প্রেমোত্তাপ পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

1
510

#প্রেমোত্তাপ
অন্তিম পর্ব: খন্ড-১

কলমে: মম সাহা

একটি গাঢ় ব্যাথাময় উত্তপ্ত দুপুর মাথার উপর তেজস্বিনী রূপ ধারণ করেছে। অকল্যাণের ডাক নিয়ে কাক গাইছে করুণ সুরে। চিত্রাদের খাবার টেবিল আজ আনন্দ শূন্য। প্লেট গুলো পরে আছে অযত্নে। ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সকলে। প্রস্থানের সময় নিকটে। ব্যাথাদের তীব্র হামাগুড়ি। ভেতর ভেতর যন্ত্রণারা ছটফটিয়ে মরছে। কিন্তু উপর উপর সবাই শক্ত। অহিকে নিতে এসেছে তার জন্মদাত্রী, ভদ্রমহিলার মুখে হাসির কমতি নেই। প্রথমে অহিরা বের হবে, তারপর চাঁদনীকে দিয়ে আসতে যাবে সকলে এয়ারপোর্টে। অহির ব্যাগ গুছানো শেষ। বিদায়ের সময় হয়ে গেছে। সবার মুখ ভার, কেউ কেউ কাঁদছে। চিত্রা এবং চেরি তো বেশ শব্দ করেই কাঁদছে। চেরি তো কতক্ষণ হাউমাউ করে কেঁদে বায়না করেছে আপাকে সে যেতে দিবে না। কিন্তু আপার মন যে বড়ো পাথর হয়ে গিয়েছে! সে যে ঠিক করে ফেলেছে চলে যাবে! আপার কঠিন অবয়ব দেখে বাচ্চাটা বুঝতে পারে তার আপা আর থাকবে না। কোনো পিছুটান তার আপাকে রাখতে পারবে না। অহি একে একে সকলের কাছ থেকে বিদায় নেয়। কেউ তাকে জাপ্টে ধরে কাঁদে, কেউবা কান্না লুকিয়ে প্রার্থনা করে তার সুখী জীবনের। তা শুনে মনে-মনে হাসে অহি। যেই সুখী জীবনকে সে দাফন দিয়ে যাচ্ছে তা যে আর ফিরে আসবে না! সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেও সে বিদায় নেয় না অবনী বেগমের কাছ থেকে। অবনী বেগম ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে দেখে অহিকে। এ বাড়িতে যখন সে বউ হয়ে এলো, তখন তার বয়স ষোলো মাত্র! আর অহির বয়স আট। মাত্র কয়েক বছরের ছোটো-বড়ো তারা! তার বিয়েটা সাদামাটা ভাবেই হয়। তার বরের দ্বিতীয় বিয়ে কি-না! বাড়িতে যখন পা রাখল, দেখল এই গোলগাল ছোটো মেয়েটা দূরে দাঁড়িয়ে পর্দার আড়াল থেকে তাকে দেখছে। অবনী বেগমও দেখল বাচ্চাটাকে লুকিয়ে-চুড়িয়ে, আড়চোখে। তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হলো গোপনে গোপনে। এরপর দেখা হলো পরেরদিন। তার শাশুড়ি অহিকে কোথা থেকে টেনে আনলেন যেন! এনেই অবনী বেগমের ছোটো হাতের মুঠোয় অহির ছোটো হাতটা রেখে বললেন, ‘ধরো তোমার মাইয়া। অহি ওর নাম। ও যেন কোনোদিনও দুঃখ না করতে পারে যে ওর মা নাই। তুমিই ওর মা, কেমন?’ অবনী বেগম তখনও সংসার বুঝতো না, সন্তান বুঝতো না, দায়িত্ব বুঝতো না। ফ্রক পড়া ছেড়ে তখনও সে থ্রি-পিস পরেনি কিন্তু তার আগেই তার কাঁধে তার অর্ধ বয়সী এক বাচ্চার ভার এসে পড়ল। কানামাছি খেলার বয়সে তার সাথে কানামাছি খেলল তার ভাগ্য। কিন্তু ছোটো অবনী বেগমের মাথায় এতটুকু গেঁথে গেল যে, সে একজন মা। এরপর থেকে উড়নচণ্ডী অবনী বেগম হয়ে উঠলেন দায়িত্বশীল একজন। নিজেও তখন বড়ো হচ্ছেন ধীরে ধীরে। তার সাথে বড়ো হচ্ছিল তার সন্তান। মা-মেয়ের একসাথে বড়ো হওয়ার ব্যাপারটা তার কাছে ছিল কৌতূহলোদ্দীপক কিছু। কিন্তু অহির কাছে পুরোটাই ছিল বিরক্তকর, অসহ্যকর। অবনী বেগম কখনো যত্নের ত্রুটি রাখেননি। সদা সে ছিল সচেষ্ট। তার দায়িত্বে কিংবা ভালোবাসায় কখনো হেলা-ফেলা করেননি। তবুও এই সংসার তাকে আপন করতে পারেনি। সে যেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে এসেছিলো, সেই শূন্যস্থান তাকে বিরাট ক্ষত বানিয়েই রেখে দিয়েছিল। স্বামীর আদর পায়নি, সন্তানের ভালোবাসা পায়নি তবুও ছোটো হাতে সবটা সামলে গেছে বছরের পর বছর। কিন্তু সে আজ অনুভব করছে, সেদিন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা অহির সাথে তার যে গোপনে গোপনে দূরত্ব ছিল আজও তা দূরত্বই রয়ে গেল। কাছে আসার গল্প হতে আর পারল না। অবনী বেগম হতাশ হলেন। এ জগতে ভালোবাসার পর আর কোনো বাঁধন নেই যা কাউকে আটকে রাখতে পারে। থাকলে হয়তো অবনী বেগম সেই বাঁধনে বাঁধতো অহিকে।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো, বাজলো অহির প্রস্থানের ঘন্টা। পিছে রাখল গোটা সওদাগর পরিবারকে এগিয়ে গেলো সে অযাচিত গন্তব্যের পথে। সবটুকু ভালো থাকা পিছনে ফেলে চলে যাচ্ছে সে। আবার, কখনো নিশ্চয় আসবে এই পরিচিত দালানে প্রিয় সুখ কুড়িয়ে নিতে। হয়তো আসবে!

চেরি ও চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। দু’টো মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায়। চাঁদনীরও ভেতরটা ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তূপ কিন্তু বাহিরে সে তবুও অটল। সবাই যদি ভেঙে যায় তবে ভরসা হবে কে?

আমজাদ সওদাগর বসে পড়লেন পাশের সোফায়৷ তার মনে পরে অতীত। ছোটোবেলা অহি ছিল ডানপিটে স্বভাবের। বাড়ির এ-কোণ থেকে ও-কোণ ছুটে বেড়াতো কেবল। ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াতো চঞ্চল পাখির ন্যায়৷ কিন্তু হুট করে তার সদ্য গজানো ডানাটা টেনেহিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলে তার জন্মদায়িনী। এরপর মেয়েটা আর উড়তে পারেনি। মায়ের এমন চলে যাওয়াটা ছোট্টো অহির মস্তিষ্কে ভয়ঙ্কর ঘা হয়ে রইল। মেয়েটা প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়তো। আমজাদ সওদাগর মেয়ের চিন্তায় যখন দিশেহারা, তখন সবাই বলল- অহির একজা মা প্রয়োজন। আমজাদ সওদাগর দিগভ্রান্ত হয়ে সে কথাও রাখলেন। নিজের প্রথম স্ত্রী’কে অনেক ভালোবাসা স্বত্তেও সে তাকে হৃদয় মাঝে মাটি দিলেন। মায়ের জোড়াজুড়িতে একটা অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করলেন। যদিও সে অবনী বেগমকে বিয়ের দিন দেখে ছিল, এর আগে দেখলে নিশ্চয় সে বিয়েটা করত না। অবনী বেগমের এই অপরিপক্ক বয়সটাই আমজাদ সওদাগরের গলার কাঁটা হয়ে থেকে গেল। তার মেয়ের মা প্রয়োজন বলেই সে বিয়েটা করেছিল অথচ অবনী বেগম ছিল সদ্য কিশোরী। এই সদ্য কিশোরী কী নিজের বয়সের অর্ধেক বয়সী মেয়ের মা হতে পারবে? এমন একটা ভাবনায় তার ভেতর বিতৃষ্ণায় ভোরে উঠেছিল। আর সেজন্য সে অবনী বেগমকে মানতে পারলেন না আর। তবুও, সংসার করে গেলেন। তার উপর দেখলেন, তার মেয়ে নতুন মা আসার পর আরও দূরে সরে গিয়েছে, সেটাও মানতে পারলেন না আমজাদ সওদাগর। আর এই সবটুকু দায়ভার গিয়ে পড়ল অবনী বেগমের উপর। যদিও পরে ধীরে ধীরে সে উপলব্ধি করেছিল অবনী বেগম একজন দারুণ ও চমৎকার মা। কিন্তু তবুও, প্রথম দৃষ্টিতে যে দূরত্ব তৈরী হয়েছিল তা আর ঘুচাতে পারেননি তিনি। আমজাদ সওদাগরের ভেতর অনুশোচনার ঘর বাঁধলো। সে ভুল করে ফেলেছে, বিরাট ভুল। ছোট্টো অহির ডানাটা যিনি নির্মমভাবে ছিঁড়ে ফেলেছিল, তার কাছেই সে বড়ো অহিকে সমর্পণ করে দিল! অথচ যিনি অহির ছেঁড়া ডানাকে বহু বছর যাবত যত্ন করে আবার সুনিপুণ করত চাইল তাকে কোনো দামই দিল না সে! আজকের অনুশোচনাটা যে বড়ো দেরিতে হলো। এখন যে আর কিছুই করার নেই। সে আটকালে অহিটা হয়তো থেকে যেত, অথচ তিনি কীভাবে এতটা পাষাণ হয়ে মেয়েটাকে যেতে দিল! আফসোসে আফসোসে পুড়তে লাগলেন তিনি। কিন্তু বড়ো দেরি হয়ে গেলো যে! এখন আর আফসোস করা উপায় নেই। মানুষ বরাবর ভুল সময়ে এসে আফসোসটা করে।

অহির ঘরের বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে রইল অবনী বেগম নির্নিমেষ। যতক্ষণ না অহিদের গাড়ি অদৃশ্য হলো ঠিক ততক্ষণ। বৈরী বাতাস বয়ে গেল জানালার অবগুণ্ঠন গুলো কাঁপিয়ে। তার তালে অবনী বেগমের চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়র নিরব অশ্রুবিন্দু। ঠিক তখনই অবনী বেগমের চোখ গেল বারান্দার সাথে লাগোয়া বুকশোলফের একটি রঙিন কাগজে। কলমদানি দিয়ে যেটাকে আটকে রাখা হয়েছে। দেখতে প্রায় চিঠির মতন। অবনী বেগমের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। ছুটে গিয়ে কমলা রঙের কাগজটা হাতের ভাঁজে মেলে ধরল। পুরো কাগজ জুড়ে জ্বলজ্বল করছে অহির লেখা……

“প্রিয় মা,
মা বলেছি বলে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়? এতগুলো বছর কেবল এই একটা ডাক শোনার জন্যই তো আপনি আপনার সকল ধ্যান জ্ঞান সমর্পণ করেছিলেন আমার ভালো থাকায়। তাই আমাদের সম্পর্কের আরম্ভে আপনি আমার কেউ না হলেও শেষবেলায় আপনি কেবল আমার মা হয়েই থাকবেন। সেই ছোটোবেলায় বাবা যখন আমার জন্য মা নিয়ে এলেন, তখন আমার কেবল চারপাশের মানুষের বলা একটা কথাই মাথায ঘুরত, আপনি আমার সৎমা। আর সৎমা কখনো নাকি আপন হয় না। সেই কথা থেকেই আমি আপনাকে আমার রূপকথার গল্পের রাক্ষসী ভাবতাম। আর সে থেকে আমাদের দূরে যাওয়া। কিন্তু দিন অতিবাহিত হতে লাগল ঋতুর প্রয়োজনে আর আমিও অনুভব করলাম আপনি আমার রূপকথার গল্পের রাক্ষসী না বরং নির্মাতা। আমি দেখেছি খুব সুক্ষ্ম ভাবে আপনি সৎমা থেকে মা হয়ে উঠার চেষ্টা করেছেন। আমার জ্বর হলে আপনার চেয়ে বেশি বিচলিত হতে কাউকে দেখিনি। আমি একবেলা কম খেলে সে বেলা আপনাকে উপোস থাকতে দেখেছি। আমি রাত জেগে পড়ার সময় খেয়াল করতাম, দরজার আড়ালে একটি প্রাণ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। আমি ঘুমিয়ে গেলে আমার বেখেয়ালি ঘরটা আপনি সাজিয়ে রাখতেন। এই যে আপনার মা হয়ে উঠার আপ্রাণ চেষ্টা আমি ঠিকই দেখেছি। চেরি আপনার রক্তের সন্তান হয়েও আপনার কাছে প্রাধান্য পায়নি। অথচ আপনার কাছে প্রাধান্য পেয়েছিলাম আমি। কারণ আমাকে যে আপনি আপনার আত্মার সন্তান হিসেবে ভেবে নিয়ে ছিলেন। আপনার ষোলো বছর থেকে ত্রিশ বছরের জীবনে এই মা হয়ে উঠার গল্প ভীষণ যত্নের। তাই শেষবেলায় বলে যাচ্ছি, মা তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমার মা-হীন জীবনে মা হয়ে আসার জন্য তোমাকে আজীবন কৃতজ্ঞতা। ভালো থেকো মা, ভালো থেকো। হয়তো কোনো এক বিষণ্ণ ঋতুতে আমাদের দেখা হবে। সেদিন আমি পর্দার আড়ালে লুকাবো না, আর তুমিও গোপনে তাকাবে না। সেদিন আমাদের সাক্ষাৎ হবে প্রকাশ্যে। এবং আমাদের গল্প হবে নিকটের। মা, তোমাকে ভীষণ মনে পড়বে আমার। বিষম ভীষণ মনে পড়বে। আমার নির্ঘুম রাত গুলোতে আর কেউ সঙ্গী হবে না ভাবলেই জানো আমার কত কান্না পায়! তবুও….. ভাগ্য তো মানতেই হবে তাই না বলো? তবে, আমার যে ভাগ্যে তুমি ছিলে, সে ভাগ্যের প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগ নেই। ভালো থেকো মা। ভালোবাসাতে থাকবে। তোমার মেয়ে এই যন্ত্রণাময় যন্ত্রের শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে মা, পালিয়ে যাচ্ছে।

ইতি
তোমার চন্দনকাঠ

[পুনশ্চঃ আমি জানি তুমি সেই ছোটোবেলা আমাকে দেখেই নাম রেখেছিলে চন্দনকাঠ৷ যে শক্ত এবং দামী।]”

চিঠিটুকু পড়তে পড়তেই অবনী বেগমের চোখ ঝাপসা হলো। ভেতরে থেকে বেরিয়ে এলো দমফাটা কান্না। অপরদিকে দামী গাড়ির জানালার ফাঁক গলিয়ে একটি মেয়ে তাকিয়ে আছে সুদূরে। যতক্ষণ পর্যন্ত তার মা’কে দেখা যায়, সে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্তই তাকিয়ে রইল। সে জানে, তার বিরহে এই সুখী শহরে একজন মানুষ রোজ কাঁদবে। সে আর কেউ না, তার মা। তার আত্মার মা।

পরিশিষ্ট: সওদাগর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নওশাদ। তার কোলে ছোটো হুমু বার বার আধো কণ্ঠে বায়না করছে আইতকিলিম আন্তিকে দেখার জন্য। নওশাদেরও মন ভালো নেই। কয়েকদিন যাবত অহিটা কেমন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল! কেন এমন করল সে ভেবে পায় না। তন্মধ্যেই সশব্দে বেজে উঠল নওশাদের ফোন। দুপুরের উত্তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে ফোন ধরল নওশাদ, বিরক্ত ছুঁড়ে ফোনের অপর পাশের মানুষটাকে বলল,
“কল করেছেন কেন আপনি? আপনার কী লজ্জা শরম হবে না ভাবী? যতই বলি কল করতে না আপনি ততই জ্বালান!”

অপরপাশের সুন্দরী রমণী হাসলো। বললো, “তুমি বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হও নওশাদ, তাহলেই তো হয়।”

বিপরীত পক্ষের কথায় ঘৃণায় তেঁতো হয় নওশাদের অন্তর। প্রায় ঘৃণা ছুঁড়েই বলে,
“আপনার লজ্জা হয় না ভাবী এসব বলতে? আমার ভাই মারা যেতেই আপনি নিজের এই ছোট্টো মেয়েটার দায়িত্ব ঝেরে ফেললেন। এই ছোটো হুমুকে আমরা মানুষ করছি। আর আপনি কি-না আমাকে বিয়ে করতে লেগে পড়েছেন! ছিহ্। আপনি নোংরা মহিলা।”

কথাটা বলেই ফোন কাটলো নওশাদ। তন্মধ্যেই সওদাগর বাড়ির দারোয়ান জানালো অহি কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। আর এই শহরে ফিরবে না কখনো।

নওশাদ যেন হতবিহ্বল। মেয়েটা এভাবে ভালোবাসা জন্মিয়ে ছেড়ে গেল? ঠকালো শেষমেশ! অথচ কেউ জানলো না প্রেমের উত্তাপে ঝলসে গেছে একটি সদ্য গজানো ভালোবাসার চারাগাছ।

#চলবে…..

#প্রেমোত্তাপ
অন্তিম পর্ব: খন্ড দুই

সবেই বিকেলের বিবর্ণ রঙ আকাশ ছুঁয়েছে। পাখিদের ব্যস্ত ডানা ঝাপটানো দেখা যাচ্ছে পুরো আসমান জুড়ে। তাদের কিচিরমিচির শব্দে বিকেলের নৈকট্যতা খুব সহজেই ধারণা করা যাচ্ছে। সওদাগর বাড়ির দু’টো গাড়ি এসে থেমেছে বিমানবন্দরে। চুপসে আসা মনের অনুভূতি এবং দ্বিতীবার হৃদয় খালি হওয়ার যাতনা তারা নিরবতার মাঝে মিশিয়ে দিয়ে নাটকীয় ভালো থাকার চেষ্টা করছে কেবল।
তবে চাঁদনী কান্নাকাটি করেনি। বরং বাড়ির বড়ো মেয়ের মতন খুশি থাকার দায়িত্ব পালন করছে অবিরত।

সকলের থমথমে মুখ যেন চাঁদনীর চলে যাওয়ার ক্ষত আরেকটু গাঢ় করেছে। তবুও সে সামলে নিল নিজেকে। এতটা দূরে সে যেতে চায়নি, যতটা দূরে গেলে পিছু ফিরে আর নিজের মানুষ গুলোকে দেখতে পাওয়া যাবে না। তবুও….. ভাগ্য বুঝি চেয়েছে অন্যকিছু। আমরা যা চাই, সচারাচর দেখা যায় ভাগ্য তার বিপরীতেই চায়। হয়তো সেজন্যই পৃথিবীতে এত মন খারাপের গল্পরা বেনামি ঠিকানায় দূঃখ উড়ায়!
যাওয়ার ঘন্টা বেজে উঠলো গোপনে। এনাউন্সমেন্টে সুরেলা একটি কণ্ঠ দিক নির্দেশনা দিতে আরম্ভ করল। যেই কণ্ঠ দিক নির্দেশনার আড়ালে হয়তো বুঝায়, আর দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই পথিক! সকল পিছুটান পেছনে ফেলে সামনে চলো। কেউ তোমার জন্য থেমে থাকবে না। তুমি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটো, তোমার জন্য পিছুটান বাঁধা নয়।

চাঁদনী বিশাল বড়ো এক শ্বাস ফেলল গোপনে। বুকের ভেতর এমন দমবন্ধকারী ভারী পাথরটা নামাতে চাইল অথচ পারল না। এই শেষ মুহূর্তে এসে তার কেবলই মনে হচ্ছে থেকে যেতে। মনের এই আহ্লাদী আবদার অবশ্য মস্তিষ্কের কাছে নিছকই ঠাট্টায় উড়ে গেল। থেকে যাওয়ার এই নিয়ম ভাঙা আবদার মেনে নিল না মস্তিষ্ক। তার কেবল দূরে যাওয়ার পায়তারা কি-না! কারণ সে তো জানে, বরাবরই মনের সিদ্ধান্ত জীবনে তুমুল ব্যাথা হয়ে থেকে যায়! মন যে কোমল, শীতল। সে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে জানেনা। তাই মস্তিষ্কককেই সেই দায়িত্ব নিতে হয়। জীবনের সবচেয়ে ভালোর জন্য, কখনো কখনো অনুভূতি বিসর্জন দিয়ে কঠিন হতেই হয়।

চাঁদনী তার বাবার হাত থেকে ট্রলিটা নিতে চাইলে আফজাল সওদাগর বললেন,
“তুমি নিতে পারবে না তো, মা। অনেক ভার।”

“জীবনের চেয়ে তো কম হবে তাই না, আব্বু? কখনো কখনো এই ভার নিতে না পারলেও নিতে হয় যে, আব্বু। আর কতকালই-বা আমার ভার বইবে তোমরা বলো? আটাশ বছরের এই বোঝা আমি হালকা করে দিয়ে যাচ্ছি, আব্বু। কয়েকটা দিন তোমরা নাহয় শান্তিতে বাঁচলে!”

কথাটা চাঁদনী মায়ের দিকে তাকিয়েই বলল। কথা শেষ করে কেমন হাসলো! এই হাসিরা মৃত, ভাষাহারা। রোজা সওদাগর মেয়ের এই ফ্যাকাসে মুখের দিকে চাইলো করুণ চোখে। অনেকদিন পর বোধহয় সে এমন বুক ভরা স্নেহ নিয়ে দেখলেন মেয়েকে।

“ছিহ্ঃ আম্মু, তুমি কখনোই আমার বোঝা ছিলে না। কন্যা সন্তান আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড়ো নিয়ামত। আমার পরম সৌভাগ্য ছিল মা যে আমি তোমাকে পেয়ে ছিলাম। আর আজ আমার পরম দুর্ভাগ্য যে আমি তোমাকে হারাচ্ছি।”

শেষের কথাটুকু বলতে গিয়ে অসহায় বাবার কণ্ঠ কাঁপলো। তবে চাঁদনী রইল অনড়। সে শক্ত মনে একে একে বিদায় নিল সকলের কাছ থেকে। সবশেষে বাদ রইল তার মা। চাঁদনী এবার নিজেকে ভীষণ শক্ত করল। যতটুকু শক্ত করলে মা-বাবাকে ছেড়ে যাওয়া যায় ঠিক ততটুকু। অতঃপর ধীর পায়ে এগিয়ে এলো মায়ের দিকে। মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলল,
“বিদায় দিবে না, মা? তোমার ঘাড়ের বোঝা আজ হালকা হচ্ছে। একটু হাসিমুখে বিদায় দাও আমারে।”

রোজা সওদাগর ঠিক এই কথাটার পরে আর স্থির থাকতে পারলেন না। জাপটে ধরলেন মেয়েকে, হাউমাউ করে কেঁদে বললেন,
“তোরে অনেক দুঃখ দিছি, মা। ক্ষমা করিস তোর অভাগিনী মা’রে।”

এবার চাঁদনীর বন্ধ চোখের পাতা থেকেও গড়িয়ে পড়ল এক বিন্দু অশ্রু। মায়ের পিঠে নিবিড় হাত রেখে অভিযোগ বিহীন বলল,
“তুমি এত যত্ন করে আমারে গড়লে মা, এতটুকু কষ্ট দেওয়ার অধিকার তোমার আছে। আর আশেপাশের মানুষ যত কষ্ট দিয়েছে আমায় তার কাছে তোমার দেওয়া কষ্ট কিছুই না, আম্মু। তবে আমি সেই ব্যাথা ভুলতেই তোমার কোল খুঁজতাম বারংবার। সেই কোল তখন আমায় ভরসা দেয়নি। আসেনি আমার ভরসা হয়ে। এই একটা আফসোস আমার চিরজীবন থাকবে মা, চিরজীবন থাকবে।”

রোজা সওদাগর আরও শক্ত করে যেন আকড়ে ধরল মেয়েকে কিন্তু লাভ কী! শেষবেলায় আকড়ে ধরে যে লাভ নেই। যার যাওয়ার কথা সে যে যাবেই।
চাঁদনী মা’কে যত্ন করে ছাড়িয়ে নিল নিজের থেকে। উদাস চোখে তাকাল বাবার পানে। কেমন এক বিষন্ন স্বরে বলল,
“আব্বু, এই কলঙ্কিনীর ভরসা হওয়ার জন্য তোমায় আমি ভুলব না। পুরো পৃথিবী যখন আমায় কোণঠাসা করে দিয়েছিল তখন আমার পুরো পৃথিবী হওয়ার জন্য আমি চিরজীবন কৃতজ্ঞতা স্বীকার করব। আব্বু, আমি দেশ ছাড়তে চাইনি, তবুও ছাড়তে হলো তোমাদের, আমার এই মন ভালো না থাকার জীবন বেছে নেওয়ার জন্য আমি কিছু মানুষকে কখনো ক্ষমা করব না। জানো আব্বু, আমি সেই দূরদেশে তোমাদের বিচ্ছেদের যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচবো। আব্বু, জীবন এত জটিল কেন?”

চাঁদনী প্রশ্ন করল ঠিকই কিন্তু উত্তর শোনার অপেক্ষা করল না। জীবন এত জটিল কেন, তার উত্তর যে কারো জানা নেই এমনকি আব্বুরও না সেটা সে ভালো করেই জানে। আফজাল সওদাগর মনে মনে ভীষণ শোকে মূর্ছা গেলেন। তবে বাহির থেকে রইলেন অটল। বাবাদের যে ভেঙে পড়তে নেই।

সকল প্রিয় মানুষ, প্রিয় পরিবেশ, সুন্দর স্মৃতি ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। চোখের উপর ভেসে উঠছে কত স্মৃতি। খুব অগোচরে মৃন্ময়ের মুখটাও বার কয়েক উঁকিঝুঁকি দিল স্মৃতির পাতায়। শাহাদাত এর সাথে দীর্ঘ আট বছরের প্রেমের স্মৃতিরাও জীবিত হলো। বিড়বিড় করে বলল,
“শাহাদাত, তুমি বড়ো নিঠুর প্রেমিক। তোমার প্রেমে আটকে আমার চরম সর্বনাশটুকু হলো। শেষমেশ কি-না নিজের ঠিকানা বদলাতে হলো। কেন প্রেম আসে ব্যাথা দিতে? কেন তোমরা চাঁদনীদের অভিমানের প্রাক্তন হয়ে থাকো? কেন তোমাদের না পেয়ে এত নিঃস্ব হয়ে যাই?”

বুকের ভেতর অসহ্য ব্যাথা নিয়ে চাঁদনী যখন দৃষ্টি সীমানার বাহিরে গেলো, বিমানবন্দরের বাহিরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে মৃন্ময় তখন খুব গোপনে আফসোসের শ্বাস উড়িয়ে ফেলল। চির জীবন এই আফসোস নিয়ে কাটাতে হবে ভাবতেই তার বুক ভার হয়।

ল্যাগেজ রেখে বসতেই চাঁদনীর বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। তখনকার মৃন্ময়ের সুদূরে দাঁড়ানো অবয়বটা তার দৃষ্টিগোচর হয়নি। কীভাবে হবে? এই ছেলেটা তো একদিন হলেও তাকে অসম্ভব ভালোবেসেছে। অকারণে তো আজকাল কেউ-ই ভালোবাসেনা। তবুও তো ছেলেটা বেসেছে। সেই কৃতজ্ঞতা তো চাঁদনীর থেকে যাবে আমরণ।
চাঁদনী চোখ বন্ধ করতেই কানের কাছে বার বার প্রতিধ্বনিত হলো সেদিনের তার বন্ধুর বলা কথা গুলো। যখন চাঁদনী ভাইরাল হওয়া ছবিটা নিয়ে দিশেহারা তখন তার বন্ধু মুমিনুল সাইবার ক্রাইমের একজন আদর্শ কর্মকর্তা তাকে ভীষণ সাহায্য করে। এবং সে-ই জানায় ছবিটা মৃন্ময় ফ্যাক একাউন্ট থেকে পোস্ট করে। চাঁদনীর অবশ্য প্রথম পর্যায়ে একটু রাগ হলেও পরে ঠিক থিতিয়ে আসে সে রাগ। মৃন্ময়কে উদাসীনতা দেখিয়ে বুঝাতে হবে, ভালোবাসার যুদ্ধে কখনো জোরজবরদস্তি খাঁটে না। সেখানে কেবল নিঃস্বার্থ হতে হয়।

মৃন্ময় ফুটপাতে বসে আছে। দৃষ্টি তার আকাশ পানে। দূরে হতে মাথার হাজার মাইল উপর দিয়ে একটি প্লেন উড়ে যাচ্ছে। মৃন্ময়ের প্রেমের ইতি এখানেই। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই নিয়ম উপেক্ষা করে মৃন্ময় কাঁদলো। বলল,
“ইন্দুবালা, আমি আপনার ব্যাথা হতে চাইনি।”

দূরে হতে তখন গান বাজছে,
“সখী ভালোবাসা কারে কয়,
তা কি কেবলই যাতনাময়………”

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
অন্তিম পর্ব: অন্তিম খন্ড

কলমে: মম সাহা

সন্ধ্যার আকাশে এক মুঠো সোনালি আভা দেখা যাচ্ছে খুব ক্ষীণ। মনে হচ্ছে নিভৃতচারীণির গাঢ় অভিমান গগণ বক্ষে আলিঙ্গন করেছে। আজ মন খারাপের অপরাহ্ণ হলেও দিনটি বিশেষ। এতটাই বিশেষ যে প্রতি বছরের ক্যালেন্ডারের পাতায় এই দিনটিকে একটি অষ্টাদশীর কন্যা লাল কালিতে বৃত্ত দিয়ে হাসতে হাসতে যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যতে পা দিবে। এই দিনটির স্মৃতিচারণে সে কখনো কাঁদবে, কখনো বা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আনন্দে আহ্লাদী হবে। আজ যে সকল অপ্রাপ্তিদের প্রাপ্তি হওয়ার দিন। আজ বাহার ভাইকে পেতেই হবে কথার বৈধ দিন।

চিত্রা লাল রঙের একটি জামদানী শাড়ি শরীরে চাপিয়ে নববধূর লজ্জাতে আবেশিত হয়েছে। শাড়িটা বাহার ভাই দিয়েছে তাকে। বিয়ে উপলক্ষেই দেওয়া। বাহার ভাইয়ের পক্ষ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার এটা। বার কয়েক শাড়িটা নাকে চেপে সে ঘ্রাণ শুঁকলো। কেমন যেন নিজের নিজের একটা ঘ্রাণ পাওয়া গেল ! চিত্রা সেই অদৃশ্য ঘ্রাণে পেয়ে লাজুক হাসলো। অতঃপর নিঃশেষ হওয়া গোধূলির দিকে তাকিয়ে ক্ষণ গুনলো সঠিক সময়টা আসার। সন্ধ্যার আকাশের শেষ আলোটুকু বিলুপ্ত হতেই সে নেমে গেল ঘর ছেড়ে। সাবধানী পায়ে এসে থামল গেটের বাহিরে। মৃদু মৃদু শীতল বাতাস এসে শিরশির করে গা কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার। সে এই বাতাসটুকুও অনুভব করল শৌখিন আত্মায়।
নিজের মনমতন জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিনটিতে সে সেজে নিয়েছে। এইতো, আর কয়েকঘন্টা! তারপর, বাহার ভাই মানুষটা চিরতরে তার বলে লিখিত হবে পৃথিবী নিষ্ঠুর বুকে। এক নিদারুণ আনন্দে তার শরীর কাঁপছে। প্রিয় পুরুষকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার যেই গোপন উল্লাস তা আর গোপন থাকছে না। বুক চিরে যেন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে আনন্দ।

চিত্রা ক্ষণে ক্ষণে শ্বাস ফেলছে। অতি আনন্দে বারকয়েক কেঁদেছেও মেয়েটা। প্রাপ্তির যে আনন্দ, সে আনন্দের কাছে পৃথিবীর সকল নিয়ম অনিয়ম হয়ে যায়। প্রেমের উঠতি ফুলে হুট করে ভ্রমর আসার ব্যাপারটা তার নিতান্তই স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এত সুখ তার কপালে ছিল! এতটা সুখ! এই সুখে না আবার মরণ হয় সইতে না পারার যন্ত্রণায়।
ঘড়ির কাটায় বেলা ফুরানোর গান। হাঁটতে হাঁটতে গলির শেষ মাথায় আসতেই স্বস্তির শ্বাস ফেলল। যাক, কেউ তাকে দেখেনি এটাই বড়ো শান্তির ব্যাপার।

রিকশার খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাতেই গলির মোড়ের টঙ দেকানটার দিকে তার নজর স্থির হলো। বার কয়েক কাঁপল ভারী পল্লব বিশিষ্ট নেত্র যুগল। কথা থেমে গেল লাল রঞ্জকে রঞ্জিত ওষ্ঠের সম্মুখে এসে। মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল চারপাশ। অস্ফুটস্বরে ডাকল সে,
“বাহার ভাই!”

টঙ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মনের সুখে সিগারেটের ধোঁয়ায় জীবন বিলাস করতে থাকা নীল পাঞ্জাবি পরিহিত বাহার সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে চাইল। চিত্রাকে দেখে ক্ষাণিক হাসল কি! বুঝার উপায় নেই। মানুষটার হাসি কান্না সবই যে তার গম্ভীর ব্যাক্তিত্বের নিচে ঢাকা পরে যায়। সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে এগিয়ে এলো বাহার। সেই এলোমেলো চলন, বাঁকা তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি, রুক্ষ শুষ্ক কদমের মতন চুলগুচ্ছ! তবে পড়নের পাঞ্জাবি আজ এক নতুন বাহারের দীপ্তি ছড়িয়েছে। এ এক অন্যরকম বাহার। এ যেন এক প্রেম সৃষ্টি করা ধ্বংস মানব।

চিত্রা স্থির, চোখ আটকে আছে নীল পাঞ্জাবিতে। মোহময় তার মায়া ভরা দৃষ্টি। বলল,
“পৃথিবীর সকল সুন্দরের মাঝে আপনি অন্যতম, বাহার ভাই! আপনি কী সে কথা জানেন?”

“কখনো বলোনি তো, জানবো কীভাবে! তবে আজ জানলাম, তাও পাঞ্জাবির কল্যাণে।”

বাহারের ঠাট্টা মেশানো কথায় হেসে উঠল চিত্রা। বিবশ কণ্ঠে বলল,
“আমার ভাবতেই কেমন যেন লাগছে! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষটা কি-না আমার ভালোবাসায় আছে!”

“ভালোবাসা! সে যে নেহাৎ মরিচীকা মেয়ে। অবেলার কুকুর। যার মূল্য দিতে দিতে আমাদের জীবন চরম মূল্যহীনতায় হারিয়ে যায়। আচ্ছা রঙ্গনা, সবটুকু ভালোবাসা যার নামে তার নামে ঘৃণার ভাগ কতটুকু হবে?”

শেষের প্রশ্নে থেমে গেল চিত্রা। লোকটার স্বভাব কী কখনো বদলাবে না! সবসময় এমন কথা বলতেই হয়! লোকটা জানেনা? এসব কথা অষ্টাদশীর হৃদয়ে যে বড্ড আঘাত হানে।

“কখনো যদি আমায় ভুলতে চাও, মেয়ে, তবে প্রথমে ভুলে যেও, একটা ছেলে ধন্য হতো তোমাকে পেয়ে।”

চিত্রা নিকোটিনে ঝলসে যাওয়া বাহারের ঠোঁট গুলো চেপে ধরল, তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আপনাকে ভুলতে হলে যে সবার প্রথমে আমার নিজেকে ভুলতে হবে, বাহার ভাই। আর নিজেকে ভুলে গিয়ে বাঁচা যায়? আমি বাঁচবো না বাহার ভাই, বাঁচবো না।”

বাহার কথা বাড়াল না আর। একটি রিকশা থামিয়ে উঠিয়ে দিল চিত্রাকে। চিত্রা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“এক জায়গাতেই তো যাচ্ছি, আপনি উঠছেন না কেন? চলুন।”

“কাজ আছে একটু। তুমি গিয়ে অপেক্ষা করো, আমি আসছি।”

কথা থামতেই চলতে শুরু করে রিকশা। চিত্রার বুকের মাঝে কেমন অসহ্য যন্ত্রণা হলো হুট করে। কিছুক্ষণ পর যে মানুষকে চিরতরে পেয়ে যাবে, সে মানুষটার সাথে ক্ষাণিকের বিচ্ছেদটা তার যেন কেমন দমবন্ধকর লাগল। সে চলন্ত রিকশা থেকে পিছু ঘুরে তাকাল। বাহার দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার স্থির। মুখে বহু করুণ মুচকি হাসি। চোখের কোণে কী চিলিক দিল অশ্রু! চিত্রা ঠিক ঠাহর করতে পারল না। রিকশা দৃষ্টি সীমানার বাহিরে যেতেই বাহার আকাশের দিকে মুখ করে চরম বিষাদগ্রস্ত স্বরে বলল,
“তোমার জীবিত মৃত্যুর শোকে বাহার শোকাহত, রঙ্গনা। বখাটে বাহার কখনোই হয়তো তোমার হবে না। তোমার মন ভাঙার অপরাধে, বাহার চির জীবন মৃত্যু নিকটে থাকা রোগীর মতন ছটফট করবে। তুমি ক্ষমা করো না তবুও আমায়। তুমি জানবেও না, তোমার ভালোবাসার সমাধীর পাশে আমি থেমে যাব। আর কখনো গাইবো না, আর কখনো চাইবো না। তুমি সামলে নিও মেয়ে। তুমি আগলে নিও নিজেকে। বাহারের বিরহের শোক কাটিয়ে তুমি ভালো থেকো, রঙ্গনা। আমি নাহয় ভালো থাকবো তোমার বাঁধন হারা অশ্রুর অবসাদে।”

কথা থামিয়ে বাহার উলটো পথে হাঁটা ধরলো। তার নিদারুণ কণ্ঠে সুর তুলল,
“আমি কী বলিবো আর….
বিচ্ছেদের অনলে পুড়ে কলিজা আঙ্গার….”

_

কাজী অফিসের সামনে ধুলোমাখা শরীর নিয়ে চিত্রা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রজনী নামে ধরায়। অথচ চিত্রাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখানো বাহার ভাই তার কথা রাখে না। চিত্রার চোখে উপচে পড়া অশ্রু। সকালের সাজ সারাদিনের বিষাদে অবসাদ নিয়েছে। লাল টুকটুকে বউ সাজার স্বপ্ন চির প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে গানের তালে ভেসে আসে বিচ্ছেদের বিরহী সুর,
“ভ্রমর কইয়ো গিয়া,
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে……
আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে,
কইয়ো গিয়া।”

চিত্রা চিৎকার করে আঁধার রাস্তায় বসে পড়ে। জোছনার রঙ হামাগুড়ি খায় তার শরীরে। মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“বাহার ভাই, চলে আসুন প্লিজ। এমনটা করবেন না। আপনি কথা না রাখলে ম রে যাব যে। চলে আসুন প্লিজ। আমার অন্তরটা সত্যিই পুইড়া যায়, চলে আসেন আপনি। আপনি কথা না রাখলে যে আমি ম রে যাব। পাষাণ প্রেমিক আপনি বাহার ভাই। বড়ো পাষাণ। এমনে আমারে মা র তে পারলেন?”

উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। শুনশান রাস্তা কেবল চেয়ে দেখে এই প্রেমোবিচ্ছেদ। চিত্রার চোখে ভেসে উঠে চঞ্চল অতীত। যে অতীতের সবটুকু জুড়ে কেবল একজন বখাটে প্রেমিকের অস্তিত্ব। যে কখনো গান গায়, কখনো বা অবহেলায় হাসে একটু। চিত্রার চোখের পাতা বন্ধ হয়। সেই বন্ধ হওয়া চোখের পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ে বেনামি কষ্টরা। কতক্ষণ বিড়বিড় করে মেয়েটা। তারপর চুপ হয়ে থাকে বহুক্ষণ। শুনশান রাস্তাটাতেও একসময় একাকিত্ব দূর করে কতগুলো গাড়ি শা শা করে ছুটে যায়। অথচ চিত্রার একাকীত্ব কাটে না। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতার ছুরিটা অষ্টাদশীর বুকের ভেতর থাকা অদৃশ্য মাংসপিণ্ডকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে যে! সেথায় আর বসন্ত ফুল ফুটাবে না কখনো। চিত্রার চোখ মুখ কেমন শক্ত হয়ে যায়, কেমন গাঢ় অভিমানে বলে,
“আপনাকে আর চাই না, বাহার ভাই। চাই না।”

এরপর সব চুপ। ভালোবাসারা মৃত।

_

মাথার উপর অর্ধ খন্ডিত চাঁদ নির্লিপ্ত। চিত্রার গাঢ় কাজল অভিযোগে লেপ্টে গেছে চোখের নিচে। প্রেমিকের জন্য খুশিতে আহ্লাদী হওয়া লাল টুকটুকে জামদানী শাড়িটাও ধুলোয় মাখামাখি হয়ে ধরেছে মলিনতা। রিকশার টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে রাতের রাস্তা জুড়ে। চিত্রা বসে আছে মৃত মানুষের ন্যায়। রাত আনুমানিক ক’টা বাজে তার ধারণা নেই। কিংবা ধ্যানও নেই সেইদিকে। তবে রাতের গাম্ভীর্যতা দেখলে আঁচ করা যাচ্ছে বারোটার কাছাকাছি সময়।
চিত্রার রিকশা যখন তার কলেজের গলির সামনে দিয়ে মোড় নিল ঠিক তখনই সে খেয়াল করল কলেজের পাশের গলিটা বন্ধ করা হয়েছে। রেড এলার্ট সাইন বোর্ডও টাঙানো হয়েছে। কয়েকজন কনস্টেবল বসে বসে ঝিমুচ্ছে সেখানে। এবার নির্লিপ্ত চিত্রার মাথায় অদ্ভুত ভাবনা খেলে গেল। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠেই রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে এখানে, মামা? এই গলিটায় পুলিশ পাহারা কেন!”

পথের দিকে ব্যস্ত থাকা আধবয়সী মানুষটা তার কাজে মনযোগ রেখেই বললেন,
“হায় আম্মা, জানেন না কী হইছে! গতকাল রাতেই তো এখানে পুলিশ তদন্ত করছিল। অনেক নেশা জাতীয় জিনিস নাকি এই গলিতে সাপ্লাই করা হয়। অনেক অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে এই নেশার জগতে বুদ হয়ে গেছে নাকি।”

চিত্রার শরীরে অদৃশ্য কম্পন দেখা দিলে। মস্তিষ্কে ভেসে উঠল বনফুলের মুখটা। সে প্রায় কয়েকদিনই তো বনফুলকে এ গলিতে দেখেছিল। এখানে বনফুলের কোনো কাজ না থাকা সত্ত্বেও তো সে এখানে আসতো। তাহলে কি…….
চিত্রা আর ভাবতে পারল না কিছু। তার বোকা সোকা বন্ধুটা এমন আঁধার জগতে বিলীন হয়েছে, এই ভাবনাটা তার মস্তিষ্কে বেশ প্রবল চাপ দিল। অসাড় হয়ে এলো তার দেহ। ভয়ে, আতঙ্কে সে মুখ চেপে ধরল দু-হাতের আঁজলে। মেয়েটা তো এমন ছিল না কখনো। এমন হলো কীভাবে! চিত্রা ভাবলো। ধীরে ধীরে তার ভাবনা স্বচ্ছ হলো। হ্যাঁ, ঠিক যখন থেকে ভাইজান রুক্ষ হলো বনফুলের প্রতি, তখন থেকেই মেয়েটার অধঃপতন শুরু। তাহলে কী এটার প্রতিশোধ নিলো বাহার ভাই! যেমন ভাবে বনফুল মূর্ছা গিয়েছিল, ঠিক তেমন জায়গাতেই এনে চিত্রাকে ফেলল সে! প্রেমিক এত স্বার্থপর হয়!

চিত্রার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই পথ ফুরায়। গন্তব্যতে এসে থামে তিন পায়া বিশিষ্ট যানটি। চিত্রা ক্লান্ত শরীরে নেমে ভাড়া মেটাতেই তার গালে চ ড় পরে। চিত্রা অবাক হয় না। এটা ভবিতব্য জেনেই সে এখানে এসেছে। তার যে এই সওদাগর ভিলা ছাড়া যাওয়ার জায়গা নেই। নিশ্চুপতা ভেদ করে মুনিয়া বেগমের কণ্ঠস্বর শোনা যায়,
“আসার প্রয়োজন কী ছিল? রাত দেড়টায় ভদ্র বাড়ির মেয়ে বাহির থেকে ফিরে না।”

চিত্রা মাথা নত রাখলেও বুঝতে পারল সকলের চোখ-মুখে উপচে পড়া বিস্ময়। তারা হয়তো চিত্রার যন্ত্রণায় ভেঙে আসা ভেতরটার উপলব্ধি করতে পারল বাহির থেকেই! কিন্তু চিত্রাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মুনিয়া বেগম আশ্চর্যের সপ্তম পর্যায়ে চলে গেলেন বোধহয়। হতভম্ব কণ্ঠে বললেন,
“বাড়ির এই খারাপ সময়ে তুমি লাল শাড়ি পরে ঘুরতে গিয়েছিলে! চিত্রা?”

চিত্রা চোখ তুলে তাকায় না। মুনিয়া বেগমের রাগ বাড়ে। সাথে লজ্জিতও বোধ করে ক্ষাণিকটা। বাড়িতে এমন বিষাদ চলছে অথচ তার মেয়ের মনে এত ফূর্তি! ছিহ্! অথচ বাড়ির মানুষ গুলো তাকে কতই না ভালোবাসা দিয়েছে।
এগিয়ে আসে নুরুল সওদাগর। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“একটা নির্লজ্জ মেয়ে জন্ম দিয়েছো। ঘৃণা লাগছে এখন এর প্রতি। তুমি মরে যেতে পারছ না?”

ব্যাথায় জর্জরিত চিত্রার শেষ ভালো থাকার চেষ্টাটুকু নিঃশেষ হয়ে যায়। হাসে সে নিখুঁত করে। গুটি গুটি পায়ে ভাইজানের কাছে এগিয়ে যায়। কী মনে করে বাচ্চার মতন লুটিয়ে পড়ে ভাইয়ের বুকের মাঝে। এবার সওদাগর বাড়ির সকলে কিছুটা চমকে গেল। এই চিত্রার আচরণ বড্ড অপরিচিত। কী হলো মেয়েটার!
তুহিন বোনকে স্নেহের হাতে আগলে নেওয়ার আগেই মেয়েটা বুক থেকে মুখ তুলে। কেমন অভিযোগ করে বলে,
“ভাইজান, আমি হেরে গেছি। প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার এই পৃথিবীতে তোমার চিত্রার খাঁদ বিহীন ভালোবাসার মূল্য কেউ দিল না। ভাইজান, তোমার চিতাবাঘকে মেরে ফেলেছে ওরা। মেরে ফেলেছে।”

আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চিত্রা ছুটে চলে গেল বাড়ির ভেতরে। সশব্দে আটকে দিলো নিজের ঘরের দরজা। সেই শব্দে কাঁপল বোধহয় সওদাগর বাড়ির সুখের শেষ অস্তিত্বটুকু। তুহিন বিভ্রান্ত হয়ে ছুটে গেলো বোনের পেছনে। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে যে!

রক্তে রঞ্জিত সওদাগর বাড়ির সবচেয়ে ভীতু মেয়েটির রুম। শ্বাস চলছে ক্ষীণ। চাঁদের আলো গাঢ় জোছনা ছড়িয়ে দিয়েছে সেই অন্ধকার ঘরটিতে। বাহির থেকে প্রচুর হাঁকডাক হচ্ছে। কিছুটা চিত্রা শুনছে কিছুটা শুনছে না। তার দৃষ্টি জানালার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা রঙচটা দু’তলা বাড়িটির দিকে। যেই বাড়িটির সদর দরজায় ঝুলছে বিরাট তালা। ছাদ খা খা, শূন্য। যে বাড়ির ছেলেটি চিত্রার নিঃশেষ হওয়ার কারণ। যে বাড়ির মেয়েটিও এমন প্রেমেই নিঃস্ব হয়েছিল।
চিত্রার চোখ বুজে এলো। বিড়বিড় করে বলল,
“ভালোবাসার কাছে নাকি সব মিছে? তবে প্রতিশোধ এত বড়ো হয়ে গেলো কীভাবে? আমার সবটুকু ভুল জীবনের শুধু সঠিক বনফুলটার সাথেও আমার এমন আজন্মের দূরত্ব তৈরী হয়ে গেলো কীভাবে? কীভাবে আমার এত ভালোবাসায় পরিপূর্ণ জীবনটা ভালোবাসা শূন্য হলো? বাহার ভাই, কী হতো শেষবেলায় একটু ভালোবাসলে? এভাবে না মারলেও তো পারতেন।”

এত প্রশ্নের উত্তর মিলে না। দূর হতে অকল্যাণের সুর নিয়ে কেবল কানাকুয়ো ডাকে।
কিন্তু প্রেমিকা কী আদৌও জানবে? প্রতিশোধের ধর্ম যে প্রেমিকের নেই।

——————

পরিশিষ্ট:

সুইজারল্যান্ডের ছোটো শহরে হুট করে আজ আশ্চর্যজনক ভোর হলো। চাঁদনীর ঘুম ভাঙলো বহু পুরোনো সেই গান শুনো, “ইন্দুবালা গো, ইন্দুবালা গো……”

চাঁদনী হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমেই উঁকি দিল জানালা দিয়ে। বরফের শহরে আজ সোনালী রোদ্দুর উঠেছে সতেজ হয়ে। চাঁদনীর আঙিনায় বসন্তের দূত এসেছে যে! চাঁদনী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। গান কোথা থেকে আসছে সে জানেনা, তবে কার কল্যাণে আসছে সেটা বোধহয় সে আন্দাজ করতে পারল খানিকটা। তাইতো নিজে নিজেই ঝলমলে কণ্ঠে বলল,
“ইন্দুবালার কাছে পৌঁছাতে তোমার দু’টো বছর লেগে গেল, মৃন্ময়!”

_

সিলেটের আবেশিত বিকেলের পথ ধরে অহি হেঁটে যাচ্ছে। বর্ষাকালের রাস্তা জলে থৈ থৈ। বহুক্ষণ জল্পনা-কল্পনা করে কল লাগাল বহু পুরোনো সেই নাম্বারটিতে। গত এক সপ্তাহ ধরেই কল করবে কি করবে না এর দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে। অবশেষে সকল সংশয় মুছে কল দিল। রিং হলো সেই নাম্বারে। অহির বুকের মাঝে অনাকাঙ্খিত কম্পন। অপর পাশের মানুষটা কল ধরবে তো! অহির সকল সংশয়কে মুক্তি দিয়ে অপরপক্ষে কল রিসিভ হলো। গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠটা বলে উঠলো,
“সাতশ উনপঞ্চাশটা দিন আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে এখন কল দিতে ইচ্ছে হলো! চলেই যদি যাবেন তাহলে এসেছিলেন কেন?”

অহি উত্তর দেয় না। চোখ উপচে বেরিয়ে আসে আনন্দাশ্রু। ভুল বুঝে সে নিজের জীবন থেকে এতগুলো দিন নষ্ট করে ফেলল!
অহির কাঁধে তখন ভরসার হাত রাখে তার জীবনের পরম বন্ধু, তার আত্মার মা- অবনী বেগম। মেয়েকে ভরসা দিয়ে বলেন,
“কাঁদছো কেন? তাকে বলো, তার অপেক্ষা শেষ হলো। তার হুমুর আন্তি ফিরছে খুব শীগ্রই।”

অহি ক্রন্দনরত অবস্থায় মা’কে জড়িয়ে ধরল। ভাগ্যিস এ মানুষটা তার জীবনে ছিল! নাহলে তো কেবল দু’বছর না, পুরো জীবনটাই তার বৃথা হতো।

_

“প্রিয় বাহার ভাই,
আপনাকে ছাড়া রঙ্গন ফুল ঝরে যাচ্ছে অকালে, সূর্যের তেজ তার প্রখরতা হারিয়েছে, অষ্টাদশী হারিয়েছে ভালো থাকা। আপনি জীবনে এসেছিলেন বলেই অষ্টাদশী জানে ধারালো ব্লে ড রগে গাঢ় ভাবে ছোঁয়ালে কীভাবে র ক্তের স্রোত বয়ে যায়। অক্সিজেন মাক্স মুখে নিয়ে কীভাবে শ্বাসকষ্টে আচ্ছাদিত থাকা যায়। আপনার অভাবে কীভাবে একজন মেয়ের একটি জীবন থেমে যায়, আপনি তা দেখলেন না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে- বউ বানানোর স্বপ্ন দেখিয়ে চির প্রতীক্ষায় রেখে চলে যাওয়া বাহার ভাইরা কী ভালো থাকতে পারে?

ইতি
রঙ্গনা”

চিত্রা চিঠিটা শেষ করেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাম হাতের কাটা গাঢ় দাগটা কেমন বিদঘুটে ঠেকল তার কাছে। মানুষ বলে, মৃত্যুর পথ কত সোজা! অথচ সে জানে, প্রতি মোনাজাতেও মৃত্যু কামনা করা সে কীভাবে যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে। বাহাররা এতটা নির্দয় কেন! ভোরের সূর্য উদিত হয়। চিত্রার আটানব্বই নাম্বার চিঠিটাও জমে পরিত্যক্ত বাক্সে। কারণ প্রাপকের গন্তব্য যে তার জানা নেই। এই হৃদয়হীন শহরে তার পত্রের মাঝে লিখা বাহার ভাইটা যে আজ ভীষণ দূরে। অষ্টাদশীর চূর্ণবিচূর্ণ মন থেকে অবশ্য দূরে যেতে পারেনি।

চিত্রা জানালা দিয়ে তাদের সামনের বহুদিনের তালাবদ্ধ বাড়িটার দিকে তাকায়। বাড়ির মানুষ গুলো কীভাবে যেন উধাও হয়ে গেলো। চিত্রার মনে এক আকাশ আশা জমিয়ে তারা হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। এই শহরের হারিয়ে যাওয়ার গল্পে, হারিয়ে গেল চিত্রার বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা।

তবে বাহার ভাই এর গল্প কেমন হয়েছিল? কী হয়েছে তার ইতি? কংক্রিটের শহর, একুশে পদার্পণ করা প্রেমিকা কী সে কথা কখনো জানবে? না প্রেমিক ও প্রেম এভাবেই হারিয়ে যাবে প্রেমিকার মৃত্যুর প্রার্থনায়!

[সমাপ্ত]

1 মন্তব্য

  1. কি গল্প লিখলেন আপু,,,,,,,,গল্প তো শেষ হয়েও হলো না,,,,,,,,দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ আসলে মনে হয় ভালো হ‌ইতো,,,,,,,,গল্পে sad ending শান্তি লাগে না

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে