তোমায় পাবো বলে পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

1
1811

#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৪০ (অন্তিম পর্ব)
#নিশাত_জাহান_নিশি

পরীক্ষার বাহানায় দীর্ঘ এক মাস পরশকে ছাড়া থাকতে হয়েছে আমার। এই একটা মাস অতি যন্ত্রণাময় এবং খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে পাড় করেছিলাম আমরা দুজনই। আবার ও সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে আমি এবং পরশ এক হতে সমর্থ হয়েছি! আজই পরশের সাথে আমি ঢাকা ফিরেছি!

প্রেগনেন্সির আড়াই মাস চলমান। কাজে, কর্মে, চলতে ফিরতে যদি ও তেমন কোনো সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে না, তবে খাওয়া দাওয়ায় বড্ড অনীহা এবং অরুচি আমার! জিহ্বায় স্বাদের কোনো বালাই নেই। যাই মুখে তুলছি তাই যেন পাকস্থলী নিংড়ে অম্লস্বাদ হয়ে বের হচ্ছে। এই বিষয়টিতে পরশের পাশাপাশি মা ও ভীষন চিন্তিত। ডাল-ভাত চটকে খাওয়া ছাড়া জিহ্বা আর কোনো স্বাদ গ্রহনই করতে পারছে না। পুষ্টিকর সঠিক খাবারের অভাবে শরীর ক্রমাগত আমার শুকিয়ে কাঠের লাকড়িতে পরিনত হচ্ছে। অন্যদিকে নিদ্রা ভারী হয়ে উঠছে প্রতিদিন নিয়ম করে! আড়াই মাসে পড়তেই যে আমার শরীরের এতটা অবনতি ঘটবে, তা নিতান্তই অপ্রত্যাশিত ছিল আমাদের প্রত্যেকের কাছে! রাত ১০ টা বাজতেই আঁখি যুগলে আমার অবাধ্য সুপ্তি পরীরা হানা দিচ্ছে। আর তখনই কোনো কাল বিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গেই আমার ঘুমিয়ে পড়তে হচ্ছে। অলসতা করলেই পরে শরীরে অবসন্নতা দেখা দিচ্ছে। মেজাজ খিটখিটে এবং চড়া হয়ে উঠছে। যার প্রভাব পড়ছে সম্পূর্ণ পরশের উপর। এই তো, আজ একটু আগের ঘটনা। কুমিল্লা থেকে ফিরেছি এক সপ্তাহ হলো। এই এক সপ্তাহে এক রাতে ও আমি পরশের ধারে কাছে ঘেঁষি নি! অফিস থেকে তিনি ফিরতে ফিরতেই প্রতি রাতে আমি দশটা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়ছি। লোকটির সাথে নীরবে, নিভৃতে দু’একটা প্রেম মাখানো কথা বলছি নি পর্যন্ত। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে লোকটি ক্লান্ত শরীর নিয়েই নিজ হাতে খাবার বেড়ে খেয়ে নিচ্ছেন! ঘুমিয়ে পড়ছি বলে আমার অসুবিধে করে ঘুম থেকে আমায় জাগিয়ে তুলতে চান নি। আজ ও ঠিক হয়েছে তাই! দশটা বাজতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খুব গভীর ঘুম। যে ঘুমে দরজা ঠেলে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি রুমে প্রবেশ করলে ও টের পাওয়া যায় না ঠিক সেই ঘুম। ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ অনুভব হয়েছিল কেউ আমায় বলিষ্ঠ শরীরে ঝাপটে ধরে আমার সমস্ত মুখমন্ডলে গাঢ় চুম্বন করছিল! সেই লোকটির নাক থেকে নিঃসৃত তপ্ত শ্বাস আমার সমগ্র মুখমন্ডলে কম্পন সৃষ্টি করছিল। লোকূপদ্বয়কে সূচালো ভাবে জাগিয়ে তুলছিল! অতি উত্তেজনা এবং ঘোর আতঙ্কে এই বার আমার গভীর ঘুম ভেঙ্গে উঠতেই হলো। বিস্ময়াত্নক এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়ল পরশের উপর। ঠোঁটের আলিজে ক্রুর হাসি ফুটিয়ে পরশ আমার ঘাঁড়ে মুখ ডোবানোর চেষ্টায় অটল হয়ে বললেন,,

“আজ কোনো বারণ শুনছি না আমি। কিছুক্ষনের জন্যে হলে ও আমায় আপন করে নিতে হবে! তোমার সঙ্গ এই মুহূর্তে আমার ভীষণভাবে প্রয়োজন।”

কি হলো জানি না! সাংঘাতিক রাগ চেঁপে বসল মাথায়! এক ঝটকায় পরশকে গাঁয়ের উপর থেকে সরিয়ে আমি বিছানার অপর প্রান্তে ছিটকে ফেললাম! নিজে ও হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম! তাৎক্ষণিক ব্যগ্র দৃষ্টিতে দাঁতে দাঁত চেঁপে পরশকে শাসিয়ে বললাম,,

“দেখছেন না? শরীর খারাপ আমার? তবু ও কেন জোরাজোরি করছেন?”

পরশ তাজ্জব বনে গেলেন! নির্বাক নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আমার রাগান্বিত আঁখিদ্বয়ে তাকিয়ে রইলেন। কিয়ৎক্ষণ একই দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে তিনি হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে হনহনিয়ে ব্যালকনীর দিকে গতি নির্ধারন করলেন! কিছু মুহূর্ত পর ব্যালকনী থেকে সিগারেটের উগ্র গন্ধ বাতাসের সঙ্গে আমার নাকে ভেসে আসছিল! সঙ্গে সঙ্গেই নাক সিঁটকে এলো আমার। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না, লোকটি ধূমপান করছেন। কম রাগে, অভিমানে লোকটি নিশ্চয়ই পুরনো অভ্যেসটি আবার নতুনভাবে শুরু করেন নি! ভুল কিছু আমার ও ছিল। ঘুমন্ত মস্তিষ্ক একটু সচল হয়ে উঠতেই আমি উপলব্ধি করতে পারলাম, যা করেছি আমি সত্যিই ভুল করেছি! স্ত্রী হিসেবে স্বামীর ইচ্ছে, চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা, মনমর্জি বুঝার উচিত ছিল আমার। মাঝখানে দীর্ঘ এক মাস তিনি আমায় ছাড়া থেকেছেন। অল্প সময়ের জন্যে ও কাছে পান নি। কুমিল্লা থেকে ফেরার পরে ও প্রায় এক সপ্তাহ লোকটির ধারে কাছে ঘেঁষি নি আমি। স্বাভাবিক ভাবেই আমার করা একটু আগের অস্বাভাবিক আচরনে পরশের কষ্ট পাওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল!

হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেই নিজেকে বকতে আরম্ভ করলাম। ইচ্ছে করছে বাঁ হাত দিয়ে ডান গালে ট্রাস ট্রাস করে সজোরে দুটো চড় বসাতে। তবে যদি একটু শিক্ষে হয় আমার। ভারী অপদার্থ আমি। নিজের হাতে এমন দু’চার ঘাঁ না খেলে এই জীবনে শুধরাবার মেয়ে আমি নই! এসব আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতেই রাগান্বিত পরশের পাশাপাশি দাঁড়ালাম আমি। আমার অস্তিত্ব টের পাওয়া মাত্রই পরশ ব্যালকনীর গ্রীল থেকে হাতটি সরিয়ে সিগারেটটা দু ঠোঁটের মাঝখানে চেঁপে ধরে স্থান পরিত্যাগ করলেন! রাগে বিষধর সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছেন তিনি। ভয়ে এবার অন্তর আত্তা কেঁপে উঠল আমার। না জানি আজ সত্যি সত্যিই আমার পিঠে দু’চার ঘাঁ পড়ে!

শুকনো ঢোক গলাধঃকরণ করে আমি মন্থর গতিতে হেঁটে চললাম পরশের পিছু পিছু। সিগারেট মুখে নিয়ে লোকটি পুরো রুম জুড়ে পায়চারী করছেন। নাক দ্বারা ফোঁস ফোঁস শব্দে রাগ নির্গত করছেন! আমি ও হন্ন হয়ে লোকটির পিছু পিছু পায়চারী করছি। এইভাবে প্রায় দু, তিন মিনিট কেটে যাওয়ার পর বিষয়টি পরশের চোখে পড়ল! পিছু ফিরে লোকটি অতি তীক্ষ্ণ এবং সূচালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই আমি আতঙ্কে গলা ঝেঁড়ে কম্পিত দৃষ্টিতে লোকটির দিকে চেয়ে বললাম,,

“স্যরি!”

কপাল কুঁচকানোর পাশাপাশি লোকটি ভ্রু যুগল ও খড়তড় ভাবে কুঁচকে নিলেন! অতঃপর আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“কেন?”

মাথা নুইয়ে আমি কাতর গলায় বললাম,,

“একটু আগের করা নির্বোধ ব্যবহারের জন্য!”

তড়তড় করে যেন পরশের রাগটা আর ও গাঢ় গভীর হয়ে উঠল! হাতে থাকা সিগারেটটি তিনি মেঝেতে ছুড়ে ফেলে আমায় উপেক্ষা করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। বিষন্ন মনে আমি কিছুসময় পরশের বিদীর্ণ মুখমন্ডলে তাকিয়ে রইলাম। রুমের লাইট অফ করে বিছানায় নিজের স্থান দখল করে নিলাম। পরশের পাশ ফিরে শায়িত হতেই পরশ উল্টো পাশ ফিরে মাথা অবধি কাঁথা টেনে নিলেন! কিছুতেই যেন আমার মুখ দর্শন করবেন না তিনি! জনাবের ভীষণ গোশশা হয়েছে! এখনই যদি এই গোশশা ভাঙ্গানো না যায় তবে আগামী কয়েকদিনে ও বোধ হয় এই গোশশা ভাঙ্গানো যাবে না। ভালোবাসায় কাতর হয়ে আমি একটু একটু করে পরশের গাঁয়ের সাথে ঘেঁষে শুলাম। পরশ কোনো প্রতিক্রিয়াই করলেন না। মনে হলো যেন আমার অস্তিত্বই উনার আশেপাশে নেই! আর ও কিছুটা সাহস সঞ্চার করে আমি আরেকটু এগিয়ে পরশকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতেই পরশ ঝাঁঝালো গলায় বললেন,,

“ছাড়ো বলছি টয়া! সিরিয়াসলি বিরক্ত লাগছে আমার!”

“উঁহু! কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। একটু ও বিরক্ত লাগছে না আপনার! আমার প্রতি রেগে আছেন বলেই আপনি ভালো লাগার অনুভূতি গুলোকে অস্বীকার করছেন। কি ভেবেছেন? আমি কিছু বুঝতে পারব না?”

“অনেক বুঝেছ আমায়! দয়া করে আর বুঝতে হবে না। ঘুমুতে দাও প্লিজ। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখো আমার থেকে!”

পরশের এত রাগান্বিত অভিব্যক্তির বিপরীতে ও আমার তেমন ভাবান্তর হলো না! পরশকে আর ও জোরালো ভাবে ঝাপটে ধরে আমি অতি প্রেমমাখানো স্বরে বললাম,,

“কিছুতেই আজ আপনাকে ছাড়ছি না আমি! আমার এই প্রেমময়ী আবেদনে আপনাকে আজ সাড়া দিতেই হবে! পূর্ণ সিক্ত হতে চাই আপনার ভালোবাসায়। যতটা সিক্ত হলে আপনার প্রতি দিন দিন আমার আসক্তি বাড়বে! নেশার মত টানবে!”

এক হেচকা টানে আমি লোকটির মুখমন্ডল থেকে কাঁথাটি সরিয়ে নিলাম! অমনি পরশ টগবগে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। কিছুতেই যেন লোকটির মন গলছে না। রাগটা ও বিন্দু পরিমান হ্রাস হচ্ছে না। মুখ ফুলিয়ে আমি আহ্লাদী গলায় লোকটিকে শুধিয়ে বললাম,,

“বাচ্চার মায়ের উপর এত রাগ দেখালে চলবে? আপনার মেয়ে কিন্তু সব দেখছে! বাবাকে খারাপ মনে করছে। খারাপ বাবা হতে চান আপনি?”

দৃষ্টিতে মিশ্রিত তুখাড় রাগান্বিত ভাবটি যেন কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই পরশের কোথাও উধাও হয়ে গেল! প্রবল মায়াসিক্ত দৃষ্টিতে লোকটি অবিশ্বাস্যভাবেই আমায় দুহাতে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলেন! ধীর গলায় আমার বাঁ কানে ওষ্ঠদ্বয় ঠেঁকিয়ে বললেন,,

“আমি খারাপ বাবা হতে চাই না বউ! আমি তো আমার মেয়ের খুব ভালো বাবা হতে চাই। আমার মেয়ের জন্য আমি সব রাগ বিসর্জন দিতে পারি। এমনকি তোমার হাজারটা ভুল ও মাফ করে দিতে পারি!”

মৃদ্যু হাসলাম আমি। লোকটির সমস্ত মুখমন্ডলে অসংখ্য চুমো খেয়ে মন্থর গতিতে লোকটির কানে লোমহর্ষক গুঞ্জন তুলে বললাম,,

“ভালোবাসি জনাব! প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই ভালোবাসি। যতটা ভালোবাসলে আল্লাহ্ র কাছে সন্তুষ্ট থাকা যায়, আমি আপনাকে ঠিক ততোটাই ভালোবাসি!”

আচম্বিতেই পরশ আমার বাঁ কানের লতিতে হালকা কামড় বসিয়ে বললেন,,

“তোমাকে তো আমি ভালোই বাসি না! তুমি হলে আমার সহজাত প্রবৃত্তি! আমার স্বভাবে মিশ্রিত এক অপরিমেয় সু-স্বভাব! আমার বুকের বাঁ পাশটায় বরাদ্দ করা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, তুমি আমার উষ্ণ রক্তের সঙ্গে মিশ্রিত এক টগবগে উত্তেজনা, তুমি আমার ললাটে উপর ওয়ালার বিধান অনুয়ায়ী অতি পূর্ব থেকেই রচিত এক জীবন্ত চরিত্র, তুমি আমার অদূর ভবিষ্যত! আমার ৬০ এর কোঠা পেরিয়ে যাওয়া বৃদ্ধ বয়সের সর্বশেষ সঙ্গ এবং সম্বল। মৃত্যের দাড়প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা আমার প্রাণবায়ুর শেষ দীর্ঘশ্বাস তুমি!”

নেত্রকোটরে অবাধ্য জলেরা চিকচিক করে উঠল। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই নেত্র কোটর বেয়ে দু ফোটা অশ্রুকণা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। জলের ভেজাটে অস্তিত্ব টের পাওয়া মাত্রই পরশ অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার অশ্রসিক্ত চোখের পানে! উতলা, উদাসীন, উদগ্রীব চিত্তে লোকটি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন আমার চোখের জল মুছে দিতে, যেনো তেনো প্রকারেই হউক আমার দুঃখ নিবারণ করতে। আনন্দ, আবেগে আমি এতটাই বিভোর হয়ে উঠেছিলাম যে, পরশকে ঝাপটে ধরে হেচকি তুলে কেঁদে উঠলাম। পরশ ও সমভাবে আমায় ঝাপটে ধরে ছোট ছোট চুম্বনে আমায় উত্তেজিত করে তুলছিলেন। লোকটি বুঝতে পেরেছিলেন এছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই আমাকে শান্ত করার! লোকটির মিলনের আবেদন আমি নিজে ও নাকোচ করতে পারছিলাম না। তাই আমি ও লোকটির উত্তেজনায় সায় দিয়ে লোকটিকে আপন করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

__________________________________________

প্রেগনেন্সির আট মাস আজ পূর্ণ হলো! ডক্টরের দেওয়া ডেইট অনুযায়ী আগামী পনেরো দিন পর আমার ডেলিভারী ডেইট। বিগত পনেরো দিন পূর্বেই আমি বাপের বাড়ি চলে এসেছি! এই নিয়ে পরশের সাথে নানান প্রকারভেদে আমার মনোমালিন্য! পরশ চায় নি আমাদের প্রথম “সন্তানদ্বয়” কুমিল্লায় হোক। পরশ চেয়েছিলেন তার উপস্থিতিতেই ঢাকায় আমার ডেলিভারি হোক। সম্পূর্ণ নিশ্চিত এবং নিরাপদ ভাবে পরশের পরিচিত প্রাইভেট হসপিটালে আমার সিজার সম্পন্ন হোক। সৌভাগ্য বশত টুইন বেবি আমার গর্ভে! আর এর জন্যই পরশের মাত্রাতিরিক্ত শঙ্কা এবং ভয়। ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী সিজারিংয়ের মাধ্যমেই আমার সন্তান প্রসবে ঝুঁকি কম থাকবে। এই দিকে বিগত কয়েক মাস যাবত অফিসে পরশের অত্যধিক কাজের চাপ বেড়েই চলছে। যার দরুন পরশের পক্ষে সম্ভব নয় কুমিল্লায় এসে আমার সাথে থাকা বা ডেলিভারির কয়েক দিন পূর্ব থেকে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আমার পাশে থাকা। ঢাকায় যদি আমার ডেলিভারি হতো তবে পরশের পক্ষে খুব সহজাধ্য ছিল। যেকোনো মুহূর্তে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হসপিটালে ছুটে আসা বা ঐ সংকটাপন্ন মুহূর্তে আমার আশেপাশে থাকা। কিন্তু কুমিল্লা থাকার দরুন তো আমার লেবার পেইনের খবর পেয়ে আমার কাছে ছুটে আসতেই পরশের কমপক্ষে ৩ ঘন্টা সময় ব্যয় হয়ে যাবে!

রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গাঁ এলিয়েছি মাত্র। কুমিল্লা আসার পর থেকে নীলা এবং স্নিগ্ধা রাতে আমার পাশে ঘুমায়। রাত বিরাতে আমার ভালো, মন্দের খেয়াল রাখে। সাত মাসের পর থেকে এই উঁচু এবং ভারী পেট নিয়ে আমার চলাফেরা করতে ভীষণ অসুবিধে হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দু কদম বাড়াতেই যেন হাঁফিয়ে উঠছি। পেটে ও সাংঘাতিক ভাবে চাপ লাগে তখন। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না! রাতে এপাশ ওপাশ ফিরে ঘুমানো যায় না। সোজা হয়ে ঘুমানো ছাড়া সুপ্তি বিলাসের আর কোনো উপায় নেই। রাত প্রায় এগারোটা বেজে যাওয়ার পরে ও নীলা এবং স্নিগ্ধা আমার রুমে আসে নি। দুজনেরই ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। হয়তো রাত জেগে পড়ছে। পরশের সাথে আজ দুই দিন যাবত কথা হয় না আমার! তবে আমার প্রতিদিনের সমস্ত আপডেট তিনি মায়ের কাছ থেকে অতি গুরুত্বের সাথে জেনে নেন। রাগের পাহাড় ভেঙ্গে কিছুতেই যেন আমার কাছে নতজানু হবেন না। আমি ও উনার চেয়ে কম যাই না। আসার পর থেকে গুনে গুনে মাত্র দুবার উনার সাথে টেলিফোনে কথা বলেছি। এর অধিক দু অক্ষর কথা বলার প্রয়োজনটি মনে করি নি! রাগ কি শুধু উনার ই আছে? আমার বুঝি রাগ করতে মানা আছে?

এসবের মাঝেই চার মাস পূর্বের কথা মনে পড়ে গেল! শৈবাল দ্বীপে যখন আমরা হানিমুনে গিয়েছিলাম। পাঁচ পাঁচ জোড়া নব দম্পতি আমরা হানিমুনে শৈবালদ্বীপ গিয়েছিলাম। খুব মজা হয়েছিল তখন! ট্রিপটি এতটাই আনন্দঘন এবং তৃপ্তিদায়ক ছিল যে আজীবন আমার এই ট্রিপটির কথা স্মৃতির পাতায় স্মরনীয় হয়ে থাকবে। কালচক্রে প্রতিটা মুহূর্তে মনে পড়বে। কত শত স্মৃতি, মুহূর্ত, হাস্যকর নানান ঘটনা জড়িয়ে আছে এই ট্রিপটিতে! পাঁচটে পুরুষ এবং পাঁচটে নারীর নব সংসারের হাসি খুশির কয়েক গুচ্ছ মুহূর্তে পরিপূর্ণ ভাবে রচিত হয়েছিল এই ট্রিপটি! সাংসারিক জীবনে সবাই এখন বেশ খুশি। পায়েল, পিয়ালী আপু, রুম্পা আপু, মিলি আপু সবাই তাদের সাংসারিক জীবনে নিজেদের ঠিকঠাক ভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। এদের মধ্যে মিলি আপু দু মাসের অর্ন্তসত্তা। রুম্পা আপুর চলমান মাস সহ পাঁচ মাস চলছে। পিয়ালী আপু মাত্র কিছুদিন হলো কনসিভ করেছেন। পায়েলের এখন ও কনসিভ করা হয় নি! হিমেশ ভাই চাইছেন না পায়েল এত দ্রুত কনসিভ করুক। আর ও ৫/৬ মাস পর তিনি ভেবে দেখবেন। ঐ দিকে ফারিহা আপুর শ্বশুড় বাড়ি থেকে দুদিন হলো খবর এসেছে ফারিহা আপু কনসিভ করেছেন! অনেক ডাক্তারি টেকনিক এবং বিভিন্ন টোটকার মাধ্যমে ফারিহা আপু শেষ পর্যন্ত পেরেছেন বাচ্চা ধারন করতে!

মুহূর্তের মধ্যেই আমার ভাবনা চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটল! বালিশের তলা থেকে আমার ফোনটি বিকট শব্দে বেজে উঠল। কলিজাটা তাৎক্ষণিক মোচড় দিয়ে উঠল! মন যেন জাগান দিয়ে বলছিল পরশ কল করেছে! এর বাইরে তো এত রাতে কেউ আমায় কল করেন না। চট জলদি ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রীনে পরশের নাম্বারটি দেখতে পেলাম। খুশিতে মনটা কানায় কানায় ভরে উঠল। প্রফুল্লিত গলায় আমি তড়িঘড়ি করে কলটি তুলে বললাম,,

“পরশ?”

অপর প্রান্ত থেকে পরশ গুরুগম্ভীর গলায় বললেন,,

“কেন? এত রাতে কি অন্য কারো কলের অপেক্ষায় ছিলে?”

“এখন ও রেগে আছেন আমার উপর?”

“আমার মেয়েদের খবর নিতে আমি কল করেছি। নিজের রাগের কারন ব্যক্ত করতে কাউকে কল করি নি!”

“এভাবে কথা বলছেন কেন? এখন বুঝি আমার চেয়ে আপনারা মেয়েরা বেশি আপন হয়ে গেল?”

পরশ বোধ হয় ধূমপান করছেন। তাই তো কেমন যেন নাক দিয়ে শ্বাস নির্গত করছেন। পুনরায় তিনি সিগারেটে ফুঁক দিয়ে বললেন,,

“মেয়েদের মা বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেছে! মেয়েদের বাবার কথা কিঞ্চিৎ পরিমান ও চিন্তা করে না। শুধু নিজের দিকটাই ভাবে। নিজের ইচ্ছে এবং চাওয়াটাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়!”

“আমার মেয়েদের বাবাটা না? বড্ড অবুঝ! সোজা বিষয়টা সোজা ভাবে বুঝতেই চায় না। মেয়েদের প্রথম সন্তান সচরাচর তার বাবার বাড়ি থেকেই হয়। আর এটাই নিয়ম। আমার শ্বাশুড়ী মা ও কিন্তু এই কথাটিই আপনাকে বলেছিলেন। তাছাড়া আপনি ও কিন্তু আপনার নানা বাড়ি থেকেই হয়েছিলেন। আমার বড় আপু ও নানা বাড়িতে হয়েছিলেন। যুগ যুগ ধরে এই নিয়ম চলে আসছে৷ তাই আমাদের দুই পরিবারের সদস্যরা ও এই নিয়মটিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। মাঝখান থেকে আপনি শুধু শুধু বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছেন!”

“আমি অতো শত বুঝি না! তোমাদের এই ফালতু নিয়মের জন্য যদি তোমার বা আমার বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি হয় না? তাহলে কিন্তু আমি তোমাদের কাউকেই ছাড়ব না। তোমাদের তিনজনকেই আমি সুস্থ, সবল এবং নিরাপদে দেখতে চাই। আর হ্যাঁ? তোমার বদরাগী বাবাকে এক্ষনি, এই মুহূর্তে জানিয়ে দাও, ডেলিভারী ডেইটের ঠিক দুদিন পূর্বে যেন তোমাকে প্রাইভেট কোনো হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেন। আগে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে রাখা ভালো। কোনো শঙ্কা বা বিপদ যেন না ঘটে। যদি এর অন্যথায় হয় না? আমি কিন্তু দুনিয়া উল্টে ফেলব। তোমার বাবাকে ও তখন ছাড়ব না!”

মিটিমিটি হাসলাম আমি। তবে লোকটিকে প্রকাশ করলাম না। কতটা চিন্তিত তিনি আমাদের নিয়ে। তাই তো সেই কখন থেকে যা তা বকেই চলেছেন। শঙ্কা কাটাতে পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ও বলছেন। চাঁপা হাসি থামিয়ে আমি লোকটির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“খেয়েছেন আপনি?”

“তিনবেলা সিগারেট সেবন করেই পেট ভর্তি হয়ে যাচ্ছে! আলাদা করে খাবারের কি প্রয়োজন?”

“এইবার কিন্তু আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে পরশ! আপনি মাত্রাতিরিক্ত করছেন। ধূমপান কি পেট ভরানোর জিনিস? এসব করে করে আপনি স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছেন। আপনার মেয়েদের খারাপ বাবা হয়ে উঠছেন!”

“মেয়েদের মা ই আমায় বাধ্য করছে খারাপ হতে! কিছুতেই যেন বুঝতে চাইবে না আমার মনের ব্যাথাটা! তাকে ছাড়া থাকতে আমার ঠিক কতটা কষ্ট হয়! কতটা অসহ্য যন্ত্রণা হয়! সে কখনই বুঝবে না! তাকে ছাড়া শূন্য লাগে আমার আশপাশটা। মনে হয় যেন ঘোর অমবস্যা লেগেছে আমার মনে! দম বন্ধ হয়ে আসে এই একা বদ্ধ ঘরে থাকতে। সে যে আমার অভ্যেস হয়ে গেছে! চোখ বুজার আগে ও পরে তাকে এক পলক না দেখলে আমার চোখে প্রশান্তি মিলে না। শান্তির ঘুম হয় না! সে কি আদৌতে বুঝবে না আমার মনের নিগূঢ় যন্ত্রণাটা?”

মনটা কেঁদে উঠল অজান্তেই। ফট করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আমি অশ্রুবিলাসে মগ্ন হয়ে উঠলাম! এসব আবেগপ্রবণ কথা বলে লোকটি প্রতিবারই আমায় দুর্বল করে দেন! মৃত্যুর মুখে পড়ে ও মৃত্যুকে ভয় পেতে ইচ্ছে করে তখন! উপর ওয়ালা না করুক, যদি ডেলিভারির সময় আমার খারাপ কিছু একটা হয়ে যায় তখন পরশের কি হবে? লোকটি কি আদৌতে এই শোক সামলে উঠতে পারবেন? নাকি তিনি ও সেচ্ছায় জীবন দান করবেন?

লোচন জোড়ায় এক সাগর অশ্রু নিয়ে আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। এর মধ্যেই নীলা এবং স্নিগ্ধা রুমে প্রবেশ করল। রুমের লাইট অফ করে দুজনই আমার পাশে শুয়ে পড়ল। তাদের দেখে মলিন হেসে আমি ও ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ অনুভব করলাম আমার তল পেটটায় ভীষন পেইন হচ্ছে। নিচের অংশ ভিজে একাকার। অসহ্য ব্যাথায় গুঙ্গিয়ে উঠলাম আমি। ক্ষনিক বাদে বিছানার চাঁদর খামছে ধরে আত্নচিৎকার করে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গেই নীলা এবং স্নিগ্ধা ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। দুজনই সমস্বরে উদ্বিগ্ন গলায় আমায় ঝাঁকিয়ে বলল,,

“কি হয়েছে আপু? চিৎকার করছ কেন?”

আঁখি যুগল খিঁচে বন্ধ করে আমি তুখাড় আর্তনাদে সিক্ত হয়ে বললাম,

“লেবার পেইন উঠেছে আমার। প্লিজ তোরা মা আর চাচীমনিদের ডেকে দে।”

মরণ যন্ত্রণা হচ্ছিল আমার! নিচের অংশ ভিজতে ভিজতে পুরো বিছানা ছড়িয়ে পড়ছিল। জবজবে ঘামে অবসন্ন আমি। আশপাশটা চড়কির মতো ঘুড়ছিল। বিষন্ন ব্যাথায় নেত্র যুগল খোলার সামান্য সাহসটুকু যোগাতে পারছিলাম না। প্রাণ বায়ু যায় যায় করছিল! বুঝতে পারছিলাম মা হওয়া অতো সহজ নয়! পৃথিবীর সমস্ত দুঃসাধ্য কাজের মধ্যে এটি একটি! মৃত্যুর দাড়প্রান্ত থেকে ফিরে আসা পৃথিবীর সমস্ত মায়েদের সৌভাগ্য রচনা করছি। আদৌ নিজের ভাগ্যে সেই সৌভাগ্য জুটবে কিনা জানি না! তবে আমি নিজে ও এখন সেই সৌভাগ্য রচনা করতে আল্লাহ্ র কাছে দু’হাত তুলে দো’আ করছি!

পরশ বোধ হয় ঠিক এই আশঙ্কার কথাটিই আন্দাজ করেছিলেন! তাই তো তিনি বার বার সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। আসন্ন বিপদে ঘাবড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু হঠাৎয়ের মধ্যে যে এই দুর্বিষহ বিপদ ঘনিয়ে আসবে কে জানত? জানলে তো পূর্ব প্রস্তুতিই নেওয়াই থাকত! আন্দাজ করতে পারলাম মা এবং চাচীমনিরা রুমে প্রবেশ করেছেন। আশেপাশে তাদের হাঁক ডাক শুনতে পারছি। দরজার বাইরে থেকে বাবার উত্তেজিত গলার স্বর কর্নপাত হচ্ছে। বাবা বোধ হয় ফোনের মাধ্যমে হসপিটালে যোগাযোগ করছেন। এর মধ্যেই মেঝো চাচীর কন্ঠস্বর কানে এলো। তিনি শুকনো গলায় বলছেন,,

“রাত প্রায় ৩ টে বাজতে চলল। এই মাঝরাতে আশেপাশের কোনো হসপিটাল খোলা থাকবে তো ভাবী?”

মা আমার মাথায় অনবরত হাত বুলিয়ে কান্নারত গলায় বললেন,,

“কিছু জানি না আমি। কিছু না। যেকোনো মূল্যেই হোক আমি আমার মেয়ে এবং নাতনিদের সুস্থ অবস্থায় দেখতে চাই। ফারিহার বাবা যেভাবেই পারুক আমার মেয়েকে হসপিটালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করুক! আদর্শ বাবা হওয়ার পরিচয় দিক।”

শরীর নিংড়ে উঠছিল আমার! সারা শরীর অবশ হয়ে আসছিল। হাত-পা ছেড়ে আমি দিশাহীন হয়ে চেতনা শক্তি হারানোর ঠিক এক মুহূর্ত পূর্বে মা কে ডেকে আকুতি ভরা গলায় বলে গেলাম,,

“পরশকে খবরটা জানিয়ে দাও মা৷ নতুবা পরশ দুনিয়া উল্টে ফেলবেন!”

দিন-দুনিয়ার আর কোনো খবর নেই আমার। চেতনা শক্তি হারিয়ে আলাদা এক জগতে বিনা দ্বিধায় আরোহণ করলাম। নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকা সেই জগত! ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাত্রাতিরিক্ত অন্ধকার। আমি একাই অবস্থান করছি সেই অন্ধকার জগতে! পরশকে হাতড়াচ্ছি! কিন্তু কোথাও তিনি নেই, কোথাও তিনি নেই!

,
,

চেতনা শক্তি ফিরতেই মনে হলো খুব সাংঘাতিক এক শ্রুতি সুন্দর স্বপ্নে নিমজ্জিত আমি! চোখ খোলা অবস্থায় কেউ স্বপ্ন দেখে নাকি? কিন্তু আমার তো সবকিছু স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে! দু পরিবারের প্রতিটি সদস্য আমায় ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন! সবার ঠোঁটের কোণে এক প্রশান্তির হাসি। সব’চে আশ্চর্যের বিষয় হলো পরশ আমার ঠিক বাঁ পাশটায় বসে আমার সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চা দুটোকে ভেজা চোখে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছেন। আমার দিকে যেন কোনো ধ্যানই নেই এই লোকটির। মেয়েদের পেয়ে একদম ভুলে গেছেন আমায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে আর ও এক দফা শুকরিয়া! তিনি আমাকে ও সৌভাগ্য রচনা করার সুযোগ করে দিয়েছেন।

তীব্র ব্যাথার রেশ মাখা অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগলে আমি মেয়ে দুটোর দিকে তাকালাম। দুজনই কেমন তীক্ষ্ণ ভাবে নাক, মুখ কুঁচকে রেখেছে। কাঁদবে কাঁদবে এমন ভাব। বাবার অতি আদরে তারা অতিষ্ঠ প্রায়! মেয়ে দুটি কি আমার মত হলো? খাড়া নাক, ভাসা ভাসা চোখ! এর মধ্যেই শ্বাশুড়ী মা হাসি মাখা মুখে আমার দিকে চেয়ে বললেন,,

“নাতনীদের খাইয়ে দাও এবার। দেখছ না? পেটের ক্ষুধায় কেমন নাক, মুখ কুঁচকে রেখেছে আমার দাদুমনিরা!”

পরশের অস্থির দৃষ্টি এবার আমার দিকে পড়ল। লোক লজ্জা ভুলে সঙ্গে সঙ্গেই লোকটি আমায় ঝাপটে ধরলেন। তাৎক্ষণিক মাথা নুইয়ে নিলাম আমি! পরিবারের সবাই এই আকস্মিক লজ্জা এড়াতে এক এক করে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। যাওয়ার পূর্বে বাবা ক্রুর হেসে পেছন থেকে পরশকে ব্যগ্র গলায় বললেন,,

“মেয়েদের বাবা হয়েছ তো এবার? আমি ও দেখে নিব, মেয়েদের কিভাবে মানুষ করো তুমি! মেয়েরা উচ্ছন্নে গেলে বাবাদের মনে ঠিক কতটা আঘাত হয় এবার বুঝবে তুমি! আমার মেয়েকে তুমি পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছিলে না? এবার আমি ও দেখব, তোমার মেয়েরা ঠিক কাকে, কিভাবে বিয়ে করে!”

এক ঝটকায় আমায় ছেড়ে পরশ অট্ট হেসে বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“আপনি কি আমায় বদ’দোআ দিচ্ছেন শ্বশুড় আব্বা?”

“তাই ধরে নাও। মেয়েদের সঠিক ভাবে গড়ে তোলা যে কত কঠিন এবার বুঝবে!”

পরশ থামকালেন। ভাবুক গলায় বললেন,,

“আপনার মনোবাঞ্ছা বুঝে তো মনে হচ্ছে…! আপনিই উসকে দিবেন আমার মেয়েদের পালিয়ে যেতে! যেন আপনি আমায় এবার অন্তত একটু ভালো ভাবে জব্দ করতে পারেন!”

“প্রয়োজন হলে ঠিক তাই করব! যে কোনো মূল্যেই হোক, তোমায় জব্দ করা চাই ই চাই!”

রাগে গজগজ করে বাবা প্রস্থান নিলেন। পরশ নির্বোধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন বাবার যাওয়ার পথে। ফিক করে হেসে আমি লোকটির কাঁধে মাথা রেখে বললাম,,

“ছাড়ুন তো বাবার কথা! বাবা আপনার সাথে রসিকতা করেছেন!”

পরশ বেশ চিন্তিত গলায় বললেন,,

“তোমার বাবার সাথে এক ফোঁটা ও বিশ্বাস নেই। এখন থেকেই আমার সতর্ক থাকতে হবে! আর শুনো? আমার মেয়েদের নিয়ে বেশি বাপের বাড়ি বেড়ানো যাবে না। সুযোগ পেলেই তোমার বাবা আমার মেয়েদের মাথা নষ্ট করে দিবেন, ছলা কলা করে উসকে দিবেন আমার মেয়েদেরকে! বলা যায় না, হয়তো আমার মেয়েদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে তোমার বাবাই সাহায্য করবেন! যদি তিনি ফন্দি করে আমার মতই কোনো ধড়িবাজ জামাইয়ের হাতে আমার মেয়েদের তুলে দেন? তখন? তখন কি হবে? ধড়িবাজ জামাই থেকে তখন আমি জাদরেল শ্বশুড় হয়ে উঠব? এমা না না! কিছুতেই এটা হতে দেওয়া যাবে না!”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম আমি। পরশ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লেন। তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। অতি যত্নে মেয়েদের মুখে স্তন জোড়া তুলে দিয়ে আমি ক্রুর হেসে পরশকে শুধিয়ে বললাম,,

“নিজের বেলায় ষোল আনা, আর পরের বেলায় এক আনা? না?”

পরশ উচ্চ শব্দে হেসে উঠলেন। সুঠাম বাহুডোরে একই সঙ্গে আমায় এবং মেয়েদের ঝাপটে ধরে সুদৃঢ় গলায় বললেন,,

“তোমাদের বেলায় আমি আজীবনই ষোল আনা! তোমাদের ঘিরেই আমার জীবন সংসার ষোল আনায় পরিপূর্ণ হলো!”

#সমাপ্ত।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে