ভালোবাসার অন্যরূপ পর্ব-০৮

0
1012

#ভালোবাসার_অন্যরূপ🍁

#লেখিকা:- Nishi Chowdhury

#অষ্টম_খন্ড

পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ আগে। আলোকিত পৃথিবীটাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে রাতের অন্ধকার।

সেইসাথে ক্রমবর্ধমান হারে জ্বর গ্রাস করছে আরিশাকে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার। কিছুক্ষণ আগে আরিসার আম্মু থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখলেন আরিশা গায়ে 103 ডিগ্রি জ্বর। বেহুশের মত পরে আছে মেয়েটা। কয়েকবার ডাকলে শুধু হু হা জবাব দিচ্ছে।

কাজের মেয়েটা মাথার কাছে বসে এক নাগাড়ে পানি দিচ্ছে। আর আরিসার আম্মু আরিশার মাথায় পানি পট্টি দিয়ে দিচ্ছে। আরকিছুক্ষণ পরপর হালকা উষ্ণ গরম পানিতে নরম টাওয়েল ভিজিয়ে আরিশার পুরো শরীর মুছে দিচ্ছে তার আম্মু। আরিশা চুপটি করে শুয়ে আছে।

হঠাৎ রুমের ভেতর হুড়মুড় করে প্রবেশ করল আহনাফ ও তার আম্মু । রুমের ভেতরে শাশুড়ি মা ও কাজের মেয়েটা থাকায় আহনাফ সংকোচ বোধের কারণে আরিশার কাছে গেল না। দরজার কাছে দাড়িয়ে রইল। কিন্তু আহনাফের আম্মু আরিশার কাছে চলে আসেন

— কি হয়েছে আরিশা মামণির? সকালে তো দিব্যি সুস্থ শরীরে এই বাসায় এসেছে। তাহলে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেল কিভাবে? আপনি সেই দুপুরে যখন বললেন আরিশা অসুস্থ। আমি প্রচন্ড অবাক হয়েছি। তাই ও বাড়িতে আর থাকতে না পেরে আহনাফকে ফোন দিয়ে পেলাম কিছুক্ষণ আগে, তারপর ও এসে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

— জ্বর এসেছে আপা। এই সন্ধ্যা থেকে।

— কিভাবে জ্বর আসলো? মামনি কী ভয় পেয়েছিল নাকি? ভয় পেলে সাধারণত এত তাড়াতাড়ি জ্বর আসে। আমি কি ওর পাশে একটু বসতে পারি?

— হ্যাঁ অবশ্যই।

বলে নিজের আসন ছেড়ে উঠে গেলেন আরিশার আম্মু। আহনাফের আম্মু সেখানে বসে আরিশার কপালে হাত দিয়ে বললেন,

—- ইস। শরীরটা জ্বর একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। ওকে ওষুধ খাইয়েছেন আপা?

—- হ্যাঁ দুপুরে ভাত খাইয়ে আমি নিজের হাতে ওকে ঔষধ খাইয়ে দিয়েছি। তখন শরীর অল্প অল্প গরম ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে যেন জ্বরটা জেকে বসলো।

— ও

আরিশাকে নিজের কাছে টেনে নিতে গেলে আরিশার গা থেকে চাদরটা সরে যায়। সম্পূর্ণ উন্মুক্ত শরীর আরিশার যা সাদা চাদরে জড়ানো ছিল।

আতকে উঠলেন আহনাফের আম্মু। আরিশার ফর্সা শরীরের পুরো পিঠের বিভিন্ন অংশে চিকন চিকন কালশিটে দাগ জমেছে । হাতে এবং শরীরের অন্যান্য অংশগুলোতে ও হয়তো এমন হয়েছে। চাদর সরিয়ে দেখেননি। কারণ ছেলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে একটা অপ্রীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

আহনাফের আম্মু বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না যে এই ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছে আর কার জন্য ঘটেছে। তিনি আরিশার আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

— এটা আপনি কি করেছেন আপা? নিজের মেয়েকে কেউ এভাবে মারে? হাত দেওয়ার জায়গা রাখেননি পিঠে এমন মার মেরেছে মেয়েটাকে। কি করেছেন আপনি এগুলো?

আরিসার আম্মু নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। কিন্তু চোখের কোনে অশ্রুগুলো চিকচিক করছে।

আহনাফ দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকার কারণে আর আরিশা কে ঘিরে তিনজন আছে বলেই সে আরিশাকে দেখতে পাইনি। কিন্তু মায়ের মুখে আরিশার জ্বর আর ওকে মারার কথা শুনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা সে খাটের কাছাকাছি এসে বলল,

— কি হয়েছে আম্মু? কি বলছো তুমি? আরিসাকে মামনি মারবে কেন?

আহনাফের আম্মু ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— তুই এখানে আয়? আরিশার পাশে বস। এখন ওর তোকে প্রয়োজন। আমরা বাইরে যাচ্ছি।

কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন আহনাফের আম্মু। তারপর আরিশার আম্মুর উদ্দেশ্যে বললেন,

— চলুন আপা । আমরা বাইরে যাই। কথাগুলো বলে আহনাফের আম্মু আরিশার আম্মুকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে আর তার পিছু পিছু কাজের মেয়েটিও বেরিয়ে গেল।

রুমে এখন বর্তমানে আরিশা অচেতন অবস্থায় আছে আর আহনাফ তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই রুম থেকে এক এক করে বেরিয়ে গেলে আহনাফ আরিশার কাছে যায়।

সকালে মেয়েটা কে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে কিন্তু হঠাৎ এই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কি এমন হয়ে গেছে যে মুখটা এমন শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। প্রথমে আরিশার কপালে হাত দিল। সত্যি শরীর অনেক জ্বর। এবার চেকআপ করার জন্য

আরিশার শরীর থেকে চাদর সরাতেই যেন হতবাক হয়ে গেল আহনাফ। বিস্ময়ের চোখ জোড়ায় স্থির হয়ে গেল আরিশার শরীরের উপর। কিছুক্ষণ এক পলকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আপন ইচ্ছায় তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ল তার হাতের উপর। সম্মোহন কেটে গেল তার। দ্রুত আরিশার মাথা নিজের কোলের মধ্যে রেখে তাকে চেকআপ করতে লাগল আহনাফ।

প্রিয় মানুষটার শরীরে এমন অজস্র মারের দাগ দেখে চোখ জোড়ায় যেন অশ্রুর বাঁধ ভেঙেছে। সে তার মেডিকেল লাইফে এরকম অনেক কেস হ্যান্ডেল করেছে কিন্তু এই প্রথম তার সারা শরীর কাঁপছে অবশ হয়ে আসছে তার হাত জোড়া। তার সাথে চোখে টলমল করছে পানি।

চেকআপ শেষ করে সযত্নে আরিসাকে শুয়ে দিল বিছানায়। ডান সাইডে আঘাত কম পেয়েছে। তাই বালিশ দিয়ে ডান কাত করে আরিশাকে শুইয়ে দিয়েছে আহনাফ। তারপর গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে।

ড্রইংরুমে আরিসার আম্মু ও আহনাফের আম্মু পাশাপাশি বসে আছেন। সবকিছু আরিসার আম্মুর মুখে শুনে হতবাক হয়ে গেলেন আহনাফের আম্মু।

ব্যাপারটা খুবই সেনসিটিভ। ধরলে অনেক কিছু না ধরলে তেমন কিছু না। আহনাফের আম্মু নিজের কাছে নিজেই অনেক ছোট হয়ে গেল। ব্যাপারটা এতটাও গুরু দোষের কিছু ছিল না। সে বরং নিজের মনে সংশয় গুলো আরিশার আম্মুর কাছে প্রকাশ করেছিল তার ফলে মেয়েটা শুধু শুধু মার খেলো।

মুখ ফুটে আহনাফের আম্মু বললেন,

—- আমারই ভুল হয়েছিল আপা। আমার মোটেও উচিত হয়নি আপনাকে এভাবে বলা। আমার কথাগুলো শুনেই মেয়েটাকে ফালতু মারলেন। এসব আমার জন্য হয়েছে।

ড্রইংরুমে ঢুকতেই তার মায়ের শেষ কথাটা কানে লাগলো। সবাইকে বসে থাকতে দেখেও কোন কথা না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে গেলে আহনাফকে পিছন থেকে ডেকে ওঠে আরিশার আম্মু।

— কোথায় যাচ্ছ বাবা?

আহনাফের অনেক রাগ হয়েছে আরিশার আম্মুর উপর। তার পরেও ভদ্রতার সহিত নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

— যাকে এভাবে নির্দয়ভাবে মেরেছেন। সে আমার বউ হয় আন্টি। আর তাকে সেবা-শুশ্রূষা করা আমার দায়িত্ব। আমি তো আর জানতাম না এসে ওকে ঐভাবে দেখব। তাই সাথে করে মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট কিছুই আনিনি। যা যা প্রয়োজন এখন আনতে হবে। সেগুলোই আনতে যাচ্ছি।

কিন্তু একটা কথা আন্টি। এই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কি এমন ঘটেছিল তা আমি জানিনা তারপরেও বলছি কাজটা আপনি মোটেও ঠিক করেন নি।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে আর দাঁড়ালো না আহনাফ বেরিয়ে গেল আরিশাদের বাসা থেকে।

🌺 🌼 🌺

প্রায় তিন ঘন্টার প্রচেষ্টায় কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে আরিশার। জ্ঞান ফিরতে কারোর কোলে নিজের মাথাটা অনুভব করতে ধীরে ধীরে দুর্বল চোখে তাকালে উপরের দিকে আরিশা। তার চোখের সামনে একটা কোমল, নির্মল, ক্লান্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ চেহারা ভেসে উঠলো। চোখ জোড়া অশ্রুতে টইটুম্বুর। আরিশা একনাগাড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সেই চোখ জোড়ার দিকে। তার চোখ দিয়েও কয়েক ফোঁটা অশ্রু কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরল।

আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে উল্টো ঘুরে বসে আহনাফকে জড়িয়ে ধরল আরিশা এবং শব্দ করে কেঁদে উঠলো। এই আলিঙ্গনের প্রয়োজন ছিল আরিশার। সেই বিকেল থেকেই তার ছন্নছাড়া বেখেয়ালি মনটা শুধু কেন জানি আহনাফকে চাইছিল। একটা উষ্ণ আলিঙ্গন চাইছিল যার বুকে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিলেও মনটা হালকা হয়ে যায়।

মানুষ যখন কোন বিপদে পড়ে বা ভয় পায় তখন প্রিয় মানুষটার উষ্ণ আলিঙ্গন চায়। যার মাধ্যমে সে তার সব ভয় কে জয় করতে পারে। কিন্তু আহনাফ কবে প্রিয় মানুষ হয়ে উঠলো। সেটা আরিশা নিজেও জানেনা সে শুধু জানে এখন তার আহনাফকে প্রয়োজন ব্যাস……….!

তাই চোখ মেলে যখনই আহনাফকে দেখল নিজের সামনে। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না ঝাঁপিয়ে পড়লো তার প্রিয় মানুষটার বুকে। আহনাফের ঘাড়ে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ অশ্রু বিসর্জন দিয়ে জড়ানো কণ্ঠে আরিশা বলে উঠলো,

—- কেন জানিনা আজ বিকাল থেকে আমি তোমাকে খুব মিস করেছি। আমার মনে হচ্ছিল তুমি আসলে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। কিন্তু লজ্জায় আর সংকোচ বোধের কারণে আমি তোমার কাছে ফোন দিতে পারিনি। আই এম সরি আহনাফ। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি।

প্রথমত আরিশার এমন হঠাৎ আক্রমণে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল আহনাফ। তারপর তার মুখে নিজেকে মিস করার কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছে আহনাফ। সে আরিশাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,

—- আমি জানতাম না তুমি আমাকে এতটা মিস করবে? জানলে অবশ্যই আমি আরো আগে চলে আসতাম তোমার কাছে।

এমন সময় দরজায় নক পড়লো। আরিশা এতক্ষণে খেয়াল হলো তার গায়ে পাতলা একটা চাদর ছাড়া আর কিছুই জড়ানো নেই আর সেই অবস্থাতেই আহনাফকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ইতস্তত করে আহনাফ এর উদ্দেশ্যে বলল,

— একটু কষ্ট করে ও ওই ওয়ারড্রব থেকে আমার একটা জামা এনে দেবে।

আহনাফ খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে আরিশার গায়ের চাদরটা ঠিক করে টেনে দিয়ে বলল,

তোমার শরীরের আঘাতের জায়গায় মলম লাগানো হয়েছে এখন ফিটিং জামা পরা যাবে না। যেভাবে আছো সেভাবে চুপটি করে বসে থাকো।

তারপর মুখ নামিয়ে কানের কাছে আস্তে আস্তে বলল,

— এখন আর এত লজ্জা পেতে হবে না। তোমার স্বামীই তো হই পরপুরুষ তো নই।

আহনাফ গিয়ে দরজা খুলতে ঘরের ভেতর একে একে আরিসার আম্মু, আহনাফের আম্মু প্রবেশ করলো। আহনাফের আম্মু আরিশার কাছে এগিয়ে গিয়ে কপালে হাত দিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল,

—- মেয়েটার জ্বর নেমে গেছে। এখন শরীর একদম ঠান্ডা। এখন কেমন লাগছে রে মা তোর? ব্যথা করছে শরীর?

আরিশা মাথা নিচু করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর আরিশার আম্মু এগিয়ে গিয়ে মেয়ের পাশে বসলেন। আহনাফের আম্মু আহনাফকে চোখে ইশারা করে ঘর থেকে চলে যেতে বলল। তারপর নিজেও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে।

আরিসার আম্মু মেয়েকে টেনে বুকের মধ্যে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন,

— তোর খুব লেগেছে তাই নারে মা? কি করব বল তো ওই সময় তুই এমন ভাবে কথাগুলো বললি । আমি আর নিজের রাগ টা কে ধরে রাখতে পারিনি। সব রাগ ঝেড়েছি তোর ওপর।

আরিশা নিরবে কাঁদছে। চোখ জোড়ার পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে আরিশার মায়ের ঘাড়ের কাছে শাড়ির কিছু অংশ ভিজে যাচ্ছে।

আমি জানি আমার মেয়েটা খুব ব্যথা পেয়েছে আজকে। কিন্তু এই ব্যাথাটা মলম লাগিয়ে ওষুধ দিয়ে ঠিকই একদিন সেরে যাবে নয় এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহ নয় আরেকটু বেশি সময় একমাস লাগলো কিন্তু তুই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবি। কিন্তু মা তুই যে ভুল পথে যাচ্ছিলি ওখানে গেলে যা আঘাত পেতে হতো তোকে তা তুই সারা দুনিয়ার সমস্ত ওষুধ দিয়েও সেই ঘা সারাতে পারতিস না। আর ওই ঘা ক্যান্সারের মতো তোকে কুরে কুরে খেত।

পরক্রিয়া এ সমাজে এক মরণব্যাধি নাম। টিভি নিউজ পেপার খুললেই এই পরক্রিয়া জন্য কত ছেলে মেয়ের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কত দুধের শিশু , ছোট বাচ্চা এই পরক্রিয়ার বলি হচ্ছে তা আমরা নিজের চোখে দেখতে পাইরে মা।

👉এই পরক্রিয়ার শুরুটা হয়তো খুব মোহনীয় হয় কিন্তু শেষটা নরকযন্ত্রণা থেকেও বিষাক্ত হয়।

আরিশা জড়ানো কণ্ঠে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

— আম্মু তুমি বিশ্বাস করো। আমি ওই বেয়াদব টার সাথে আবার সম্পর্কটাকে পুনরায় ঠিক করার জন্য দেখা করতে চাইনি। সে আমাকে বারবার রিকোয়েস্ট করছিলো। সে নাকি কি প্রমাণ দেবে। আমি জানতাম তুমি মিথ্যে কথা বলবে না। আমার মা কখনো মিথ্যা কথা বলে না আমি সেটা খুব ভাল করেই জানি। তাই ওকে সরাসরিভাবে নিষেধ করতে চেয়েছিলাম যাতে সে আমাকে আর কখনো বিরক্ত না করে। সাথে করে আমার ফ্রেন্ড সার্কেল কেউ যেতে বলেছিলাম। কিন্তু তার আগে তুমি কোন কিছু না শুনেই আমার উপরে চড়াও হয়ে ছিলে।

আরিসার আম্মু মেয়ের মুখটা নিজের হাতের মধ্যে এনে বললেন,

—- তুই এখন বুঝবি নারে মা। আমি কেন আজ তোকে ওখানে যেতে দিলাম না। আমার মন বলছিল আজ তোর জন্য খুব বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। হয়তো ওই ছেলেটা আজ থেকে কোন বড় বিপদে ফেলে দিত।

একটা কথা কেন বুঝলি না তুই,
তোর তো বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরেও এখন এত প্রমাণের কি আছে? কি হবে প্রমাণ দিয়ে। তারপরও যখন ওই ছেলেটা তোকে ডাকছে, তোর সাথে দেখা করতে চাচ্ছে তোর কি মনে হয় না যে ছেলেটার কোন অসৎ উদ্দেশ্য আছে।

আরিশা এবার সত্যিই ভাবনায় পড়ে গেল। মা তো ঠিক কথাই বলেছে। সত্যিই তো এখন এসব প্রমাণ প্রমাণ দিয়ে কি হবে। সেটা আরিশাও অভিকে প্রশ্ন করেছিল কিন্তু সে বারবার তার কথা এড়িয়ে গিয়ে বলছিল,

—- শুধুমাত্র একবার দেখা করো আমার সাথে। আমি সব ঠিক করে দেবো।

আরিসার আম্মু মেয়েকে বুক থেকে সরিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

— আজ তোর মনের ভিতর চলতে থাকা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবি না। কিন্তু একদিন না একদিন ঠিক পাবি। সেদিন তোর মায়ের এই কথাগুলো মনে পড়বে। মিলিয়ে নিস আমার কথাগুলো।

নে এবার বিশ্রাম কর। তোর আব্বু ভাইয়া তো শহরের বাইরে গেছে। তারা ফিরলে সবাই মিলে বসে একটা দিন ঠিক করব তারপর খুব বড় করে অনুষ্ঠান করে তোকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবো। তার আগে ইনশাল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবি।

আরিশা মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর বলল,

— তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মু। তোমার সাথে আজ অনেক বেয়াদবি করে ফেলেছি।

ধুর আমি কিছু মনে রাখিনি। বরং তুই আমাকে মাফ করে দিস আজ আমি না চাইতেও আমার কলিজার টুকরাকে অনেক আঘাত করে ফেলেছি।

কথাগুলো বলে দ্রুত মেয়ের রুম ত্যাগ করলেন আরিশার আম্মু। আর মায়ের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকলো আরিশা। মায়েরা এমনই হয় তাই না।

🌺 🌼 🌺

রাত বারোটা বাজে,

শহরের প্রায় একাংশ ঘুমন্ত পুরী তে পরিণত হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে ডিনার শেষ করে সবাই যে যার রুমে ঘুমাতে গেল। আহনাফের আম্মু ও আজ আরিশার বাপের বাড়িতে রয়ে গেল। তিনি আজ তার বেয়ানের সাথে খোশ গল্পে রাত পার করবেন। আহনাফ ও আরিশা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে আসলো।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আরিশার হঠাৎ ছাদে যাওয়ার বায়নায় আহনাফ টিকতে না পেরে তাকে কোলে করে নিয়ে ছাদে চলে আসলো। সত্যি আরিশাদের ছাদটা অনেক বড় এবং সুন্দর। ছাদে বসার জন্য একটা ডিভানের মত আছে। কিছু সোফাসেট রাখা আছে বিকেলের সৌন্দর্যতা এখানে বসে উপভোগ করার জন্য। আরিশা কে কোলে করে নিয়ে গিয়ে ডিভানে বসলো আহনাফ। আরিশা আহনাফের কাঁধে মাথা দু হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।

কিছুক্ষণ পর আরিশা বলল,

—- তুমি আমার ওপর খুব রেগে আছো তাই না?

— কেন?

— এই যে আমি তোমাকে না বলে। তোমার অগোচরে অভির সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম এজন্য।

—- যদি বলি রাগ করিনি তাহলে মিথ্যা বলা হবে। আবার যদি বলি খুব রাগ করেছি তাও মিথ্যা বলা হবে।

—- এখনো কি রেগে আছো আমার উপর?

—- মোটেও না। বরং আমি চাই সবকিছু ভুলে আবার নতুন করে শুরু করতে। প্রত্যেকের জীবনে কোন না কোন অতীত থাকে তাই বলে কি অতীতের ঘটে যাওয়া সেই ভুলগুলো আঁকড়ে ধরে জীবনটাকে শেষ করে দিতে হবে। মোটেও না বরং অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে হবে তাহলেই তো জীবনটা সুন্দর হবে তাইনা।

আরিশা জোরে একটা শ্বাস নিয়ে আহনাফের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল,

—-সত্যি বলছি আহনাফ। এই কয়েক ঘন্টায় তোমার সাথে থেকে তোমাকে কাছ থেকে জেনে সত্যি তোমার মোহে পড়ে গেছি।আর মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই ভালোবেসে ফেলব তোমাকে।

— আরে আমিতো এমনই । আমার আশেপাশে থেকে যতই চেষ্টা করো না কেন আমাকে ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না।

— হাহা হা তাই নাকি?

— জ্বী ম্যাডাম। নাও এখন নীচে চলো। অনেক রাত হয়ে গেছে।

—- উহু যেতে ইচ্ছা করছে না।

— তাহলে কি ইচ্ছা করছে?

— ইচ্ছা করছে তোমাকে বিছানা বানিয়ে তোমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়তে।

—- এতো রোমান্টিক ব্যাপার-স্যাপার।তা এত দেরি কেন তারাতারি এসো।

তাই বলে আহনাফ ডিভানের লম্বা হয়ে শুয়ে পরলো।ডিভানে একজন ভালোভাবে শুতে পারলেও দুইজন শোয়াটা একটু কষ্টের । কিন্তু ম্যারিড কাপলদের জন্য ঠিক আছে।আরিশার শরীরের তিনভাগের দুই ভাগ ভর আহনাফের উপর।তার পরেও আহনাফ এর কষ্ট লাগছে না বরং ভালো লাগছে।

প্রিয় মানুষটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর মজাই আলাদা।আরিশাও আহনাফ এর বুকে মাথা রেখে এক পরম শান্তির ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে । যা অনেকদিন পর তার চোখে ধরা দিয়েছে। আর আহনাফ সে তো এই মূহূর্তটাকে অনুভব করতে ব্যস্ত আছে।

দুইজন ই একসময় নিজেদের অজান্তে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।

কিন্তু মাঝরাতে এই শান্তির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে আহনাফ এর ফোনের রিংটোন এর শব্দে। আহনাফ চোখ মেলে তাকালেও আরিশা ঔষধের প্রভাবে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ফোনটা সামনে টি টেবিলে রাখা। তাই নিজের বুকের উপর আরিশাকে এক হাতে আঁকড়ে ধরে কিছুটা উঁচু হয়ে হাতরে টি টেবিল থেকে ফোনটা নিলো আহনাফ। চোখের চশমাটা ঠিক করে ফোনটা উঁচু করেই কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল ভেসে ওঠা নামটার উপর। তারপর রিসিভ করে কানে নিয়ে বলল,

— যেমন বলেছিলাম সেভাবে কাজ হয়ে গেছে?

—— ****

—- ঠিক আছে নজরে রেখো। আমি কিছুক্ষণ পর আসছি।

কথা শেষ করে আরিশা কে নিয়ে নিচে নেমে আসলো আহনাফ। বিছানায় যত্ন করে শুইয়ে দিয়ে। নিজের রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল তার নিজস্ব উদ্দেশ্যে।

চলবে……….!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে