প্রেমময় আসক্তি ২ পর্ব-১২

1
1267

#প্রেমময়_আসক্তি_২
#পর্ব_১২
#নন্দিনী_চৌধুরী

১২.
চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে রোদেলা আদ্রিতাকে। তাদের সামনে বসে আছে আশরাফ। রোদেলা আর আদ্রিতার জ্ঞান নেই তাই আশরাফ সামনের টেবিলে রাখা পানির গ্লাস নিয়ে পানি ছুঁড়ে মারলো ওদের মুখে।
পানি ছুঁড়ে মারতেই দুজনের জ্ঞান ফিরে আসে। রোদেলা আর আদ্রিতা আসতে আসতে চোখ খুলে তাকালো। চোখ খুলে ভালো ভাবে তাকিয়ে আসে পাশে দেখতে লাগলো। রোদেলা আর আদ্রিতা সামনে তাকিয়ে আশরাফকে দেখে অবাক হলো। বিশেষ করে আদ্রিতা আশরাফকে দেখে অবাক হলো। আদ্রিতা অবাক কন্ঠে বললো,

আদৃতা:বাবা!
রোদেলা আদ্রিতার কথা শুনে চমকে গিয়ে বললো,
রোদেলা:বাবা মানে?
আদ্রিতা:উনি আমার আর ভাইয়ার বাবা।

আদ্রিতার কথায় শুনে রোদেলা অবাকের চরম সিমানায় চলে গেলো। আশরাফ আদ্রিতার কথায় হেঁসে বললো,

আশরাফ:হ্যা আমি।
আদ্রিতা:আমাদের এভাবে এখানে ধরে আনার মানে কি?
আশরাফ:মানে তো অনেক আছে। আসতে আসতে সব জানতে পারবে।
রোদেলা:আপনি আমাদের এখানে কেন নিয়ে এসেছেন। কি চাই আপনার?
আশরাফ:তোমার কাছে আমার কিছু নেই আবার আছে। তোমার সাথেই আমার চাওয়া জরিতো আছে।
রোদেলা:মানে?
আশরাফ:মানে খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে।

রোদেলা আর আদ্রিতা বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে। আশরাফ তার পাশে থাকা ল্যাপ্টপটা অন করলো তারপর সেই ল্যাপ্টপের স্ক্রিনে একটা ছবি আনলো। রোদেলা আর আদ্রিতা সেই ছবি দেখে অবাক হলো। কারন ছবিটা আদ্রিয়ানের ফ্যামিলির ছবি। যেখানে আদ্রিয়ানের মা আর একটা লোক যার কোলে আদ্রিয়ান। আশরাফ ছবিটা দেখিয়ে বলতে লাগলো,

এই যে ছবিটা তোমরা দেখছো সেটা হলো আদ্রিয়ানের পরিবারের ছবি। আদ্রিয়ানের মায়ের ২য় স্বামী আমি। আদ্রিয়ানের আসল বাবা আর আমি ছিলাম দুই বন্ধু। আদ্রিয়ানের বাবা ছিলো অনেক বড়লোক আর আমি একজন মধ্যবিত্ত। আদ্রিয়ানের বাবা আর মায়ের প্রেমের বিয়ে ছিলো। ওদের বিয়ের ২বছর পর আদ্রিয়ান হয়। আদ্রিয়ানের বাবার তখন বিজনেসে আরো লাভ হচ্ছিলো আর আমি সেই ছোট ছোটই থেকে যাচ্ছিলাম। দেখতে দেখতে আদ্রিয়ানের ১বছর হলো। একদিন আদ্রিয়ানের বাবা একটা এক্সসিডেন্ট করলো আর সেই এক্সসিডেন্টে স্পোট ড্যাথ হয়ে যায় তার। আদ্রিয়ানের বাবা তার সব সম্পত্তি আদ্রিয়ানের মায়ের নামে করে দিয়েগেছিলো। আদ্রিয়ানের বাবা মারা যাওয়ায় আদ্রিয়ানের মা অনেক ভেংগে পরেছিলো আমি তাদের সামলাচ্ছিলাম। একটা সময় আদ্রিয়ানের মাকে আমি বিয়ের প্রস্তাব দিলাম আর এটাও বললাম আদ্রিয়ানকে একদম নিজের ছেলের মতো আগলে রাখবো। এরপর আদ্রিয়ানের মা আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়। বিয়ে করে নেই আমি আদ্রিয়ানের মাকে। তার তার সাথে শুরু করি সংসার। আদ্রিয়ানের ৪বছর বয়সের সময় আদ্রিতা হয়। আমি কৌশলে আদ্রিয়ানের মায়ের থেকে সব সম্পত্তি লেখে নেই নিজের নামে তারপর শুরু করি তাদের প্রতি অবহেলা। কারন সম্পত্তি ছিলো আমার আসল চাওয়া। তাই আদ্রিয়ানের মাকে বিয়ে করেছিলাম আমি। আদ্রিয়ানের মা আমার এই পালটে যাওয়া মানতে পারতোনা। আমাকে কারণ জিজ্ঞেশ করলে আমি কিছু বলতাম না। এরপর আসতে আসতে তার প্রতি আমার আরো বিরক্তি আসতে লাগলো। তাদের রেখে আমি চলে আসলাম অন্য জায়গায়। ওদের কোনো খোঁজ খবর নিতাম না। এমনকি আমার ছেলেমেয়েদেরও দেখতে যেতাম না।আদ্রিয়ানের মা আমাকে ফোন দিলেও আমি ধরতাম না। এভাবেই যেতে লাগলো সময়। একদিন আদ্রিয়ানের মা আমাকে কল করে বললো আমি যদি তাদের সাথে এমন করতে থাকি তবে সে পুলিশের কাছে গিয়ে আমার নামে মামলা করে দেবে। আমি ভয় পেয়ে যাই যে যদি সত্যি ও আমার নামে মামলা করে দেয় তাহলে। তাই আমি সেদিনের পরেরদিনই ওদের কাছে যাই। সেদিন আদ্রিয়ান স্কুলে ছিলো বাসায় ছিলো আদ্রিয়ানের মা আর আদ্রিতা। আমি বাসায় গিয়ে আদ্রিয়ানের মাকে বুঝাই কিন্তু সে মানতে নারাজ। এক পর্যায় সে আমার সাথে চিল্লা চিল্লি শুরু করে দেয় আর আমিও রাগের মাথায় হাতের কাছে থাকা ছুড়ি দিয়ে ওকে একের পর এক আঘাত করতে থাকি। একটা সময় বুঝি যে আদ্রিয়ানের মা মারা গেছে। আমি ভয় পেয়ে যাই বুঝতে পারছিলামনা কি করবো। ছোট আদ্রিতা আমাকে দেখে ফেলে খুন করতে। আমি তাড়াতাড়ি ওকে সেখান থেকে নিয়ে পালিয়ে আসি। আদ্রিয়ানের ব্যাপারে আমি কোনো চিন্তা করিনি। কারন সে আমার নিজের সন্তান ছিলোনা বলেই আমার কোনো চিন্তা ছিলোনা ওকে নিয়ে। আদ্রিতাকে নিয়ে সোজা চলে যাই অস্ট্রেলিয়া। সেখানেই বড় হতে লাগে আদ্রিতা। আর আমার সব কালো ব্যাবসাও সেখানে বসে করতে থাকি। একটা সময় আদ্রিতাকে সেখানে রেখে আমি চলে আসি বাংলাদেশে। খবর নিয়ে জানতে পারি আমার ভাই আদ্রিয়ানকে সিডনিতে কোনো এক ওর্ফানে রেখে এসছিলো সেখানেই আদ্রিয়ান বড় হচ্ছে। এভাবেই সব যেতে লাগলো। আদ্রিতা বুঝার বয়সের থেকেই আমার সয্য করতে পারতোনা কারন আমি তার মাকে মেরেছি এই কারণে। আমিও সেদিকে পাত্তা দিতামনা। রোজ এক এক নারীতে মজে থাকতাম। এভাবে চলতে লাগে সময়। একটা সময় আদ্রিয়ান নিজের মাফিয়া জগৎ তৈরী করে। আদ্রিয়ান জানতোনা যে ওর মায়ের খুনি আমি আর না জানতো এটা যে আদ্রিতা বেঁচে আছে।আদ্রিয়ান বুঝার বয়স থেকে আমাকেই ওর বাবা জানতো। ওর আসলে বাবার কথা কোনোদিন ওকে জানানো হয়নি। একটা সময় আদ্রিয়ান আমার পিছনে এসে লাগে কারন আমার সব ইল্লিগ্যাল কাজের বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো আদ্রিয়ান। আমার সকল কাজে ও কালো ছাঁয়ার মতো ছিলো। আমি যদিও আগে জানতাম না যে এই মাফিয়া লিডার ও পরে জানতে পারি আমার ছেলেই আমার শত্রু। দিন দিন ও আমার কাছে বিষের মতো হয়ে যাচ্ছিলো। তাই ওকে মারার চেষ্টা করলাম কিন্তু লাভ হয়নি। এক সময় জানলাম আদ্রিয়ানের সব থেকে দুর্বলতা তুমি। তাই তোমাকে মারার পরিকল্পনা করলাম। কিন্তু তার আগেই আদ্রিয়ান চলে আসে দেশে। তাও তোমাকে মারার চেষ্টা চালিয়ে যাই। কিন্তু ফলাফল শুন্য। এক সময় জানলাম আদ্রিয়ান জেনে গেছে ওর মায়ের খুনি আমি। এখন মনের ভিতর ভয় ঢুকলো কারন আদ্রিয়ান আমাকে ছাড়বেনা তাই নিজেকে আন্ডারগ্রাউন্ড করে দিলাম। আর শেষ একটা চেষ্টা করলাম আদ্রিয়ানকে মারার। মেরেই দিয়েছিলাম তবুও আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। তারপর নিজেদের আত্মগোপন করে দিলাম কিছু সময়ের জন্য।

এতুটুকু বলে থামলো আশরাফ। আশরাফের কথা শুনে রোদেলা আর আদ্রিতা চুপ হয়ে যায়। আদ্রিতা তো জেনো কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সে তার ভাইয়ের আপন বোন না। মানে তার পরিচয় সে এই নোংরা লোকটার মেয়ে আদ্রিয়ানের বাবার মেয়ে নয়।

রোদেলা আশরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,

রোদেলা:আপনি বাবা নাকি অন্য কিছু। আপনার নিজের ছেলে না বলে তার সাথে এসব করলেন। আপনি তো মানুষ না।
আশরাফ:আমার হিসাব পরে করো আগে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো। কি ভালোবাসলে স্বামীকে একটা ভিডিও দেখেই মেরে ফেললে।
রোদেলা:আপনি!
আশরাফ:হ্যা এইসবের পিছনেও আমিই ছিলাম। তোমার বাবা মাকে আদ্রিয়াননা আমি মেরেছি। আমার লোকেরা মেরেছে তোমার বাবা মাকে। তোমার বাবা মাকে যেদিন মারলাম সেদিন যে ভিডিও তোমাকে দিয়েছিলাম আর তাতে আদ্রিয়ান রুপে যাকে দেখেছিলে সে ছিলো আমার লোক। আমিই ওকে আদ্রিয়ানের মতো করে সাজিয়েছিলাম। যাতে করে তুমি বিশ্বাস করো আদ্রিয়ানই তোমার বাবা মাকে মেরেছে। লিজাকে দিয়েও মিথ্যা বলিয়েছিলাম। লিজার তো পেটে কোনো বাচ্চা ছিলোনা সব ছিলো সাজানো নাটক। আর তুমি সেই নাটক বিশ্বাস করে আদ্রিয়ানকে মেরে ফেললে। কি ভালোবাসা তোমার।

আশরাফের কথা শুনে রোদেলা যেনো এবার সাত আসমান থেকে পরলো। এই একটা কথাই তার সব এলোমেলো করে দিলো। একি ভুল করলো সে। কি করলো এটা সে। না জেনে না বুঝে কত বড় অন্যায় করলো সে আদ্রিয়ানের সাথে। আশরাফের কথা শুনে আদ্রিতা অবাক নয়নে রোদেলার দিকে তাকালো। রোদেলা তখন পাথর হয়ে বসে ছিলো।

_________________________
এদিকে মুন,রুবা,কাশু সবাই বসে আছে সোফায়। রাফসান মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সেই সকাল থেকে রোদেলা নিখোঁজ।
সকালে রোদেলা আদ্রিতাকে নিয়ে গেছে ডাক্তারের কাছে চেকাপ করানোর জন্য কিন্তু সেই সকালের পর থেকে আর কোনো খবর নেই ওদের। কারো ফোনও লাগছেনা আর না দুজনের মধ্য কারো কোনো হদিস আছে। রাত এর মধ্যেই আদ্রিয়ানকে কল করে জানিয়েছে রোদেলার নিখোঁজ এর কথাটা। আদ্রিয়ান জানিয়েছে সে দেখে নিচ্ছে।

মুন:এভাবে বসে না থেকে পুলিশকে জানালে ভালো হতোনা।
রাফসান:আমিও তাই ভাবছি পুলিশের কাছে গিয়ে মিসিং রিপোর্ট করি।
রাত:আমার মনে হয় আরো কিছু সময় অপেক্ষা করা উচিত। হতে পারে তারা ফিরেও আসলো।
রাফসান:হ্যা আজকের দিনটা দেখি।

~এদিকে~

সায়মন:স্যার খবর একদম পাক্কা আপনার বাবা ভাবি আর আদ্রিতা কে তুলে নিয়ে গেছে।
আদ্রিয়ান:রোদেলাকে আমার জন্য তুলে নিয়ে গেছে বুঝলাম। কিন্তু সাথে ওই মেয়েটাকে কেন নিলো?
সায়মন:হয়তো কোনো কারনেই নিয়েছে।
আদ্রিয়ান:গাড়ি বের কর। আমার বাচ্চা গুলাকেও নে। আজ অনেকদিন পর ওদের নৈশভোজ হবে।
সায়মন:একদম😎।

আদ্রিয়ানরা বেরিয়ে পরলো রোদেলাদের বাঁচানোর জন্য।

__________________________
রোদেলা:আপনি, আপনি একজন বাবা নামের নরপশু। আপনি বাবা নামের কলঙ্ক। আপনি আমার হাত দিয়েই আমার সন্তানদের বাবাকে মারালেন। আমার সন্তানরা জন্মের আগেই তাদের বাবাকে হারিয়েছে। আমার করা অন্যায়ের কোনো মাফ নেই তেমন আপনার করা অন্যায়েরও কোনো মাফ নেই। মনে করবেননা আপনি বেঁচে যাবেন। কোনো না কোনো ভাবে ঠিক আপনাত পতন হবেই।

আশরাফ:হ্যা সেই পতন কে এখানে আনার অপেক্ষাই করছি। মেরে তুমি আদ্রিয়ানকে দিয়েছিলে ঠিকই কিন্তু সে আসলে মরে গেছে নাকি এখনো জীবিত আছে তাই এখন দেখা বাকি আমার। তোমাদের এখানে আনার কারন এটাই ওই পতনকে এখানে আনার।
রোদেলা মনে মনে ভাবে,,
রোদেলা:উনি কি আরিয়ানের কথা বলছেন! আরিয়ানকি আদ্রিয়ান হতে পারে। আর আরিয়ান আদ্রিয়ান হবেই বা কি করে। আদ্রিয়ানের সাথে সে যা করেছে তারপর আদ্রিয়ান কি আসবে তার কাছে। কিন্তু ওই যে তার কাছে রাতে আসতো সে?
আশরাফ:এখন শুধু অপেখা।

___________________________

মিস্টার হাসান আর মিস্টার খান বসে কথা বলছেন,,

মিস্টার খান:আচ্ছা ভাইয়া তুমি আরিয়ানকে পেলে কিভাবে। মানে আরিয়ানের তো তার আগের কোনো কিছু মনে নেই। তার কি মনে পরেনা আগের কিছু?
মিস্টার হাসান:ওর অপারেশনের পর ডাক্তার বলেছিলো আগের কথা মনে হয়তো পরতেও পারে নাও পরতে পারে। তবে এতো মাসেও আমি ওর মুখে ওর আগের কিছুই শুনিনি। আর ওকে পেয়েছিলাম একটা খাদে রক্তাক্ত অবস্থায়। তুইতো জানিস আমার ছেলে আরিয়ান মারা গেছে অনেক আগেই এভাবে খাদের থেকে পরে গিয়ে। সেই জন্য তোর ভাবি সব সময় আপসেট থাকতো। ৮মাস আগে আমি আর তোর ভাবি পাহাড়ে গেছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে আরিয়ানকে আমরা পাই আহত অবস্থায়। তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে যাই হাসপাতালে। বাংলাদেশে ওর চিকিৎসা ভালো হচ্ছিলোনা। তাই নিয়ে যাই অস্ট্রেলিয়া। সেখানে ট্রিটমেন্টে করে আল্লাহর রহমতে আরিয়ান একদম সুস্থ হয়ে যায় কিন্তু সব আগের সৃতি হারিয়ে ফেলে। তাই আমি আর তোর ভাবি ওকে আমাদের সন্তানের পরিচয় দিলাম। আর এখন পর্যন্ত আরিয়ানের আগের কিছুই মনে পরেনি। আর মনে যেনো না পরে তাই চাই।
মিস্টার খান:হ্যা যত তাড়াতাড়ি পারো রুহির সাথে ওর বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।
মিস্টার খান:হ্যা তাই করবো।

~অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আদ্রিয়ান চলে আসে আশরাফের ঠিকানায়।~

আশরাফ দূর থেকে আরিয়ান ওরফে আদ্রিয়ানকে দেখে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে তারপর সামনে এগোতে এগোতে বললো,

“অবশেষে আমার অপেক্ষার অবসান হলো।”

#চলবে

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে