জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

1
1169

#জানালার_ওপারে
||শেষ পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
দমবন্ধকর লাগে প্রতিটি দিন। আমার ঘুম ভাঙার আগেই আবেগ ভাই চলে যান অফিসে। উঠে তাঁর ছায়াটাও পাই না। এটাই প্রায় সপ্তাহ তিনেক ধরে চলমান। আজও তেমনই হলো। উদাস মনে পানি বসালাম চুলায়। অসহ্যকর তাপে টগবগ করে ফুঁটতে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে অগোছালো হয়ে পড়া সমীকরণগুলোতে মেলানোর চেষ্টা করছি। কখনও ব্যর্থ হয়ে নিজেকে বোঝাচ্ছি। এসব কিছু তো ভ্রান্ত ধারণা মাত্র, মুখে বললেই কি শুধু ভালোবাসার প্রকাশ হয়? আবার নিজের যুক্তিতে আবার নিজেই সন্দেহ প্রকাশ করছি।

চা কোনোরকম গলাধঃকরণ করে টুকটাক জরুরি জিনিসপত্র একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিলাম। প্রচণ্ড অস্থিরতা কাজ করছে, ভালো লাগছে না বদ্ধ ঘরে। ভাবছি, দিন দুয়েক নিজেদের বাসায়ই কাটাবো।

কেমন যেন অদ্ভুৎ লাগছে নিজের বাসায় যেতেই। ঐ যে বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় আম্মু জরুরি তলবে ডেকে আবেগ ভাই বাসায় কাজে হেল্প করে এই ব্যাপার নিয়ে, আর ভাবী ইচ্ছে মতো কথা শোনায় মাকে নীরব পেয়ে। তারপর থেকেই যাই না, গেলেও ঐ বসার ঘরে ঘণ্টা খাণেক বসে চলে আসি। রাগ-ক্ষোভ ধরে রেখেছি বা কথা বলি না এমন নয়। তবে আগের মতো আপন মনে হয় না। তীব্র কিংবা অতীব্র এক অদৃশ্য তিক্ততা তো তৈরি হয়েছে পরিবারের সাথেই, তা মানি।

দরজা খুলে আমাকে দেখে হাসি মুখে ঘরে তোলে মা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠায় আমি অসম্ভব হাঁপিয়ে গিয়েছি, কথাও বলতে পারছি না। মা পানি নিয়ে আসলে ডগডগিয়ে এক গ্লাস পানি পান করে ফেলি।

“ভালো লাগছে রে এখন সামু? এতো কষ্ট করে আসতে গেলি কেন? কোনো দরকার হলে আমাকে বললে আমিই তো যেতাম।“

“বেড়াতে এসেছি।“

মা কেমন যেন চমকালো। ভাবীর কপালে দৃশ্যমান ভাঁজ। তারা কি অখুশি আমার আগমনে? ঠাট্টার ছলে একদিন থাকবো বলেছিলাম তখনও কিছুটা বিচলিত হতে দেখেছিলাম ভাই-ভাবীকে। বিয়ের পর বুঝি সত্যিই পিতৃগৃহ বলতে কিছু থাকে না নারীদের। তবে আল্লাহ যে অংশীদার করলো নারীকে পিতৃগৃহ, স্বামীগৃহ উভয়েরই। অথচ, সমাজ করেছে দুই দিক থেকেই বঞ্চিত। সমাজ কি আর মানে কোনো ধর্ম?

“থাকতে এসেছিস? আচ্ছা, ভালো করেছিস। ভাত চুলোয় বসানো, আমি দেখে আসি একটু।“

মা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আমিও উঠে লাগেজ নিয়ে নিজের রুমের দিকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলাম। ভাবী বাধা দিলেন।

“ঐ রুমে কোথায় যাচ্ছো? খাট নেই তো। তুমি তো আর নেই, সাব্বিরের স্টাডি রুম বানিয়ে দিয়েছি ঐটাকে। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িই শুধু নিজের বাড়ি, সেখানেই থাকা ভালো।“

আমি শক্ত ধরনের নারী হলেও কান্না আটকানো বড়োই কষ্টসাধ্য আমার নিকট। তবুও প্রাণপণ চেষ্টা করে চোখের জল চোখেই স্থির রাখি।

মুখে কোনোরকম বললাম, “নিজেও মেনো!“

“বেয়াদব মেয়ে! আমার স্বামীর বাড়িতে এসে আমাকে কথা শোনানো! আসুক তোমার ভাই!”

“বাড়িটা আমার বাবার।“

মাও ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছে। ভাবীর চোখে এক মুহূর্তেই জলের ফোয়ারা নামতে শুরু হয়ে গিয়েছে।

“মা আমি শুধু বলেছি স্বামী-সংসারে ভালো ভাবে করতে। তাতেই দেখুন না, আপনার মেয়ে আসতে না আসতেই আমাকে খোঁটা দিচ্ছে। আমি না কি আপনাদের সেবা-যত্ন করি না, সারা বছর বাপের বাড়ি পড়ে থাকি। এমন কী এটা নিজের বাবার বাড়ি বলেও খোঁটা দিল।“

“মাশিয়াত! মেয়েটা মাত্র এসেছে, এমন না করলেই কি নয়! আর তোকেও বলি মেয়ে, আসতে না আসতেই ভাবীর সাথে ঝগড়া শুরু করেছিস! বেয়াদব মেয়ে!”

এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম না। লাগেজ হাতে বেরিয়ে গেলাম। মা কয়েকবার ডাকলো বোধহয়। সত্যি বলতে, ভাবীর চেয়ে মায়ের কথাগুলোই বেশি গায়ে লেগেছে।

বাসায় ফিরতে মন চাচ্ছে না। তবুও রাস্তায় রাস্তায় তো ঘুরে বেড়াতে পারি না। ঐ দমবন্ধকর ফ্ল্যাটটাতেই ফিরে গেলাম।

সারা দিন আর মুখে কিছু উঠলো না আমার। হৃদয় ভর্তি সব হতাশা, তিক্ততা সেখানে পেটে আর কী করে খাবার ঢোকে।

নিয়মমাফিক রাত হলো, আবেগ ভাই বাড়ি ফিরলেন। ফ্রিজের খাবার গরম করে দিলে চুপচাপ খেয়ে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমিও ধীরেধীরে নিদ্রায় ডুবলাম। তন্দ্রাহীন থেকেও বা লাভ কি? আগামীকালও তো সব নিয়মমাফিক চলবে, ভোরের আগেই তাঁর অফিস, সারা দিন আমার একাকী থাকা।

শুক্রবার বেলা এগারোটা।

ঘুম ভাঙতেই চোখ কপালে আমার। আজ আবেগ ভাই বাসায়, আবার নাস্তা বানানোও বাকি। তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে উঠলাম। এমনিতেই আমার গর্ভাবস্থার প্রথম থেকে রক্তশূন্যতা আর অপুষ্টির সমস্যা আছে, তার উপর বিগত মাস খাণেক নিজের প্রতি অবহেলায় দু’কদম চলতেই ঢলে পড়তে নিলাম। আবেগ ভাই ধরায় এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। তিনি বেডে এনে বসালো।

“ঠিক আছো তুমি মায়াবালিকা? হঠাৎ এমন হলো কেন? কালই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এক মিনিট তোমার মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন? তুমি কি খাওয়া-দাওয়া করো না ঠিক মতো?”

আবেগ ভাইয়ের এই কেয়ারিং কথাগুলো শরীরে সূচের মতো ফুঁটছে। তাচ্ছিল্য জেগে উঠছে হৃদয়ে।

“আপনি কি আসলেই পরোয়া করেন? প্লিজ, আবেগ ভাই আর কতো অভিনয় করবেন? এর চেয়ে অবহেলাটা বরং বেশি মেনে নিত পারবো আমি।“

তিনি অবাক হলেন মনে হলো। তবে অবাক হওয়ার মতো সত্যিই কিছু বলেছি কি?

“এসব কী বলছো মায়াবালিকা? তুমি কি কিছু নিয়ে রেগে আছো আমার উপর? দেন আ’ম সরি। বাট এভাবে কথা বোলো না। আমি অভ্যস্ত নই তোমার এমন আচারণে।“
বলতে বলতেই আমার মুখ দু’হাতের মাঝে নিয়ে নিলেন। আমি সরে আসলাম তাঁর থেকে।

“প্লিজ, আবেগ ভাই এই কেয়ারিং স্বামী বা প্রেমিক হওয়ার নাটক করবেন না। বাস্তবতা তো এটাই করুণার থেকে বিয়ে করেছিলেন আমায়, তাই তো সময়ের সাথে ধৈর্য্য, যত্ন সব ফুঁড়িয়েছে। কখনও তো ভালোবাসেননি আমায়।“

আবেগ ভাই এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর মুখ খানা থমথমে। কেমন যেন বিধ্বস্ত, অপ্রস্তুত, হতাশ দেখালো তাঁকে। আমি বুঝেও অবুঝ হয়ে রইলাম। কারণ আমার মতে বাস্তবতাই ব্যক্ত করেছি।

তিনি ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আমি ভালোবাসি না তোমায়?”

“না। বাসেননিও কখনও।“

“আমি সত্যি ভালোবাসি না তোমায়? সত্যিই তোমার এটা মনে হয়? এতোটা পথ তোমায় আগলে পাড়ি দেওয়ার পর, তোমার জন্য এতো যুদ্ধের পর, এতো ভালোবাসার পরও আমার ভালোবাসার প্রমাণ পেলে? আমি ব্যর্থ, সত্যিই ব্যর্থ প্রেমিক। ব্যর্থ প্রেমিকদের বেঁচে থাকাও মৃত্যুতুল্য।“

তিনি বদ্ধ উন্মাদের ন্যায় দু’হাতে চুল আঁকড়ে কথাগুলো শুধাতে শুধাতে বের হয়ে গেলেন।

আমার চোখ বেয়ে বিরামহীন ভাবে নোনাজল বেয়ে চলেছে। অপারাধবোধ কোথাও তীব্র ভাবে আঘাত করে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে আমাকে। অথচ, মুখ্য ভাবে মনে হচ্ছে আমি ভুল কিছু বলিনি।

হঠাৎ করেই ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠে। চোখের জল মুছে আমি যেয়ে ধরি।

“হ্যালো, আমি হীমা বলছি আবেগ। ফোন বন্ধ কেন তোর? ট্রিট দিবি, বস তোর প্রজেক্ট এপ্রুভ করেছে।“

“আসসালামু আলাইকুম, আমি তাঁর স্ত্রী বলছি। তিনি তো নেই।“

“আপনিই আবেগের মায়াবালিকা! সত্যিই আপনাকে দেখার অনেক ইচ্ছে ছিল। বড্ড কপাল আপনার আবেগের মতো হাজব্যান্ড পেয়েছেন। গত কয়েকটা মাস গাধার মতো খেটেছে আপনার স্বামী, শুধুই আপনার ডেলিভারির সময়টা আপনার সাথে থাকার জন্য।“

“মানে? বুঝলাম না কী বললেন?”

“আপনাকে আবেগ বলেনি ভাবী? আসলে আমাদের বড়ো একটা প্রজেক্ট ছিল আমেরিকান কোম্পানির সাথে। যেটার জন্য আবেগকে আপনার ডেলিভারির টাইমে মাস খাণেকের জন্য আমেরিকা যেতে হতো। আবেগ প্রথমে বসকে ডিলে করতে বা অন্যকাউকে রিপ্রেজেন্ন্টেটিভ হিসেবে পাঠাতে রিকুয়েস্ট করে। কিন্তু তিনি কোনো কথা শুনেন না কারণ আবেগের থেকে বেটার কেউ হবে না এ কাজের জন্য এবং ডিলটিতে লাভ প্রচুর কোম্পানির। চাকরিচ্যুত করার হুমকিও দেন। আবেগ পরে রিকুয়েস্ট করে সে এই প্রজেক্টটার সমস্ত কাজ কিছু সময়ের মধ্যে করে দিলে তার আমেরিকার ট্রিপটা যেন আগে নিতে দেওয়া হয়। কারণ আপনিও তাহলে সাথে যেতে পারবেন। বসও শর্ত দেন তিনি যোগ্য মনে করে এপ্রুভ করলেই রিকুয়েস্ট কমপ্লিট হবে। আবেগ সত্যিই সাত-আট মাসের কাজটা মাত্র আড়াই মাসে কমপ্লিট করে দিয়েছে দিন-রাত এক করে। সত্যিই সৌভাগ্যবতী আপনি।“

নারীটির কথা শুনে আমি খুশি হবো কোথায়? আমার হাত-পা, হৃদয়, কণ্ঠ অনবরত কম্পিত হচ্ছে। আরেক দফা এতো বাজে ভাবে ভুল বুঝলাম তাঁকে! কী করে ক্ষমা চাইবো? কী করে তাঁর সামনে এই মুখটি নিয়ে দাঁড়াবো? তাঁর কয়েক মাসের ব্যস্ততাও মেনে নিতে পারলাম না? কাজ করা পুরুষের কাজের ব্যস্ততা অস্বাভাবিক কিছু না, এ কথা একবারও মাথায় আসলো না?

কোনোরকম বিদায় জানিয়ে টেলিফোনটা রাখলাম। নিজেকে অসংখ্যবার বকে যাচ্ছি। বারবার কল করছি আবেগ ভাইকে, কিন্তু ফোন বন্ধ। এতো অভিমান! এতো অভিমানের দেয়াল কী করে পাড় করবো আমি? তৃষ্ণার্ত পাখির মতো অপেক্ষা করতে থাকি।

আসরের নামাজ শেষ করে তসবিহ পড়ছি এমন সময়ে মোবাইলে কল রিংটোন বেজে উঠে। আমি তাড়াহুড়ো করে জায়নামাজ থেকে উঠে কল রিসিভ করি। অতঃপর যে দু’টি বাক্য কর্ণগোচর হয় তা আমার পুরো পৃথিবী ধ্বংস করতে যথেষ্ট ছিল।

“হ্যালো, এই মোবাইলটি যার তিনি এক্সিডেন্ট করেছেন। ‘নর্থ ইস্ট’ (ছদ্মনাম) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন।“

আমি সামলাতে পারি না নিজেকে। “আল্লাহ” বলে জোরালো এক চিৎকার দিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ি। মোবাইলটাও ছিটকে পড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খায়।

আমার চিৎকার শুনে আবেগের মা, বাবা, বোন ছুটে আসে। আমার আর হুশ নেই কোনো। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করি।

শাশুড়ি মাও ভয় পেয়ে যান। “কী হয়েছে বউ? এভাবে কাঁদছো ক্যানো?”

“মা, আবেগ ফোন… এক্সিডেন্ট করেছেন। মা আমার আবেগ…” আর কিছু মনে নেই আমার। চোখের সামনে ঘোর অমাবস্যা।

জ্ঞান ফিরলে নিজের মাকে দেখতে পাই সামনে। মাও আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছে। আবেগ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে।

“মা, আবেগ ভাই কোথায়? তিনি কেমন আছেন? আমি হাসপাতালে যাবো।“ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করি।

“আম্মু, তুই শান্ত হ। আবেগ সুস্থ হয়ে যাবে। তুই শান্ত হ।“

“না, না, আমি আবেগ ভাইয়ের কাছে যাবো।“

আমার পাগলামিতে আব্বু, আম্মু বাধ্য হয়ে আমাকে নিয়ে সেই মুহূর্তে হাসপাতালে যায়। তখন আইসিইউতে আবেগ ভাই। কাঁচের গ্লাস হয়ে তাঁর নিথর দেহ খানা দেখে যেন আমার হৃদয় টুকরো টুকরো হচ্ছে অনবরত।

আমি পাগল হয়ে নার্স-ডাক্তারের কাছে বারবার জানতে চাচ্ছি তাঁর অবস্থা। তাঁদের একটাই উত্তর, “আল্লাহকে ডাকেন বেশি বেশি।“

অবশেষে রাতের দিকে আবেগ ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে। প্রথমেই একজন পুলিশ অফিসার ভিতরে যান রিপোর্ট তৈরি করতে আমরাও দরজায় দাঁড়িয়ে শুনি। পুলিশটির বারবার জিজ্ঞেস করার পরও তিনি তীব্র ভাবে নাকোচ করেন যে ট্রাক ড্রাইভারের ভুল নেই। তিনিই মাঝ রাস্তায় এসে পড়েন।

তাঁরা বের হয়ে যেতেই নার্স এসে জানায়,
“মায়াবালিকা কে? রোগী বারবার এই নাম জপছে। তিনি প্লিজ আসুন আমার সাথে।“

আমি তাড়াতাড়ি উঠে গেলাম নার্সের সাথে। আবেগ ভাইয়ের শোচনীয় দশা দেখেই মুখ চেপে গুমড়ে কেঁদে উঠলাম।

আবেগ ভাই বহু কষ্ট করে শুধালেন, “মায়াবালিকা তোমার অশ্রু আমার কাছে মৃত্যুযন্ত্রণা থেকেও বহু গুণ বেশি কষ্টতুল্য। কেঁদো না দয়া করে।“

আমি জোরপূর্বক কান্না থামাই। তিনি আবারও মুখ খুলেন।

“সদ্য কলেজ কাল থেকে, যখন তোমার বয়স কিশোরী হতেও আরও এক কাঠি উপরে উঠতে বাকি… বিশ্বাস করো, তখন থেকে আমি নিজের সর্বস্ব দিয়ে তোমায় ভালোবেসেছি। আমি ছোটো বেলা থেকেই… এমন, মুখে অনুভূতির প্রকাশে…. অসক্ষম। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র খাদ… নেই। জানি না কোথায় কমতি থেকে গেছে যে তুমি আজও আমার… আমার ভালোবাসা বোধ করোনি। আমার ব্যর্থতা, ব্যর্থ পুরুষ, ব্যর্থ প্রেমিক আমি। কিন্তু অন্ততপক্ষে মৃত্যুর আগে তোমায় বিশ্বাস…. বিশ্বাস করাতে চাই, আমি সত্যিই, সত্যিই ভালো…“

তিনি কথা বলতে পারছেন না। বারবার শ্বাস আটকে আসছে, কষ্ট হচ্ছ, থামতে হচ্ছে। তাও অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না।

অনুরোধ করলাম,
“থামুন, প্লিজ থামুন, আপনার কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি আপনার মতো করে ভালো আমাকে কেউ বাসতে পারবে না। এমন কী আমার ভালোবাসাও আপনাকার ভালোবাসার কাছে তুচ্ছার্থক। লোকে ঠিকই বলে আমিই আপনার যোগ্য নেই। ব্যর্থ আপনি নয়, আমিই। এমন খাঁটি প্রেম উপলব্ধি করার জ্ঞান যার নেই, তার গোটা জীবনই ব্যর্থ। আপনি এবার সুস্থ হয়ে উঠুন, সারা জীবন আপনার পদতলে দাসী হয়ে কাটাবো।“

মলিন মুখেও ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো তাঁর। যদিও চোখে বেয়ে পানি পড়ছেই।

“মায়াবালিকা আমার শাহাজাদি, দাসী তো কখনও দুঃস্বপ্নতেও হ.. হতে পারবে না আমার। সেই সুযোগই দিব না আমি।“

উত্তর দিলাম না। তাঁর একদিনেই শীর্ণ হয়ে পড়া হাত কপালে ঠেকিয়ে আঁখিজল ফেলতে লাগলাম। অতঃপর গভীর নীরবতা…

আকাশটা ঘোলাটে, এই যেন নামবে অশ্রু। ভরা দুপুর, তবে সন্ধ্যা মনে হচ্ছে। প্রকৃতিরও কতো রকম লীলাখেলা। সকালবেলাও এক চোট বৃষ্টি হয়েছে। ইকবাল রোডের বাইতুস্ সালাম জামে মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছি, সামনেই আবেশের স্কুল। বড়ো বড়ো ইমারতগুলো পেরিয়ে উঁকি দিচ্ছে ছাদে, বারান্দায়, প্রাঙ্গনে লাগানো বৃষ্টি স্নাত বাগানবিলাস, কদম, দোলনচাঁপা, জুঁই ফুল৷ সারা বাতাস মৌ মৌ করছে জুঁই ফুল, স্পাইডার লিলি সহ নানা ফুলের ঘ্রাণে। শহরে ভেজা মাটির ঘ্রাণ তেমন একটা না পাওয়া গেলেও বড়ো বড়ো অট্টালিকার ভীড়ে ফুলের সমারোহের অভাব হয় না। মানুষের সচেতনাতা না সৌখিনতা এর পিছনে কে জানে?

ফুলে সজ্জিত গাছের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেই আমি। অথচ, একদা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম এসব গাছ, ফুল দেখলে। আবেগ ভাই সবসময় বলতেন আমাকে একটা বিশাল বাগান করে দিবেন। কীভাবে যেন করা আর হয়ে উঠেনি। ব্যস্ততায় হয়তো, আবার আমরা সময়ই বা কতোটুকু পেয়েছিলাম একে অপরের সাথে?

ভাবনার মাঝেই নিশা ডাক দেয়। নিশার ছেলে নিহামও একই স্কুলে পড়ে, আবেশের থেক দুই ক্লাস নিচে। এগিয়ে গেলাম তার দিকে।

“কোথায় যাচ্ছিস? আবেশেদের আজকে এক্সট্রা ক্লাস হবে। আর যেই ভীড়! চল কোথাও বসি।“

“হু।“

স্ট্রাইকার মাঠের সামনে বসে আছি। নিশা নিজের মতো কথা বলে যাচ্ছে। আমার তাতে ধ্যান নেই, নিজের হাস্যরসিক আচারণ হোক বা প্রাণখোলা হাসি সব তো কবেই হারিয়েছি।

“তুই শুনছিস আমার কথা?”

চমকিত হলাম মৃদু। শঙ্কিত চোখে নিশার দিকে তাকালাম।

নিশা আমার কাঁধে হাত রাখলো। “এভাবে আর কয়দিন? আবেগ ভাই চলে গিয়েছে সাত বছর হতে চলেছে এখন তো সামলা নিজেকে।“

হৃদয়টা মুচড়ে উঠলো আমার। হ্যাঁ, আবেগ ভাই সেদিন রাতের গভীর নীরবতায় আমার সকল সুখ-অনুভূতির ভার নিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে তাঁর যেই ভালোবাসায় আমি এতো অবিশ্বাস ও শঙ্কা রেখেছিলাম সেই ভালোবাসার আরেক দফা প্রমাণ দিয়ে গিয়েছিলেম।

সেদিন তাঁকে হারিয়ে আমার ছয় মাস অবধি দিন-দুনিয়ার কোনো হুশ ছিল না। পাথুরেমূর্তি বনে গিয়েছিলাম, কথা বলাও ভুলে গিয়েছিলাম। কেউ খাবার মুখে তুলে দিলে খেতাম, নাহয় না। এতোটাই শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম কাঁদাও যেন ভুলে গিয়েছিলাম।

সর্বক্ষণ ভাবতাম, আমার কণ্ঠটা না ফিরলে কতোই না ভালো হতো। না শব্দের বাণ ছুঁড়ে ফেলতাম, না আবেগ ভাই ঐ ক্ষণে রাস্তায় থাকতো। প্রিয় পুরুষের মৃত্যুর শোক বড়োই কঠিন! তার উপর পরদিনই মা-বাবা এসে আমায় নিয়ে যায়, আমাদের স্মৃতির রাজ্য তথা ফ্ল্যাটটা থেকে।

হুশ আসে সেদিন যেদিন ভাই তার এক বিপত্নীক বন্ধুর সাথে বিয়ের প্রস্তাব তুলে। আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম বাবা-মা, ভাইয়ের কথাবার্তায়। প্রত্যাখ্যান করি, তারা অনর্থক বোঝায়, ভবিষ্যতের ভয় দেখায়, কিন্তু আমাকে আর বোঝে না। সেই থেকে আর তাদের সাথে তেমন একটা সম্পর্ক নেই।

প্রিয় বন্ধুর শোকে কাতর হয়ে হাসান ভাই নিশাকে নিয়ে দেশে দুই সপ্তাহের মাঝেই সব গুছিয়ে দেশে ফিরে। আমাকে যা জানায় তাতে আমি স্তম্ভিত হয়ে ছিলাম।

বহুদিন ধরেই আবেগ ভাইকে মতি ব্যাপারীর ছোটো ভাই বহুদিন যাবত হুমকি দিচ্ছিল তাঁকে হত্যার। জেলে তিনি ঢুকিয়েছেন জেনে তাঁর উপরই মূলত ক্ষোভটা ছিল। নেতা মানুষ মারুফ ব্যাপারী। এদেশে টাকা এবং শিক্ষার জোর উভয়ই ক্ষমতার জোরের কাছে সদা পরাজয়স্বীকার করে। তাই চুপ ছিলেন আবেগ ভাই। আমাকেও জানাননি, হয়তো দুশ্চিন্তা করবো ভেবে। এই কারণেও আবেগ ভাই আমেরিকার কোম্পানির প্রজেক্টের ঝামেলাতেও চাকরি ছাড়েননি। তাঁর মতো পাগলাটে মানুষের চাকরি ত্যাগই অধিক মানানসই ছিল। কিন্তু চুক্তিটা পাকা হলে প্রমোশন পেয়ে আমাকে নিয়ে এই ঝামেলা হতে দূরে আমেরিকায় সেটেল হতে চেয়েছিলেন তিনি। এর আগেই মারুফ ব্যাপারীর লোকেরা তাঁকে হত্যা করে। ঐ জায়গার সিসিটিভি ফুটেজেও বোঝায় এটা সাধারণ কোনো এক্সিডেন্ট। কিন্তু আবেগ ভাইয়ের মুখের বাণীই সব গোলমাল করে দিয়েছে।

কিন্তু কেন মিথ্যে বললেন তিনি? উত্তর অনুধাবণ করতে সময় লাগেনি। তা হলো – আমাকে বাঁচাতে পারিবারিক, সামাজিক লাঞ্ছনা থেকে। দোষী অন্য কেউ হলেও আবেগের মা-বাবা, পাড়া-পরশি তো আমাকেই দোষী করতো, আবার শত্রুতাও বাড়তো। সত্যিই তাঁর ভালোবাসায় কোনো খাঁদ নেই, খাঁদ তো আমার ভালোবাসায়, বোধশক্তিতে ছিল।

প্রতিশোধের জ্বলন্ত আগুন নিয়ে যখন খোঁজে বের হয়েছি, তখন দেখি কার থেকে প্রতিশোধ নেব? আবেগ ভাইয়ের মৃত্যুর তিন দিন পরই গ্রামের বাড়িতে বাজ পড়ে মারা গিয়েছে, ভয়ংকর এক মৃত্যু ছিল! কথায় তো আছেই, আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর।

বর্তমানে আবেগ ভাইয়ের কোম্পানিতেই তাঁর তুলোনায় ছোটো একটা পোস্টে চাকরি করি। শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে থাকি অফিসের পাশে এক ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে। একসময় মেয়ের কথায় তাঁরাও বের করে দিয়েছিলেন, শুধুমাত্র আবেগ ভাইয়ের আমাদের সন্তানের জন্য রাখা সঞ্চিত অর্থ তাঁদের হাতে তুলে দেইনি বলে। কিন্তু ঐ যে তাঁরা মানুষ হিসেবে একদম খারাপ তো নয়। যখন মেয়ে সকল সম্পত্তি নিজের নামে লিখে দিতে জোর করলো আবেশকে বঞ্চিত করে সেখানেই তাঁদের বিবেক জেগে উঠলো। নাতির কাছে ছুটে আসেন দাদা-দাদী। এই দ্বন্দ্বে মেয়ের সাথে আজও সুসম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তবে দুলাভাই মাঝে মাঝে আসেন আর্শিকে নিয়ে।

আজকাল আমার শাশুড়িও আমায় কিছুটা বোঝে। প্রায় শুধান, “ভাগ্য গুনে এমন বউ জুটেছে আমার আবেগের”। আমি ভাবি, কথাটা হয়তো উলটো হবে।

তবে একটা বিষয় আল্লাহ দেখিয়েছে। আপন যে সদাই আপন থাকবে তা না, পরও আপনের চেয়ে আপন হয়। এই নিশা আর হাসান ভাই আমাদের মা-ছেলের জন্য চাকরিতে বদলি নিয়ে দেশে চলে এসেছে। নিজের ছেলের চেয়ে কম আদর করেন না তারা। জীবিত দু দুটো পরিবার থাকতেও আমার ডেলিভারির সময় শুধু এই দু’টো মানুষই দিন-রাত আমার পাশে ছিল। তাদের কথা মনে পড়লো নিজেকে প্রকৃতপক্ষে ভাগ্যবতী মনে হয়।

খারাপ নেই আমি৷ শ্বশুর-শাশুড়ি, চাকরি, ফুটফুটে সন্তান, স্বচ্ছলতা সবই আছে। নিঃসঙ্গ বোধ করার মতোও একাকী সময় নেই আমার প্রতিদিনের রুটিনে। তবে ভালো কি আছি? না, নেই। এ প্রশ্নই তো ব্যর্থ, যেখানে উত্তর একবারে নির্ধারিত, অপরিবর্তনীয়।

“কী হলো? কথা বলছিস না ক্যানো? দোস্ত প্লিজ মুভ অন কর, আমি জানি তোর কষ্ট বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। তবুও তোকে এভাবে দেখে আমার মোটেও ভালো লাগে না।“

আমি হাসলাম। মনে পড়ে গেল সুফিয়া কামালের ‘তাহারেই পড়ে যে মনে’ কবিতার শেষ কিছু চরণ। আপন মনেই আওড়ালাম,

“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”

“যার স্বামী বিরহের কবিতা আবৃতি করলি না, তিনি নিজেও এবং আরও বহু নারী-পুরুষ কিন্তু জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছিল অন্যকারো সাথে। আর কোনো ভুলও নেই এতে, বরং ভালো।“

“হুম নেই। কিন্তু আবেগ ভাই তো আমায় বিরহ দেননি সাদা খামে মুড়িয়ে, না আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছে। তিনি আর তাঁর ভালোবাসাটা শুধু আমার জানালার ওপারে, দিন-দুনিয়ার দায়ের পাঠ চুকিয়ে ঐ জানালার ওপারে পা রাখলেই তো তাকে পাবো। ততদিন শুধু তাকিয়ে থাকবো তৃষ্ণার্ত প্রেয়সীর মতোন জানালার ওপারে।“

__সমাপ্ত__

1 মন্তব্য

  1. সত্যিই আজ অনেক দিন পর কোনো গল্প পড়ে আবেগপ্রবণ হলাম। গল্পটা আসলে আমাদেরকে অনেক কিছু শেখায়। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ঈপ্সিতা আপু, আমাদের মাঝে এত সুন্দর একটা গল্প উপহার দেওয়ার জন্য।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে