বেলা শেষে পর্ব-৩৩

0
1268

#বেলা_শেষে। [৩৩]

গ্রাম থেকে চলে এসেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক হলো। আরাভ এখন তার অফিস নিয়ে ভিষন ব্যস্থ হয়ে পরেছে।ভূমি সারাক্ষণ বাসায় থাকে। বাড়ির কাজ কর্ম করে আর বাকিটা সময় অভিকে নিয়ে কটিয়ে দেয়। ভূমির সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকা নিয়ে বেশ ভাবাচ্ছে আরাভকে। ভূমি কেন তার অফিসে যায়। এই নিয়ে আরাভ তাকে অনেক প্রশ্ন করলেও প্রতিবারই এড়িয়ে যাচ্ছে ভূমি। কোন না কোন বাহানা দিয়ে কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছে সে। আজ সকাল সকাল আরাভ অফিসে চলে যায়। সকালে ঠিকমতো ব্রেকফাস্ট ও করে নি সে। এই নিয়ে ভূমি কিছু জিগ্যেস করলেও কোন জবাব দেয়না আরাভ। একরকম ভূমিকে ইগনোর করে চলে যায় সে। আরাভ চলে যাওয়ায় পরে ভূমি অভিকে নিয়ে স্কুলে চলে যায়। খন্দকার আদনান মাহবুব তার স্ত্রীরে নিয়ে পাহাড়ে বেড়াতে গেছে। এই বয়সে এসে জুবাইদার মনের সব আশা পূরন করতে ব্যস্ত সে। সারাজিবন বইয়ের পাতায় মুখ গুজে রেখে এখন গেছে বউকে নিয়ে বেড়াতপ। আজহার মওদুদের শরীরটা খুব ভালো নয়। সারাক্ষণ তার রুমেই থাকে। ভূমি গিয়ে সময় মতো তার খাবার আর ঔষুদগুলো দিয়ে আসে।

বিকাল বেলায় নয়না মিষ্টিকে নিয়ে আসে খন্দকার ভিলায়। অভি ড্রয়িংরুমে বসে একা একা বল নিয়ে খেলছিলো। এমন সময় নয়না আর মিষ্টির প্রবেশ। অভি নয়নাকে দেখে খুশি হলেও মিষ্টিকে দেখে খুব রাগ হয় অভির। সে বলটাকে মিষ্টির মাথা বরাবর ছুঁড়ে মারে। কিন্তু অভির ব্যার্থ হয়। তার আগেই মিষ্টি দৌড়ে এসে ভুমির কোলে উঠে। এবার অভির রাগ আকাশ ছোঁয়া। তাকে তার দেখে কে।রাগে কটমট করতে করতে সেখান থেকে চলে যায়।ভূমি মিষ্টিকে কোলে নিয়ে সুফায় বসে। নয়নাও তার পাশে বসে। তারপর দুজনে গল্প করতে শুরু করে।

রাতের বেলা আরাভ রাকিবকে নিয়ে বাসায় ফিরে। ভূমি আগেই ওদের জন্যে রান্না করে রাখছিলো। আরাভ বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে অভিকে কোলে নিয়ে সোজা ড্রাইনিং টেবিলে বসে। তারপর রাকিবকে নিয়ে এক সাথে খেতে বসে সে। ভূমি খাবার পরিবেশ করছে। কিন্ত আশ্চর্য বিষয় আরাভ ভূমির সাথে একটা কথাও বলছে না। নিচের দিকে তাকিয়ে একমনে খেয়ে যাচ্ছে সে। ভূমি কিছু জিগ্যেস করলে তার জবাব ও দিচ্ছে না। ব্যপারটা ভূমির কাছে খুব খারাপ লাগে। ভূমির ইচ্ছে করছে ফল কাটার ছুড়িটা নিয়ে আরাভের গলায় ধরতে। আর ছিনতাই কারির মতো বলতে, কথা বল, কথা না বললে,তোর গলাটা কেটে দিবো। কিন্তুু এই মুহূর্তে সে এটা কিছুতেই করতে পারবে না। তার ভালো মেয়ের মতো চুপ করে সবটা সহ্য করে নেয়। ওদের খাওয়া শেষ হলে আরাভ আর রাকিব দুজনেই সুফায় বলে গল্প করতে শুরু করে দেয়। এদিকে ভূমি অপেক্ষা করতে থাকে সে কখন আরাভকে একা পাবে। আরাভের ইগনোর সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। প্রিয় মানুষের অবহেলা সত্যিই খুব যন্ত্রনাদায়ক। কেও মেনে নিতে পারে আবার কেও মানতে পারে না। যারা মানতে পারে না তারা কেও কেও আবেগের বসে নিজর জিবনটাই ধংশ করে দেয়। কিন্ত ভূমি শক্ত মানব। জিবনের সাথে লড়াই করেই বেচে আছে। তার ধারনা সমস্যার মোকাবেলা না হলে সমস্যাটা আরো জটিল হতে থাকে। তাই সে কোন সমস্যার আগে মোকাবেলা করতে হবে।তারপর ভাবতে হলে কি করে সেই সমস্যার সমাধান করা যায়। সমস্যা থেকে দূরে পালিয়ে থাকলে সেটা আরো জটিল থেকে জটিল হতে থাকে।

রাতের দশটার দিকে বাড়ি ফিরে যায় নয়না আর রাকিব। ভূমি অভিকে ঘুম পারিয়ে ওর পাশেই শুয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। আরাভ রুমে গিয়ে বিছানায়র দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে লেপটপ নিয়ে বসে পরে। রুমে আরাভের অবস্থা টের পেয়ে চোখ খুলে ভূমি। আরাভকে বিছানার এক পাশে লেপটপ এ মাথা গুজে থাকতে দেখে ভূমি উঠে বসে। তারপর সে আরাভে পাশে গিয়ে লেপটপটা বন্ধকরে নিজের কাছে নিয়ে নেয়। আরাভ ভূমির দিকে তাকিয়ে বলে,

-প্রবলেম কি তোমার??

-প্রবলেম আমার নয়। প্রবলেম হচ্ছে তোমার। আমাকে ইগনোর কেন করছো??

-লেপটপটা দেও। কাজ করছি আমি।

-আগে আমার জবাব চাই। বলো কেন ইগনোর করছো আমাকে।

আরাভ ভূমির কথার কোন জবাব দেয় না। সে উঠে সোজা বারান্দায় চলে যায়। বারান্দায় দাড়িয়ে রেলিং এর উপর হাত রেখে বাহিরে দিকে তাকিয়ে থাকে সে। অন্ধকারে মুড়িয়ে থাকা শরটাকে দেখে মনে হয় যে গায়ে কালো চাদর জড়িয়ে আছে। আজকে অন্ধকার একটু বেশীই পরেছে। দুরে ল্যাম্পপোস্টের আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর ভূমি এসে আরাভকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে মাথা রাখলো। এতে মনে হয় আরাভে হৃদস্পন্দন হাজার গুনে বেড়ে যাচ্ছে।

-আমার সাথে কেন কথা বলছো না তুমি?? তুমি জানো না তোমার ইগনোর আমি মেনে নিতে পারি না।

আরাভ কোন কথাই বলল না। সে আগের ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রইলো। অতঃপর ভূমি আবারও বলল,

-আমার কোন কাজে তুমি কষ্ট পেলে থাকলে প্লিজ বলো আমাকে। আমি সেটা শুধরে নিবো। কিন্তু তুমি চুপ করে থেকো না আরাভ।

আরাভ এবার কোন কথা না বলে ভূমিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ভূমিকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,

-আমার সব কথাই শুনবে তুমি।

-হ্যাঁ শুনবো। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। প্লিজ আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। এমনিতেই সবার চোখে অপরাধী আমি। তুমি আমাকে যা শাস্তি দেওয়ার দাও। কিন্তু আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।

ভূমির শেষ বাক্যটা আরাভের বুকে লাগলো। কেমন যেন চিন চিন ব্যথা শুরু হলো সেখান থেকে। সে দ্রুত ভূমির কাদে হাত রেখে বলল,

-কেন নিজেকে অপরাধী মনে করছো। তোমার সাথে যা হয়েছে তাতে তোমার কোন হাত নেই। ভূমি, তোমার উপর আমার কোন রাগ অভিমান কিছুই নেই। তুমি ভাবলে কি করে আমি তেমার সাথে রাগ করবো। সারাদিন যতই কাজ করিনা কেন? অফির কাজের চাপে যখন মন খারাপ হোক না কেন? #বেলা_শেষে বাড়ি ফিরে তোমার হাসি মুখখানা দেখলে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। আমার ভালো থাকার মহা ঔষুদ তুমি।আর আমি তোমাকে কি শাস্তি দিবো বল।আমার শুধু একটা কথাই জানতে চাই, তোমার অফিস, নিয়ে কথা বললে ইগনোর কেন করো। সেখানে কোন ঝামেলা হয়েছে কি? বলো আমাকে।

-আরাভের কথা শুনে চুপসে যায় ভূমি। আরাভ এই কারনে তার সাথে রেগে আছে।

-এই কারনে তুমি রেগে আছো আমার উপর। করুন চোখে আরাভের দিকে তাকিয়ে বলল ভূমি।

-কারনটা আমি জানতে চাই ভূমি। প্লিজ চুপ করে থেকো না। স্পিক আপ। ভূমি প্লিজ বলো আমাকে কি হয়েছে। চুপ করে থাকলে কোন সমস্যার সমাধান হয় না। বলো আমাকে।

-এটার সমাধান তুমি করতে পারবে না আরাভ। মাথা নিচু করে বলল ভূমি। আমি আর কোন দিন লো-ইয়ার হিসাবে কাজ করতে পারবো না আরাভ। আমার ক্যারিয়ার নস্ট হয়ে গেছে।

ভূমির কথা শুনে আরাভের হাত আলগা হয়ে আসলো। ও ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলো মনে মনে। তার কানের কাছে এখনো একটা কথাই বাঝছে, আমার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে গেছে।

-কি করে হলো এসব।

আরাভের প্রশ্নে শুনে ভূমি ছলছল চোখে ওর দিকে তাকায়। অতঃপর বলতে শুরু করে, একদিনের জন্যে বিচারপতি হয়ে আমি আমার পুরো ক্যারিয়ারটাই শেষ করে দিয়েছি। মাহিনকে কোর্টে উঠানোর পর আমি প্রথমে একজন আইনজীবি হিসাবে যোগ দেই। ওর সমস্ত কু কর্মের প্রমান জোগাড় করি আমি। কিন্ত তাতেও আমার শান্তি হচ্ছিল না। ওর ফাঁসির আদেশ নিজে হাতে লিখতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু আমি বিচারপতি নই। তাহলে কি করে মাহিনের ফাঁসির আদেশ লিখবো আমি।

বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনজীবী ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের মধ্যে সত্যিকার যোগ্য ব্যক্তি নির্ধারণে প্রধান বিচারপতি মুখ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তি বলে মত দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নিয়োগ বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া এক রায়ে এমন মত এসেছে। সংবিধানের ৯৫ (২) অনুচ্ছেদ তুলে ধরে যোগ্যতার বিষয়ে সাত দফা পর্যবেক্ষণসহ হাইকোর্টের দেওয়া ৪৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ একটি রায় প্রকাশিত হয়।

রায়ে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে একজন ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স ৪৫ হওয়া উচিত। বিচারকদের ক্ষেত্রে জেলা ও দায়রা আদালতে বিচারিক অভিজ্ঞতা তিন বছরের কম হলে উচ্চতর বিচারিক ক্ষেত্রে তাঁরা সুপারিশের জন্য গণ্য হবেন।

এর কোনটাই আমার ছিলো না। আমি কিছুতেই বিচারপতির আসনে বসতে পারছিলাম না। তাই আমি বিচারপতি জিয়াউর হায়দারের সাথে কথা বলি। আর তিনি আমাকে একটা শর্ত দেন। আমি দ্বিধায় পরে যাই। কি করবো। একদিকে আমার স্বপ্ন,আমার ক্যারিয়ার আর অন্যদিকে মাহিনের ফাঁসির রায় লেখার ইচ্ছে। কোনটা নেওয়া উচিৎ বুঝতে পারছিলাম না। পর ভাবলাম, আইনজীবি হতে চেয়েছিলাম অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্যে। মাহিনের চেয়ে বড় অপরাধী আর কে হতে পারে বল আমাকে। যে মেদের সম্মান নষ্ট করে। আমাদের দু দুবার ধর্ষণ করতে চেয়েছে। তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো তার শাস্তি আমি নিজের হাতে লেখতে পারবো না। এটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। পরে যা হবে দেখা যাবে। আমি শর্তটা মেনে নেই। আর একদিনের বিচারপতি হয়ে আমার স্বপ্ন বিসর্জন দেই। আরাভ আমি জানি আবেগের বসে আমি ভূল সিদ্ধান্ত নিয়েছি।কি করবো বলো, দু-চোখ বন্ধ করলেই তোমার সেই রক্তাক্ত শরীরটা ভেসে উঠতো। আরাভ প্লিজ আমাকে ভূল বুঝো না তুমি। বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো ভূমি। আরাভ ভূমিকে নিজের বুকে জড়িয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

-প্লিজ কেদো না জান। তোমার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এই সিদ্ধান্ত টাই নিতাম। প্লিজ কেঁদো না। আমি বিচারপতি জিয়াউর হায়দারের সাথে কথা বলবো। ওনি কেন তোমাকে এমন শর্ত দিলো। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে ক্যারিয়ার তোমাকে ফিরিয়ে দিবো আমি।

ভূমি আরাভকে দুহাতে শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো। আরাভও তার প্রিয়সিকে তার বুকে আগলে রাখলো।

চলবে,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে