আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস পর্ব-২৪+২৫

1
1131

#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ২৪

রহমান সাহেব মাত্রই কবজি ডুবিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে উঠেছেন। ভালো করে হাত ধুয়ে তিনি সোজা ড্রইং রুমে চলে এলেন। সোফায় আয়েশ করে বসে টিভি ছাড়লেন। আজ নববর্ষ। টেলিভিশনে ভালো ভালো প্রোগ্রাম দেখানোর কথা। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে, তিনি থেকে থেকে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। ঢেঁকুর দিয়েও কাচা মরিচ আর পেঁয়াজের আস্বাদন। রহমান সাহেব কিছুটা বিরক্ত হলেন। স্ত্রী সুরমা ডায়নিং এর আশে পাশেই ছিলেন। তিনি হাঁক ছাড়লেন,
‘রুদালির মা, এক কাপ চা খাওয়াও দেখি’।
‘দিচ্ছি’। একথা বলে সুরমা রান্নাঘরে চলে গেলো। টেলিভিশনে স্বমসুরে গান গাইছে একদল ছেলেমেয়ে। এসো হে বৈশাখ, এসো এসো। রহমান সাহেব চোখ বন্ধ করে বুকের ওপর হাত দিয়ে তাল দিচ্ছেন। মাথা নাড়ছেন। গানটি তার বেশ পচ্ছন্দ। দলীয় কন্ঠে শুনতে আরো ভালো লাগছে। তিনি যথেষ্ট উপভোগ করছেন। তার তাল কেটে গেলো কলিং বেল এর শব্দে। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই তিনি বললেন,
‘রুদালির মা। দেখো তো কে আসছে?’
প্রত্যুত্তরে সুরমা রান্নাঘর থেকেই কিছু একটা বললেন। তবে তা রহমান সাহেবের বোধগম্য হলো না। একে তো উচ্চ শব্দে টেলিভিশন চলছে। তার ওপর সুরমা বরাবরই কিছুটা অস্পষ্ট স্বরে কথা বলে। রহমান সাহেব আরো একবার জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি বললে?’
সুরমা পুনরায় কিছু একটা বললো। এবারো তার কথা বোঝা গেলো না। রহমান সাহেব অসন্তোষ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। লুঙ্গি মোড়াতে মোড়াতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজা খোলার সাথে সাথে তিনি কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলেন। তার সামনে রুদালি দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন পর মেয়েকে দেখে রহমান সাহেবের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি খুশি হতে পারলেন না। রুদালির হাতে লাগেজ দেখে সন্দেহের দৃষ্টি মেলে রাখলেন। মেয়ে ঘুরতে আসলে লাগেজ নিয়ে আসবে কেনো? তাছাড়া মেয়ের জামাই কই? আশেপাশে তার টিকিটা পর্যন্ত নেই!
‘বাইরেই দাঁড়া করিয়ে রাখবে? ভেতোরে ঢুকতে দিবে না, বাবা?’
‘আয় ভেতোরে আয়’।
রুদালি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
‘আমি আশাতে মনে হয় তুমি খুশি হও নি। তাই না বাবা?’
‘এসব কি বলছিস? খুশি হবো না কেনো?’
রহমান সাহেব কথার ফাঁকে বারবার রুদালির হাতের লাগেজ দেখতে লাগলেন। তার এই কৌতূহলমিশ্রিত চাহনী রুদালির দৃষ্টি এড়ায় নি। রুদালি সহজ কন্ঠে বললো,
‘তোমাদের জামাই বললো, কটা দিন বাবার বাড়ি ঘুরে আসতে। তাই চলে এলাম’।
রহমান সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
‘ও তাই বল। আমি ভাবলাম কি না কি!’
‘কি ভেবেছো? শশুড় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে?’
‘না তা ভাববো কেনো?’
‘ভাবা উচিত ছিলো। ভাবো নি কেনো?’
‘এরকম অলুক্ষুণে কথা কেনো ভাববো? কি আজেবাজে বকছিস এসব?’
রুদালি হেসে বললো,
‘আমাকে শশুড়বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নেহাত ভদ্র পরিবার বলে সরাসরি বলতে পারে নি। কিন্তু পরোক্ষভাবে হলেও দেওয়া হয়েছে। আর কোনো প্রশ্ন করো না। আমি ঘরে গিয়ে একটু ঘুমাবো। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। বাসায় মাথা ব্যাথার ট্যাবলেট আছে?’
‘আছে’।
‘মা কোথায়?’
‘রান্নাঘরে’।
‘কি করছে?’
‘চা বানাতে বলেছিলাম। মনে হয় চা বানাচ্ছে’।
‘পানি বেশি দিয়ে থাকলে আমাকেও একটু চা দিতে বলবে। সাথে মাথা ব্যাথার ট্যাবলেট’।
রুদালি নিজের ঘরে চলে গেলো। অবিলম্বে সুরমাও রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে বের হয়ে এলেন। রহমান সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘কে এসেছে?’
‘রুদালি’।
সুরমার দুচোখ চিকচিক করে উঠলো।
‘ওমা তাই! জামাইও এসেছে?’
‘না। ওকে নাকি বের করে দিয়েছে ও বাড়ি থেকে’।
সুরমা ভয়ার্ত গলায় বললো,
‘মানে?’
রহমান সাহেব রাগন্বিত স্বরে বললেন,
‘জানি না আমি। তোমার কণ্যাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। সে অঘটন ঘটন পটীয়সী। কে জানে কি কান্ড ঘটিয়ে এসেছে যে ব্যাগপত্র সমেত পাঠিয়ে দিয়েছে! আগে বিয়ের জন্য মানুষের হাত পা ধরতে হতো, এবার মেয়ের সংসার টেকানোর জন্য হাত পা ধরতে হবে। শান্তি নাই!’
‘আচ্ছা। আমি গিয়ে কথা বলে দেখছি’।
‘এক কাপ চা নিয়ে যেও। সাথে মাথা ব্যাথার ট্যাবলেটও নিও’।
সুরমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

রুদালি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দরজা খোলার আওয়াজে সে চোখ মেলে তাকালো। সুরমা এসেছেন। রুদালি মায়ের দিকে তাঁকিয়ে হাসলো। সুরমা মেয়ের পাশে গিয়ে বসলো।
‘কেমন আছিস মা?’
রুদালি উত্তর দিলো না। শোয়া থেকে উঠে বসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। সুরমা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
‘তোর বাবা বললো, জামাই আসেনি’।
‘হু’।
‘কিছু হয়েছে?’
রুদালি এবারো উত্তর দিলো না। মায়ের কাছ থেকে মাথা ব্যাথার ট্যাবলেট নিয়ে পানি দিয়ে গিলে খেলো।
সুরমা আবার জিজ্ঞেস করলেন,
‘ও বাড়ি থেকে নাকি তোকে বের করে দিয়েছে! কি হয়েছে খোলসা করে বলতো আমাকে’।
রুদালি শান্তভাবে বললো,
‘ভুল বোঝাবোঝি হয়েছে মা’।
‘সংসার জীবনে একটু আধটু ভুল বোঝাবোঝি হবেই। জামাইয়ের সাথে কথা বলে সব মিটমাট করে ফেল। এভাবে চলে আসাটা কি কোনো সমাধান?’
‘আমি তো চলে আসতে চাই নি। আমাকে চলে আসতে বলা হয়েছে। তাছাড়া এই ভুল বোঝাবোঝি অনেক বড় তো! চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মতো বড়। এত সহজে মিটবে না’।
সুরমা ফ্যালফ্যাল করে মেয়ের দিকে তাঁকিয়ে রইলেন। রুদালি এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ জানালার বাইরে তাঁকিয়ে থেকে বললো,
‘জানালাটা লাগিয়ে দাও তো মা’।
‘এই ভ্যাপসা গরমে জানালা লাগিয়ে থাকবি কিভাবে?’
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে’।
সুরমা অবাক হয়ে বললো,
‘আকাশে মেঘের ছিটে ফোটাও নেই! বৃষ্টি কিভাবে নামবে?’
‘না থাকুক। তারপরেও বৃষ্টি নামবে। তুমি লাগিয়ে দাও। পর্দাও টেনে দিও।’
সুরমা মেয়ের কথা মতো জানালা লাগিয়ে দিলো। পর্দা টেনে দিলো। পুরো ঘর এখন আবছা অন্ধকার। রুদালি আধ শোয়া অবস্থায় চোখ বন্ধ করে আছে। ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। সুরমা বললো,
‘তুই তাহলে বিশ্রাম নে। আমি পরে আসবো নি’।
‘চা নিয়ে যাও মা। খেতে ইচ্ছে করছে না’।
সুরমা ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। বেশি নয়, মাত্র মিনিট পাঁচেকের ব্যবধানে আবহাওয়া বদলে গেলো। কে জানে কই থেকে? দলে দলে কালো মেঘেরা এসে জমা হতে শুরু করলো ঈশান কোণে। দেখতে দেখতে কালো মেঘের আলোড়ন গগণ জুড়ে। প্রচন্ড গতিতে বাতাস শুরু হলো। ঝম ঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। সুরমার কেনো যেনো মনে হলো তার মেয়েটা কাঁদছে! আর সেই কান্না আড়াল করতেই প্রকৃতি তার মাঝে এনেছে এই ভিন্নতা।

—-
নুরুল আলম হাসিমুখে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে চারটি শাড়ির প্যাকেট। তিনি মেয়ের দিকে প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এখান থেকে তোর পচ্ছন্দমতো দুটো শাড়ি আলাদা করে ফেল তো’।
রায়া বাঁকা স্বরে বললো,
‘কেনো? আলাদা করে ফেলবো কেনো?’
‘দুটো শাড়ি তুই নিজের জন্য আলাদা করে রাখবি’।
‘বুঝলাম। কিন্তু কি উপলক্ষে জানতে পারি?’
নুরুল আলম ইতস্তত করে বললেন,
‘কি উপলক্ষে আবার! এমনি। তোকে দিতে মন চাইলো’।
রায়া হেসে বললো,
‘সোজা সাপ্টা বলো না এই শাড়ি পরে, সেজেগুজে সার্কাসের ভাঁড় সেজে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হবে!’
‘কথা না বাড়িয়ে যা বললাম তাই কর’। নুরুল আলম স্থান ত্যাগ করলেন।

রায়ার সামনে রঙ বেরঙের শাড়ি রাখা। সবগুলোই রায়া ফ্যাশনের নিজস্ব ডিজাইনের শাড়ি। যে কোনো দুটো শাড়ি রায়াকে এখন আলাদা করতে হবে। এইতো! আজ বাদে কাল তাকে দেখতে আসবে। রায়া আঁড়ি পেতে সবই শুনেছে। সে উপলক্ষেই নতুন শাড়ি দেওয়া হচ্ছে তাকে। নুরুল আলম একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা থেকে পিছপা হোন না। টুটুল টাকলার সেই আমেরিকা পজিটিভ পাত্রর সঙ্গেই কথা বার্তা এগোচ্ছে। নুরুল আলমকে পাত্রর ছবি দেখানো হয়েছে। দেখতে মন্দ নয়! চেহারায় বিদেশী ভাবও আছে। রায়ার পাশে এই ছেলে চলনসই। রায়াকেও ছবি দেখানো হয়েছে। ছবিখানি দেখে সেকি ভণিতা। নুরুল আলম বেশ কয়েকবার বলেছেন, এমন ছেলে হাজারে একটা পাওয়া যায়। রায়ার সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বিছানায় মেলে রাখা শাড়িগুলো থেকে দুটি শাড়ি বাছাই করে নিলো। একটির রঙ গোলাপি অপরটির রঙ সবুজ। এই রঙ দুটোতে রায়াকে মানায় না। শাড়ি দুটোর রঙ নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বার্থকতা এটাই। রায়া শাড়ি দুটো আলমারিতে যত্ন করে তুলে রাখলো। তারপর ফোন হাতে বারান্দায় চলে এলো। অভ্রর নাম্বার ডায়াল করলো।
‘আমাকে চিনেছেন?’
‘নম্বরটা সেভ ছিলো বলেই হয়তো চিনেছি। নচেৎ চেনার সম্ভবনা ছিলো না। দীর্ঘদিন পর কই থেকে উদয় হলেন?’
‘যেখান থেকে সবসময় উদয় হই সেখান থেকেই। আচ্ছা আমার নম্বরটা কি নামে সেভ করা?’
‘তনিমা’।
রায়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে_
স্যার আমি তনিমা নই। আমি রায়া। খুব শিঘ্রই আমার বিয়ে হয়ে যাবে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। বিয়ের পর আমায় নিয়েও আমেরিকা চলে যাবে। কিন্তু আমি যেতে চাই না। স্যার আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন? আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।

কিন্তু রায়া একথাগুলো অভ্রকে বলতে পারবে না। সব কথা সবাইকে চাইলেও বলা যায় না।

(চলবে…)

#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ২৫
অর্ণব তার পরিধেয় কাপড় গুলো ভাঁজ করছে। ভাঁজ করছে বললে অবশ্য ভুল হবে। ভাঁজ করার চেষ্টা করছে। পরিপাটি করে কাপড় ভাঁজ করা ছেলেদের কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন যথার্থ ট্রেনিং এর। কাপড়ের দোকানের কর্মচারীদের উপযুক্ত ট্রেনিং দেওয়া হয় বলেই তারা কাপড় ভাঁজ করায় পারদর্শী। অর্ণব কোনো কাপড়ের দোকানের কর্মচারী নয়। এতদিন এই কাজগুলো রুদালিই করে এসেছে। সে বাবার বাড়ি আছে। তাই বাধ্য হয়ে অর্ণবকেই ভাঁজ করতে হচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদেই সে ঢাকার উদ্দেশ্যে আবার রওনা হবে। এবার যাচ্ছে দীর্ঘসময়ের জন্য। মে মাস পুরোটা সে ঢাকায় থাকবে। জুনের মাঝের দিকে ফেরার সম্ভাবনা প্রবল। রুদালি বাবার বাড়ি গিয়েছে আজ দশ দিন হতে চললো। অর্ণব রুদালিকে ফিরিয়ে আনতে যায় নি। রুদালিও তেমন কোনো ইচ্ছা পোষণ করে নি। যেনো সে শ্বশুর বাড়ি ছাড়া ঢের ভালো আছে!
সাহেলা ছেলের ঘরে উঁকি দিলো। অর্ণব একমনে কাপড় ভাঁজ করারা ব্যর্থ চেষ্টায় মগ্ন।
‘আমি ভাঁজ করে দিচ্ছি’।
‘লাগবে না, মা। আমাকে কাপড় ভাঁজ করা শিখতে দাও’।
‘কাপড় ভাঁজ করা শিখে কি হবে?’
‘কিছুই হবে না। আবার অনেক কিছুই হবে। সুন্দর করে কাপড় ভাঁজ করতে জানাটাও একটা স্কিল। আর স্কিল ডেভেলোপমেন্টের জন্য প্র্যাকটিস করতে হয়। প্র্যাকটিস মেইকস এ ম্যান পার্ফেক্ট’।
এটুকু বলে অর্ণব হাসলো। সাহেলা ছেলের হাত থেকে কাপড় নিয়ে বললো,
‘এই স্কিল নিয়ে তুই পরে ভাবিস। কাপড় এভাবে ভাঁজ করলে লাগেজে বাকি কাপড়গুলো ভরতেই পারবি না’।
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘তাও ঠিক। আচ্ছা তুমিই ভাঁজ করে দাও’।
সাহেলা ছেলের কাপড় ভাঁজ করতে লাগলো। অর্ণব তার অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র ড্রয়ার থেকে বের করে গোছাতে লাগলো।
‘হ্যা রে। তুই ঢাকা যাচ্ছিস। বউকে জানিয়েছিস?’
‘জানিয়েছি’।
‘এবাড়িতে রেখে গেলে ভালো হতো না?’
‘না মা। এ বাড়িতে থাকলে ও কারো সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। বিশেষ করে বাবার সামনে। তাছাড়া ও গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করুক সেটা আমিও চাই। কিন্তু ওকে নিয়ে যে ধরনের কথা উঠেছে, ওর মাঝে এক প্রকার জড়তা চলে এসেছে। এখানে থেকে সংশয় ছাড়া আর ভার্সিটি যেতে পারবে না’।
‘শুধু মাত্র এই কারণে ওকে বাবার বাড়ি রেখে এসেছিস তুই? নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে? কিছু লুকাচ্ছিস?’
‘কি ব্যপার থাকবে! কি লুকাবো?’
‘আমাকে যতটা বোকা ভাবিস ততটা বোকাও আমি নই, অর্ণব। বিয়ের পর মেয়েরা বাবার বাড়ি ঘুরতে যায়। দিন কয়েকের জন্য থাকতে যায়। মাসের পর মাস কাটাতে যায় না’।
‘এই নিয়ম তো তোমারাই বানিয়েছো। একজন মেয়ে নিজের বাবার বাড়ি গিয়ে মাসের পর মাস থাকতে পারবে না শুধুমাত্র তার বিয়ে হয়েছে বলে?’
‘কথায় কথায় তর্ক করিস না। বৌমার সাথে যে ছেলেটা অটোতে করে সেদিন এসেছিলো তাকে তুই চিনিস। অভ্র না কি যেনো নাম ছেলেটার। বল চিনিস না তুই?’
‘চিনি’।
‘ওই ছেলের সাথে বৌমার কিসের সম্পর্ক?’
‘এতকিছু আমি জানি না মা’।
‘তুই জানিস কিন্তু আমাকে বলবি না’।
অর্ণব চুপ করে রইলো। সে জানে। সব জানে। অভ্রর সাথে রুদালির কি সম্পর্ক? শুরুটা কিভাবে হলো। শেষটা কেনো হয়েছিলো সব প্রশ্নের উত্তর তার কাছে আছে। তবে রুদালির ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে সম্মান করা এবং তা সংরক্ষণ করাও অর্ণবের দায়িত্বের মধ্যে পরে। তাই এই বিষয়গুলো নিয়ে সে অবশ্যই তার মায়ের সাথে আলোচনা করবে না। কিছু কিছু বিষয় স্বামী স্ত্রীর একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। এ বিষয়গুলোতে তৃতীয় কারো উপস্থিতি কখনোই ভালো নয়। তৃতীয় ব্যক্তি যদি মা হয় তাও নয়।
সাহেলা কাপড় ভাঁজ করা শেষ করে বললো,
‘তৈরি হয়ে টেবিলে খেতে আয়’।

সাহেলা ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর অর্ণব তার অফিস ব্যাগটা হাতে নিলো। মাঝারি সাইজের একটা ডায়রি বের করলো। ডায়রির প্রথম পাতায় তিন রঙের কলম দিয়ে ডিজাইন করে লিখা রুদালি। নামটি লিখতে নীল, সবুজ আর গোলাপি রঙের কলম ব্যবহার করা হয়েছে। পাতা কয়েকটি উল্টিয়ে একটি ছেলের ছবি পাওয়া গেলো। এই ছবিটা আগেও অর্ণব দেখেছে। এই ছবিটার পেছোনেও ডিজাইন করে লিখা আছে ‘অভ্র’। ডায়রিটা অর্ণব পড়েছে। বার বার পড়েছে। রুদালির প্রতিটি ইচ্ছার কথা উল্লেখ করা আছে এই ডায়রিতে। অর্ণব তার সবটুকু উজার করে চেষ্টা করে যাচ্ছে রুদালির প্রতিটি ইচ্ছে পূরণ করতে। রুদালির কাছে অর্ণব সেই আকাঙ্ক্ষিত মানুষটি নয়। যার সাথে রাত জেগে জোছনা দেখা যায়। গহীন অন্ধকারে শুধুমাত্র জোনাক পোকার আলোয় দুজনকে ভালোবাসা যায়। হাত ধরে সমুদ্রে পা ভিজিয়ে শত বছর বেঁচে থাকার খেয়ালে ডুবে যাওয়া যায়। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে একটি আইসক্রীমের স্বাদ দুজন মিলে নেওয়া যায়। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতে বাড়ির ছাদে হাত ধরে ভেজা যায়!
তবুও সময় মানুষের ক্ষত শুকিয়র ফেলার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে। হয়তো তাই, অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষ হয়েও রুদালির অদূরে তাকে বেশিদিন থাকতে হয় নি। খুব মিষ্টি একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তাদের মাঝে। এ সম্পর্ক দৈহিক সম্পর্কের চেয়েও মধুর।
তথাপি, কিন্তু। এই ‘কিন্তু’ নামক শব্দটি উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারো নেই। তাই একশ ভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করার সাধ্যও কারো নেই। ক্ষত শুকিয়ে যাবে, পুনরায় সংক্রামিত হবে না- এমন নিশ্চয়তা সময় দেয় নি। অর্ণব রুদালির বন্ধু হবে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হবে। এতে রুদালি অতীত ভুলে যাবে এমনটা কোথাও লিখা ছিলো না। অভ্র রুদালির জীবন থেকে একদম নিলীন হয়ে যাবে তার নিশ্চয়তাও ভবিষ্যত তাকে দেয় নি। তবে এত প্রত্যাশার আগমন হয়েছিলো কই থেকে?
অর্ণব বড় করে শ্বাস নিলো। তার মা সাহেলা পরিপাটি করে কাপড়গুলো ভাঁজ করে গেছে। লাগেজে এখনো অফুরান জায়গা। রুদালির বেশ কয়েকটা শাড়ি রাখার পরেও আরো কিছু জায়গা বাকি থাকবে। তাদের পরিবার সদস্য যদি আজ তিন সংখ্যার হতো তাহলে হয়তো লাগেজে আর জায়গা থাকতো না। প্রথমে অর্ণবের কাপড় থাকতো। তারপর রুদালির। তারপর তাদের সোনামণির কাপড়গুলো। কি সব এলোমেলো চিন্তা করছে সে! অর্ণব লাগেজ বন্ধ করে ফেললো।
———————–
অভ্র সিগারেট কিনতে গিয়েও কিনলো না। সে যে ভদ্রলোকের বাড়ি যাচ্ছে তিনি নিজের থেকেই অভ্রকে সিগারেট সাধবেন। খামোকা টাকা নষ্ট করার মানেই হয় না। অভ্র শামসুর চৌধুরীর বাড়ি যাচ্ছেন। তার সিদ্ধান্ত জানাতে। অভ্র কি সিদ্ধান্তে উপনীত হলো তা জানানোর কথা ছিলো এক দিন পর। সে একদিন পর জানায় নি। এমনকি ভদ্রলোকের সাথে কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টাও করে নি। এতদিন পর সিদ্ধান্ত জানাতে আসার যৌক্তিকতা নিয়ে অভ্র ভাবছে না। তাকে দেখেই বাড়ির দারোয়ান সালাম দিয়ে গেট খুলে দিলো। যেনো সে আগের থেকেই জানতো অভ্র এখন আসবে। অভ্র সেই অদ্ভুতুড়ে ঘরটিতে গিয়ে বসলো। তবে আজ এ ঘরের পরিবেশ কিছুটা আলাদা বলে মনে হচ্ছে। অদ্ভুতুড়ে লাগছে না। বুকসেলফ এর বইগুলোর প্রতি অভ্রর আগ্রহ জন্মেছিলো প্রথম দিন। সংকোচ ফেলে সেলফের কাছে যাওয়া হয়ে ওঠে নি। আজ চুপ করে বসে না থেকে সে সেলফ এর দিকে এগিয়ে গেলো। অনেক লেখকের বইয়ের কালেকশন রয়েছে। বিদেশী লেখকের বইও আছে। সেলফের মাঝখানে একটি উক্তি ফটো ফ্রেমে বাধাই করে রাখা আছে। তাতে লিখা,
‘সাফল্যের জন্য মনকে তৈরি করুন’।
উক্তিটি অভ্রর খুব পচ্ছন্দ হলো। সাথে একটি জিনিস অপচ্ছন্দও হলো। এই উক্তিটি কার তা লিখা নেই।
‘উক্তিটি সুন্দর তাই না?’
অভ্র পেছোন ফিরে তাকালো।
‘জ্বি সুন্দর’।
শামসুর চৌধুরী সোফায় বসতে বসতে বললেন,
‘উক্তিটি কার জানো?’
‘না’।
‘ডেল কার্নেগির। তাঁকে চিনো?’
‘না’।
‘আমেরিকান রাইটার। গল্পের বই পড়া হয়?’
‘না। আগ্রহ খুঁজে পাই না। তবে বুকসেলফ ভর্তি বই দেখতে ভালোলাগে’।
‘আমারো এক সময় বইয়ের প্রতি আগ্রহ ছিলো না। এখন প্রচুর আগ্রহ’।
অভ্র মুচকি হাসলো। সেলফের কাছ থেকে সরে এলো। ভদ্রলোকের সামনে বসলো।
‘আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাতে এসেছি’।
‘সময় নিয়ে গেলে একদিনের। আসলে গুনে গুনে পঁয়ত্রিশ দিন পর’।
‘আমার সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লাগে’।
‘মানুষ দীর্ঘদিন কোনো বিষয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে তার পজিটিভ দিকগুলো রেখে নেগেটিভ দিক গুলো অধিক পরিমাণে আবিষ্কার করতে পারে তা কি জানো?’
অভ্র কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
‘না’।
‘আমার ধারণা, তুমি তাই পেরেছো এবং তোমার সিদ্ধান্ত নেগেটিভ। তুমি ফার্মের দায়িত্ব নিচ্ছো না। ভুল বলেছি?’
অভ্র চুপ করে রইলো। শামসুর চৌধুরী হাসলেন। নীরবতা হলো সম্মতির লক্ষণ। অভ্রর যে ফার্মের দায়িত্ব নিবে না তা তিনি আগেই ধরতে পেরেছেন। তিনি এটাও জানেন, এই কাজটা অভ্রর অতি শিঘ্রই প্রয়োজন পরবে এবং সে পুনরায় তার কাছে আসবে। তার আগ পর্যন্ত তিনিও ফার্মের কাজ শুরু করবেন না।
‘ঠিকাছে আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি তুমি এখন আসতে পারো’।
অভ্র বললো,
‘আচ্ছা’।
রাস্তায় নেমেই অভ্র সিগারেট কিনলো। ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তাকে আজ সাধে নি। বিষয়টা নিয়ে অভ্র কিছুটা বিরক্ত। তার নিজের ওপর রাগও হচ্ছে। অবশ্য দুটোর কারন ভিন্ন।
ডেল কার্নেগীর উক্তির নিচে তার নাম কেনো নেই- একথা ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করা হয় নি। অথচ জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো। এটাই রাগের উৎস। একথা জিজ্ঞেস করার জন্য পুনরায় ও বাড়ির চৌকাঠের ভেতোর যাওয়াটাও অযৌক্তিক। অভ্র সিগারেট খাওয়ায় মন দিলো।

চলবে…

লেখনীতে, আতিয়া আদিবা

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে