প্রেমোত্তাপ পর্ব-২৪+২৫

0
315

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২৪.

অহি বিশাল প্রাচীর ঘেরা একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাঁধে শুয়ে আছে ছোট্টো হুমু। হুট করে রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়েছিল বাচ্চাটার সাথে, এখন সে আর অহিকে ছাড়বে না। অবশেষে না পেরে, বাধ্য হয়েই বাড়িতে আসতে হলো অহিকে। সুন্দর দোতালা বাড়িটির সামনের জায়গাটিতে বাগান করা। সেখানে ফুটে আছে রঙবেরঙের ফুল। বাগানের ভেতর বসার জন্য একটি সুন্দর জায়গাও আছে। বাগানটির মাঝখানে ছোট্টো জলাশয় টাইপ কিছু আছে যা খুব সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। অহির চোখ ছানাবড়া। হ্যাঁ ওদেরও নিজস্ব বাড়ি এবং বাগান আছে ঠিক কিন্তু এত শৌখিন ভাবে কোনোকিছুই গোছানো নেই। বাড়িটি দেখলেই বুঝা যায় কোনো একজন মানুষ অনেক শখ করেই বাড়িটি বানিয়েছেন।

অহির ভাবনার মাঝেই নওশাদ ডাকল,
“বাড়ির ভেতরে যাবেন না? বাহির থেকেই দাঁড়িয়ে দেখবেন?”

অহির ধ্যান ভাঙে তবে মন টানে না আর ভেতরে যেতে। তন্মধ্যেই খেয়াল করে ছোটো হুমু গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। অহি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হুমুকে দেখিয়ে বলল,
“যার বায়নায় এসেছি, সে-তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার না গেলেও চলবে।”

“তাই বলে বাহির থেকে চলে যাবেন না-কি!”

নওশাদের প্রশ্নে অহি গাঁইগুঁই করল। সে বরাবরই কম মিশুকে। হুট করে কারো বাড়িতে চলে যাওয়া তার কাছে বড়ো অশোভনীয় লাগল। আর তাছাড়া বাড়ির ভেতর কে আছে সেটাও সে জানেনা। কে তাকে কোন নজরে দেখবে, তাদের সাথে কীভাবে কথা বলবে, কি বলবে সেটাও ভাববার বিষয়। অথচ এ জায়গায় চিত্রা হলে মহা আনন্দে চলে যেত। মেয়েটা বড়ো মিশুকে কি-না! এক মুহূর্তে মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে। কিন্তু অহির যে বড়ে সংকোচ হয়। তাই এত-শত অস্বস্তি নিয়ে অবশেষে সে মনস্থির করল যাবে না। যেই ভাবনা সেই কাজ। হুমুকে আলগোছে নওশাদের কোলে দিতে দিতে বলল,
“আজ নয়, আরেকদিন যাব। আজ একটু তাড়া আছে।”

“এটা কখনো সম্ভব না। আপনি আমার বাড়ির সামনে থেকে চলে যাবেন আর আমি কিছু বলবো না ভেবেছেন? চলুন এখুনি। নাহয় হুমু কাঁদবে।”

নওশাদের বোকা-বোকা একরোখা উত্তরে অহি বিরক্ত হলো না বরং হাসল,
“যার জন্য যেতাম, সে তো ঘুমেই। তাহলে কীভাবে কাঁদবে সে?”

অহির ভাবলেশহীন উত্তরে ভ্যাবাচেকা খেল নওশাদ। তবে সে দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তাই অহিকে বিব্রত করতে দুষ্টুমির স্বরে বলল,
“হুমু না কাঁদলে হুমুর বাপ কাঁদবে। তাও আপনাকে যেতে হবে।”

“তাহলে বরং হুমুর বাপ একটু কাঁদুক, এরপর ভেবে দেখব যাওয়া যায় কি-না।”

“কাঁদবো সেদিন, যেদিন একবারের জন্য আনবো। খুশিতে কাঁদব। আজ তো মিনিট খানেক থাকবেন। কান্নাটা আজ লস প্রজেক্ট হবে।”

নওশাদের কণ্ঠে দুষ্টুমির ছোঁয়া এবং ঠোঁটে কুটিল হাসি। ইশারা বুঝতে ভুল হয় না অহির। তাই তো সে প্রায় খিলখিল করে হেসে উঠে। নওশাদের থেকে এক ধাপ উপরে গিয়ে বলে,
“তাহলে ঠিক আছে, কান্নাটা সেদিনের জন্যই বরাদ্দ থাক যেদিন এটা লাভ প্রজেক্ট হবে। আজ তবে আসি।”

কথা থামিয়েই বিদায় নিল অহি। নওশাদ চেয়েও জোর করতে পারল না। অতটুকু অব্দি অধিকার তার বোধহয় এখনো হয়ে উঠেনি। যখন হবে, তখন দরকার হয় বেঁধে রেখে দিবে।

_

সবচেয়ে বেশি বেতনের টিউশনিটাও আজ হাতছাড়া হয়েছে বাহারের। ছাত্রীর বিরক্তিকর কর্মকান্ডেই টিউশনিটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে সে। অল্পবয়সী মেয়েদের আবেগ থাকে গুরুতর। এবং সেই আবেগের সমুদ্রে পড়ে তারা আর কিছু দেখতে চায় না, বুঝতে পারে না। বাহারের ছাত্রী টিনাও সেই শ্রেণীর একজন মানুষ। অতিরিক্ত আবেগে সে অন্ধ হয়ে গিয়েছে। অন্ধ না হলে কী আজ বাহারকে চিঠি দিতে পারত! এমনকি বাহার প্রত্যাখান করায় তার পা ধরে বসে ছিল। অবশ্য বেশ কয়েকদিন যাবতই বাহার এটা খেয়াল করেছিল কিন্তু পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল অল্পবয়সী আবেগকে বেশি গুরুত্ব না দিলে তা আপনা-আপনি থিতিয়ে আসবে। অথচ সে ভুল ছিল। বরং তার নিরবতাকে মেয়েটা সম্মতি ভেবে নিয়ে আরও ভয়ঙ্কর কাজ করার সাহস পেলো।

বাহারের চোখে-মুখে ক্লান্তি আছড়ে পড়ছে। একে একে প্রায় দু’টো টিউশনি হাতছাড়া করল। চিত্রাকে অবশ্য সে ইচ্ছে করেই আর পড়াতে যাচ্ছে না। মেয়েটা আজকাল তার কাছে পড়ছিলোও না। বাহারের সাসনে তার যত অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন, ভাবুক হা-হুতাশ। কী করবে? বয়স অল্প। নিজের পছন্দের মানুষটাকে এত কাছ থেকে দেখে আবেগ সামলাতে পারে না। অনুভূতি দমিয়ে রাখতে পারেনা। এতে প্রকৃতপক্ষে মেয়েটারই তো ক্ষতি হচ্ছে। তাই এসব ভেবেই আর পড়াতে যায় না।

এমন অনির্দিষ্ট হাজার খানেক চিন্তার বোঝা নিয়ে যখন রাস্তা দিয়ে একা হাঁটছিল বাহার, তখন অনুভব করল সে একা নয়। তার পাশে আরও একজন হাঁটছে। নিঃশব্দে, নিরবে, নিভৃতে। বাহার পাশ ফিরে তাকাতেই চিত্রার ঘর্মাক্ত মুখটি চোখে পড়ল। লাল হয়ে আছে মুখটি। বাহার ভ্রু কুঁচকালো,
“তুমি এখানে?”

“আপনি যেখানে, আমি তো সেখানেই থাকব।”

চিত্রার হাসি-হাসি বদনখানি সরু চোখে একবার পরখ করে নিল বাহার ভাই। ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল সে। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তোমার এখন বাড়িতে থাকার কথা। কিছুদিন পর তোমার পরীক্ষা। সব ভুলে গেছ?”

“বাড়িতে কীভাবে থাকব? আপনি বাহিরে থাকলে আমার যে বাড়িতে মন টিকে না।”

“ফাজলামো করছো?”

“না, ভালোবাসা-বাসি করছি। আপনারে ভালোবাসলে এত শান্তি লাগে কেন?”

“কারণ এখনো অশান্তি তোমার ভালোবাসার দুয়ারে এসে দাঁড়ায়নি।”

“কখনো দাঁড়াবেও না। আপনি যেখানে আছেন, সেখানে কোনো খারাপই আসতে পারবে না।”

“হাসালে রঙ্গনা। আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে বলছো ‘আগুনকে তুমি বিশ্বাস করো, সে তোমার শরীর জ্বালাবে না’! অন্ধবিশ্বাস করো না, মেয়ে। যখন পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তখন বুঝবে আগুনের জ্বালা কতো। আগে থাকতে সামলে যাও।”

চিত্রা দাঁড়াল। আড়চোখে চাইল বাহার ভাইয়ের পানে। বাহার ভাইয়ের দৃষ্টি তখনও গন্তব্যহীন। মিহি মন্দ বাতাস এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের শরীর। চিত্রা সে বাতাসের তালে অন্যমনস্ক হলো। কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,
“আমায় বিয়ে করবেন, বাহার ভাই?”

চিত্রার অসম্ভব রকমের আবদারে থেমে গেল এবার বাহার ভাইয়ের পা। তড়িৎ গতিতে সে চিত্রার দিকে চাইল। মেয়েটার চোখে যেন পৃথিবীসম মায়া। আবদার-আহ্লাদী, আদুরে সকল আধ্যাত্মিক অনুভূতি যেন মেয়েটার মুখমন্ডলে এসে ঘাপটি মেরে বসেছে। অথচ সেই সকল মায়াও ঝেরে ফেলল বাহার। গা-ছাড়া ভাবে চিত্রার সকল অনুভূতিকে হাওয়ায় উড়িয়ে বলল,
“অদ্ভুত আবদার করো না, রঙ্গনা।”

চিত্রা দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। একরোখা ভাবে বলল,
“বিয়ে না করলে যাব না।”

বাহার গা করল না তেমন। চিত্রা ঘাড়ত্যাড়ামি করল। বাহারের হাত জড়িয়ে ধরল। মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলল,
“চলুন, বিয়ে করে ফেলি। আমাদের সকল সমস্যা দেখবেন মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে। চলুন।”

চিত্রার আবদারের কোনো থামা থামি নেই। বাহার বারকয়েক থামতে বললেও চিত্রা শুনলোনা বারণ। পথচারীদের কেমন সন্দিহান দৃষ্টি এসে চিত্রার চোখ-মুখ এবং শরীরেও ছড়িয়ে পড়েছে। চোখ এড়ালো তা বাহারের। অবশেষে হুট করেই সে একটি অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসল। কোমল চিত্রার আদুরে শরীরটা হালকা বল প্রয়োগ করে ধাক্কা দিয়ে দিল। আচমকা ধাক্কায় ছিটকে পড়ল মেয়েটা। ককিয়ে উঠল ব্যাথায়। অথচ বাহার সেই ব্যাথার আর্তনাদ শুনল না। এর আগেই সে প্রস্থান নিয়েছে। চিত্রার ব্যাথাতুর দৃষ্টি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। কেউ দেখল না সেই অশ্রু। কেউ দেখলো না অষ্টাদশীর বুকের ব্যাথা।

_

সওদাগর বাড়িতে চিন্তার আরেকটি রাত নেমেছে। বাড়ির মেয়েটি আজ আবার নিরুদ্দেশ। চারপাশে খোঁজ পড়েছে তার। এ নিয়ে আক্রোশে ফেঁটে পড়েছে চিত্রার দাদী মনোয়ারা বেগম। চিত্রার বাবাও বার কয়েক হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে। চিন্তায় সকলের অবস্থা বেসামাল। এর মাঝেই সকলকে লুকিয়ে অহি চেরিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সাবধানী ভঙ্গিতে কিছুটা দৌড়িয়ে ছুটে গেল তারা বাহার ভাইদের বাড়িতে। বার কয়েক বেল বাজাতেই দরজা খুলল নোঙর নামের মেয়েটি। প্রথমে অহিকে দেখে কিছুটা ভ্রু কুঁচকালেও পরক্ষণেই চেরিকে দেখতেই তার কুঁচকানো ভ্রু সমান হয়ে এলো। চোখ-মুখে কেমন ছড়িয়ে পড়ল বিরক্ত। কর্কশ কণ্ঠে তবে ফিসফিসিয়ে বলল,
“কী চাই?”

নোঙরের এমন কণ্ঠ পছন্দ হলো না অহির। তাছাড়া মেয়েটাকেও তার পছন্দ নয়। এই মেয়েটাই সেদিন চেরির সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। তাছাড়া চিত্রাও মেয়েটাকে সহ্য করতে পারেনা। আর অহির সিক্স সেন্স বলে, চিত্রা ও বনফুলের দূরত্বের ভয়ানক পরিণতির কারণ এই মেয়েটাই। মেয়েটা ওদের সম্পর্কের তৃতীয় ব্যাক্তি ছিল। আর সবসময় যেকোনো সম্পর্কেই তৃতীয় ব্যাক্তি গুলো সুচ হয়ে ঢুকে এবং ফাল হয়ে বের হয়। হোক সেটা প্রেমের সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্বের।

“কী সমস্যা? দরজায় এসে সঙের মতন দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কী প্রয়োজন?”

মেয়েটার কথার ভঙ্গিতে খেপে উঠল অহি। দাঁত কিড়মিড় করে উত্তর দিল,
“কাকে সঙ বলছেন আপনি? জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে দিব আপনার। অসভ্য মেয়ে। থাকছেন অন্যের বাড়িতে আবার ভাব করছেন যেন আপনি বাড়ির মালিক!”

অহির এমন আক্রোশ সহ্য হলোনা মেয়েটির। ওদের মুখের উপর দরজাটি বন্ধ করে দিল। মেয়েটির এহেন আচরণে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল তারা। দুই বোন দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। চেরি অসহায় কণ্ঠে বলল,
“থাক, বুবু, চলে যাই আসো। ওরা ঢুকতে দিবে না আমাদের।”

বোনের অসহায় কণ্ঠে রাগ বাড়ল অহির। ইচ্ছে করল মেয়েটাকে ঠাটিয়ে দু’টো চ ড় মারতে। যদিও সে জানেনা মেয়েটা তার বয়সে বড়ো কি-না ছোটো কিন্তু তবুও তার এই অন্যায় কাজটি করার ইচ্ছে হলো। অবশেষে না পেরে দু’জনই বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই বাহার ভাইদের সদর দরজাটা খুলে গেল শব্দ করেই। ভেসে এলো মেয়েলি কণ্ঠ,
“ছোটো আপা? তুমি চলে যাচ্ছ কেন? আসো ভেতরে।”

আকস্মিক বনফুলের কণ্ঠটি কাঠফাটা রোদ্দুরে একবিন্দু বৃষ্টির ন্যায় লাগল অহির। তার আক্রোশ মেটানোরও সুযোগ পেল যেন। তাইতো ভয়ঙ্কর রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
“কীভাবে ভেতরে যাব, বনফুল? তোমাদের বাড়িতে তো নতুন কর্ত্রী এসেছে। সে অনুমতি না দিলে কী আমরা অধম’রা যেতে পারি?”
শেষের কথাটি অহি নোঙরের দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেলেই বলল।

“তাই নাকি? শুক্কুর শুক্কুর অষ্টদিন হলো বাড়িতে এসেছে সে, তাও মেহমান হয়ে, সে ঠিক করবে কে বাড়িতে আসবে, কে আসবে না? হাসালে, ছোটো আপা। মেহমান আর যাই হোক কর্ত্রী হতে পারবে না। আর যারা অনির্দিষ্টকালের জন্য আসে, তারা বেশিদিন মেহমানও থাকে না। তারা তখন…… যাক বাদ দাও। ভেতরে আসো, আপা।”

নোঙর যেন অপমানে মূর্ছা গেল। নতজানু মাথাটি তার আরও নত হয়ে এলো। বনফুল তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসল। বনফুলের আচরণে অহির ভ্রু কুঞ্চিত হলো। মেয়েটার আচরণে তো আজ কোনো উগ্রতা নেই! বরং চোখ-মুখ যেন কেমন অদ্ভুত লাগছে। চোখের নিচে কালো কালির প্রলেপ। কেমন যেন দেখতে লাগছে! এখন এত-শত ভাবনার সময় নেই বলেই অহি তেমন মাথা ঘামালো না। দ্রুতই বাসায় প্রবেশ করল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“বনফুল, এখন এতকিছু বলার সময় নেই। বাহার ভাই কোথায় বলো তো?”

বনফুল উত্তর দেওয়ার আগেই বাহার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। চিন্তিত অহিকে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“কী হয়েছে?”

“চিত্রাকে খুঁজে পাচ্ছি না, বাহার ভাই। আপনি কী একটু খুঁজতে যাবেন প্লিজ।”

অহির আবদারে থমকাল বাহার। তবে কিছু একটা ভেবে গা-ছাড়া ভাবে বলল,
“তোমাদের বাড়িতে কী লোকসংখ্যা কম পড়েছে খোঁজার জন্য?”

বাহারের উত্তরে তাজ্জব অহি। এতক্ষণের উজ্জ্বল মুখটাতে নেমে এসেছে অন্ধকার। কিন্তু থেমে নেই বনফুল। চিন্তিত কণ্ঠে ভাইকে তাড়া দিল। ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল নিজেই।

বাহার হতাশার শ্বাস ফেলে সেই পথে হাঁটা ধরল যে পথে মেয়েটাকে ফেলে এসেছিল। বিড়বিড় করে বলল,
“রঙ্গনা, জোর করে যন্ত্রণা বেছে নিচ্ছো। চির বেদনা হয়ে থেকে যাবে তোমার প্রেম।”

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

পর্ব: পঁচিশের প্রেম

ঝড় হচ্ছে অবিশ্রান্ত। অক্লান্ত বর্ষণ ধারায় ভিজছে পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তাখানি। তার সাথে ভিজছে নিশ্চুপ, নিরবে দাঁড়িয়ে থাকা শত যুগের হলুদ বাল্ব গুলো। যার আলোয় ভেজা রাস্তাটিকে মনে হচ্ছে কুড়ির কৃষ্ণকলি। যৌবন যার দেহে টইটম্বুর। বৃষ্টির এই মধ্যরাত একা। এই ব্যস্ত রাস্তায় রাত বাড়তেই ঝুপ করে নেমে আসে একাকীত্ব। সেই একাকীত্বকেই সঙ্গী করে ভিজছে এক অভিমানী রঙ্গনা। প্রেমিকের বুকে যত্নে থাকা অবাধ্য ক্যাকটাস ফুল।

কম্পনরত হৃৎপিণ্ডটুকু নিয়েই এই একা রাস্তায় ছুটে এসেছে বাহার ভাই। অষ্টাদশীর শখের প্রেমিক পুরুষ। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল গুলো বৃষ্টির ছোঁয়ায় অবাধ্য হয়ে লেপ্টে আছে কপালে। খুব শান্ত, নিবিড় ভাবে। নীল রাঙা টি-শার্টটাও বৃষ্টির কল্যাণে ভিজে একাকার। শ্যামলা পুরুষটির ছিমছাম শরীরে বৃষ্টিকে মনে হলো শৌখিন প্রেমিকা। যে প্রেমিকা, প্রেমিকের দেহ বেশ প্রেম নিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। চিত্রাকে এই ফুটপাতের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে দেখে বাহারের হৃৎপিণ্ড শান্ত হলো কিন্তু কণ্ঠ হলো রুষ্ট। সে প্রায় বাজখাঁই গলায় চেঁচালো,
“এখানেই থাকবে সারারাত?”

হঠাৎ রাশভারি পুরুষ কণ্ঠে চিত্রার গুরুগম্ভীর ধ্যানে ভাঁটা পড়ল। সে ঘোলা-ঘোলা দৃষ্টিতে সামনে চাইল। একটানা বৃষ্টিতে ভেজায় চোখ জ্বালা করছে তার। জ্বর আসবে কী! ঠিক ঠাহর করতে পারল না সে। তবে প্রেমিকের রুষ্ট চোখ জোড়া সে ঠাহর করতে পারল। তাই কিছুক্ষণ মৌন থেকে জবাব দিল,
“আপনাকে আসতে বলেছে কে?”

“আর কে বলবে? তোমার পরিবারের মানুষ ছাড়া? তারা তো ভাবেই আমি আজাইরা। আমার কোনো কাজকর্ম নেই। তাদের মেয়ের মতিভ্রম হবে আর আমি আমার সকল কর্ম ফেলে সেই মতিভ্রমের পিছে বলদের মতন ঘুরবো। আছিই তো আমি। বিনে পয়সার বলদ।”

কথা থামল বাহার ভাইয়ের আর ক্ষত-বিক্ষত হলো চিত্রার অন্তর। সে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল মানুষটার দিকে। মনে মনে অভিমানও করল। মানুষটা তাহলে তার কথা ভেবে এখানে আসেনি? তাকে আসতে নিশ্চয় জোর করা হয়েছিল তাই এসেছে। সেজন্যই কী এত রেগে গিয়েছে? হয়তো! ভেতরে-ভেতরে কথা গুলো ভেবেই তপ্ত শ্বাস ফেলল চিত্রা। তার এই ছোট্ট জীবনে সবচেয়ে বড়ো আফসোস হলো- মানুষটা তাকে ভালোবাসে না। আর এই আফসোস সবচেয়ে যন্ত্রণার। বাহার ভাই তাকে ভালোবাসলে, তার বোধহয় আর দুঃখ থাকত না।

চিত্রার অভিযোগের গোপন শ্বাস অগোচর হলো না প্রেমিকের। সে-ও এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আসলে চিত্রার প্রতি তার রাগ না, একটা গোপন ভয় তৈরী হয়ে গিয়েছিল। যখন শুনলো মেয়েটা এত রাতেও বাড়ি ফেরেনি, তখন অনাকাঙ্খিত ভয়ে তার মাথা দপ করে উঠেছিল। এই বুঝি মেয়েটা কিছু করে বসল। সেই ভয়টাই কণ্ঠে রাগ হয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বাহার হতাশার শ্বাস ফেলল। বড়ো বড়ো পা ফেলে খুব নিরবে গিয়ে বসল চিত্রার পাশে। নিভৃতে তাকাল মেয়েটার মুখের দিকে। চোখ গুলো কেমন লাল হয়ে গিয়েছে না মেয়েটার? অথচ সে হুশ কী তার আছে? না, নেই। মেয়েটা আজকাল কেমন জেদি হয়েছে। নিজের সকল সিদ্ধান্তে একরোখা মনোভাব প্রকাশ করছে। কীভাবে তাকে বুঝাবে যে দায়বদ্ধতার কাছে ভালোবাসাও বড়ো রঙহীন হয়ে যায় যে! অবুঝ মেয়েটা কী সেটা বুঝবে? বাহার নিবিড় দৃষ্টি পথের দিকে নিবদ্ধ করল,
“এত জেদ করে কী লাভ হয়, রঙ্গনা?”

“প্রেমিককে পাওয়া যায়।” চিত্রার তৎক্ষণাৎ উত্তর। হাসল বাহার ভাই,
“প্রেমিককে পেলে কী হয়, রঙ্গনা?”

“প্রেম স্বার্থক হয়।”

চিত্রার আবার দ্রুতগামী উত্তরে বাহার ভাই একপলক চাইল তার পানে। বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস, সাথে ছন্নছাড়া মানুষটির গোছানো কথা,
“প্রেমিককে পেলেই প্রেম স্বার্থক…. কে বলেছে, মেয়ে? প্রেম স্বার্থক হয় নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়। যেখানে চাওয়া-পাওয়া থাকে সেখানেই স্বার্থ জড়িয়ে যায় যে! আর সম্পর্কে স্বার্থ চলে এলে সঠিক ভাবে ভালোবাসা-বাসি আর হয়ে উঠে না। তখন মানুষ লেগে পড়ে স্বার্থ উদ্ধার করার কাজে। ভালোবাসা হলো খোলা আকাশ। যার দৈর্ঘ্য থাকবে না, প্রস্থ থাকবে না। যার পুরোটা জুড়েই থাকবে প্রশান্তি। হোক প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তি, ভালোবাসা হতে হয় অমলিন। যা কখনো, কোনো কিছুর বিনিময়ে হারাবে না। নৈকট্য পেলেই প্রেম থাকবে, দূরত্ব পেলে প্রেম হারাবে— এমন প্রেম যে খাঁটি নয়। নৈকট্য হোক কিংবা দূরত্ব, ভালোবাসার পরিমাণ যখন বদলাবে না, তখনই তো হবে প্রেম স্বার্থক। বুঝলে, রঙ্গনা?”

“খাঁটি প্রেম দিয়ে কী হবে, বাহার ভাই? যদি চাঁদনী আপার মতন না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে হয়?”

চিত্রার গলার স্বর কিছুটা কোমল। হুট করে এমন প্রশ্নে থতমত খেল বাহার ভাই। তড়িৎ গতিতে তাকাল চিত্রার পানে। মেয়েটার চোখে-মুখে অসহায়ত্ব। বা-চোখটা দিয়ে খুব গোপনে মুক্তোর মতো অশ্রুকণা ঝরে পড়ল। এটাও অগোচর হলো না বাহারের। সে খুব গোপনে তপ্ত এক শ্বাস ফেলল।
“চাঁদনীর হয়তো না পাওয়ার যন্ত্রণা আছে তবে সে এটা জেনে শান্তি পায় যে তার তরফ থেকে সে যথেষ্ট ছিল। যখন আমরা নিঃস্বার্থ ভালোবাসি তখন আমরা নিজেরাই ভেতর ভেতর একটা শান্তি অনুভব করি। আমরা জানি, পুরো পৃথিবী মিথ্যে হতে পারে তবে আমাদের ভালোবাসা একমাত্র সত্যি। আর এই শান্তিটা জীবনকে একটি অনন্য মাত্রায় নিয়ে যায়, রঙ্গনা। কেবল পেতেই হবেতে আটকে থাকলে তুমি সেই অনুভূতি অনুভব করতে পারবে না, মেয়ে।”

“আপনি আমাকে যতই বুঝান বাহার ভাই, আমি পেতেই হবেতেই থেকে যাব।”

মেয়েটার একরোখা জেদ অটল রইল। বাহার ভ্রু কুঁচকালো খানিক। বিরক্ত হলো কি-না ঠিক বুঝা গেল না। তবে সে তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বাহারকে উঠে দাঁড়াতে দেখে তৎক্ষণাৎ তাকাল চিত্রা। আবারও অভিমান হানা দিল তার বুকে। বাহার ভাই কি আবারও অষ্টাদশীর অভিমান না বুঝেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে? বুকের ভেতর জবাব বিহীন প্রশ্ন হামাগুড়ি দিতেই চিত্রা বলে উঠল,
“চলেই যেহেতু যাবেন, এসে ছিলেন কেন?”

মেয়েটার প্রশ্নে গা-ছাড়া ভাবে হাসল বাহার। মাথার ঝাকড়া চুল গুলো ঝেড়ে নিল নিঃসংকোচে। অতঃপর একটু নিচু হয়ে চিত্রার ডান হাতের বাহু আঁকড়ে ধরল এবং হেচকা টেনে দাঁড় করিয়ে দিল আকষ্মিক। মেয়েটাও থতমত খেল প্রায়। চিত্রার থতমত হওয়া চেহারার লাল চোখের পাতা গুলো খুব আলতো ছুঁয়ে অগোছালো বাহার ভাই বলল,
“থেকে যাওয়ার জন্যই তো এলাম। রেখে দাও। তোমার কথাই রইল, খুব শীগ্রই আমাদের বিয়ে হবে। রঙ্গনার অবাধ্য বাহার ভাই তার হবে। এবার চলো বাড়ি। নিজের প্রতি তোমার এত অবহেলা আমার একদম পছন্দ নয়, মেয়ে। মনে রেখো, তুমি মানে কেবলই তুমি নও। তুমি মানে কখনো কখনো আমি। তাই তোমার যত্নের নামে তুমি একটু আমার যত্ন নিও।”

চিত্রা এই আকস্মিক প্রেম প্রস্তাবে হতবিহ্বল। অথচ বাহার বেপরোয়া। বেখেয়ালি কণ্ঠে গান ধরল,
“যদি তুমি ভালোবাসো
ভালো করে ভেবে এসো
খেলে ধরা কোনোখানে রবে না
আমি ছুঁয়ে দিলে পরে
অকালেই যাবে ঝরে
গলে যাবে যে বরফ গলে না

আমি গলা বেচে খাবো
কানের আশেপাশে রবো
ঠোঁটে ঠোঁটে রেখে কথা হবে না
কারো একদিন হবো
কারো এক রাত হব
এর বেশি কারো রুচি হবে না

আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবে না…”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে