প্রিয় বেগম পর্ব-০১

1
1681

#প্রিয়_বেগম
#পর্ব_১
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

বিয়ে করে তোমার বর তোমাকে রেখে পালিয়েছে?

ভয়ে ভীত বিহ্বলিত মেয়েটা চোখের অশ্রু ভেতরে উদগীরণ করার চেষ্টা করে কম্পিত গলায় বলল, না সাহেব । উনি পালাননি। আমার মনে হয় উনি বিপদে পড়েছে।

বলা শেষ করার আগেই ফুঁপিয়ে উঠে এদিকওদিক তাকালো মেয়েটা।

শত্রু? কেমন শত্রু। শত্রু হলে তোমাকেও তুলে নিয়ে যেত না? তোমাকে রেখে যাবে কেন?

মেয়েটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ডানে-বামে তাকায়। তারপর ঠোঁট ভেঙে কাঁদে। পড়নে লাল টকটকে বিয়ের শাড়ি। মাথার কবরীবন্ধ চুলের সাথে আটকানো একটা যবনিকা। নাকে ছোট্ট একটা সোনার নাকফুল। গলায় সোনার চেইন। হাতে দুটো চিকন বালা। সেটা স্বর্ণের। মাথায় সোজা সিঁথি। সিঁথি বরাবর পড়া টিকলিটা বাঁকা হয়ে আছে। অল্পবয়স্কা মেয়ে। দেখতে ভারী সুশ্রী, দেহের আঁটসাঁট বাধুনি, তেজোদৃপ্ত চোখ। এককথায় লাবণ্যময়ী। মেয়েটার রূপে মোহিত হয়ে ছেলেটা হয়ত তাকে পালিয়ে বিয়ে করেছে।

তোমরা কি পালিয়ে বিয়ে করেছ?

প্রশ্নটায় মেয়েটা লজ্জা পেল। লজ্জায়, সংকোচে আরক্তিম হয়ে বুকে চিবুক ঠেকিয়ে মাথা দুলালো।
কয়েকটা উৎসুক চোখ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে।

নাগরঙ্গ পশ্চিমাকাশে সূর্যের বিদায়লগ্ন জানান দিচ্ছে রাতের আগমন। শাহজাহান সুলতান বহুদিন পর নিজ বাড়িতে ফিরছেন পলাশপুর থেকে। নিজ বাড়ি রূপনগরে। পলাশপুর থেকে রূপনগরে ফেরার পথে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের কাঙ্খিত ট্রলারটির জন্য। ট্রলার আসতে দেরী হওয়ায় চুরুট টানছিল একপাশে দাঁড়িয়ে। বর্ষার পানিতে নদীর পানি টুইটম্বুর। একপাশে মালবহনকারী জাহাজে মালামাল তুলছে জাহাজ খালাসিরা। বেশ হাঁকডাক পাড়ছে কর্মীরা। সবার পড়নে লুঙ্গি। তিনি লক্ষ্য করলেন নদীর পাড় ঘেঁষে ভয়ে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কন্যাটি লুঙ্গি পরিহিত লোকগুলোর কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে মাথা ঢাকা লাল অবগুণ্ঠন দিয়ে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করছে আর হালকা কাঁপুনির সাথে সাথে হালকা হালকা কাঁদছে।

বড়ই মায়া হলো শাহজাহান সুলতানের। উনারও মেয়ে ভাইঝি আছে মেয়েটার বয়সী। অনেকদিন মেয়েদের হৈচৈ কানে বাজে না। আজ আব্বাজানকে দেখে তারা কতই না খুশি হবে।

তিনি এগিয়ে গিয়ে সস্নেহে মেয়েটির কাছে সমস্যার কারণ জানতে চাইলে মেয়েটি সব বৃত্তান্ত উল্লেখ করে নির্ভয়ে। যদিও মনের মধ্যে কু ডাকছিল কিন্তু উপায় নেই। রাত নেমে গেলে সে বিপদে পড়বে তা নিশ্চিত। উনি তাকে ফেলে কোথায় চলে গেল? মানুষটার কোনো বিপদ আপদ হলো না তো। অজানা আশঙ্কায় মেয়েটার গলা শুকিয়ে এল।

তন্মধ্যে মোটা গলায় কে যেন হাঁক পাড়লো,

বড়বাবু ট্রলার আইয়া পড়ছে। তাড়াতাড়ি আহেন।

শাহাজাহান সাহেব উনার লোক গুলোকে ডেকে ইশারা করলেন উনার জিনিসপত্র মালামাল গুলো ট্রলারে তোলার জন্য। লোকগুলো জিনিসপত্র গুলো নিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটির দিকে পলক তুলে সন্দিহান দৃষ্টিতে বারকয়েক তাকালো। তাদের চাউনি দেখে আরও ভয়ে সিঁটিয়ে গেল মেয়েটি।

চুরুটের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে এল মেয়েটির। শাহজাহান সাহেব ধোঁয়া উড়িয়ে বললেন

রাত নামছে মেয়ে। কি করবে কিছু ভেবেছ? এখানে এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? তোমার বর কি আসবে?

মেয়েটি কাঁপতে কাঁপতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বিপন্ন কন্ঠে বলল

জানিনা । উনি আমাকে বলেছিলেন আধঘন্টার ভেতর ফিরে আসবে। গিয়েছিলেন ভাংতি পয়সা জন্য। উনার কাছে গোঁটা পয়সা ছিল মাঝিরা নিতে চাইছিলো না। একটা বৃদ্ধা মহিলা ও তার দু নাতি ছিল। তাদের সাথে রেখে গিয়েছে। উনি যাওয়ার ঘন্টাখানেক পর বৃদ্ধাকে নিয়ে তার দু নাতি চলে যায়। আমি একা হয়ে পড়ি।

মেয়েটা কাঁদতে চাইছেনা কিন্তু কান্না আটকে রাখতেও পারছেনা। ভবিষ্যত আশঙ্কায় সে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। শাহজাহান সাহেব আরও একটি চুরুট ধরালেন। বললেন

তোমরা যাচ্ছিলে কোথায়?

নির্বোধের মতো তাকালো মেয়েটা।

নদীর ওপাড়েই যাচ্ছিলাম।

ওপাড়ে কোথায়?

মেয়েটার উত্তর দিতে পারলো না।

আজব মেয়ে তো তুমি। নিজের শ্বশুরবাড়ি কোথায় তা জানো না?

উনার তো বাড়িঘর নেই। উনার দুকূলে কেউই নেই। বিয়ের পর অন্য একটা গ্রামে চলে যাব শুধু এটুকু বলছিলেন আমায়। যাতে আমার চাচা খোঁজ না পায়।

তুমি তো আমাকে বিপাকে ফেলে দিলে মেয়ে। তোমাকে একা রেখে কিভাবে যায়। এসব জায়গা খারাপ । তার উপর তুমি যুবতী মেয়ে। লোকজন তো তোমাকে চোখে গিলে খাচ্ছে।

কথাটায় বোধহয় মেয়েটা অপমানিত বোধ করলো কিন্তু তা বোধগম্য হলো না শাহজাহান সুলতানের। মেয়েটার পায়ে লাল ফিতার জুতো। পায়ের অঙ্গুলি আলতায় রাঙানো। উনি মেয়েটাকে আপাদমস্তক দেখে বললেন

তোমার বাড়ির ঠিকানা বলবে?

না না।

তার আতঙ্কিত গলার স্বর বলে দিচ্ছে সে বাড়ি ফিরতে চায় না। আপনি চলে যান আমি উনার জন্য অপেক্ষা করব।

বোকা মেয়ে। কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? তুুমি বরং আমার সাথে চলো। আমি রূপনগরে যাচ্ছি। এখান হতে দুগ্রাম ফেলে রূপনগর। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের বলে যাই তুমি রূপনগরে সুলতান মহলে যাচ্ছ তোমার বর যদি এসে খোঁজ করে ওরা বলে দেবে তুমি রূপনগরে আছ।

অংশুমালীর বিদায়লগ্নকে সাক্ষী রেখে সদ্য বিবাহিত স্বামীর কথা ভেবে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বর্তমান ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা অনিশ্চয়তা উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিয়ে পিতৃসম মানুষটার কথায় মাথা দুলায় মেয়েটি। বলা হয়নি রক্তরঙে সজ্জিত, বিপদগ্রস্ত, স্বামীকে নিয়ে উৎকন্ঠিত মেয়েটির নাম অপরূপা। দেখতে সে তার নামের মতো হলেও জীবনটা তার রঙিন রূপ পেতে পেতে কেমন কুহেলিকাবৃত অন্ধকূপে ডুবে গেল।

ট্রলারে উঠে জড়সড় হয়ে এককোণায় হাত পা গুটিয়ে বসে সে রাতের খোলা আকাশ দেখে। চোখের কোল বেয়ে অহর্নিশ পড়তে থাকে অশ্রু। এমন একটা জ্যোৎস্না ভরা রাতে তার মাথাটা থাকার কথা ছিল স্বামীর বক্ষঃস্থলে। তার জীবনের মধুময় দিনগুলো আসার আগেই কেন অমাবস্যার রাত এসে ঝাঁপি নামায় সে জানে না।

মায়ের প্রথম সন্তান সে। এমন এক পূর্ণিমার রাত্রিরে মায়ের কোল আলো করে জন্ম নেয় সে। তার জন্মে কেউ খুশি ছিল না। সবাই আশা করেছিল একটা পুত্রসন্তান।
কারণ বাবা একজন অসুস্থ মানুষ। বুড়ো বয়সে বিয়ে করে তার মাকে।
বাবার কিছু হয়ে গেলে মা সন্তানের মুখ চেয়ে থেকে যাবেন এই ভেবে পুত্রসন্তান আশা করেছিলেন সকলে । কিন্তু অপরূপার জন্মে সবাই অসন্তোষ প্রকাশ করে। এমনকি জন্মদাত্রী মাও। একমাত্র দাদীজানই তাকে বুকে আগলে নেয়। তারপর বছর খানেকের মাথায় বাবা মারা যায় হৃদরোগে। মাকে বিয়ে দেয়া হয় অন্যত্র। দাদীর কাছেই সস্নেহে লালিত হয় সে। দাদীর চোখে অমূল্য রতন হলেও চাচা চাচীদের চোখে ছিল তার জন্য ভৎসনা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর বঞ্চনা। কার গরুকে কে খড় দেয়? তাদেরও অভাবের সংসার। তারপর দাদী মারা গেলেন। চাচার ঘরেই তার ঠাঁই হয়। তার বাবার সমুদয় সম্পত্তি তার আঠারো বছর হওয়ার পরপরই চাচা চাচী নিজেদের নামে লিখে নেয়ার চেষ্টা চালায়। সম্ভব হয় না। অপরূপা ততদিনে বুঝতে শিখেছে এদের সোজা রাখতে হলে সম্পত্তি ধরে রাখতেই হবে তাকে। পাড়াপড়শিরাও সাহস যুগিয়ে বলে তুই কত সম্পত্তির মালিক জানিস? তোর দেখভাল করার জন্য তোর দাদীজান ওদের ভাগের চাইতেও বেশি সম্পত্তি লিখে দিয়ে গিয়েছে।

অপরূপা সেই জোর দেখিয়ে টিকে থাকে চাচার সংসারে । তারপরও সারাদিন গাধার মতো খাটে। আর কপালে জোটে তিক্ত গালাগাল আর দুমুঠো ভাত। ছোটবেলায় মাকে একদিন চিঠি লিখেছিল সে। মা ফের চিঠি পাঠিয়েছিল। খুব খুশি হয়ে অপরূপা চিঠি খুলে পড়তেই অঝোরে কাঁদলো। মা লিখেছে তার সংসার জীবনে অপরূপার কোনো ঠাঁই নেই। সে যেন মাকে ভুলে যায়। তার জন্য তিনি নিজের সংসারে আগুন ধরাতে পারবেন না।

মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর আর পড়ালেখার কথা তুলতে পারেনা অপরূপা। দাদী থাকলে কলেজে পড়ার কথা বলতে পারতো। কলেজও খুব কাছে না। অনেক দূর। পড়াশোনার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে অপরূপা। বিয়ের সম্বন্ধ আসে রোজ। পাড়াপড়শিরা তার অভিভাবক। অপরূপা লোকসমাগমের আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। মানুষকে সে ভয় পায়। মিশতে ভয় পায়। সে ভীতু মেয়েটির ভালোবাসা, মায়ামমতাহীন জীবনে একদিন বসন্ত আসে।
এক বসন্ত বিকেলে তার বিষাদময় জীবনে আগমন ঘটে এক আগন্তুকের। জীবনের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণায় মুখ তেঁতো হওয়া অপরূপাকে যে বাঁচার স্বপ্ন বুনতে শিখিয়েছে সে কেন হুট করে তাদের জীবনের এমন পরিণয় লগ্নে এসে আড়াল হলো অপরূপার সত্যিই জানা নেই। তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। কেন সে একটুখানি সুখের দেখা পায় না। সুখপাখি ধরা দেবে বলে বলেও কেন ধরা দেয় না।

এই মেয়ে চিঁড়াদই খাবে?

অপরূপা চমকে উঠে চোখের জল লুকোনোর চেষ্টা করে। অপরূপার সামনে এসে বসে শাহাজাহান সাহেব। বলেন

আরেহ মেয়ে কাঁদছ কেন? বরের জন্য? বরকে খুব ভালোবাস বুঝি?

অপরূপা ঠোঁট টিপে কেঁদে মাথা দোলায়। সে ভালোবাসা কি জানে না। তবে মানুষটার সাথে সে সংসার করার স্বপ্ন দেখেছিল। তাদের টিনের চালের একটা ঘর হবে। ঘরের সামনেই একটি পদ্মপুকুর থাকবে। বৃষ্টির দিনে চালে পড়া বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে সে মানুষটার বুকে ঘুমাবে। পদ্মপুকুরে সাম্পান নিয়ে ঘুরে বেড়াবে সকাল-সন্ধ্যা। একসাথে রৌদ্দুর গায়ে মাখবে, একসাথে ভিজবে। কত সুখময় মুহূর্ত হয়ে উঠতো সেসব!

ওর সম্পর্কে কতটুকু জানো?

অপরূপা কেঁদে উঠে বলে,

যতটুকু জানলে একটা মেয়ে তার সাথে ঘর করার স্বপ্ন দেখে ততটুকু।

শাহজাহান সাহেব কি বলবেন খুঁজে পেলেন না। অপরূপার মাথা হাত বুলিয়ে বললেন,

কান্না থামাও। আমার সাথে সহজ হও। নাও চিড়াদই খাও। পথে খাব বলে নিয়েছি। আমি আবার খুব খাদ্যরসিক। তোমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে বেগমের হাতে বানানো মিষ্টি খাওয়াবো তোমার বিয়ে উপলক্ষে।

মানুষটার কথায় অপরূপার ঠোঁটের কোণায় ঈষৎ হাসির দেখা মিললেও তা আবারও নিভে গেল।

কেঁদো না। ব্যবসায়িক খাতিরে অনেকদূর পর্যন্ত আমার হাত রয়েছে। আমি তোমাকে তোমার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেব। আমার উপর বিশ্বাস রাখো।

স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে চিড়াদই মুখে দিয়ে অপরূপা জানতে চায়

আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?

সে এক বিশাল সামাজ্র্য আমার। গেলেই দেখতে পাবে।

চাঁদের আলোয় পানির ডুবডুবি আর খোলা আকাশ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লো অপরূপা। চমকে উঠলো শাহজাহান সাহেবের সাথে থাকা লোকলস্করের চেঁচামেচির আওয়াজে।

আইসা পড়ছি। এই ছেঁড়ি নাইম্যা পড়ো। অন্নেক ঘুমাইছো।

এ্যাই সুন্দর কইরা কথা বল।

কৃষ্ণ বর্ণের লোকটা লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকে বলল

জ্বি হুজুর। মাইয়্যাডারে নিয়া গেলে মা বেগমে কিছু কইবো না? কোথাকার মাইয়্যা? চেনা নাই জানা নাই।

তোদের মারে এই চিনছোস? সে কুকুর বিড়ালরে পর্যন্ত আশ্রয় দেয়। তোরেও তো দিছে। মতিবানুরেও তো দিছে। এই মেয়েটারেও দিবে। বেশি প্যাঁচাল না পেড়ে এসব নামা।

অপরূপা দুরুদুরু বুকে চোখ বুলালো নদীর পাড়ে। অনেক লোকজন। তার মাঝে সে এক অজানা অপরিচিত মানবী। পুরুষের গমগম গলার স্বর তার ভয় বাড়িয়ে দিল। তীক্ষ্ণ চোখ মেলে সে দেখতে লাগলো তার স্বামী নামক পুরুষটি এখানে নেই তো?

কি হলো নামো।

শাহজাহান সাহেবের পিছু পিছু নিজের পুঁটলিটা সাথে নিয়ে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ট্রলার থেকে নামার সময় ত্যাড়ছাভাবে পা পড়ায় পেরেকে পা কেটে গেল তার। আর্তস্বরে ‘ওমাগো’ বলে উঠতেই বাকিরা পিছু ফিরে তাকিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করলো।

শাহজাহান সাহেব এগিয়ে এসে মেয়েটাকে তুললেন। রক্ত গড়াচ্ছে। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,

অনেক রক্ত পড়ছে দেখি। এই কার কাছে পানি আছে। দ্রুত পানি আন।

অপরুপাকে ধরে উনি তীরে নামালেন।
মেয়েটার চোখমুখ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। যেন কোনো ব্যাথা নেই। উনাকে অস্থির হতে দেখে অপরূপা নিজেকে সামলে বলল

সামান্য রক্ত । কিছু হবে না। আপনি অস্থির হবেন না।

পানির বোতল নিয়ে এসে অপরূপাকে দিলেন উনি। অপরূপা ঢকঢক করে পানি খেয়ে শাহজাহান সাহেবের পিছু পিছু হাঁটা ধরে। মালামাল বহন করা একটা লোক এসে অপরূপার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে

হুজুর আপনি আগান। আমি এই ছেঁড়ির লগে আছি।

অপরূপা লোকটার দিকে তাকিয়ে কড়া চোখে তাকায়। লোকটার হাসিহাসি কপট চেহারা মুহূর্তেই মলিন হয়ে আসে। খানিকক্ষণের জন্য হলেও ভীডু হয়। তারপর ভাবে, হুজুরের আশ্রিত হয়ে যাচ্ছে তাও তেজ কেমন! সুযোগ পেলেই এর তেজ বাইর কইরা আনবে সে।

অপরূপাকে দাদী বলেছিলেন সবসময় শক্ত থাকতে। যাতে তাকে কেউ ভীতু না ভাবে। সে শক্ত থাকবে ভাবে কিন্তু পরক্ষণে মনটা তার দুর্বল হয়ে পড়ে। সে কান্না চেপে রাখতে পারেনা। দৌর্বল্য আপনা-আপনি প্রকাশ পেয়ে যায়।

অচেনা অজানা পিতৃতুল্য একজন মানুষকে ভরসা করে অপরূপা এগোতে লাগলো সামনের দিকে। জানা নেই এরপর কি হবে? কতদিনই বা আশ্রিতা হয়ে এই মানুষটার বাড়িতে থাকবে সে? অপরূপা ভাবতে ভাবতে সবার সাথে সাথে পৌঁছে যায় একটি প্রকান্ড বাড়ির সামনে। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা সাবেকী বাড়িটি ঘন সবুজ গাছগাছালি আর লতাগুল্মে আচ্ছাদিত। বাড়ির ভেতর থেকে কাজের লোকগুলো ছুটে এসে হাতাহাতি করে মালামাল আর জিনিসপত্র গুলো নিয়ে বাড়িতে ঢুকে।
মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় এক বধূ এসেছে বড় বাবুর সাথে। মেয়ে মহিলারা দরজার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায় হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে অপরূপাকে। এত গভীর রাতে এক দৃষ্টিনন্দন সুন্দরী কন্যা নিয়ে হাজির ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষটা। ফিসফিসানি শুরু হতে হতে অন্দরমহল পর্যন্ত গড়ায়। শাহজাহান সাহেবের স্ত্রী বেগম খোদেজা চেঁচায় আর বিলাপ করতে থাকে। এই বয়সে এসে এমন দিন দেখতো হলো? হে পরওয়ারদিগার তুমি আমায় তুলে নিলে না কেন?

সবাই অপরূপাকে দেখতে ব্যস্ত অপরূপা তখন মুগ্ধ চোখে বাড়িটির আনাচকানাচ দেখতে থাকে। এ যেন এক রহস্যপুরী!

চলমান……..

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে