ভালো লাগে ভালোবাসতে-পর্ব ১০

1
2266

#ভালো লাগে ভালোবাসতে
#পর্ব-১০
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

রাত আটটা ত্রিশ।বিরক্তিকর সময় পার না করতে পারায় বিছানার উপর শুধু গড়াগড়ি খাচ্ছি।বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।এবার বর্ষার আগেই বৃষ্টি হচ্ছে কেনো কে জানে!সকাল থেকে সেই যে শুরু হয়েছে সারাদিনে আর থামার নাম নেই।এখন এই বৃষ্টির মধ্যে সারাদিন ঘরে বসে থাকায় ভীষন বোরিং লাগছে।বিকেলের দিকে তবুও স্নিগ্ধর হাত থেকে ওর মেকানিক্যাল পার্টসগুলো টেনেটুনে নিয়ে ছাতা মাথায় জোর করে বাইরে নিয়ে গিয়ে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে কাগজের নৌকা ভাসিয়েছি।
এখন সন্ধ্যার পর কিচ্ছু করার নেই।নিদ্র আমার সামনে টেবিলে বসে সেই যে একনাগাড়ে পড়ে যাচ্ছে আশেপাশে তার কোনো হুঁশ নেই।সেই সকাল থেকে পড়ে যাচ্ছে।তার এখন ফাইনাল পরীক্ষা চলছে,প্রায় শেষের দিকেই।
আমি বিরক্তি আর না কাটিয়ে উঠতে পেরে নিদ্রকে ডাক দিলাম,
-‘নিদ্র শুনছেন,চলুন না একটু লুডু খেলি।’
সে বই থেকে মুখ না তুলেই বলল,’হুম।’
মনে হয় না সে আমার কথা কিছু শুনেছে।আমি বিরক্তিস্বরে বললাম,’কি হুম?আপনি আমার কথা শুনেছেন?’
সে বই থেকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,’কি বলেছো?’
-‘লুডু খেলতে,লুডু।একটুও ভালো লাগছে না,চলুন না একটু খেলি।’
-‘না,এখন আমি পড়ছি।’
-‘সেটা তো আপনি সারাদিনই পড়েন।আপনার পরীক্ষা তো আবার সেই পাঁচ ছয় দিন পর,এখন একটু খেললে কি হয়?’
সে আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে আবার বইয়ের ভেতর মুখ ডুবিয়ে দিল।আমিও ক্ষেপে গিয়ে বিছানা থেকে উঠে তার সামনে থেকে বই ছিনিয়ে নিলাম।
সে বিরক্তস্বরে হাত বাড়িয়ে বলল,’সুপ্তি,এমন করো না,দাও তো।’
আমি দিলাম না।বই নিয়ে ছুটতে লাগলাম।সে বই ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।শেষে বলল,’ঠিক আছে শুধু আজকেই কিন্তু!’
আমিও ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।

লুডুর নীল গুটি আমার আর লাল গুটি নিদ্রর।দু দুইবার খেলে ফেলেছি আর দুইবারই সে আমাকে হারিয়ে দিল।আমার সবগুটি শুধু খেয়ে দেয়।একটা গুটিও পাকা বানাতে পারি না।লুডুর চারকোণা কোটে শুধু তার গুটি একাই রাজ করে যাচ্ছে।আমি মুখ গোমড়া করে তৃতীয় দান খেলা শুরু করলাম।শেষমেষ একটি গুটি বহুকষ্টে টেনেটুনে পাকা বানালাম।আর একঘর পেরোলেই গুটি আমার ঘরে।ঠিক সেই সময় দুই ছয় পাঁচ উঠিয়ে তার লাল গুটি দিয়ে সে আমার নীল গুটি খেয়ে ফেলল।আর এখন হা হা হা করে হাসছে।আমার তো কেঁদে ফেলার উপক্রম।তার হাসি শুনে আরো রাগ চেঁপে বসল।একটা বালিশ নিয়ে তাকে ইচ্ছামত পেটাতে লাগলাম তবুও তার হাসি থামে না।খেলার এক ফাঁকে তার অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে হাতের কাঁচা গুটি কোটে রেখে দিলাম।সে হয়ত বুঝতে পারেনি।
এবার আমি তার একটি পাকা গুটির পেছনে আমার গুটি লাগিয়ে দিলাম।মাত্র তিন পড়লেই খাওয়া।কিন্তু কানা ছাড়া এখন আর কিছু পড়ছেই না।মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল।এখন আর একটা কানা পড়লেই তার গুটি পগারপার।কিন্তু এইবার আর কানা পড়লো না।পড়লো দুই।তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার এদিকে অত খেয়াল নেই।আমি একটু চুরি করে লুডুর ছক্কাটা ঘুরিয়ে দুইয়ের জায়গায় কানা এনে দিলাম।তারপর চেঁচিয়ে হাত তালি দিয়ে বলতে লাগলাম,
-‘এই আমার কানা পড়েছে।খাওয়া আপনার গুটি।’
তার দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।সে বলল,’খাওয়া না?একবার চুরি করে গুটি উঠিয়েছো আবার এখন চুরি করে আমার গুটি খাওয়া!’
আমি একটু ঢোক গিলে দৌড় দেবার প্রস্তুতি নিলাম।সে বুঝে ফেলেছে আমার চুরি!

নিদ্র আমাকে ধরার আগেই আমি বিছানা ছেড়ে দৌড় দিলাম,আমাকে ধরার ক্রমাগত চেষ্টা করছে সে।আমিও তার থেকে রেহাই পাবার আশায় ছুটে চলছি।হঠাৎ সে পেছন থেকে আমার ওড়না টেনে নিয়ে গেল।আমি থতমত খেয়ে তার দিকে ঘুড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।সে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে দুষ্টু হাসি দিয়ে তার এক হাতে আমার ওড়না পেঁচাতে লাগল আর ধীরে ধীরে আমার দিকে আগাতে লাগল।আমিও পিছাতে লাগলাম।
একসময় দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেল।আর সেও খুব কাছে ঘেষে দাঁড়ালো।তার এভাবে আমার ওড়না টেনে নেওয়ায় আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলাম।তার থেকে চোখ নামিয়ে নিলাম।সে আমার চুলগুলো তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে আমার কানে গুঁজে দিয়ে আমার কানের কাছে তার মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,’মেয়েদের লজ্জা পেলে যে এত সুন্দর লাগে আগে জানতাম না তো!এবার কিন্তু লোভে পড়ে যাচ্ছি।বারবার লজ্জা পাইয়ে দিতে ইচ্ছে করছে যে!’
তার কথায় অজান্তেই আমার ঠোঁটের কোণায় ফুটে উঠল লজ্জা মাখা মৃদু হাসি।
কথাটি বলে মুচকি হেসে সে আমার গায়ে ওড়না জড়িয়ে দিয়ে চলে গেল।আর আমি লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে ঠায় দাঁড়িয়েই রইলাম।


তারাভরা আকাশের বিশাল চাঁদটির দিকে নিদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।বারান্দায় গিয়ে আমিও তার পিছনে দাঁড়ালাম।বাতাসে আমাদের দুজনের চুল মৃদু মৃদু উড়ছে।আমার পরণে একটি নীল তাঁতের শাড়ী।চোখে দেওয়া কাজল,আর পিঠে মেলা খোলা চুল।
অফিসে জয়েন করার পনের দিনের মধ্যেই আজ সে অনেক বড় ডিল ফাইনাল করেছে,সেই খুশিতে বাবা তাকে এডভান্স স্যালারি দিয়েছে।আজ সন্ধ্যার পর আমার হাতে একটি নীল তাঁতের শাড়ী আর নীল চুড়ি তুলে দিয়ে সে বলল তার নাকি এখন কোনো নীল শাড়ী পড়া মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করছে এবং আমাকে সেই ইচ্ছা পূরণ করতে হবে।কারণ ঐ যে আমার দেওয়া থাপ্পড়ের কারণে আমি তো তার আজগুবি আদেশে আবদ্ধ।
তার পেছন থেকে আমি হঠাৎ বলে উঠলাম,’আজকে কি আপনি খুব খুশি?’
বারান্দার রেলিং থেকে হাত সরিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,’হুম,খুব।’
আমিও হালকা হেসে দিলাম।
সে একটু ভ্রু ভাঁজ করে বলল,’আজকে নাকি তুমি আমার জন্য খুব টেনশন করেছো?
কথাটি সত্যি হলেও আমি তার সামনে স্বীকার গেলাম না।একটু ভাব নিয়ে পিছনে ঘুরে বললাম,’ইশ!আমার বয়েই গেছে আপনার জন্য টেনশন করার।আপনার জন্য আমি টেনশন করব কেনো!’
কথাটি বলে আমি চলে যেতে উদ্যত হলাম।সে আবারো চাঁদের দিকে তাকিয়ে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো,
আমি কত ছলে কৌশলে
তোমায় ভালোবেসে যাই,
এত করে চাই আমি বলো
আর কি ভাবে বোঝাই।
তুমি একবার বলো যদি
আমি পাড়ি দিবো কোন স্রোতা নদী
ভালোবাসা দিবো পুরোটাই।

তার মুগ্ধকর গানের আওয়াজে আমি থমকে দাঁড়ালাম।খালি গলায়ও কি সুন্দর গান গায়!
হঠাৎ আমি ভাবতে লাগলাম নিদ্রর প্রকৃত জীবনসঙ্গি কতটা ভাগ্যবতী হবে!সে আমারই কত খেয়াল রাখে তাহলে তার ভালোবাসার মানুষকে কতটা যত্নে আগলে রাখবে?
নিদ্রর মধ্যে কাউকে ভালোবাসার অসীম ক্ষমতা আছে।কাউকে পাগলের মত ভালোবাসার যোগ্যতা আছে।যেই ভালোবাসার সন্ধান খুঁজে চলেছি আমি।আর এতদিনেও সেই গাধী মেয়েটা কেন এখনো মানছে না কে জানে!

একদিন বিকেলে আমি বাসার ড্রয়িংরুমে বসে কমেডি মুভি দেখছিলাম।একটা হাসির সিন হচ্ছে তার মাঝে হঠাৎ হরর মুভির ভয়ংকর শব্দ আসতে লাগলো।আর এই শব্দটা ঠিক সেদিন রাতে শুনতে পাওয়া শব্দের মতোই,দিন হওয়ায় এখন আর তত ভয় পেলাম না।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আমার পাশের সোফায় স্নিগ্ধ বসে বসে ফোনে এই শব্দ শুনছে আর খিলখিল করে হাসছে।আমি ঝট করে উঠে গিয়ে ওর হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে দেখলাম এটা নিদ্রর ফোন।
শব্দটা আবার প্রথম থেকে প্লে করে কিছুক্ষণ শুনলাম।এবার আমার কাছে সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে গেল।সেদিনের এই কাজ করার পেছনে নিদ্ররই হাত।কি ফাজিল ছেলে!
আমাকে কি ভয়টাই না দেখিয়েছিল।এবার হাতে নাতে ধরা পড়েছে,আজকে তার খবর আছে।

বাগানে হনহনিয়ে হেঁটে গেলাম।মাথায় রাগ হাই ভোল্টেজ পাওয়ারে চেপে বসেছে।আর উনি বিন্দাসে বাগানের দোলনায় বসে বসে চোখ বন্ধ করে হেডফোনে গান শুনে যাচ্ছে।তার কাছে পৌঁছানোর আগেই একটি ফুল গাছের সামনে এসে আমি থমকে গেলাম।
আমি নিজের হাতে বাগানে একটি গোলাপ ফুলের গাছ লাগিয়ে ছিলাম।প্রতিদিন গাছের কলি দেখতে আসতাম আর অপেক্ষা করতাম কবে এই গাছে ফুল ফুটবে।আর আজ সত্যি সত্যি গোলাপ ফুটেছে।জীবনে প্রথম নিজের লাগানো গাছে ফুল দেখে আমি এতটা খুশি হলাম যে রাগ টাগ সব ভুলে গেলাম।
দৌড়ে নিদ্রর হাত টেনে নিয়ে আসলাম।গাছের কাছে এনে দেখাতে লাগলাম তাকে সেই ফুল।পিছন থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখি সে আমার তাকে হাত ধরার দিকে তাকিয়ে আছে।আমিও হকচকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ছেড়ে দিলাম।নিদ্র অনেকবার আমার হাত ধরলেও আমি কখনো নিজ থেকে ধরিনি।কারণ ঐ যে ঠিক করেছিলাম আমার ভালোবাসার মানুষই আমার হাত প্রথম ধরবে আর আমিও শুধু সেই পুরুষের হাতই প্রথম ধরবো যাকে আমি ভালোবাসবো।প্রথম কথাটা নিদ্রর মাধ্যমে ভেঙে গেলেও আমি নিজ থেকে আমারটা ভাঙতে দেয়নি।আর আজ আমি নিজেই সেটা করে ফেললাম।কি করে আমার দ্বারা এটা হয়ে গেল।আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমার কোনো খারাপও লাগছে না বরং আরেকটু ধরতে ইচ্ছে করছে।


ঘুমের চোখে মনে হল যেন কোনো এক উত্তপ্ত অগ্নির চাদরে আমাকে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে।অগ্নি যেন আজ তৎপর হয়ে আমার শরীরে যতটুকু শীতলতা আছে সবটুকু শুষে নিতে চাইছে।চোখ মেলে পুরো ব্যাপারটা অবগত হতে আমার কয়েক মুহুর্ত সময় লাগল।নিদ্র আমার বুকের উপর এসে শুয়ে রয়েছে।আমার ঘাড়ে তার উষ্ণ মুখ ডুবিয়ে হাতের শক্ত বাঁধনে আমাকে জড়িয়ে রেখেছে।তার শরীরের তাপমাত্রায় আমি আৎকে উঠলাম।এতো দেখি জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে!
সে প্রায় অবচেতনের মতোই পড়ে রয়েছে।অফিস থেকে তার ফিরতে অনেক দেরি হওয়ায় আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি তা মনে নেই।এখন মাঝ রাতে তার এই অবস্থায় আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম।গায়ে এত জ্বর!এখন আমি কি করব?ডাক্তারকে কি ডাকবো?
আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠার বৃথা চেষ্টা করলাম।সে কিছুতেই আমাকে ছাড়ছে না।আমি তাকে হালকা ঝাঁকিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে বললাম,’নিদ্র প্লিজ আমাকে ছাড়ুন।আপনি ওষুধ খেয়েছেন?আপনার গায়ে ভীষণ জ্বর,ডাক্তার ডাকতে হবে।’
সে আমাকে ছাড়লো না,বরং কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে আধো ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,’কিচ্ছু করতে হবে না।তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো তো।আমি ঠিক হয়ে যাবো।আমি তো আমার মেডিসিনের কাছেই এসেছি।’
কথাটা বলে আরেকটু আমার ঘাড়ে তার মুখ ঘষে ডুবে রাখল।সে জ্বরের ঘোরে কি পাগলের মত প্রলাপ বকছে!জ্বর যেন বেড়েই যাচ্ছে।তার প্রখর উষ্ণ নিঃশ্বাসে আমার ঘাড় গলাও গরম হয়ে উঠছে,শরীরে ঘাম দিয়ে দিচ্ছে।আমার ভীষণ ভয় করতে লাগল।অনেক কষ্টে তাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ঠিক করে শুইয়ে দিলাম।ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজে প্যারাসিটামল বের করে তাকে খাইয়ে দিলাম।মাথায় ভেজা কাপড়ের পট্টি দিলে ভালো হয় তাই ভেবে তা নেওয়ার জন্য উঠতে যাবো কিন্তু তার আগেই নিদ্র আমার হাত ধরে ফেলল।
বলল,
-‘কোথায় যাও বারবার তুমি।আমার কাছে একটু বসে থাকতে পারো না।’
নিদ্র ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না।কথাগুলো বারবার জড়িয়ে আসছে।ফর্সা মুখটা শুকিয়ে জ্বরে লাল রয়েছে,কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে,ঠোঁটটাও শুকিয়ে আছে।
সে জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আমার হাত নিয়ে তার ঘাড়ে ঘসতে লাগল।তার এই অবস্থায় আমার চোখে পানি চলে এলো।এদিকে জ্বরও কমার নাম নিচ্ছে না।
আমি জোর করে তার থেকে হাত ছাড়িয়ে এক ছুটে গিয়ে বাবা মাকে ডেকে আনলাম।মা এসে নিদ্রর পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিতে লাগলো।বাবা ডাক্তারকে খবর দিল।ডাক্তার এসে তাকে চেকআপ করছে।
নিদ্র এখন পুরোপুরি অবচেতন হয়ে পড়ে আছে।তার এই অবস্থা দেখে হঠাৎ করে আমার খুব কান্না পেল।কিছুতেই আঁটকে রাখতে পারছি না।ফস করে কেঁদে দিলাম।আমার কান্নার আওয়াজে সবাই আমার দিকে ফিরে তাকালো।
আমি মুখে হাত দিয়ে কান্না সংবরণ করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই হলো না বরং আরো বাড়তেই লাগলো।আমার কান্নার অবস্থা দেখে এই সিরিয়াস মুহুর্তেও সবাই মৃদু হেসে দিল।
বাবা আমার কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বলল,’দূর পাগলি!এতটুকুর জন্য এভাবে কাঁদতে হয়।ডাক্তার ইনজেকশন লাগিয়ে দিয়েছে এখনই কমে যাবে।’
মা আমার পাশে এসে আমাকে বোঝাতে লাগল।আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।আমার কান্না থামার কোনো নামই নিচ্ছে না।যেনো কোনো অবাধ স্রোতের বাঁধ ভেঙে ভেতর থেকে সব বেড়িয়ে আসছে,যতক্ষণ না পর্যন্ত আসল মানুষ এসে একে আটকাবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ একে থামাতে পারবে না।আমার মন যে নিদ্রর এমন অবচেতনের মত পড়ে থাকা কিছুতেই মানতে পারছে না।আমি চাই এখন নিদ্র উঠে আসুক।তার ঘন কালো ভ্রুগুলো কুঁচকে একটা ধমক দিয়ে বলুক ‘এই মেয়ে এমন ফিছ ফিছ করে কাঁদছো কেনো?কান্না থামাও!নাহলে কিন্তু এখন তোমাকে নিয়ে এই মাঝরাস্তায় সাইকেলে চড়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াবো।আমার এখন একজন সাইকেলে চড়ার সঙ্গী দরকার।’

এই বাড়িতে আমার অনেকটুকু সময় যে কিভাবে কেটে গেল তা বুঝতেই পারলাম না।খুব আপন করে নিয়েছি এই বাড়িকে।খুব আপন করে নিয়েছে এই বাড়ির মানুষ আমাকে।এক অস্পৃশ্য মায়ার বাঁধনে অজান্তেই জড়িয়ে গেছি।মায়ের সাথে চায়ের টেবিলের উড়োধুরো গল্প,বাবার সাথে দাবার কোটে বারবার পরাজয়,স্নিগ্ধর স্টাইলিশ চুলগুলো এলোমেলো করে ওর গালগুলো আচ্ছা মতো টিপে দিয়ে ওর দৌড়ানি খাওয়া সবকিছুর অভ্যাসে পড়ে গেছি।অভ্যাসে পড়েছি নিদ্রর ঘুমন্ত মুখের,ওর অদ্ভুতভাবে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকার,এলোমেলো চুল,মন জুড়ানো সেই হাসি,ফট করে ধমক দেয়া,হঠাৎ আজগুবি আদেশ সবকিছুর।এসব যেন আমার জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে মিশে গেছে।আমাদের বিয়ে কিভাবে হয়েছে,কেন হয়েছে,এর স্থায়ীত্ব কতদিন এসব প্রশ্ন আর এখন আমার মনে জাগে না।একপ্রকার ভুলেই গেছি সেসব।নিদ্রকে আর এখন এই ব্যাপারে প্রশ্ন করে হয়রান করি না।বরং আরো ভয় হয় ওর মুখ থেকে যদি শিঘ্রই শব্দটা শুনে ফেলি!
আমার মন খুঁড়ে নিদ্রর সাথে আমার সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু তা আমার মাপতে ইচ্ছে করে না।ইচ্ছে করে না আমাদের সম্পর্কের সমষ্টির সমীকরণ বের করতে।কারণ জীবনে প্রথম এই কনফিউশন আমার খুব ভালো লাগছে।আমার ভালো লাগে সে যখন আমাকে ধমক দেয়,ভালো লাগে সে যখন আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে,তার সেই পৃথিবী বিক্রি করে দেয়ার মত হাসি আমার ভালো লাগে,তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে।তার হঠাৎ’আমার একজন মানুষ দরকার’বলে আমার উপর জারি করা আজগুবি ইচ্ছে আমার ভালো লাগে,তার দরকার টাকেই আমার ভালোলাগে,তার দরকার পূর্ণ করতে আমার ভালো লাগে।আমার সমস্তটুকু ভালো লাগা জুড়েই যে শুধু নিদ্র রাজ করে চলছে।প্রিয়জন না হলেও তার শুধু প্রয়োজনটুকু মেটানোর জন্য হলেও আমি তার কাছে সারাজীবন থেকে যেতে চাই।তার সেই ‘দরকার’গুলোর পূর্ণকারক হতে চাই।
খুব ইচ্ছে করছে দু দিন জ্বরে ভুগে শুকিয়ে যাওয়া নিদ্রর মলিন মুখটি স্পর্শ করতে।আমার ছোঁয়ায় নিদ্র আবার জেগে উঠে বুঝে ফেলবে না তো!বুঝলে বুঝুক।ইচ্ছেটাকে একটু প্রশ্রয় দিয়ে নিদ্রর খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজানো গালে ধীরে ধীরে আলতো হাতে স্পর্শ করলাম।আমার স্পর্শে নিদ্র চোখ মেলে তাকালো।আমি চমকে উঠে লজ্জা পেয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে নিলাম।নিদ্র মৃদু হেসে বলল,’তুমি নাকি আমার জন্য সেদিন খুব কান্না করেছিলে?’
আমি পিছনে ঘুরে মুচকি হেসে বললাম,’ইশ!আমার বয়েই গেছে আপনার জন্য কান্না করতে!
আমি তো শুধু এমনিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
-‘যে যেটা করতে পারে না তার সেটা না করাই ভালো।নয়তো ধরা পড়ে যায়।’
দুদিন পর তার স্পষ্ট কথাগুলো শুনতে পেরে আমার চোখ ছলছল করে উঠলো।আমি কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে বললাম,’আপনি সেদিন কেনো বৃষ্টিতে ভিজে অফিস থেকে আসতে গেলেন?
জানেন আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম।’
তার কোনো উত্তর না পেয়ে আমি তার দিকে ঘুড়ে দেখলাম সে আবারো ঘুমিয়ে পড়েছে।
যাহ!এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো।আর এদিকে আমার ঘুম যে কোথায় পালিয়ে গেছে!


ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে রোদে শুকোতে দেওয়া মায়ের বানানো কাঁচা আমের আচারের বোরম কোলে তুলে নিয়ে আচার বের করে খাচ্ছি।মৌসুমের নতুন আমের আচার মুখে দিতেই চোখ মুখ বন্ধ হয়ে আসে টকে।দারুন আয়েশে পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে খাচ্ছি।হঠাৎ নিদ্র তার বারান্দা থেকে আমাকে মুখ দিয়ে শব্দ করে ডাকল।আমি বসে আছি ছাদের পেছনের অংশের দিকে।এখান থেকে তার রুমের বারান্দা থেকে ছাদ অনেকটা কাছে।বারান্দার ডান সাইড থেকে সরাসরি দেখা যায়।আমি তার দিকে হালকা তাকিয়ে আবার আচার খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।সে মৃদু হেসে রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বলল,’মেয়েদের আচার খাওয়ার দৃশ্য দেখতে খুব সুন্দর।কুমারী আর বিবাহিত মেয়ে দুটো দুই ধরণের সুন্দর।’
আমি ঈষৎ ভ্রু ভাঁজ করে বললাম,’কুমারী আর বিবাহিত মেয়েদের আচার খাওয়ার আবার মধ্যে পার্থক্য কি?’
-‘কুমারী মেয়েদের আচার খাওয়ার মধ্যে শিশুসুলভতা লুকিয়ে থাকে আর বিবাহিত মেয়েদের আচার খাওয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকে লাজুকতা।দুটোই দুই ধরণের সৌন্দর্য্য ব্যক্ত করে।’

তার কথার আগামাথা কিছু বুঝতে না পেরে আমি আবার আচার খাওয়ার মাঝে মন দিলাম।সে আবার বলল,’এত আচার খেয়ো না।তুমি কিন্তু বিবাহিত,দেখো আবার সবাই ওসব না ভেবে বসে!’
-‘ওসব মানে?’

সে হেসে দু হাত পেটের সম্মুখে ধরে দুলিয়ে দুলিয়ে মুখে বাচ্চাদের কান্নার মত শব্দ করতে লাগল উঁই উঁই…

তার কথা শুনে আমি আর মুখে আচার ঢুকাতে পারলাম না।সে হাসতে হাসতে চলে গেল।আর আমি লজ্জায় পুরো লাল হয়ে রইলাম।


রুমের মধ্যে সোফায় বসে বসে চিপস খাচ্ছি। আমার পাশেই বসানিদ্র,সামনের টি টেবিলে পা তুলে এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে রেখে সে গভীর মনোযোগে ইংলিশ মুভি দেখে যাচ্ছে তার পরনে একটি সবুজ শার্ট থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট।পায়ের বড় বড় লোমগুলো সব ফর্সা পায়ের সাথে লেপ্টে রয়েছে।দেখতে সুন্দর লাগলেও তার পায়ের দিকে বারবার চোখ পড়তেই আমার শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।তার উচিত সব সময় ফুল প্যান্ট পড়ে থাকা।
আমার একটু চিপস মুখে দিয়ে চাবানোতে তার ডিস্টার্ব হচ্ছে।আমিও আস্তে আস্তে চাবানোর চেষ্টা করলেও ক্রান্চি চিপসের শব্দ হয়েই যায়।
এর মাঝে রুমে এই বাড়ির কাজের লোক রহিমা খালা প্রবেশ করে।রহিমা খালা খুব বেশি কথা বলে।তার পেটে কোনো কথা পঁচে না।পঁচার আগেই সে অন্য পেটে রপ্তানি করে দেয়।রহিমা খালা এসেছে লন্ড্রি থেকে আসা কাপড় চোপড় দিয়ে যেতে।আমি উঠে সব ঠিক জায়গায় রাখতে গেলাম।নিদ্র আলমারি থেকে কিছু কাপড়চোপড় বের করে রহিমা খালার হাতে দিতে লাগল আগামীকাল লন্ড্রিতে দেওয়ার জন্য।
রহিমা খালার সেদিকে খেয়াল নেই,সে হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে মুভি দেখে যাচ্ছে।
মুভিতে এখন একটি ছেলে মেয়ের হাগিং সিন হচ্ছে।ছেলে মেয়ে দুটি বেস্ট ফ্রেন্ড,অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় দুজন এক্সাইটমেন্ট আর খুশিতে দুজন দুজনকে লাফিয়ে লাফিয়ে হাগ করছে।একটা নরমাল সিনই।রহিমা খালা সেটাই দেখতে দেখতে মুখ একশ আশি ডিগ্রী কোণে গোল করে হা করে রয়েছে।একসময় নিদ্রকে জিজ্ঞাসা করলো,’ভাইজান এই দুইডা পোলা মাইয়ার কি বিয়া হইছে?
-‘না।’
সে এই কথা শুনে গালে দুই হাত দিয়ে বলল,’হায় ,এয়া কি কন,তাইলে এই পোলা মাইয়া টিভির মধ্যে ঢুইকা এমন জড়াজড়ি করতাছে কে?
রহিমা খালার কথা শুনে আমি খিলখিল করে হেসে দিলাম।
রহিমা খালা আমার হাসিতে আরো উৎসাহিত হয়ে একটু লাজুক ভঙ্গিতে বলল,’ভাইজান আপনি যেডা দেখতাছেন হেইডার নামটা একটু কইয়েন তো আমি আমার উনারে নিয়াও একটু দেখতাম।’

রহিমা খালার কথায় আমার এত হাসি পাচ্ছিলো,তার চলে যাওয়ার পরেও আমি মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।
নিদ্র আবারো সেই অসহায়ের মত তাকিয়ে থেকে হুট করে বলল,’তোমাকে আর কতবার বলতে হবে আমার সামনে এভাবে হাসবে না।’
তার কথায় আমার মুখটা থমথম হয়ে গেল।আবারো সেই এক কথা।মাথায় জেদ চেপে বসল।তার কি শুধু ঐ মেয়ের হাসিই ভালো লাগে যে আর কারো হাসি ভালো লাগে না।
রাগ করে মুখ ফুলিয়ে বললাম,’আমার যেভাবে ইচ্ছা আমি সেভাবেই হাসবো তাতে আপনার কি?’

-‘দেখো আমি কিন্তু তোমাকে মানা করছি।পরে কিছু হলে কিন্তু আমার দোষ নেই।’

-‘তো?আমার তো এভাবেই হাসতে ভালো লাগে,যে যাই করুক আমি তো এভাবেই হাসবো।’

এই বলে আমি আরো ইচ্ছে করে বেশি বেশি মুখ টিপে হাসতে লাগলাম।সে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেঁচকা টানে তার দুই হাতে আমার গাল ধরে আমার ঠোঁট তার ঠোঁটের আয়ত্তে নিয়ে গেল।ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটলো যে চোখ বড় বড় করে আমি পুরো ফ্রিজড হয়ে রইলাম।

চলবে,,
(রেগুলার গল্প দেওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না।এখন থেকে একদিন পর পর গল্প দিব।
Sorry,I am helpless……)

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে