বেলা শেষে পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

1
1811

#বেলা_শেষে।

[অন্তিম পর্ব]

সূর্যের রশ্নি এসে ঘুমন্ত ভূমির মুখে পড়তেই চোখ পিটপিট করে ভূমি। সূর্যের তেজ খুব বেশী না হলেও ভূমির ঘুম ভাঙার জন্যে যথেষ্ট। পিটপিট করে আখি মেলে সামনে তাকাতেই আরাভের হাসিমাখা মুখ দেখতে পায় সে। আরাভ অধরে হাসি ঝুলিয়ে ভূমির দিকে ঝুকে বসে আছে।

-শুভ মর্নিং জানপাখি। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল আরাভ।

-গুভ মর্নিং। শোয়া থেকে উঠে বসলো ভূমি। অতঃপর সে আরাভকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো,

-আজ অফিস নাই তোমার। তারপর সে পাশে তাকালো কিন্ত অভি সেখানে ছিলো না। অভি কোথায় আরাভ। রাতে তো আমার পাশেই ছিলো তাহলে এখন কোথায় গেলো??

ভূমির করা প্রশ্নের কোন জবাব দিলো না আরাভ। সে ভূমিকে বিছানা থেকে টেনে তুলে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো। এদিকে ভূমি আয়নার সামনে দাড়িয়ে হাই তুলছে বারবার। তখনি আরাভ হাতে একটা শুভ্ররাঙা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। সে ভূমিকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

-এখনো এভাবে দাঁড়িয়ে আছো। তারপর আরাভ নিজেই ভূমির ব্রাশে পেষ্ট ভরিয়ে নিলো। তারপর সে ভূমির দিকে দু-পা এগিয়ে ঠোঁঠের কোনে দুষ্ট হাসি টেনে বলল, ব্রাশটা কি আমিই করিয়ে দিবো।

ভূমি খপ করে আরাভের হাত থেকে ব্রাশ নিয়ে বলে, অসভ্য লোক একটা। ভূমি আরাভের হাত থেকে শাড়ি নিয়ে ওকে ওয়াশরুমে থেকে বের করে দেয়।

শুভ্র শাড়ি পরে মাথায় টাওয়াল পেচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসে ভূমি। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শরীরে বডি স্প্রে লাগাচ্ছিল আরাভ। আয়নার মধ্যে ভূমিকে দেখে একরকম নেশা লেগে যায় আরাভের।সাদা শাড়িতে একদম সদ্য ফুটে উঠা ফুলের মতো লাগছে ভূমিকে। হাতে থাকা বডি স্প্রে ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে ঘোর লাগালো চোখে ভূমির দিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সে ধীর পায়ে ভূমির দিকে এগোতে থাকে। আরাভের এমন ধারা চাহনি দেখে অধরোষ্ঠ চেপে হাসে ভূমি।মনে মনে বলে, এই আরাভনা বড্ড পাগল।

ভূমির হাত ধরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসিয়ে দেয় আরাভ। তারপর ওর মাথা থেকে টাওয়াল খুলে আলতো হাতে ভূমির মাথার চুল মুছে দিতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আরাভ টাওয়ালটা রেখে ভূমির চুলগুলো এক সাইডে নিয়ে কানের লতিতে গভীরভাবে চুমু খায়। এতে ভূমি কেপে উঠে শাড়ির আঁচল শক্তমুঠি করে ধরে। আরাভ ভুমিকে উঠিয়ে তার সামনে দাঁড় করায়। তারপর সে ভূমির অধরের দিকে ললাসুদৃষ্টি প্রয়োগ করে। আরাভের এমন ললাসুদৃষ্টি ভূমিকে বারবার কাপিয়ে তুলছে।ভূমি তার অধর কামড়িয়ে বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। আরাভ ভূমির দিকে এগিয়ে আসলে ভূমি পিছিয়ে যায়। আরাভ ওর দিকে এগোতে থাকে। আর ভূমি পিছনের দিকে দিকে যেতে থাকে।এক পর্যায়ে ভূমি দেয়ালের সাথে লেপ্টে যায়। আর আরাভর ওর দু-পাশে দেয়ালে হাত রেখে গভীর ভাবে তাকিয়ে থাকে ভূমির মুখশ্রীর দিকে। কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর আরাভ আবারও এগিয়ে যায় ভূমিকে কিছ করার জন্যে আর তখনি অভি এসে পরে রুমের ভিতরে । দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরাভকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-পাপা আই এম রেডি।চল এবার।

অভিকে রুমে দেখে চমকে উঠে দুজনেই। হঠাৎ করেই অভির আগমনে মন খরাপ হয়ে যায় আরাভের। আর আরাভের এমন ধারা মুখের রিয়্যাকশন দেখে ফ্যালফ্যাল করে হেসে দেয় ভূমি।আরাভ হাত দিয়ে মাথা চুলকিয়ে বিরবির করে বলে,

-এই ছেলের জন্যে এখন ঠিকমতো রোমান্স ও করতে পারি না। ছেলেতো নয় যেন শত্রু হয়ে জম্মেছে। আরাভের বিরবির করে বলা কথা ভূমির কানে ঠিকই পৌছালো। আরাভের কথা শুনে ভূমি ঠোঁট চেপে হেসে বলে,

-দাঁড়িয়ে আছো কেন?? তোমার ছেলে তোমাকে ডাকছে যাও। আমি এখনি রেডি হয়ে আসছি। আরাভ অসহায়ের মতো ভূমির দিকে তাকিয়ে বলে,যাচ্ছি। তারপর সে অভির কাছে গিয়ে অভির হাত ধরে বাহিরে চলে যায়। আর ভূমি তৈরী হতে থাকে।

ড্রয়িংরুমে বসে অভিকে খাওয়াচ্ছে আরাভ। অভি ফুটবল নিয়ে পুরো ড্রয়িংরুমে খেলছে আর খাচ্ছে। এমনি সময় রাকিব তার পরিবার নিয়ে হাজির হয়। রাকিবের কোলে মিষ্টিকে দেখেই ক্রোধান্বিত হয়ে মিষ্টির দিকে তাকায় অভি। সে ফুলবলটাকে লাথি দিয়ে উল্টোদিকে দেয় । অভির ফুটবলে লাথি দেওয়া দেখে মিষ্টি রাকিবের কোল থেমে ফুটবল আনতে যায়। আর ততক্ষণে রাকিব ও নয়না আরাভের পাশে গিয়ে বসে।

মিষ্টির পিছু পিছু অভিও যায় ফুটবলের কাছে। মিষ্টি যেই না ফুলটবলে হাত দিবে অমনি অভি ফুটবলটা তুলে নেয়। আর মিষ্টির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে দেয়। কারন তখন মিষ্টির মুখের অবস্থা ছিল নাজেহাল। সে জানে অভি তাকে কিছুতেই বল টা দিবে না। বাচ্চা মন এতকিছু মনে ধরে রাখার ক্ষমতা নাই তার। তাই সে আবারও বলটা ধরতে যায়। আর তখন অভি মিষ্টির মাথার ছোট ছোট ঝুটি দুইটা টান দিয়ে খুলে দেয়। মাথার ক্লিপগুলো খুলে দেয়। ক্লিপ অভির হাতে দেখে মিষ্টি আধো আধো গলায় বলে,

-আমাল কিপ দাও ভায়া।

-দিবো না। যা এখান থেকে।

মিষ্টি জোড় করে অভির হাত থেকে ক্লিপ নিতে যায় কিন্ত পারে না। তাই সে অভির হাতে কামড় বসিয়ে দিয়ে। অভির চিৎকার করে ওর হাতে থাকা রাবার ক্লিপ নিচে ফেলে দেয়। মিষ্টি সেগুলো তুলে নেয়। আর ততক্ষণ আরাভ ভূমি রাকিব ও নয়না ওদের কাছে চলে আসে। আরাভ অভির কাছে গিয়ে বলে,

-কি হয়েছে বাবা, ব্যথা লাগছে। অভির হাত নাড়াতে নাড়াতে জবাব দেয়,

-ওই জংলি বিল্লি আমাকে কামড় দিয়েছে। ও মানুষ নয় ওর একটা রাক্ষস। ওকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় দিয়ে এসো।

-তুই কি করেছিস আগে বল। তুমিও যে খুব ভালো মানুষনা সেটা আমি জানি। মিষ্টিকে কি করেছিস বল। ভ্রু কুচকিয়ে প্রশ্ন করলো ভূমি। অভি কিছু না বলে আরাভকে জড়িয়ে ধরলো। ভূমি মিষ্টিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

-মামনি, ওই বাদুরটা আবার তোমাকে মেরেছে তাইনা।মিষ্টি মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিলো। অতঃপর ভূমি আমার বলে,

-তাহলে কি করেছে। মিষ্টি ওর হাতে থাকা ক্লিপগুলো দেখিয়ে বলে,

-আমাল কিপ নিয়েথিলো। তাই কামল দিয়েতি। ভূমি ক্রোধান্বিত হয়ে অভির দিকে তাকাতেই আরাভ অভিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

-ছেড়ে দাওনা বাচ্চা ছেলে।

-হ্যাঁ বাচ্চাই তো। তুমি ওকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছো।অতি আদরে বাদর হচ্ছে দিনদিন। অভি আরাভের কোল থেকেই আড় চোখে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে ওর গুষ্টির ষষ্টি উদ্ধার করতে থাকে।

-আহ্ ভূমি কি হচ্ছে কি?? আমাদের লেট হয়ে যাচ্ছে চল। অতঃপর তারা সকলেই বেড়িয়ে যায়।

প্রায় চার ঘন্টা জার্নি শেষে নয়নাদের গ্রামে পৌঁছায় সবাই। ওরা আসবে বলে নয়নার মা আগে থেকে সব কিছুর বন্ধবস্ত করে রেখেছিলো। নিতু আর ইভান ও এখানে আসছে। ওদের এক বছরের একটা মেয়ে আছে। নীলাও ওর স্বামিকে নিয়ে আসছে। দুই বছর ওদের দাম্পত্য জিবন। এখন কোন সন্তানসন্ততি হয়নি।সবাইকে একসাথে দেখে বেশ অবাক হয় সকলে।তাছাড়া বাড়িটাকেও বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আজ এই বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান আছে বলে তো মনে হয়না। তাহলে বাড়িটাকে এত সুন্দরকরে কেন সাজানো হয়েছে। নয়নার কাছে বিষয়টা জানতে চাইলে নয়না জবাব দেয় আজ তার বড় ভাই দেশে ফিরছে। লেখাপড়া করার জন্যে তুরস্কে গিয়েছিল সে। সেখান থেকে আর ফিরে নি। এতদিন সেখানেই থেকেছে। ওখানেই এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করছে। দুজন বাচ্চা আছে তাদের। আজ এতবছর পর ভাইয়ের মনে হয়েছে সে দেশে ফিরে আসবে। তাই এই ছোট্ট আয়োজন। আর আমাদের সকলের এখানে আসা।

বিকালের নয়নার ভাই তার পরিবার নিয়ে বাড়ি ফিরে। তাদের দুটো সন্তান। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলেটার বয়স অভির বয়সের কাছাকাছি হবে। আর মেয়েটা মিষ্টির সমান। এতবছর পর ছেলেকে বাড়ি ফিরতে দেখে খুব খুশি হয় নয়নার বাবা মা।

সন্ধাবেলায় সকলে যখন নয়নার ভাই আর তার পরিবারকে নিয়ে ব্যস্ত তখন ভূমি এসে দাঁড়ায় নয়নাদের উঠনে সে হাসনাহেলা ফুল গাছের কাছে। কি সুন্দর ফুলের গ্রাণ। মুহূর্তেই মনটাকে ভরিয়ে তুলে। ভূমি দুই হাত প্রসারিত করে মনটাকে উপভোগ করতে থাকে তখন আরাভ এসে সেও তার হাত প্রসারিত করে ভূমির হাতে হাত রাখে।

-একা একা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করবে নাকি জানপাখি। ভূমির হাতদুটো ধরে গুটিয়ে নিয়ে ভূমিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আরাভ।

-তুমি এখানে।

-দেখতে এসেছি।

-প্রকৃতি অপরুপ।

-না। আমার মায়াবতীর রুপ দেখতে এসেছি। আমার মায়াবতী দেখবে প্রকৃতির রুপ। আর আমি দেখবো আমার মায়াবতীর রুপ। বলেই ভূমির গালে চুমু খায় আরাভ। তারপর সে ভূমির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

-ভালোবেসেছি যখন ছাড়ছি না আর তোমাকে। তুমি শুধু আমার, দেবনা ভাগ আর অন্য কাউকে। তোমার মহিমাতে আস্তে আস্তে যাচ্ছি যে আমি পুড়ে, রেখেছি তোমায় মনের গহিনে। ওগো প্রিয়সি।

আরাভের বলা প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করার সময় ওর ঠোট স্পর্শ করেছে ভূমির কানের লতিতে। ভূমি বারবার কেপে কেপে উঠছে তাতে। ভূমি গভীর গলায় বলল,

-আরাভ!!

-হুম বলো।

-এভাবেই পাশে থাকবে আমার। আমাকে ভালোবাসবে। কখনো আমাকে একা করে দিবে না।

-তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতেও পারিন। আর তুমি বলছো, তোকে ছেরে যাওয়ার কথা। যদি কখনো তোমাকে একা করে চলে যাই তাহলে ভেবে নিবে এই আরাভ আর পৃথিবীতে নেই। আরাভ যতদিন আছে সে তোমার পাশেই আছে। আমার এই হাত দুটো ধরে আছে। জানপাখি তুমি জানো তুমি আমার অস্তিত্বে মিশে আছো। তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাবো বলো। #বেলা_শেষে আমি শুধু তোমার।

ভূমি সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর সে আরাভের গলা জড়িয়ে ধরে। আরাভ দু-হাতে ভূমির কোমড় জড়িয়ে ধরে ভূমির কপালে ভালোবাসার পরশ একে দেয়। ভূমি আবেশে তার চোখ দুটি বন্ধকরে নেয়। ভূমি মনে মনে বলতে লাগে,

-আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়-মাঝে আরো কিছু নাহি চাই গো।
আমি তোমারে রেখেছি মন পাঁজরে আর কিছু নাহি চাই গো।
আমি তোমারে দেখি দু-নয়ন ভরে আর কিছু দেখি নাহি গো।
আমি তোমারে ছুয়েছি বক্ষ ছুঁয়ে আর কিছু ছুই না গো।।

সমাপ্তি।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে