কালো মাইয়া কালো বইলা কইরো নাকো হেলা

1
980

ইয়া মাবুদ, এই মাইয়ারে দেখতে তো বাতি জ্বালান লাগবো’ আমি হওয়ার পর লোকমুখে এটাই সবচেয়ে বেশী শোনা কথা ছিল আমার মায়ের জন্য।
‘ বাপের সহায় সম্পদ এই মেয়েরে বিয়া দিতেই শেষ হইবো। তাও যদি এই কালো মেয়েরে কেউ দয়া কইরা বিবাহ করে।’ এটা ছিল আমার সম্পর্কে বাবার লোকমুখে সবচেয়ে বেশিবার শোনা কথা।
এই কথা গুলো কখনো কাছের লোকে বলেছে কখনো দূরের লোকে। কেউ কেউ হাসতে হাসতে বলেছে কেউ কেউ মন খারাপ করে।
শুধু যে যার মনে আসা কথাগুলো অভব্যের মতো বলে দিয়েই খালাস হয়েছে। যেন এ কথাগুলো না শুনালে আমার বাবা মায়ের জীবন থমকে যাচ্ছিল। একবারও কেউ বোঝার চেষ্টা করেনি কথাগুলো মেয়েটার বাবামায়ের মনের কোন কুঠুরীতে আঘাত করতে পারে?

নিজে যখন একটু বড় হলাম তখন থেকে মা বাবার সাথে লোকের কথা নিজেও শুনতে শুরু করলাম। এক আধজনের মুখের ওপর কথা ফিরিয়েও দিয়েছিলাম। মা বোঝায় তাতে নাকী লোকে বেয়াদপ বলবে। মুখ দিয়ে নয় কাজ দিয়ে নাকি ওসব কথার জবাব দিতে হয়। কি জানি কি কাজ করলে পরে ঐ লোকগুলোর মুখ বন্ধ করা যাবে তা আমার ছোট মাথায় সেভাবে ঢোকেনি তখন। পড়াশোনা খুব একটা করতে চাইতাম না তবে আমার বাবা খুব সুন্দর করে পড়াতেন। সারাদিন শেষে অফিস ফেরত বাবার থেকে ঐ সময়টুকু পাওয়ার লোভেই পড়াশোনা করতাম। তাছাড়া কোন কারণে কখনো পড়া না পারলে কিছু শিক্ষক খুব বাজে বকুনী দিতেন। বেশীরভাগ ছাত্রীর বকুনী এক জায়গায় থামলেও আমার মতো রংয়ের যারা ছিল তারা দু লাইন বেশীই শুনতো। বলতেন, ‘পড়বি কেন? পরের ঘাড়ে উঠে খাবি এইতো ইচ্ছা। গায়ের যা রং তা দিয়ে যে কারো ঘাড়ে উঠে খাবি সেই আশাও তো কম।’ সেই কথার লজ্জা এড়াতেই পড়া করে যেতাম স্কুলে।

স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠলাম। বান্ধবীরা কেউ কেউ তখন প্রেম পত্র পাচ্ছে, কেউ প্রেম করছে। শুধু আমার জন্য কেউ বরাদ্দ নেই। আমাদের সামনের বাসায় থাকতেন তানিম ভাইয়েরা। পুরো পাড়ায় ওনার খুব সুনাম ছিল। ভালো ছাত্র, দেখতে ভালো। আমার কি যে হলো আমি পড়ার ফাঁকে সুযোগ পেলেই ওনাকে একনজর জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতাম। আমি আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখছি এটা খুব ভালো বুঝলেও কেন যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারতামনা। কিশোরী বয়সের আবেগ বলে কথা। সেই তানিম ভাই যেদিন ডেকে বললেন দোতলার কথা আপাকে চিঠি পৌঁছে দিতে আমার ইচ্ছে করছিলো মরে যাই। বুঝে গিয়েছিলাম কিছু স্বপ্ন সবার দেখতে হয়না।

মা ছোটবেলা থেকে সবসময় বলতেন নিজেকে যোগ্য করে তোলো, তোমার যোগ্যতার আলোয় যেন তোমার গায়ের রং ঢাকা পরে যায়। লোকে দুকথা বলতে যেন চিন্তা করতে হয়। কিন্তু আমি ভাবতাম চাইলেই কি সব হয়? নিজের অপরিসীম চেষ্টায় দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠে পড়ার সুযোগ মেলে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি ভালো রেজাল্ট আমাকে করতেই হবে। সবাই যখন ক্যাম্পাসে হুল্লোড় করে বেড়াতো আমি তখন মনোযোগ দিয়ে সব ক্লাস করতাম। এমনি একদিন ক্লাসে নিজের ডেস্কে একটা ছোট্ট চিরকুট পাই, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি। মেঘলা দিনে দেখেছিলেম তার কালো হরিণ চোখ।’ পরপর কয়েকদিনে কয়েকটা এরকম ছোট ছোট মায়াভরা চিরকুট আসে। বলতে দ্বিধা নেই মনে মনে আমিও বুঝি একটুখানিক স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। তারপর আসে সেই কাঙ্খিত চিঠি আমার সাথে সেই অজানা মানুষ দেখা করতে চায়। কি যে এক অজানা ভয়, শিহরণ, ভালো লাগার এক অব্যক্ত অনুভূতি তা বুঝি ভাষায় প্রকাশের নয়। উল্লেখিত স্থানে যেয়ে দেখি আমার ক্লাসের অনেকেই উপস্থিত। এমনকি আমার কিছু কাছের বান্ধবী ও। কথা বলতে এগিয়ে আসে ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে তারেক। আমি কোন ক্লাস ফাঁকি না দেয়াতে আমার সাথে তারা এরকম একটা মজা করেছে। তারেকই নাকি মূলত চিঠিগুলো লিখতো। লজ্জায় অপমানে আমি যখন মুখ ঘুরিয়ে রওয়ানা দিয়ে চলে আসছি পেছনে তখন বয়ে যায় কলকল হাসির ধ্বনি।

হোস্টেল থেকে বাসায় চলে আসি কাউকে কিছু না বলে। ভেবেছিলাম আর কখনো ক্যাম্পাসে ফিরে যাবোনা। আমার নিশ্চুপ নীরবতার মানে আমার মা কতটুকু বুঝেছিলেন জানিনা। শুধু নিজের মনে বলে যান, ‘কারো থেকে কষ্ট পেয়ে যদি নিজেকে শেষ করে দাও তবে তুমি একটা নীচু মনের মানুষের কাছে হেরে গেলে; যে বা যারা কিনা তোমাকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করেনি। এমন বন্ধু থাকার চেয়ে না থাকাই তো ভালো।’ মায়ের কথায় নিজেকে সামলে নেই। কষ্ট হয় অনেক কিন্তু ফিরে যাই ক্যাম্পাসে, নিজেকে ব্যস্ত করে তুলি আরো বেশী পড়াশোনার জগতে। তেমনি কোন এক পড়ায় ব্যস্ত দুপুরে লাইব্রেরীতে রায়হান নামে আমারই এক সহপাঠী এসে পাশে বসে।

সেদিন তারেকদের ওরকম ব্যবহারের জন্য আমি খুব সরি রাত্রি।

– এটা কি আমাকে নিয়ে তামাশা করার দ্বিতীয় অংশ?

না না রাত্রি। আমি খুবই অনুতপ্ত। আমি ওদেরকে অনেক নিষেধ করেছি জানো। ওরা কেউ আমার কথা শোনেনি।

– জেনে খুশী হলাম। তুমি কি আর কিছু বলবে?

তারপর আর কথা জমেনা রায়হানের সাথে। হয়নি তেমন কোন বাক্য বিনিময়ও যতদিন ক্যাম্পাসে ছিলাম। যদিও নজরে পরেছিল অনেকবারই আমার চলার পথে নানা সময়ে তার নীরব উপস্থিতি।

বিয়ের বাজারে কতবার ধাক্কা খেয়েছি সে কথা বলতে গেলে বোধহয় উপন্যাস হয়ে যাবে। চাকুরীর বাজারেও আমার ভালো ফলাফলের চেয়ে আমার গায়ের রং আর চেহারা সমস্যার যখন মুখোমুখি হলাম তখন জেদ করেই খুব অল্প পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করি। হাতের কাজের জিনিসপত্রের একটা ছোট্ট দোকান দিয়ে শুরু হয় আমার নিজের উপার্জন।
বাবামা খুব ভাবতেন আমাকে নিয়ে, সঙ্গীবিহীন কিভাবে যাবে আমার ভবিষ্যত? তবে আমার বারেবারে হওয়া অপমানিত মুখের দিকে তাকিয়ে জোর করেননি আর।

………………

গত সপ্তাহে অফিসে আমার নামে একটা চিঠি এসেছে। এ বছরের ‘আউটস্ট্যান্ডিং ওমেন ইন বিজনেস’ এওয়ার্ডের জন্য আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। আজকের রাতটা আমার জন্য গত দশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পারিশ্রমিক পাওয়ার রাত। আমার সেদিনের একলা হাতে শুরু করা ব্যবসার প্রসার দিনে দিনে ছড়িয়েছে পুরো দেশ তথা বিশ্বজুড়ে। আমাকে আমার লক্ষ্যে পৌঁছতে আমার বাবা মায়ের পাশে আরেকজনের নামও যে নিতে হয়। সেই কোন এক ক্লান্ত দুপুরে লাইব্রেরীতে সরি বলতে আসা সেই মানুষটা ভালবেসে আমার জীবনে নিজে থেকেই এসেছে।

কিছু লোকে আনন্দই পায় অন্যকে ছোট করে। মতান্তরে যে তার নিজের নীচু মনের মুখোশ নগ্ন হয়ে ধরা দেয় তা তারা বুঝলে তো? সেসব লোকের মুখের কথা ফিরিয়ে না দিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় নিজের যোগ্যতাটুকু। আর তার জন্য প্রয়োজন হয় জীবনের মূল্যবান কিছু সময়, অসীম ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রম আর সততা।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে