পুতুল বিয়ে পর্ব-০১

1
1960

#এক_আপুর_জীবন_কাহিনী_নিয়ে_লিখা_গল্প-
‘#পুতুল_বিয়ে
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে যখন দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে যাবো ঠিক তখন দেখি আমার স্বামী মিতুল কারোর সাথে ফোনে রোমান্টিক ভাবে কথা বলছে, এবং কথা বলার এক পর্যায়ে চুমুও খেয়েছে।
বিষয়টা দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল।সারাটা দিন খাটুনি খেটে এলাম আমি।ওর গায়ে কাজ কর্ম সয়না।এক বাপের এক ছেলে।জীবনেও পরিশ্রম করে অভ্যেস নাই।তাই তার কষ্টের কথা ভেবে আমিই সারাদিন খাটি।অফিস করেও দুটো টিউশনি করাই।আর সে কি না বাসায় বসে বসে এসব করে!
আমি যে অত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবো মিতুল বুঝতে পারেনি হয়তোবা। হঠাৎ আমি গলা খাঁকারি দিতেই ফোন কেটে দিয়ে ব্যাস্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সে বললো,’রাফি,অত সকালে ফিরলে যে?’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে খানিক নুইয়ে পড়ে পা থেকে জুতোর বেল্ট খুলতে খুলতে বললাম,’কেন? বিরক্ত করেছি বোধহয়!’
মিতুল এবার রাগ দেখায়।চোখ লাল লাল করে বলে,’তোমার সাথে থাকাটাই উচিৎ হচ্ছে না।সব ছেড়ে ছুড়ে তোমায় নিয়ে পালিয়ে এলাম। তোমার জন্য শুধু এই ঘরে বন্দী জীবন কাটাচ্ছি।অথচ বাড়িতে আমি ছিলাম রাজপুত্র।যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাম। ভুল করেছি।তোমায় ভালোবেসে পালিয়ে এসে ভুল করেছি।’
মিতুলের রাগ এবং অভিমানী গলার কথা শুনে আমার কেমন কষ্ট হয়। খানিক আগেও যে নিজের চোখে দেখেছি ও ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে তা হঠাৎ কেন জানি আমার কাছে ভুল দেখা মনে হয়!ওর চুমু খাওয়াকেও ভুল মনে হয়!আমি তখন মনকে বোঝ দেই।বলি, আমার মতো গরীব ঘরের একটা মেয়ের সাথে যে সে থাকছে,আমায় যে সে ভালোবাসে এটাই তো আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।আমি কেন শুধু শুধু ওকে সন্দেহ করছি!
জুতো খুলে ব্যাগ গুছিয়ে রেখে আমি এসে বসি মিতুলের পাশে। মিতুল দূরে সড়ে যেতে চায়।আমি তার হাত খপ করে ধরে ফেলি।ও আমার দিকে রাগী রাগী চোখে তাকায়। কিন্তু ওর রাগ মুহূর্তে আমি ভাঙিয়ে ফেলি।হুট করে ওর জামার কলার খামচে ধরে ওর গালে চুমু বসিয়ে দেই। মিতুল তখন আর রাগ ধরে রাখতে পারে না।সেও আমায় জড়িয়ে ধরে। পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,’তুমি আমায় রাগিয়ে দাও কেন বলতো?’
আমি ওর বুকের ভেতর আমার মাথা গুঁজে দিতে দিতে বলি,’তোমায় রাগতে দেখলে সুন্দর লাগে যে এইজন্য!’
কথাটা বলে ফিক করে হেসে উঠি আমি।
মিতুল তখন হাসে না।সে চুপচাপ বসে থাকে। বসে বসে কী যেন ভাবতে থাকে শুধু!
চিন্তিত ওকে দেখে আমার বুকের ভেতর যন্ত্রণা শুরু হয়। আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না ওর জন্য আমার অত মায়া হয় কেন? ভালোবাসার মানুষের প্রতি কী এমন দরদ সব সময় থাকে?

সে রাতে আমি মিতুলের কাছাকাছি যেতে চাই। কিন্তু মিতুল কাছে আসে না।বলে, শরীর ভালো না। খারাপ লাগছে। সকাল সকাল ঘুমোতে হবে।
আমি অস্থির হয়ে বলি,’কী হয়েছে তোমার? আগে বলোনি কেন?ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম!’
মিতুল তখন বলে,’আরে তেমন কিছু না।ঘুম পাচ্ছে।লাইট নিভিয়ে দাও।চোখ কেমন জ্বলছে।’
আমি ব্যাস্ত হয়ে দ্রুত লাইট নিভিয়ে দেই। তারপর মিতুলের পাশে এসে শুয়ে পড়ি।
একটু পরই মিতুলের নাক ডাকার আওয়াজ পাই।ওর এই এক বদ অভ্যাস। ঘুমিয়ে গেলে নাক ডাকে।ঘরঘর শব্দ হয়। কিন্তু আমার ওর এই নাক ডাকাটাই ভীষণ ভালো লাগে। ইচ্ছে করে ওর বুকে মাথা রেখে ওর এই নাক ডাকা শুনি সারারাত ভর। কিন্তু রাতভর আমার আর নাক ডাকা শুনা হয় না। সারাদিন খাটা খাটুনির পর শরীর ক্লান্ত হয়ে আসে।ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠে।আজও এমন হলো। কখন ঘুমিয়ে গেলাম টেরও পেলাম না।

ঘুম ভাঙলো যখন তখন রাত তিনটা। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে।গরম পড়ছে খুব। শরীর ঘামছে। এই জন্যই ঘুম ভেঙ্গে গেছে।ঘুম ভাঙার পর ডান পাশে হাত রাখলাম মিতুল ঘামছে কি না দেখার জন্য। কিন্তু মিতুলের জায়গাটা শূন্য দেখে চমকে উঠলাম আমি। বুকটা কেমন কেঁপেও উঠলো একবার। ভাবলাম, হয়তোবা গরমের জন্য বাইরে গেলো কি না!আমি বিছানা হাতড়ে মোবাইল বের করে লাইট জ্বালাতেই দেখি দরজা খোলা।মিতুলকে দেখা যাচ্ছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।তার কানে ফোন ধরা।কারোর সাথে কথা বলছে।কী মনে করে যেন লাইটটা নিভিয়ে ফেললাম আমি। তারপর ছোট ছোট পা ফেলে দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম।এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে মিতুলের গলা। মিতুল বলছে,’বিশ্বাস করো,আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।’
ও পাশ থেকে কে কী বলছে তা তো আর আমি জানি না।
মিতুলের কথাগুলো শুধু আমি শুনতে পাচ্ছি।মিতুল এবার বলছে,’কথা দিলাম আমি তোমায় বিয়ে করবো। ওকে নিয়ে তুমি ভয় করো না। এইসব পালানো বিয়ে টিয়ে অত শক্ত হয় না।ধরে নাও এটা একটা পুতুল বিয়ে।সময় হলে ঠিক দেখবে আমি তোমার কাছে চলে এসেছি।’
মিতুল এসব কী বলছে?ওর কথাগুলো শুনে আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। কেন জানি আমার মনে হচ্ছে এসব ভুল শুনছি আমি।
কিন্তু না সব সত্যি। মিতুল এবার চুমু খাচ্ছে। তারপর বলছে,’শুনো, তুমি আমায় নিয়ে ভয় পেও না।ওর সাথে এখন আমার কোন ফিজিক্যাল রিলেশনও নাই!আমরা দুজন দু বিছানায় থাকি। ওকে ছেড়ে আসতে একটু সময় লাগবে শুধু। তুমি কিছুদিন ওয়েট করো লক্ষ্মীটি।প্লিজ প্লিজ প্লিজ!’
আর সহ্য হচ্ছে না আমার। কিন্তু আমাকে এখনও চুপ থাকতে হবে। গরীবের ঘরে জন্ম আমার। ছোট বেলা থেকেই অনেক কিছুতেই চুপ করে থাকতে হয়েছে। শুধু গলা দেখাতাম মায়ের সাথে।গরীব অসহায় মা আমার বলতো, ওইসব বড় লোকেদের সাথে গরীবদের কোন সম্পর্ক হয় নারে মা।এরা শুধু শরীর চায়।আর কিছু না!
মার কথা আমি শুনিনি। কাউকে না জানিয়েই পালিয়েছি। সেদিন ভেবেছিলাম পালিয়ে আমি জিতে গেছি! কিন্তু এখন? এখন মনে হচ্ছে আমি আটকে গিয়েছি! ভয়ংকর একটা খাদে আমি আটকে গিয়েছি।এখান থেকে আর কিছুতেই বেরুতে পারবো না!

মিতুলের কথা প্রায় শেষ।বোঝায় যাচ্ছে এখন ফোন রেখে দিবে। তারপর এসে শুয়ে পড়বে বিছানায়।আমি তাড়াহুড়ো করে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম ও পাশ ফিরে। এখন আমার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতে তো আর পারবো না।কান্নাকে লুকিয়ে রেখে আমার ঘুমের বাহানা করতে হবে।যেন ও এসে দেখেই বোঝে আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।এতে ওর তৃপ্তি হবে। শান্তির একটা ঘুম হবে।আমি তো ওর শান্তিই চাই।শান্তি না চাইলে কী অতকিছু হজম করতে পারতাম!

মিতুল অতটা চালাক আমি জানতাম না।ও ঘরে এসে অন্ধকারেই আমায় ডাকলো,’রাফি?’
আমি চুপ করে রইলাম। ঘুমের বাহানা করেছি। এখন তো কিছুতেই কথা বলা যাবে না।নড়াচড়াও করা যাবে না।
মিতুল আবার ডাকলো।বললো,’ঘুমের ভাব করতে হবে না।আমি জানি তুমি জেগে আছো। এতোক্ষণ তুমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলে।আমি সব দেখেছি।’
মিতুলের মুখ থেকে এইসব কিছু শুনে আমি বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলাম!এই মিতুল কী সেই মিতুল তবে!আমি তো ভাবতাম এই ছেলে জগতের সবচেয়ে বড় বোকাদের একজন!নাকি প্রেমের বেলায় সব ছেলেরাই এমন বোকা সাজার চেষ্টা করে তার প্রেমিকার কাছে!
মিতুলের কথায় আমি বিছানা থেকে উঠলাম না।মিতুল এবার বললো,’থাক উঠতে হবে না। কিন্তু শুনো,সত্যিটা শোনা তোমার প্রয়োজন।আমি আরেকটা মেয়ের সাথে কথা বলি।ওর সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক। সবকিছু জানার পর যদি তুমি আমার সাথে থাকতে রাজি হও তবে হ্যা বলতে পারো।রাজি না হলে কাল সকালে আমি বাড়ি চলে যাবো। তোমার কাছে জোর করে আমি থাকবো না!’
মিতুল কত সহজ করে এই কথাগুলো বলে দিয়েছে। কিন্তু ওর এই সহজ কথাগুলোই তো আমার বুকে তীরের ফলার মতো গিয়ে বিঁধছে।ব্যথায় নরম বুকটা কাতরাতে শুরু করেছে। খুব বেশিদিন হয়নি তো আমরা পালিয়ে এসেছি।বড়জোর তিন মাস।এই তিন মাসেই আমি ওর থেকে অতটা দূরে সড়ে গিয়েছি!
মিতুল এসে শুয়ে পড়েছে তার জায়গায়। গরমে কেমন হাঁসফাঁস করছে ও।আমি দ্রুত টেবিলের উপর থেকে হাতপাখা টা নামিয়ে এনে ওর গায়ে বাতাস করতে লাগলাম। মিতুল ঘুম জড়ানো গলায় শেষবারের মতো বললো,’এই তুমি চিন্তা ভাবনা করে সকাল বেলা আমায় কথাটা জানিয়ো কিন্তু!’
ওর অত অবহেলা আমার প্রতি! তবুও আমি তাকেই চাই।তার গরম লাগলে আমার কষ্ট হয়।বাতাস করি ওর গায়ে।অথচ নিজে ঘামছি। ভেতরে ভেতরে পুড়ছি। এইসব কিছুর নাম কী ভালোবাসা নাকি দহন?
আমি জানি না!
চোখের পাতায় জল নামে।কান্নায় গলা ধরে আসে।ও পাশে মিতুল নাক ডাকতে শুরু করে আবার!
ঘড় ঘড় ঘড়।কী কুৎসিত ব্যপার!
তবুও ওর নাকের ডাকটাই আমার অত ভালো লাগে!

#চলবে

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে