ভালো লাগে ভালোবাসতে-পর্ব ১৬

2
2172

#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-১৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

মুখের একটি ছোট্ট কথাও যে মানুষকে মেরে ফেলতে পারে তা আমি আজ প্রথম বুঝতে পারলাম।নিদ্রর মুখে এই কথাটি শুনে আমি পুরো স্তম্ভিত হয়ে রইলাম।যেই মানুষটি আমার মুখে আলাদা হওয়ার কথা শুনে আমাকে খুন করে ফেলার কথা বলেছিল আজ সে নিজে আলাদা হতে চাইছে।আমার ঠিক এই মুহুর্তে কি বলা উচিত আমি জানি না।বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না।শুধু নির্বাক দৃষ্টি নিরব অশ্রু বর্ষণ করে যাচ্ছে।আমার ঘোর কাটলো নিদ্রর পেছন থেকে আসা ছিপছিপে গড়নের একটি সুন্দরী মেয়ের ডাকে।মেয়েটি প্রথমে নিদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ও এসে পড়েছে?’
তারপর আমার সামনে এসে একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,’হায়! আমি রাইশা,নিদ্রর ফিয়ান্সে।’

মেয়েটির মুখে ‘নিদ্রর ফিয়ান্সে’ কথাটি শুনে আমার মাথাটা ঘুরে উঠল।হাত পা যেনো অবশ হয়ে আসছে।একদৃষ্টিতে শুধু নিদ্রর দিকে তাকিয়ে রইলাম।অথচ তার কোনো ভাবান্তর নেই।আমার নিরব দৃষ্টি তাকে কত কথা বলে যাচ্ছে,সে কি তা শুনতে পাচ্ছে না? সে না আমাকে আমার থেকেও
বেশি বুঝতে পারে?তবে কি সাত মাসের দূরত্ব সব পাল্টিয়ে দিল….সব…!

সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরত আসতে আমি বাঁধ সাধলাম।সে তো আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ডিভোর্স করাতে,আমাদের সম্পর্কের ইতি টানতে,তবে আমি কেনো যাবো!বলে দিলাম মুখের উপর আমি ফেরত যাবো না।কিন্তু আমার বলা না বলায় কি!
সেই মুহুর্তেই এক প্রকার টেনেটুনে জোর করেই সে আমাকে ঢাকা নিয়ে আসলো।কষ্ট তো হলো সবথেকে বেশি তখন,যখন আমি গাড়িতে তার পাশে বসতে নেই আর সে আমাকে হাত দিয়ে বাঁধা দিয়ে পেছনে বসতে বলে।কারণ এখন আর তার পাশে আমার জায়গা নেই।এখন তো তার ফিয়ান্সে আছে।
কষ্টে জর্জড়িত মন নিয়ে আমি পেছনে বসে পড়লাম।সারা রাস্তায় গাড়ির ব্যাক মিররে তাকে দেখতে লাগলাম,কিন্তু সে একবারের জন্যও সেখানে দেখলো না।ঘন্টার পর ঘন্টা সময় গাড়িতে কাটিয়ে একসময় নিদ্রর বাড়ির সামনে এসে পৌঁছালাম।আজ সাত মাস পর এই বাড়িতে আবার আসলাম।সবকিছুই এক অথচ মনে হচ্ছে কোথায় যেনো কিছু বদলে গেছে।চিরচেনা স্থানে অচেনার ঘ্রাণ আসছে।এক ধরণের জড়তা আমাকে আঁকড়ে ধরল।কতদিন পর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করবো,কতদিন পর দেখবো আবার সেই প্রিয় মুখগুলো।কিন্তু প্রিয় মুখগুলোর সাথে সেখানে কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন,কিছু অসন্তুষ্ট ভরা অভিযোগ।কিভাবে মুখোমুখি হবো সেসবের।নিদ্রর পেছনে মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু হয়ে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলাম।আস্তে আস্তে মাথা তুলে দেখি সবাই শক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমার আব্বু আম্মুও সেখানে উপস্থিত।তাদের দেখে আমার চোখ ছলছল করে উঠলো।আব্বু ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।ছলছল চোখে অপরাধী দৃষ্টি নিয়ে অস্ফুট স্বরে আব্বু বলতেই ঠাস করে একটা চড় পড়লো আমার গালে।এই প্রথম আব্বু আমাকে চড় মারলো।গালে হাত দিয়ে আমি অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলাম।
আব্বু রাগ অশ্রু মিশ্রিত চোখে বলতে লাগলো,

-‘খুব বেশি বড় হয়ে গেছিস তাই না?এখন আর আমাদের কাউকে প্রয়োজন পড়ে না।একা একাই নিজে নিজে চলতে পারিস!’

আম্মু এসে আমার হাত শক্ত করে ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে বলতে লাগলো,
-‘কি করে পারলি সুপ্তি,আমাদেরকে এভাবে ছেড়ে চলে যেতে।আমাদের কথা তোর মাথায় একটুও আসলো না।তোকে না পেয়ে আমাদের অবস্থা কেমন হয়েছিলো জানিস!তোর যদি কিছু হয়েও থাকতো তাহলে আমরা কি সব মরে গিয়েছিলাম যে তোর চিকিৎসা করাতে পারতাম না।একবারো তখন ভেবে দেখেছিলি তোকে হারিয়ে আমাদের অবস্থা কেমন হবে!এত বড় কাজ তুই করলি কিভাবে?’
নিদ্রর বাবা মাও আমাকে একই কথা বললো।আমি শুধু নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম।
বলার মত যে কিছু নেই,আজ আমি সবার কাছেই অপরাধী।এই মানুষগুলোকে আমি হারানোর তীব্র কষ্ট দিয়েছি।
কিছুক্ষণ পরে সবাই একে একে আমার সামনে থেকে সরে গেল।আমি সোফায় বসে বসে এখনো নিরবে চোখের জল ফেলছি।পাশে তাকিয়ে দেখলাম একটু দূরে স্নিগ্ধ মুখ কাঁদো কাঁদো করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম,’তুইও কি আমার সাথে কথা বলবি না?’
-‘তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে ভাবু।তুমি জানো আমরা কত কষ্ট পেয়েছি।তোমার জন্য কত কান্না করেছি।আর ভাইয়া তো……

-‘স্নিগ্ধ!……..

পেছন থেকে নিদ্রর ধমক শুনে স্নিগ্ধ কথা অসম্পূর্ণ রেখেই দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে যায়।
নিদ্র একবার আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে শক্ত মুখে তাকিয়ে পেছনে ফিরে চলে যেতে উদ্যত হয়।কিন্তু আমি দৌঁড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পথরোধ করে তার একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলি,
-‘নিদ্র,আমাকে প্লিজ মাফ করে দিন।আমি এমন ভুল আর কক্ষনো করবো না।শুধু একবার বলুন আপনি আমাকে যা বলেছিলেন তা সব মিথ্যা।আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করছেন না,আমাদের ডিভোর্স হবে না।’

নিজের হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে তিনি বললেন,
-‘কেনো তুমি তো এটাই চেয়েছিলে তাই না! আমি আবার নতুন করে যেনো জীবন শুরু করতে পারি।এখন তো আমি সেটাই করছি।
নাউ ইউ মাস্ট সুড বি হ্যাপি।’

-‘নিদ্র আমাকে আপনার যেই শাস্তি দেওয়ার দিন।যতই কঠিন শাস্তি হোক আমি হাসি মুখে মেনে নিবো।কিন্তু এই বিয়ে আপনি করবেন না,প্লিজ করবেন না।আমি তো বাড়ি ছেড়ে এই কারণে গিয়েছিলাম যেনো….
আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই সে হঠাৎ রেগে আমাকে শক্ত করে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল,
-‘যেনো কি?যেনো আমি খুব ভালো থাকতে পারি!
আমাকে রেখেছো তো,খুব ভালো রেখেছো!
এখন আরেকটু ভালো করে দাও।এই বিয়েটা হবে,দু দিন পরই হবে।আর এই বিয়ের সাক্ষী হবে তুমি।তুমি তো আমার শুভাকাঙ্ক্ষী তাই না?আমার কত ভালো চাও তাই এতটুকু তো আমার জন্য করতেই পারো।’
কথাটি বলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে সে চলে গেল।আমি দৌঁড়ে গিয়ে আব্বু আম্মু আর নিদ্রর বাবা মার কাছে চলে গেলাম।আব্বুর হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বললাম,
-‘আব্বু উনি নাকি আবার বিয়ে করবেন?আব্বু তুমি একটু তাকে বলো না বিয়েটা না করতে।আমি তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।’

-‘কেনো এতদিন কিভাবে বেঁচে ছিলি?ছেলেটাকে তুই যেই কষ্ট দিয়েছিস তার জন্য তুই আর অন্য কোনো অজুহাতই দেখাতে পারিস না।নিদ্র এতকিছুর পর এবার নিজের ভালো থাকার একটি উপায় খুঁজে নিয়েছে,আমরা সবাই ওর সঙ্গে আছি।’

নিজের বাবা মাই যেখানে আমার সাথে নেই সেখানে আমার বলার কি থাকতে পারে।নিজেকে আজ একা লাগছে,বড্ড একা।এখন মনে হচ্ছে এর থেকে মরে গেলেই ভালো হতো।নিদ্রকে ছাড়া বেঁচে থেকেই বা কি হবে।সেই তো আমাদের আলাদা হতেই হচ্ছে।কেনো করছে ভাগ্য আমার সাথে এমন!
-‘সুপ্তি।’
পেছন থেকে সোমা আপুর গলা শুনে তাকিয়ে দেখলাম সোমা আপু আর সাফা এসে বাগানে দাঁড়িয়ে আছে।দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।তারাও আমাকে ধরে কাঁদলো।সাফা বললো,
-‘তুই এমন কেনো করলি সুপ্তি?সবাইকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কি মজা পেয়েছিস বলতো।তোর কোনো ধারণাও নেই সবাই কতটা চিন্তা করেছে যে তুই ঠিক আছিস কিনা!’
সোমা আপু বলল,
-‘সবার কথা বাদ দে।নিদ্র ভাইয়ার কি অবস্থা হয়েছিলো তুই জানিস?পাগল হয়ে গিয়েছিলো,পুরো পাগল!
তোকে কোথায় কোথায় না খুঁজেছে।তোকে খুঁজে না পেয়ে ভাইয়া কেমন ছটফট করেছে।সারাদিন ছোটাছুটি করতো।পুলিশের কাছে রিপোর্টও করে।এক পুলিশ অফিসার একবার বলে দিয়েছিলো যে হয়তো তুই কোনো অ্যাক্সিডেন্টে মারা যেয়ে বেওয়ারিশ হয়ে গেছিস।এই কথায় নিদ্র ভাইয়া সেই পুলিশ অফিসারের কলার ধরে তাকে মারতে যায় সবাই জোর করে ঠেকিয়ে রাখে।সারাদিন তোকে খুঁজে বেরিয়ে না পেয়ে গভীর রাতে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতো।এসব আমাকে রাফি বলেছে।ছোটো থেকে ওরা বন্ধু,নিদ্র ভাইয়া খুব শক্ত ছেলে বলেই ওরা জানে।কখনো এভাবে কাঁদতে দেখেনি।প্রথমে তো কোনো ধারণাও ছিলো না তুই এমন কেনো করলি।সেদিন তোর উদ্ভট আচরণ আর তার পর গায়েব হয়ে যাওয়া সব কিছু সবাইকে চরম বিভ্রান্তে ফেলে দেয়।তারপর আমরা নিদ্র ভাইয়াকে বলি তুই সেদিন তাকে তোর ভালোবাসার কথাই বলতে চেয়েছিলি।তারপর নিদ্র ভাইয়ার এড্রেসে তোর ডক্টরের সেই রিপোর্ট আর সেই চিঠি আসে।তারপরই সবকিছু সবার কাছে ক্লিয়ার হয়ে যায়।
এটা জানার পর থেকেই সে তোর উপর অনেক রেগে যায়।তুই নিদ্র ভাইয়াকে অনেক কষ্ট দিয়েছিস,এত সহজে সে তোকে মাফ করবে না।’

সাফা বলল,
-‘আর সুপ্তি,এটা কেমন কথা!তোর যদি সেই রোগ সত্যিই হয়ে থাকতো তাহলেই তুই এভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবি!কোনো চেষ্টা না করেই?কখনো ভেবে দেখেছিস আল্লাহ না চাক এগুলো যদি সত্যি হতো তাহলে নিদ্র ভাইয়া নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতো কি না।কোনো পরিস্থিতিতেই কখনো এভাবে হাল ছেড়ে দিতে হয় না।’

আমি চোখের পানি মুছে বললাম,
-‘আমি মানছি আমি ভুল করেছি।তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।এখন সে এটা কেনো করছে,অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইছে।আমি সত্যি এটা মানতে পারবো না।’

সোমা আপু বললো,
-‘নিদ্র ভাইয়াকে তো তুই চিনিস,সে একটা একবার ঠিক করে ফেললে আর পিছু হটে না।’

-‘সুপ্তি তুমি এখানে শুয়ে পড়লে কেনো?’

-‘আপনিই তো বলেছিলেন আমার যেখানে ঘুমানোর ইচ্ছা আমি সেখানেই ঘুমাতে পারি।’
তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
-‘সেটা তো কাল বলেছিলাম।তাহলে গতকাল রাতে আমার পাশে শুয়ে ছিলে কেনো?’

-‘কারণ কাল রাতে আমি ভয় পেয়েছিলাম তাই।আজকে তো আর পাচ্ছি না।তাই এখন থেকে আমি সোফাতেই ঘুমাবো।’

-‘গতকাল যেমন ঘুমিয়েছো এখন থেকে সেভাবেই ঘুমাতে হবে।আমার পাশে ঘুমিয়ে আমার অভ্যাস করালে কেনো?এখন তো আমার একা একা আর ঘুম আসবে না।পাশে একজন কাউকে দরকার।এখন তুমি অভ্যাস করিয়েছো তাই তুমিই পূরণ করবে।’

কালো প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে কি অবলীলায় ব্যাপক মুডে তিনি কথাগুলো বললেন।আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম।মামা বাড়ির আবদার যেনো!যেনো তার সব ‘দরকার’কে
পূরণ করার এই বিশেষ উদ্দেশ্যেই আমার এই পৃথিবীতে জন্ম হয়েছে।হুহ!
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম,
পঁচিশ বছর একা ঘুমিয়েও আপনার অভ্যাস হয়নি আর এখন একরাতেই আপনার অভ্যাস হয়ে গেলো?’
তিনি মুচকি হেসে ঘাড় নারিয়ে সায় দিলেন।
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
-‘তাহলে আপনার এই অদ্ভুত অভ্যাসকে ডিপ ফ্রিজে প্যাকেট করে রেখে দিন।আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।আমি ঘুমোলাম।’

কথাটি বলে আমি চোখ বন্ধ করে হালকা পাশ ফিরলাম।হঠাৎ সে আমাকে কোলে তুলে নিল।আমি অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে রাখলাম।সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে একটি চোখ টিপ দিল।তারপর ধপ করে বিছানায় নিয়ে ছেড়ে দিল।আর নিজেও পাশে শুয়ে পড়লো।
আমি আড়মোড়ে আবার উঠতে গেলেই বলে উঠলো,
-‘খবরদার!আর এক বিন্দুও নড়াচড়া করবে না।নয়তো এবার কিন্তু দড়ি নিয়ে এসে বেঁধে রাখবো।’

এই বাড়িতে আমার দ্বিতীয় রাত্রির এই মিষ্টি ঘটনার কথা মনে পড়তেই অশ্রু চোখেও ঠোঁটের কোনাে একটা হাসি ফুটে উঠলো।আজ সাত মাস পর নিদ্রর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে এমন আরো ছোটোখাটো মিষ্টি স্মৃতি মাথায় ভেসে উঠতে লাগলো।রুমটা কি অগোছালো হয়ে আছে।
এমন গোছালো ছেলের রুম এভাবে হঠাৎ অগোছালো হয়ে উঠলো কিভাবে!
নিজে গিয়ে সব গুছিয়ে দিতে লাগলাম।সব গোছানো শেষে বিছানাটা গোছানোর জন্য হাত দিতেই নিদ্র এসে হাতে হেঁচকা টান দিয়ে বাঁধা দিল।রুক্ষ স্বরে বলল,
-‘কে বলেছে এসবে হাত দিতে।আমার জিনিস যেমন পড়ে আছে তেমনই থাকতে দাও।এখন গোছাতে এসেছো কেনো?ছেড়ে যাওয়ার সময় মনে ছিল না?’
-‘তবে সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ার আমাকে আর একটা সুযোগ দিন।’
নিদ্র আমার হাত ছেড়ে পিছনে ঘুরে বলল,
-‘এখান থেকে চলে যাও,এই রুমে আর আসবে না।এই রুমে এখন আর তোমার কোনো অধিকার নেই।’

নিদ্রর মুখের এই কথায় খুব কষ্ট পেলাম।বিকেলে যখন আব্বু আম্মু চলে যেতে নিল তখন অভিমান করে আমিও সাথে গাজীপুরে চলে আসলাম।কেনো থাকবো ঐ বাড়িতে?নিদ্র তো বলেই দিল তার রুমে আমার আর কোনো অধিকার নেই।যদি তার রুমেই না যেতে পারি তবে সেই বাড়িতেই থেকে কি লাভ!
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামাতেই দেখতে পেলাম আমাদের তিনতলা বিশিষ্ট গোটা বাড়িতে সাজগোজ চলছে।মনে হচ্ছে কোনো বিয়ে হতে যাচ্ছে।গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে আম্মুকে প্রশ্ন করলাম,’এসব কি?’
আমার প্রশ্নের জবাব দিল আব্বু।বলল,
-‘নিদ্রর বিয়ে এখানে হবে।আমার মেয়েই যেহেতু ওঁকে এত কষ্ট দিয়েছে তাই ওর বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব আমি নিয়েছি।আশা করি তুমি বুঝে গেছো।’
আব্বুর কথা শেষ হতে না হতেই পেছনে দু তিনটে গাড়ি এসে থামলো।গাড়ি থেকে নিদ্র বাবা মা সব বন্ধুরা নামলো আর সবার পেছনের গাড়ি থেকে নিদ্র আর রাইশা নামের মেয়েটি নামলো।তাদের দুজনকে একসাথে দেখে খুব ব্যাথা লাগলো বুকে।নিচের ঠোঁট কামড়ে অভিমান চোখে আব্বুর দিকে একবার তাকিয়ে আমি একছুটে দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।দরজা বন্ধ করে খুব কাঁদতে লাগলাম।প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে আব্বু আম্মুর উপর।কেউ আমার আপন না,কেউ না।সবাই পর।এতবড় শাস্তি আব্বু নিজের মেয়েকে দিতে পারলো!কোনো বাড়িতেই আমার একটু ঠাঁই নেই।এখানেও নিদ্রর বিয়ে!
আমি মরে যাবো তবুও পারবো না তাকে চোখের সামনে অন্য কারোর হতে দেখতে।সবাই যেনো আমাকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার খেলায় মেতে উঠেছে।

পুরো রুম জুড়ে কালো নিকষ অন্ধকার।রাতের গভীরতার সাথে সাথে যেন রুমের অন্ধকারও গভীর হচ্ছে।ঠিক আমার জীবনের মতো।বাইরে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।মাঝে মাঝে আকাশ মৃদু গর্জে উঠছে।আবারো কি অদিনে বৃষ্টি নামবে।
বারান্দার দরজা খুলে বাইরে এলাম।খোলা বারান্দার কার্ণিশ ছুঁয়ে বাতাস মৃদু শো শো শব্দ করে আমার সামনের চুল উড়িয়ে দিচ্ছে।বারান্দার রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে বসে বাইরের আকাশ দেখতে লাগলাম।পুরো আকাশ ধীরে ধীরে মেঘের চাদরে ঢেকে যাচ্ছে।বাইরে টাঙানো নিদ্রর বিয়ের মরিচ বাতিতে অন্ধকারটা আবছা হয়ে আছে।
আমাদের এই তিনতলা বিশিষ্ট বাড়ির নিচের দুতলায় আমরা থাকি।আর উপরের তলা ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়।তবে এখন কোনো ভাড়াটিয়া না থাকায় উপরের তলা খালিই পড়ে আছে।সেখানেই নিদ্রদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে।আমার রুমটি দোতলায়।এই যে আমার সরাসরি মাথার উপরের ছাঁদটির উপরেই নিদ্রর রুম।সেখানে নিদ্র আছে।মাত্র এক ছাদের ব্যবধান তবুও কি দূরত্ব!
আমাদের এখনকার সম্পর্কের মত।উদাসী মনে উদাসী আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আনমনে গেয়ে উঠলাম,
মেরে দেহলীজ ছে হোক্যার
বাহারে যাব্ গুজারতী হে…
ইহা কেয়্যা ধূব কেয়্যা সাবান
হাওআয়ে ভি বারাসতে হে….

♪♪হামে..পুছো…কেয়্যা..হোতা..হে
বিনা দিলকে যিঁয়ে যানা……

হঠাৎ উপর থেকে ভেসে আসা গিটারের সুরে নিদ্রর আবেগী কষ্ট ভরা সুরে গেয়ে উঠা শেষোক্ত দু লাইনটি শুনে আমি চমকে উঠলাম।নিদ্র গাইতে লাগলো,
বহোত আয়ী গ্যায়ী ইয়াদে
মাগার ইছবার তুম হী আনা….

গানটির বেদনাদায়ক সুর গুলো অনবরত গিটারে তুলে নিদ্র যেনো নিজের কষ্টকেই ফুটিয়ে তুলছে।তার এই বেদনার সুর আমার কষ্টকেও দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলছে।বুকের বা পাশে খুব তীক্ষ্ণ ব্যাথা হচ্ছে,খুব।তার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত যেনো মনে এসে আমাকে ছুড়ি ঘাত করে যাচ্ছে।আকাশও যেনো প্রবল রেগে বারবার গর্জে উঠছে। বুকে হাত দিয়ে আমি শুধু বসে বসে নির্ঝরে নিরব চিৎকারে কাঁদতে লাগলাম।

♪♪মারজাভান…আ…আ….মারজাভান…♪♪

নিদ্রর গিটারের বেদনা ভরা সুরে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে চারিপাশকেও যেনো ব্যাথিত করে তুললো।সেই ব্যাথার আঘাতেই যেনো ঝরঝর করে তুমুল বেগে আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরতে লাগলো।আমি কষ্ট মিশ্রিত অশ্রু চোখে সেই জলধারার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম।কেনো যেনো মনে হল এই বৃষ্টি মাথার উপর বাইরে বাড়িয়ে দেওয়া নিদ্রর প্রসারিত হাতকে ছুঁয়ে আমার সম্মুখে ঝরছে।আমিও হাতটা বাড়িয়ে দিলাম সেই উন্মুক্ত জলধারায়।হয়তো পেলেও পেতে পারি এই গগন বর্ষিত ধারার সঙ্গতে সেই প্রিয় হাতের অস্পৃশ্য স্পর্শ।

চলবে,,

2 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে