মনোহারিণী পর্ব-০১+০২

0
1733

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১)+(২)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

-“আমি সময়মতো পৌঁছে যাব চাচ্চু! তুমি অযথা টেনশন করো না। স্টেশনে কাউকে পাঠিয়ে দিও!”

আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের বিয়েসাদীর অনুষ্ঠানে খুব একটা আয়োজন করে যাওয়া হয় না মাইসারা’র। জমকালো অনুষ্ঠান, বাদ্য-বাজনা, মানুষের ভিড় ঠে’লাঠে’লি এসব অকারণ ঝামেলা মনে হয় তার কাছে। অথচ তার বড়ো চাচ্চু খুব করে তাকে এই আয়োজনে উপস্থিত থাকতে বলেছেন। শত হলেও ছোটো ভাইয়ের একমাত্র ওয়ারিশ সে। বাড়ির একটা অনুষ্ঠানে থাকবে না, সেটা তো হয়ই না। লোকে শুনলে তো পাঁচ কথা শুনাবে। অথচ তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই বাড়িতে যাওয়ার। একে তো পড়াশোনার চাপ, তার উপর ইন্টার্নশিপ কোর্স! এই মুহূর্তে ছুটি নেওয়াটাও খুব ঝুঁকির হয়ে গেছে তার জন্য। তবুও কিছু করার নেই। কাজিনের বিয়ে খাওয়ার ঝামেলায় বেশিদিন জড়ালেই পড়াশোনায় ঘা’প’লা মা’রবে নিশ্চিত। এতটা পথ অতিক্রম করে শেষে এসে থেমে যাওয়ার পাত্রী সে নয়! এজন্যই মন খুঁতখুঁত করছে তার। সেই সকাল থেকে গড়িমসি করে নিজের ব্যাগপত্র গুছাতে শুরু করে সে। অবিরত ফোনের আওয়াজ তাকে যথেষ্ট বিরক্ত করছিল, তাছাড়া বাবা-মা কেউ-ই নেই! শুধু নেই নয়, বেঁচে থেকেও ওনারা তার কাছে মৃ’ত হয়েই আছেন! অথচ তারা থাকা সত্ত্বেও মাইসারার পুরো দায়িত্বটাই আরমান সাহেব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। অন্তত মুরব্বি মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু তো ছাড় দেয়াই যায়। এজন্যই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। সোজা জানিয়ে দিয়েছে, মাত্র এক সপ্তাহ থাকবে সেখানে, ওয়ালিমা শেষে যথারীতি হোস্টেলে ফিরে আসবে। এসব ঝামেলায় তার বেশি না জড়ানোই উচিত। শেষে নিজেকে গড়ে তোলার সঠিক লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাবে।

এক সপ্তাহের জন্য যাবে, এজন্যই বেছে বেছে চার-পাঁচটে জামা ব্যাগে ঢুকিয়েছে মাইসারা। সবকিছু চেক করে রুমমেট রিপার থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনে চলে আসলো। কাউন্টার থেকে পারাবাত ট্রেনের একটা টিকিট কে’টে নিল। ট্রেন আসলো খানিকক্ষণ পরই। তাতে আরোহন করে নিজের সিট খুঁজে নিল। ব্যাগ উপরে রেখে সিটে বসে আরমান মাহমুদকে জানিয়ে দিল, সে ফিরছে! ভদ্রলোকের খুশি আর ধরে না। কতদিন হলো মেয়েটাকে দেখেননি। হাতে তুলে খাবার খাইয়ে দেননি! অবশেষে মেয়েটা তার বাড়ি ফিরছে, এই আনন্দ কীভাবে প্রকাশ করবেন তিনি ভেবে পাচ্ছেন না! ফোন রেখে দ্রুত বাড়ির বাইরে চোখ বুলালেন।

ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একজনকেও বাড়ির আঙিনায় দেখা গেল না। কোনদিকে যে পালিয়েছে সবক’টা কে জানে! বাড়ির পুরো আঙিনা খুঁজতে খুঁজতে পুকুরপাড়ে আসলেন। সেখানেই বড়শী হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে মাছ তোলায় ব্যস্ত আছে অনিক! যদিও ব্যাংকের সবাই তাকে ইমতেহান মাহমুদ হিসেবেই চিনে। আত্মীয়স্বজন আর পরিবারের লোকেরা অনিক নামেই ডাকে। ছেলেকে দেখে একপ্রকার চিৎকার করে বললেন,

-“মাছ যখন তুলছিস, বড়ো দেখে রুই, কাতলা তুলিস। কতদিন পর সারা বাড়ি আসছে! হোস্টেলে ডালভাত খেয়ে বাচ্চাটার দিন যাচ্ছে। মুখ ফুটে বলেও না, চাচ্চু আমি এখানকার খাবার খেতে পারছি না। তুই তো পারিস, মেয়েটার একটু খেয়াল রাখতে! সারাদিন কী এমন হালের ব’ল’দ টানিস যে, আমার একমাত্র ভাতিজীর কোনো খোঁজখবরই রাখিস না? বিয়ে করে বউ পালতে পারবি তো বাপ?”

-“বিয়ের জন্য আমি পা’গ’ল হইনি। যা পা’গ’লা’মি করার তোমরা করছো। আর শোনো, তোমার ভাতিজী কচি খুকি না যে ডালভাত হজমে তার অসুবিধা হবে! স্বপ্ন পূরণের জন্য হোস্টেলে যেতে হয়েছে তাকে, কেউ ঠেলে পাঠায়নি। বিয়ের জন্য কি দেরী করলে হতো না? ওর পড়াশোনায় চা’প দেয়ার দরকার ছিল না। কী এক লাফঝাঁপ শুরু করেছো তোমরা!”

অনিকের চেহারায় কোনো হেলদোল নেই। গাম্ভীর্য ধরে রেখে কথা বললেও বাবার দিকে ফিরেও তাকায়নি সে! বড়শীর দিকে তাকিয়ে বাবাকে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে একমনে। আরমান সাহেব খানিকটা বিরক্তই হলেন। বললেন,

-“অক’র্মার ঢেঁ’কি একেকটা! একটা সন্তানও যদি ঠিকঠাক মানুষ হোক। সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। বলি, মেয়েটা আমার বা’নের জলে ভে’সে যাচ্ছে না যে, তোমরা তাকে এইভাবে অবহেলা করছো!”

-“বাবা, কী বা’জে কথা বলছো তুমি! কে সারাকে অবহেলা করে বলো তো? বাড়ির সবাই-ই যথেষ্ট ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে, নয়তো কবেই ভেসে যেত!”

-“আগলে রাখলে কীসের জন্য বাড়ি ছেড়েছে সে? তাছাড়া বড়ো বউমাও তো ভালো ব্যবহার করছে না তার সাথে!”

ভাইয়ের বউ সম্পর্কে একটাও বা’জে কথা বলা কিংবা তড়িৎ সেকথা নিয়ে কোনো আলাপ তোলার আগ্রহ পেল না অনিক! একবার যদি ব্যাপারটা ফারজানার কানে যায় তবে আর রক্ষে নেই! তাছাড়া আলিফও জানে না নিজের স্ত্রীর এই বা’জে স্বভাবের কথা। শেষে দু’দিন খুশিতে কাটানোর বদলে চোখের জলকে সঙ্গী করেই কাটবে মাইসারা’র। আপাতত মুখ কুলুপ এঁটে বসে থাকাই শ্রেয়! তবুও কথা ঘুরাতে বলল,

-“বাবা একটু বুঝো, সারা মেডিক্যালের স্টুডেন্ট। কতটা চাপ ওর উপর। ঠিকমতো পড়াশোনা না করলে ভালো ডাক্তার হতে পারবে না। আমাদের গ্রামের যা অবস্থা, তাতে প্রতি ঘরে ঘরে ভালো একজন ডাক্তার দরকার। ভেবে দেখো, এখানে থাকলে ওর পড়াশোনায় অনেক ঝামেলা হতো। না নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারতো, আর না সফলতাকে আঁকড়ে ধরার জন্য সহজ পথ খুঁজে পেত!”

আরমান সাহেব আর কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। আসলেই তাই! গ্রামের যা পরিবেশ, তাতে এখানে থেকে ওতো দূরে রোজ যাতায়াত করা অনেক কঠিন হয়ে যেত মাইসারা’র জন্য। তাই তার স্বপ্ন পূরণের পথকে সহজ করতেই অনিক তাকে দূরে পাঠিয়েছে। এমন না যে, সে মাইসারার খোঁজখবর নেয় না। মাঝেমধ্যে ফোন করে যখন যা প্রয়োজন সেটা তো সে-ই পাঠায়। আরমান সাহেব আদৌ কি সে খবর জানেন?

*****

মাইসারা স্টেশনে নেমেই চারপাশের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ দেখে চমৎকার করে হাসলো! ট্রেনের বগি থেকে কাঁধে ব্যাগটা ঝুলাতেই ত্বোয়া দু’হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। এই মেয়েটা তার বোন কম বন্ধু বেশি! বয়সের পার্থক্য হলেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণটাই বেশি। একসাথে যত মজার স্মৃতি আছে, দুঃখ এবং সুখের স্মৃতি আছে সবই এই ত্বোয়ার সাথেই! কাঁধের ব্যাগটা টে’নে নিজের কাছেই আনলো সে। বলল,

-“অবশেষে তুই আসলি! বাড়িটা কত ফাঁকা লাগে জানিস? মা চলে যাওয়ার পর থেকে ভাবীটাও পর হয়ে গেছে! কত যে কথা শোনায় রোজ! থাক ওসব কথা, ভালো আছিস তো? পড়াশোনা ঠিকঠাক চলছে?”

মাইসারা ম্লানমুখে হাসি ফুটালো! বাড়ি থেকে হোস্টেলে যাওয়াতে ভালোই হয়েছে বোধহয়! নয়তো রোজ ক’টুভাষীর ক’টুকথায় কান পঁচে যেত তার। শুধু যে কান পঁচতো তা নয়, মন নষ্ট হতো! মস্তিষ্ক চাপ নিতে নিতে দুর্বল হয়ে যেত। এত কষ্টের পড়াশোনা তার, স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই ভে’ঙে যেত। হাঁটতে হাঁটতেই স্টেশনের সীমানা পেরিয়ে মূল গেটের কাছে আসলো। বলল,

-“আমি তো ভালো আছি! তোর পড়াশোনার কী খবর? এবার তো ছোটো ভাইয়াও সংসারী হয়ে যাবে। শুধু তুই-ই পড়ে থাকবি!”

-“তুই বুঝি সারাজীবন আইবুড়ো থাকবি? আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, আমি তোকে চিরদিনের জন্য বাড়িতেই রেখে দিতাম! এই ঘর-সংসার এক নায়ক তন্ত্রের হাতে চলে গেছে! তার ইচ্ছেতেই সব! জানি না, ছোটো ভাইয়া এই বিয়েতে সুখী হবে কিনা! তবে খুব করে চাই, ছোটো ভাইয়া সুখী হোক!”

তখনই অনিক এসে সামনে দাঁড়ালো। ত্বোয়া চমকে গিয়ে কথা মাঝখানে থামিয়ে দিল! ব্যাগটা গাড়িতে তুলে মাইসারার দিকে তাকালো সে। চোখমুখের মলিনতা টের পেয়ে বলল,

-“কী রে, মুখ ওমন শুকনো লাগছে কেন? খাওয়া-দাওয়া করিস না? নাকি বরের শো’কে কা’ত’র হয়ে দেবদাসের পারবতী সাজার পণ করেছিস?”

হাস্যরসের এমন কথা শুনে খিলখিল করে হাসলো মাইসারা! আগ বাড়িয়ে অনিকের কাঁধে চিমটি দিয়ে বসলো! ব্যথায় সামান্য আর্তনাদ করলো অনিক। বলল,

-“গায়ে তো শক্তি ঠিকই আছে। তবে মুখ এমন রসকষহীন কেন তোর? শোন, সারাক্ষণ হাসবি। যেন বাবা টের না পায় যে, তাঁর ভাতিজী কোনো না কোনোভাবে মনের ভেতর ভারি চাপ নিয়ে দিন কাটাচ্ছে! আর একটা কথা শুনে রাখ, যাই হয়ে যাক নিজের স্বপ্ন পূরণের পথ থেকে এক’পা-ও পিছাবি না। কথাটা মাথায় রেখে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর!”

মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে মাইসারাকে। আইটেম, কার্ড, টার্ম, প্রফ ( প্রফেশনাল এক্সাম)। আইটেম হলো ক্লাস টেস্ট টাইপের পরীক্ষা। মূলত মৌখিক পরীক্ষা। আইটেম পাশ করার কতগুলো আইটেমের পড়া নিয়ে কার্ড হয়। কার্ড এ উত্তীর্ণ হওয়ার পর টার্ম, যেখানে রিটেন, ভাইভা, প্র‍্যাক্টিক্যাল সবই ছিল। সব গুলো টার্ম উত্তীর্ণ হওয়ার পর আসলো পেশাগত বা প্রফেশনাল পরীক্ষা। পেশাগত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে একজন মেডিকেল স্টুডেন্টের জন্য পরের ইয়ারে উত্তীর্ণ হওয়া সহজ। এমবিবিএস এর এই পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করে এখন ইন্টার্নিশিপ কোর্স করছে সে। এই কোর্সটাতে পুরোপুরিভাবে উত্তীর্ণ হতে পারলে অধরা স্বপ্ন দু’হাতের মুঠোয় চলে আসবে তার। এতটা পথ এগিয়ে আসার পিছনে একমাত্র ভরসা ছিল অনিক। প্রতি পদে পদে অনিকের সহযোগিতাই তাকে এই অবধি নিয়ে এসেছে। তবে এখানে তার মেধাও ছিল প্রখর। যার জন্য শত আ’ঘা’তেও দমে যায়নি মাইসারা।

পুরো বাড়িতে সবার থেকে এই মানুষটাই তাকে সব বিষয়ে সাপোর্ট করে! এমন দায়িত্বশীল পুরুষ আজকাল চোখে দেখা যায় না। কতদিকে নজর তার! বিয়ে করে যখন বউয়ের আঁচল খুঁজে পাবে তখন কি সে একইভাবে মাইসারা’র খেয়াল রাখবে? নাকি পর করে দিবে চিরদিনের জন্য? উত্তর জানা নেই তার, শুধু জানে স্বপ্ন পূরণের পথে এই মানুষটার মতো ভরসা আর সহানুভূতি দেখানোর কেউ নেই! তবে কি তার স্বপ্নগুলো অধরাই দেখে যাবে? পূর্ণতা পাবে না? বিয়ে করলে যে সব পুরুষ পর হয়ে যায়! যেমনটা পর হয়েছে আলিফ, তেমনটা যদি অনিকের বেলায়ও হয়! তবে? অন্তহীন এই ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল মাইসারা! সম্বিত ফিরে পেল অনিকের ডাকে।

-“কী রে, ওঠ গাড়িতে। বাবা অপেক্ষা করছে তোর জন্য!”

-“আসছি!”

এইটুকু বলে চোখের কোণে আসা পানিটা যত্ন করে মুছে নিল মাইসারা! পিছনে বসে ত্বোয়ার সাথে গল্প জমানোর চেষ্টা করলো! অযাচিত যত চিন্তাভাবনা আসছে মনের গোপন কুঠরিতে, সবকিছুকে দুরেই ঠে’লে দিল। মনে মনে বিড়বিড় করলো,

-“আমার জন্য আর কোনো চা’প নিতে হবে না কাউকে! এবার থেকে নিজের জন্য নাহয় নিজেই ভাববো!”

যাকে তার বাবা-মা একাকী ফেলে চলে গেছে, তাকে আগলে নিয়ে কত চা’পের মুখের পড়েছে অনিক সেটা মাইসার’র অজানা নয়! তবুও ভয় হয়, জীবনে একাকী বাঁচা, একাকী স্বপ্ন পূরণের পথে এগোনো অনেক কঠিন! সে এখনি টের পাচ্ছে, অধরা স্বপ্ন দূর থেকেই তাকে ডাকছে। কাছে ভিড়ছে না। হয়তো ভিড়বেও না। সবার সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। কিছু স্বপ্ন অজীবন অপূর্ণ থেকে যায়। হয়তো তার বেলায়ও এমনটাই ঘটবে। স্বপ্নগুলো অপূর্ণই থাকবে। তবুও সে চেষ্টা করবে। আত্মসম্মান নিয়ে নিজেকে গড়ে তোলার কঠিন পথে একাকী নামবে! ডাক্তার যে তাকে হতেই হবে!

*****

-“কেমন আছো ভাবী?”

হাসিমাখা মুখে প্রশ্ন করলো মাইসারা। বাড়িতে পা রাখতেই ফারজানা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো তার দিকে। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে, চুলে খোঁপা বেঁধে পুরো ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলো সে। অনিক তখনো পা রাখেনি সেখানে। ভাড়া মেটাতেই পিছনে পড়ে গেছে বেচারা। ত্বোয়া যখন মাইসারাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো তখনই হাতের কাজ থামিয়ে দিল সে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালোমতো দেখে বলল,

-“দিন দিন তুই খুব মুটিয়ে যাচ্ছিসরে! কম করে খেতে পারিস না? যা ফ্রেশ হো জলদি। বাড়িতে কত কাজ জমেছে জানিস? ভালোই হয়েছে তুই এসেছিস, বিয়েসাদীর ঝা’মে’লা ওসব আমি একা সামলাতে হিমশিম খেতাম খুব। ওমা, হা করে দেখছিস কী! যা…! কানে কি তালা দিয়েছিস?”

নীরবে তাকিয়ে রইলো মাইসারা। কোনো জবাব দিল না। ত্বোয়া আলতো করে তার হাতে চাপ দিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়লো। মাইসারা চুপ থাকতে না পেরে ফের হেসে বলল,

-“তোমার কাজের চাপ কমানোর জন্য দ্বিতীয়জন তো আসছেই ভাবী! দুই জা মিলে সবকিছু সামলে রাখবে! এমনিতেও আমি এ ঘরের বাড়তি লোক! মাস ছ’য়েক পরে আসি, ক’টা নিন্দেমন্দ হ’জ’ম করে দু’চার দিন অতিবাহিত করি! এরপর আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাই। কী করবো বলো, যাওয়ার তো জায়গা নেই। অপমান করো, লা’তি মা’রো, ঘুরেফিরে আমাকে তো সেই এখানেই আসতে হবে। নয়তো চাচ্চু কেঁদে বুক ভাসাবে। নেহাৎ মুরব্বি মানুষটার মুখের উপর না বলতে পারি না…!”

এইটুকু বলেই থেমে গেল মাইসারা। ত্বোয়া মুখ টিপে হাসলো। দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে অনিকের কাছ থেকে নিজের ব্যাগটা এনে রুমের দিকে এগোলো। তখন পিছন থেকে ফারজানা আবারও বলল,

-“ভালোই কথা শিখেছিস দেখছি! মুখে মুখে ত’র্ক করিস! আলিফ যদি এসব বেয়া’দবি শুনে..!”

-“আমিও বলবো, রাতবিরেতে তুমি কী করো!”

পালটা হেসে জবাব দিল মাইসারা। ফারজানা ঢুক গিলে ভীতিগ্রস্ত চোখে তাকালো। তবুও নিজের দুর্বলতাকে প্রকাশ পেতে দিল না। উলটে মেজাজ ধরে রেখে বলল,

-“ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

-“কেন? আমার ঘরে!”

-“ওখানে আমার ভাই থাকবে। আমি ওর জন্যই রুমটা গুছিয়েছি! তুই বরং ত্বোয়ার রুমটা শেয়ার করেনে। আছিস তো মাত্র এক সপ্তাহ। মানাতে খুব একটা অসুবিধা হবে না!”

অনিক ততক্ষণে নিজের রুমে চলে গেছে তাই এই দু’জনের কথা কা’টা’কা’টির দৃশ্যটা তার চোখ এড়িয়ে গেছে। দরজার সামনে থেকে ফিরে আসলো মাইসারা! বলল,

-“আমার অনুমতি না নিয়ে, তুমি কীভাবে আমার রুমে অন্য কাউকে জায়গা দেয়ার কথা ভাবতে পারো? আগামী এক সপ্তাহ আমি ওই রুমেই থাকবো। তুমি তোমার ভাইকে কোলে নিয়ে বসে থাকো, নয়তো যা খুশি তাই করো, আমার তাতে কী!”

দায়সারাভাবে জবাব দিল মাইসারা। ব্যাগ হাতে নিয়ে ঝটপট নিজের রুমে ঢুকলো। পিছন থেকে ফারজানা রীতিমতো গ’র্জে উঠলো। বলল,

-“অতি বার বেরো না, ঝড়ে পড়ে যাবে। তোর অবস্থাও তেমন হয়েছে। আসুক আজ তোর ভাই, আমিও দেখে ছাড়বো তুই কীভাবে ওই রুমে থাকিস!”

অনেকদিন পর নিজের রুমে ঢুকে প্রশান্তি অনুভব করলো মাইসারা। চারপাশে হেঁটে হেঁটে রুমের ভেতরটা ভালো মতো দেখলো। ত্বোয়া পাশে থেকে বলল,

-“তুই একটু বিশ্রাম নে। আমি দেখি, দুপুরের খাবার হলো কী না!”

-“তুই কী করে হ’জ’ম করিস এসব? আমার তো ইচ্ছে করছে এক্ষুণি ওই দু’মুখো সা’পে’র মাথাটা অ’র্ধেক করে ফেলি! শুধু চাচ্চুর জন্য…!”

ত্বোয়া মৃদু হাসলো। বলল,

-“কিছুক্ষণ পেরোক, বুঝবি। কেন আমি হ’জ’ম করে পড়ে আছি! নিজের যদি সামর্থ্য থাকতো, এই বাসস্থান কবেই ত্যাগ করতাম।”

বলতে বলতে চোখের পানি মুছলো ত্বোয়া। শান্তস্বরে বলল,

-“তুই বেঁচে গেছিস হোস্টেলে থেকে। নয়তো প্রতিনিয়ত মেয়ে হওয়ার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে হতো! নিজের ঘরেই আমরা স্বাধীনতা পাচ্ছি না, পরের ঘরে গেলে কী হবে সেটা ভেবেই দমব’ন্ধ লাগে সারা! বিশ্বাস কর, এই জীবনের যে এত যন্ত্র’ণা আগে জানলে মায়ের সাথে আমিও দুনিয়া ত্যাগ করতাম।”

রুম ছেড়ে বাইরে বের হয়ে গেল ত্বোয়া। মাইসারা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাপড়চোপড় গুছানো শুরু করলো। তখনই বাহির ছেড়ে হাঁক ছেড়ে আদরমাখা একটা ডাক ভেসে এলো! সেই ডাকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল সে। ডাকটা একাধারে ভেসে আসছিল, যা তাকে রীতিমতো দিশেহারা করে ফেলেছে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে। আরমান সাহেব আহ্লাদী কণ্ঠে আবারও ডাকলেন,

-“কই? আমার মা কোথায় গেল? বাড়ি এসে বুঝি মা তার সন্তান ভুলে যায়! সারা, ও মা কই গেলি! আয় দেখি একবার!”

ছোটো বাচ্চাদের মতো আদরের লোভে দ্রুত আরমান সাহেবের সামনে উপস্থিত হলো মাইসারা। দৌড়, আর খুশির আতিশয্যে এখনো তার হাত-পা মৃদু কাঁপছে! একছুটে ভরসার জায়গাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো সে। বুকের সাথে লেপটে থেকে বলল,

-“এইতো চাচ্চু আমি! তোমার কাছেই আছি।”

আরমান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন তিনি। কতদিন পর মেয়েটাকে চোখের সামনে দেখলেন। কিছুক্ষণ পর চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হলেন তিনি। বললেন,

-“কতদিন একসাথে খাওয়া না রে মা। আজ আমি তোকে নিজ হাতে খাইয়ে দিব! ওখানে খেতে খুব অসুবিধা হয় না? অনিকটা যে কী! কত করে বলি, তোর একটু খেয়াল রাখার জন্য! তাও কেমন গা’ছাড়া ভাব দেখিয়ে চলে!”

আরমান সাহেবের ভালোবাসার প্রখরতা টের পেয়ে প্রাপ্তির হাসি ফুটালো মাইসারা। বলল,

-“তুমি শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করো আমার জন্য। এত ভেবো না। জীবনে শ্রেষ্ঠ স্থানে আরোহন করতে হলে একটু স্ট্রাগল করতেই হবে! সব যদি হাত পাতলেই পেয়ে যাই, তবে যে দামী সম্পদটাও ফেলনা মনে হবে। সং’গ্রাম করে যদি অল্প হলেও প্রাপ্তি জুটে, তবে তাতেও সুখ আছে চাচ্চু!”

আরমান সাহেব হাসলেন। সময়ের স্রোতে কতগুলো বছর জীবন থেকে পেরিয়ে গেছে! সেই ছোট্ট মেয়েটা বুঝতে শিখেছে! জীবনের কঠিন মুহূর্তকে উপলব্ধি করতে শিখেছে! হয়তো এভাবেই একদিন স্বপ্ন পূরণের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাবে সে। পেয়ে যাবে তার আসল ঠিকানা! যেখানে শুধু তারই আধিপত্য বিস্তার হবে সর্বদা। যেখানে কেউ তাকে নিয়মের ক’ড়া শা’স’নে আটকে রেখে সীমা পরিসীমার ব্যাখ্যা বুঝাবে না। যেখানে সে পুরোটাই হবে স্বাধীন! মুক্ত! ঠিক ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা পাখির ন্যায়!

*****

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (২)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

ছাদের একপাশে থাকা রঙবেরঙের ফুল গাছের পাশেই আচারের বৈয়ামগুলো রেখেছিল ত্বোয়া! যেকোনো ফলের সিজন আসলে নিত্য নতুন মশলা মিশিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের বিভিন্ন ফলের আচার তৈরী করে সে। একপাশের বৈয়ামে ছিল সাতকরা, আম এবং অড়বড়ইয়ের আচার। অন্যপাশে ছিল, বড়োই, জলপাই, লেবু ছাড়াও আরও অন্যান্য ফলের আচার। সাতকরার আচারটা মাইসারার ভীষণ রকমের পছন্দের। প্রতিবার এখানে আসলে ত্বোয়া দুটো করে বৈয়াম ধরিয়ে দেয় হাতে। হোস্টেলে বসে পড়ালেখার ফাঁকে বোনের এই জাদুর হাতে ছোঁয়া টক, ঝাল, মিষ্টি আচারের সাথে দারুণ সময় উপভোগ করে সে। এখনো সেটাই করছে। একটা বৈয়াম খুলে চামচ দিয়ে এক পিস বাহিরে টেনে এনে সেটা মুখের ভেতর নিয়ে উহুম শব্দ উচ্চারণে আচারের স্বাদটা প্রকাশ করছে। তখন ছাদের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে হবু বউ নামিরার সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল অনিক!

বিয়েটা পারিবারিকভাবে ঠিকঠাক হলেও দু’জনে পূর্ব পরিচিত ছিল। তাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা না জন্মালেও বন্ধুত্বের একটা সুক্ষ্ম টান বিদ্যমান। যা একে-অন্যকে বুঝার পাশাপাশি দায়িত্ব, কর্তব্য পালনেও দক্ষতা বজায় রেখেছে। তাদের দু’জনার এক মিনিট কথা হলে দুই মিনিট ঝগড়া হয়! একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করার পাশাপাশি ভাগ্যক্রমে একই ব্যাংকেই জব হয়ে যায় দু’জনার। সেই থেকে এদের বন্ডিংটা ভীষণরকম মজবুত। বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে দু’জনে তুই বোধক সম্বোধনে অভ্যস্ত ছিল! এই ক’দিন ধরেই তুমিতে নেমে এসেছে তারা। বিয়ে বন্ধনটা যেমন সম্মানের সেখানে সম্বোধনটাও তেমনি হোক! দু’জন দু’জনকে তুইতোকারি করবে এটা ঠিক মানতে পারে না নামিরা। এজন্যই তাদের তুমিতে নেমে আসা! মাইসারার আচার খাওয়ার ভাবভঙ্গি দেখে সেদিকে দৃষ্টি ফেরালো অনিক। দূর থেকে তাকিয়ে মেয়েটার পা’গ’লা’মি দেখে মুচকি হাসলো। এখনও বাচ্চাই আছে। বড়ো হয়নি! ফোনে নামিরা কিছু বলছে, যা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে সে, কিন্তু দৃষ্টি তার অন্য এক জায়গায় থমকে গেছে!

তখন গোধূলির আকাশে সূর্যাস্তের শেষ সময়টা এসে উপস্থিত হয়েছে। ত্বোয়া বৈয়ামগুলো হাতে নিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছে অথচ মাইসারা ব্যস্ত আচার খাওয়াতে! পিছন দিকে আকাশের কিনারে ডুবে যাওয়া এক টুকরো সূর্যের অলোকছটা এসে হাসিমাখা মুখে উপস্থিত হলো। সেই আলোটা চোখে-মুখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্নিগ্ধ অথচ চঞ্চল এক হরিণীকে চোখের সামনে আবিষ্কার করলো অনিক! ফোন কানে রেখে বিড়বিড় করলো,

-“সর্বনাশ! এটা কী হলো!”

ওপাশে নামিরার গলার আওয়াজ থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর একরোখা কণ্ঠে বলল,

-“অনিক, তুমি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা!”

কিছুটা গম্ভীর অথচ তীক্ষ্ণ আওয়াজটা কানে আসতেই চোখের পলক ফেলে গভীর করে শ্বাস টানলো অনিক। বলল,

-“হ্যাঁ! বলো।”

-“কাল দেখা করবো তো আমরা? আসবে কিনা সেটা তো বললে না!”

-“আসবো। কখন আসতে হবে?”

-“বিকেলে! আমরা কিছু কেনাকাটা করবো আর জরুরী আলাপটাও সারবো।”

-“আচ্ছা!”

-“ত্বোয়া আর সারাকেও নিয়ে এসো।”

-“ওদেরকে আবার টে’নে নিব কেন? কাবাবের হা’ড্ডি একেকটা!”

খিলখিল করে হাসলো নামিরা! সদ্য প্রেমে পড়া তরুণ যেভাবে হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে প্রেমিকার সাথে ডেটিংয়ে যাওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আটকাতে রগরগে মেজাজ ধরে রেখে কথা বলে, অনিকের কথাও অনেকটা সেরকমই শুনালো। মেয়েটার হাসি কানে আসাতেই নিজের অসহায় অবস্থা টের পেল অনিক! চোখমুখ কুঁচকে বলল,

-“রাখো তো ফোন! মেজাজটাই নষ্ট করে দিয়েছো!”

-“অনিইইইইক!”

আদুরে আওয়াজে হার্টবিট থামার জোগাড় হলো অনিকের। কণ্ঠ নামিয়ে বলল,

-“শুনছি তো বাবা!”

-“আসবে তো ওদের নিয়ে? প্লিজজজ…!”

-“আচ্ছা!”

-“থ্যাংক য়্যু সো মাচ্! লাভ য়্যু! টা টা।”

দিনে অসংখ্যবার এই মেয়ে লাভ য়্যু শব্দটা উচ্চারণ করে। আগেও এমন করতো। এখনও করে। আগামীতেও করবে এই বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই তার। নামিরা ফোন কেটে দিলেও অনিকের চেহারার যে আশ্চর্যের রেখা ফুটে উঠেছিল সেটা তখনো তার চোখেমুখে বিদ্যমান! দৃষ্টি স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ সে। মনের কোথাও গোপন ব্যথার হাজারও সুর এসে উপস্থিত হয়েছে। বিরহ, বেদনা ভর করেছে চারিপাশে। কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে তার সবকিছু! দুঃশ্চিন্তায় ভরা মাথা নিয়ে মাইসারার দিকে এগোলো সে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হাতের চামচটা কে’ড়ে নিয়ে বৈয়াম থেকে সাতকরার একটা পিস বের করে মুখে দিয়েই মুখটা হা হয়ে গেল তার। তড়িঘড়ি করে সেটা মুখ থেকে ফেলে চামচটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-“এই তেতো আচার খাচ্ছিস কী করে! মুখের ভাবভঙ্গি এমন যে, বহু সাধনার জিনিস পেটে ঢুকাচ্ছিস! অসুস্থ হয়ে পড়বি তো! রেখে দে আর খেতে হবে না!”

হাতের টানে বৈয়ামটা ত্বোয়ার হাতে ধরিয়ে দিল সে। মাইসারা পেট ফা’টা হাসি হাসতে গিয়েও থেমে গেল। অনিকের চিন্তিত চেহারা দেখে বলল,

-“ভাবী কী বললো?”

-“তোর সাথে দেখা করতে চায়!”

-“সত্যিই?”

-“হ্যাঁ! যাবি আগামীকাল বিকেলে?”

-“অবশ্যই! ত্বোয়াকে নিব?”

-“তোদের দু’জনকেই যেতে বলেছে!”

চিন্তিত চেহারায়ই জবাব দিল অনিক! মাইসারা খুশিতে হাস্যজ্বল কিশোরীর মতো দুরন্ত হয়ে গেল! ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার দিয়ে পুরো ছাদে দৌড়াতে শুরু করলো! ত্বোয়া হাসতে হাসতে নিচে নামলো। পিছনে অনিকও আসলো। ফেরার আগে পিছু ঘুরে মাইসারাকে বলল,

-“সন্ধ্যে হচ্ছে, ঘরে আয়। নয়তো ভূ’ত, প্রে’তের নজর লাগবে!”

খুব স্বাভাবিক কথা! অথচ কেমন আদেশ, অনুরোধ মিশেছিল কণ্ঠস্বরে! ত্বোয়া ফের হাসলো। মাইসারার তখন দু’ঠোঁটের ফাঁকে আঙুল খাড়া করে রাখা। গভীর ধ্যানে অনিকের কথাকে রিপিট করছে সে। ‘ভূ’ত, প্রে’তের নজর লাগবে!’ সত্যিই লাগবে? লাগতেও পারে! একটা সময় ঠোঁট উলটে ‘দুচ্ছাই’ বলে দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে এলো! যেন এই কথার ব্যাখ্যা তার কাছে অস্পষ্ট!

*****

রাতে খাবারের আয়োজনের আগ মুহূর্তে ব্যাগপত্র ছাড়া খালি হাতেই বোনের বাড়িতে হাজির হলো ফারহান। বিয়ের দাওয়াত পেলেও বেশ জানে সকালেই চলে যেতে হবে। বোন তো জানে না, তার ভাই তার থেকেও বড়ো সেয়ানা। শুধু আলিফের কথা রাখতেই আসা। নয়তো এখানে পা-ও ফেলতো না সে। অসময়ে মেহমানকে দেখে কেউ বিরক্ত না হলেও ত্বোয়াকে খানিকটা বিপর্যস্ত দেখালো! চোখমুখ কুঁচকে খাবারের প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বলল,

-“আমি রুমেই খেয়ে নিব!”

মাইসারা সন্দিহান চোখে তাকালো। ত্বোয়া এক ছুটে নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে দিল! বুকের ভেতর এখনো ধড়ফড় করছে তার। নিজেও জানে না, কেন! ফারহানকে দেখলেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় এসে জড়ো হয় চোখমুখে! হয়তো সেটা তার চোখের ভাবভঙ্গির জন্যই! কেমন যেন চেহারা! অদ্ভুত, আকর্ষণীয়! তাকালেই ভয় পায় সে। কারণে, অকারণেই ভয় এসে জমা হয় ভেতরে। তখন দূরে সরে যাওয়াতেই মুক্তি খুঁজে নেয় দ্রুত!

খাওয়া-দাওয়া শেষে ভাইয়ের জন্য মেহমানদের জন্য থাকা বাড়তি রুমটাই গুছিয়ে দিল ফারজানা। মাইসারা মুচকি হেসে বলল,

-“নালিশ দিলে না যে! এত ভদ্রতা তোমাকে দিয়ে মানায় না ভাবী!”

তখন খাবার টেবিলের কাছে বাকিরা কেউ ছিল না! ফারজানার ছোট্ট বাচ্চা নাহিয়ানকে কোলে তুলে ভাত খাওয়াচ্ছিলো মাইসারা। সবার খাওয়া শেষ হলেও তার খেতে খানিকটা সময়ই লাগছে। ছোটো বাচ্চা দ্রুত গিলতেও পারে না, চিবোতেও পারে না। এজন্য ধীরে ধীরে সময় নিয়েই তাকে মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে সে। আলিফের সামনে ফারজানার এমন শান্তশিষ্ট চেহারা দেখে বড্ড মজা নিচ্ছে মাইসারা। তার এমন হাসি দেখে বলল,

-“ফড়ফড় করে যেমন উড়ছিস, ডানা ভা’ঙা’র সাথে সাথে ফট করে নিচে পড়ে যাবি! নিজেকে এত সুখী ভাবিস না! পরের অন্ন ধ্বংস করছিস তো, টের পাচ্ছিস না। সামান্য ক’টা টাকা উপার্জন করতে মাথার ঘা’ম পায়ে ফেলে তোর ভাই! অনিকও সুবিধাবা’দী! নবাবজা’দা বিয়ে করবে ঠিকই কিন্তু সংসারে খরচ করবে না!”

-“কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো! তোমার আমার উপর রাগ থাকতে পারে। আমাকে ঘৃ’ণা করো, বা’জে বকো অসুবিধা নেই। খামাকা ছোটো ভাইয়াকে এখানে টানছো কেন!”

-“গায়ে লাগে খুব? তোর ভাই যে শুধু নিজের স্বার্থ দেখে চলে সেদিকে নজর যাচ্ছে তোর? এই সংসারের পিছনে আমি একাই শ্রম দিচ্ছি! ঘর-সংসারের সব কাজ আমাকে সামলাতে হয়! মাস শেষ হলে আলিফ পকেট ফাঁকা করে টাকা দেয়! যাবতীয় খরচ সে চালায়…! আর তোরা পায়ের উপর পা তুলে আরামসে সেই খাবার গিলিস! গলায় আটকায় না তোদের?”

মাইসারা শান্ত চোখে তাকালো। এর কোনো জবাব নেই তার কাছে। এজন্যই ত্বোয়া দিনের বেলা বলেছিল, কিছুক্ষণ পেরোক, বুঝবি! দিন গড়িয়ে রাত নামার সাথে সাথে যে ফারজানার বাড়তি রূপটা সামনে আসবে জানা ছিল না তার! নাহিয়ানের মুখে খাবার তুলে দিয়ে মেকি হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে বলল,

-“আমার ভুল হয়েছে ভাবী! এবারই শেষ। আর এখানে আসবো না। এই সম্পত্তিতে আমারও অধিকার আছে। ফসলি জমির ভাগও আছে। চাচ্চুকে বলবো, আমারটা আমাকে বুঝিয়ে দিতে। আমি চলে যাব। তখন আর তোমাকে এত ভাবতে হবে না। সংসারের মানুষও কমবে, চাপও কমবে!”

খাবার শেষে এঁটো থালাবাসন নিজেই ধুয়েমুছে তুলে রাখলো মাইসারা। ফারজানা ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর বাহানায় রুমে চলে গেল। রান্নাঘর থেকে বেরোতে গিয়েই অনিকের মুখোমুখি পড়লো সে। দু’জনার এমন তর্কাত’র্কির আওয়াজটা কানে আসতো না, যদি না প্রয়োজনীয় কথা বলতে বাবার রুমের দিকে এগিয়ে আসতো সে। মাইসারার মলিন চেহারা দেখে বলল,

-“সম্পত্তি আলাদা করতে চাস?”

-“এছাড়া উপায় কী!”

নির্বিকার ভঙ্গিমায় জবাব দিল মাইসারা! অনিক ম্লান হাসি ফুটিয়ে বলল,

-“চাচ্চুর করা ভুল আজ তোর জীবনটা নষ্ট করছে। আমাদের তো চলে যাবে যেকোনোভাবে! তোর কী হবে? একা বাঁচা সহজ মনে করছিস?”

-“কঠিন না তো! যার কেউ নেই সে তো একাই! আমারও কেউ নেই! থাকলে কি আর এভাবে কথা শুনতে হতো? হতো না।”

-“আন্টি ফোন করেছিলেন আর?”

-“ছ’মাস ধরে কথা হয় না! আমার ঘুম পাচ্ছে! আমি যাই।”

আর এক মিনিট এখানে থাকা মানেই পুরনো আলাপ-আলোচনার দিকে এগিয়ে যাওয়া। মাইসারা কোনোভাবেই চায় না, বাবা-মা নামক দুই ব্যক্তিকে নিয়ে তার জীবনে আর কোনো কথা আসুক! এজন্যই এড়িয়ে যাওয়া। অনিকও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কথা বাড়ালো না। শুধু শান্তস্বরে বলল,

-“ভয় পাস না সারা! এসব টুকরো টুকরো ঝা’মে’লা সব পরিবারেই হয়ে থাকে। তুই নিজেকে দুর্বল ভাববি না! সাহস রাখ! তোর আগামীর পথটা অনেক সুন্দর! যখন সেই সুন্দর পথ ধরে হেঁটে বেড়াবি, তখন দেখবি আজকের সময়ে যে বা যারা তোকে নি’ন্দে ব’কছে তারাই সেই তোকে মাথায় তুলে নাচবে! তুই দেখে নিস, সেই সুন্দর পথ আর মাত্র কয়েক’পা এগোলেই! খুব সামনে। শুধু ধৈর্যের সাথে এগোনো বাকি! এতদূর এগিয়ে মাঝপথে থেমে যাস না প্লিজ!”

অনিকের কথাটা কাজে দিল। মাইসারা নির্ভরশীল হাসি ফুটিয়ে শুভরাত্রি বলে নিজের রুমে চলে গেল! অনিক ভাবতে লাগলো, ঠিক কীভাবে পারিবারিক এই সমস্যার সমাধান করা যায়! যদিও পরিবারের পিছনে আলিফের চেয়ে অনিকের অবদানই বেশি। তবে সেটা প্রকাশ্যে নয়, অপ্রকাশ্যে! যা কেবল আরমান সাহেবই জানেন!

*****

মাইসারা সম্পত্তি আলাদা করার কথা ভাবছে, এই কথাটা মাথায় আসলেই সমস্ত চিন্তাভাবনা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে ফারজানা, তবুও দুঃশ্চিন্তার ভারে ঘুম এসে ধরা দিচ্ছে না চোখে। শান্তির ঘুমও পালিয়ে গেছে তার। সম্পত্তি ভাগ হওয়া মানে অর্ধেক মালিকানা মাইসারার হাতে চলে যাওয়া। মনে মনে অসম্ভব বলে লাফিয়ে উঠলো সে। বিছানা ছেড়ে নেমে রুমের ভেতরেই পায়চারি শুরু করলো! ভাবতে লাগলো, ঠিক কীভাবে শ’ত্রু বি’না’শ করা যায়। এমন কিছু করতে হবে, যাতে সা’পও ম’রে লা’ঠিও না ভা’ঙে। কিন্তু করবেটা কী! একমনে ভাবতে ভাবতে রুম ছেড়ে বেরোলো সে। সোজা চলে গেল ভাইয়ের কাছে। এতরাতে বোনের গলার মৃদু আওয়াজে যথেষ্ট বিরক্ত হলো ফারহান! হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে বলল,

-“এইজন্যই আসতে চাই না। শান্তির ঘুমটাও অশান্তির হয়ে যায় এখানে আসলে!”

দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা আট’কে দিল সে। বিছানায় বসে ভাইয়ের হাত টেনে ধরে তাকেও পাশে বসালো। ফারহান ঢুলুঢুলু চোখে বোনের দিকে তাকালো। বলল,

-“আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আপু, সকালে কথা বলি!”

-“দরকারি কথা ভাই! আগে শোন!”

দু’হাতে চোখ ভালোমতো কচলে নিল ফারহান। সোজা হয়ে বসে বোনের আতঙ্কিত চেহারা দেখে ঠোঁট বাঁ’কা’লো। বলল,

-“প্লিজ আপু এসব বাদ দে। শুধু শুধু পরের ক্ষ’তি করতে চাইছিস তুই! মেয়ে দুটো যথেষ্ট ভালো। তোর কপাল অনেক ভালো যে, এরকম একটা সংসার পেয়েছিস! তাও কেন অসুখী তুই?”

ফারজানা মুখ ঘুরিয়ে নিল! বলল,

-“সুখী না ছাঁই। তোকে যা বলেছিলাম, তা করেছিস? তাবি’জ কোথায়?”

-“আমি কোনো তাবি’জ নিয়ে আসিনি!”

-“মা তাবি’জ দেয়নি!”

-“দিয়েছিল! আমি সেগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছি!”

-“কী করলি হা’রা’ম’জা’দা! আমার এত চেষ্টাকে তুই জলে ফেলে দিলি! তুই কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবি। এই বাড়িতে আর আসবি না!”

হনহনিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল ফারজানা। বোনের অসহায় ফেসটা দেখে মুচকি হাসলো ফারহান! দু’জনের ক্ষ’তি করার অনেক চেষ্টাই সে করছে, কিন্তু সফল হচ্ছে না। একটার পর একটা বাঁধা তৈরী করছে ফারহান! অবশ্য এখানে তাদের মায়ের হাতটাই বেশি। একমাত্র উনিই যত বা’জে বুদ্ধি মেয়ের মাথায় দিয়ে সংসারে ভা’ঙ’ন ডেকে আনার চেষ্টা করছেন। প্রতিবার এখানে আসার বাহানা খুঁজে তার হাতে তা’বি’জ, পানি পড়া ধরিয়ে দেন তিনি। ফারহান সঙ্গে আনে ঠিকই কিন্তু মাঝরাস্তায় সেটা ফেলে দেয়! যেন বোনের হাত অবধি এসব না পৌঁছায়। এই নিয়ে তিন বার হা’র মানলো সে। তবুও ছাড় দিচ্ছে না। একটার পর একটা চেষ্টা করেই যাচ্ছে। কিন্তু তাতে লাভ কিছুই হচ্ছে না! যে তা’বি’জ গুলো ঘরে পুঁ’তে রাখার কথা, যে পানিটুকু মাইসারা আর ত্বোয়াকে খাওয়ানোর কথা, সে পানি আর তা’বি’জের বারোটা সে বাজিয়ে দেয় অতি সুক্ষ্ম বুদ্ধির জুড়ে। শেষবার এই কথাগুলো ত্বোয়ার সাথে গোপনে শেয়ার করেছে ফারহান, যার কারণে ত্বোয়া পুরোটাই তাকে ইগনোর করতে শুরু করে। আগে টুকটাক কথা বললেও এখন সেটাও বলে না। দেখলেই গা ঘিনঘি’ন একটা ভাব এসে উপস্থিত হয় তার মাঝে! অবুঝ মনের কোথাও হয়তো গেঁথে গিয়েছে, ভাই-বোন দু’জনেই তাদের ক্ষ’তি চায়!

রুমে এসে আলিফকে ধা’ক্কাতে ধা’ক্কাতে তার ঘুম ভাঙালো ফারজানা! ঘুম ঘুম চোখে বউয়ের এমন দিশেহারা মলিন চেহারা দেখে চোখমুখ কুঁচকে গেল তার। হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁলো। জ্বরহীন সুস্থ স্বাভাবিক শরীর দেখে বলল,

-“জ্বর তো নেই। এত রাতে ঘুম ভা’ঙা’লে কেন? সকালে ক্লাস আছে আমার!”

-“হ্যাঁ! এসবই করো। ওইদিকে তোমার বোন সম্পত্তি ভাগ করতে চাইছে। আমরা তাকে খাওয়ার দেই না, তাকে থাকতে দেই না! কীসের জন্য জায়গা-সম্পত্তি আলাদা করবে সে? সারাদিন শুধু দৌড়ের উপর থাকো, ঘরের কোন খোঁজটা রাখো তুমি?”

-“আশ্চর্য! মাঝরাতে এসব বলতে ঘুম ভা’ঙি’য়েছো! তুমিও না পারোও বটে! এই সংসারটা ভা’ঙা’র নয়! আর সম্পত্তি ভাগ হবে কেন? যৌথ পরিবারে ভাগ হয় নাকি? শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা! শুনো যদি ভাগ হয় কখনো তখন তোমার খাওয়াপড়া নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। তোমার জন্য আমি আছি তো নাকি! ঘুমাও তো!”

হাত ধরে টে’নে স্ত্রীকে পাশে শুয়ালো আলিফ! হাতের বেষ্টনী পেঁ’চি’য়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

-“সংসার সুখী হয় রমনীর গুণে! যদি গুণে না পারো, দো’ষে কিছু করো না। একটা সংসার ভে’ঙে গেলে তাকে গড়ে তোলা অনেক কঠিন! ভাবো তো, যদি ভা’ঙ’নটা তোমার আর আমার মাঝে আসে, তখন? সইতে পারবে তো বউ…?”

রাগে হাতের কনুই দিয়ে আলিফকে গুঁ’তো মারলো সে। বলল,

-“আমি তো গড়তেই চাই! কিন্তু সারা বলেছে বাবাকে বলবে, ওর ভাগ যেন আলাদা করে দেয়!”

আলিফ হাসলো। স্ত্রীর হিসাবটা ধরতে খুব একটা দেরী হলো না তার। তবুও শান্তস্বরে বলল,

-“করলে করুক। এই বাড়ির অর্ধেকের মালিক তো সারা! অর্ধেক আমরা দুই ভাই আর ত্বোয়ার! তার জায়গা সে চাইতেই পারে, এতে তোমার তো সমস্যা হওয়ার কথা না!”

ফারজানা দমে গেল। আর একফোঁটা বাড়তি কিছু বললেই আলিফ ধরে ফেলবে তার ভাবনার দৌড়। এভাবে সে কিছুই করবে না। আরও গভীর করে ভাবতে হবে তাকে। তার আগে মাইসারাকে চিরদিনের জন্য তা’ড়াতে হবে, এরপর সম্পত্তির ভাগ থেকে বা’তি’ল করতে হবে। তার জন্য একটু গভীর ভাবনার প্রয়োজন আছে বৈ কী! তাড়াহুড়ো করলে চলবে না, খুব গোপনে ধীরস্থিরভাবে এগোতে হবে। যেন কাক পক্ষীতেও টের না পায় তার পরবর্তী চিন্তাভাবনা!

*****

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে