সুতোয় বাঁধা জীবন পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

1
782

#সুতোয়_বাঁধা_জীবন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
সমাপ্তি পর্ব

দিন পেরিয়েছে, সপ্তাহ পেরিয়েছে, পেরিয়েছে কয়েক মাস। সময়ের সাথে সাথে পালটেছে অনেককিছু। বাচ্চাদের নিয়ে মায়ের কবর দেখতে নানুবাড়িতে এসেছে রুদিতা। মূলত রুহামার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার জন্যই এখানে আসা। এই ছ’মাসে অনেককিছু বদলে গেছে। বদলে গেছে রওনক ও শর্মীর জীবন। পাপ ও পূণ্যের হিসেবে কে হারল, কে জিতল, এসব দ্বন্দ্বে কেউ-ই জড়ায়নি আর। শুধু মাঝখান থেকে পা//পের বোঝাটাকে হালকা করতে প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে রওনককে। আজ বোনের বিয়েতে মামার আদেশ রক্ষা করতে এখানে এসেছে রওনক নিজেও। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে কবরস্থানের দিকে চোখ গেল রুদিতার। দেখল, হুইলচেয়ারে বসা রওনক ডুকরে কাঁদছে মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে। রুদিতা ভাইয়ের পাশে এসে জানতে চাইল,

-‘কেমন আছো ভাইয়া?’

রওনক চোখ মুছে বোনের দিকে তাকিয়ে ম্লানমুখে বলল,
-‘ভালো। তুই ভালো আছিস্?’

-‘হুম, আছি। ঘরে এত মেহমান রেখে তুমি এখানে বসে আছো কেন?’

-‘কী করব বল? সব শান্তি হারিয়ে আজ যখন আমি নিঃস্ব হলাম তখনই অনুভব করলাম, মায়ের দোয়া ও ভালোবাসা সন্তানের জীবনে কতখানি প্রয়োজন।’

-‘এসব ভেবে আর কী লাভ বলো? ফেলে আসা দিন কি আর ফিরে আসবে? আমরা তো আর চাইলেও মাকে ফিরে পাব না।’

রওনক বোনের হাত ধরে বলল,
-‘তোরা আমাকে ক্ষমা করেছিস্ তো বোন?’

নির্দিষ্ট কোনো জবাব খুঁজে পেল না রুদিতা। কী বলবে, ক্ষমা করেনি? না-কি করে দিয়েছে? রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা সবই তো পালিয়ে গিয়েছে বহুদিন আগে। অল্পস্বল্প যা অভিমান আছে, সেটুকুও হয়তো মুছে যাবে একদিন। যেদিন হসপিটালের বেডে ভাইকে জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়তে দেখেছে, সেদিনই একটু একটু করে ভাইয়ের কান্না ও অসহায় স্বর দুইবোনকে তাদের কঠিন সিদ্ধান্ত থেকে টেনে বাহির করেছিল। যখন মায়ের জানাযা শেষ করে, রাতের শেষভাগে একাকী গন্তব্যের দিকে দিশেহারা হয়ে ছুটছিল রওনক। বেহুঁশের মতো হাত-পা ছুঁড়ছিল আর কাঁদছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ওই রোড অ্যাক্সিডেন্ট তাকে বুঝিয়েছে, গায়ের জোর ও গলাবাজি বেশিদিন থাকে না। অর্থ ও সম্পদ, প্রাচুর্য ও অহংকার এসবও বড্ড ঠুনকো।

দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়টায় আর ভাইয়ের ওপর কোনোপ্রকার রাগ-অভিমান কিংবা ঘৃণা জমিয়ে রাখতে পারেনি রুদিতা। ছুটে গিয়েছিল হসপিটালে। চিকিৎসার পর থেকে রওনক সুস্থ হলেও পায়ে জোর ফিরে পায়নি আর। পিছনের অধ্যায়টা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদিতা। পরপর দুটো দুর্ঘটনা সবাইকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। শর্মীরও হুঁশ ফিরিয়েছে। ভাইয়ের নীরব আর্তনাদ বুঝতে পেরে বলল,

-‘যদি ক্ষমা না করতাম, তবে সম্পর্ক ঠিক থাকত না ভাইয়া। এতদিনে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেত।’

দূর থেকে ফুপিকে দেখে ছুটে এলো পিকলু ও মৌমি। বাচ্চাদুটোকে আগলে নিয়ে আদর করল রুদিতা। মৌমি আদুরে গলায় বলল,

-‘তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে ফুপি। তাড়াতাড়ি এসো।’

-‘এইতো আসছি। তোমরা এগোও।’

বাচ্চারা সবাই একসাথেই বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। রুদিতা চেয়ারের পিছনদিক দিয়ে সামান্য ধাক্কা দিয়ে ধীরেধীরে বাড়ির ভেতরে এসে দাঁড়াল। শর্মী বেরিয়েছিল স্বামীকে ঘরে আনার জন্য। ভাই-বোনকে একসাথে আসতে দেখে এগোলো না, দূরেই দাঁড়িয়ে রইল। যে রুদিতার সাথে দিনদিন সে খারাপ ব্যবহার করত, সে-ই রুদিতাই দিনের পর দিন হসপিটালে কাটিয়েছে শুধু ভাইকে সুস্থ করার জন্য। নানান জায়গায় ছোটাছুটি করেছে। রাত জেগে ভাইয়ের পাশে বসে থেকেছে। সে যখন পুরোটা ভেঙে পড়েছিল, তখন ভরসার ন্যায় পাশে দাঁড়িয়েছিল এই মেয়েটাই। সাহস জুগিয়েছিল। সাপোর্ট দিয়েছিল। সবকিছু দেখে, বুঝে নিজের ভেতরে থাকা পুরনো সেই অহংকারী, অমানুষ সত্ত্বাকে গ//লাটি//পে মে//রে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল শর্মী।

ওদের এগিয়ে আসাটা দূর থেকে দেখল শর্মী। লজ্জা ও অপরাধবোধ থেকে কাছে ভীড়ল না। রুদিতা তাকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসিমুখে বলল,

-‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে কত মেহমান। বিয়ের কাজ কী শুরু হয়নি এখনও?’

-‘তোর অপেক্ষাতেই আছে সবাই। এত দেরী হলো কেন?’

-‘বাচ্চারা স্কুলে ছিল, এজন্য।’

সিঁড়ির ঢালু অংশ দিয়ে আলগোছে হুইলচেয়ারটাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসলো রুদিতা। উষাদ ও রওনক মেহমানদের সাথে যোগ দিল। ফাহাদ ও তার বাড়ির সবার সাথে প্রাথমিক আলাপ সেরে বোনের কাছে চলে গেল রুদিতা। সেই ফাঁকে বিয়ের কাজ এগোনোর অনুমতি দিল শামীম।

রুহামার ভেতরটায় অস্থির অস্থির লাগছে। সমস্ত অনুভূতি মিলেমিশে এক হয়ে যেতে চাইছে। ‘কবুল’ বলতে গিয়ে টের পেল, হাত-পাসহ সারা শরীর কাঁপছে। মায়ের জন্য একদলা কষ্ট কণ্ঠনালীর কাছে এসে আটকে যাচ্ছে। কান্নাকাটি করা একদম নিষেধ। এই ব্যাপারে কড়া আদেশ শামীম ও মাহেরার। আর কত কাঁদবে? কাঁদতে কাঁদতে তো এতদিন গেল। আর কেঁদে কী লাভ? যার সময় ফুরাবে সে তো চলে যাবেই। তার জন্য কি বাকিদের জীবন থেমে থাকবে? রুদিতা বোনের ভেতরের যন্ত্রণা বুঝতে পেরে পাশে বসল। ভরসা দিয়ে বলল,

-‘মন খারাপ করিস্ না। মায়ের দোয়া সবসময় আমাদের সাথে আছে।’

রুহামার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল তৎক্ষনাৎ। নীরব কান্নায় চিবুক ভাসাল। ভেতর থেকে শব্দেরা ছুটে আসতে চাইল, ‘কেন এমন হলো? মা কাছে থাকলেই তো সবকিছুকে সহজে গ্রহণ করে নেয়া যেত।’ সব কথাকে গিলে নিয়ে বিয়ের সমস্ত নিয়মকানুন পরিপূর্ণ করে দিল। একটা সিগনেচার ও ‘কবুল’-এর জোরে তার জীবনের সমস্ত দায়-দায়িত্ব চলে গেল ফাহাদের হাতে। দু’জনার নতুন জীবনের জন্য দোয়া চেয়ে হাত উঠালেন সবাই।

ফাহাদ পাশে থাকতে চেয়েছিল। রুহামা প্রথম পাত্তা না দিলেও সে থেমে থাকেনি। বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। মায়ের মৃত্যু ও ভাইয়ের জীবনের দুর্ঘটনার কারণে, ফাহাদকে অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল দীর্ঘদিন। সব অপেক্ষার অবসান ঘটল আজ। ঠোঁটে ফুটে উঠল প্রাপ্তির হাসি। আড়চোখে রুহামার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে ফিসফিস করে জানিয়ে দিল মনের অভিব্যক্তি। বলল,

-‘বলেছিলাম না, পাশে থাকব? দূরে সরাতে পেরেছ, মিসেস?’

মুরব্বিদের সামনে রুহামা কথা বলার আগ্রহ দেখাল না খুব একটা। মুখ নামিয়ে মুচকি হাসল শুধু। জীবনের নতুন এই অধ্যায়কে খুব করে আগলে নিল মনে।

***

উমামা ও রুহান বাড়ির সামনের উঠোনে ছোটাছুটি করছে। সঙ্গী হয়েছে উষাদ নিজেও। বিকেলের এই সময়টা প্রতিদিন বাচ্চাদের জন্য তুলে রাখার চেষ্টা করে সে। রুদিতাও ফাঁক পেলে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটায়। চাকরি ছেড়ে এখন সে একদম ফ্রি। সকাল-বিকাল বাচ্চাদের সময় দেয়া। ঘরের কাজ-কর্ম করা। শাশুড়ির সেবাযত্ন করা। তাঁর সাথে গল্প করা। এসব করেই দিন কেটে যাচ্ছে রুদিতার। একটা সময় এই ঘর-সংসারের চিরচেনা অধ্যায়কে ছুঁয়ে দেয়ার তীব্র ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু ভাগ্য তার সাথে নিষ্ঠুর খেলা খেলেছে। একটা অ//মানুষের সাথে বিয়ে হওয়ার পর যখন ঘর-সংসারবিমুখী হয়ে পড়ল সে, তখন থেকে ঘর আঁকড়ে থাকার ইচ্ছেটাকেও কুরবানী দিতে হয়েছিল। মন বলছিল, এভাবেই জীবন কেটে যাবে। বেঁচে থাকাটা তার কাছে তখন একটু ফাঁসের মতো ছিল। বাঁচাও কঠিন, মরাও কঠিন। এমন দোটানা পরিস্থিতি ছিল তার সবদিকে।

আজও ইফতির মৃত্যুর বিষয়টা উষাদের সাথে শেয়ার করতে পারেনি রুদিতা। উষাদও জানতে চায়নি। তার বলতে ইচ্ছে হয় না, এমন নয় ব্যাপারটা। মৃত মানুষটার অসম্মানের কথা ভেবেই বলে না। হাজার হলেও একটা সময় ওই মানুষটাকে আঁকড়েই বেঁচে থাকা ছিল তার উদ্দেশ্য। বার বার বলতে চেয়েও সংকোচ ও লজ্জার কারণে থেমে যায় সে। ইফতির এই মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। অন্যের বাড়িতে চু//রি করতে গিয়েই ধরা পড়ে গিয়েছিল। সাঙ্গপাঙ্গরা পালিয়ে যেতে পারলেও ইফতি ফেঁসে গিয়েছিল পুরোটাই। গ্রামের লোকজন ইচ্ছামতো পি//টিয়েছে। সেই পি//টুনিতেই মৃত্যু হয়েছে ইফতির।

অনেকক্ষণ ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার খেলা দেখছিল রুদিতা। উষাদও তাকে খেয়াল করল এবার। বাচ্চাদের হাতে ব্যাট ও বল দিয়ে রুদিতাকে অন্যমনস্ক দেখে কাছে এসে জানতে চাইল,

-‘কী ভাবছ?’

-‘কিছু না।’

বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল রুদিতা। উষাদ ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
-‘কিছু তো একটা ভাবছিলে।’

-‘উঁহু, দেখছি।’

-‘কী দেখছ?’

-‘বাচ্চাদের দেখছি।’

খেলা রেখে ছুটে এলো উমামা। রুদিতার হাত ধরে টেনেটুনে তাকে উঠোনে নিয়ে আসলো। বলল,
-‘আসো, আমরা একসাথে খেলি।’

-‘তোমরা খেল সোনা। মাম্মামের কত কাজ আছে।’

রুহান নিজেও ছুটে এসে রুদিতাকে জড়িয়ে ধরে বায়নার স্বরে বলল,
-‘খেল না মাম্মাম। দারুণ মজা হবে।’

ছেলের কপালে চুমু খেল রুদিতা। বলল,
-‘আমি হচ্ছি দর্শক। শুধু দেখব আর হাততালি দেব। তোমরা খেল। দেখি, কে জিতে।’

-‘আমি জিতব।’

-‘তাই?’

রুহান জিতে যাবে আর উমামা জিতবে না, তা-ও হয়? রুহানের কথা মেনে নিতে পারল না উমামা। বলল,
-‘তুমি না। আমি জিতব।’

-‘তুমি পারবে না আমার সাথে।’

-‘একশোবার পারব। দেখো…।’

ব্যাট-বল নিয়ে দু’জনের যুদ্ধ শুরু হলো এবার। কে বোলিং করবে, কে ব্যাটিং করবে এই দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। দু’জনের দ্বন্দ্ব থামাতে ছুটে এলেন হোসবা বেগম। বললেন,

-‘ঝগড়া থামাও। আমি তোমাদের সাথে খেলব।’

-‘সত্যিই দাদী? তুমিও খেলবে?’

-‘হ্যাঁ, খেলব। বসে থেকে অলস হয়ে যাচ্ছি দিনদিন। নাতি-নাতনীদের সাথে খেলব না তো কী করব? তাড়াতাড়ি এসো, খেলা শুরু করি।’

দাদীকে পেয়ে ঝগড়া থামিয়ে দিল দুই ভাই-বোন। খেলা শুরু হলো। রুহান ব্যাট ধরেছে, উমামা বল ছুঁড়ে মারছে। হোসনা বেগম ফিল্ডিং দিচ্ছেন। ছোটো হলেও ব্যাট দিয়ে বলে খুব সুন্দর আঘাত করছে রুহান। বল ছুটে যাচ্ছে দূরে। বল ধরতে দৌড়াচ্ছেন হোসনা বেগম। এই বয়সে এসেও শাশুড়িকে এত আমোদ-ফূর্তি ও হাসিখুশী মেজাজে থাকতে দেখে রুদিতা বলল,

-‘মা, ওরা আপনাকে দৌড়িয়ে মারবে। বাদ দিন। ঘরে আসুন।’

হোসনা বেগম অসম্মতি জানিয়ে বললেন,
-‘না বউমা। জীবন উপভোগের সময় এটাই। আফসোস নিয়ে চোখ বন্ধ করার আগে কিছু সুখকে আগলে নিয়ে মরি। মানসিক শান্তি পাব।’

মায়ের কথা শোনে উষাদ বলল,
-‘বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের মতো হয়ে যান, তাই না?’

-‘হ্যাঁ, তখন তাদের সন্তানদের সাপোর্টের ভীষণ প্রয়োজন হয়। আমাদের উচিত, এই সম্পর্কটাকে বিশ্বাসের সাথে বাঁচিয়ে রাখা। তাদের প্রতি উদার হওয়া, যত্নশীল হওয়া।’

-‘শুধু বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে নয়, সব সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রত্যেকের যন্ত্রশীল হওয়া উচিত। সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে বেশিকিছুর প্রয়োজন পড়ে না। একটু শ্রদ্ধা-সম্মান ও ভালোবাসা সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম। হোক সেটা যেকোনো সম্পর্ক। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী অথবা বন্ধুবান্ধব। প্রত্যেকটা সম্পর্কই এসবের ওপর বেঁচে থাকে। দীর্ঘদিন, দীর্ঘবছর। শুধু শক্ত হাতে সেইসব সম্পর্কের যত্ন নিতে শিখতে হয়। আমরা পারব তো রাহা, সব সম্পর্ককে আমৃত্যু বাঁচিয়ে রাখতে?’

-‘চেষ্টা করব। আমাদের দিক থেকে কোনো ত্রুটি আমরা রাখব না।’

-‘ত্রুটি পেলে শা//স্তি অনিবার্য। মনে রেখো।’

উষাদের কথা শোনে নিঃশব্দে হাসল রুদিতা। মনে মনে ভাবল, সবাই যদি এইভাবে ভাবতে পারত, তবে কেউ-ই পরিবারের সুখ থেকে বিচ্ছিন্ন হতো না। সুখ তো সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার মাঝেই। যেকোনো সম্পর্ককে বিশ্বাস, ভরসা, শ্রদ্ধা-সম্মান ও ভালোবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখলে, সেই সম্পর্কটা হয় দীর্ঘস্থায়ী বন্ধনের একটা। মৃত্যুর পরও সেসব সম্পর্ক বেঁচে থাকে, স্মৃতির মাধ্যমে।

দৌড়াতে দৌড়াতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়লেন হোসনা বেগম। হাঁপিয়ে উঠলেন প্রায়। কয়েক মিনিটেই ঘাম ছুটল শরীর বেয়ে। হাসতে হাসতে বারান্দায় লাগোয়া সিঁড়িতে এসে বসলেন। উমামা ও রুহান সারা গায়ে ধুলোমাটি মাখিয়ে তখনও খেলছেই। সন্ধ্যে হয়ে আসছে প্রায়। রুদিতা এবার বাচ্চাদের থামাতে ছুটে গেল কাছে। দু’জনকে দু’হাতে ধরে ওড়নার প্রান্ত দিয়ে মুখ মুছে দিয়ে বলল,

-‘এই হচ্ছে খেলার নমুনা। দুটোর গায়ে মাটি লেপটে আছে। গায়ের কাপড় ছাড়তে হবে, এসো ঘরে।’

উমামা গাইগুই শুরু করল। আবদারের স্বরে বলল,
-‘আরেকটু খেলাই না মাম্মাম।’

-‘আর একমিনিটও না। কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আযান হবে। পড়তে বসবে না?’

-‘খালি সারাক্ষণ পড়া পড়া করো কেন? এত পড়ালেখা ভালো লাগে না।’

উষাদ আর দাঁড়াল না। দু’জনকে শূণ্যে তুলে নিল। বলল,
-‘পড়ালেখা ভালো লাগে না, না?’

হুট করে এইভাবে ধরাতে ভীষণ সুড়সুড়ি শুরু হলো রুহানের। হাত-পা এদিক-ওদিক নাড়িয়ে ঝুনঝুন শব্দ তুলে হেসে কুটিকুটি হতে লাগল। একসময় বলে উঠল,

-‘বাবাই ছাড়ো না। সুড়সুড়ি লাগে তো।’

আহা। ঢঙ্গী বাচ্চার ঢং দেখে কোল থেকে নামিয়ে তাকে আরও সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল উষাদ। রুহানের হাসি যেন থামছেই না। হাসতে হাসতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খেতে শুরু করেছে।

***

দু’জনকে পরিষ্কার করে, পরনের পোশাক পালটে পড়তে বসাল রুদিতা। নিজে গেল রান্নাঘরে। পড়ার টেবিলে দুই বিচ্চুর ঢং বেড়ে গেল। আঁকিবুঁকির ফাঁকে ফাঁকে টম এন্ড জেরির মতো ঝগড়া, খুঁনসুটি শুরু হলো। সব খাতা-কলম গুছিয়ে দু’হাতে গালে হাত চেপে ধরল উমামা। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ শুনিয়ে রুদিতা বলল,

-‘কী হলো? পড়া শেষ? সাউন্ড নেই কেন কারও? তাড়াতাড়ি হোমওয়ার্ক শেষ করো।’

উষাদ নিজেও ব্যাপারটা খেয়াল করল। টেলিভিশন ছেড়ে বাচ্চাদের কাছে গিয়ে দেখল, দু’জনেই গালমুখ ফুলিয়ে বসে আছে। দূর থেকেই বলল,

-‘এত তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছ কেন? লিখতে বসো। ক্লাসে কত হোমওয়ার্ক দিয়েছি আজ। সেসব কি ভুলে গেছো? দু’জনের সমস্যাটা কী? পড়াশোনায় মনোযোগ নেই কেন একেবারে?’

উমামার জেদ আজ পড়বেই না। সে বাবাইয়ের কথা শোনেও পাত্তা দিল না। ঢঙ্গী চেহারা নিয়ে গানের স্বরে বলল,
-‘আম্মু একবার কয় কেন পড়তে বসিস্ না? আব্বু একবার কয় কেন লিখতে বসিস্ না? কী করে বলি, আমার পড়ালেখা ভালো লাগে না। ভালো লাগে না।’

উষাদ আহাম্মক বনে দাঁড়িয়ে রইল দরজায়। মেয়ের গুনগুন শোনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো রুদিতাও। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,

-‘এই নিয়ে গানও মুখস্থ করা হয়ে গেছে?’

বকা খাওয়ার ভয়ে ঝটপট বইখাতা খুলে পড়তে বসল রুহান। উমামা নিজের মতো মাথা নাড়িয়ে গান গাইছে তখনও। রুদিতা আবার জানতে চাইল,

-‘গান শিখেছ কোথা থেকে?’

উমামা সাহসের সাথে বলল,
-‘বাবাই শিখিয়েছে।’

জিহ্বায় কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল উষাদ। কোনো একদিন ইউটিউবে গান বাজিয়েছিল। সেটাই দু’জনে গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে, মুখস্থ করে এবার তাদের ওপরই বাঁশ নাচাচ্ছে। মেয়ের মুখ থেকে এই কথা শোনে বলল,

-‘গান শিখলে পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে হবে, এই যুক্তি কোথায় পেয়েছ?’

উমামা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-‘আমি সত্যি বলছি, পড়ালেখা একদম ভালো লাগে না।’

ধীরপায়ে মেয়ের কাছে এগিয়ে গেল রুদিতা। মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
-‘পড়ালেখা না করলে যে তোমারই ক্ষতি হবে মা। এটা তো বুঝতে হবে তোমাকে।’

মুখ ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল উমামা। হাত বাড়িয়ে কোলে ওঠার ইচ্ছে প্রকাশ করল। রুদিতা মেয়েকে কোলে নিলে, উমামা জানতে চাইল,

-‘কী ক্ষতি হবে মাম্মাম?’

-‘এই পৃথিবীটা কত্ত বড়ো জানো?’

দু’দিকে মাথা নাড়ল উমামা। সে জানে না। রুদিতা বলল,
-‘বিশাল বড়ো। এত বড়ো যে, এর সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জ্ঞান অর্জন করতে হলে তোমাকে প্রচুর, প্রচুর পড়তে হবে। পড়তে পড়তে একদিন তুমি শুধু পৃথিবী নয়, পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যা কিছু আছে, সবকিছু সম্পর্কে জানতে পারবে। এখন পড়ো। একদম দুষ্টুমি না, ঠিক আছে?’

সত্যি সত্যি পড়তে বসল উমামা। রুদিতা রুহানের পাশে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ ধরে দেখছে ছেলে মুখ নামিয়ে আছে। কী আঁকিবুঁকি করছে কে জানে। সে নিচু করে যখন মনোযোগ দিল, দেখল রংপেন্সিল দিয়ে সুন্দর একটা পারিবারিক ছবি এঁকেছে রুহান। রুদিতা নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করল,

-‘এটা কার ছবি, রুহান?’

রুহান লজ্জামাখা এক হাসি দিয়ে আবারও মুখ নামিয়ে আঁকাবুঁকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রুদিতা চোখের ইশারায় উষাদকে বুঝাল, ছেলের পিছনে এসে দাঁড়াতে। উষাদ তা-ই করল। পিছনে দাঁড়িয়ে ছবিতে মনোযোগ দিল। ততক্ষণে রুহানের ছবি আঁকার কাজ কমপ্লিট। সে নিচে নাম লিখছে। একপাশে একটা পুরুষ, নিচে লেখা বাবাই। অন্যপাশে শাড়ি পরিহিত নারী, নিচে লেখা মাম্মাম। মাঝখানে দুটো বাচ্চা। একটা ছেলে ও একটা মেয়ে। হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, হাসিমুখে। রুহান ছেলেটার জায়গায় নিজের নাম ও মেয়েটার জায়গায় উমামার নাম বসাল। তারপর মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-‘কেমন হয়েছে, মাম্মাম? আমাদের ছবি।’

রুদিতা দেখল। গভীর মনোযোগ দিয়ে। উপলব্ধি করল, একটা বাচ্চার পরিপূর্ণ সুখকে। আলগোছে বাচ্চাটাকে বুকের কাছে আগলে নিয়ে বলল,

-‘মাশা’আল্লাহ্, অনেক সুন্দর হয়েছে।’

রুহানের সব সমস্যা পুরোপুরি কাটেনি। তবে এখন সে আর রুদিতাকে ভয় পায় না। দূরেও থাকে না। মাঝখানে আরও দু’বার ডাক্তার স্বর্ণালির কাছে গিয়েছিল তারা। তিনি বেশকিছু সাজেশন দিয়েছেন। নিয়ম মেনে চলতে বলেছেন। ঔষধপত্র ছাড়াও বাবা-মায়ের সান্নিধ্য, আদর-ভালোবা সবটাই এখন হিসেবের বাইরে পাচ্ছে রুহান। অল্পস্বল্প যা ভয়ভীতি আছে তা সময়ের সাথে সাথে কেটে বলে জানিয়েছেন ডাক্তার।

***

পড়াশোনা শেষ করে কার্টুন দেখছিল উমামা। রুহান এতক্ষণ জেগে থাকলেও কয়েকমিনিট আগেই সে তার দাদীর কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে ঔষধ শুরু করার পর থেকে বেশিক্ষণ রাত জাগতে পারে না। চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসে। রুদিতা রান্নাঘর গোছাচ্ছিল। উষাদ রুমে, জরুরী ফোন আসায় সে রুমের ভেতরে থেকে কথা বলছে। হঠাৎই দরজার নক হওয়ার সাথে সাথে একটা ডাক ভেসে এলো,

-‘এ্যাই যে বাচ্চা, শোনো।’

বারান্দায় যে গ্রিল ছিল, সেটায় তালা দেয়া থাকলেও গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সম্পূর্ণ বসার ঘরটা দেখা যায়। চারিদিকে আলো থাকায় আওয়াজ শোনে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিল উমামা। অচেনা একজন নারীকে দেখে জবাব দিল,

-‘আমাকে ডাকছেন?’

-‘হ্যাঁ। তুমি কি একটু বাইরে আসবে?’

উমামা জানে, গ্রিল ওই সময় তালা দেয়া থাকে। আর অপরিচিত কারও কাছে যাওয়া, তার থেকে কিছু নেয়া সবটাই নিষেধ। এগুলো উষাদের শিখানো কথা। সে দূর থেকে দেখে কী বুঝল, কে জানে। গলা তুলে রুদিতাকে ডাকল,

-‘মাম্মাম, দেখে যাও। কেউ এসেছে।’

ততক্ষণে রান্নাঘরের সমস্ত কাজ ফেলে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়াল রুদিতা। বাইরের দিকে তাকাল। বিপাশাকে দেখে খানিকটা অবাক হলো। তৎক্ষনাৎ রাগও হলো। ইচ্ছে হলো, একগাদা কথা শুনিয়ে দিক। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে চুপ থেকে গেল। শুধু জানতে চাইল,

-‘এখানে কী চাই?’

বিপাশা মলিনমুখে বলল,
-‘বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন? ভেতরে আসতে বলবেন না?’

-‘হঠাৎ কেন এসেছেন বলবেন? এই বাড়ির কারও সাথে তো আপনার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি কারও আত্মীয় কিংবা কাছের কেউও নোন। কী প্রয়োজনে এখানে পা রাখলেন আজ?’

-‘আমি আমার মেয়েকে দেখতে এসেছি।’

রুদিতা হাসল। দু’হাতে উমামাকে আগলে নিয়ে বলল,
-‘দুঃখিত, এই বাড়িতে আপনার মেয়ে থাকে না। এটা আমার স্বামীর বাড়ি। এখানে আমি আমার শাশুড়ি, স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে থাকি। আপনার মেয়ে এখানে আসলো কী করে?’

আহ, অপমান। বিপাশা দাঁত কিড়মিড় করে দাঁড়িয়ে রইল। উষাদের এই বউটা সুবিধার না। বড্ড কথা জানে। এসেছিল মেয়েকে একনজর দেখে একটুখানি ছুঁয়ে দেয়ার জন্য। আর কভু মা হতে পারবে না সে, এই সত্যি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিজের মেয়েটাকে হাতছাড়া করার জন্যও আফসোস হচ্ছে। আজ একটু কাছে টানতে চেয়েছিল, অথচ সেটাও তার ভাগ্যে জুটছে না। সে দূরে থেকেই বলল,

-‘আমি জানি, এই বাড়ির সবাই আমার ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে। আমার তো কিছু করার ছিল না। তখন যা ঠিক মনে হয়েছে সেটাই করেছি। আমি কারও কোনো ক্ষতি করব না। শুধু একবার আমার মেয়েটাকে কোলে নিতে দিবে? একটু আদর করেই চলে যাব।’

রুদিতা কিছু বলার আগেই গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়াল বিপাশা। উমামাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘একটু আমার কাছে আসবে, উমা? আমি তোমার মা। তোমাকে জন্ম দিয়েছি অথচ ভাগ্যের দোষে তোমার সাথে আমার দূরত্ব তৈরী হয়েছে। এসো না, মা। একটু কাছে এসো।’

উমামা হা করে তাকিয়ে রইল। সে জানে, তার মা আকাশে। কোনোদিন ছবিও দেখেনি। কেউ আকাশের তারা হয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। অথচ তার মা এলো। আজ হঠাৎ মা কীভাবে এলো, তার ছোটো মাথায় কিছুই ঢুকল না। সে এবার গলা ফাটিয়ে উষাদকে ডাকল,

-‘বাবাই, ও বাবাই। দেখে যাও। মা, আকাশ থেকে নেমে এসেছে। ও বাবাই, কোথায় গেলে তুমি?’

সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ছুটে এসে বারান্দায় পা ফেলল উষাদ। অমনি চমকে গেল। বিরক্ত হলো কিছুটা। বলল,
-‘আপনি এখানে কেন এসেছেন? কী চাই?’

-‘আমার মেয়েটাকে দেখতে এসেছি, উষাদ। একটু ছুঁয়ে দিই না ওকে। দরজাটা খুলবে না?’

উষাদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল উমামা। বলল,
-‘বাবাই, উনি আমার মা?’

-‘তুমি নিজেই বুঝে নাও। উনি তোমার মা হলে নিশ্চয়ই তোমাকে তার ছবি দেখাতাম। তুমি দেখেছ ওনার ছবি?’

-‘না, দেখিনি।’

-‘উনি তোমার কেউ হোন না। যাও। ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে। অনেক রাত হয়েছে।’

বাবার বাধ্য মেয়ে উমামা। তাই কথা শুনল। আদেশ করা মাত্রই উমামা দাদীর কাছে চলে গেল। উষাদ এবার রেগেমেগে বলল,

-‘আপনি কি যাবেন এখান থেকে? কী সমস্যা আপনার? সবকিছু তো ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কেন এসেছেন এখন, আমার সুখের সংসারে আগুন লাগাতে?’

-‘আমি তো শুধু মেয়েকে দেখতে এসেছি।’

-‘যতটুকু দেখেছেন, যথেষ্ট। আর দেখতে হবে না।’

রুদিতার দিকে রাগী চোখে তাকাল উষাদ। বলল,
-‘বাইরের মানুষের সাথে এত কথা কীসের? মুখের ওপর দরজা আটকে দিতে পারো না? উমাকে ঘুম পাড়িয়ে তাড়াতাড়ি রুমে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।’

কথা বাড়াল না রুদিতা। মেয়ের কাছে চলে গেল। উষাদ শক্তচোখে বিপাশাকে একনজর পরখ করে বলল,
-‘যে ভুলটা আপনি করেছিলেন, সেটা শোধরানোর সুযোগ আর নেই। উমার জীবন থেকে তার মা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এইটুকু বুঝিয়েই বাচ্চাটাকে বড়ো করছি আমি। যেহেতু আপনি নিজেই একদিন বাচ্চাটাকে অস্বীকার করেছিলেন, সেই হিসাবে উমার ওপর আপনার কোনো অধিকার আর নেই। উমা মা পেয়েছে। মায়ের ভালোবাসা, আদর-স্নেহ সবটাই পাচ্ছে। আশা করব এটাই আমাদের শেষদেখা। এরপর যদি আপনি এখানে আসেন, উমাকে নিজের সন্তান বলে দাবী করে তার অবুঝ মনে আপনাকে ঘিরে মায়ের টান ও ভালোবাসা জাহির করতে চান, তবে আমি আপনার নামে মা//মলা করতে বাধ্য হব। যে সম্পর্কের সুতো আপনি নিজে ছিঁড়েছেন, সেই সম্পর্ককে এখন আবার কোন সুতো দিয়ে জোড়া লাগাতে চাইছেন? একটু বেশিই স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছেন না? দূরে ছিলেন, দূরেই থাকুন। অকারণ অন্যের সংসার ভাঙতে এসে নিজের পায়ে কুড়াল মারবেন না। চলে যান এখান থেকে। এই বাড়ির কেউ আপনার আপন নয়, আপনিও কারও কিচ্ছু নোন।’

***

এত কথার পর আর থাকা যায় না এখানে। লজ্জায় মাথা নুইয়ে এলো বিপাশার। অপমানের চা//বুকটা আর সহ্য করতে পারল না। চলেই গেল। দরজা আটকে মায়ের রুমে উঁকি দিল একবার। উমামা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। হোসনা বেগমও ঘুমিয়ে পড়েছেন। দু’জনের দু’পাশে পাশবালিশ রেখে দিল রুদিতা। আলো নিভিয়ে দরজার সামনে উষাদকে দেখে বলল,

-‘চলে গেছে?’

-‘যাবে না তো কী করবে?’

-‘যেভাবে এসেছিল। উমা ভীষণ ভয় পেয়েছে। ওর মনে যদি ভয় ঢুকে?’

-‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তেমন কিছু হবে না আশা করি। ও কোনোদিন বিপাশার ছবি দেখেনি। ও জানছে তোমাকে। চলতে পথে তুমি-ই ওর ভরসা, এতদিনে এটা বুঝে গেছে।’

-‘তবুও, যদি ওই মেয়েটা আবার আসে?’

-‘আরেহ্ দূর। আসবে না। খামোখা ভয় পাচ্ছ।’

রুদিতার ভয় দূর হলো না। নিশ্চুপে হেঁটে হেঁটে রুমে আসলো। সকাল থেকে কিছু বলার চেষ্টা করছিল সে, কিন্তু সুযোগই হচ্ছিল না। এখন যা পরিস্থিতি গেল, তাতে আর সায় পাচ্ছে না। একটা ছোট্ট অপরাধবোধ এসে ঘিরে ধরছে তাকে। বার বার মনে হচ্ছে, আরেকটু সাবধান থাকা উচিত ছিল। ভাবনারত চেহারা নিয়ে রুমে প্রবেশ করে চুপ করে বিছানায় বসে রইল। উষাদ অবাক হয়ে বলল,

-‘আশ্চর্য! এখনও ভয় পাচ্ছ?’

-‘ভয় না। অন্যকিছু ভাবছি।’

-‘কী?’

এইমুহূর্তে দুটো বাচ্চাকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া উচিত তার। অথচ কোথা থেকে সবকিছু গড়বড় হয়ে গেল টেরই পেল না। নানুবাড়ি থেকে ফিরে, গত ক’দিন ধরে নিজেকে ভালোমতো নোটিশ করছিল রুদিতা। সব হিসাব মিলিয়েই, গতকাল একটা প্রেগন্যান্সি কীট এনে টেস্ট করে রেখেছিল। রেজাল্ট যে পজেটিভ আসবে কে জানত। ভয়মিশ্রিত মন নিয়ে রুদিতা বলল,

-‘একটা মিস্টেক হয়ে গেছে। আমাদের আরেকটু সতর্ক থাকা উচিত ছিল।’

গালে হাত দিয়ে, ভাবুক নয়নে তাকিয়ে উষাদ বলল,
-‘ওমা তাই! কেন শুনি?’

সিরিয়াস মুহূর্তে উষাদের এই একটা কথাতে রুদিতা বেজায় রেগে গেল। ছেলেটা এমনভাবে তাকিয়ে আছে, যেন সে কোনো কৌতুক শোনাতে বসেছে। তার গাল ফুলানো দেখে মজা পেল উষাদ। বলল,

-‘বলো, কী মিস্টেক হয়েছে? বলছ না কেন?’

হাতের কাছে থাকা বালিশ তুলে উষাদের মুখের ওপর ছুঁড়ে মা//রল রুদিতা। হনহনিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে আসলো আবার। টিস্যুপেপারে মুড়িয়ে রাখা প্রেগন্যান্সি কীটটা চোখের সম্মুখে নাড়িয়ে বলল,

-‘এটা। এখন কী হবে?’

উষাদ কীটের দিকে নজর দিল। দুটো দাগ দেখে তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। চট করে রুদিতাকে কোলের ওপর বসিয়ে দু’হাতে প্যাঁচিয়ে নিয়ে বুকে মাথা রেখে বলল,

-‘যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমরা বাবা-মা হতে যাচ্ছি।’

রুদিতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘আমরা বাবা-মা হয়ে গেছি অলরেডি।’

-‘আবার হব, সমস্যা কী?’

-‘সমস্যা কিছুই না।’

-‘তাহলে এত ঘাবড়াচ্ছ কেন?’

-‘সন্তানদের ঠিকমতো মানুষ করতে না পারলে কী হয়, তা তো দেখেছেন। এই কারণেই ভয় হচ্ছে একটু। তাছাড়া, ওরা কি সারাজীবন একসাথে থাকবে? যদি আলাদা হয়ে যায়? যদি মতের মিল না হয়? যদি সবার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হয়? যদি একজন আরেকজনকে বোঝা ভাবে? কী করবেন তখন?’

উষাদ মাথা তুলে বেশ খানিকক্ষণ গভীরচিত্তে চেয়ে থেকে আলগোছে অধর ছুঁলো কপালে। ধীরকণ্ঠে বলল,
-‘প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনা ও ভালোবাসার ধরনও আলাদা। তবে প্রত্যেকেই যদি মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারে, তাহলে আর কোনো সমস্যা দেখা দেয়ার কথা না। আমাদের করণীয়, সবাইকে শিক্ষা-দীক্ষা দেয়ার পাশাপাশি প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করা। যেন কোনোদিন, ওরা কেউ কাউকে পর না ভাবে। সবাই যেন একই সুতোয়, একই সম্পর্কে বাঁধা থাকতে পারে। দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে যদি আমরা কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি দেখাই, তবে তারাও বিগড়ে যাবে। ওদের জন্য আমাদের ভালোবাসা ও দৃষ্টিভঙ্গি সমান থাকতে হবে।’

-‘এটাই তো কঠিন কাজ। শিক্ষা-দীক্ষা কি সবসময় মানুষকে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে?’

-‘ঠিক এই কারণেই ছোটোবেলা থেকে পারিবারিক সাপোর্ট খুব বেশি প্রয়োজন সন্তানদের। একজন সন্তান প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে তার পরিবার থেকে। ভালো হোক কি মন্দ, বাবা-মা, পরিবারের সদস্য ও আশেপাশের দৃশ্য দেখেই তারা শিখে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটা বিবেকবান মানুষের উচিত, বাচ্চাদের সামনে সদা সৎ থাকা। যেকোনো বিষয়েই। তুমি-আমি মিলে চেষ্টা করব, আমাদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষাটা দিতে। হয়তো প্রত্যেকের মেধা এক হবে না, হয়তো প্রত্যেকের চিন্তাভাবনা সমান হবে না, তবে কেউ বিপথগামী হবে না ইনশা’আল্লাহ্।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদিতা। আর কেউ রওনকের মতো না হোক। তার অনাগত সন্তান, রুহান ও উমামা যেন সবার আদর-ভালোবাসা ও সাপোর্টে প্রকৃত মানুষ হয়, এইটুকু প্রার্থনা তার। নীরব থেকে নিজের মনকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রুদিতা। উষাদ বলল,

-‘মিছেমিছি ভয়কে দূরে সরাও আর সুস্থ থাকো। মনের জোর হারিয়ে ফেলো না। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার হুকুমে যে বন্ধন তৈরী হয়েছে, তিনি চাইলে তা আমৃত্যু অটুট থাকবে। হয়তো অনেক ঝড়তুফান আসবে, অনেক বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে, তবুও কোনো অবস্থাতেই ভয়কে মনে প্রশ্রয় দেয়া চলবে না।’

নির্ভার হাসল রুদিতা। বলল,
-‘জেনে রাখুন, আপনি পাশে থাকলে কোনো ঝড়তুফান কিংবা বাধাবিপত্তিকে আমি ভয় পাই না।’

-‘তাহলে আর কী? চুপটি করে শোও আর আমাকে আমার অস্তিত্বটাকে অনুভব করতে দাও।’

এবার বেশ লজ্জা পেল রুদিতা। উষাদ থামল না। সে তার অনাগত সন্তানের সাথে বকবক শুরু করল। বাবা হওয়ার যে অসাধারণ অনুভূতি সেটা খুব কাছে থেকে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরে চোখ থেকে দু’ফোঁটা খুশির পানিও ঝরে পড়ল আনন্দে। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো নিজের কাছে। সন্তানদের জন্য ভালো বাবা হয়ে উঠবে। হবে তাদের ভরসা ও বিশ্বাসের জায়গা। তার সন্তানেরা তাকে দেখেই শিখবে, কীভাবে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে হয়। কীভাবে জীবনটাকে উপভোগ করতে হয়। কীভাবে প্রত্যেকটা সম্পর্ককে একই সুতোয় বেঁধে রাখতে হয়। করুণাময় সহায় হলে, তাদের এই যাত্রা নিশ্চয়ই সহজ, সুন্দর ও বিশ্বাসের হয়ে উঠবে।

***

সমাপ্ত…

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে