ভালোবাসার অন্যরূপ পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
1287

#ভালোবাসার_অন্যরূপ🍁

#লেখিকা:- Nishi Chowdhury

#দশম_ও_শেষ_খন্ড

রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে আরিশা ও অভি। কিছুক্ষণ আগে অভি আরিশাকে ডেকেছিল। আরিসা পিছনে ঘুরে সে চেনা-পরিচিত মানুষটিকে চিনতে খুব বেশি কষ্ট হয়নি। প্রথম নজরেই চিনে ফেলেছিল।

চিনতে একটু কষ্ট হওয়ার কারণ অভির চেহারায় সেই আগের মত জৌলুস আর নেই। কেমন যেন একটা ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। অভি আরিসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আরিশা কে বলল,

— কেমন আছো আরিশা?

— ভালো। আপনি কেমন আছেন?

— এই আছি কোনরকম। আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে। যদি কিছুক্ষণ সময় আমাকে দাও। তাহলে খুশি হব।

আরিশার মনের মধ্যে ঘূর্ণয়মান প্রশ্নগুলো জট খোলার সময় এসে গেছে তা বুঝতে পেরে বিনা সংকোচে তার অফার একসেপ্ট করল আরিশা। তারা শপিং কমপ্লেক্স এর সংলগ্ন একটি রেস্টুরেন্টে বসলো।

—- কি বলবেন বলুন?

— অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছো তুমি আরিশা।

—- কাজের কথা বলুন আমি আপনার সাথে এখানে খোশগল্প করার জন্য বসে নেই। আপনি বলেছেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তাই এখন আমি আপনার সামনে বসে আছি।

অভি কিছুক্ষণ আরিশার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠলো,

—- তোমার মনে প্রশ্ন জাগে না। হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন আমি? তোমাকে তো বিকেলে কফিশপে দেখা করতে বলেছিলাম। তুমি এসেছিলে কি?

আরিশা পুরনো কিছু স্মৃতি মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— না আমি আসতে পারিনি।

— কিন্তু আমি এসেছিলাম। এক ঘন্টা বসে ছিলাম। তারপরে যখন তুমি আসোনি তখন আমি….

ওসব বাদ দিন। ঐদিন কি বলতে চেয়েছিলাম সেটাই বলুন।

অভি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

— তোমার মা আমার সম্পর্কে যা যা বলেছিল তার পুরোটাই সত্যি। আমি বিবাহিত। তোমার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে আমি বিয়ে করেছিলাম। ইনফ্যাক্ট বাধ্য হয়েছিলাম। বাবার বন্ধুর মেয়ে কে বিয়ে করতে। বাবা তার বিজনেস সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য আমাকে জোর করে ওই মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমি সংসার জীবনে সুখী ছিলাম না।

— সেটা আপনার পার্সোনাল ম্যাটার। আমি আর কিছু শুনতে চাই না। আমি আপনার জন্য আমার মাকে অনেক ভুল বুঝেছি। অনেক বাজে কথা বলেছি আমার মাকে। আমার অমন স্বামীকেও আমি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম আপনার জন্য। আপনি অনেক বড় অন্যায় করেছেন অভি। অনেক বড় অন্যায়।

— সেটার জন্য তো শাস্তি পাচ্ছি আমি।

ভুরু কুচকে তাকালো আরিশা অভির দিকে। তা দেখে অভি বলে উঠলো,

— তুমি তখন আমার কথাটা শেষ নামাতে দাওনি। সেদিন আমি এসে এক ঘন্টা বসে ছিলাম। তোমার নাম্বারে বারবার ফোন দিচ্ছিলাম কিন্তু তোমার নাম্বার বারবারই নট রিচেবল বলছিল। হঠাৎ ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে।

প্রথমে রিসিভ না করলেও পরে মনে করলাম হয়তো তুমি দিতে পারো। তাই আমি রিসিভ করলাম। একজন আমার পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইল। আমি বললাম। তারপর সে আমার স্টুডেন্ট-এর পরিচয় দিয়ে বলল আমার সাথে নাকি তার কি কথা আছে। আমি তাকে বললাম আমি একটা রেস্টুরেন্টে আছি। সে আমার থেকে ঠিকানা নিয়ে।

ওখানে যায় এবং আমাকে ফোন দিয়ে বলে আমি বাইরে আছি আপনি দয়া করে বাইরে আসুন। আমি গিয়েছিলাম তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু সেখানে কেউ ছিলনা। হঠাৎ কেউ আমার নাক মুখ বরাবর একটা রুমাল ঠেসে ধরে। তারপরে আর কিছু মনে নেই আমার।

তারপরে যখন জ্ঞান ফিরে আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে ছিলাম। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে যখন আমার জ্ঞান ফিরল। তখন আমার পুরো পরিবার আমার পাশে বসে আছে। কিন্তু সারা শরীরে অতটাও ব্যথা লাগেনি যতটা ব্যথা লেগেছে এই খবরটা শোনার পরে। যে আমি নাকি আর কোনদিনও বাবা হতে পারবো না।

হুহ। সেদিন সত্যি নিজের উপর অনেক করুণা হয়েছিল আমার। মেনে নিতে পারিনি ব্যাপারটা। আমার এই খবর শুনে আমার স্ত্রী আমাকে ফেলে চলে যায়। তার ছয় মাসের মাথায় আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়।

— সত্যি অনেক বড় অন্যায় করেছে আরিশা তোমার সাথে। আরও বড় অন্যায় করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।

কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল অভি। ছেলেরা সহজে কাঁদে না তা আরিশা জানে। কিন্তু অভির এই কান্না দেখে আরিশার সেই আগের মত খারাপ লাগছে না। বরণ করুণা হচ্ছে ।

আরিশা তাকে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে প্রশ্ন করে উঠলো

—- আবার নতুন করে কি অন্যায় করতে চেয়ে ছিলেন আপনি?

অভি কান্না থামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন তারপর উত্তর দিলো

— তোমাকে নিজের কাছে আটকে রাখার জন্য যতটা নিচে নামা যায় ততটা নিচে নামতে চেয়েছিলাম আমি। আমি জানতাম তুমি আমার বিয়ের কথা শুনে। আমাকে ছেড়ে চলে যেতে
কিন্তু আমিতো তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। তাই এই একটা রাস্তায় আমার কাছে খোলা ছিল।

কথাগুলো শুনে শিউরে উঠলো আরিশা। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে অভির দিকে। অভি একবারও আর আরিশার দিকে তাকাই নি। নিচের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলো,

— সেদিন আমি তোমাকে কফিশপে ডাকলেও ওখান থেকে তোমাকে যে কোনো পন্থায় আমি আমার ঠিক করা রেসর্ট নিয়ে যেতাম। তারপর…

—- চুপ করুন। আর একটা কথা শুনতে চাই না আমি আপনার।

আরিশার কন্ঠ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ল। আরিশা আর দাঁড়ালো না। ব্যাগ গুলো নিয়ে রেস্টুরেন্টের বাইরে চলে আসলো। দেশে আসার পথ অবরোধ করে বলল,

— আরিশা আমি ভালোবাসা অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। আমি চেয়েছিলাম যে কোনো পন্থায় তোমাকে আমার কাছে আটকে রাখতে।

— আপনার পন্থা বা পদ্ধতি যেটাই বলুক না কেন সেটা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। আপনি জানেন আমি কেন সেদিন আসেনি। কারণ আমার মা হয়তো আপনার এই নোংরা ইনটেনশন বুঝতে পেরেছিল। তাই আমাকে উন্মাদের মতো আঘাত করেছিল। হেঁটে চলাচল করার মতো অবস্থায় আমার মা আমাকে রাখেনি। সত্যি সেদিন প্রচন্ড রাগ হয়েছিল আমার মায়ের ওপর। তার ওপর আপনার ঐ কুমন্ত্রণা মায়ের প্রতিটা কথা কানে বিষের মত লেগেছিল।

এতদিন মনে করতাম আপনার সাথে হয়তো অন্যায় করা হয়েছে। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি আমি কত বড় ভুল ছিলাম। প্রসঙ্গ যদি আসে আপনাকে মাফ করে দেওয়ার। তাহলে বলব সমাজের বুকে আপনি আমাকে অপমানিত করার জন্য যে ভয়ঙ্কর খেলা খেলতে চেয়েছিলেন সেই খেলায় আপনি নিজেই জড়িয়ে গেছেন। যেখানে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আপনাকে শাস্তি দিচ্ছে। সেখানে নতুন করে আমি আর কোনো কিছু করতেও চাইনা আর বলতেও চাইনা। শুধু এটুকু বলব আমি আপনাকে মাফ করে দিয়েছি। ভালো থাকবেন।

অভি আরো কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু আরিসা আর শুনলো না।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে শেষ করে আরিশা দৌড়ে গাড়িতে এসে বসলো। এতক্ষণে সে বুক ভরে শ্বাস নিল সে। অভির ঐদিনের পরিকল্পনার শুনে সারা শরীর অসার হয়ে দিয়েছিল আরিশার। বারবার মনে পড়ছে ঐদিন যদি মা তাকে না আটকাতো তাহলে তাকে কি পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হতো তা বারবার ভাবতে গেলেই আর আরিশার শরীর শিউরে উঠছে। সে দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিতে বলল। আরিশার মন বলছে যত দ্রুত এখান থেকে চলে যাওয়া যায় ততই তার জন্য মঙ্গল।

🌺🌼🌺

গাড়ি এসে থামল আরিশার বাবার বাসার সামনে। গাড়ি থেকে শপিং ব্যাগ গুলো নামিয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসলো সে। কলিংবেল দিতে। কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে দরজা খুলে গেল। আরাফ দৌড়ে এসে তার মাকে জড়িয়ে ধরল। সাড়ে তিন বছর বয়স মাত্র। হাতের শপিং ব্যাগ থাকার কারণে ছেলেকে ঠিক মতো জড়িয়ে ধরতে পারল না আরিশা। শপিং ব্যাগ গুলো দরজার কোনায় রেখে তারপরে কোলে নিল ছেলেকে। কোলে নিয়ে দুই গালের পাপ্পি দিয়ে বলল,

— আমার বাবাটা কি আমাকে খুব মিস করেছে? আর নানুমণি কে বিরক্ত করোনি তো?

উপরে নিচে মাথা ঝাকালো আরাফ। তারপর আবার ডানে বাঁয়ে। দ্বিতীয় বার বলল সে নানুমণি কে মোটেও ডিস্টার্ব করিনি। সে দেখতে একেবারে বাবার কার্বন কপি। স্বভাব চরিত্র তেও হয়েছে একেবারে বাবার মত। ওর মুখের দিকে তাকালে আরিশার আহনাফের কথা মনে পড়ে যায়।

তারপর আরিশা ছেলের গালে একটা ছোট্ট চুম্বন এঁকে নিচে নামিয়ে দিয়ে বলল,

—- এইতো গুড বয়’। যাও মামার সাথে গিয়ে খেলা করো।

আমার নাতি কি তোদের মতো নাকি। ও হয়েছে একেবারে ওর বাবার মত শান্তশিষ্ট। আর তোরা বদমাইশের দল হয়েছিস সম্পূর্ণ তোর বাপের মত। সকাল হলেই এক ট্যাংকি চা লাগবে তার কিছুক্ষণ পর পর। তারপর এটাকে তো (আরিয়ানের মাথায় চাটি মেরে) সকাল দশটার সময় মেরে মেরে ঘুম থেকে তুলতে হয়। আর তুই কোথায় ছিলি এতোক্ষন? তোর কোর্ট তো বেলা একটায় শেষ হয়ে গেছে। এতক্ষণ কই ছিলি তুই? আর একটা বার ফোন ও দিস না‌।

—- উফ আম্মু। তুমি যেভাবে জেরা করছ তোমার মেয়ের জামাই ও কখনো করে না আমাকে? দেখতে পাচ্ছ তো হাতে শপিং ব্যাগ আছে। শপিংয়ে গেছিলাম আরকি।

—- ফোনে কি হয়েছে? ওটা কি শপিংমলে বেচে দিয়ে এসেছিস নাকি?

— চার্জ খতম।

— পাওয়ার ব্যাংক?

— নিতে ভুলে গেছি।

আরিশার আম্মু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

— সত্যি তোদেরকে আর কিচ্ছু বলার নেই আমার। সব বদেরহাড্ডি গুলো সব আমার কপালে জুটেছে।

এতক্ষন আরাফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানীর কাছে তার মায়ের বকা খাওয়া শুনছিল। বেশ মজাও পাচ্ছিল সে। এই একটা জায়গায় তার মা কংক্রিটের রডের মত সোজা। আরাফ ও এই সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার কম করে না। মামনি একটু বকলেই অমনি নানীর কাছে নালিশ করে সে।

এতক্ষণে আরিসার খেয়াল করে দেখল। তার ছেলে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আরিশা একটু চোখ গরম করে তাকাতে ছুটতে দৌড় দিলো রুমের ভেতরে।

আরিশা তার মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

— ও মা। তোমাকে কতবার বলেছি আমার ছেলের সামনে আমার প্রেস্টিজ পাংচার করবা না। আর তুমি বারবার তাই করো।

প্লিজ রাগ করোনা। সত্যি বলছি আজ এজলাস শেষ করতে দুটো বেজে গিয়েছিলো। তারপর ওখান থেকে শপিংয়ে চলে গিয়েছিলাম।আর….

আর কাজের ফিরিঙ্গি দেওয়া লাগবে না। যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আগে লাঞ্চটা করে নাও।আরিশা তার মায়ের গালে চুমু দিয়ে বলল,ওকে আম্মু। বাবাহ এত আয়োজন? তারপর আশেপাশে তাকিয়ে বলল,

—- আহানাফ এখনো আসেনি ?

— এসেছে। ও তোর জন্য অনেকক্ষণ বসেছিল একসাথে লাঞ্চ করবে বলে। তোকে কতবার ফোন দিল । ফোন বন্ধ । তাই আমি জোর করে তাকে খেতে বসিয়ে দিয়েছিলাম। বেচারা হসপিটালে নাইট শিফট করে একেবারে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল।

ভাগ্য করে একটা জামাই পেয়েছি। শ্বশুরবাড়িতে বছরে দুটোই ঈদ ছাড়া তার টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যায় না। একটু যে আদর আপ্যায়ন করবো তার সুযোগ করে দিতেই চায় না। এই যাহোক বেয়ান শহরের বাইরে গেছেন বলে ছেলেটাকে তিনদিন বেঁধে রেখেছি এই বাড়িতে।

তো কি করবে বলো মা? ডাক্তারদের কোন টাইম টেবিলের ঠিক আছে নাকি। যখন ইচ্ছা তখন হসপিটাল থেকে ডাক পড়বে। সেখানে পাগলের মতো ছুটতে হবে। তোমার জামাই আদর আপ্যায়ন এর সুযোগ পাবে কিভাবে?

—- যা তাড়াতাড়ি যা। দুপুর শেষ হতে চলল। তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চলে আয় তুই আর আমি একসাথে খাব। আর আর আরাফকে আমি অনেক আগেই খাইয়ে দিয়েছি।

শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে নিজের বেডরুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে ব্যাগগুলো আলমারিতে গিয়ে রাখলো। এখানে সে যা যা কিনেছে সবকিছু সে নিজের হাতে সবাইকে দিতে চায়। আলমারি ঘুরে পিছন ঘুরতেই‌ বিছানার উপর আহনাফকে খালি গায়ে ট্রাউজার পড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখল। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মশাই।তাই তাকে ডিস্টার্ব না করে আরিশা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে গেল।

🌼🌺🌼

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আরিশা ঘুমন্ত আরাফকে কোলে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। ছেলেটা দুপুরের এই সময়টা ঘুমায়। ছেলেকে মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে অপর পাশে আরিশা শুয়ে পড়ল। ছেলে স্বামীর মাথায় একসাথে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আরিশা। আরিশা আহনাফের চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবল।

—- এক সময় এই মানুষটার থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য সে কত কিছুই না করে ছিল। কিন্তু আজ তাকে ছাড়া এক কদম চলার কথা ভাবলে আমার বুক কেঁপে ওঠে। কই আহনাফ ও তো আমাকে ভালোবাসে। আমাকে পাওয়ার জন্য সে কোন ভুল পন্থা অবলম্বন করে নিত। বরং বৈধভাবে সে আমাকে কাছে টেনেছে আর আমি তাকে ভালবাসতে বাধ্য হয়েছি। কই এর ভিতরে তো কোন জবরদস্তি ছিল না। কোন লালসা ছিলনা, শুধু ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে এক সময় আরিশা ঘুমিয়ে পড়ল। বেশ অনেক্ষণ পর। একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতির জন্য হঠাৎ চোখ মেলে তাকাল আরিশা। এবং দেখল দুপাশ থেকে বাবা ছেলে মিলে তাকে চেপে ধরেছে। বেচারার নড়াচড়া করার একটু জায়গা অবশিষ্ট নেই। আরিশা এটা ভেবে অবাক হচ্ছে যে সে কখন মাঝখানে চলে আসলো। পরমুহূর্তে বুঝতে পারলে এটা আহনাফ এর কাজ। কিন্তু এভাবে জাপ্টে ধরা মানে কি। মেরে ফেলার ধান্দা করছে নাকি?

অনেক গুঁতোগুঁতি করে অবশেষে আরিশা বাবা ও ছেলের হাত থেকে মুক্তি পেল। ছেলেকে বাবার কাছে ঠেলে দিয়ে নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—- আমার বর মশাই তো কুম্ভকর্ণ ছেলেটাও হয়েছে বাপের মতো কুম্ভকর্ণ। ঘুম পুরোপুরিভাবে কমপ্লিট না হলে এদের দুজনকে কোনভাবে ওঠানো সম্ভব নয়। থাকুক ওরা ওদের মত আমি একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।

যা বলার তাই কাজ। রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনের দিকে নজর যেতেই দেখতে পেল তার মা কিচেনে কি যেন করছে। ডিরেকশন চেঞ্জ করে রান্না ঘরে গিয়ে দেখলো মা চা বানাচ্ছে। পেছনে চুপিচুপি আরিশা দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখতে লাগল হঠাৎ আরিশার আম্মুর পেছনে তাকিয়ে দেখে বলল,

—- কিরে দুপুরে ঘুমাসনি।

— হাহ… ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তাই চলে আসলাম।

— চা খাবি নাকি?

— মন্দ হয় না। চলো গরম চা নিয়ে আমরা ছাদে যাই।

—- আচ্ছা ঠিক আছে।

দুই মগ চা বানিয়ে মা আর মেয়ে ছাদে চলে আসলো। অনেকদিন সময় কাটানো হয় না আরিসার তার মায়ের সাথে। ছাদে উঠে মন মেজাজ দুটিই ফুরফুরে হয়ে উঠলো। চা খেতে খেতে আনিসার আম্মু কত রকম কথা বলতে লাগলেন। গল্প করতে লাগলেন মেয়ের সাথে। ওই বাড়িতে কি হয়েছে, সেদিন গন্ডগোল বেঁধেছিল। সিরিয়ালে এটা হয়েছে ওটা হয়েছে। কত কি। একেবারে মন খুলে মেয়ের সাথে চায়ের আড্ডা জমিয়ে ফেললেন। আরিশা ও তার মার সাথে গল্প করতে লাগল। সে সারাদিন কি কি করেছে। এজলাসে কি কি ঘটনা ঘটেছিল। শুধু মাত্র অভির ব্যাপারটা স্কিপ করে গেল। কথাগুলো মনে পড়তেই হঠাৎ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল আরিশা। এমন অতর্কিত আক্রমণে আরিশার আম্মু কিছুটা ভড়কে গেলেন। মেয়ের মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

— কি হয়েছে তোর কেন কোন সমস্যা?

— আম্মু তুমি জানো। তুমি আমার লাইফ এর কিউট আঞ্জেল। যে সব কিছু আগে থেকেই কেমন ভাবে যেন জেনে যায়। আজ অভির সাথে দেখা হয়েছিল আমার।

তারপর বিস্তারিত সব কিছু বলল তার মাকে। সবকিছু শুনে তার মায়ের মুখে কোনো পরিবর্তন না দেখে বলল,

— কি হলো আম্মু তুমি কিছু বলছো না কেন?

— ভয় পেয়েছিস?

— *****

—- ভয় পাস না। আগে শুধু আমি তোর খেয়াল রাখতাম। আর এখন আহনাফ তোর সর্বক্ষণ এর সাথী। আমার আর কোন ভয় নেই। বলে নিজের বুকের সাথে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন আরিশার আম্মু।

সত্যিই এমন দুটো মানুষ থাকতে আরিশার আর ভয়ের কিছু নেই। মাগরিবের আজান আজান দিয়ে দেওয়াই মা মেয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলো। নামাজ পড়ে নতুন করে চা নাস্তা তৈরি করল। তারপর বসলো সন্ধ্যার আড্ডা। আজ ডিউটি সিডিউল নেই আহনাফের। তাই সেও যোগ দিলো এই আড্ডায়।

আড্ডার এক পর্যায়ে আরিশা গিয়ে শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে আসলো। সবাইকে এক এক করে তাদের গিফট দিল। মায়ের জন্য তার পছন্দের মেরুন কালারের একটি সিল্কের শাড়ি আর বাবার জন্য মায়ের সাথে মিল রেখে মেরুন কালারের একটি পাঞ্জাবি কিনেছে আর আরিয়ানের জন্য কিনেছে একজোড়া স্পোর্টস শু। ছেলের জন্য হালকা কিছু শপিং করেছে।

কিন্তু আহনাফের জন্য? টপ সিক্রেট।তা আহনাফ আরিশার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছে। যেহেতু ব্যাপারটা সবাই কমবেশি বুঝতে পেরেছে তাই আরে ব্যাপার নিয়ে কেউ কথা বাড়ালো না। কিছুক্ষন গল্প করে এশারের নামাজ পড়ে ডিনার শেষ করে যে যার রুমে চলে আসে। আজ হঠাৎ আরাফ বায়না ধরেছে সে নানু নানীর কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাবেন। যা বলে তাই করে বালিশটা নিয়ে ছুটে চলে গেল আরিশার আম্মুর রুমে।

আরিশা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুতে গেলে আহনাফ থাকে হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বসিয়ে দিল। আরিশা শ্বাস ফেলে বলল,

— কি হল আবার ঘুমাবো তো

— অনেক ঘুমিয়েছি। এখন আর ঘুম আসছে না।

— হ্যাঁ নিজের ঘুমটা তো কমপ্লিট করে নিয়েছো। কিন্তু আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। বলছি দুপুরবেলায় এভাবে কেউ চেপে ধরে ঘুমায়। আর একটু হলে আমার দম বেরিয়ে যাচ্ছিল।

—- বউ হেলায় ফেলায় রেখে ঘুমানোর জিনিস না। বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে ঘুমানোর জিনিস। বুঝছো ম্যাডাম। তোমার উপরে আমার রাগ হয়েছিল। মানুষ ফোনটা কেন ব্যবহার করে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। আর তাতেই তোমাকে পাওয়া যায় না। তাই তোমাকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে শাস্তি দিয়েছি। এখন চলো?

— কোথায়?

— তোমাদের বাসার ছাদে। জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর।

— যেতেই হবে।

— অবশ্যই

আচ্ছা ঠিক আছে তুমি আগে যাও আমি একটু পরে আসছি। কথা শেষ করে আহনাফ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আরিশা নিজের শাড়ি ঠিক করে। আলমারি থেকে আহনাফের জন্য আনা শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে চলে গেল। গিয়ে দেখল আহনাফ ছাদের এক কোনায় দোলনায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আরিশা গিয়ে তার পাশে বসতে। সে ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

— একটু বলে অনেকটাই পরে এলে কিন্তু। এর জন্য শাস্তি পেতে হবে।

— শাস্তি পরে দেবেন আগে এগুলো নিন।

— কি এগুলো?

— খুলেই দেখুন।

আহনাফ বক্স টা খুলে অবাক হয়ে গেল। তার জন্য তার সবথেকে পছন্দের পারফিউম। যেটা সে বিগত কয়েক বছর খুঁজেও পাই নি। তার পাশে একটা বক্স । যেটা খুলতেই একটা ব্রেসলেট বেরিয়ে আসলো। যাতে আহনাফ ও আরিশার নামের সাথে আরাফের নামটাও খুব সুন্দর ভাবে ডিজাইন করা। আরিশা নিজে আহনাফের হাতে যত্নসহকারে ব্রেসলেটটা পরিয়ে দিল। সত্যি অসাধারণ লাগছে।

— তুমি এই পারফিউম কোথায় পেলে? এটা আমি কত খুজেছি কিন্তু পাইনি কোথাও।

— এটা আমি স্পেশালি তোমার জন্য আনিয়াছি। তুমি যখন বাসায় এসো। তোমার আগে তোমারি পারফিউমের স্মেল আমাকে জানিয়ে দেয় তুমি আমার আশেপাশেই আছো।

কথাগুলো বলতে বলতে আরিসা পারফিউমটা আহনাফের শরীরে স্প্রে করে দিল। তারপর আহনাফের কাঁধে মাথা রেখে দূর আকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আরিশা। আহনাফের দুহাতে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে এই মুহূর্তটাকে অনুভব করছে।

হঠাৎ আরিশা বলে উঠলো,

—- তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি আহনাফ। যদি বলে কবে থেকে? তাহলে বলব হিসাব করে রাখিনি। যদি বলো কতটা? পরিমাপ করার প্রয়োজনীয়তা দেখিনি। শুধু এটুকু জানি আমি আমার প্রিয়তম কে প্রচন্ড ভালোবাসি।

— আমিও ভালোবাসি আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে।

কথাটা শ্রবণ হতেই আরিশা আরো গভীরভাবে আহনাফকে জড়িয়ে ধরল। এবং একসময় তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্য। আহনাফ আরিশা কে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখে দোলনায় হালকা দুলতে লাগল

হঠাৎ থেমে গিয়ে হেসে উঠলো আহনাফ। আস্তে আস্তে তার হাসির আওয়াজ বাড়তে লাগলো। আলিশার মুখটা এক হাতে তুলে ধরে ঘাড় কাত করে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

— এত কিছু বললে একটা কথা তো বললে না প্রিয়তমা? যে আজ অভি সাথে দেখা হয়েছিল তোমার? ভয় নেই প্রিয়তমা আমি জানি আমার প্রতি তোমার যে অনুভুতি গুলো আছে সেগুলো একদম সলিড। আরে এগুলো আমি নিজে অর্জন করেছি তোমার থেকে। এতে খাদ কি করে থাকবে বল?

একদিক থেকে ভালই করেছ ওই রাস্কেল টার কথা আমার সামনে না তুলে। ওর নাম শুনলে আমার রক্ত গরম হয়ে যায়। নিজেকে কন্ট্রোলে রাখা দুষ্কর হয়ে পরে।

কিন্তু একটা কথা । নিশ্চয়ই তোমার মনে একটা প্রশ্ন আসছে যে ওর এই অবস্থা কে করল? উউউউউ গেস করো। বুঝতে পারছ না। হাহা হা আরে অবভিয়াসলি আমি। ও তোমাকে নিরব যন্ত্রনা দিতে চেয়েছিল। ধুকে ধুকে মারতে চেয়েছিল। আমি শুধু চালটা উল্টে দিয়েছি। যার পরিণতি হবে কষ্টদায়ক মৃত্যু।

আই প্রমিস ইউ তোমার দিকে যে হাত বাড়াবে তাকে আমি ওই ভয়ঙ্কর ঠিকানার বাসিন্দা করে দেবো। যেখানে কেউ একবার আর ফেরত আসা যায়না। একেবারেই আসা যায় না। তারপর ঠোট জোড়া গোল করে শিস বাজাতে লাগলো আহনাফ। শুনতে এতটাই ভয়ানক লাগছে যে মুহূর্তেই স্নিগ্ধ পরিবেশটা ভয়ঙ্কর গুমোট আবহাওয়ায় পরিণত হল যেন। তার পরেও সে বাজিয়ে চলেছে। এটা যে তার শত্রুদের কাছে মৃত্যুর দামামা…………!

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে