পুতুল বিয়ে পর্ব-০২

1
1274

#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



আরেকটি সকাল হলো।পূবের জানালায় আলোর খেলা। জানলার বাইরে একটা বুড়ো কাঁঠাল গাছ। সেই গাছে এক জোড়া দোয়েল বসে আছে।সাদা আর কালো পালকের দোয়েল।একটি অপরটির ঠোঁটে ঠোঁট ঘষছে।
সারাটা রাত আমার ঘুম হয়নি। সকাল হতেই আমি ছুটে এসেছি জানলার কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির খেলা দেখছি। কিন্তু এই একটা দৃশ্য আমায় খুব কাঁদালো। একজোড়া পাখি। তাদের প্রণয় দৃশ্য। এইসব দেখে অত কাঁদবার কী আছে? কিন্তু আমার কান্না পেয়ে গেল।মনে পড়ে গেল অতীতের কিছু কথা।মিতুলের সাথে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে উড়নচন্ডি হয়ে ঘুরা। প্রচন্ড তেষ্টা পেলে জলের বদল একে অপরকে চুমু খাওয়া।
মিতুল বলতো,’তোমাকে যদি না পায় তবে এই সবুজ পৃথিবীকে আমি দোযখ বানিয়ে ফেলবো।আর নিজের জীবনকেও!’
আজ সে আমায় পেয়েছে। কিন্তু সবুজ পৃথিবী অথবা তাকে নয়।আমাকেই দোযখ বানিয়ে দিচ্ছে।

কিচেনে রান্না চড়াতে যেতে হবে।একটু পর অফিস। রান্না হলে গোসল করতে হবে। এছাড়াও ঘরে অনেক কাজ কর্ম আছে। চটজলদি জানলা থেকে সরে এলাম আমি।বা হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে কিচেনে ঢুকলাম। কিচেনে ঢুকে মনে হলো ঘরে চাল নাই।কী সর্বনাশ! আমার জন্য আমি ভাবছি না। আমি না হয় পানি খেয়ে পেট ভরে নিবো। সমস্যা নাই এতে। ছোট বেলায় এমন করে দু তিনদিন থেকেও অভ্যেস আছে। কিন্তু মিতুলের কী হবে?ওর জন্য তো খাবার প্রস্তুত করতে হবে।বড় লোকের ছেলে ও। ছোট বেলা থেকে খাবারের কষ্ট কী সে টের পায়নি। এখানে এসে যে আমার জন্য ধৈর্য ধরে এসব কমদামি খাবার দাবার খাচ্ছে এটাই তো আমার রাজ কপাল!

হাতে একটা টাকাও নাই। পালিয়ে আসার সময় মার সারা জীবনের সঞ্চয় আমি চুরি করে নিয়ে এসেছিলাম। টাকাটা সামান্য।বিশ হাজার টাকা। কিন্তু আমার মার কাছে এই টাকা অনেক বড় কিছু ছিল। টাকাটা হাওয়ার মতো ফুরিয়ে গেছে প্রথম মাসেই।তার পরের মাস থেকে চাকরি জুটিয়েছি। কিন্তু এতে যা স্যালারি তা দিয়ে দুজন মানুষের এক মাস চলা খুব কষ্টকর।এ মাসেও এমন হলো।পনেরো তারিখের আগেই সব শেষ। তাছাড়া মিতুলের ফোনের খরচাটাও আমায় দিতে হয়।ওর তো আর আলাদা ইনকাম সোর্স নাই।আমি ছাড়া ওকে আর কে বা টাকা দিবে!

বাসা থেকে বের হয়ে সামনের দোকান থেকে কিছু চাল বাকীতে নিলাম। চিন্তা করলাম আমার ফোনটা বিক্রি করে দিবো।এতে মাসের বাকী পনেরো দিন খুব ভালো ভাবেই কেটে যাবে। কিছু হাতেও থাকবে।পরে টাকা হলে ফোন কেনা যাবে।
বাসায় ফিরে কিচেনে গিয়ে রান্না চড়ালাম। রান্নার এক ফাঁকে গোসল সেরে নিলাম। তারপর অফিসের জন্য রেডি হয়ে মিতুলকে আস্তে করে ডাকলাম।
মিতুল ঘুম জড়ানো গলায় বললো,’কী হয়েছে?ডাকছো কেন?’
‘রান্না হয়েছে।আমি অফিস চলে যাবো।উঠো, একসাথে খাই!’
মিতুল ত্যাক্ত গলায় বললো,’এখন খাবো না।ডিস্টার্ব করো না।একটু ঘুমাতে দাও!’
আমি মনে মনে নিজেকেই বকলাম। অনেক রাত অবধি জেগেছে ও। এখন একটু ঘুমোচ্ছে। আমার একটুও উচিৎ হয়নি ওকে ডাকা।
তারপর একা একাই সকালের খাবার খেয়ে ওর জন্য আলাদা করে খাবারটা ঢেকে রেখে দিলাম। তারপর যখন বের হতে যাবো তখন মিতুলের গলা শোনা গেল। মিতুল পেছন থেকে বললো,’কথাটা তো জানালে না!আমি কী চলে যাবো নাকি?’
মিতুলের এই একটা কথা শুনে আমার বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তবে আমি কার জন্য এসব করছি! চাকরি বাকরি, সকাল হতেই নিজের কথা না ভেবে শুধুমাত্র ওর কথা ভেবে বাকীতে চাল আনা, রান্না চড়ানো। কেন করছি এসব। ওকে ভালোবাসি বলে? ভালোবাসা কী এমন। ভীষণ রকম অসহায়?
আমার কান্না আসে খুব। ঠোঁট কেঁপে উঠে বন পাতাদের মতো তিরতির করে। বুকের কাছে যেন সমুদ্রের গর্জন হয়।ঢেউ ভাঙ্গে পাঁজরের খুব কাছে!
কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে দেই একপাশে। তারপর ধপাস করে বসে পড়ি ফ্লোরের উপর দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে। এবার ওড়নায় মুখ চেপে ধরে কাঁদতে থাকি খুব!
মিতুল অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার কান্না দেখে। তারপর বিছানা থেকে নেমে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়।চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,’রাফি,আই অ্যাম সরি! একচ্যুয়েলি আমি তোমার সাথে ফান করছিলাম। কেন অত সিরিয়াস হয়ে যাও তুমি বল তো!’
আমি তখন পাগলের মতো হয়ে যাই।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো মিতুলকে জাপটে ধরি।ওর জামার আস্তিনে খাবলে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলি,’তুমি আমায় নিয়ে এমন পুতুল পুতুল খেলা খেলো কেন বল তো?জানো, তোমায় ছাড়া আমি কিছুতেই থাকতে পারবো না তবুও কেন দূরে সড়ে যাওয়ার কথা বলো?’
মিতুল আমায় শক্ত করে ওর বুকের সাথে লেপ্টে ধরে রাখে। ঘাড়ে ওর দাঁতের নরম কামড় বসিয়ে দিতে থাকে। পিঠে হাত বুলাতে থাকে দ্রুত। তারপর আমার কানের কাছে ওর মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,’মানুষের জীবনটাই তো পুতুলের মতো!এসো আমরা পুতুলের বিয়ে খেলি।’
বলে সে আমায় পাঁজাকোলা করে বিছানার কাছে নিয়ে যায়।বহু বহুদিন পর আমরা আবার মিলিত হই। এমন একটা সকালকে আমার স্বর্গের সকাল মনে হয়। এমন একটা সকাল পবিত্র জলের মতো।মনের সবটুকু ঘ্লানি,ভেতরে জমা সবটুকু অভিমান,ক্লেদ,রাগ, সন্দেহ সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়।

সেদিন অফিসে যাইনি আমি। ভেবেছিলাম সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে।মিতুল আবার আমার হয়ে গেছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম আমি।এক পরিচিত বন্ধুকে দিয়ে ফোনটা ভালো দামে বিক্রি করিয়ে মিতুলের জন্য একটা ভালো পাঞ্জাবি কিনে আনি।ওর হাতে পড়ার জন্য একটা ঘড়ি কিনি।রাতে ফিরে ওর হাতে গিফট ধরিয়ে দিতেই ও চকচকে চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি ভেবেছিলাম ও বুঝি ধন্যবাদ দিবে। কিন্তু ধন্যবাদ না দিয়েই জিজ্ঞেস করে,’অত টাকা পেয়েছো কোথায়?’
আমি তখন বলি,’ফোনটা বিক্রি করে দিয়েছি।’
মিতুল হাসি হাসি মুখে বলে,’কত বিক্রি করেছো?’
‘আট হাজার টাকা।’
‘আমায় কিছু দিতে পারবে?বেশি না।দু হাজার হলেই চলবে।পরে তোমায় ফিরিয়ে দিবো!’
ওর ফিরিয়ে দেয়ার কথাটা শুনে আমার যা কষ্ট হলো!ওর তো এমনিতেই খরচা করে অভ্যেস।বড় লোকের ছেলে। আমার সাথে কতো কষ্ট করেই না সময় কাটাচ্ছে ও!কত শখ আহ্লাদ আমার জন্য মাটি করেছে ও।আর আমি কি না ওকে মাত্র দু হাজার টাকা দিলে তা ফিরিয়ে নিবো!
আমি বললাম,’টাকাটা দিবো যদি তুমি ফিরিয়ে দিবে না কখনো এই শর্তে রাজি হও?’
মিতুল গাঢ় হেসে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে কোনদিন ফিরিয়ে দিবো না। এখন হলো?’
কথাটা বলে মিতুল আমার কপালে চুমু খেলো।
তারপর ফিসফিস করে আমার কানের কাছে ওর মুখ নিয়ে বললো,’ভালোবাসি।’
আমি লজ্জায় ওর বুকের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে লাগলাম।আর মনে মনে বলতে লাগলাম,আমার মিতুল যেন সারা জীবন ঠিক এরকমটাই থাকে।
কিন্তু এরকমটা আর রইলো না। সেদিন রাতেও ঘুম ভেঙ্গে আমি দেখি মিতুল বিছানায় নাই। গতকালের চেয়ে আজ আরও বেশি করে বুকটা কেঁপে উঠে আমার।মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে ভনভন করে। ফুল স্পীড। তবুও আমার শরীর কেমন ঘামছে। আমি তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে আবার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।মিতুলের কানে ফোন ধরা। হেসে হেসে ও মিষ্টি করে কথা বলছে।গাঢ় করে চুমু খাচ্ছে কাউকে ফোনেই।
মাথাটা আমার ঘুরছে।মনে হচ্ছে পড়ে যাবো টুপ করে। তবুও আমি চুপচাপ এসে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।একটু পর মিতুল এলো। এসে সে সোজাসাপ্টা বললো,’রাফি, আমার আর কিছুই করার নাই।একটু সময় দাও। মেয়েটা আমায় পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু আমি বাসি না।ও আমায় হুমকি দেয়।বলে সোইসাইড করবে।আর আমাকে নাকি এর জন্য দায়ী করবে। তুমি কী চাও আমি জেলে পঁচি?’
ওর কথা শুনে আতংকে আমার বুকটা কেঁপে উঠে।আমি তখন বলি,’জেলে পঁচবে কেন? তোমার কী এতে?মরে গেলে ও মরে যাবে!’
মিতুল বলে,’এইসবকিছু তুমি বুঝবে না।ও মরার আগে চিরকুটে লিখে যাবে ওর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী।’
আমার এবার খুব ভয় হয়। খুব খুব ভয়!আমি বলি,’এখন কী করবে তবে?’
মিতুল রাগী রাগী গলায় বলে,’কী আর করবো? তুমি কী ভেবেছো ও যা বলে তাই মানবো? কিছুতেই না।ওর নাকে বড়শি দিয়ে ঘুরাবো। আপাতত একটু সহ্য করো।একটু একটু শুধু ওর সাথে কথা বলবো। তারপর ওর মাথা থেকে সোইসাইডের ভূত নেমে গেলে ওর পাছায় লাথি দিয়ে ওকে বিদেয় করবো!’
আমি ওর কথায় আস্বস্ত হই
যদিও কোন স্ত্রী কিংবা প্রেমিকাই পারবে না তার স্বামী কিংবা প্রেমিককে আলাদা কোন নারীর সাথে প্রেম করার জন্য অনুমতি দিতে। কিন্তু আমার দিতে হলো।কারণ আমি ভীতু।মিতুলকে হারানোর ভয় সব সময় আমায় তাড়িয়ে বেরায়। নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারি আমি কিন্তু মিতুলকে না।
আমি তখন মিতুলের গলা জড়িয়ে ধরে বলি,’মিতুল, তুমি কিন্তু আমায় ঠকাবে না?’
মিতুল তখন বলে,’তোমায় ঠকাবার আগে যেন আমার মরণ হয়!’

#চলবে

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে