মনোহারিণী পর্ব-১৭+১৮

0
803

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১৭)+(১৮)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

একটা ভে’ঙে যাওয়া পরিবার বাঁচাতে কত রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত তা সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নেই অনিকের। বয়সে ছোটো হলেও, ঘর, সংসার, পরিবারের মূল্য সে বুঝে। আর বুঝে বলেই ভা’ঙ’ন ঠেকাতে বড়ো ভাইকে নানাভাবে বুঝিয়ে চলেছে। কিছু হোক বা না হোক, প্রয়োজনে সে গা’লি শুনুক, ব’কা শুনুক তা-ও পরিবারটা আবারও আগের মতো হোক। হাসি, আনন্দে ভরে উঠুক চারপাশ। নাহিয়ানের দৌড়ঝাঁপ চলুক ঘরের এক কোণা থেকে অন্য কোণা। তবুও অবুঝ বাচ্চাটা জীবনের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি না দাঁড়াক। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে ফাঁক পেলেই অনিক তার ভাইকে যথাসাধ্য বুঝানোর চেষ্টা করে। জবাবে আলিফ কতশত অজুহাত, লজিক দাঁড় করায়, তবুও মুখ ফুটে বলে না, ফারজানাকে বাড়ি নিয়ে আসবে। এ কারণে দিনের পর দিন দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে অনিক। কে চাইবে, সুখের সংসার ভা’ঙতে? কে চাইবে অবুঝ বাচ্চার জীবনে দোটানা আনতে? কেউ চাইবে না। একটা সুন্দর হাসি, তার সুন্দর স্মৃতি অকালেই সুদূরে মিলাক, সেসব কারও কাম্য নয়। তাই প্রত্যেকের আপ্রাণ চেষ্টা সংসারটা আবারও প্রাণ ফিরে পাক।

এই মুহূর্তে আরমান সাহেবও ছেলেকে বুঝাতে কোনোপ্রকার কমতি রাখছেন না। সকলের চেষ্টা এখানেই, সংসারটা আগের মতো করা। আলিফ শুধু বাবার কথা শুনছে, কোনো জবাব দিচ্ছে না। তার মাথাটা যথেষ্ট নিচু, নিজে নিজেই হয়তো কোনোকিছুর হিসাব কষছে নয়তো প্রিয়জনের পালটে যাওয়ার হিসাবটা বুঝতে চাইছে। ছেলের এমন নীরবতা দেখে ভদ্রলোক বললেন,

-“মেয়েটা ভুল করে ফেলেছে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত বাবা। আরেকটা সুযোগ দিয়ে দেখি, হয়তো সে তার ভুল বুঝতে পারবে। বাচ্চাটার কথাও ভাবতে হবে তোকে। তুই কি চাস, সারার মতো ঠিকানাবিহীন জীবনযাপন তোর ছেলে করুক?”

প্রশ্ন তুলে চুপ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। আলিফ মাথা তুলে তাকালো। মাইসারার জীবনের প্রতিটা দিন সে দেখেছে। বাবা-মায়ের জন্য কতই না ছটফট করেছে অবুঝ বয়সে। বুঝ হওয়ার পর মানিয়ে নিয়েছে ঠিকই, তবুও বাবা-মায়ের প্রতি তার রাগ, অভিমান, অভিযোগ একটুও কমেনি। আলিফ চায় না, ভবিষ্যতে তার সন্তান তার উপর কোনো অভিযোগ রাখুক। এজন্য সে অনেক ভেবেছে। ভাবনা অনুযায়ী সিদ্ধান্তও নিয়েছে শুধু সবার মতামতের জন্যই নিজের কথাগুলো সে বলতে পারছে না। অনেকক্ষণ পর মুখ খুললো সে। বলল,

-“সন্তান দূরে থাকুক, এটা কোনো বাবা-মা চাইবে না বাবা। আমিও চাই না। তবে আমার একটা কথা, তোমার বউমা যদি আসতে চায় তাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসবো। কিন্তু ভুলের প্রায়শ্চিত্ত না করা পর্যন্ত আমি তাকে ক্ষমা করবো না। এতে যদি তোমাদের আপত্তি তাকে বলো, আমি এগোবো না।”

-“তুই কি তাকে আরও শা’স্তি দেয়ার কথা ভাবছিস?”

আরমান সাহেব যে ছেলের ভেতরের ভাবনা ধরে ফেলবেন সেটা বুঝলাম পারেনি আলিফ। আবারও নীরব হয়ে গেল সে। শুধু মাথা নেড়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানালো। আরমান সাহেব আবারও বললেন,

-“কী শা’স্তি?”

-“সেটা আমাদের দু’জনার ব্যাপার বাবা!”

ভদ্রলোক কথা বাড়ালেন না আর। মান-অভিমান তাদের দু’জনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেখানে তিনি বাবা হয়ে নাক গলাতে পারেন না। তবে শা’স্তিটা কতটা কঠিন আর হজম যোগ্য সেটাই ভাবাচ্ছে তাঁকে। তবুও ছেলের সিদ্ধান্তকে সহমত পোষণ করে বললেন,

-“যা শা’স্তি দিবে দিও, কিন্তু মনে রেখো, সেই শা’স্তিটা যেন নাহিয়ানের চোখের আড়ালে হয়! আমি চাই না, তোমাদের মধ্যে মনমালিন্য আমার নাতির উপর কোনো প্রভাব ফেলুক। তার মনে ভয় সঞ্চার হোক, এমন কোনো কাজ তুমি করবে না।”

আলিফ জবাবে মাথা নাড়লো। শা’স্তিটা কীভাবে দিবে সেটা শুধু সেই জানবে। বাকিরা কেউ টেরও পাবে না। আপাতত মুরব্বি মানুষের কথা শুনে, অবুঝ বাচ্চাটার কথা ভেবে ঘরের বউকে ঘরে ফিরিয়ে আনা যাক। বাকি কাজ তার একার। সেটা সে একাই করবে। ঘরের কোনো মানুষ জানা তো দূর, কাকপক্ষীও টের পাবে না তাদের নীরব রে’ষারে’ষি!

*****

ঘটা করে এক বিকেলে ত্বোয়াকে বাড়িতে রেখে সব পুরুষরাই ফারজানাদের বাড়িতে উপস্থিত হোন। তাদের হঠাৎ আগমনে ফারজানার মা বিচলিত হলেও খুশি ছিল ফারহান। সে বুঝতে পারছিল, সমস্যাটা এবার সমাধানের দিকে এগোবে। তাই সাদরে তাদেরকে গ্রহণ করেছে ঘরে। আপ্যায়নের ত্রুটি রাখছে না। একসঙ্গে বাড়ির এতজনকে দেখে নাহিয়ানের খুশিটা আর দেখে কে! সে এক দৌড়ে আলিফের দু’পায়ের ফাঁকে ঢুকে কোলে বসে পড়েছে। লতানো হাত দু’খানা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরেছে। আহ্লাদী কণ্ঠে, অভিমানী চেহারা বানিয়ে আলিফকে শা’সিয়ে বলল,

-“তুমি খুব পঁচা! এতদিন আসোনি কেন? জানো, এখানে নানু মা’কে কত বকে! দিনরাত বকে! মা’রেও। নিয়ে যাও তোমার কাছে। তাহলে আর বকবে না।”

বাচ্চাদের সামনে বড়োরা যাই করবে, সেটাই তারা মুখস্থ করে বসে থাকবে। ভালো হোক মন্দ এর তফাৎ তারা বুঝতে পারে না দেখেই সবকথা সবাইকে বলে বেড়ায়। অনেক সময় তাদের এই কথাবার্তা সংসারে ঝামেলা টেনে আনে আবার অনেক সময় কঠিন সমস্যার সমাধানে পৌঁছায়। নাহিয়ানের এখনকার কথাও ঠিক সেরকমই প্রভাব ফেললো। আলিফ আড়চোখে ফারহানের দিকে দৃষ্টি দিল। জবাবে সে শুধু মাথা নাড়লো। বুঝালো, নাহিয়ানের কথাই সত্যি!

তখনও ফারজানা সেখানে এসে উপস্থিত হয়নি। তাই তাদের কথাবার্তা সে কিছুই শুনছে না। আরমান সাহেব হাত বাড়িয়ে নাতিকে নিজের কোলে নিয়ে আসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে গালে চুমু খেয়ে বললেন,

-“সব কথা সবাইকে শোনাতে হয় না দাদাভাই। এখন তো তুমি অবুঝ তাই হয়তো বুঝতে পারছো না। যখন বুঝবে, উপলব্ধি করবে, তখন এটাও মাথায় আসবে কখন কোন কথাটা কোথায় বলতে হয়! যাও, মায়ের কাছে যাও। গিয়ে বলো, আমরা এসেছি তোমাদের নিয়ে যেতে। বাড়ি যাবে না?”

-“যাব তো। মা’কে রোজ বলি, তা-ও নিয়ে যায় না। সারাদিন শুধু চুপচাপ বসে থাকে। আমি এক্ষুণি মা’কে বলছি, আজকেই আমরা বাড়ি যাব।”

খুশির খবর মা’কে দেয়ার লো’ভে দৌড়ে পালালো নাহিয়ান। ভদ্রলোক এবার নিজের বিয়াইনের সাথে আলোচনায় নামলেন। বললেন,

-“আমার ঘরের বউ আমি ঘরে ফিরিয়ে নিতে চাই। আপনার কোনো আপত্তি আছে বেয়াইন?”

সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিলেন না তিনি। কিছু একটা ভাবনায় ব্যস্ত! মেয়েকে এখানে রেখে অযথা বোঝা তৈরী করার ইচ্ছে তার নেই। এমনিতে এই কয়েক মাসে বেশ খরচ হয়েছে। যদিও সবটা ফারহানই সামলে নিয়েছে। কখনো টাকা-পয়সার কমতি আসলেও মুখ ফুটে বলার ছেলে সে নয়। নিজের বুদ্ধি দিয়েই ঘরের যাবতীয় দিক সে সামলাচ্ছে অতি যত্নে। তবুও প্রতি মাসে বাড়তি কিছু খরচ হয়ে গেছে। হওয়ারই কথা। বিয়ে দিয়ে বিদায় করার পরেও যখন মেয়ের দায়িত্ব বাবা-মায়ের উপর এসে পড়ে তখন এটা তাদের কাছে বাড়তি খরচ হিসেবেই বিচার হয়। যদিও সব বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারগুলো এক নয়। অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে বললেন,

-“মেয়ে যেতে চাইলে আমার কোনো আপত্তি নেই বেয়াই! আপনারা বরং মেয়ের সাথে কথা বলুন!”

এ পর্যায়ে ফারহান নিজেই বোনকে ডেকে আনতে গেল। ফারজানাও ঘাড়ত্যাড়ামি করে বসলো তখন। কারও সামনে যাবে না, কোনো কথা বলবে না, এমনকি সে শ্বশুরবাড়িতে ফেরত যাবে না, একইভাবে এইসব কথা বলে ফারহানকে বিদায় করে দিল! কিছুক্ষণ পর নাহিয়ানকে পুরোটা তৈরী করে তার কাপড়চোপড় গুছিয়ে অনিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথা নিচু রেখেই বলল,

-“তোমাদের আমানত নিয়ে যাও।”

-“সেকী ভাবী! তুমি যাবে না? ঝটপট তৈরী হও প্লিজ। বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। তোমার হাতে খিচুড়ি খুব মিস করছি। আর অপেক্ষা করিও না। অনেকদিন তো হলো, এবার নিজের ঘরে চলো।”

-“না ভাই! ওই জায়গাটা আমার জন্য নয়। আমি এটাই ডিজার্ভ করি! এখানেই ভালো আছি। এভাবেই থাকবো।”

*****

অভিমান হোক কিংবা কষ্ট, ফারজানার এরূপ কথা শুনে ভীষণ চমকালেন সকলে। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন শুধু। গুটি গুটি পা ফেলে চলে আসতে চাইলো। পিছন থেকে আরমান সাহেব বললেন,

-“ওটাই তোমার বাড়ি বউমা। বিয়ের পর বাপের বাড়ির চেয়ে শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের সবচেয়ে আপন ঘর হয়! নিজের ঘর ছেড়ে কেউ পরের ঘরে বসে থাকে না। তুমি কি তোমার শাশুড়ি মা’কে দেয়া কথাও রাখবে না?”

ফারজানার পা মাঝপথে থেমে গেল। দু’চোখ বন্ধ করে মনে করলো, শাশুড়ি মায়ের বলে যাওয়া কথাগুলো। অসুস্থ শরীর নিয়ে কত কাকুতিমিনতি করেছিলেন তিনি! বলেছিলেন, নিজের সবটা দিয়ে হলেও যেন ওই সংসার সে আগলে রাখেও। কথা দিয়েছিল ফারজানা। চেষ্টাও করেছিল। আগলে নিয়েছিল সবাইকে। কিন্তু হুট করে মায়ের কু’বুদ্ধি তার সোনার সংসারে আগু’ন জ্বালিয়ে দিল। সবকিছু হারিয়ে আজ সে নিঃস্ব! চোখ ফে’টে কান্না আসছে তার। এই পরিবারের লোকজন এতটাই ভালো যে, তার এত বড়ো অপরাধ জানা সত্ত্বেও খুব কম শা’স্তি দিয়েছে। অথচ সে এরচেয়েও কঠিন শা’স্তি ডিজার্ভ করে। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই জবাব দিল,

-“বাবা আমি আমার দায়িত্ব, কর্তব্য পালনে ব্যর্থ! আমাকে মাফ করে দিবেন। আমি আর ফিরে যেতে চাইছি না।”

আর কোনো কথা না শুনেই ঝটপট নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল ফারজানা। সবার বিস্মিত চেহারাকে অপেক্ষায় ফেলে সেই যে ভেতরে ঢুকলো আর বাইরে এলো না। অনেকক্ষণ পর ধড়াম করে একটা শব্দ হলো। সেই শব্দ শুনে দৌড়ের উপর বোনের রুমের কাছাকাছি আসলো ফারহান। দরজায় ধা’ক্কাতে ধা’ক্কাতে বলল,

-“আপু দরজা খোল! উল্টাপাল্টা কিছু করিস না। আমার কথা শোন। তোকে কোথাও যেতে হবে না। তুই আমার কাছে থাকবি। তা-ও নিজের ক্ষতি করিস না প্লিজ!”

ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। শুধু গো’ঙা’নির আওয়াজ বেরিয়ে আসলো। ফারহানের গলার পানি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। চিৎকার করে ডাকলো আলিফকে। দু’জনে মিলে প্রায় অবিরত ধা’ক্কা দিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলতে পারলো। ভেতরে ঢুকে যা দেখলো, তা দেখবার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না কেউ! তখনও ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে ফারজানা। বাঁচার কোনো ইচ্ছাই নেই তার মধ্যে, সেটা তার নীরব বিস’র্জন দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ফ্লোরে পড়ে রয়েছে ছোট্ট টোল। যার সাহায্যে লম্বা কাপড় সে ফ্যানের সাথে পেঁ’চিয়ে মাথাটা তার মধ্যে ঢু’কিয়ে নিয়েছে। তড়িঘড়ি করে বিছানায় উঠলো আলিফ। দ্রুত গলা থেকে লম্বা কাপড়টা খুলে ফেললো! তখনো তার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়নি। গ্লাস থেকে পানি বাড়িয়ে দিল ফারহান। প্রথমে অর্ধাঙ্গিনীর চোখে-মুখে পানি ঝাপটা দিল সে। এরপর অল্প পানি খাইয়ে দু’হাতের মাঝখানে আগলে নিল। অনিক এমন দৃশ্য দেখে ঝটপট নাহিয়ানকে নিয়ে সরে পড়লো। ফারজানার মা দ্রুত ভেতরে ঢুকলেন। মেয়ের চুলের মুঠি টেনে ধরে আলিফের সামনেই দু’গালে পর পর দুটো চ’ড় মে’রে বললেন,

-“আমাকে ফাঁ’সা’তে চাস তুই? ম’র’বি তো ওই বাড়ি গিয়ে ম’র! আমার বাড়িতে তোর কোনো জায়গা নেই।”

আবারও আঘা’ত দেয়ার চেষ্টা করলে আলিফ আগলে নিল তাকে। রাগী চোখে শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল,

-“ও আমার স্ত্রী! যতক্ষণ আপনার মেয়ে আমার দায়িত্বে আছে ততক্ষণ তার উপর হাত তোলার অধিকার আপনার নেই! ফারহান, তোমার মা’কে এখান থেকে নিয়ে যাও। এই মহিলার মাথায় সমস্যা আছে। তাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে বলো, নয়তো আমি বাধ্য হবো পুলিশ আনতে।”

ততক্ষণে ফারহানও যথেষ্ট রেগে গেছে মায়ের এমন আচরণে। দু’হাতে টেনে ভদ্রমহিলাকে কোনোরকমে ঘরের বাইরে বের করে দরজা আটকে দিল।

*****

দু’পায়ের মাঝখানে মাথা রেখে অবিরাম চোখের পানি ফেলছে ফারজানা। চোখ তুলে সামনে তাকাচ্ছেও না। আলিফ নিজেই তাকে হাতের ভরে সোজা করলো। নরম কণ্ঠে বলল,

-“বাড়ি চলো!”

-“আমি কোথাও যাব না।”

অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিল ফারজানা। খানিকক্ষণ চোখের পানি মুছে, আবারও ফুঁপিয়ে কাঁদে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও ফারজানার কোনো নড়চড় পেল না। সে ওভাবে কাঁদছেই। দেরী না করে দু’হাতের শূন্যে তুলে নিল তাকে। বলল,

-“তুমি নিজেই নিজেকে কোনো শা’স্তি দিবে না। অন্যায় তুমি আমাদের সাথে করেছো, শা’স্তিটা আমরাই দিব। সবসময় শুধু নিজের জন্যই ভেবেছো। এবার অন্তত বাচ্চাটার কথা ভাবো!”

-“আমায় ম’র’তে দাও প্লিজ। বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”

-“এভাবে আত্মহ’ত্যা করে কেউ অপরাধ কমিয়ে নিতে পারে না। এটা জঘ’ন্য অপরাধ! উভয় জাহানকে বরবাদ করে দিচ্ছিলে তুমি! অন্যায় করলে তা ক্ষমার মাধ্যমে মুক্তিও জড়িয়ে আছে, কিন্তু আত্মহ’ত্যা করলে মুক্তি নেই পাগ’ল!”

ফারজানা আর কথা খুঁজে পেল না। ওভাবেই মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। আলিফ সোজা তাকে গাড়িতে তুললো! অনিকের কোল থেকে নাহিয়ানকে এনে মায়ের পাশে বসালো। ফারহানের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলেন সকলে।

ফারজানা এমন একটা কাণ্ড করে বসবে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কেউ। ভাবেওনি, অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে, লজ্জাকে সঙ্গী করে শ্বশুরবাড়ি সে আর ফিরতে চায়নি। তাই নিজের শা’স্তির জন্য নিজেই এই পথ বেছে নিয়েছিল। এতসব কথা যখন মাইসারা শুনলো তখন সে রীতিমতো আঁতকে উঠলো। নিজে থেকেই কথা বলতে চাইলো ফারজানার সাথে। আজ আর কোনো অভিমান, অভিযোগ কিংবা রাগ, ঘৃ’ণাকে প্রশ্রয় দিল না ফারজানা। মোবাইল হাতে নিয়ে কানে রেখে চুপ করে রইলো। ওপাশ থেকে মাইসারা বলল,

-“মানুষ এত বোকা হয়, তোমাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। তোমার ঘর, তোমার সংসার, অথচ তুমি তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো। মানছি, অন্যায় হয়ে গেছে! তাই বলে কেউ এত অভিমান পুষে রাখে? আর এমনটা করো না কখনো। তোমার আমার উপর রাগ তাই তো? আমি বাড়ি না গেলেই তো হলো। তোমার সংসারে আমি কখনো বাড়তি ঝামেলা হবো না ভাবী। তা-ও প্লিজ, নিজের কোনো ক্ষ’তি করে নাহিয়ানের জীবনটাকে অ’ভিশ’প্ত করো না। বাচ্চাটা নিতে পারবে না এত চা’প! শুনছো তো আমার কথা?”

-“তোর উপর আমার কোনো রাগ নেই সারা!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে জবাব দিল ফারজানা। মাইসারা কেবল হাসলো। সে জানে, ফারজানার রাগটা কোথায়! একদিকে হোস্টেল ছেড়ে দেয়ার সময় হয়ে এসেছে, অন্যদিকে বাড়িতে আসা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা! পরবর্তীতে এমন হবে না তার কি গ্যারান্টি? দু’দুবার তাকে মা’র’তে চেয়েছে, এই কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তবুও মানতে হচ্ছে তাকে। সত্যিই কি ফারজানা অনুতপ্ত নাকি এটা তার দ্বিতীয় কোনো নাটক! ভেতরে অকারণ এক বাড়তি চিন্তার উদয় হলো তার। যদিও সে এটা ভাবতে চায় না। বরাবরই ব্রেইন তাকে পজেটিভ সিগনাল দিচ্ছে তবুও পুরনো কথা ভেবে ভয় পাচ্ছে সে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিল মাইসারা। বলল,

-“রাগ পুষে রেখো না ভাবী! আমি কখনও তোমার কষ্টের কারণ হবো না।”

মাইসারার এমন কথায় খানিকটা চমকালো ফারজানা! মেয়েটা এমনভাবে বললো কেন সেটাই বোধগম্য হলো না। ঝটপট প্রশ্ন করলো,

-“আমি কি বলেছি তুই আমার কষ্টের কারণ?”

-“না, না! তা হবে কেন।”

-“তবে এভাবে বললি কেন?”

-“এসবের মূলে তো আমিই তাই না? বাড়তি ঝামেলা ছিলাম এতদিন, এখন হয়তো তোমার মনে হবে, আমি তোমার ঘর-সংসার কে’ড়ে নিচ্ছি। বিশ্বাস করো ভাবী, আমি কখনো এমনটা ভাবি না। আমার জন্য বাড়তি ঝামেলা যেন তৈরী না হয়, সেই ব্যবস্থাই করবো!”

-“কী বলছিস তুই এসব?”

ফারজানা বুঝেও বাড়তি প্রশ্ন করলো। মাইসারা জবাব দিল না। কথা ঘুরিয়ে বলল,

-“সাবধানে থেকো। আর নিজের যত্ন করো। কখনো এমন ভুল আর করো না। রাখছি!”

হতভম্ব হয়ে গেল ফারজানা। মাইসারা যা বলেছে তা পুরোটা বুঝতেও বেগ পেতে হচ্ছে। হ্যাঁ, একটা সময় সে তো তার ক্ষ’তি চেয়েছিল। কিন্তু এখন তো অনুতপ্ত! নিজের ভুলে নিজেকেই শা’স্তি দিতে প্রস্তুত ছিল সে। তবুও কি পা’পের বোঝা হালকা হয়নি তার? এখনো বাকি আছে আরও! কী চাইছে মাইসারা? কী করতে পারে সে? কেনই-বা এমন রহস্যময় কথা বলে দুঃশ্চিন্তা ঢুকিয়ে দিল? আদতে এর কোনো উত্তর জানা নেই ফারজানার। ফোন রেখে নীরবে মাথা ঠেকালো বালিশে। গাল বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অশ্রুটুকু মুছলো না সে, শুকনো খটখটে বালিশের তুলোতে শুকিয়ে গেল চোখের পানি। কেউ বুঝলো না, দেখলো না, আড়ালের এই অশ্রু বিসর্জ’নের দৃশ্য!

*****

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১৮)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

দিন পেরিয়ে রাত নামে, আবার রাত শেষে ভোর! সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দিন অতিবাহিত হয়, তবুও মাইসারার দুঃশ্চিন্তা কমে না। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর ইন্টার্নিশিপের সমাপ্তি। পরবর্তী অধ্যায়টা কীভাবে করবে সেটা নিয়েও যথেষ্ট চিন্তিত সে। বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েও এখন অবধি সুষ্ঠুভাবে সঠিক সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাতে পারেনি। এদিকে সময় এত দ্রুত যাচ্ছে যে, ডিউটি শেষে বাড়তি চিন্তাভাবনা করার সময় সে পাচ্ছে না। দিনের দুটো ভাগে খুব অল্প সময়ের জন্য অনিকের সাথে কথা হয়! কখনো কখনো রাত জেগে কথা বলে, নিজেদের মধ্যে থাকা টুকরো টুকরো ইচ্ছের প্রকাশ ঘটে, হাসি-আনন্দে সময়টা যে কীভাবে হাওয়ার বেগে উড়ে যায় টের পায় না মাইসারা!

একটানা ডিউটি করে প্রায় হাঁপিয়ে ওঠার অবস্থা হলো তার। ঘামে চটচটে শরীর নিয়ে দ্রুত রুমে ঢুকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসার পরই টের পেল বেয়া’দব ফোনটা অবিরত কাঁপছে। ডাটা অন থাকাতেই ইমোতে ভিডিও কল দেখতে পেল সে। রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে অনিক বলল,

-“কোথায় ছিলি তুই? এতক্ষণ লাগে ফোন রিসিভ করতে?”

-“শাওয়ার নিচ্ছিলাম তো, তাই খেয়াল করিনি। সবার কী খবর বলো?”

-“সবার খবর জানতে হলে সবাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর। আমি ফোন করেছি এখন আমার সঙ্গে কথা বলবি। শুধু আমাদের দু’জনার কথা হবে! বাড়তি কাউকে এলাও করবো না সারা।”

অনিকের এই পাগ’লাটে স্বভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে মাইসারা। দিনকেদিন অনুভূতি যতখানি প্রখর হচ্ছে, দায়িত্ব, কর্তব্য ততই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। হেলায়, ফেলায় অনেক তো দিন অতিবাহিত হলো, এবার কিছু স্বচ্ছ অনুভূতিকে ধরে রাখার চেষ্টা হোক! টাওয়াল দিয়ে মুখের পানি শুকিয়ে মোবাইলটা কাৎ করে ড্রেসিংটেবিলে রাখলো। ভেজা চুল মুছতে মুছতে বলল,

-“একটা জরুরী কথা বলার ছিল!”

-“বল! শুনছি। আরে চুলটা শুকিয়ে নে ভালো মতো। নয়তো ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আচ্ছা বলতো, তোর কী কী লাগবে? একটা লিস্ট তৈরী করে দিস। ওসব মেয়েলী ব্যাপার স্যাপারে খুব একটা আইডিয়া নেই। হেয়ার ড্রায়ার, স্টেইট মেশিন, আর কী কী লাগবে, সব লিখে দিস। কিনে রাখবো।”

-“তুমি তো দেখি তোমার গান গাইছো, আমার কথা শুনছো কই! রেখে দিব ফোন?”

বিরক্তি নিয়ে বললো মাইসারা। সেই কবে থেকে কথাটা বলবে বলে অপেক্ষার প্রহর গুনছে, ভয়ে তাসবীহ্ জপছে অথচ অনিক তাকে পাত্তাই দিতে চাইছে না। সে পুরোদমে প্রস্তুত নতুন সংসার সাজানোর জন্য। বউ বাড়ি যাওয়ার পর কী কী লাগবে সেটা পরেও তো আলোচনা করা যায়! এখনই কেন এতসব কথা বলতে হবে? সময় আসুক, তখন দেখা যাবে। মাইসারার গাল ফুলানোর ধরন দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো অনিক। বলল,

-“তুই তো বলছিস না। না বললে শুনবো কী করে! আমি তো আর তোর মনের ভেতর ঢুকে যাইনি যে, মনের কথা বলার আগেই বুঝে নিব!”

-“এত বুঝতে হবে না। যা বলছি শুনো। আমি চাইছি এখানকার ঝামেলা মিটে গেলে আমাদের সদরের কোনো একটা ক্লিনিকে প্রেকটিস শুরু করবো! সেজন্য কাছাকাছি একটা বাসা দেখা দরকার। অল্প খরচের মধ্যে হলে হবে। যেন যাতায়াতে সুবিধা হয়! চাইলে তুমিও তোমার সুবিধা অনুযায়ী দেখতে পারো, দু’জনে একসাথে বেরোলাম। দেখবে…!”

মাইসারার শান্তশিষ্ট মনের এমন কথায় প্রচণ্ড চমকালো অনিক। বুঝতে দেরী হলো না যে, মেয়েটা বাড়ি ফিরতে চাইছে না। কিন্তু কেন? এখন তো ফারজানা নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত! আর কীসের দুঃশ্চিন্তা। থম মে’রে কিছুক্ষণ বসে রইলো সে। ভ্রু কুঁচকে তখনো অর্ধাঙ্গিনীর বলা কথাকে একমনে ভেবে চলেছে। কোনো সঠিক ক্লু না পেয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো,

-“তুই বাড়ি আসতে চাইছিস না?”

সোজা ক্যামেরার দিকে দৃষ্টি ফেরালো মাইসারা। অনিকের গম্ভীর, রাগী চোখ দেখে ঘাবড়ে গেল। তাৎক্ষণিক কোনো জবাব মুখে আসলো না। শুধু ভীরু চোখে তাকিয়েই রইলো। রাগ নিয়ন্ত্রণ করা প্রচণ্ড কষ্টের মনে হলো তার। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

-“জবাব দে সারা!”

আপাদমস্তক কেঁ’পে উঠলো মাইসারা। দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো। স্তম্ভিত, অনড়, নীরব হয়ে কিছুক্ষণ পর মৃদুস্বরে বলল,

-“আমার প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে!”

-“ঠিক আছে। বাড়ির কাউকে তো তোর বিশ্বাস নেই, থাক তুই। একা একাই থাক। কেউ তোর আশেপাশে যাবে না। আমি আর কী করবো। বাসা একটা দেখে দেব। তুই যাওয়ার পর হাত-পা ছড়িয়ে আরাম-আয়েশে দিন কাটাবো। নিজের সেবাযত্ন আর বাদবাকি চা’হিদা মেটানোর জন্য আরও তিনটে বিয়ে করবো। প্রথম বউ আমাকে রোজগার করে টাকা-পয়সা এনে দিবে। দ্বিতীয় বউ দিনরাত সেবা করবে, তৃতীয় বউ ক্ষিধে পাওয়ার আগেই মুখের সামনে খাবার ধরে থাকবে, আর চতুর্থ বউ ভালোবাসার গল্প করবে। কী শান্তির জীবন কাটাবো আমি, ভাবতে পারছিস সারা? মন্দ হবে না একদমই। তুই থাক! আসার প্রয়োজন নেই।”

প্রথমে রাগ থাকলেও পরবর্তীতে অনিকের চেহারা বেশ সিরিয়াস দেখালো। চোখ গোল গোল করে অনিকের হাসিমাখা ফেসটা দেখলো মাইসারা। মনে হলো, এই ছেলে এরকমটাই করবে ভবিষ্যতে! দ্বিতীয়, তৃতীয় বউয়ের দৌড় ঠিক আছে। কিন্তু চতুর্থ জনের ভবিষ্যৎ দৃশ্য কল্পনা করে প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে তার। রোজ ভিউ রেস্টুরেন্টের দু’রাতের চমৎকার দৃশ্য চোখে ভাসছে। কতখানি আদরে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নিয়েছিল তাকে। এখন সে জায়গায় অন্য কেউ আসবে! চোখমুখ ফুলিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে, এমন অবস্থা হলো মাইসারার। অনিক ক্যামেরা অফ করে বিছানা কাঁপিয়ে হাসছে। তার সেই হাসি মাইসারার চোখে পড়ছে না, ততক্ষণে লাইন বিচ্ছিন্ন করে গাল গড়িয়ে অভিমানের অশ্রু ঝরিয়ে দিয়েছে মেয়েটা!

*****

অনেকক্ষণ, খুবক্ষণ, বহুক্ষণ পর আবারও মোবাইলের আওয়াজ কানে আসলো তার। ওভাবে বসেই কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে সে। অতিরিক্ত কান্নার কারণে নাকের ডগাও যথেষ্ট লাল হয়ে গেছে। খুব স্বাভাবিক হয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে রাখলো। অনিক প্রথমে কথা বলল না, চুপচাপ কিছু শোনার অপেক্ষায় রইলো। মাইসারাও রেসপন্স করলো না। ওভাবে কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর অনিক নিজেই বলল,

-“ফোন কে’টে দিলি কেন?”

গাল ফুলিয়ে বসে রইলো মাইসারা। জবাব দিল না। অভিমানীর এমন অভিমানের রূপ আগে কখনো দেখেনি অনিক। দূরত্বের এই সময়টা কষ্টের হলেও অনুভূতির প্রখরতা অনেকটা বেশিই ছিল, এটা সে দিব্যি বুঝতে পারছে। জবাব না পেয়ে আবারও বলল,

-“থাকতে পারবি আমায় ছাড়া?”

কোনো জবাব খুঁজে পেল না মাইসারা। সে এতটাই আবেগপ্রবণ যে, এই সম্পর্কে দূরত্ব রেখেই বুঝতে পেরেছে, নীরবে, গোপনে, মনের মনিকোঠায় খুব যতনে অনিক নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছে। দিন একবার তার কণ্ঠস্বর না শুনলে ভয়ে বুকে কাঁপন শুরু হয় তার। আবারও যদি নিজের ভুলে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়, তবে কি অভিমানের পাহাড় ডিঙিয়ে ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিতে অনিক ফের ছুটে আসবে কাছে? আসবে না হয়তো! ভুলকে ফুল ভেবে গ্রহণ করবে না। বরং অভিমানকে বাঁচিয়ে রাখতে অনুভূতিকে দূরে ঠে’লে দিবে। একটা মানুষ আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা দিবে? অনেকক্ষণ পর গভীর করে শ্বাস টানলো মাইসারা। কেঁপে কেঁপে উচ্চারণ করলো,

-“তুমি আরও তিনটে বিয়ে করবে?”

মাইসারার বলার ধরন শুনে আবারও হাসি আসলো অনিকের। কোনোমতে তা দমিয়ে রেখে বলল,

-“করতে তো হবেই। আমার সব প্রয়োজন মেটাতে তুই তো আর কাছে আসবি না। তাই যারা কাছে থাকবে তাদেরকে দিয়ে চালিয়ে নিবো। দিন দিনের পথে গেল, রাত রাতের পথে। মাস ছ’য়েক পর কিংবা বছরে একবার দেখা করবো তোর সাথে! হবে না? দারুণ হবে। কম কম দেখা সাক্ষাৎ হলে অনুভূতিও প্রখর থাকবে।”

-“তুমি খুব খারাপ!”

-“আমি ভালো, সেই সার্টিফিকেট দেখিয়েছি কখনো?”

মাইসারা ফের নীরব হয়ে গেল। রাগে, দুঃখে প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে দু’চারটে কি’ল, ঘু’ষি মে’রে আসুক অনিককে। কিন্তু দূরত্বের এই পথ শুধু দূরেই নয়, নাগালেরও অনেক বাইরে। চাইলেও সে ছুটে যেতে পারবে না, রাগ অভিমান মিটিয়ে বৈধ পুরুষের প্রশস্ত বক্ষে মিশে যেতে পারবে না। অপেক্ষা করতে হবে কাঙ্ক্ষিত সময়ের জন্য। মনে মনে নিজেকে হাজারও স্বান্তনার বাণী শুনালো। শান্তস্বরে বলল,

-“তিনটে কেন দ্বিতীয় বিয়েরও নাম নিবে না তুমি!”

-“নিলে কী হবে?”

রসিকতা করে বলল অনিক। মাইসারাও অভিমানে জবাব দিল,

-“আমার ম’রা মুখ দেখবে!”

-“ছিঃ সারা! বা’জে কথা মুখে আনতে নেই।”

-“তুমি আরও তিনটে বিয়ে করবে এটা দোষের না! আমি ম’রার কথা বললেই দোষ?”

-“আচ্ছা আমি বিয়ে করলে তোর সমস্যা কী? তোকে তো ডি’ভোর্স দিচ্ছি না। তুই আমার প্রথম বউ আছিস, তাই-ই থাকবি। বাকিরা কেউ-ই তোর জায়গা নিতে পারবে না।”

-“মে’রে হাড়গোড় ভে’ঙে দেব তোমার!”

-“তুই ডাক্তার হওয়ার বদলে লেডি কি’লার হলি কবে?”

-“ফের শুধু বিয়ের নাম মুখে নিয়ে দেখো, তোমার মুখে আমি তালা ঝুলিয়ে দিব বা’জে ছেলে।”

-“তুই বাড়ি না আসলে চারটে বিয়ে কনফার্ম! ভেবে সিদ্ধান্ত জানা, ঠিক আছে? এখন রাখি। রাত অনেক হয়েছে সোনা বউ, ঘুমিয়ে পড়। গুড নাইট। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখ, বাকি তিনটে বউ কীভাবে তাড়াবি!”

বেশ মজার ছলে মাইসারাকে রাগিয়ে দিচ্ছে অনিক। সামনে না থাকলেও বুঝতে দেরী হচ্ছে না যে, পাহাড়সম অভিযোগ দাঁড় করিয়ে ফেলেছে এই মেয়ে। কাছে আসলে নির্ঘাত শো’ধ তুলে ছাড়বে। বিদায় নিয়ে ভালোমতো ফোন কে’টে দিতে চাইলো অনিক। ওপাশ থেকে মাইসারা ঝটপট বলল,

-“একটা কথা শুনো!”

-“বল!”

-“প্রমিস করো, তুমি আর কারও দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।”

মাইসারার এই বোকা বোকা কথায় প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে অনিকের। এমনিতেও যথেষ্ট রেগে আছে মেয়েটা। আর রাগানো উচিত হবে না। তাই বেশ শান্ত গলায় বলল,

-“আমার জন্য শুধু একজন নারীই বৈধ। আর সেটা কেবল তুই!”

-“মিথ্যে কথা। যদি আমিই হতাম, তবে তুমি আরও তিনটে বিয়ে করতে চাইতে না। নিশ্চয়ই আরও তিনজনকে অপেক্ষায় ফেলে রেখেছো!”

-“ডোন্ট বি সিরিয়াস সারা, আই ওয়াজ জাস্ট কিডিং!”

-“মজার ছলেও এমন কথা আর বলবে না।”

-“ওকে, আ’ম সরি! তুই আমার প্রাণপাখি সারা। প্রাণ ছাড়া প্রাণীকে বাঁচতে দেখেছিস কখনও?”

নিশ্চুপে ফোনটা কানে লাগিয়ে বসে রইলো মাইসারা। এই প্রশ্নের কোনো জবাব তার জানা নেই! কতখানি ভালোবাসলে প্রিয়জনকে প্রাণ বলে সম্বোধন করা সম্ভব, আসলেই তা জানা নেই তার। শুধু জানে ওই অনুভূতিটুকু সব সময়ের জন্য সত্য। তবুও মজা করে বলল,

-“আমি আসার আগেই ওই তিনটে বউকে বিদায় করো, নয়তো ভালো হবে না বলছি।”

-“আসবি তো? আর অপেক্ষায় ফেলবি না তো আমাকে?”

উত্তরে শুধু ছোটো করে ‘ফিরবো’ উচ্চারণ করলো মাইসারা। তবে মনে মনে বিড়বিড় করলো তাকে খুব শীঘ্রই ফিরতে হবে। অপেক্ষার এই লম্বা সময় যেন খুব দ্রুত ফুরোয়, নীরবে সেই প্রার্থনাই রোজ করে সে। শুধু মুখ ফুটে বলতে পারে না, ‘আমার তোমাকে প্রয়োজন!’ প্রয়োজন হয় বলেই তো কাছের মানুষ প্রিয়জন হয়ে উঠে! তার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হলো না। মনে প্রাণে সে এইটুকুই মানে, বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পর স্বামীই একটা মেয়ের সবচেয়ে কাছের এবং আপন হয়ে উঠে। সেই হিসেবে অনিকের তো তুলনা হয় না। মানুষ হিসেবে হোক কিংবা জীবনসঙ্গী হিসেবে, নিঃসন্দেহে সে একজন উত্তম পুরুষ!

*****

দূরে থেকেও দু’জনার অনুভূতি এতটাই প্রখর যে, মন থেকে তারা কাছে অথচ আলিফ আর ফারজানার ব্যাপারটা এখন ভিন্ন। দু’জনে এতটাই কাছে থাকা সত্ত্বেও দূরত্ব আজ দু’জনার সব সময়ের সঙ্গী। আলিফ বলেছিল, নীরবে শা’স্তি দিবে প্রিয়জনকে। দিচ্ছেও। ঘরের ভেতরে থাকা মানুষগুলো টেরই পাচ্ছে না, দু’জনার মাঝখানে এখন অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরী হয়েছে। যে দুর্ভেদ্য দেয়াল ভে’ঙে ফেলার সাহস কিংবা শক্তি কোনোটাই ফারজানার নেই। সেই যে বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিল এরপর আলিফ তার সাথে মেপে মেপে কথা বলছে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ডাকে না, সবার সামনে যা হোক একটু কথা বলে কিন্তু চার দেয়ালের ভেতরে অন্য এক মানুষে রূপান্তরিত হয় সে। কথা বলা তো দূর, তখন ফিরেও তাকায় না অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। আলিফের এই পরিবর্তন মানতে পারছে না ফারজানা। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। আশায় আছে হয়তো আবারও একদিন সব ঠিক হবে। সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। আগের মতো ভালোবাসা হবে, গল্প হবে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন। সময় ফুরাবে তবুও কথারা ফুরাবে না। বকবক চলতেই থাকবে।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে ফ্লোরের দিকে। একটা পাটি বিছিয়ে বালিশে মাথা, কপালে কনুই রেখে শুয়ে আছে আলিফ। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি জেগে আছে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। কোনো নড়চড় নেই ঠিকই তবুও ফারজানার কেন যেন মনে হলো, সে ঘুমায়নি। হয়তো জেগেই আছে। কথা বলে দেখবে কি? উত্তর দিবে? কিন্তু কী কথা বলবে? আগে তো দিনরাত নিজেদের মধ্যে কত কথা হতো, কারণে অকারণে কথা হতো। অথচ এখন কথারাও হুট করে ফুরিয়ে গেছে। মান-অভিমানের সাথে তারাও দূরত্বকে আপন করে নিয়েছে। অনেকক্ষণ চেয়েও কোনো কথা খুঁজে পেল না ফারজানা। নীরবে তাকিয়ে রইলো শুধু। কীভাবে শুরু করবে সেটা নিয়েই দোটানা তার মধ্যে। অপরাধটা যে তার অনেক বড়ো, ক্ষমা করলেও হয়তো আগের মতো বিশ্বাস করছে না। ঠিক কীভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত তার? নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছে এটাও কি কম ছিল? কমই তো। মৃ’ত্যুর চেয়েও কঠিন শা’স্তিই আলিফ তাকে দিচ্ছে। একেবারে নিঃসঙ্গ জীবন উপহার দিয়েছে। এরচেয়ে কঠিন শা’স্তি আর কী হতে পারে!

ভোররাতে অদ্ভুত এক ঘটনার সাক্ষী হলো আলিফ। বুকের কাছটায় ক্রমশ ভেজা ভেজা ঠেকলো। প্রথমে মনে হলো, গরমের ঘাম। অথচ উপরে সিলিংফ্যান চলছে। ঘাম আসার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু পরবর্তীতে নড়াচড়া করতে গিয়েই আবিষ্কার করলো অর্ধাঙ্গিনীর পুরো শরীর তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে। বহুদিন পর বিয়ের প্রথম রাতগুলোর কথা মনে পড়লো তার। আপনজন ছেড়ে এসে ঠিক এভাবেই কাঁদতো রোজ। সুখের আতিশয্যে একটা সময় সেই কান্নাও মুছে গেছে মেয়েটার। নিজের শরীর থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলো আলিফ। ফারজানা বাঁধ সাধলো। ওভাবেই জড়িয়ে রইলো, তবে হাতের বাঁধনটা আগের চেয়ে শক্ত করে দিল। এমন একটা সিচুয়েশনে পড়বে ভাবেইনি সে। এরকমটা হবে জানলে রুম আলাদা করতো, শা’স্তির জন্য শুধু শয্যা আলাদা করতো না। খানিকটা বিরক্তির সুরে বলল,

-“হাতটা সরাও। আযানের সময় হয়েছে। আমাকে উঠতে হবে তো। নাহিয়ান জেগে গেলে সমস্যা হবে। সরো!”

-“তুমি আমাকে মা’রো, বকো, যা খুশি বলো তা-ও কথা বলা বন্ধ করে দিও না। আমি আর নিতে পারছি না এসব।”

-“মা’রতে চাইলে সেদিনই মা’র’তে পারতাম।”

-“তবে ক্ষমা করে দাও। ভুল তো মানুষেরই হয়। নিজের ভুলে সব এলোমেলো করে ফেলেছি আমি। তুমি যদি ক্ষমা না করো, তবে তো আমার একটাই পথ খোলা থাকে!”

-“ক্ষমা করলেও ফের তুমি এমনটা করবে না তার কী গ্যারান্টি? বিশ্বাস করেছিলাম তোমাকে। সাজানো, গোছানো একটা সুন্দর সংসার চেয়েছিলাম। তুমি কী করলে? আমার এতদিনের সব ভালোবাসা আর বিশ্বাসকে মিথ্যে করে দিলে! এমনটা তো আমি কখনোই চাইনি। কেন করলে?”

-“মে’রে ফেলো আমাকে। যা অন্যা’য় করেছি তার প্রতিশো’ধ নাও। মুক্তি দাও এতসব যন্ত্রণা থেকে। এভাবে চলতে থাকলে, দম আট’কে মা’রা যাব আমি। তারচেয়ে ভালো, তুমি নিজেই মা’রো।”

-“একবার বিশ্বাস ভে’ঙে গেলে দ্বিতীয় বার তা আর জোড়া লাগে না! আমি কী করে আবারও তোমাকে বিশ্বাস করি?”

-“এজন্যই তো বলছি, নিজেই মে’রে ফেলো। বিশ্বাসও করতে হবে না আর।”

পরক্ষণেই কোনো নির্দিষ্ট জবাব খুঁজে পেল না আলিফ। হাত সরিয়ে জোরপূর্বক উঠার চেষ্টা করলো। ফারজানাও নাছোড়বান্দা। ওভাবেই চেপে ধরে শুয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল সে। বলল,

-“ভেবে দেখবো, ক্ষমা করা যায় কি-না! এখন উঠতে দাও।”

-“উঁহু, এভাবে থাকো। বেশি নড়াচড়া করলে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবো!”

-“কী আর করবে! লম্বা একটা কাপড়ই শুধু গ’লায় ঝু’লা’তে পারবে। ভয়ে কলিজা কেঁপে উঠেছিল আমার।”

-“স্বীকার করছো তবে, এখনো আমাকে ভালোবাসো।”

কোন কুক্ষণে যে এমন একটা মুখে আনলো আলিফ, নিজেও বুঝলো না। ধাক্কাধা’ক্কি করেও ছুটতে পারছে না। মেয়েটা একেবারে সা’পের মতোই পেঁ’চিয়ে ধরেছে তাকে। দূরের মসজিদ থেকে তখন মুয়াজ্জিনের মধুর কণ্ঠের আজান ভেসে এলো। আলিফ একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে বলল,

-“এখন তো ছাড়ো। নামাজ পড়বো।”

-“ছাড়বো। আগে বলো ক্ষমা করেছো।”

-“একটা শর্তে ক্ষমা করবো। আজ তুমি আবারও ওয়াদা করবে, কোনোদিনও সংসারে ভা’ঙ’ন ডেকে আনবে না। কারও কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না। ওয়াদাটা আমার সাথে নয়, আল্লাহর সাথে করবে। যেন পরবর্তীতে তোমার অন্যা’য়ের শা’স্তি তিনি নিজেই দিতে পারেন।”

আলিফের এই কথাটা যথেষ্ট কাজে দিল। ঝটপট সোজা হয়ে বসলো ফারজানা। চোখমুখ মুছে, এলোমেলো চুল খোঁপা করে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকলো। ওযু করে আলিফের আগেই জায়নামাজে দাঁড়ালো সে। সিজদাহ্’তে অনেকক্ষণ কাঁদলো! তার দীর্ঘ সিজদাহ্ দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আলিফ। বুঝতে পারলো, এইবার ওয়াদার খেলাফ করতেও জাহান্না’মের আগু’নের ভয় তাকে কাঁপাবে। দেরী না করে সে নিজেও নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে অর্ধাঙ্গিনীর হাতটা শক্ত করে ধরলো সে৷ দৃঢ় বিশ্বাস আর ভরসাকে সঙ্গী করে বহুদিন পর স্ত্রীর কপালে অধর ছুঁলো। বলল,

-“শেষবারের মতো ক্ষমা করলাম। আর কখনো এমন ভুল করো না। প্রিয়জনের বদলে যাওয়া মারাত্ম’ক ব্যথার সৃষ্টি করে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, নিজের দেখা মানুষটা একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে।”

মুখে আর কোনো জবাব আসলো না তার। গুটিসুটি মে’রে জড়িয়ে গেল আলিফের সাথে। বুকে মাথা রেখে আগের মতো লতানো হাতে পেঁ’চিয়ে ধরলো পুরোটা। অনেকক্ষণ পর টের পেল, আলিফ নিজেও দু’হাতে আগলে নিয়েছে তাকে। মন থেকে খোদার দরবারে শুকরিয়া জানালো ফারজানা। অনেক ভুল হয়েছে, অনেক মান-অভিমান হয়েছে, আর কোনো ভুল সে ভুলবশতও করবে না। ভা’ঙ’ন সে তো অনেক দূরের চিন্তাভাবনা।

*****

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে