একটু ভালোবাসা পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

1
1560

পর্ব ১২ এবং শেষ পর্ব
#একটু_ভালোবাসা
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________

রাত প্রায় দুটোর মতো বাজে। রিশাদ ঘুমিয়ে গেছে আরো আগেই। রিশাদের চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার হয়েছিল মনের ভেতর। মানুষটা ভীষণ রকম ভালো। আল্লাহ্ তার মনের সব দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিক। মাকে সুস্থ করে দিক। মা না থাকার কষ্টটা কখনো যেন কেউ অনুভব না করে। সবার মাকে আল্লাহ্ বাঁচিয়ে রাখুক হাজার বছর।

প্রিয়ুর চোখে ঘুম নেই। খিদেয় পেটের ভেতর চো চো করছে। পেটে খিদে থাকলে ঘুমও আসতে চায় না। তাই প্রিয়ু ফ্রিজ খুলে দেখে খাবার কী কী আছে। এখন ঠান্ডা খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না আবার গরমও করতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া রিশাদ নিজেই যেখানে না খেয়ে আছে সেখানে প্রিয়ু কখনোই রিশাদকে ছাড়া খেতে পারবে না। কোকের বোতল দেখতে পেয়ে একটা বোতল হাতে নেয়। গন্ধ শুকে দেখে মদ মেশানো আছে নাকি। না নেই! কোক নিয়ে আবারও ফ্লোরে বসে পড়ে। কোক খেতে গিয়ে আমিনের কথা মনে পড়ে। প্রিয়ুর জানামতে আমিনের এত ভালোবাসা কখনো দেখেছে বলে তো মনে হয় না। প্রিয়ু তো দূরের কথা, আশাকেও কখনো কিছু কিনে দেয়নি। তাহলে আজ কেন? তাও আবার অর্ধেক খাওয়া কোক। এসে দিয়েই চলে গেল। এতে কি কোনো মারপ্যাঁচ আছে? প্রিয়ু একটু নড়েচড়ে বসে। মনের ভেতর কেমন যেন কু গাইছে। অস্থির অস্থির লাগছে। বাড়িতে আবার কেউ নেই। আশা এখন একা আছে। প্রিয়ু কিছুক্ষণ পায়চারী করতে থাকে রুমের ভেতর। এরপর সিদ্ধান্ত নেয় এখনই বাড়িতে যাবে। টেবিলের ওপর থেকে কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসে, ‘আমার অস্থির লাগছে খুব রিশাদ। আমার বাড়িতে যেতে হবে। তুমি ঘুমিয়ে আছো তাই আর তোমায় ডাকিনি।’ চিরকুটটা রিশাদের বালিশের নিচে রেখে প্রিয়ু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। মেইন গেটে গিয়ে সালাম চাচাকে বলে,
“আঙ্কেল আমি বাড়িতে যাচ্ছি। রিশাদ চিরকুটটা দেখবে নাকি আমি শিওর নই। রিশাদ অফিসে যাওয়ার সময় বলে দিয়েন আমি বাড়িতে গেছি।”
সালাম চাচার উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রিয়ু চলে যায়।

পথে প্রিয়ুর সঙ্গে সিয়ামের দেখা হয়ে যায়। প্রিয়ু সিয়ামকে খেয়াল করেনি। সিয়ামই প্রিয়ুকে দেখতে পেয়ে ডাক দেয়।
“আরে প্রিয়ু না?”
প্রিয়ু পিছনে ফিরে তাকায়। সিয়ামকে দেখে বলে,
“আপনি এখানে?”
“আমার এক পরিচিত ফ্রেন্ডের বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বন্ধুর বাবাকেই দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?”
“বাড়িতে যাচ্ছি।”
“ছিলেন কোথায়?”
“ছিলাম এক জায়গায়।”
“চলুন বাড়িতে এগিয়ে দিয়ে আসি।”
“না, লাগবে না। আমি একাই যেতে পারব।”
“তবুও আমি এগিয়ে দিতে চাই।”

প্রিয়ু কী ভেবে যেন বলল,
“ঠিকাছে।”
দুজন কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে।
.
হানিফের সাথে তর্কাতর্কি হচ্ছে আমিনের। যেই টাকাটা আমিনকে দেওয়ার কথা ছিল সেই টাকা হানিফ দিতে নারাজ এখন। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পুরো টাকাই দেয় হানিফ। একটা কাজে আটকে যাওয়ার কারণে যেসময়ে যাওয়ার কথা ছিল সেই সময়ে যেতে পারেনি। হানিফ আমিনের বাসায় যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন ছেলেরা এসে আমিনকে মারধোর করে টাকা সব নিয়ে যায়। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকায় আমিন ওদের কাউকেই চিনতে পারেনি। রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে।
দূর থেকে কাউকে পড়ে থাকতে দেখে প্রিয়ু আর আমিন এগিয়ে আসে। আমিনকে দেখে দুজনই বেশ চমকে যায়। তারচেয়েও বেশি চমকে যায় আমিন নিজে। নেশাগ্রস্থ থাকলেও প্রিয়ুকে চিনতে ওর কখনোই ভুল হবে না। প্রিয়ু আমিনকে ধরে বলে,
“তোমার এই অবস্থা কেন? কে মেরেছে তোমায়?”
আমিন প্রিয়ুর দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে বলে,
“তুই এখানে কেন? তুই কোথায় ছিলি? তুই প্রিয়ু?”
সিয়াম আর প্রিয়ু দুজনই দুজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। প্রিয়ু বলে,
“হ্যাঁ, আমিই প্রিয়ু। তুমি এমন করছ কেন? আশা আপুকে রেখে তুমি এখানেই বা কী করছ?”
সবচেয়ে বড় ধাক্কা বোধ হয় এখন আমিন খায়। অবাক হয়ে বলে,
“আশা বাড়িতে?”
“হ্যাঁ।”
আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না আমিন। দৌঁড়াতে শুরু করে। একটু পরপর হোঁচট খাচ্ছে তবুও থামছে না। ওর পেছনে সিয়াম আর প্রিয়ুও দৌঁড়াতে থাকে।
.
.
এলোমেলো হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে আশা। হানিফ ফোনের লাইট অন করে প্রিয়ুর বদলে আশাকে দেখতে পায়। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় হানিফের। টাকা নিয়ে এত ঝামেলা করল আর শেষমেশ কী না প্রিয়ুর বদলে আশা! সে যাই হোক, টাকা তো উসুল করতে হবে। ঘুমন্ত আশার দিকে এগিয়ে যায় হানিফ। গা থেকে ওড়না সরাতেই দরজায় করাঘাত করতে থাকে আমিন। ক্রমশ করাঘাতের শব্দ বাড়তে থাকে। আমিন জোরে জোরে করাঘাত করতে করতে ডাকতে থাকে হানিফকে।
“দরজা খোল! হানিফ দরজা খোল।”

হানিফ দরজা খোলে না। আশেপাশের বাড়ির মানুষজনও ঘুম থেকে উঠে যায়। দেখতে আসে কী হয়েছে। আমিন কিছু বলছে না। ওর পায়ের নিচের মাটিকে হালকা মনে হচ্ছে ভীষণ। বিরক্ত হয়ে হানিফ দরজা খুলে। ততক্ষণে হানিফের সাথে দেখতে পায় এলাকার আরো মানুষজনকে। দেখতে পায় প্রিয়ু আর সিয়ামকেও। থতমত খেয়ে যায় হানিফ। হানিফকে দেখে সবাই খুব অবাক হয়। আমিন হানিফের শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,
“দরজা খুলতে এত দেরি করলি কেন? কী করছিস তুই আমার বোনের সাথে?”
আমিন থতমত খেয়ে বলে,
“কী যা তা বলছিস?”
প্রিয়ু তাড়াতাড়ি রুমে ঢোকে। সাথে যায় আরো কয়েকজন মহিলা।

—————————–
ভোরের আলোর সাথে নিভে যাচ্ছে আশার নিজের জীবনের আলো। এক পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কাঁদছে। অন্যদিকে এলাকার মানুষরা সবাই ছিঃ ছিঃ করছে। আলেয়া বেগম, মনসুর আলী খবর পেয়েই ছুটে এসেছে। আমিন ক্ষেপে আছে হানিফের ওপর। এত মানুষের এত কথা শুনতে না পেরে আমিন আবারও হানিফকে মারতে যায়। হানিফও এবার রেগে গিয়ে বলে ফেলে,
“টাকা নেওয়ার সময় মনে ছিল না? আজকে যদি আশার জায়গা প্রিয়ু থাকত তখন তো তুই মারতে আসতি না। তাছাড়া তোর সাথে তো আমার ডিল হইছিল প্রিয়ুকে নিয়ে।”

আমিন এবার থেমে যায়। পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায় সবার কাছে। হানিফ সবকিছু খুলে বলে সবাইকে। একটা মানুষ এতটাও নিচে নামতে পারে! আশা এতক্ষণ কাঁদলেও এবার তেড়ে যায় আমিনের দিকে। সিয়াম আটকে রাখে আশাকে। প্রিয়ু আমিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
“টাকার জন্য এত নিচেও নেমে গেছ তুমি? শুধু মাত্র তোমার আপন বোন নই বলে? আজকে যদি আপুর জায়গায় আমি থাকতাম। আমার সাথে…”
প্রিয়ু পুরো কথা বলতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে। তারপর ঠাটিয়ে থাপ্পড় বসায় আমিনের গালে। ইচ্ছেমতো থাপ্রাতে থাকে আর বলে,
“তুই তো মানুষ না। জানোয়ার তুই! অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে যে সেই গর্তে নিজেকেই পড়তে হয় সেটা দেখলি তুই? আজ যদি আমরা না আসতাম? তাহলে আপুর কত বড় ক্ষতি হয়ে যেত বুঝতে পারছিস তুই? অবশ্য তুই তো চেয়েছিলি আমার ক্ষতি।”

আলেয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়ুর দিকে তেড়ে আসে। হাত চেপে ধরে বলে,
“এইসব কিছুর পেছনে তোর হাত আছে। তোর জন্যই এসব হইছে।”
প্রিয়ু হাত ঝটকা মেরে ফেলে দিয়ে বলে,
“এতকিছুর পরও! এতকিছুর পরও অন্ধ হয়ে তুমি আমার দোষ দেখছ?”
“ওরে ছাড়ো।” বলেন মনসুর আলী।
এলাকার গুণীজনরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে হানিফের সঙ্গেই আশার বিয়ে দেবে। এর ঘোর প্রতিবাদ জানায় প্রিয়ু। এরকম চরিত্রহীন ছেলের সাথে বোনের বিয়ে দেবে না প্রিয়ু। এই প্রথম প্রিয়ুকে সাপোর্ট করে আমিনও। আমিন সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
“ওর সঙ্গে আমার বোনের বিয়ে দিমু না আমি।”
আলেয়া বেগম চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন,
“তুই কোনো কথাই বলবি না আর। এই মাইয়ারে এখন কেডায় বিয়া করব? সমাজে মুখ দেখাইতে পারমু আমরা কেউ?”
সিয়ামের উদ্দেশ্যে কঠিন এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় প্রিয়ু। জিজ্ঞেস করে,
“আমার আপুকে বিয়ে করবেন ডাক্তারবাবু?”
উত্তর দিতে সময় নেয় না সিয়াম। আশার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি আশাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতাম। আমি জানি, এখানে আশার কোনো দোষ নেই। আশার যদি কোনো ক্ষতিও হয়ে যেত তবুও আমি আশাকে বিয়ে করতাম। আমি আশাকে বিয়ে করতে রাজি। আমি সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা দিচ্ছি, আবার পরিবারকে নিয়ে আমি আজই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসব। আর আজই আমাদের বিয়ে হবে।”

যেখানে সিয়াম নিজেই বিয়ে করতে রাজি হয় সেখানে আশার পরিবার বা এলাকার অন্য কেউই দ্বিমত করে না। সিয়ামের উত্তরে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় প্রিয়ু। আশার জীবনে নতুন আশার আলো হয়ে আসছে সিয়াম। ডাক্তারবাবু!
মানুষজনের ভীড় কমেছে। সিয়াম বাড়িতে গিয়েছে ওর পরিবারকে সাথে করে নিয়ে আসতে। বাড়ির প্রতিটা মানুষ স্তব্ধ হয়ে আছে।

রিশাদ লাঞ্চ টাইমে প্রিয়ুদের বাড়িতে আসে। হঠাৎ করে ওমন চিরকুট ও সালাম চাচার মুখে প্রিয়ুর অস্থিরতা শুনে রিশাদ নিজেও কিছুটা ভয় পেয়ে গেছে। তাই আর কিছু না ভেবেই প্রিয়ুদের বাসায় চলে এসেছে। বাড়িতে ঢুকেই রিশাদের সাথে দেখা হয় আলেয়া বেগমের। সালাম দিয়ে রিশাদ জিজ্ঞেস করে,
“প্রিয়ু বাড়িতে আছে?”
আলেয়া বেগম জিজ্ঞেস করেন,
“তুমি কে?”

#পর্ব_১৩(অন্তিম পর্ব)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________

প্রিয়ু ঘর থেকেই রিশাদের কণ্ঠ শুনে দৌঁড়ে বাইরে আসে। প্রিয়ুকে দেখে অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচে রিশাদ। প্রিয়ু এগিয়ে এসে বলে,
“আপনি এখানে?” রিশাদকে কিছু বলতে না দিয়েই প্রিয়ু আবার বলে, “আসুন ঘরে আসুন।”
“না, হাতে সময় নেই বেশি। পরে একদিন আসব। এখন যাই।”
প্রিয়ুও আর আটকায় না। রিশাদের মুখ দেখেই অস্বস্তিটা আন্দাজ করতে পেরেছে। আলেয়া বেগম এতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলেন রিশাদকে।

ছেলের খুশিতেই সকলে খুশি বলে সিয়ামের পরিবার আর দ্বিমত করেনি। রাজি হয়ে গিয়েছে আশাকে বাড়ির বউ করে আনতে। আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ঘরোয়াভাবে বিয়ে হবে এখন। সন্ধ্যার মধ্যেই সিয়াম ওর পরিবার নিয়ে আশাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়। এলাকার মুরুব্বী ও কাছের কয়েকজন আত্মীয়দের নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আশার বিয়েতে সাহিলও এসেছিল ওর মেয়ে সিন্থিয়াকে নিয়ে। প্রিয়ু দৌঁড়ে দৌঁড়ে সব কাজে সাহায্য করছিল আলেয়া বেগমকে। আজ প্রিয়ু খুব খুশি। আপুর বিয়ে হবে তাও আবার তার পছন্দের মানুষটার সাথেই। বিয়ে পড়ানো শেষে যখন সবাই খেতে বসে তখন সিন্থিয়া প্রিয়ুর কাছে এসে হাত ধরে বলে,
“আম্মু পানি খাব।”
লোক সমাগমের উপস্থিত থাকায় হৈচৈ বেশ ভালোই। তাই বাচ্চা মেয়েটি কী বলে প্রিয়ুকে সম্বোধন করেছে তা পরিষ্কার শুনতে পায়নি। প্রিয়ু কিছু বলছে না বলে সিন্থিয়া আবার বলে,
“আম্মু পানি খাব।”
প্রিয়ু এবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সিন্থিয়া বা সাহিল ওদের কাউকেই চেনে না। বাবা নাকি মা দাওয়াত দিয়েছে সেটাও জানে না প্রিয়ু। তবে মৃদু হেসে পানির গ্লাস তুলে দেয় সিন্থিয়ার হাতে। পানি পান করা শেষ হলে প্রিয়ু ও’কে এক সাইডে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি আমায় আম্মু ডাকলে কেন?”
“আব্বু বলেছে, তুমি আমার আম্মু হবে।”
প্রিয়ু এবার ফিক করে হেসে ফেলে। হেসে হেসেই বলে,
“হয়তো অন্য কারো কথা বলেছে।”
“না। তোমার কথাই বলেছে।”
মেয়েটার কনফিডেন্স দেখে এবার সত্যিই ঘাবড়ে যায় প্রিয়ু। তাই সিন্থিয়াকে বলে,
“তোমার আব্বু কে?”
সিন্থিয়া প্রিয়ুর হাত ধরে আমিনের রুমে নিয়ে যায়। বিছানায় টান হয়ে শুয়ে ছিল সাহিল। মেয়ে আর প্রিয়ুকে দেখে পা ভাঁজ করে বসে। প্রিয়ু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সিন্থিয়া সাহিলের কাছে গিয়ে বলে,

“আব্বু তুমি না বলেছ, ও আমার আম্মু হয়? আম্মু তো আমার কথা বিশ্বাস করে না।”
“আপনি সত্যিই ও’কে এসব বলেছেন?” জিজ্ঞেস করে প্রিয়ু। সাহিলের সোজাসাপ্টা উত্তর,
“হ্যাঁ।”
“এসব বলার মানে কী?”
“ভুল কিছু তো বলিনি প্রিয়ু। খুব শীঘ্রই তুমি আমার বউ আর সিন্থিয়ার মা হতে চলেছ।”
“পাগল হয়ে গেছেন নাকি আপনি? আর আপনি কে হ্যাঁ? কেন এসেছেন আমাদের বাসায়?”
“আমি তো এসেছি তোমায় দেখতে।”

প্রিয়ুর কাছে সাহিলকে পাগল ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। পাগলের পাগলামি দেখার মতো কোনো ইচ্ছে নেই প্রিয়ুর। তাই রাগে হনহনিয়ে আমিনের ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সাহিল মুচকি মুচকি হাসে। সিন্থিয়া বলে, “আম্মুর কি খুব রাগ?” সাহিল মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “রাগী মেয়েদের মন ভালো হয়। আর তোমার আম্মুও অনেক ভালো।”
.
আশার বিয়ের পর থেকে সিয়ামের সাথেই ওর বাসায় থাকে। ভীষণ সুখী এখন আশা। প্রিয়ু প্রায়ই গিয়ে দেখে আসে আশাকে। যখন আশার সুখী মুখটা দেখে তখন প্রিয়ুর মনে হয় সুখ বোধ হয় দেখার ভাগ্য হচ্ছে এখন প্রিয়ুর। কিন্তু আশা শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার পর থেকেই বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মন টিকে না একদম। রাতে ঘুমাতে গেলে দম আটকে আসে। বুক ফেঁটে কান্না চলে আসে। এত একা কখনো লাগেনি। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মায়ের কবরের কাছে গিয়ে বসে থাকে। কান্না করে করে মায়ের কাছে আশার সুখের বর্ণনা করে। নামাজ পড়ে আল্লাহ্’র কাছে সবার জন্য সুখ কামনা করে। খুব বেশিই মন খারাপ করলে রিশাদের কাছে চলে যায়। আজ হঠাৎ করেই ইচ্ছে হলো আগে তিতলিদের বাসায় যেতে। তিতলিকে দেখলে খুব কষ্ট হয় প্রিয়ুর। অরণ্যর সব স্মৃতিরা আঁকড়ে ধরে তখন। অসহায়বোধ বেড়ে যায়। তবুও যেন এক প্রশান্তি লাগে তিতলিকে দেখলে। তিতলির বাড়িতে গিয়ে তিতলিকে পাওয়া যায় খাটের এক কোণায়। পূজা সরকারের মুখের দিকে তাকানো যায় না। তিতলির চিন্তায় চিন্তায় শরীর, স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। প্রিয়ু সাবধানী পায়ে তিতলির ঘরে যায়। লাইট অন করে না। অন্ধকারেই তিতলির পাশে গিয়ে বসে। জিজ্ঞেস করে, “ভালো আছো দি?”
তিতলির স্থির উত্তর,
“মৃত্যুর প্রহর গুণী।” এত কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আর হয়ে ওঠে না। সবকিছুরই তো একটা শেষ আছে। এই কষ্টের শেষটা কোথায়? জানা আছে কি? হয়তো আছে। আবার হয়তো নেই! তিতলির সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে প্রিয়ু রিশাদের বাড়িতে যায়।

রিশাদ ল্যাপটপে মুভি দেখছিল। প্রিয়ু গিয়ে চুপচাপ পাশে বসে। রিশাদ মুভি দেখতে দেখতেই জিজ্ঞেস করে,
“তোমার আপুর তো বিয়ে হয়ে গেল। তুমি কবে করছ?
প্রিয়ু মৃদু হেসে বলে,
“তুমি যেদিন চাইবে।”
রিশাদ নিশ্চুপ। প্রিয়ু বলে,
“মুভি বন্ধ করো। একটা গান শুনব।”
“মুভিটা শেষ করি?”
“ততক্ষণে না আমি শেষ হয়ে যাই!”
“আজেবাজে কথা শুধু।”
“না তো!”

রিশাদ ল্যাপটপ বন্ধ করে রাখে। প্রিয়ুর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,
“আচ্ছা বলো, কী গান শুনবে?”
“তোমার ইচ্ছেমতো শোনাও।”
রিশাদ কিছুক্ষণ চুপ করে ভেবে গান শুরু করে,
“Khairiyat poocho
Kabhi to kaifiyat poocho
Tumhaare bin deewane ka kya haal hai
Dil mera dekho
Na meri haisiyat poocho
Tere bin ek din jaise sau saal hai

Anjam hai tai mera
Hona tumhein hai mera
Jitni bhi ho dooriyan filhaal hain
Yeh dooriyan filhaal hain.

Ohoho…

Khairiyat poocho
Kabhi to kaifiyat poocho
Tumhaare bin deewane ka kya haal hai
Dil mera dekho
Na meri haisiyat poocho
Tere bin ek din jaise sau saal hai.”

গান শেষ হলে প্রিয়ু রিশাদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। রিশাদ একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। প্রিয়ুর চোখের কার্ণিশ বেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কেন যে এত কষ্ট হয়।
“কাঁদছ কেন?” জিজ্ঞেস করে রিশাদ। প্রিয়ু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,
“জানি না। কষ্ট হচ্ছে খুব। কী যেন হারিয়ে ফেলব মনে হচ্ছে। আমার আছেই বা কী? এমন কেন মনে হচ্ছে আমার?”
“তোমার আপুর বিয়ে হয়ে গেছে তাই হয়তো এমন মনে হচ্ছে।”
“জানি না আমি কিচ্ছু!”
“কিছু খাবে?”
“খাব।”
“কী খাবে বলো?”
প্রিয়ু রিশাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভালোবাসা খাব।”
রিশাদ হেসে বলে,
“আমাকেই খেয়ে ফেলো।”
“সম্ভব হলে খেয়েই ফেলতাম।”
“শয়তান, তুই আমার দেহ পাবি কিন্তু মন পাবি না। ছেড়ে দে বলছি!”

রিশাদের কথা শুনে প্রিয়ুর হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেছে। হাসতে হাসতেই বলে,
“তুমি তো দারুণ অভিনয় করো। আসো তাহলে খেয়েই ফেলি।”
রিশাদ বলে,
“তুমি একটা ডিপজল।” প্রিয়ুর হাসি আরো বেড়ে যায়। পেটে খিল ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্রিয়ুর সঙ্গে সঙ্গে রিশাদও হাসে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে প্রিয়ু বলে,
“আর তুমি ময়ূরী।” বলে আবার হাসিতে ফেঁটে পড়ে। হাসতে হাসতে দুজনেরই গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা।

—————————————-

আলেয়া বেগম সাহিলের সাথে পরামর্শে বসেছে। আলেয়া বেগম সাহিলকে বলেছে প্রিয়ু এই বিয়েতে রাজি হবে না। প্রিয়ু যে রিশাদকে ভালোবাসে এতে তো কোনো সন্দেহ নেই। তাই আলেয়া বেগম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাড়ি তৈরি করার আগেই সাহিলের সাথে প্রিয়ুর বিয়ে দিয়ে দেবেন। প্রিয়ু হাত ছাড়া হয়ে গেলে সাহিল হাত ছাড়া হয়ে যাবে। আর সাহিল হাত ছাড়া হওয়া মানে সব টাকা-পয়সা হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া। এত্ত কাঁচা কাজ তো করা যাবে না কিছুতেই। প্রিয়ুকে বিয়েতে রাজি করাতে হলে রিশাদকে প্রিয়ুর জীবন থেকে সরাতে হবে। এরজন্য রিশাদের সাথে কথা বলাটা জরুরী বলে মনে করেন তিনি। সাহিলকে বলে দিয়েছেন বিয়ের সব আয়োজন এখন থেকেই শুরু করে রাখতে। সাহিলেরও কোনো আপত্তি নেই। সাহিল নিজেও অধীর আগ্রহে বসে আছে প্রিয়ুকে পাওয়ার জন্য। এটা যদি খুব তাড়াতাড়িই হয় তাহলে তো নিজেরই ভালো।
.
রিশাদের ঘরে মুখোমুখি বসে আছে আলেয়া বেগম ও মনসুর আলী। তারা কেন এসেছে রিশাদ তা জানে না। তবে চিনে ওদের। ভনিতা করে প্রথমে আলেয়া বেগমই বলা শুরু করে,
“বাবা প্রিয়ুকে তো তুমি চিনো?”
“জি।” বলে রিশাদ।
“কী বলব বাবা! তুমি হয়তো জানোই আমি ওর সৎ মা। মাঝে মাঝে একটু আধটু মারধোর করি। কিন্তু বিশ্বাস করো খুব ভালোওবাসি আমি ও’কে। মা মরা মেয়ে যেন উচ্ছন্নে না চলে যায় তাই একটু শাসন করি।”
মনসুর আলী বলেন,
“তুমি হয়তো ভাবছো তোমারে ক্যান আমরা এসব বলতেছি? বলতেছি তার কারণ আমরা প্রিয়ুর বিয়ে ঠিক করছি। কিন্তু প্রিয়ু তো রাজি হয় না বাবা। ছেলে খুব ভালো। অবস্থাশীল পরিবারের ছেলে। ঐখানে ওর বিয়ে হলে খুব সুখে থাকব। ছেলেও প্রিয়ুরে খুব ভালোবাসে।”
“এখানে আমি কী করতে পারি আঙ্কেল?”
“তোমার হাতে ধরি বাবা, তুমি প্রিয়ুর জীবন থেকে সইরা যাও।
“ছিঃ আঙ্কেল! এভাবে বলবেন না। প্রিয়ুর সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। আমি নিজেও চাই প্রিয়ু সুখে থাকুক। কেউ ও’কে অনেক বেশিই ভালোবাসুক।”
“এই কথাগুলোই তুমি ওরে বুঝিয়ে বলবা বাবা। তুমি বুঝাইলে ও ঠিক বুঝবে।”
“আচ্ছা আমি চেষ্টা করব।”
“চেষ্টা না বাবা পারতেই হবে। আমরা বিয়ে ঠিক করে ফেলছি। এমনিতেই বড় মেয়েকে নিয়ে এক কাহিনী হয়ে গেছে। এলাকায় এখনো মুখ দেখাইতে পারি না আমরা। এরপর যদি আবার প্রিয়ুর কারণে এই বিয়েটা ভেঙে যায় তাহলে মরা ছাড়া আর উপায় নাই বাবা।” বলে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে মেকি কান্না করেন আলেয়া বেগম।
রিশাদ বলে,
“আপনারা কাঁদবেন না প্লিজ। আমি প্রিয়ুকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে বোঝাব।”
“আজ বিকেলে আমরা আবার আসব প্রিয়ুকে নিয়ে। তুমি ও’কে একটু বুঝিয়ে বইল বাবা।”
“জি।”

মনসুর আলী আর আলেয়া বেগম খুশি খুশি মনে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তাদের প্ল্যানিং কাজে লেগেছে। এখন শুধু প্রিয়ুকে বিয়ে পর্যন্ত নিতে পারলেই হলো।
রিশাদ রুমের ভেতর পায়চারি করছে। কীভাবে বুঝাবে প্রিয়ুকে! আদৌ প্রিয়ু বুঝতে চাইবে কী না! যদি উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসে। অন্যদিকে প্রিয়ুর বাবার মান-সম্মানও জড়িয়ে আছে পুরো বিষয়টাতে। এমনও তো নয় আমি প্রিয়ুকে ভালোবাসি। শুধুমাত্র ও যেন কোনো পাগলামি না করে তাই সময় দিতাম। আমি নিজেও চাই প্রিয়ু কারো ভালোবাসা নিয়ে অনেক সুখে থাকুক। সব কষ্ট যেন ভুলে যায়। কিন্তু এগুলো কীভাবে বুঝাবে রিশাদ তা ভেবেই দিশা পাচ্ছে না।

বাড়িতে গিয়ে বিয়ের ব্যাপারে সব বলেছে আলেয়া বেগম। সব শুনে প্রিয়ু রেগেমেগে আগুণ। কিছুতেই প্রিয়ু রাজি নয় এই বিয়ে করতে। আলেয়া বেগম শান্ত ভঙ্গিতে বলেন,
“কেন করবি না বিয়ে?”
“কেন করব? আমি রিশাদকে ভালোবাসি। রিশাদকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না আমি।”
“রিশাদ তোকে ভালোবাসে? বিয়ে করবে?”
“জানি না। তবুও আমি অপেক্ষা করব তার জন্য।”
“চল রিশাদের বাড়িতে যাই। রিশাদ যদি তোকে এই বিয়ে করতে বলে তাহলে তো করবি?”
“সবটা জেনে রিশাদ কখনোই বলবে না আমায় এই বিয়ে করতে। আর আমি করবও না।”
“চল যাই তাহলে।”
মনসুর আলী আর আলেয়া বেগম প্রিয়ুকে নিয়ে আবারও রিশাদের বাসায় যায়। রিশাদ আর অনিক বারান্দায় বসে ছিল। প্রিয়ুকে পাগলের মতো ছুটে আসতে দেখে অনিক বলে,
“মেয়েটাকে এভাবে ফিরিয়ে দিস না রে রিশাদ।”
“তোকে তো আমি সবটা বলেছি। ওর বাবা খুব অনুনয় করে বলেছে আমায়। তাছাড়া প্রিয়ু আমার কাছে সুখী হবে না। ওর জীবনে ও অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। ওর সুখের দরকার। অনেক ভালোবাসার দরকার আছে। যেটা হয়তো আমার কাছে পাবে না।”
দুজনের কথা বলার মাঝেই কলিংবেল বাজে। অনিক গিয়ে দরজা খুলে দেয়। অনিককে দেখে প্রিয়ু বলে,
“রিশাদ কোথায়? রিশাদ!”
রিশাদ বারান্দা থেকে আসতে আসতে বলে,
“আছি। বলো।”
প্রিয়ুর অস্থিরতায় শরীর, হাত-পা কাঁপছে। রিশাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“দেখো আব্বা নাকি আমার বিয়ে ঠিক করেছে। তুমি তো জানো আমি তোমায় ভালোবাসি। আমি তো তোমায় ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না।”
“পাগলামি বন্ধ করো প্রিয়ু। এটা তোমার আবেগের বয়স না। আর সবকিছু আবেগ দিয়ে ভাবা বন্ধ করো। বিবেক দিয়ে ভেবে দেখো, তুমি মরীচিকার পেছনে ছুটছো। তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এক তরফা ভালোবাসাকে আগলে নিয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।”
প্রিয়ু অশ্রুসজল চোখে ধরে আসা কণ্ঠে বলে,
“আমায় ভালোবাসতে হবে না তোমার। আমি একাই তোমায় ভালোবাসব। তবুও প্লিজ এভাবে বোলো না। আমি সত্যিই তোমায় অনেক ভালোবাসি।”
“আমার আর কিছু বলার নেই। যা বলার আমি বলে দিয়েছি। এবার তুমি আসতে পারো।”
প্রিয়ু কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“এত কঠিন কেন হচ্ছো তুমি আমার সাথে? প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করো রিশাদ।”

মনসুর আলী প্রিয়ুর হাত ধরে বলেন,
“চলে আয় মা। জোর করে ভালোবাসা হয় না। চলে আয়।
“আব্বা আমি যাব না! আমি রিশাদকে ছাড়া বাঁচব না।”
মনসুর আলী আর আলেয়া বেগম জোর করেই প্রিয়ুকে টেনে নিয়ে যান। প্রিয়ু কাঁদতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেন। বারবার রিশাদের কাছে ফিরে যেতে চায়। বেশিক্ষণ প্রিয়ুকে দেখতে পারল না রিশাদ। অজানা কষ্টে বুকের ভেতর হু হু করছে। স্টাডিরুমে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। টেবিলের ওপর দেখতে পায় প্রিয়ুর সেই চুলের কাটা যেটা এখনো অব্দি প্রিয়ুকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি! রিশাদের কান্নাগুলো কেমন যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে!
.
.
বাড়িতে গিয়ে প্রিয়ু পাগলামি শুরু করে দেয়। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর শুরু করে। রাগ, জেদ নিজের মধ্যে চেপে রেখে এতক্ষণ ভালো মানুষের অভিনয় করলেও আলেয়া বেগম এবার তার আসল রূপে আসে। প্রিয়ুকে থাপ্পড় দিয়ে বলেন,
“ঘরের জিনিস ভাঙতেছিস ক্যান? বিয়ের পর জামাইর বাড়ি গিয়ে যত পারিস ভাঙিস।”
“এভাবে অল্প অল্প না মেরে পারলে আমাকে একেবারেই মেরে ফেলো। তোমরাও শান্তিতে থাকো আর আমায়ও শান্তি দাও।”
“তোরে বিয়ে দিতে পারলেই আমাদের শান্তি। এক হাত দিয়ে তুই যাবি আর অন্য হাতে শুধু টাকা আর টাকা!”
প্রিয়ু এবার মনসুর আলীর পা ধরে বলে,
“তোমার কাছে কখনো আমি কিছুই চাইনি আব্বা। এবার চাইছি, দিবে আমায়? রিশাদের থেকে আমায় আলাদা কোরো না আব্বা। আমায় রিশাদের কাছে যেতে দাও।”
মনসুর আলী প্রিয়ুকে ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ান। বলেন,
“আমি তো ভাবছিলাম পোলায় তোরে ভালোবাসে। ওর সাথে কথা বলে জানলাম তোদের কোনো সম্পর্কই নাই। ওর কাছে যাইয়া তুই কী করবি?”
“তোমরা আগেও রিশাদের কাছে গেছিলে?”
আলেয়া বেগম বলেন,
“তোরে এত কৈফিয়ত দিতে যামু ক্যান? আমগোর যা বলার তা বলছিই রিশাদরে। এখন তুই ভালো ভালোই বিয়েতে রাজি হয়ে যা। ঘরে যাইয়া দেখ শাড়ি, গয়না সব আছে। পরে রেডি হয়ে নে। আজই বিয়ে হবে তোদের।”

প্রিয়ুর আকুতি-মিনতি, কান্নাকাটি কারো মন গলাতে পারেনি। অরণ্যর কথা খুব মনে পড়ছে এখন। আজ যদি অরণ্য ভাইয়া বেঁচে থাকত তাহলে ঠিকই কোনো না কোনো উপায়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারত। আব্বা-মা নিশ্চয়ই রিশাদকে উল্টা-পাল্টা বুঝিয়েছে। আশাকে এই বিয়ের কথা জানানো হয়নি। আশা, সিয়াম আসলে যে বিয়েটা হতে দেবে না তা ভালো করেই জানে আলেয়া বেগম। তাই নিজের বোনকে ডেকে এনেছে প্রিয়ুকে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য। সাজ বলতে শাড়ি আর গয়নাই শুধু পরাতে পেরেছে। কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়ু ক্লান্ত। চোখ দুটো লেগে আসতে চাচ্ছে। সবাই অন্য রুমে বিয়ের ব্যবস্থা করছে। প্রিয়ুকে ঘরের ভেতর আটকে রেখেছে। ক্লান্ত চোখে প্রিয়ু মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে মায়ের কবরের পাশে নিজের কবরটাও বানিয়ে নিতে। এই পৃথিবীর মানুষগুলো খুব নিষ্ঠুর খুব। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আশাকে দেখতে পায়। মুহূর্তেই আশা যেন প্রিয়ুর জীবনে আশার আলো হয়ে এসেছে। প্রিয়ু দৌঁড়ে গিয়ে আশাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আপু আমায় সাহায্য করো প্লিজ। আমি এই বিয়ে করব না। আমি রিশাদের কাছে যাব।”
“ঠান্ডা হ তুই। তোকে রিশাদের কাছেই নিয়ে যাব চল। কেউ দেখে ফেলার আগেই আমাদের বের হতে হবে।”
“হ্যাঁ।”
দরজায় তাকিয়ে আমিনকে দেখে শক্ত করে আশার হাত চেপে ধরে প্রিয়ু। চোখেমুখে আতঙ্ক। শেষ সময়ে এসেও কি ধরা পরে গেল? আমিনের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার উপায় কী!
আমিন প্রিয়ুর দিকে এগিয়ে এসে প্রিয়ুর হাত ধরে। আশা প্রিয়ুকে আশ্বস্ত করে বলে,
“ভয় পাস না। তোর বিয়ের কথা আব্বা, মা কেউই আমায় জানায় নাই। ভাইয়াই জানাইছে।”
প্রিয়ু অবাক হয়ে তাকায় আমিনের দিকে। আমিন অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলে,
“তোর সাথে অনেক অন্যায়, অত্যাচার করছি আমি। আমি ক্ষমার অযোগ্য জানি আমি। আমি চাই তুই ভালোবাসার মানুষটার সাথেই সুখী হ। এখন তাড়াতাড়ি যা। বাড়ির কেউ আইসা পরব।”

প্রিয়ুও আর কথা বাড়ায় না। কথা বাড়ানোর সময়ও নেই। এই বাড়ি থেকে পালাতে হবে। রিশাদের কাছে যেতে হবে। রিশাদকে সবটা জানাতে হবে। রিশাদকে নিশ্চয়ই তখন সবটা বুঝিয়ে বললে প্রিয়ুকে ফিরিয়ে দেবে না। রিশাদের বাড়ির কাছে যেতেই সালাম চাচা বলেন,
“কোথায় যাচ্ছ?”
প্রিয়ু অস্থিরতাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলে,
“রিশাদ! রিশাদের কাছে যাব।”
সালাম চাচা ভারাক্রান্ত মনে বলেন,
“বিকালে তুমি চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় রিশাদ ওর বাড়িতে চলে গেছে।”

প্রিয়ু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
“মিথ্যা বলছেন চাচা! রিশাদ বাড়িতেই আছে।”
“মিথ্যা বলতাছি না মা।”
প্রিয়ু সালাম চাচার কথা বিশ্বাস করে না। দৌঁড়ে যায় রিশাদের ফ্ল্যাটে। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। প্রিয়ু কাঁদতে কাঁদতেই দরজার সামনে বসে পড়ে। সিয়াম প্রিয়ুকে ধরে বলে,
“কেঁদো না বোন। একটা না একটা উপায় তো হবেই।”
আশা বলে,
“ঐ চাচাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। উনার কাছে রিশাদের বাড়ির ঠিকানা তো থাকতেও পারে।”
“জিজ্ঞেস করে দেখি।”
সালাম চাচার কাছে গিয়েও কোনো উপায় পাওয়া গেল না। বাড়ির ঠিকানা নেই তার কাছে। নাম্বারও বন্ধ। সব পথ বন্ধ। প্রিয়ুকে বাড়িতে না পেয়ে মনসুর আলী, আলেয়া বেগম, সাহিল ও তার কিছু বন্ধুকে নিয়ে আসে। প্রিয়ুকে বাড়িতে না পেয়েই বুঝতে পেরেছে প্রিয়ু কোথায় যেতে পারে। আশা প্রিয়ুর হাত শক্ত করে ধরে বলে,
“খবরদার মা! ভুলেও প্রিয়ুর দিকে আগানোর চেষ্টা করবে না।”
আলেয়া বেগম কিছু বলার আগেই সাহিল প্রিয়ুর হাত ধরে বলে,
“কাউকেই কিছু করতে হবে না। আমার হবু বউকে আমিই নিয়ে যাচ্ছি।”

সিয়াম বাঁধা দিতে আসলে সাহিলের বন্ধুরা সিয়ামকে আটকায়। হাত ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করেও প্রিয়ু পেরে উঠছে না। উপায় না পেয়ে সাহিলের হাতে জোরে খামচি বসিয়ে দিয়ে দৌঁড়ে কিছুটা দূরে চলে যায়। রাতে নিয়নলাইটের আলোয় রাস্তাঘাট আলেকিত। সেই আলোতে আলোকিত হয়ে উঠেছে প্রিয়ুর অশান্ত মুখটা। আস্তে আস্তে প্রিয়ু রাস্তার আরো ধারেকাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“আমার কাছে কেউ আগানোর চেষ্টা করলেই আমি গাড়ির নিচে ঝাঁপ দেবো বলে দিলাম।”
মনসুর আলী বলেন,
“কী করছিস তুই? রাস্তা থেকে সরে আয়।”
“কেন? আমি মরে গেলে তোমার কী? তুমি তো তাহলে বেঁচে চাও। না, না বেঁচে যাবে কীভাবে? আমি মরে গেলে তো টাকা হারিয়ে যাবে তোমার। টাকার খুব লোভ তোমার তাই না আব্বা? ছোট্ট থেকে আমি তোমার অবহেলা সহ্য করে আসতেছি। তোমার কি মনে পড়ে আব্বা শেষ কবে তুমি আমায় একটু ভালোবেসেছ? বাসোনি আব্বা তুমি আমায় একটুও ভালোবাসোনি। কতটা ছটফট করতাম জানো? শুধু মাত্র বাবার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। মা দিবসে স্কুলে যখন অনুষ্ঠান হতো তখন খুব সহজেই বলতে পারতাম আমার মা দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে। মাকে নিয়ে হাজারটা লাইন বলতেও আমার মুখে বাঁধত না। কিন্তু বাবা দিবসে আমি তোমায় নিয়ে একটা লাইনও বলতে পারতাম না। আমার ঠোঁট কাঁপত। কী করে বলতাম বলো তো? আমার তো মনেই পড়ে না শেষ কবে আমি তোমার ভালোবাসা পেয়েছি। আমার তো বাবা থেকেও ছিল না! আমার চোখের সামনেই তুমি আমিন ভাইয়া আর আশা আপুকে আদর করতে, ভালোবাসতে। আর আমি তীর্থের কাকের মতো দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ভাবতাম, একবার তুমি আমায় কাছে ডাকবে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু ভালোবাসবে। আমার সেই স্বপ্ন কখনোই পূরণ হয়নি আব্বা। নতুন মা আসার পর থেকে তুমি হয়ে গেছ তার হাতের পুতুল। আমার গায়ে যেই তুমি কখনো একটা ফুলের টোকাও দিতে না সেই তোমার সামনেই আমার ওপর করা হাজারটা অন্যায়-অত্যাচার দেখেও তুমি চুপ ছিলে। শুধু কি তাই? তুমি নিজেও আমায় মেরেছ। তখন থেকেই বুঝে গেছিলাম এই মানুষটা আমার পরিচিত আব্বা নয়। এইটা আমার সৎ মায়ের স্বামী। যখন জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর জন্য রিশাদকে বেছে নিলাম তখন তুমি রিশাদকেও আমার থেকে কেড়ে নিলে। কেন করলে এমনটা আব্বা? শুধুমাত্র টাকার লোভ আর নিজেদের ভালোর জন্য? একটাবারও ভাবলে না তুমি আমার কথা! রিশাদকে ছাড়া আমি ভীষণ অসহায় আব্বা। রিশাদের একটু ভালোবাসা পাওয়ার প্রতিক্ষায় যখন আমি দিন গুনি তখন তুমি ওকেই কেড়ে নিলে আমার থেকে। তুমি তো আমায় নিঃস্ব করে দিলে আব্বা!”

মনসুর আলীর চোখে পানি। কখনোই প্রিয়ু আগে এই অভিযোগগুলো করেনি। আজকে প্রিয়ুর প্রতিটা অভিযোগ বুকের ভেতর এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে। রাস্তাঘাটের অনেক পথযাত্রীই তাদের সাথে দাঁড়িয়ে প্রিয়ুর কথা শুনছিল। সকলের বুকেই অজানা চিনচিন ব্যথার শুরু হয়। কী নিদারুণ সেই ব্যথা! মনসুর আলী বলেন,
“আমার কথা শোন…”
প্রিয়ু কেঁদে কেঁদে বলে,
“আমায় আটকিও না আব্বা। তোমার মিথ্যে কান্না আমায় দেখিও না। আমার এইটুকু জীবনে আমি যদি কাউকে খুব বেশি ঘৃণা করে থাকি তাহলে সে তুমি আব্বা। তোমায় আমি ঘৃণা করি। প্রচণ্ড ঘৃণা করি। তোমায় আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। কোনোদিন না।”
এরপর প্রিয়ু রিশাদের রুমের ব্যালকোনির দিকে তাকিয়ে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“রিশাদ, তুমি আমার গল্পে কোনো প্রতারক নও। কোনো বিশ্বাসঘাতক নও। কোনো প্রেমিকও নও। তুমি আমার গল্পে একরাশ আফসোস! যদি একটু ভালোবাসতে…”

কথাগুলো বলতে বলতেই প্রিয়ু এক পা দু’পা করে পিছিয়ে যায়। সকলের দিকে তাকিয়ে শেষ হাসিটা হেসে চলন্ত গাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই।
.
.
রিশাদ মন খারাপ করে বাসে বসে আছে। জানালা দিয়ে সাঁ সাঁ করে বাতাস আসছে। কিন্তু এই বিশুদ্ধ বাতাসও মনের অস্থিরতাকে কমাতে পারছে না একবিন্দুও। অজানা কষ্ট মনে চেপে ধরেছে। এমন কেন লাগছে? প্রিয়ু তো আমার কেউ নয়। কখনো ভালোবাসিনি আমি ও’কে। এখনো ভালোবাসি না। তাহলে এত কষ্ট কেন হচ্ছে? মনে হচ্ছে কী যেন হারিয়ে ফেলছি! ধুর! সব মায়া। মানুষ তো! এতদিনে মেয়েটার ওপর মায়া পড়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওর হয়তো কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের পর এসব আর কিছুই মনে থাকবে না। এই বয়সে একটু আধটু পাগলামি সবাই করে। আবেগ আর থাকবে না। বিয়ের পর মেয়েটাকে তুমি সুখি করে দিও আল্লাহ্।”

নিজের মনে শত বাক্য বুনন করেও মনকে শান্ত করতে পারছে না রিশাদ। নিজের সাথে আর পেরে না ওঠে হু হু করে কান্না করে ফেলে। চোখের পানি আটকানো যাচ্ছে না। ছেলেদের এত অল্পতেই কাঁদলে চলে নাকি? তাছাড়া ওর জন্য কাঁদবই বা কেন! ও তো কেউ নয় আমার! ও ভালো থাকবে। আমি জানি!
.

সত্যিই কি প্রিয়ু ভালো থাকবে? অথচ ভালোবাসার মানুষটা জানলোই না রাস্তায় দপরাতে দপরাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে একটু ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় কাঙাল মেয়েটা। সব আবেগ নয়। আবেগ ছাড়া ভালোবাসাও হয় না। হ্যাঁ, রিশাদের মতে আজ থেকে আর প্রিয়ুর আবেগ থাকবে না। কীভাবে থাকবে? যে বেঁচেই নেই তার আবার আবেগ থাকে নাকি? মেয়েটা আর একটু ভালোবাসার জন্য পাগলামি করবে না। কাঁদবে না। রাত-বিরেতে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে না। দুষ্টুমি করবে না। এমনকি কখনো রিশাদকে খুঁজবেও না। নিজে শান্তি না পেলেও মেয়েটা রিশাদকে শান্তি দিয়ে গেছে। ভালোবাসার মানুষগুলো শান্তিতে থাক। আচ্ছা রিশাদ কি কখনো জানবে, একটু ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্টে প্রিয়ু পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে! জানবে কখনো?

(সমাপ্ত)

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে