প্রিয় বেগম ২ পর্ব-৩৬

0
730

#প্রিয়_বেগম
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ #পর্ব_৩৬
লেখনীতে পুষ্পিতা প্রিমা

প্রকান্ড, পরিত্যাক্ত, বড় বড় মাকড়সার জালে আবৃত অন্ধকারাচ্ছন্ন, অপরিষ্কার, বিশালাকার বাসভবনে বৃহদাকার কক্ষ। যার পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তান্ত্রিক জাদুকরদের অপশক্তি আর অপকর্মের দৃষ্টান্ত। দুষ্কর্মের নিদর্শন।
খাওয়ার পর ছুঁড়ে ফেলা ভাঙা মদের বোতল, বন্য পশুপাখির হাড়গোড়, ফোঁটা ফোঁটা রক্তের চিহ্ন, দুর্গন্ধ, মানুষরূপী্ জানোয়ারদের পদচারণা।

মজবুত লোহার শিকল দিয়ে দু’হাত দুদিকে বেঁধে অনবরত চাবুক মারা হয়েছে শেরহামের গায়ে। যে যেভাবে পেরেছে মেরে শোধ তুলেছে। রক্তাক্ত খঞ্জর শেরহামের সামনেই পড়ে আছে। সেই খঞ্জর দিয়ে তার উপর বর্বরোচিত হামলা, পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে পিঠে হাতে, বুকে। ফলসরূপ সাদা পাঞ্জাবি ক্ষরিত রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছে। তাকে যন্ত্রণা দিয়ে মৃত্যু দেবে এই তাদের একমাত্র ও অন্যতম উদ্দেশ্য।
তেষ্টায় শেরহামের গলা শুকিয়ে চৌচির। পানি পানি বলে কয়েকবার অস্ফুটস্বরে ডাকলেও কেউ সাড়া দেইনি। বরঞ্চ পানির বদলৌতে মদের বোতল বাড়িয়ে দিয়েছিল একজন মাতাল। তার মুখ বরাবর থুতু মারলো ঘৃণায় বিনিময়ে লাঠিপেটা খেতে হয়েছে।
অমানবিকভাবে গনপ্রহারের ফলে সামনের দিকে ঝুঁকে থাকা সেই তেজীয়ান মুখটা চুপসে যেতে দেখে অতি আনন্দে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে চন্দ্রলাল ও তার অনুসারীরা ।
সেদিনকার পরাগ পাহাড়ে হওয়া আকস্মিক বোমা হামলায় তার অর্ধপোড়া দেহ, আর আঘাতপ্রাপ্ত পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসে থামে শেরহামের সামনে। শেরহাম আধোআধো চোখ মেলে তাকায়। ঠোঁট নড়েচড়ে উঠতেই গাল হতে রক্ত গড়িয়ে মাটিতে পড়ে। মুখের ন্যায় রক্তাক্ত চোখদুটো দিয়ে ভয়ানক ক্রোধ, রাগ প্রকাশ পায়, গা ঝাঁকিয়ে উঠতেই লোহার শিকল নড়ে উঠে। চোখ দিয়ে ক্ষোভ ঝড়ে পড়ে। চন্দ্রলাল হাসতেই থাকে। শেরহাম গা ঝাঁকায় পুনরায়। গর্জন করতে থাকে। ভগ্ন কন্ঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠে,

‘ তোদের একটা উদ্দেশ্যও সফল হবে না। আমি মরতে ভয় পাইনা। মার আমাকে। আমার মেরে তোরা রূপনগর পাবিনা। সাহস থাকলে এককোপে মার। মার। ‘

তার বজ্রগম্ভীর স্বর কাঁপুনি ধরায়।
চন্দ্রলাল সাথেসাথেই আদেশ দেয়, ‘ এই তলোয়ার দে। এককোপে মা**থা আলাদা করব। ‘
বলতে বলতে তেড়ে গিয়ে শেরহামের মুখ বরাবর ঘুষি বসায়। মুখের দুপাশে চেপে ধরে বলে,
‘ তোর বাপ আমার ছেলেকে মেরেছে। তোর বুড়ো দাদা সবাইকে নগর ছাড়া করেছে। তোর বুড়ো নানা আমাকে লোকায়ত থেকে তাড়িয়েছে। আমাকে একমুহূর্তও শান্তি দেয়নি। সেখানে আমি তোকে লালন পালন করেছি পনেরটা বছর। তোকে যখন তোর বাপ চাচা মিলে বের করে দিয়েছে মহল থেকে সেদিন তোকে আমি আশ্রয় দিয়েছি। আমার নাতিকেও ততটা দীক্ষিত করিনি যতটা তোকে করেছি। তোর হাতে সবটা সপে দিয়েছি। আর তুই আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিস রূপনগরের সিংহাসন, রূপনগরের একচ্ছত্র দখলদারির। আমি তোকে সাহায্য করেছি, যোগ্য করে গড়ে তুলেছি। কিন্তু তুই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি ক্ষমতা পাওয়ার সাথে সাথে। যখন তোর সব পাওয়া হয়ে গেল তুই উল্টোসুরে গান গাইতে শুরু করলি। আমিই বোকা। আমার বুঝা উচিত ছিল তোর গায়ে শেরতাজ সুলতানের রক্ত বইছে। ভুলে গিয়েছিলাম তুই আমার ছেলের খুনীর ছেলে। তোকে সেদিন মেরে নগরের প্রবেশমুখে ঝুলিয়ে দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেদিন যা করিনি তা এবার করব। তোর লাশ ঝুলিয়ে দেব নগরের প্রবেশমুখে। নির্বংশ করে দেব সুলতান মহলকে। একটা জীবকেও বাঁচিয়ে রাখবো না। তোর সব মা বোনকে এখানে এনে হাজির করব। সব কটার সামনে তোর লাশ পড়বে। আমি উল্লাস করব।’
বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে। বাসভবন কাঁপিয়ে হাসলো তার অনুসারীরা। তলোয়ার শান দেয়ার বিরাট আয়োজন চলছে। শেরহাম তার সব কথা শোনার পর কটাক্ষ করে হাসে। হাসতেই থাকে উচ্চৈস্বরে। তার হাসি দেখে ভড়কে যায় সকলে। হাসতে হাসতে একসময় শক্ত হয়ে উঠে শেরহামের মুখমণ্ডল। সুযোগ বুঝে লাথি বসায় চন্দ্রলালের মুখ বরাবর। চন্দ্রলাল ধপাস করে গিয়ে দূরে ছিটকে পড়ে। তার অনুসারীরা এসে শেরহামকে মারতে থাকে। শেরহাম হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে,

‘ আমি মরার আগে তোদের সমূলে উৎপাটন করব। আমার হাত থেকে তোদের নিস্তার নেই। তোর ছেলেকে আমার বাপ খুন করেছে, তোকে আর তোর নাতিকে খু*ন করব আমি। পারলে আমায় মেরে দেখা। ‘

গুলজারের আগমন ঘটলো। তার ক্ষোভমিশ্রিত চেহারা, দানবের মতো চাহনি দেখে শেরহাম গা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ সাহস থাকলে আমাকে ছেড়ে সম্মুখযুদ্ধ কর। আর নয়ত বুকে সোজা তলোয়ার চালা। ‘

গুলজার জিভ দিয়ে আফসোসের সহিত চ্ চ্ শব্দ করে হেসে বলল

‘ তিলে তিলে মরা অনেক কষ্টের না? কষ্ট হচ্ছে? আহারে। তোর বউ বাচ্চা তো সব আগুনে পুড়ে মরেছে। তাদের কাছে যাবি? ‘

শেরহামের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। না, তনীর কিছু হতে পারেনা। তনী আর তার বাচ্চা সুস্থ আছে। সে বিশ্বাস করেনা এদের কথা।
তার পায়ের কিছুটা দূরে মদের বোতলের ভাঙা অংশ ছিল। সে পা দিয়ে সেটি ছুঁড়ে মারলো। গুলজারের বুকের একপাশে গিয়ে খাপ করে গেঁথে গেল সেটি। সাথে সাথে সেটি তুলে নিয়ে শেরহামের দিকে ছুঁড়ে মারলো গুলজার। শেরহামের বুকে গিয়ে ঠেকলো সেটি । চোখ খিঁচিয়ে নিল সে।
ফুটো করে দিয়ে ঝড়ে পড়লো ভাঙা অংশটি। সেই ফুটো দিয়ে রক্ত গড়ানো শুরু করলো। গুলজার এগিয়ে এসে শেরহামের গলা চেপে ধরলো শক্ত করে। খেঁকিয়ে খেঁকিয়ে বলতে লাগলো,

‘ তোর ভাই আসার অপেক্ষা। সবাইকে তোর সামনে মারবো। তোকে দেখিয়ে দেখিয়ে মারবো। তোর বউ বাচ্চা বুড়ো নানাকে মেরেছি। এবার তোর ভাইদের মারব, তারপর তোর বাপের মাথা কা**টবো কু*চিকু*চি করে। তোর জন্য তোর বাপকে মারিনি কিন্তু এবার ওই বুড়োকে ছাড়বো না। সে আমার বাপকে মেরেছে। একটাকেও ছাড়বো না আমি। ‘

শেরহাম হাত দুটো ঝাঁকালো শিকল মুক্ত হতে। রক্তগরম কন্ঠে বলল,

‘ কিচ্ছু করতে পারবি না। ‘

গুলজার গর্জন করে বলল,

‘ এই এই মা** বাচ্চা যাতে কথা বলতে না পারে সেই ব্যবস্থা কর। শুধু যাতে চোখ মেলে চেয়ে থাকতে পারে। মুখ বন্ধ করে দে একেবারে। ‘

মোটা লাঠি হাতে শেরহামের দিকে তেড়ে গেল সবাই। পেটাতে থাকে অবিরত। জোরালো আঘাতে বলিষ্ঠ দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
শ্রবণশক্তি, বাকশক্তি, দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে বসে শেরহাম। চারপাশ অন্ধকার দেখে সে। কোনোকিছু তেমন শুনতে পায় না। শুধু সেই ছোট্ট শিশুর কন্ঠস্বর কানে বাজতে থাকে প্রবলভাবে। চোখে ভাসে তটিনীর কান্নামিশ্রিত প্রসববেদনায় যন্ত্রণাদগ্ধ কাতর চেহারা। নেতিয়ে পড়ে সে সামনের দিকে। মুখটা নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে। শরীরের ভার ছেড়ে দিতেই হাত দুটো আটকে থাকে লোহার শিকলে। ঝুঁকে থাকা মুখ হতে নির্গত রক্ত চুইয়ে চুইয়ে মাটিতে পড়তে থাকে।
চাকু বসানো অংশগুলোতে ইচ্ছেকৃতভাবে আঘাত করতে থাকে সকলে মিলে। এক পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠে সকলে।
পাপের ফল, শতশত মানুষের অভিশাপ, অন্যায়, অত্যাচার, অসহায়ের উপর নিপীড়ন, আপন-মানুষদের দীর্ঘশ্বাস, সবকিছুর বিনিময়ে সে এই মৃত্যুকে আপন করে নিতে বদ্ধপরিকর। সে জানে কিভাবে মহলে আগমনের পূর্বে শেহজাদকে খু**ন করার প্রয়াস চালিয়েছিল সে। কতভাবে তাকে অপদস্ত করতে চেয়েছে। কতশত পরিকল্পনা করে ক্ষমতাধর হতে চেয়েছে। মন যা চেয়েছে তাই করেছিল সে। ভালোমন্দ বাছবিচার করেনি। বোকা, সহজ-সরল অপরূপাকে ব্যবহার করে প্রতিহিংসার জোরে নিজের ছোট ভাইকে পরাস্ত করতে চেয়েছে। অপরূপার দাদীজানের মৃত্যুর কারণ সে। এমন অনেক নিরাপরাধ মানুষকে ডাকাতি করতে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সে। এত এত মানুষের অভিসম্পাত তাকে মৃত্যুর কাছে টেনে এনেছে। তার ধ্বংস যেখানে অনিবার্য, সেখানে একজনের কথা ভেবে আজ তার জীবনের দিকে এগোতে ইচ্ছে করছে। যে মেয়েটি তার বিদ্বেষী রূপকে ভালোবেসে নিজের করে আগলে রাখতে চেয়েছে, সত্যি মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে শিখিয়েছে, আলো-আঁধারের পার্থক্য চিনিয়েছে, জীবনের দিকে আহ্বান করেছে সেই মেয়েটির কথা ভেবে তার কঠোর, বর্বরতা, পাশবিকতায় মোড়া হৃদয়টা আজ কাঁদছে। যদি সুযোগ হতো সে ক্ষমা চেয়ে নিত অপরূপার কাছ থেকে। যার সাথে সে প্রতারণা করেছিল। ভালোবাসার নামে ছলনা করেছিল। ক্ষমা চেয়ে নিত তনীর কাছ থেকে। যে তাকে অন্ধের মতো ভালোবেসেছে। তার সব অপকর্মের কথা জেনেও পিছপা হয়নি। তার দুঃখে ব্যথিত হয়েছে। তার কষ্টে যে মেয়েটার চোখ দিয়ে জল গড়িয়েছে সে মেয়েকে সুখ দিতে পারেনি।
একজনকে ভালোবাসার নামে ঠকানোর মূল্য আজ তাকে চুকাতে হচ্ছে, অন্যজনকে চুকাতে হচ্ছে তার মতে আঁধার মানবকে ভালোবাসার জন্য। তার সন্তানের জননী হওয়ার জন্য।
এই দুই মানবীর কাছে সে অপরাধী। অপরাধী তার সদ্য সন্তানলাভ করা সন্তানের কাছে। যার আগমন বার্তা সে শুনেছে কিন্তু ছুঁয়ে দেখতে পারেনি। যার গায়ে অমানুষের বাচ্চার কালিমা সে মুছে দিতে পারেনি। শেরহামের চোখের কিনারা বেয়ে কপাল হতে নির্গত রক্ত ঝড়তে থাকে অশ্রুর মতো। ঝাপসা ঝাপসা চোখের পাতায় শুধু একটা প্রিয় মুখ ভাসে।

গুলজার আর চন্দ্রলাল তলোয়ারে তলোয়ারে ঘষে আওয়াজ তোলে। হাসিতে ফেটে পড়ে বলে,

‘ তোর রক্ত দিয়ে তোকে গোসল করাবো আজ। ‘

শেরহাম চোখের আলো নিভে আসে। দেহের ভার ছেড়ে দেয় সে।

_____________

সুউচ্চ কালো রঙের পাহাড়ে যেন ঢাকা পড়েছে আকাশ। জঙ্গলের পথ পাড়ি দেয়া শেষ হতেই পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ তাকাতেই শুধু চোখে পড়ে ভয়ংকর কালো পাহাড়। তাকাতেই মনে হয় যেন তেড়ে আসছে পিষে ফেলতে। সেই পাহাড় হতে উদ্ভট শব্দ, আওয়াজ ভেসে আসে ক্ষণে ক্ষণে। মাংসাশী প্রাণীদের বেওয়ারিশ হাঁকডাক আর রাতের আঁধারে ডাকা হুতুমের ডাক স্পষ্ট কানে লাগছে। মশাল হাতে সৈন্য-সামন্তের ঘোড়াসহ জঙ্গল পেরিয়ে মরানদীর দিকে এগোতে লাগলো সকলে। চালাকি করে নদীর পাড়ে কোনো সৈন্য-সামন্ত রাখেনি তারা। যাতে সকলেই নদী পার হয়ে তাদের আস্তানায় পথে পা রাখে। শেহজাদ বুঝতে পারলো বিষয়টা। সে ভেবেছিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হবে নদীর পাড়ে। তাই সে পুনরায় সাবধান করলো সবাইকে। সবাইকে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তে বারণ করেছে। ভাইজানের অবস্থান জানার পর আক্রমণ করতে হবে। তার আগ অব্দি অনেক সতর্ক থাকতে হবে।
সৈন্যরা তার আদেশ মাথা পেতে নিল। যেই ডাকাত গুলোকে শেরহাম সেদিন মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে রেখেছিল গলা অব্দি মাটি দিয়ে, সেদিন শেহজাদ তাদের প্রাণভিক্ষা দিয়েছিল এই বলে তারা আজীবন শেহজাদের পক্ষে থাকবে। সত্যের পক্ষে আর কোনোপ্রকার অন্যায়, অবিচার, খুন জুলুম করবেনা। তারা প্রাণভিক্ষা পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেহজাদের বশ্যতা স্বীকার করে নিল। নয়ত নগরের মানুষের পাথর ছোঁড়ায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভয়ানক মৃত্যু হতো তাদের। আজ তারাও আছে শেহজাদের সৈন্যদের সাথে।

ঘাটে রাখা নৌকাগুলিতে উঠে পড়লো সকলে। পানির ঢেউয়ের সাথে পঁচা পানির দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে কাঠের নৌকাগুলি এগিয়ে চলেছে ডাকাত আস্তানার পথ ধরে। সৈন্যরা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শেহজাদের মন ব্যাকুল হয়ে আছে ভাইজানের জন্য, অপরদিকে মহলের জন্য। রূপার কি জ্ঞান ফিরেছে? বাচ্চাদের দেখেছে সে? কোনো বিপদ যদি হয়? সৈন্যরা তো সকলে চলে এসেছে তাদের সাথে। তাঈফ, আব্বা, আর বড়চাচা কি রুখে দাঁড়াতে পারবেন? কোনো ডাকাত সৈন্য যদি নগরে কোথাও লুকিয়ে থাকে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে শেহজাদের মস্তবড় ভুল হয়ে গেল। যদি কোনো সৈন্য আড়ালে থাকে তাহলে তো ঘোর বিপদ। ঘন কৃষ্ণবর্ণ আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বুঁজে সে। খোদাতায়ালার উপর অঢেল বিশ্বাস আছে তার। তিনি তার বান্দাদের হতাশ করেন না।
নৌকা থেকে নেমে আস্তানার দিকে এগুতেই অকস্মাৎ অতর্কিত বোমা হামলা চালায় ডাকাত বাহিনী। সৈন্যরা সবাই ছিটকে পড়ে একেককজন একেকদিকে। ধোঁয়ার কবলে পড়ে সাফায়াতও ছিটকে পড়ে দূরে। খুকখুক করে কেশে উঠে সে। ধোঁয়ায়, পোড়া গন্ধে সে নিঃশ্বাস নিতে পারেনা। চোখ তুলে দেখে হাঁটুঅব্দি পোশাকে ত্রিশূল হাতে ছুটে আসছে কয়েকজন নরদানব। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। পিঠে গাঁথা তলোয়ারের খাপ হতে তলোয়ার বের করতে তাক করে বলে,

‘ এগুলে লাশ পড়বে তোমাদের? ‘

তারা এগিয়েই এল। বালির মতো কিছু একটা সাফায়াতের দিকে ছুঁড়ে মারে আর সাথে সাথেই চোখে অন্ধকার দেখে সাফায়াত। সকলেই তেড়ে আসে তার দিকে।

_________

অপরূপা অবাকচোখে চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চা দুটোকে আলতোহাতে ছুঁই। আদর করে। তাকিয়ে দেখে অপলক। তারপর কি যেন হয়! চোখ সরিয়ে অনুপমার বুকে পুনরায় মুখ গুঁজে বলে, ‘ ওরা কত ছোট দেখো। আমি এই দুটোকে কি করে মানুষ করব আম্মা? ‘

অনুপমা তার মাথায় হাত বুলায়। বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে। খোদেজা বলে উঠে,
‘ এসব কেমন কথা? মহলে কি মানুষের অভাব আছে? ওরা ওদের আব্বার মতো শান্তশিষ্ট হবে । তোমাকে পালতে কষ্ট করতে হবে না। আর আমি আছি কেন? ‘

অপরূপা অনুপমার বুকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপায়। ওখানে ওই মানুষগুলো সব কেমন আছে কে জানে? কি যুদ্ধ চলছে সেখানে। তার তো মন মানছেনা এখানে। ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। তারা না থাকলে কি করবে এই নগর দিয়ে, এই মহল দিয়ে? শরীরের ব্যাথার সাথে সাথে অপরূপার বুক ব্যাথা বাড়ে তার। তীব্র হাঁসফাঁস লাগে। দমবন্ধ লাগে।

মহলে এত রাত্রিরে হঠাৎই এক মানব এসে হাজির হয়। তাঈফ নাদিরকে এত রাতে দেখে অবাক হলো। নাদির জানালো জাহাজের এক যাত্রীর মাধ্যমে সে জানতে পেরেছে মহলের এমন দুরাবস্থার কথা। নানাজান মানুষটার অল্প সময়ের সাক্ষাৎ । অল্পসল্প কথাবার্তা হয়েছিল। মানুষটা নাকি মারা গিয়েছেন। জানাজাও পেল না সে। তাঈফ তাকে সবটা আরও ভালোকরে বিশ্লেষণ করলো। শাহজাহান সাহেব, আর শেরতাজ সাহেব অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন। নাদিরকে পেয়ে বললেন নদীপথে ওই জঙ্গলের দিকে যাওয়া যায় না বাবা? যদি যাওয়ার পথ থাকে তাহলে আমাদের নিয়ে চলো। এখানে দমবন্ধ লাগছে, আর পারছিনা। আমার কথাটা রাখো।

নাদির ফজল সাহেবের কাছ থেকে সবটা জেনে নিল ভালো করে। হঠাৎ বলল, হ্যা আছে পথ। স্থলে গেলে সময় কম লাগে। জাহাজে সময় একটু বেশি লাগবে। কে কে যাবেন?

শেরতাজ সাহেব বললেন, আমরা সবাই যাব। মেয়েরা থাকবে এখানে। শাহাজাহান সাহেব বলেন,
‘ কি বলছো ভাইজান? মেয়েদের এভাবে একা রেখে যাওয়া যাবে না। ওদের যদি কোনো বিপদআপদ হয়?’

সোহিনী সায়রা খবর পেয়ে ছুটে আসে। কেঁদেকেটে বলে, তারাও যাবে। এখানে বসে অপেক্ষা করা যায় না। সময় ফুরোয় না। তটিনী শোহরাবকে বুকে নিয়ে বসা ছিল। সিভানের মাধ্যমে সে কথা শুনে সেও আবদার করলো যাবে। এমনকি হেঁটে হেঁটে চত্বরে চলে এল। কাঁচা নাভি হওয়ায় শাহানা তাকে কতকরে বারণ করলো না হাঁটতে। সে কথা শুনছেনা। তার মন মানছেনা। তার ভেতরে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে সে ছাড়া কেউ বুঝবে না। কেউ বুঝবে না যে মানুষকে নিজের চোখের সামনে ভালোবাসা দিয়ে একটু একটু করে মানুষে পরিবর্তন করেছে সে তাকে হারাতে দেখা কতটা কষ্টের। সবাই ভালোবেসে প্রেমিক বানায়, সে বানিয়েছে মানুষ। আর এই মানুষ নিজে যতটা পুড়ে, তার চাইতেও বেশি পোড়ায় তাকে। সবার যাওয়ার কথা শুনে তটিনীর পাগলামির সীমা থাকেনা। শোহরাবকে দেখিয়ে বলে,

‘ ওকে নিয়ে যাও তবে। ওর আব্বার সাথে একবার দেখা করাও। এতবড় আফসোস নিয়ে আমার বাচ্চাটা কিভাবে বাঁচবে আম্মা? আমার জন্য ওকে ধরা পড়তে হলো। নইলে ও ঠিকই ওদের ধ্বংস করার ফন্দি আঁটছিলো। আমার জন্য ওকে আজ মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হয়েছে। আমাকে ভালোবেসে ওর আজকে এই দশা। ওর বাচ্চার মুখ না দেখলে অনেক বড় আফসোস থেকে যাবে ওর। দয়া করো,আমাকেও নিয়ে চলো। ‘

শাহানা তাকে জড়িয়ে কপালে আদর করে বলল,
‘ আচ্ছা কেঁদোনা। দেখো তোমার বাচ্চা কিভাবে কাঁদছে মায়ের সাথে সাথে। ‘

শাহজাহান সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন সবাইকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো অপরূপাকে নিয়ে। দুটো বাচ্চা জন্মদান করার পর তার শরীর নিস্তেজ। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু নেই। তাকে কি করবে?
অপরূপা সায়রার মুখ থেকে সবটা শুনে নিজে নিজে দাঁড়িয়ে পড়লো। পোশাক পাল্টে, মাথায় হিজাব জড়ালো। একটা বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে পিঁপড়ের পায়ে হেঁটে বলে,

‘ আমিও যাব। থাকবো না এখানে। যা হবার হোক।’
খোদেজা স্তব্ধ চোখে চেয়ে থাকে। শেষমেশ সকলেই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। পুরো মহলের সবাই জাহাজে করে রওনা দেয় সেই জঙ্গল আর কালো পাহাড়ের দেশে। পুরুষেরা মরা নদীর পাড়ে যাবে আর মেয়েরা সকলেই জাহাজে অবস্থান করবে এই ছিল কথা।

________________

বৃহদাকার সেই অর্ধপোঁড়া বাসভবনের প্রকান্ড একটা মৃত্যু পুরীর ন্যায় কামরায় মুখ থুবড়ে পড়ে সাফায়াত। চোখে অসংখ্য বালি পড়ায় চোখ মেলতে কষ্ট হয়। কোথাও প্রচন্ড গোলাগুলি চলছে। সাথে হৈচৈ, আগুনে পোড়ার গন্ধ, পেট্রোলের গন্ধ। সাফায়াত আধোআধো চোখ মেলে দেখে তার কিছুটা দূরে পড়ে আছে শেহজাদ। নাক, ঠোঁট, আর কান দিয়ে অঝোর রক্ত নির্গত হচ্ছে ভাইজানের। সে চিৎকার দিল, ‘ ভাইজান! ‘

সম্মুখে চোখ পড়তেই শক্ত হয়ে জমে গেল সে লাল রক্তে রঞ্জিত লোহার শিকলে বন্দি ঝুলে থাকা মানবটিকে দেখে। চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই সে বড় ভাইজান। সাফায়াত আর্তস্বরে ডাকলো,

‘ ভাইজান! হায় আল্লাহ এ কেমন পরীক্ষা আপনার। ‘

চলমান…

রিচেক হয়নি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে