প্রণয়ে প্রলয়ের সুর পর্ব-৩৮ এবং শেষ পর্ব

1
862

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৩৮ (শেষ পর্ব)
.
তরু রাতের খাবার খায়নি। চুপচাপ শুয়ে আছে সে। মা’কে স্পষ্ট বলে দিয়েছে নির্জন ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। ওকে পছন্দ করে সে। আফতাব আলমের কথা মিলে যাওয়ায় আসলাম সাহেব ফোনটা নিয়ে নিলেন ওর। নেয়ার সময় শাসিয়ে বললেন, ‘ছেলেটি নেহাত ভালো, তাই প্রেম-পিরিতের কথা শুনেও মেনে নিয়েছে।’

তরু ফোন দিয়ে দিয়েছে। সে বিশ্বাস করে না নির্জন ছাড়া কারও সঙ্গে বিয়ে হতে পারে। কখনও এ হতে পারে না। শুয়ে-শুয়ে ইশহাক সাহেবের সঙ্গেও মায়ের ফোনালাপ শুনেছে। ফোন রেখে নিজেদের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছে তাও। তরু কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু নির্জনের কাছে না। অন্য কোথাও। সেখান থেকে শিক্ষা দেবে এদের। সবার ডাকা-ডাকির পরও রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেল তরু। ঘুম থেকে উঠে গেল ভোর চারটায়। বিছানা থেকে নেমে আলগোছে দাদার রুমে গেল। বালিশের পাশেই উনার মোবাইল। সেটা নিয়ে নিল হাতে। তারপর পেছনের দরজা খুলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে ওড়না প্যাঁচিয়ে চলে এলো মূল রাস্তায়।
খানপুর পৌঁছাতেই ভোরের আলো ফুটে গেল। একটা বাস কাউন্টারে বসে কেয়াকে সে কল দিল। কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ করে ঘুম ঘুম গলায় বললো,

– ‘হ্যালো আব্বা এত রাতে?’

– ‘ফুপু আমি তরু।’

– ‘কিরে কি হয়েছে? আব্বার মোবাইল দিয়ে এত ভোরে কল দিয়েছিস যে।’

– ‘শোনো, তোমাকে গতকাল মেসেজ দিয়েছিলাম। পেয়েছো?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘এখন বলো এখানে আমার দোষ কোথায়৷ তোমার কারণে আমার পড়ালেখার ক্ষতি হয়েছে। এখন জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছে।’

– ‘আমি আজ দিনে আব্বাকে কল দিতাম। আমার বিয়ে ভেঙেছে তাতে অসুবিধা কি। আমি তো তোর বাবা-মাকে বলিনি আমাকে ছেড়ে দিছে তোমাদের মেয়েকে বিয়ে দিয়ো না।’

– ‘দাদা আর আম্মাকে ইশহাক সাহেব কল দিয়েছিলেন। ওরা শুনেনি কথা। তারা আফতাব স্যারের কাছেই বিয়ে দেবে।’

– ‘আচ্ছা আমি কল দেবো তোর মা’কে।’

– ‘তুমি তোমার কল দিয়ো। এখন আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছি।’

– ‘বলিস কি এসব? কোথায় তুই?’

– ‘তা জেনে লাভ নেই। এখন বলো আমি কি কোনো বান্ধবীর কাছে যাবে। না-কি তোমার কাছে আসবো।’

– ‘এসে কি করবি?’

– ‘দেখো পরে কি করি।’

– ‘তাহলে আমার এখানে আয়।’

– ‘কিন্তু তুমি বলবে না তোমার ওখানে এসেছি। আর বললেও কোনো লাভ হবে না।’

– ‘আচ্ছা আয় তুই বলবো না। দেখি কি করতে চাচ্ছিস।’

– ‘ওকে রাখছি। ফোনে টাকা শেষ হয়ে যাবে।’

– ‘ওকে, আর আমি তোর কথা না বলে কল দিয়ে কথা বলে নিব।’

– ‘তা বলো যা ইচ্ছা।’

– ‘ওকে।’

তরু দুপুরেই ঢাকা এসে পৌঁছে গেল। কেয়া এসে রিসিভ করলো তাকে। ফুপুর পূর্বের কোনো কর্মই সে পছন্দ করেনি, সমর্থন করেনি। কিন্তু ভুল করে ফেলার পর মানুষটিকে যতটুকু পারা যায় ধ্বংস না করে শুধরে যাওয়ার সুযোগ দেয়ায় বিশ্বাসী তরু। সেই সুযোগ কেয়া পাক পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে তরুও চেয়েছে। সেটা পেয়েছেও কেয়া। ফুপুকে আজ দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল ওর। একজন সুন্দর, সুস্থ তরুণীর মতোই লাগছে। ব্লু-গ্রিন কালার থ্রি-পিস পরনে। খানিকটা শুকিয়েছে। তাকে নিয়ে গেল একটি বাসায়। বেশ কয়েকজন মিলে তারা থাকে। কেয়া তাড়াহুড়ো করে আবার অফিসে চলে যাওয়ার পর সে নির্জনকে কল দিল, রিসিভ করে সালাম দিল নির্জন। তরু মুচকি হেসে বললো, ‘আমি দাদা শ্বশুর না, আমি তোমার থাক বলছি না। কি করছো?’

– ‘আরে তরু, ফোন লুকিয়ে এনে কল দিলে না-কি। আর হাসছো যে? আমি এদিকে চিন্তায় শেষ।’

– ‘কীসের চিন্তা জনাব? তোমার কি মনে হয় অন্য কাউকে আমি বিয়ে করবো? মরে গেলেও না। প্লিজ শান্ত থাকো, ওকে? আমি এখন ঢাকায়ই আছি।’

– ‘মানে! কোথায়?’

– ‘ঢাকায় এসেছি মানেই পালিয়ে বিয়ে করবো তা না। এসেছি পরিকল্পনা আছে। দেখি।’

– ‘কি পরিকল্পনা। কোথায় আছো বলো তো। আসি আমি।’

– ‘চুপ থাকো, রাখছি। আর শোনো, এই নাম্বারে শখানেক টাকা পাঠাও। প্রচুর কল আছে। আর রাখছি।’

– ‘তা পাঠাচ্ছি, কিন্তু কোথায় আছো, ঠিক আছো কি-না কিছু তো বলো।’

– ‘লাগবে না, তোমাকে কল দিয়ে এটুকু বলেছি যাতে নিশ্চিন্তে থাকো এজন্য। রাখলাম।’

তরু কল রেখে দিল। খানিক পরে এসে টাকা ঢুকলো ফোনে। বাড়ি থেকে অসংখ্য কল এসেছে। একবারও রিসিভ করেনি সে। প্রথমেই সে কল দিল মা’কে। তিনি রিসিভ করলেন সঙ্গে সঙ্গেই।

– ‘হ্যালো আম্মা।’

– ‘তরু তুই কোথায়? তোর দাদার মোবাইল নিয়ে কোথায় গিয়েছিস?’

– ‘আমি কোথায় গুরুত্বপূর্ণ না৷ কিন্তু বাস্তব হলো বাড়িতে নাই। এখন চাইলেই আমি নির্জনের কাছে চলে যেতে পারি। ইশহাক সাহেব কাজি ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেবেন।’

– ‘কি যা-তা বলছিস? এমন করলে তোর বাপের কি হবে জানিস? মরে যাবে সে। কোথায় আছিস বল। বাসায় আয়।’

– ‘তোমাদের কথা ভেবেই সুন্দরভাবে বিয়ে ভাঙতে চেয়েছিলাম। নির্জনকে আমিই বলেছিলাম আফতাব স্যারকে রিলেশনের কথা বলে দাও। কিন্তু সে কি করছে? উলটো ঝামেলা লাগিয়ে দিয়েছে। আচ্ছা, আমাকে তুমি বলো আমার দোষ কি? ফুপু যে কাজ করেছে, আমি তো নানাবাড়ি তোমাকে নিজেই জানিয়েছিলাম। চেষ্টা করছিলাম কীভাবে ফেরানো যায়। ফুপুর বিয়ে যখন হয় আমি মনে মনে পছন্দ করিনি। তোমাদের কোনোকিছুতে আমি নাই। তাহলে আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দাও, যখন তখন ফোন কেড়ে নাও। এখন আবার জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ, সমস্যা কি? তোমরা এরকম হলে আমি কেন তোমাদের কথা চিন্তা করবো? জবাব দাও।’

– ‘তাই বলে তুই আমাদের মুখে চুনকালি মাখিয়ে পালিয়ে যাবি?’

– ‘আমি পালিয়ে যাইনি এখনও। কিন্তু যাব। তোমরা আফতাব স্যারকে না করে দাও। এরপর ইশহাক সাহেবকে কল দিয়ে বাড়িতে ডাকো। বিয়ে ঠিক করো নির্জনের সঙ্গে। আমি একেবারে বিয়ের দিন বাড়িতে আসবো।’

– ‘তুই কি বলছিস এসব তরু?’

– ‘খারাপ কিছু বলিনি। নির্জনের কাছে বিয়ে দিলে তোমাদের সমস্যা কি? সে কি করছে তোমাদের?’

– ‘আফতাবকে বিয়ে করলে তোর সমস্যা কি? ও শিক্ষিত ছেলে, দেখতে মাশাল্লাহ।’

– ‘বিয়েটা আমি করবো। তাই যাকে ভালো লাগবে তাকে। নির্জনের কোনো কমতি থাকলে বলো। সেও শিক্ষিত, দেখতে-শুনতে ভালো। এখন বাবার বিজনেসেও সময় দেয়। আর আফতাব স্যার ভালো হলো কীভাবে? আমি আরেকজনকে পছন্দ করি জেনেও বিয়ে করতে চাইল কেন?’

– ‘তোর বাপ-দাদাকে বুঝা আমি এসব জানি না।’

– ‘আমার বাপ-দাদা কাউকে আর বুঝানোর ইচ্ছা নাই। তোমরা অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর। ফুপু এতকিছু করার পরও ওরা সুন্দরভাবে ছেড়ে দিল। নির্জন তন্ময়কে বিয়ে করার জন্য রাজি করিয়েছে। টাকা দিয়েছে৷ এখন আবার ওরা গ্রহণ করেনি বলে তোমরা ইশহাক সাহেব কল দেয়ার পরও রাজি না। উনি কীভাবে ছেলের জন্য ব্যক্তিগত ক্ষোভ ভুলে বিয়েতে রাজি হলেন? আমাকে এটা বলো। ইশহাক সাহেব রাজি না হলেও উলটো মানা যেত। কারণ আমাদের পরিবারেরই একটি মেয়ের থেকে উনি তিক্ত অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। আমি কল রাখছি আম্মা। তোমাদের প্রতি আমার এখন ঘেন্না লেগে গেছে। তাই পালিয়ে যেতে দ্বিতীয়বার ভাববো না। এখন চব্বিশ ঘণ্টার জন্য একটা সুযোগ দিচ্ছি। ইশহাক সাহেবকে কল দিয়ে সম্মান দিয়ে বাড়িতে ডাকো। আমাকে সম্মানের সঙ্গে বিয়ে দাও। না হলে পালিয়ে যেতে আমি বাধ্য, নির্জনকে ছাড়া কাউকে আমি বিয়ে করবো না।’

– ‘তরু তুই বাড়িতে আয়, পরে..।’

কল কেটে দিল তরু।

*

সকাল থেকে রান্না-বান্না কিছুই হয়নি। দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল। নাহেরা বেগম সোফায় বসে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদছেন। আসলাম সাহেব শার্ট খুলে আলনায় রেখে বললেন, ‘কান্না বন্ধ কর, গিয়ে রান্নাবান্না কর। কোথায় গেছে গিয়ে মরে যাক। সব জায়গায় কল দিছি কারও বাসায় নাই।’

– ‘মরে যাক না? মরে গেলে শান্তি পাই তুমি? ও যা করছে ঠিক করছে। তোমাদেরই সব দোষ।’

– ‘তোর মেয়ে খুব ভালো। পড়তে দিছিলাম গিয়ে পিরিত করছে।’

– ‘তাই বলে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে? আর প্রেম কি কোনো রাস্তার ছেলের সাথে করছে? তোমার বোন সংসার করতে পারেনি ওর নিজের দোষে। আমার মেয়ে কেন এসবের জন্য শাস্তি পাবে?’

– ‘চিল্লাচিল্লি বন্ধ কর। এমন মেয়ের জন্য আমার এত দরদ নাই।’

– ‘আমিও চলে যাব এ বাডি থেকে। অনেক করেছি। আর না। তোমার বোনের নিজের দোষে সংসার করতে পারেনি। তার শাস্তি কেন আমার মেয়ে পাবে?’

আরিফুল সাহেব এসে ধমক দিয়ে দু’জনকে বন্ধ করে বললেন, ‘আসলাম এখন কি করবি। তোর মেয়ে তো আর কলই ধরছে না। বাড়িতেও নেই। সত্যিই তো বিয়ে করে নিবে।’

– ‘ইশহাককে বলো আমার মেয়েকে যেন তার ছেলে বিয়ে না করে। বাসায় ফিরিয়ে দিক।’

– ‘পাগল হয়েছিস না-কি। ছেলে-মেয়ে মিলে বিয়ে করে নিলে কি করবি আর?’

নাহেরা বেগম বললেন, ‘ও পাগলই তো। পাগল না হলে এমন করে কেউ? মেয়ে যে পালিয়ে না গিয়ে দয়া দেখিয়ে এখনও আছে এটাই তো আসল।’

‘আমার এই মেয়েকে নিয়ে কোনো চিন্তা নাই, তোমরা যা ইচ্ছা করো’ বলে আসলাম সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

আরিফুল সাহেব নাহেরাকে বললেন, ‘আফতাবের মা’কে তুমি না করে দাও বউমা। আমি ইশহাককে কল দেই না-কি?’

নাহেরা বেগম চোখের পানি মুছে বললেন, ‘আচ্ছা।’

আরিফুল সাহেব দীর্ঘ সময় ইশহাক সাহেবের সঙ্গে কলে কথা বললেন। ফোন রাখার পর নাহেরাকে বললেন, ‘কিন্তু তরু বাড়িতে না এলে এরা কি শুধু আমাদের সঙ্গে কথা বলবে?’

– ‘ও তো কল ধরে না। আর বিয়ের সবকিছু ঠিক না হলে আসবে না। কাউকে বিশ্বাস করে না।’

– ‘তাহলে ওদের কি বলবে?’

– ‘ওরা আসুক। বলবো তরু ওর নানাবাড়ি। এগুলো সমস্যা হবে না।’

আরিফুল সাহেব মাথা নাড়লেন।

*

পাঁচটার দিকে নির্জন তরুকে কল দিল। তরু রিসিভ করেছে। নির্জন বিস্ময় নিয়ে বললো, ‘তুমি না ঢাকায়? কিন্তু আব্বু বললেন তোমার ফ্যামিলি রাজি হয়ে গেছে। মানে আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তরু। কীভাবে সম্ভব! তুমি কোথায় এখন…।’

তরু তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘একটু দম নাও, দম আঁটকে কোনো অঘটন ঘটে গেলে আমার কি হবে?’

– ‘তুমি এত শান্তভাবে কথা বলছো কীভাবে? আমাদের ফাইনালি বিয়ে হবে। বুঝতে পারছো? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। তুমি কোথায় বলো আসি আমি।’

– ‘তোমার আনন্দটা সামনাসামনি দেখলে ভালোই লাগতো। কিন্তু বিয়ের আগে কোনো দেখাদেখি করছি না, রাখলাম।’

তরু কল কেটে দিল। বারান্দায় বসে আছে সে। খোলা আকাশ। চোখ ছলছল করছে। নির্জন আজ বিশ্বাস করতে না পারলেও সে পারছে। এই মানুষটিকে ছাড়া কাউকে সে বিয়ে করবে ভাবতেই পারে না। রাতে কেয়া বাসায় ফিরলো। বাইরে থেকে তরুর জন্য আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। তরু সেটা সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে খেতে শুরু করলো। কেয়া হাত-মুখ ধুয়ে আসার পর বললো, ‘বাড়ি থেকে কল দিয়েছি একবার। জিজ্ঞেস করেছিল তুই আমার এখানে কি-না। না করেছি। কিন্তু এবার বল তোর মতলব কি? চাইলে তো নির্জনের কাছে চলে যেতে পারতি।’

– ‘তোমার এখানে এমনিই বেড়াতে এলাম।’

– ‘আচ্ছা আমি এখন তোর মা’কে বুঝিয়ে কল দেই। আমার যেখানে প্রব্লেম নেই তাদের বিয়ে দিতে কীসের অসুবিধা?’

তরু আইসক্রিম খেতে খেতে বললো, ‘লাগবে না কল দেয়া। ওরা বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে।’

– ‘বলিস কি! কীভাবে?’

– ‘এইতো এখানে এসে কল দিয়ে বললাম বিয়ে না দিলে পালিয়ে যাব।’

– ‘তোর কি বুদ্ধি, নির্জনকে বলেছিস?’

– ‘তোমার এখানে আছি বলিনি। তবে বুঝে গেছে হয়তো।’

– ‘তাহলে যদি চলে আসে?’

– ‘আসবে না, আমি জায়গার নাম বলিনি মানে চাই না আসুক, তাই আসবে না।’

– ‘বাবা এত বুঝাপড়া।’

তরু মুচকি হাসলো।

*

দুই পরিবার মিলে আগামী শুক্রবার তাদের বিয়ে দিন ঠিক হয়ে গেল। নির্জন আর তরুর এই কয়দিন শুধু ফোনে কথা হয়েছে। দেখা করলো না কেউই। বিয়ের সকল বন্দোবস্ত হয়ে গেছে দেখে তরু কেয়াকে নিয়ে বাড়িতে গেল বুধবার। নাহেরা বেগম মেয়েকে পেয়ে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। আসলাম সাহেব কিছুই বললেন না। শুক্রবারে খানপুর কমিউনিটি সেন্টারে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। কনেকে বিদায় করে দিল সবাই। তরু শেষ বেলায় কাঁদলো ভীষণ। ইশহাক সাহেব আর আছমা চৌধুরী বুঝিয়ে গাড়িতে তুললেন তাকে। তরুর সঙ্গে নুসরাত আর ওর ছোটবোন গেল। ইশহাক সাহেবও গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। তারপর গ্লাস নামিয়ে হাত নেড়ে কনেপক্ষকে বিদায় জানানোর সময় দেখলেন কেয়া সবার পেছনে দাঁড়িয়ে এক হাত বুকে বেঁধে অন্য হাতে ওড়না দিয়ে মুখ ডেকে কাঁদছে। অদ্ভুত! ওর এরকম কান্নার কি আছে তিনি ভেবে পেলেন না। গাড়ি চলতে শুরু করলো। কিন্তু পুরো রাস্তা ইশহাক সাহেবের মন খারাপ হয়ে রইল।

*

রাত এগারোটার দিকে নির্জন বাসর ঘরে এলো৷ তাদের আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি ভর্তি। তরুকে আসার পর থেকেই সবাই ঘিরে রেখেছে। এখন রুমে এসে শুধু নুসরাতকে পেল। সে উঠে চলে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু তরু মাথা নুইয়ে থাকলেও এক হাতে ওকে ধরে বসে আছে। নুসরাত ফিসফিস করে বললো, ‘জামাই তোর, বাসর ঘর তোর, আমি এখানে কি করবো, ছাড়।’

তরু হাত ছেড়ে দেয়। নুসরাত উঠে যাওয়ার আগে নির্জনের দিকে তাকায়। নির্জন কি বলবে বুঝতে পারছে না। ইতস্তত করে বললো, ‘বসো, সমস্যা কি?’

– ‘কিন্তু তরু থাকতে বলছে থাকবো?’

– ‘ও তাহলে থাকো না হয়।’

– ‘আপনি অন্য রুমে থাকবেন?’

– ‘ও, তাহলে যাই অন্য রুমে।’

নুসরাত ফিক করে হেসে বললো, ‘আপনারা দু’জনই আজ এত নার্ভাস কেন বলুন তো? আমি গেলাম। শুভ রাত্রি। সুন্দর একটা রাত কাটুক।’

বলে সে চলে গেল। নির্জন এগিয়ে গেল। তরু বিছানা থেকে নেমে তাকে সালাম করলো। নির্জন ওর থুতনি ধরে মুখ তুলে তাকায়। তরুর মুখে লাজুক হাসি। তার বুকটা কেমন করে যেন উঠে। টেনে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তরুকে। দীর্ঘ সময় এভাবে ধরে তাকে। তরু ফিসফিস করে বললো, ‘শাডি সহ জড়িয়ে ধরেছো একটু অসুবিধা হচ্ছে।’

নির্জন ছেড়ে দিল তাকে। কপালে চুমু খেয়ে বললো, ‘খুলে নাও তাহলে।’

তরু ভ্রু-কুঁচকে ওর দিকে তাকায়। নির্জন শুধরে নিয়ে বললো, ‘আমি এত বিশ্রী রসিকতা করবো মনে হয়? চেঞ্জ করার কথাই বলতে চাইছি ম্যাডাম। আমি তো সেই কবে সব খুলে ফেলেছি।’

– ‘একটু বাইরে যান।’

‘আচ্ছা আমি বারান্দায় আছি’ বলে নির্জন চলে গেল। তরু খানিক পর বিয়ের ভারী পোশাক পালটে পাতলা শাড়ি পরে বারান্দায় আসে। নির্জন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তরু পিছু থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে পিঠে নাক-ঠোঁট চেপে ধরলো। নির্জন ওর হাত ধরে নিজেকে ছাড়িয়ে ঘুরে রেলিঙে হেলান দেয়৷ চাঁদের আলোয় তরুকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নীলের মতো একটি শাড়ি পরনে। দুইহাতে চুড়ি। বাঁ হাতের মাঝের আঙুলে তার ওই আংটি। তরু তার কাছে নিবিড় হয়ে এসে দাঁড়ায়। নির্জন বুঁদ হয়ে তাকিয়ে থাকে তরুর দিকে৷ কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তরুকে৷ গোলাপি ঠোঁটে কিছুই নেই, কপালেও নেই কোনো টিপ। তবুও অদ্ভুত এক মায়া লাগছে দেখতে। নির্জন হাত বাড়িয়ে ওর কপাল থেকে চুল সরিয়ে নিল। তারপর গালে হাত রেখে বললো, ‘জানো তোমার গাল দেখলে কি ইচ্ছা করে?’

– ‘কি?’

– ‘আপেলের মতো কামড় খেতে। অথচ জীবনে এই ইচ্ছা পূরণ হবে না।’

তরু মুখে হাত দিয়ে মাথা নুইয়ে ফিক করে হাসে। চুলগুলো আবার সামনে চলে আসে ওর। নির্জন ওর হাত ধরে এনে চুমু খায়। তারপর দুইহাতে তরুর মুখ ধরে তাকিয়ে থেকে বলে, ‘কামড় তো কোনোদিন দেয়া যাবে না। কিন্তু আরেকটা ইচ্ছা আছে। সেটা হলো তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা। এখনও তৃপ্তিমত সে সুযোগ হয়নি।’

তরুর সবকিছু কি যে ভালো লাগছে।নির্জন কথাটি বলে তার দিকে মুগ্ধ চোখে অপলক তাকিয়ে আছে। তরুরও ইচ্ছা করছে চোখ চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু তাকাতে গিয়ে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে সে। বারবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। নির্জন ওকে টেনে কাছে নিল। তারপর গালে চুমু খেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তরুকে। তরুও ওর বুকে মাথা রেখে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে নিজেও শক্ত করলো বাঁধন।
___সমাপ্ত___
লেখা: জবরুল ইসলাম

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে