পবিত্র সম্পর্ক পর্ব-০১

1
2332

#পবিত্র_সম্পর্ক
#পর্ব_১
#Nishat_Tasnim_Nishi

বাসরঘরে ভারী লেহেঙ্গা পরে লাল টুকটুকে বউ সেজে বসে আছে রুহি।একটুপর তার সদ্য বিবাহিত স্বামী প্রবেশ করতেই রুহি হাক ছেড়ে বললো,,

–“আমার বয়ফ্রেন্ড আছে!”

কথাটা রোহানের কানে পৌঁছাতেই রোহান কয়েক মুহূর্ত থম মেরে দাড়িয়ে রইলো, হঠাৎ ই এক আকস্মিক কান্ড করে বসলো।ও দৌড়ে এসে রুহি এর গালে কিসি দিয়ে উৎফুল্ল হয়ে বললো,,

–“আমারও গার্লফ্রেন্ড আছে।”

রোহানের কথা শুনে রুহি খুশি হলেও ওর কান্ডতে মেজাজ চটে গিয়েছে।কারন ছোট থেকেই রুহির গালে কেউ কিসি দিলেও রেগে যেতো,রেগে কান্না করে দিতো।কাউকে ওর গাল স্পর্শ করতে দেয় না। কেউ যদি এমন করে তাহলে ওর চৌদ্দগুষ্টির রফাদফা করে দেয়। ও প্রচন্ড রেগে রোহানের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,

—“আপনি তো সেই লেভেলের লুইচ্চা। এক মুখে বলতেছেন আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে আর অন্যমুখে আপনি আমাকে কিস করতেছেন।আপনি তো দুমুখো সাপ।আমার মনে হয় আপনার তো চরিএ তেও সমস্যা আছে।লুচু..!!”

রুহির কথা শুনে রোহানের মেজাজ চটে গেলো।যেহেতু দোষ টা তার তাই সে দমে গেলো।সে নরম গলায় বললো,,,

—“দুঃখিত।আসলে এক্সাইটমেন্টের কারনে আমি ভুল করে ফেলেছি। ”

রোহানের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো রুহি।ও বাজখাই গলায় বলে উঠলো,,

–“দুঃখিত মানে?হোয়াট দুঃখিত? এখন ২০২০ চলতেছে।অভিয়াসলি সবার গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড থাকবে।এটাতে এত এক্সাইটেড হওয়ার কিছু নেই।কই আমি তো হয় নাই! বলেন যে আমাকে কিসি দেওয়ার জন্য এমন করেছেন।”

রুহির কথা শুনে রোহানের মেজাজ খারাপ আরেক ধাপ বেড়ে গেলো। হোয়াট!মেয়েটা বলে কী এসব?ওর মতো মেয়েকে আমি ইশতিয়াক আবরার রোহান কিস দেওয়ার জন্য এমন করেছি!সিরিয়াসলি? ও আমার পরিচয় জানলে কথাটা বলার আগে বহুবার ভাবতে হতো।কথাগুলো মনে মনে ভেবে এবার নিজেকে সে শান্ত করলো না বরং উঁচু গলায় বললো,,

—“নিজেকে কী মনে করেন যে আপনাকে আমি কিসি দেওয়ার বায়না খুজবো?এত ভাব দেখানোর কিছু নাই।চামড়া ফার্মের মুরগীর মতো হলে কেউ সুন্দর হয়ে যায় না।”

রোহানের কথা শুনে রুহি মাথায় এক রাশ রাগের ঝুলি এসে ভর করলো। ও কী বললো?আমি ফার্ম এর মুরগী মানে ও কি আমায় ইনডাইরেক্টলি অপমান করছে?দুইদিনের ছেলের কত বড় সাহস!

রুহি আরো উঁচু গলায় মুখ ভেটকিয়ে বললো,,

—“নিজেকে কেমন লাগে দেখছেন?না দেখলে আয়নাতে দেখে নিয়েন। পুরো মুখে নাক ছাড়া আছে কিছু?এত বড় নাক ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে? এ্যাহ্,,আবার আসছে আমার সৌন্দযের কথা বলতে।”

নাকের কথা শুনে রোহানের মুখ টা একটু চুপসে গেলো। কারন সত্যিই বেচারার নাক টা একটু বোচা। বেচারা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।এ মেয়েটা যে ওকে বোল্ট করে দিবে ও ভাবতেই পারে নি। ও রেগে বললো,,

–“আমাকে যদি দেখতে এতই বিশ্রি লাগে তো বিয়ে করেছিলেন ক্যান?তখন তো পাগল হয়ে বিয়ে করেছিলেন?”

—“এক্সকিউজ মি!আপনাকে পাগল হয়ে বিয়ে করেছি মানে? আমি কি কানা,ল্যাংড়া নাকি যে আপনাকে পাগল হয়ে বিয়ে করবো?উল্টো আপনি পাগল হয়েছেন আমার জন্য।”

—“আপনার মতো হাফ সেন্টিমেন্টাল মেয়ে মানুষকে বিয়ে করার জন্য পাগল হবো আমি??

আপনি নিজেই তো ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে আমার মায়ের সামনে হাজির হয়েছিলেন,আমার গলায় ঝুলার জন্য।”

—“ওই, হেলো!নেচে নেচে এসেছি মানে?শুনুন আমার কোনো এত শখ নেই আপনাকে বিয়ে করার বুঝেছেন।আমি কি জানি নাকি যে আপনার মা আমাকে দেখে আপনাকে বিয়ে করানোর জন্য পাগল হয়ে যাবে।যদি জানতাম তাহলে জীবনে ওই ফাংশনে যেতাম না।আর আমি মেয়েটাই এমন যে, যে কেউ একবার দেখলে পাগল হয়ে যাবে,বুঝেছেন?”

রুহির কথা শুনে রোহানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।একটা মানুষ কীভাবে নিজের এত সুনাম করতে পারে ওকে না দেখলে বুঝাই যেতো না।ও ভাবলো না এর সাথে কথা বলে পারা যাবে না। কপালে বিরক্তির ছাপ নিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো,,

–“জ্বি,খুব ভালো বুঝেছি। এবার একটু নিজের সুনাম বাদ দিয়ে অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললে ভালো হবে।আপনি কেমন আমি দেখতেই পাচ্ছি!বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে, এখন এটা নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই।এটা ভাবেন যে কীভাবে এটার সমাধান করবো।আমি কিন্তুু আপনাকে মেনে নিতে পারবো না,আমার গার্লফ্রেন্ড যদি ক্ষুনাক্ষরে টের পায় তাহলে আমার জীবন শেষ।”

—“আমি বুঝা যায়, আপনাকে মেনে নেওয়ার জন্য বসে আছি।আমিও আমার বয়ফ্রেন্ডকে খুব ভালোবাসি। ও যদি জানতে পারে তাহলে এখনই চলে আসবে।এখনও তিনদিন হয়নি লন্ডন গিয়েছে।”

—“ও আপনার বয়ফ্রেন্ড লন্ডন থাকে?”

—“হুম,দুইদিন আগেই গিয়েছে।একমাসের মধ্যেই ফিরে আসবে।”

—“ওহ,আচ্ছা। তারমানে আমাদের কাছে এক মাসের মতো সময় আছে। ”

—“মানে?”

—“মানে হচ্ছে এ একমাসের মধ্যেই যা করার করতে হবে।আপনার বিএফ ফিরে আসার আগেই আমাদের আলাদা হয়ে যেতে হবে।কিন্তু কীভাবে?”

–“কীভাবে মানে ডিবোর্সের মাধ্যমে।আমি আপনার সাথে একমুহূূ্র্ত থাকতে পারবো না।”

–“অশিক্ষিতদের মতো কথা বলছেন কেনো?এক মাসে ডিবোর্স কীভাবে সম্ভব?”

রুহি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,,,

–“আমার কাছে সব সম্ভব।আমার মামাকে এখনই ফোন দিয়ে বললে এক চুটকিতে করে দিতে পারবে।আমার মামার কলিজার টুকরা আমি।আমার মামা কে জানেন?এ শহরের বিখ্যাত মন্ত্রী শেখ শাহিন শিকদার! মামা এখন সুইজারল্যান্ড এ আছেন,উনি আমার বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানেন না,উনি যদি থাকতেন তাহলে আমার বিয়ে জীবনেও হতো না।মামা আসার পর এসব জানলে তুমুল কান্ড বাঁধিয়ে বসবেন।আমার পুরো পরিবার ষড়যন্ত্র করে আমাকে বিয়ে দিয়েছে,আমি নিজেও জানতাম না আমার বিয়ে ছিলো। আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে বিষয়টা হ্যান্ডেল করা আমার জন্য এক চুটকির ব্যাপার।”

রোহান কিছুটা কৌতুহল নিয়ে বললো,,,

—“আমি রাজি থাকবো না কেনো?কিন্তু কীভাবে করবেন?”

রুহি হাই তুলে বলতে লাগলো,,

—“বেশি কিছু না,শুধু বলবো আপনি আমায় খুব মেরেছেন। এরপর আমার রাস্তা ক্লিয়ার,মামা আপনাকে গায়েব করে দিবে।”

রোহান চোখ বড় বড় করে বললো,,

—“কিহ?আমি আপনাকে কখন মারলাম? ”

রুহি দাত কেলিয়ে বললো,,

—“আমার গালে কিসি দেওয়ার ফল এটা। ”

–“আপনি এমনটা করতে পারেন না। এমন হলে তো উনি আমাকে মেরেই ফেলবেন।”

–“কিসি দেওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিলো।”

কথাটা বলেই রুহি বিছানার উপর উল্টে শুয়ে পড়লো।

রুহির এমন ঠান্ডা মাথার ধমকি শুনে রোহান কিছুটা ভয়ের রেখা মুখে ফুটিয়ে তুললো। ও খুব ভালো করেই চিনে শাহিন শিকদারকে। উনার আন্ডারেই তো সব। উনি যদি চায় তাহলে ওকে এক মিনিটে শেষ করে দিবে। এই শাহিন শিকদার দেখতে যতটা শান্ত আর ভদ্র আসলে সে এমন নয়।তার সাথে কেউ কিছু করলে পরের দিন আর সেই ব্যক্তির হাদিস পাওয়া যায় না। এগুলো ও খুব ভালে করেই জানে। এসব ভেবে ও রুহির কাছে গিয়ে কোকিলের কন্ঠে বললো,,

–“সরি। প্লিজ ক্ষমা করে দেন আমি আর এমন করবো না। প্লিজ প্লিজ।”

এমন অনেকবার মিনতি করার পর রুহি এক চোখে খুলে বললো,,

—“ঠিক আছে,ঠিক আছে। আমি অন্য কোনো উপায় ভেবে নিবো।”

কথাটা বলে রুহি অন্যদিকে উল্টে শুয়ে পড়লো। রুহির কথা শুনে রোহান রহস্যময় হাসি দিলো। যার কারন শুধু ও নিজেই জানে।

এদিকে রুহি উল্টে পড়ে আফসোস করতে লাগলো যে ও কেনো সেদিন প্রিয়ন্তির বিয়ের ফাংশনে গিয়েছিলো। সেদিন প্রিয়ন্তি অর্থাৎ রুহির বেস্টি বিয়ে ছিলো। বেস্টির বিয়ে বলে রুহি একদম ঝাকানাকা সাজ দিয়েছিলো।মিশির গায়ের রং ধবধবে ফর্সা,ঠোঁট দুটো একদম চিকন,আবার নিচের ঠোঁটের নিচে ছোট্ট একটা কুচকচে কালো তিল আছে,গলার খানিকটা নিচে বামপাশেও একটা গাঢ় কালো তিল রয়েছে,চোখ দুটো হরিনের চোখের মতো,চোখের পাপড়িগুলো বড়বড় মনে হয় যেনো আইলানার দেওয়া,আর জোড় ভ্রু এর জন্য সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় লাগে। বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে বলে সেদিন ভালো করে সেজে লাল শাড়ি পরেছিলো।সেখানেই রোহানের মা ও সেদিন ফাংশনে উপস্থিত ছিলেন। রুহিকে সেখানে দেখেই উনি তৎক্ষণাত পছন্দ করে ফেলেন। ওখানে বসে রুহির পুরো ফ্যামিলির সাথে কথা বলে ফেলে।

রোহান রা দুই-ভাই বোন। বোন টা রোহানের ছোট,প্রায় রুহির সমবয়সী।তবে রুহি থেকে ২-৩ বছরের ছোট। ওদের ফ্যামিলি অবস্থা ও রুহিদের মতো। রোহানের পরিবার রা বেশিরভাগ সময়ই দেশের বাহিরে থাকে।রোহানের বাবার প্যারিস শহরের একজন বিজনেসম্যান। কিন্তু রোহান সেখানে চাকরী করে না।ও নিজে সাবলম্বী হতে চায়,নিজের যোগ্যতায় কাজ করতে পছন্দ করে। রোহান প্যারিসের একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে। গত কয়েক মাস হয়েছে দেশে এসেছে।

রুহির পরিবার ও রোহানদের অবস্থা দেখে আর না করে নি। উনারা জানে যে রুহির মামা থাকলে কখনই ওদের বিয়ে হবে না।কারন রুহি যা বলে উনি তাই করে, একমাত্র আদরের ভাগ্নী।কিন্তু তাই বলে উপযুক্ত মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখবে,এ কথা তো কিছুতেই উনারা বুঝাতে পারেন না।তাই উনারা বুদ্ধি খাটিয়ে সারপ্রাইজ বলে ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়।

হঠাৎ ফোনের আওয়াজ শুনে রুহি ভ্রু দুটো কুচকে চোখ খুললো। ও তাকিয়ে দেখে রোহান ফোন হাতে নিয়ে ব্লাশিং করছে। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রোহানের দিকে,লজ্জা পেলে ছেলেদের যে এত সুন্দর লাগে ও ওর আগে কখন দেখে নি। ও ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। রোহানের কথা বলার ভাব-ভঙ্গি দেখে ও বুঝলো যে,, নিশ্চিত গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে। ও নিজে নিজে ভাবলো কই ও তো রেদোয়ানের সাথে কথা বলার সময় এমন করে না,,আর না রেদোয়ান করে। হু হু,,তাই বলে কী ও ভালোবাসে না।মোটেও না, কত ভালোবাসে।

একটুপর ও উঠে গিয়ে রোহানকে খোঁচা দিলো। রোহান বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো কী? রুহি ইশারায় বললো,, ফোন দিতে। রোহান মোবাইল টা কান থেকে সরিয়ে বললো,,

–“দেখছেন না, কথা বলছি।”

—“তো?আমিও কথা বলবো।”

—“তো বলুন।আমাকে জ্বালাচ্ছেন কেনো?”

—“আজব তো।আপনি জানেন না আমার কাছে ফোন নেই।ফোন থাকলে কি আপনার থেকে খুজতে আসতাম।”

–“ওহ।আচ্ছা একটু ওয়েট করুন আমি কথা শেষ করে নেই।”

—“আমি ওয়েট করতে পারবো না।আপনি দিন।”

—“আপনি এমনভাবে জিদ ধরছেন মনে হচ্ছে যেনো আপনার ফোন। ”

হ্যা,আমার ফোন বলে, রুহি ওর হাত থেকে ফোন টান দিলো।

আরে কী করছেন,বলে রোহান রুহির হাত থেকে ফোন টান দিলো।

এবার দুজনেই ফোন হাতাহাতি করতে করতে বললো,,”আমাকে দিন!”

ওদের হাতাহাতির মধ্যেই ফোনের স্পিকার টা অন হয়ে যায়।তখনই ফোনের ওপাশ থেকে সুরেলী কন্ঠে একটা মেয়ে ন্যাকা কান্না করে বললো,,,

—“বেবী,তুমি কার সাথে আছো?তোমার সাথে মেয়ে কেনো?তুমি আমাকে ধোকা দিচ্ছো?এ্যা,এ্যা!”

–“না,না।বাবু,তুমি ভুল ভাবছো।আমি কোনো মেয়ের সাথে নেই।”

কথাটা বলে রোহান রুহির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,,”আমার ফোন দিন।”

রুহি ফিসফিস করে বললো,,”আপনি ছাড়ুন।নাহলে এখন আমি যা করবো পরে পস্তাতে হবে।”

রোহান ওর কথা শুনেও শুনলো না।জিদ দেখিয়ে ফোন হাতাহাতি করতে লাগলো।

রোহান ছাড়ছে না দেখে রুহি ফোনের সামনে মুখ নিয়ে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো,,”লাভ ইউ জানু।আমি জানি তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো,তাই তো আমাকে এত সুন্দর ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছো।এখন আবার এখানে ঘুরতেও নিয়ে এসেছেন।আই লাভ ইউ বাবু,উম্মাহ..!!”

.

চলবে?

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে