ফানাহ্ পর্ব-৫৭

1
1453

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫৭
#হুমাইরা_হাসান
| প্রথমাংশ |
_____________

– তোকে একটা কথা বলা হয়নি

– কী কথা?

মোহরের ভাঙা ভাঙা গলার স্বরটা ভীষণ ক্লান্ত শোনালো। মুখের দিকে চাইতেও বুকটা মুচড়ে উঠছে মিথিলার। এতবড় একটা সত্য উন্মোচনে ওর যতটা না কষ্ট হয়নি তার চেয়ে শতগুণ হচ্ছে বোনের বিধ্বস্ত অবস্থাটায়। বুকভর্তি শ্বাস টেনে ধীমি গলায় বলল,

– এর আগে দুই তিনবার আমার বাড়িতে তল্লাশি করিয়েছে। ইফাজকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যখন ছিলাম ফিরে এসে দেখি বাড়ি ঘরের যা তা অবস্থা, এক একটা জিনিস উলটে পালটে রেখেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো চোর চোট্টা কিন্তু ঘরে আমার যে গয়না কয়েক হাজার ক্যাশ টাকা ছিলো তার একটাও এদিক ওদিক হয়নি। খুব অবাক হয়েছিলাম যে চোর এসে সারা বাড়ি লণ্ডভণ্ড করলো অথচ একটা টাকার নোট ও সরালো না! পরে অবশ্য ও নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি৷ তার প্রায় মাস খানেক পর রাতে হুট করে দরজা ধাক্কানোর শব্দে তোর ভাইয়া গিয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে কতগুলো মানুষ ঢুকে পড়লো। চেহারা বেশ ভূষায় চোর মনে হয়নি, তবে মুখ নাক সব ঢাকা ছিলো গামছায়। এসেই রি’ভলবার বের করে বলছিলো ‘ বাঁচতে চাস তো পেনড্রাইভটা দিয়ে দে ’ কোন পেনড্রাইভের কথা বলছে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি আমরা। হাজার বার করে বললেও ওরা মানতে চাইনি।সারা বাড়ি ঘর উলট পালট করেও যখন ওদের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেলোনা তখন কিছু না বলেই চলে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে যদি কোনো ভাবে পুলিশে এসব ব্যাপার জিডি বা ইনফর্ম করতে যাই তাহলে জানে মে’রে ফেলবে। ইফাজ তবুও থানায় যেতে চেয়েছিল আমিই দেইনি। তুই তো জানিস আমি এসব ব্যাপারে কত ভয় পাই। যা হওয়ার হয়েছে আমাদের তো ক্ষতি হয়নি তাই আর ওকে আমি যেতে দেইনি। কী দরকার যেয়ে চেয়ে বিপদ ডাকার। আর তোর শ্বশুরবাড়িতেও তখন ওই শ্রীতমার সাথে তাথইয়ের বরের সম্পর্ক নিয়ে ঝামেলা চলছিল। এমনিতেই তোর উপর চাপ ছিল তাই আর আমি এসব বলে তোকে চিন্তায় ফেলতে চাইনি, যা হওয়ার হয়েই তো গেছে আমরা ভালো আছি এই ভেবেই ওসব মন থেকে সরিয়ে ফেলেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি ওরা কিসের পেনড্রাইভের কথা বলছিল।

মোহর বিস্মিত হলো না নাইবা হলো হতবাক। যেন সবকিছু সয়ে গেছে ওর, চুপচাপ বসে রইলো। তামাটে বর্ণের মুখটা বেজায় রকম ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে যেন রক্তহীন একটা শরীর, বুকটা কেঁপে উঠলো মিথিলার। এইতো দিন দুয়েক আগেও এসেছিল মোহর, তখন চেহারা জুড়ে ছিল মোহনীয়তা, ঔজ্জ্বল্য আর স্নিগ্ধতার প্রলেপ একদিনের ব্যবধানে এ কী অবস্থা হলো মোহরের!

– তোর কোনো ভুল হচ্ছে না তো পুতুল? একটু ভালো করে ভাব না, মেহরাজ ভীষণ ভালোবাসেন তোকে। সে এরকম…

– বুবু, ওই নামটা নিস না আর প্লিজ! সবটা নিজের চোখেই তো দেখলি! বাবার মুখের কথা আর আমার নিজ চোখে দেখা কী ভুল? তবুও, তবুও আমি চেয়েছিলাম সবটা ভুল হয়ে যাক শুধু রুদ্ধ নামটাই সত্য থাকুক। কিন্তু কী হলো! সে তো নিজের মুখে সবটা স্বীকার করে নিলো। আমি যখন চলে আসছিলাম বারবার চেয়েছি, বাড়ির চৌহদ্দি পার হওয়ার আগ পর্যন্ত চেয়েছি রুদ্ধ আসুক, আমার হাতটা ধরে বলুক, এসব মিথ্যে শুধু সে আর তার ভালোবাসাই সত্য। অথচ হলো কী! আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে নিঃশব্দে সে বুঝিয়ে দিলো ভুল ছিলাম আমি, মিথ্যে ছিল সবই, নিষ্ঠুর আমার নিয়তি।

মোহরের হাতের উপর রাখা হাতটা কেঁপে উঠলো মিথিলার। মোহরের যান্ত্রিক গলায় বলা কথাগুলোর মধ্যে কতটা যন্ত্রণা, কতটা বিধ্বংসী চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থা চেপে আছে তার ন্যূনতম আন্দাজটাও কি ও করতে পারলো! কী করে সইছে মেয়েটা! মিথিলার দুষ্কর ভাবনার মাঝেই মোহর উঠে দাঁড়াল, ঘরের দিকে এগোতে নিলে পেছল থেকে বলল মিথিলা,

– কোথায় যাচ্ছিস?

– হসপিটাল যেতে হবে।

– তোর শরীর টা তো ভালো নেই। একটু রেস্ট..

– শরীর নাহয় রেস্ট করে ভালো করা যাবে কিন্তু জীবনটা!

মিথিলার মুখটা চুপষে গেলো। এ প্রশ্নের উত্তর ওর জানা নেই। মোহর স্মিত হাসলো, দীর্ঘ পলক ফেলে বলল,

– অরণ্যে রোদন না করি।

বলে ঘরের দিকে গেলো। মিনিট কয়েক বাদেই বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলে মিথিলা বলল,

– কী করতে চাচ্ছিস তুই?

মোহর চুলগুলো হাত খোপা করে নিয়ে ওড়না জড়িয়ে নিলো মাথায়। মিথিলার দিকে তাকিয়ে বলল,

– জানি না, সত্যিই জানি না আমি কী করবো।

মিথিলা রয়েসয়ে ঢোক গিলল বার দুয়েক। ঝুমু কে কোল থেকে নামিয়ে সোফাতে বসিয়ে ফের এগিয়ে এলো মোহরের কাছে, ওর হাতটা ধরে বলল,

– বাবার প্রাণটা যে এই করতেই গেছে তা তো জানিসই। মাও নেই। শুধু আছি আমি তুই আর এই দুজনের ছোট্ট একটা পরিবার। ওরা বাবার মতো পুলিশ অফিসার কে মা’রতে পারলে আমরা কিছুই না।

মোহর শুরুতেই বুঝলো বুবুর কথার মর্মার্থ। তবুও মিথিলা নিজের কথার বিস্তর ব্যাখ্যা খাটিয়ে বলল,

– বাবার আগেও অনেকেই চেষ্টা করেছিলো ওদের মূল পর্যন্ত পৌঁছাতে, পারেনি তো। অনেক বড় বড় মানুষের হাত আছে এসবে সেখানে আমার তোর মতো মানুষ গুলোকে ওরা একহাতে গেলে দেবে। যা হারানোর সব তো হারিয়েই ফেলেছি যেটুকু আছে এও হারিয়ে ফেললে বাঁচবো কি নিয়ে রে পুতুল!

মোহর চোখ তুলে তাকালো বোনের অশ্রুভরা চোখের দিকে। পরিবার, আপনজন হারানোর আতঙ্কে মিথিলার দুঃশ্চিতার বেঁরিবাধ টার দৃঢ়তা খুব করে বুঝতে পারছে, মিথিলা সদা সর্বদাই মায়ের মতো সহজ সরল নরম মনের। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর ভয় পায়৷ আর মোহর পেয়েছে বাবার মতোই গাম্ভীর্য আর দৃঢ় মনোবল। তবুও আজ বুবুর মুখভরা আতঙ্কের বলিরেখা গুলো ওর বুকটাও কাঁপাচ্ছে। ভুল তো বলেনি মিথিলা! মোহর নাহয় সব হারানো নিঃস্ব, কিন্তু ওর বুবু তো নয়! ওর বুবুর একটা পরিবার আছে একমাত্র মেয়ে আর স্বামী নামক বহুমূল্য অলংকার আছে। যে হার হামেশা ওর সাথে ছিলো আছে, যাকে ছাড়া ওর বুবুর একটা বেলাও চলে না। মোহরের কোনো পদক্ষেপের জন্য যদি ওদের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়!
তবুও মুখভর্তি নির্বিকার চিত্তে তাকালো বাঁয়ের সোফাটাতে বসে ছোট শরীরের ভালোবাসার চেহারাটাকে। নিটোল শরীরে লাল টুকটুকে একটা ফ্রক পড়নে। ঝুমু দেখতে একদম ওর বাবার মতো হলেও গায়ের গৌড়বর্ণটা মেয়েছে হুবহু মায়ের ন্যায়। চোখ তুলে তাকালো দেওয়ালটার বুকে ঝুলিয়ে রাখা তিন তিনটা হাসি হাসি মুখের দিকে। এই ছোট্ট ঘর, গুটি কয়েক সদস্য আর আবহ সবটাই খুব যত্নপূর্ণ ভালোবাসায় গড়া। ওর বুবু আর ইফাজ ভাইয়ের একে অপরের পরিশ্রুতিতে অর্ধযুগের ভালোবাসার ফলন। এসবের একটা কোণ যদি ধষে পড়ে ওরা কেও ই তো সইতে পারবেনা!

কলিং বেলের ধাতব শব্দটা কানে বাজতেই নীরবতা ভঙ্গুর হলো। মিথিলা চোখের ইশারায় নিজে দেখছে বলে এগিয়ে দরজা খুলে দিলো।

– আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া । আসুন না, ভেতরে আসুন।

মিথিলার অতিব শ্রদ্ধাশীল আচরণে ভ্রুদ্বয় কুঁচকে নিলো মোহর। ইফাজ অনেক আগেই বেরিয়েছে তবে এই সকালে কে এলো! তৎক্ষনাৎ মোহরের কৌতূহলকে প্রশান্ত করে ঘরে ঢুকলো বিনয়ী হাসিমিশ্রিত একটা সুদর্শন মুখ।

– স্যার আপনি?

আগন্তুকের আগেই মিথিলা উত্তর করলো,

– আমি ডেকেছি।

বলে মোহরের অতীব জিজ্ঞাংসু চোখের প্রত্যুত্তরে মিথিলা নিজেই বলল,

– একা একা যাতায়াত করার কোনো প্রয়োজন নেই। আজ থেকে ফায়াজ ভাইয়ার সাথেই তুই যাবি। এ তল্লাটে এখন ভাইকে ছাড়া আর কাওকে পাচ্ছিনা ভরসাযোগ্য।

শেষোক্ত কথাটুকু বেশ গুরুগম্ভীর মুখাবয়বে বলল মিথিলা। ফায়াজ এখনো নিশ্চুপ। চশমার আড়ালের কৃষ্ণাভ চোখ দু’টো শুধু চেয়ে আছে মোহরের মুখের দিকে। তাতে যেনো হাজারো কৌতূহল, উদ্বিগ্নতা, তৎপরতার খেই ছুটেছে। মোহর কী বলবে ভেবে পায় না, বুবু এমন একটা কাজ করবে আগে জানলে কখনোই সম্মতি দিতো না।

– আর আগেও তো ফায়াজ ভাইয়ের সাথেই কতো আসা-যাওয়া করেছিস। এখন করতে তো অসুবিধে নেই?

– আগের আর এখনকার সময় এক নেই মিথিলা। এখন সময়, পরিস্থিতি, সম্পর্ক সবই পালটেছে।

তন্মধ্যে ফায়াজের বলা প্রথম বাক্যটা শুনে মোহর নিরুত্তর থাকলেও মিথিলা তীব্র প্রতিবাদী ভাবে বলল,

– পরিস্থিতি যেমনই থাকুক সম্পর্ক আর আপনজন তো বদলে যায় না। আপনি আমাদের জন্য আগে যা ছিলেন এখনো তাই ই আছেন ভাইয়া। হয়তো যোগাযোগ কমেছে বিশ্বস্ততা না। আর এখন আর সেই পরিস্থিতি ও নেই। মোহরের ওই বাড়িতে..

– বুবু!

কথার মাঝখানটাতেই মোহর তীব্র উৎকণ্ঠিত স্বরে চুপ করিয়ে দিলো মিথিলাকে, যেনো এ বিষয়ে ফায়াজকে জানাতে ভীষণ নারাজ। ফায়াজ প্রথমত মিথিলার এমন আকস্মিক তলবে যতটা না কৌতূহলী ছিলো এখানে এসে মোহরের মুখাবয়ব আর কথাবার্তা শুনে কেমন সন্দেহের সৃষ্টি হলো ওর মনে। বিব্রতবোধ নিয়েই বলল,

– আব্… কিছু হয়েছে কী? মানে খুব আপত্তি না থাকলে আমাকে বলা যায় না?

– কোনো আপত্তি নেই ভাইয়া। আমিই বলছি

বেশ শক্ত গলায় উত্তর করলো মিথিলা। মোহরের নাকচ ইশারাবার্তাকে উপেক্ষা করে সবটাই খুলে বলল ফায়াজকে। যদিও ফায়াজকে সবটা ভেঙেচূড়ে বলার প্রয়োজন হয়নি। কেননা ওর সম্পর্ক এ বাড়ির সাথে বহুদিন। মাহবুব শিকদারের নিখোঁজ হওয়া,মৃত্যু সবটাই জানা। আর তার চেয়েও বড় কথা মাহবুবের আকস্মিক মৃত্যুতে সন্দেহের তাড়নায় মোহর থানায় জিডি অ্যাপ্লিকেশন সবই করেছিল স্পেশাল তদন্তের জন্য। আর সেই সময়টাতে ফায়াজ একচেটিয়া সাহায্য করে গেছে নিঃস্বার্থভাবে। তাই পরের বিষয় টুকু ফায়াজের কাছে গোপন রাখার কোনো হেতু আছে বলে মিথিলার মনে হয় না।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা সেরে মোহর অগত্যা ফায়াজের সাথেই বের হলো। মিথিলা বেশ কড়াকড়ি ভাবে বলে দিয়েছে একা চলাফেরা না করতে। আর ফায়াজের কান অব্দি যখন এ খবর পৌঁছেছে ও আর একটুও একা ছাড়বে না।

•••

– পরশু’র আগের রাত। দশটার মধ্যে খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে সবাইকে নিজেদের স্থানে ঢুকিয়ে এগারোটার মধ্যেই সব যে যার জাগায় ফিরেছে। কয়েদিরা সব ঘুমানোর পর ঠিক রাত বারোটা বিশ মিনিটে পুরো পুলিশ স্টেশনের ইলেক্ট্রিসিটি কানেকশন কাট-অফ হয়েছে ঠিক দশ মিনিট পর রি-কানেক্ট হয়। আর নোমান ওই দশ মিনিটের মধ্যেই থানা থেকে পালিয়েছে।
রাতে ব্যাপারটাকে কেও আমলে না নিলেও সকালেই নোমানের মিসিং হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ইলেক্ট্রিসিটির এই ইনফরমেশন আমি কয়েদীদের থেকেই নিয়েছি। থানায় তখন নাইট গার্ড আর কয়েকজন হাবিলদার ছাড়া অফিসারেরা ছিলো না।

দীর্ঘ একটা ব্যাখ্যা দিয়ে ফাইলটা বন্ধ করে এগিয়ে রাখলো কাঁচের টেবলটার সামনে। মেহরাজ চোখ বন্ধ করেই বলল,

– ছিলো। ওখানে অফিসার নয়, অফিসারের বাপ ছিলো। সবার ঘুম আর সাজানো লোডশেডিং এর সুযোগ নিয়ে নোমান কে বের করেছে।

পৃথক পিঠ সোজা করে বসলো। ফাইলের দুই তিনটা কাগল উল্টে বলল,

– আমারও এমনটাই মনে হয়। তবে ডিউটিরত যতগুলো অফিসার ওই থানায় আছে আমি সকলের পারসোনাল ডেটা কালেক্ট করেছি ওই মুহূর্তে একজন অফিসার বিশেষ রিজনে লিভ নিয়ে শহরের বাহিরে ছিলো, আর যারা শহরে ছিলো তারা বাড়িতেই। আর তা প্রমাণ’সহ।

– এটাই প্লাস পয়েন্ট। সাপ ও মরলো লাঠিও ভাঙলো না। বুঝিস নাই ব্যাপার টা?

এতক্ষণে চোখ দুটি মেলে প্রসারিত নয়নে তাকালো মেহরাজ। অফিসের নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কেবনটাতে মুখোমুখি বসে দুজন। পৃথক মেহরাজের ছোট্ট লাইনটার বিস্তর ব্যখ্যা উপলব্ধি করে মনে মনেই অপ্রকটভাবে ছকটা মিলিয়ে বলল,

– তার মানে থানার বাইরের কেও করেছে। যার হাত অনেক লম্বা।

– শুধু লম্বা না, অনেক ফ্লেক্সিবল ও। এদিক ওদিক সবদিকেই ঘোরানো হয় ওই হাত।

.
.
.
চলমান

#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫৭
#হুমাইরা_হাসান
| পরিশিষ্টাংশ |
________________

– খুব তো বড়াই করে বলেছিলে মেহরাজ তোমার ওকে কখনো তোমার থেকে দূরে সরানো যাবে না, তো এখন কী হলো?

শুকনো মুখটার নির্লিপ্ত চাহনি মেলে তাকালো মোহর। একদম পাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে ওর কান বরাবর উচ্চতা সমান মেয়েটা। চোখে মুখে আজ ঔদ্ধত্য ঝিলিক দিচ্ছে, একটা অদ্ভুত প্রশান্তি পাচ্ছে যেন মেয়েটা মোহরকে এসব কথা শুনিয়ে। মোহর নিরুত্তর রইলো। মাথাটা বেজায় ঘোরাচ্ছে, তিয়াসার মুখটাও কেমন অস্পষ্ট দেখাচ্ছে ওর চোখে। তিয়াসাকে এড়িয়ে চলে আসতে চাইলো তবে তিয়াসা আজ ওকে ছাড়তে রাজি না মোটেও, যেনো এই সুযোগের অপেক্ষাতেই প্রহর গুনছিল এতদিন ঘাপটি মেরে।

– দাঁড়াও! এড়িয়ে যাচ্ছ কেনো? উত্তর নেই কাছে? থাকবেও বা কী করে। তুমি তো অকৃতজ্ঞ, নিষ্ঠুর তুমি। যে তোমাকে সবার থেকে বাঁচিয়ে, প্রটেক্ট করে রাখলো আমার মতো মেয়েকে উপেক্ষা করে তোমার মতো থার্ড ক্লাস একজনকে নিজের সবটা দিলো তার প্রতিদানে কী দিয়েছ? ছেড়ে এসেছ! বেশ হয়েছে, আমি জানতাম তোমার মতো মেয়ে আমার মেহরাজের যোগ্য না, আসলে কী জানো তো অন্যের ভালোবাসা ছিনিয়ে কেও সুখী হতে পারে না!

মোহরের পা দুটো থেমে গেলো। ওয়ার্ডের ভেতরে অনেক পেশেন্ট ছিলো। তিয়াসা নাহয় কথা শোনানোর তাগিদে লোকজন না মেনেই কথাগুলো তুলেছে কিন্তু এতগুলো অচেনা অজানা মানুষের সামনে ব্যাপার টা ভীষণ দৃষ্টিকটু বলেই মোহর বেরিয়ে এসেছে। তিয়াসার সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক দেখলো। ছিমছাম গড়নের যত্নের শরীর। চর্চা করে বডি, চেহারা সবটাই মেইনটেইন করা তা দেখেই বোঝা যায়। কী অদ্ভুত! এতো সুন্দর মেয়েটা রেখে মেহরাজ কী না ওকে বেছে নিলো! হয়তো কষ্ট দেওয়ার জন্যেই বেছে নিয়েছে।

মোহর দম ছেড়ে শান্ত গলায় বলল,

– ঠিকই বলেছেন। আমি অকৃতজ্ঞ, ভীষণ স্বার্থপর। তাই তো ওই দামী বাড়ি, গাড়ি বিলাসিতা ছেড়ে এসেছি। ঠিকই বলেছেন আমি আসলেই ওকে ভালোই বাসিনি তাই তো তার বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ হাতে থাকা সত্ত্বেও একটা বারও তার ব্যবহার করিনি। আমি আসলেই তার ভালোবাসার যোগ নই তাই তো দূরে চলে এসেছি।

মুহুর্ত কয়েক বিরতি নিয়ে আবারও বলল,

– কী জানেন তো, মানুষ সবসময় নিজের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অন্যকে খুব সহজেই বিচার করে ফেলে। তাকে বাড়াবাড়ি রকম, বা অযাচিত বলে ফেলে। এই যেমন আপনার মনে হয় আমি ইচ্ছে করে আপনার ভালোবাসা ছিনিয়ে নিয়েছি যেখানে আমার কোনো ভূমিকাই ছিলো না,আর সেটা আপনি নিজেও জানতেন। তবুও দোষারোপ করেন, করেন তো! আজকে আমি যেই জায়গা টাতে দাঁড়িয়ে আছি এখানে একটা বার নিজেকে কল্পনা করুন তো! আসলেই তো আমি থার্ড ক্লাস,আমার কোনো ক্লাস ই নেই। ক্লাস রাখতে হলে তো সম্বল থাকা দরকার। আমার নিজের মানুষ বলার ন্যূনতম জিনিসটাও নেই। তাহলে আমি তো শুধু থার্ড ক্লাসই না মিসকিন ও।

তিয়াসা প্রত্যুত্তর করলো না। চুপচাপ মোহরের কথাগুলো গলাধঃকরণ করছে। আজ মোহরের কথার সুর ভিন্ন, চোখের চাহনি ভিন্ন। মোহর বলতে থাকলো,

– কখনো চোখের সামনে নিজের বাবার অর্ধ পচা গলা লা’শ দেখেছেন? দেখেননি তো, নিষ্ঠুরতা কী করে বুঝবেন। চোখের সামনে নিজের মা কে তিলে তিলে ম’রতে দেখেছেন? দেখেননি তো, যেই মায়ের জন্য নিজের সবটা বিলিয়ে দেওয়া হয় তারই মৃত্যুর দায়ভার নিজের ঘাড়ে নিতে হয়েছে কখনো? জীবনের সমস্ত সংগ্রাম, ঝড় ঝাপটায় সটান দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে যখন হেলান দেওয়ার জন্য একটা অবলম্বন পেয়ে যখন একটু একটু করে মাথা তোলা হয় হুট করেই একদিন নিচে তাকিয়ে দেখলেন যাকে অবলম্বন ভেবে দাঁড়িয়ে আছেন সেই আপমার শেকড় ফুড়ে বেরিয়েছে, আপনার গোড়াতে পচন ধরিয়েছে। তখনও তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইবেন? চাইবেন না তো! তাই তো আমি নিষ্ঠুরতম। আমি স্বার্থপর। কারণ যেই বাবার লা’শটা আমি সচক্ষে হজম করেছি তারই মুখ থেকে শোনা তার হ’ত্যাকারীর নাম জানা সত্ত্বেও তার সাথে এক ছাদের তলায় থাকা সম্ভব হয়নি, পারিনি আমি। জীবনের দূর্বিষহ যুদ্ধে ভয়ংকর পরিনতিতে পরাজিত হয়ে দাঁড়িয়েছি পাথার আর আগুনের মাঝামাঝি। এক জাগায় বিবেক, ন্যায়নীতির দংশন আমাকে নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করছে অন্যদিকে মায়া আর ভালোবাসার টান আমায় অগ্নিকু’ণ্ডে স’মাধি দিচ্ছে। আমি কোথায় যাবো? বলতে পারেন!

চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া নোনাজল টুকু সহস্তে মুছে নিলো। এইখানে দাঁড়িয়ে অশ্রু ফেলা বড্ড বেমানান। তবুও চোখটাকে তো আর নিজের মতো নিষ্ঠুর করে তুলতে পারছে না। নিজেকে পূনরায় ধাতস্থ করে যান্ত্রিক গলায় বলল,

– ও বাড়িতে আমার বাবার খু’নীরা নিঃশ্বাস নেয়। হেসে খেলে বেঁচে বেড়ায়। ওইখানে থেকে নিজের দম বন্ধ করতে পারিনি। তাই চলে এসেছি, মুক্তি দিয়ে এসেছি একজন কে সমস্ত দায় ঝঞ্জাট থেকে। আপনাকে তো একদিন বলেই ছিলাম,আজও বলছি – ছেড়ে দিয়েছি তাকে যদি পারেন তো নিজের করে নেন। তাকে আমি কখনও বেঁধে রাখিনি আজও রাখবো না। আর আপনাকে এতগুলো কথা বলা আর হাঁটু পানিতে ডুব দেওয়া একই বিষয়। তবুও বললাম, কারণ মুর্তজা পরিবারের সাথে চৌধুরীদের সখ্যতা অনেক বেশিই আর তা সব ক্ষেত্রেই। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে জানেন তো! হতেও তো পারে আমি যা দেখেছি তার অর্ধেক হলেও আপনাকে দেখা লাগবে!

কথাখানা শেষ করে আর দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করলো না মোহর। বেরিয়ে এলো। আপাতত আর কোনো ডিউটি ওর নেই, শরীর টা বেজায় খারাপ লাগছে। যেকোনো মুহুর্তে মনে হচ্ছে তাল হারিয়ে পড়ে যাবে। দ্রুতপায়ে হেঁটে রাস্তায় এলেও রিকশা বা অটো জোগাড় করতে পারলো না৷ দুপুরের এই সময়টার জ্যামে পা ফেলার জায়গা থাকে না। এখানে বসে থাকা মানে নিঃশব্দে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয়। অগত্যা সামনে হাঁটা শুরু করলো মোহর।
দেখতে দেখতে তিনটে দিন পেরিয়েছে, মেহরাজ রোজই রাত বারোটার পরে এসে ওর ব্যালকনির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে এক পলক মোহরকে দেখবার খায়েশে, আর মোহর ঘর অন্ধকার করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থেকে মেহরাজের অস্পষ্ট মুখটা দেখেই রাত কাটায়। বড্ড ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে, বুকের মধ্যিখানে বুকটা লেপ্টে হাউমাউ করে কেঁদে বলতে “ আমি নিষ্ঠুর নই রুদ্ধ, আমি নিষ্ঠুর নই। নিষ্ঠুর আমার নিয়তি যেই বুকে স্বর্গসুখ খুঁজে পেলাম সেটাই আমার জন্য কাঁটার বিছানা সমান। যেখানে মাথা পাততে হলে হাজারো কাঁটার দংশ’নে ক্ষ’তবিক্ষত হতে হয়। আর এই অদৃশ্য কাঁটা গুলো ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক! আপনি কেনো সব ঠিক করে দিচ্ছেন না, কেনো সবটা মিথ্যে প্রমাণিত করে দিচ্ছেন না ”

প্রতিটা রাতেই এমনটা মনে হয়, বারংবার মনে হয়। কিন্তু তখনি নিজের বাবার মৃত, বিভৎস মুখটা আর ওই ভিডিও ক্লিপের কথাগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কানে বেজে ওঠে। যেনো মেহরাজের হাত দুটো রক্তাক্ত! ওর নিজেরই বাবার রক্তে র’ক্তাক্ত! আচ্ছা মোহর নিজ কী সত্যিই নিষ্ঠুর আর অকৃতজ্ঞ? তাহলে কেনো এখনো মনের ভেতরের কোনো এক সুপ্ত অংশ বারবার জপে যাচ্ছে মেহরাজের নির্দোষ হওয়ার প্রার্থনা, কেনো চোখ কান চাতক পাখির মতো সজাগ হয়ে থাকছে কখন এসে মেহরাজ বলবে “ আমি এসেছি মোহ.. আপনাকে আবারও আমার বুকে ফিরিয়ে নিতে এসেছি ” কেনো আসে না মেহরাজ! কেনো বলে না ও নির্দোষ? কী করে স্বীকার করে নিলো সবটা! জীবনের সর্বসুখের প্রশান্তিটা যার সান্নিধ্যে পেয়েছিলো তার থেকেই যখন বিধ্বংসী যন্ত্রণা টা পাওয়া যায় তার ভোগ কতটুকু আর কতখানি তা কী ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব!

ভাবনাগুলোর সাথেই অনেকটা পথ চলে আসলেও বড় বিপত্তি টা এবার ঘটলো। মোহর ভেবেছিল হয়তো কোনো ভাবে বাড়ি অব্দি পৌঁছে যাবে, কিন্তু চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে শরীর সমস্ত ভরটা ছেড়ে দিচ্ছে। রাস্তার একপাশে একটা ছাউনির নিচে দাঁড়ালো। সামনেই দোকান একটা পানির বোতল কিনতে হবে, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, কিন্তু এগোনোর শক্তি পাচ্ছে না কোনো ভাবে। সমস্ত গা টা ঝাঁকুনি দিয়ে গুলিয়ে এলো৷ আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো দূর্বল শরীরটা।

•••

– দিদা, ভাবী কেনো চলে গেছে আমাদের ছেড়ে? কেনো দাভাইকে এতটা বিধ্বস্ত দেখায়? দাভাই এর এমন অবস্থা আমি কোনোদিন ও দেখিনি। মা,বড়মা কেও আমায় কিচ্ছুটি বলে না। তুমি অন্তত বলো না কী হয়েছে? আমার ভাবী কেনো ফিরছে না?

সাঞ্জের কথার প্রত্যুত্তরে শুধুমাত্র চোখ দুটোই ভিজে এলো শাহারা বেগমের৷ তাথই ও সাঞ্জের সাথে তাল মিলিয়ে বলল,

– সাঞ্জে তো ভুল বলছে না। কেনো বলছো না তোমরা কিছু? প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো গুরুতর কোনো কারণে হুট করেই গেছে। ওকে ফোন দিয়েও পাইনি, ভাইকে কিছু জিগ্যেস করলেও উত্তর দেয়না। পৃথকটা সারাদিন ভাইয়ের সাথে সাথে থাকে কাম ধাম বাদ দিয়ে। তোমরা অনেক বড় কিছু লুকাচ্ছ আমাদের থেকে, কেনো লুকাচ্ছ? বড়মার চোখ মুখের দিকে তাকানো যায় না, তোমরা কেনো কিছু বলছো না আমাদের!

বেশ চ্যাঁচিয়ে বলল তাথই। কয়েকদিন ধরেই এই অবস্থা দেখছে। এভাবে তো আর সহ্য করা যায়না। মোহরকে ভীষণ মনে পড়ছে, কষ্ট লাগছে। মেহরাজকে এভাবে দেখা যায় না! কী হয়েছে ওদের মাঝে? কখনো তো ঝগড়া দূর মনোমালিন্য ও হয়না দুটির মাঝে তবু কেনো আজ তিনদিন ধরে এসব চলছে।

– তোমরা এমন কেনো করে আছো? সোজাসাপটা বলো মুখ খুলবে নাকি আমি নিজেই ভাবীর কাছে যাবো? আমি জানি তুমি সবটা জানো!

সাঞ্জের গলা খাঁকারিতে শাহারা বেগম অপরাধীর ন্যায় তাকিয়ে বললেন,

– তোরা জানিস মোহর কোথায়?

– মোহর মিথিলার বাড়িতে আছে। তুমি বলো আর না বলো আমি আর সাঞ্জে আজই যাচ্ছি ওর কাছে। যা শোনার নাহয় আমিই শুনবো ওর কাছ থেকে।

শাহারা বেগম খানিক নিশ্চুপ থাকলেন । অতঃপর কেমন ব্যাকুল গলায় বললেন,

– আমায় একটা বার নিয়ে যাবি ওর কাছে! ওকে অনেক কিছু বলা প্রয়োজন।

•••

– প্রেসারের এই অবস্থা কেনো? খাওয়া দাওয়া কী একেবারেই করেন না! ইনসমনিয়ার সমস্যা আছে?

মোহর ডায়ে বাঁয়ে ঘাড় নাড়ালো। মাঝবয়েসী মহিলা স্টেথোস্কোপ খুলে রেখে সফেদ প্যাডে কলম ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন,

– আপনি যথেষ্ট ম্যাচিউর। এ বিষয়ে আপনার জানা উচিত নিশ্চয়! ভীষণ অবহেলা করছেন শরীরের প্রতি। এভাবে চলতে থাকলে কত বাড় প্রবলেম ক্রিয়েট হবে ভাবতে পারছেন? টেস্ট কবে করিয়েছিলেন?

– কীসের টেস্ট?

ভীষণ শক্ত গলায় বলল ফায়াজ। এখানে এসেছে আধ ঘন্টা মতো হলো৷ হসপিটাল থেকে বের হতে একটু দেরি কী হয়েছে মোহরকে আর পাইনি। রাস্তায় এগোতে গিয়ে পথের ধারে ভীড় দেখে কী একটা মনে হতে ছুটে গিয়েছিলো। ওইখানেই মোহরের জ্ঞানহীন শরীরটাকে ঘিরে মানুষের ভীড়। ওকে ওইভাবে দেখে একটু সময় ব্যয় না করে তুলে নিয়ে এসেছে। মোহরের পড়ে থাকা জায়গাটার পাশেই একটা ছোট্ট ক্লিনিক, উপায়হীন হয়ে অগত্যা এখানেই এনেছে ওকে৷ মোহরকে এখানে আনার মিনিট পনেরো পরেই জ্ঞান ফিরেছে। অতঃপর চেকাপ আর ডক্টরের সাথে এসব আলাপ।

– আপনি কী পেশেন্টের হাসব্যান্ড?

ফায়াজের প্রশ্নটাকে উপেক্ষা করে উলটো নিজেই প্রশ্ন ছুড়লেন ভদ্রমহিলা। ফায়াজ বেশ বিড়ম্বনায় পড়লো, আড়চোখে মোহরকে দেখে স্পষ্ট ভাবে বলল,

– না। আমি ওর পরিচিত।

– লোকাল গার্জিয়ান?

– বলা যায়।

– হবে না। উনার হাসব্যান্ড অথবা বাড়ির কাওকে ডাকুন। কথা আছে।

মহিলা বেশ রাগচটা স্বভাবের কথাবার্তার কাঠিন্যে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ফায়াজ বিরক্ত হলো ভীষণ, ওকে নিশ্চয় চিনতে পারেনি বলেই এভাবে কথা বলছে। মোহরের অবস্থা খারাপ ছিলো বলেই এখানে এনেছে ইমারজেন্সীতে নাহ তো এখানে আনার কোনো প্রশ্নই ছিলো না।
ফায়াজের ভাবনার মাঝেই ডক্টর মোহরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– আপনার হাসব্যান্ড কোথায় থাকেন?

– ওর হাসব্যান্ড এখানে। আমি।

পুরুষালী কণ্ঠের শব্দগুলো যেনো কানকে উপেক্ষা করে বুকে বিঁধলো। এক লহমা বিলম্ব হলো না মোহরের নিজের পেছনের জায়গা দখল করে এসে দাঁড়ানো মানুষটাকে চিনতে৷ হাতের মুষ্টিতে রাখা টিস্যুটা মুচড়ে ধরলো। বড় বড় শ্বাস ফেলে যতটা নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো মানুষটার উপস্থিতিতে যে চিরচেনা ঘ্রাণটা ওক নাকে এসে লেগেছে তা চুরচুর করে ফেললো সমস্ত সত্তাকে।

– হ্যালো। মাইসেল্ফ মেহরাজ আব্রাহাম। মিসেস মোহর আব্রাহামের হাসব্যান্ড, এ্যান্ড গার্জেন অলসো ।

শেষোক্ত কথাটুকুতে যেনো তীব্র অধিকার বোধে নিজের অদৃশ্য দাপট টা বুঝিয়ে দিলো কড়ায় গন্ডায়। ফায়াজ মেহরাজকে দেখে উঠে দাঁড়ালো, মেহরাজ এগিয়ে এসে মোহরের পাশের জায়গা টা দখল করে বসলে ডক্টর বেশ হেসে বললেন,

– নিজের পরিচয় টা তো বেশ দিলেন। বউয়ের খেয়াক কী রাখছেন না?

মেহরাজ সকৌতুকে চাইলে অবিলম্বে ভদ্রমহিলা বললেন,

– সী ইজ প্রেগন্যান্ট। মেবি থ্রী মান্থ রানিং। অথচ শরীরের এ কী অবস্থা। খাওয়া, ঘুম কোনো টারই ঠিক নেই। ভীষণ যত্নে রাখতে হবে। প্রেগন্যান্সিতে এতটা ফিজিক্যালি আর মেন্টালি প্রেসার নিলে বচ্চার জন্য ব্যাপক ক্ষতি। আমি এখানে কিছু টার্ম লিখে দিয়েছি ফলো করতে বলবেন। আপাতত কোনো মেডিসিম স্যুটেবল না।

মহিলা নিজেও জানে না তার খুব স্বাভাবিক ভাবে বলা কথাটা সামনের মানুষ গুলোর মধ্যে টাইফুন তোলার জন্য যথেষ্ট। মেহরাজ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো নতজানু বউয়ের পানে। মোহর একটা বারের জন্যেও ঘাড় তুলে তাকালো না ওর দিকে। হুট করেই বুকটা মুচড়ে উঠলো ওর। নিজের ভেতরে ক্রমশ বেড়ে চলা তুফানকে ঢোক গিলে দমিয়ে ডক্টরের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে দাঁড়ালো মোহরের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে । ফায়াজের সামনে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বলল,

– ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস ডক্টর ফায়াজ। আপনি ওকে সঠিক সময়ে না আনলে অনেক কিছু হতে পারতো। অ্যাগেইন থ্যাংকস।

বলে ডক্টরের থেকে বিদায় নিয়েই বেরিয়ে এলো। এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে মোহরকে এনে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও উঠে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই ছুটিয়ে নিলো। না কোনো শব্দ নাইবা কোনো বাক্য। একেবারে পিনপতন নীরবতা পালন করে এগিয়ে এলো। মোহর চোখ মুখ খিঁচিয়ে নামিয়ে রেখেছে। সজোরে ঠোঁট দুটো কামড়ে রেখেছে, একদম ভরসা পাচ্ছে না নিজেকে সংযত করার একটুও সুযোগ পাচ্ছে না। মনের অবাধ্যতা ক্রমেই মস্তিষ্ককে অসাড় করে দিচ্ছে। চোখ দু’টো বেহায়ার মতো পাশ ফিরে তাকাতে চাচ্ছে। লোকটা কী আগের মতোই আছে? একবার আড়চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে মোহর খেয়াল করলো মেহরাজের পরনে গাঢ় ধূসর বর্ণের একটা শার্ট। কনুই পর্যন্ত গুটানো হাতা। শার্টের রঙটা একদম ওর চোখের মতোই। আচ্ছা ওর চোখ দু’টো কী এখনো আগের মতোই শান্ত দীঘির মতোই টলমলে লাগে! প্রচণ্ড সংযতচিত্তেও মোহরের মনে পড়লো রোজ সকালে মোহর নিজ হাতে মেহরাজের শার্টের বোতাম গুলো, গলার টাই নিজ হাতে পরিয়ে দিত৷ আবার বাড়িতে ফিরলে খুলতোও নিজে হাতে, এ যেনো মেহরাজের কড়া আবদার বইকি হুকুম ও। আচ্ছা লোকটা এখন যখন নিজের টাই নিজেই বাঁধে তখন কী মোহরের কথা মনে পড়ে না? রাতে যখন আঁকড়ে ধরার জন্য মোহরের বুকটা পায়না তখন কী করে ঘুমাই লোকটা! তারপর আবার নিজেরই মনে পড়লো ঘুমাই আর কোই, সারাটা রাত তো ওরই সামনে দাঁড়িয়ে থাকে! বুক চিরে, স্বরযন্ত্র ভেদ করে কান্না গুলো উগড়ে আসতে চাইলো, মোহর কোনো ক্রমেই আঁটকাতে পারছে না। ওর এসব ভাবনার মাঝেই গাড়িটা ব্রেক করলো। ঘাড় বাঁকিয়ে মোহর জায়গা টা দেখতেই মনটা বি’ষিয়ে এলো, দরজাটা খুলে এক মুহূর্তে অপেক্ষা না করে ছুটে এলো, সিড়ি বয়ে উঠে দরজায় ঘনঘন তিনবার ধাক্কা দিতে মিথিলা এসে দরজা টা খুলে দিলেই ও হুমড়ি খেয়ে পড়লো মিথিলার শরীরে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় আছড়ে পড়ে বলল,

– আমাকে আর কত কিছু সইতে হবে বুবু। আর কত! নিজের ভারটাই বইতে পারিনা অথচ আরও একজন জুড়ে আছে আমার শরীরে। যার ভালোবাসার চিহ্ন যার অংশ নিজের গর্ভে রেখেছি আজ সেই নেই আমার কাছে। আমি কীভাবে এতকিছু সইবো

মিথিলা পুরো কথা টা না বুঝলেও বোনের কান্না ওর সহ্য হলো না৷ নিজের চোখ গড়িয়ে পানি ঝরলেও মোহরকে ধরে ঘরের ভেতর এনে খাটের উপর বসিয়ে দিলো, দুহাতে ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,

– কাঁদিস না সোনা। বল না কী হয়েছে? কাঁদছিস কেনো পুতুল। আর কাঁদিস না তো! তোর এই কান্নার ভার কতটা আমি কী করে বোঝাই তোকে!

– বুবুরে জানিস আজ ডক্টর কী বলেছে। বলেছে আমার ভেতরেও নাকি একটা প্রাণ আছে। আমার শরীরের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে জুড়ে আছে ওই মানুষটার চিহ্ন। এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে আরও একটা জীবন কেনো জুড়ে গেলো বুবু! আমি ওকে কী করে সুস্থভাবে বাঁচাবো? পাষাণ লোকটা আমাকে এই বাড়ি অব্দি ছেড়ে গেলো অথচ একটা বার আমায় জিগ্যেস করলো না কেমন আছি। একটা বার চাইলো না আমাকে ওর কাছে রাখতে, এতো নিষ্ঠুর কেনো? আমার ক্ষেত্রেই সবটা এমন কেনো বুবু!

মিথিলা জড়িয়ে ধরলো মোহরকে৷ ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,

– চুপ কর বোন আমার। এইটা তোর ভালোবাসার অংশ। তোর নিরবিচ্ছিন্ন ভালোবাসার ফল। তোর সন্তান, ওকে কষ্ট দিসনা। ও তোর মোহর

মোহর কান্নার হিড়কে একটা শব্দ বলতে পারলো না। ওর ভেতরে যে আরেকটা প্রাণ বাড়ছে তা তো মাস দুয়েক আগেই আভাস পেয়েছিলো ও৷ উত্তেজনা, উৎকণ্ঠায় পরীক্ষা করার সাহস পাইনি। কত সাধ করেছিলো মেহরাজকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকের ভেতর মিশে গলা জড়িয়ে ধরে বলবে ‘ আপনি বাবা হবেন আব্রাহাম সাহেব। আপনার পাগলামি আর বাচ্চামিতে ভাগ বসাতে আরেকজন আসছে, তাকে কিন্তু একদম হিংসে করতে পারবেন না! ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে আপনার হাতটা আমি বাদেও আরেকজন খুব ভালোবেসে ধরবে, আপনাকে বাবা বলে ডাকবে ’
কিন্তু হলো কোই! সেসব আর হলো কোই! মেহরাজ পাশে থাকা অবস্থায় নিজের অবাধ্য মনটা হাজারো বার, সহস্র বার প্রলোভন দিয়েছে সবটা ভুলে যা মানুষটাকে ঝাপটে ধর, একে ছাড়া তুই বাঁচবি না মোহর! কিন্তু পারলো কোই! সে তো একটা বারও বলল না কিছু!

……

তিন জোড়া চোখ ভীষণ স্নেহ,ভালোবাসা আর আকুতিভরা টলটলে চাহনিতে তাকিয়ে আছে মোহরের দিকে। তবে ওর আর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ কোই! সে তো নিজের আনমনেই চুপটি করে বসে আছে যেনো শ্বাসক্রিয়া চলমান জীবন্ত একটা পুতুল!

– ও ভাবী! তুমি একটা বার আমাদের সাথে কথা বলো না গো! কী হয়েছে তোমার। কেনো আমাদের ছেড়ে চলে এলে, দাভাইকে ছেড়ে কেনো এলে! তুমি জানো না দাভাই তোমাকে ছাড়া থাকতে পারেনা। খায়না, ঘুমায়না৷ রাত হলেই কোথায় বেরিয়ে যায় সকালে আসে। আর যখন সকালে আসে তখন আর দাভাইয়ের মুখের দিকে তাকানো যায়না, দাভাই খুব যন্ত্রনায় আছে ভাবী।

সাঞ্জের ছেলেমানুষী কথাগুলোর ওজন ও আজ বেশ ভারী। মোহর জবাবের ভাষা খুঁজে পাইনা।তাথই ওর মুখে হাত দিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলে,

– আমাদের কথা কী মনে পড়ে না? কেনো চলে এলে! তোমাকে ছাড়া সবটা খুব এলোমেলো।

মিথিলা চুপটি করে বসে আছে পাশেই। উত্তর দেবেই বা কী। মোহর একবার চোখ তুলে তাকালো সামনে মাথা নুইয়ে বসে থাকা বৃদ্ধার দিকে৷ অবশেষে সে ভীষণ কাতর গলায় বললেন,

– মোহর। আমি জানি তুমি কী সহ্য করছো, তোমার ভেতর কতটা তুফান চলছে। তবে তুমি সবটা জানো না। আজ আমি তোমাকে এমন কিছু বলবো যা খুব গোপন, খুব অজানা আর একেবারেই অভাবনীয়

.
.
.
চলমান।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে