, একসঙ্গে রক্ষা করা যায় না। যে কোনও এক কূল বেছে নিতে হয়। আমি পরিবারের কথামতো চলিনি দেখে, তাঁরা আমার ওপর বিরক্ত হয়ে আছেন। আমি জানি, এই বিরক্তি সাময়িক। কিছুদিন পরই তা কেটে যাবে। তবে নিজের ইচ্ছাগুলোকে মেরে ফেলে, অন্যের ইচ্ছায় চললে, আমি নিজে কখনো ভালো থাকতে পারতাম না। জিনিয়াকেও হয়ত হারিয়ে ফেলতাম।

সমাপ্তি।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে