তুমি আমার প্রণয়িনী পর্ব-০৭

0
58

#ধারাবাহিক গল্প
#তুমি আমার প্রণয়িনী
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

বিয়ের কেনাকাটা করতে গিয়ে জোবায়দার কতো পুরনো স্মৃতি মনে পড়ছে। হিমেল বলেছিলো, ওরা পাশাপাশি বসে কবুল বলবে। যদিও মেয়েদেরকে অন্দরমহলে কবুল পড়ানো হয় কিন্তু ওরা একসাথে কবুল বলবে। আর দু’জন দু’জনের অভিব্যক্তি লক্ষ করবে। অথচ নিয়তি আজ ওকে কোথায় টেনে এনেছে।
জোবায়দা এলিফ্যান্ট রোডে শেরওয়ানির দোকানগুলোতে এসেছে। হিমেলের জন্য শেরওয়ানি কিনতে হবে। মাপটা হিমেলের বাবা ফোন করে জোবায়দার মাকে জানিয়ে দিয়েছিলো। সাথে এও বলেছে যখন অনুষ্ঠান করে বউ তুলে নিবে তখন হিমেল আর আদিবাকে সাথে নিয়ে শপিং করবে। এখন যেহেতু আকদ হবে সেটা ঘরোয়াভাবে হোক। এটা হিমেলের ও ইচ্ছা। হিমেলের বাবা নিজের ইচ্ছাটাকে হিমেলের নাম বলে চালিয়ে দিলো। শেফালী বেগম জোবায়দার কাছে হিমেলের শেরওয়ানির মাপ, জুতোর মাপ, আংটির মাপ সব বুঝিয়ে দিলো। জোবায়দার একবার জানতে ইচ্ছে হয়েছিলো,ওর মা এই মাপগুলো কিভাবে পেলো। পরে আবার কি মনে করে জানতে চাইলো না।
অতএব শপিং করতে জোবায়দা একাই আসতে হলো। আদিবা আসতে চেয়েছিলো। ও ইচ্ছে করেই আনেনি। কারণ ও হয়তো বারবার নস্টালজিয়ায় ফিরে যাবে। সেটা আদিবার সামনে ঠিক হবে না। জোবায়দা জানে, হিমেলের পছন্দ কেমন? খুব গর্জিয়াস চাকচিক্য হিমেলের পছন্দ নয়। সাদামাটা নিটোল জিনিস হিমেলের খুব পছন্দ। তাই ক্রিমকালারের উপর হালকা জরিবুটি কাজ করা শেরওয়ানি ও হিমেলের জন্য পছন্দ করে। সোনার একটা আংটিও কিনে ফেলে। যদিও হিমেল ওকে একবার বলেছিলো, বাসর রাতে ও জোবায়দাকে ডায়মন্ডের আংটি পরিয়ে দিবে আর জোবায়দা যেন ওকে প্লাটিনামের আংটি পরিয়ে দেয়। এখন তো সে অবস্থা নেই। জোবায়দা ভাবে,কি অদ্ভূত ভাগ্য নিয়ে ও এই পৃথিবীতে এসেছে। সেই ছোটোবেলা থেকে মা ওকে বলতো মেয়ে হয়ে জন্মেছো সবার সাথে এডজাস্ট করতে শিখতে হবে। এডজাস্ট করতে করতে আজ ও নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে ছোটো বোনের বিয়ে দিয়ে নিজেকে এডজাস্ট করে নিয়েছে।

আজ আদিবার বিয়ের দিন। সকাল থেকে জোবায়দার অনেক ব্যস্ততা চলছে। এর মাঝে জোবায়দা বিয়ের সব কেনাকাটা কমপ্লিট করেছে। ও আগে থেকেই বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, আজকের রাতের ট্রেনে ও চিটাগাং যাবে। বাড়ির সবাই প্রবল আপত্তি করেছে। তারপরও ওর এখানে থাকা আর সম্ভব নয়। নিজের ভালোবাসার মানুষকে যখন অন্যের হাতে তুলে দিতে হয় এযে কতো বড় কষ্ট এর ভিতর দিয়ে যে গিয়েছে সেই একমাত্র অনুভব করতে পারবে।
ওর চাকরি ক্ষেত্র রাঙ্গামাটি। চিটাগাং এ নামার সাথে সাথে হাসপাতালের মাইক্রোবাসে করে রাঙ্গামাটি রওয়ানা হবে। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হতে চললো। পারলার থেকে মেকাপ আর্টিস্ট চলে এসেছে। আদিবাকে সাজাতে শুরু করেছে। জোবায়দা ওর জন্য বানানো গয়নাগুলে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললো,
—-এগুলো আদিবাকে পরিয়ে দাও।
গয়নার বাক্স হাতে নিয়ে শেফালী বেগমের চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে উনি ভালোই বুঝতে পারছেন, কি গভীর ক্ষত মেয়ে তার বুকে সযতনে লুকিয়ে রেখেছে। চোখের জল মুছে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-এগুলো তো তোর বাবা তোর জন্য বানিয়েছিলো। আদিবাকে দিতে গেলি কেন? তোর বিয়ের সময় আবার কোথা থেকে যোগাড় করবো।
—এ জীবনে আমি আর বিয়ে করছি না। আর তাছাড়া তোমার মেয়ে যদি খালি হাতে শ্বশুর বাড়ি যায় এতে কি তোমার সম্মান বাড়বে? এর থেকে এটাই ভালো। ওকে এই গয়নাগুলো পরিয়ে দাও।
পাশ থেকে স্বর্ণা খোঁচা মেরে বললো,
—-মা তো আমাকে কিছু দিলেন না। অবশ্য দিবেনই বা কোত্থেকে? মাথার উপর দু,দুটো ননদ থাকলে ভাইয়ের বউয়ের কপালে আর গয়না জোটে না।
শেফালী বেগম মনে মনে একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, নিজের জ্বালায় বাঁচি না। আর উনি এসেছেন দেনা পাওনার হিসেব মেলাতে। মা মেয়ের কথার মাঝখান থেকে ওকে সরাতে উনি স্বর্ণাকে বললেন,
—-দেওয়ার সময় তো পালিয়ে যাচ্ছে না। দেখ তো ওমর কোথায়?
যদিও শেফালী বেগম জানে ওমর কোনো কাজের না।তারপরও বোনের বিয়েতে খাবারের খরচটা দিতে চেয়েছে। এতেই উনি খুশী।স্বর্ণা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর শেফালী বেগম আদিবাকে ডেকে বললেন,
—-এই গয়নাগুলো অনেক যত্ন করে রাখিস। তোর বাবা আর বোনের অনেক কষ্টের টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে।
আদিবা গয়নার বাক্স খুলে গলার হারটা নেড়েচেড়ে বললো,
—-এরকম পাতলা ফিনফিনে হার গলায় জড়ালেই তো ছিঁড়ে যাবে। এ আর আমি কিভাবে যত্নে রাখবো?
জোবায়দা একটু রেগে গিয়ে বললো,
—-সোনার হিসাবে এই গয়নার হিসাব মেলাতে যাস না। এরসাথে বাবার ঘাম মেশানো রয়েছে।
—–অতশত বুঝি না। আমার বান্ধবীদের মধ্যে যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান চলেছে এক সপ্তাহ ধরে। ছেলেপক্ষ থেকে ডায়মন্ডের আংটি নাকফুল দিয়েছে। আর আমাকে পাতলা সোনার আংটি দিয়ে ওরা দায় সারলো। তুমি পাতলা একসেট গয়না দিয়ে তোমার দায় সারছো।
—-তোমার তাহলে আমার গর্ভে জন্ম না নিয়ে কোনো রানীর গর্ভে জন্ম নেওয়া উচিত ছিলো।
এমন সময় জাফর এসে জোবায়দাকে বললো,
—-আপু গেট কতো টাকা ধরবো?
—-জাফর, গেট ধরা নিয়ে বেশী ঝামেলা করিস না।
জোবায়দা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-কেন মা, নিষেধ করছো কেন? ওরা একটু বন্ধুবান্ধব নিয়ে মজা করতে চাচ্ছে করুক না।
আদিবা রেগে গিয়ে জাফরকে বললো,
—-গেট সাজিয়েছিস যে গেটধরার টাকা চাইছিস?অত গেট ধরতে হবে না।
এমনসময় স্বর্ণা কোত্থেকে উদয় হয়ে বললো,
—কবুল না বলতেই বরের প্রতি এতো টান।
—-এখানে টানের কি দেখলে ভাবি? কথার পরে তোমার ফোঁড়ন না দিলে পেটের ভাত হজম হয় না,তাই না?
শেফালী বেগম ওদের দু’জনের কথায় বিরক্ত হয়ে স্বর্ণাকে বললো,
—খুব তো কথা জানো। বর কিভাবে বরণ করো সেটাই এবার দেখবো।
—আপু থাকতে আমি কেন বর বরণ করতে যাবো? ও–ও আপু তো আবার আইবুড়ো হয়ে বসে আছে। উনাকে দেখে নানাজনে হয়তো নানা কথা বলবে। ঠিক আছে আম্মা আমিই না হয় ছেলেকে বরণ করে ঘরে তুলবো।
আদিবা আর স্বর্ণার আচরণে জোবায়দার এখানে আর থাকতে ইচ্ছা হলো না। ও ওর মাকে বললো,
—-আমি ওদিকটায় গিয়ে দেখি। ওমর ঠিকঠাক মতো সব করছে কিনা।
এরমধ্যে ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে ফোন আসলো। জোবায়দা ফোনটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে বললো,
—-হ্যালো জোবায়দা ম্যাম বলছেন?
—হুম,
—-ম্যাম আমাদের পেমেন্ট তো পুরো বুঝে পাইনি। পেমেন্ট পুরো বুঝে না পেলে আমরা খাবার পাঠাই না।
—-আমি যতটুকু জানি পেমেন্ট তো সব ক্লিয়ার করার কথা।
—না ম্যাম,এখনও ক্লিয়ার করা হয়নি।
জোবায়দা ওমরকে ডেকে বললো,
—কিরে, তুই ক্যাটারিং সার্ভিসের সব বিল ক্লিয়ার করিসনি?
—-আমার যেটুকু সামর্থ আমি সেটুকু দিয়েছি।
—সেটা আমাকে জানাতে পারতি।
জোবায়দা ওর সাথে কথা না বলে ক্যাটারিং সার্ভিস সেন্টারে বিকাশের মাধ্যমে সব পেমেন্ট বুঝিয়ে দিলো।
ওদিকে ডেকোরেটরদের সব বিল পরিশোধ করা হলো। সব যখন শেষের পথে তখন ওর মামা, ফুফু এসে বললো,”ওদের কোনো হেল্প লাগবে কিনা।” আত্মীয়স্বজনের এরকম চেহারার সাথে অবশ্য ও আগে থেকেই পরিচিত। সব কিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিয়ে নিজের রুমে এসে ব্যাগ গুছাতে লাগলো। পাশের রুমে ওর ফুফুর কথা জোবায়দা শুনতে পারছে।
—শোনো ভাবি, মন খারাপ করো না। জোবায়দা যেতে চাইছে যাক। ওমর ওর ছোটো হয়ে বিয়ে করে ফেললো। আবার তুমি এখন আদিবারও বিয়ে দিচ্ছো। লোকে ভাববে তোমার বড় মেয়ের হয়তো খুঁত আছে সেই কারনে বিয়ে হয়নি। নানাজনে নানা প্রশ্ন করবে। এর থেকে ওর চলে যাওয়াই ভালো।

জোবায়দা এসব কথা শুনে মনে মনে বললো,”আত্মীয়স্বজনের কথা হজম করতে করতে এখন বাইরের মানুষের কথা গায়ে বিঁধে না।” ওদিকে হিমেলদের আসার সময় হয়ে যাচ্ছে। ও আর দেরী না করে সবার কাছে বিদায় নিয়ে উবারে উঠে পড়লো। কিছুদূর যাওয়ার পর মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। আজ যেন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরছে। কালো মেঘের বুক চিরে বিদ্যুৎ এর ঝলকানি আর বজ্রপাতের কড়াৎ কড়াৎ শব্দে জোবায়দার একলা পথের যাত্রা শুরু হলো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে