ভালোবাসার অন্যরূপ পর্ব-০৯

0
1044

#ভালোবাসার_অন্যরূপ🍁

#লেখিকা:- Nishi Chowdhury

#নবম_খন্ড

পাঁচ বছর পর ♥️

এডিশনাল ডিস্ট্রিক জজ কোর্টের এজলাস রুমে বিচারপতির আসনে বসে আছে মিসেস আরিশা আহমদ চৌধুরী। আর সামনের উইটনেস বক্সে দাঁড়িয়ে আছে পরকীয়ায় আসক্ত অল্প বয়সী এক নারী। দু হাত জোর করে কান্নায় ভেঙে পড়েছে সে। তার এক মাস বয়সের দুধের শিশুটি তার স্বামীর কোলে আছে। তার মা কাঁদছে বলে। সে ও হয়তো বাবার কোলে ছটফট করছে।

আরিশা মেয়েটির মধ্যে নিজের পাঁচ বছর আগের সেই হতে যাওয়া ভুলটার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে। শুধু একটাই পার্থক্য মেয়েটির একটি এক মাস বয়সী বাচ্চা আছে আর আরিশার তা ছিল না। কিন্তু আরিসা ও ভালবেসে ঠকে ছিল এই মেয়েটার মত।

আরিশা চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলের উপর রেখে। মেয়েটির উদ্দেশ্য বলল,

— কান্না বন্ধ করুন। কাঁদলেই সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে না। আপনার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদালতে পেশ করুন।

মেয়েটি কান্না থামিয়ে ওড়না দিয়ে চোখ মুছে বলল,

— ম্যাডাম আমার পড়াশোনা করে ডাক্তার হওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমার বাপের সেই সামর্থ্য ছিল না। তাই কোনরকমে কষ্ট করে এসএসসি পাস করতেই আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় সোহানের সাথে।

সোহান বিএ পাস। বিদেশে একটা ফুড ফ্যাক্টরি তে কাজ করতো ‌। আমার ছবি দেখে তার পরিবার কোন দাবীদাওয়া ছাড়াই আমাকে তাদের বাড়ির বউ করতে চেয়ে ছিলেন। আর এই প্রস্তাবে আমার বাবা এক পায়ে খাড়া হয়ে আমাকে বিয়ে দেয় এ সোহান এর সাথে। আব্বা একবার আমাকে জিজ্ঞেস করিনি যে আমি কাউকে পছন্দ করে কিনা।

হ্যাঁ আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করতাম। আমার খুব ভালো লাগতো তাকে। সেও পড়াশোনা করতো পাশাপাশি একটা হোটেলের হোম ডেলিভারির কাজ করতো। সাইকেল নিয়ে যাওয়ার পথে স্কুলের সামনে তার সাথে আমার দেখা হতো। আমি আব্বাকে বলেছিলাম তার কথা। আব্বা তেড়ে এসেছিলেন আমাকে মারতে। আর আমার ছোট বাটন ফোনটা এক আছাড় মেরে দু’টুকরো করে ফেলেছিলেন। সপ্তাহের শেষে জোর করে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন।

বিয়ের পরে প্রথম এক মাস সবুজের কথা খুব মনে পড়লে ও আস্তে আস্তে আমার স্বামীর সোহানের ব্যবহার আচরণে মুগ্ধ হয়ে আমি তার দিকে ঝুঁকে পড়ে ছিলাম। প্রায় ভুলতে বসেছিলাম সবুজকে। কিন্তু চার মাস পরে সোহান আবার বিদেশে পাড়ি জমায় নিজের কর্মস্থলে। এখানে আমি একা হয়ে যাই। প্রায় শুয়ে-বসে আমার দিন কাটতো। আমি একদিন বলেছিলাম আমার স্বামীকে আমি আবার পড়াশোনা করতে চাই।

সে বলেছিল :- এটা তো খুব ভালো কথা তুমি আবার পড়াশোনা করতে চাও। তো কোথায় ভর্তি হতে চাও আমাকে বল কত টাকা পয়সা লাগে আমি এখান থেকে পাঠিয়ে দেবো। আমি তাকে জানিয়েছিলাম আমার ডাক্তার হওয়ার খুব ইচ্ছা। তাই সে বলেছিল বাড়ির পাশে যে কলেজটা আছে সেখানে তুমি আবার সাইন্স নিয়ে ভর্তি হও।

তার কথামত আমি সেই কলেজে ভর্তি হলাম। ভালই যাচ্ছিল দিনকাল আমার। প্রতিদিন কলেজ যেতাম। বাড়িতে ফিরে এসে টুকটাক কাজকর্ম আর পড়াশোনা। আমি যখন ইন্টার পরীক্ষার্থী তখন সোহান দেশে এসেছিল তাদের ফ্যাক্টরিতে নাকি কি সমস্যা হয়েছে। সমস্যা কেটে গেলে সে আবার ফেরত যাবে।

সেই কলেজে আনা-নেওয়া করতো আমাকে। এভাবেই চলছিল আমার জীবন । ধীরে ধীরে আমার এইচএসসি পরীক্ষা এগিয়ে আসতে থাকে প্রস্তুতি খুব ভাল ছিল। পরীক্ষা দিলাম। পুরোটা সময় সোহান আমার পাশে ছিল। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি।

বাড়িতে আনন্দের আমেজ বয়ে গেল। কিন্তু আমার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে আমার স্বামী বলেছিলেন তুমি মেডিকেলে এডমিশন টেস্ট দাও। আমি তোমার এডমিশন কোচিং এর সব ব্যবস্থা করে দেবো। কি জানো আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এই টানাপোড়নের সংসারে আমার ইচ্ছে টাকে কবর দিতে হয়েছিল। তাই কোনোরকমে বিএ পাস করে। বিদেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

তাই তুমি আমার বউ হয়ে যদি ডাক্তারি পড়ো আমি খুব খুশি হব। আমি সব রকম ভাবে সাহায্য করবো তোমাকে। তুমি শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করো। সেদিন সত্যি ও তার কথাগুলো আমার খুব ভাল লেগেছিল।

হঠাৎ একদিন বিদেশ থেকে খবর আসে কোম্পানিটা আবার পুনরায় চালু হয়েছে। শোহানের আমাকে রেখে যাওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না। তার পরেও মাঝপথে এভাবে না বলে কয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে সে আবার বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বলে যায় যে বাবু হওয়ার আগে ওখানকার সব কাজ মিটিয়ে সে দেশে পার্মানেন্টলি চলে আসবে। তারপর চলে গেল সে। এরপর স্বাভাবিক নিয়মের সবকিছু চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে আমার আবার সবুজের সাথে দেখা হয়।

আরিসা এবার মেয়েটির কথা শোনায় আরো বেশি মনোযোগী হলো।

মেয়েটি হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,

— এখান থেকেই শুরু হয় আমার অবনতি। বিশ্বাস করুন ম্যাডাম প্রথমে আমি ওর সাথে কথা বলতে চাইনি। আমি চলে আসছিলাম। কিন্তু বারবার আমার পথ অবরোধ করে বলছিল আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে। প্লিজ আমার সাথে এরপরে দেখা করো নয়তো তোমার ফোন নাম্বারটা দাও আমি সবকিছু তোমাকে খুলে বলব।

আরিসা জমে গেল। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো বারবার তাকে সিগন্যাল দিচ্ছে ঘটনাগুলো আগেও ঘটেছে স্বয়ং তার নিজের সাথে। আনিসা শুকনো ঢোক গিলে শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে মেয়েটার উদ্দেশ্যে বলল,

— তারপর

ম্যাডাম আমি তাকে বলেছিলাম আমি মা হতে চলেছি। তারপরে সে বারবার জোর করছিল ওর সাথে কথা বলবে বলে। ওখান থেকে আসতে দিতে চাইছিল না নাম্বার না দেওয়া পর্যন্ত আমি তাকে আমার নাম্বার দে ই। আমি প্রথম কয়েক দিন ফোন রিসিভ করিনি তার। তারপরে একদিন বাধ্য হয়েই ওর কল রিসিভ করি।

সে আমাকে নানা রকম কথা বলে। সে নাকি একটা বিশ্ববিদ্যালয় ভালো একটা সাবজেক্ট এ পড়াশোনা করছে তার পাশাপাশি একটা ব্যবসা করছে সে আমাকে নিয়ে তার নানারকম স্বপ্নের কথা বলতো। তার কাছে চলে যেতে বলতো। আমাকে বোঝায় যে আমার স্বামীর সামান্য বিএ পাস করেছে আর আমি যদি ডাক্তার হয় তাহলে আমি সমাজে কি পরিচয় দেবো তার।

প্রথম প্রথম তার কথাগুলো আমি অতটাও গুরুত্ব না দিলে পরে তার কথাগুলো শুনতে থাকি সত্যিই তো সমাজে আমি কি পরিচয় দেবো আমি যখন ডাক্তার হব একসময় আমি সবুজের কথার জালে এতটাই ফেসে যাই যে নিজের পেটের সন্তানের ক্ষতিও করতে গিয়েছি তার কথা শুনে।

‌কিন্তু নিজের সন্তান তো হাজার চেষ্টা করেও তার কোন ক্ষতি করতে পারিনি।তারপর আমি যখন তাকে বললাম এ বাচ্চা আমি নষ্ট করতে পারবো না। তখন সে আমাকে বলেছিল সে আমাকে বাচ্চা সহ মেনে নেবে। শুধু আমি জানো তার কাছে চলে আসি। এদিকে সোহানের সাথে আমার যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। সে ফোন করলেও আমি রিসিভ করতাম না।

তারপর একদিন সিদ্ধান্ত নেই আমি সবুজের সাথে পালিয়ে যাব। তাই করেছিলাম। সে আমাকে নিয়ে তার খালার বাসায় রেখেছিল। সেদিন সন্ধায় আমি জানতে পারি

আসলে সবুজ ড্রাগস ও নারী পাচার কর্মীদের সাথে যুক্ত। আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে পাচার করার জন্য তার আগে আমার বাচ্চা তোকে মেরে ফেলবে সে। একটা মেয়ে পাচার করতে পারলে না তা থেকে অনেক প্রফিট পাওয়া যায়।

সেখান থেকে অনেক কষ্টে রাত দুটোর সময় আমি খালি পায়ে পালিয়ে আসি। কিন্তু এদিকে যা সর্বনাশ হওয়ার তা ঘটে গেছে।

সবাই জেনে গেছিলো যে আমি একটা ছেলের সাথে পালিয়েছে এবং এই ঘটনা শোনার পরে আমার শাশুড়ি আর আমাকে শ্বশুরবাড়ি উঠতে দেয়নি। তারপর আমার স্বামী সবকিছু জেনেশুনে আমার সাথে পুরো যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বাচ্চা হওয়ার আগে পার্মানেন্ট বিদেশ থেকে চলে আসে সে ।

আমার যেদিন বাচ্চা হয়। সেদিন হাসপাতাল থেকে সোহান আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে নিয়ে চলে আসেন। আমি অনেক কেঁদেছিলাম। তার পা ও জড়িয়ে ধরে নিজের সব ভুল স্বীকার করেছিলাম কিন্তু তার মনে একটুও দয়া সৃষ্টি করতে পারিনি।

আমার দুধের বাচ্চাটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল। আর বলে গিয়েছিল আজ থেকে তুমি মুক্ত। তোমার যা ইচ্ছা হয় তাই করো। আমি বা আমার ছেলে তোমার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াব না।

কথাগুলো শেষ নামে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটি। কান্না জড়িত কন্ঠে আবার বলতে লাগলো,

— আমি জানি আমি অনেক বড় অন্যায় করেছি অনেক বড় পাপ করেছি আমি। সেই পাপের শাস্তি আজ এই কয় মাস ধরে আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমার দুধের বাচ্চা টাকে আমি কোলে নেওয়ার একটা সুযোগ পাইনি। ওদের বাড়ির গেটের সামনে বসে থেকে এক নজর দেখতে পাইনি আমার বাচ্চাটাকে। অনেক শাস্তি পেয়েছি আমি। আর সহ্য করতে পারছি না এবারের মতো আমাকে মাফ করে দাও। এমন ভুল আমিও কোনদিনও করব না।

আমি জানি আমার বাচ্চাটা মায়ের বুকের একফোটা দুধের জন্য পাগলের মত কাঁদে। আর সেই কান্না আমাকে গেটের কাছে বসে বসে হজম করতে হয়। অনেকক শাস্তি পেয়েছি এবারের মতো আমাকে মাফ করে দাও। আমার বাচ্চাটাকে আমার কাছে দাও।

————–&—————-

আরিশা সব শুনল। একবার আড় চোখে মেয়েটার স্বামীর দিকে তাকালো। তার চোখেও পানি ছল ছল করছে। বাচ্চাটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছে। কেসটা খুব সেনসিটিভ। স্বামী ওই স্ত্রী দুজনে দুজনকে ডিভোর্স দিতে জোরপূর্বক রাজি হলেও বাচ্চা কেউ কাউকে দিতে চাচ্ছেন না।

যেহেতু দুধের বাচ্চা। কাস্টডি মা ই পাবেন। কিন্তু দুজনের ডিভোর্স হয়ে গেলে বাচ্চার ভবিষ্যৎ টা অনিশ্চিত হয়ে যাবে তাই কিছুক্ষণ ভাবার জন্য আরিশা এক ঘন্টার জন্য কেসটা মুলতবি করল।

এজলাসকক্ষের পাশে নিজের খাসকামরায় ইজি চেয়ারে বসে ভাবতে থাকলো কি করা যায় কেসটা নিয়ে। প্রথমে দুই পক্ষের উকিল কে নিজের রুমে ডাকলো আরিশা । দুইজন ই তাদের মক্কেলকে নিয়ে নানা সাফাই গাইতে শুরু করল। কিন্তু একবারও কেউ বাচ্চাটার কথা ভাবল না। দুজন উকিলের কারোর কথাই মন মত হল না আরিশার। দুজন দুজনকে চলে যেতে বলল।

হঠাৎ কিছু একটা ভেবে আরিশা বেল বাজালো। আরিশার বেঞ্চ সহকারী অনুমতি নিয়ে কামরায় প্রবেশ করলো।

আরিশা কার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

— পেশকার সাহেব। মিস্টার রহমানকে বাচ্চাসহ আমার কেবিনে আসতে বলুন। আর আমি যখন আপনার ফোনে একটা মিসকল দিব তখন মিসেস রহমানকে আমার কেবিনে পাঠাবেন। বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলেছি।

— জী ম্যাডাম।

পেশকার সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে মিস্টার সোহান রহমান বাচ্চাসহ কেবিনে প্রবেশ করলেন। আরিশা বাচ্চাটির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,

— এখানে বসুন। আমার আপনার সাথে একান্ত কিছু কথা আছে। বাচ্চাটা কার কাছে রাখা যায় বলুন তো।

তখনই খাস কামরা দরজা ঠেলে মিসেস শাহানা রহমান রুমে প্রবেশ করলেন। সোহান আড়চোখে তাকিয়ে আবার সামনে মনোনিবেশ করল। আরিশা এবার কৌশলে সোহানকে বলল,

— এক কাজ করুন। বাচ্চাটা তার মায়ের কোলে দিন। তাহলে সেই শান্ত থাকবে। আর আমরা শান্তি মত কথা বলতে পারব।

বিচারকের কথা অমান্য করা অসম্ভব। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও সোহান শাহানার কোলে তার ছেলেকে তুলে দিল। শাহানা যেন আকাশের চাঁদ খুঁজে পেল। পাগলের মত হামলে বাচ্চা টাকে নিজের কাছে নিয়ে নিল। নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রইল কিছুক্ষন।তারপর আরিশার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ম্যাডাম ওর মনে হয় খুব খিদে লেগেছে। আমি ওকে একটু আমার বুকের দুধ খাওয়াতে চাই। কোথায় বসবো যদি একটু বলতেন।

আরিশা চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল কাচের দরজার ওইপাশে আমার বিশ্রামের ঘর। ওখানে বসেই তুমি তোমার বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারো। কথা শেষ হতে দেরি মেয়েটার দৌড় লাগাতে দেরি নেই। দৌড়ে গিয়ে ওই রুমের সোফায় বসে বাচ্চাটিকে খাওয়াতে শুরু করলো মেয়েটি। বাচ্চাটার কান্না ও ধীরে ধীরে কমে আসলো। যা আরিশা ও সোহান কাঁচের এপাশের রুমে বসে স্পষ্ট দেখতে পেল। সোহানকে একনজরে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরিশা তার উদ্দেশ্য বলে উঠলো,

—- কি মিস্টার সোহান অবাক হচ্ছেন? যে বাচ্চাটিকে সকাল থেকেই কান্না থামাতে পারছিলেন না। মুহূর্তেই মায়ের সংস্পর্শে গিয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি এজলাস রুমে দেখেছি আপনি অনেক পদ্ধতিতে বাচ্চাটিকে চুপ করানোর চেষ্টা করছিলেন কিন্তু পারছিলেন না।

আসলে কি জানেন একটি সন্তানের কাছে মা-বাবা একে অপরের পরিপূরক, বিকল্প নয়। আপনি বাবা হয়ে যেমন মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তেমনি মিসেস শাহানাও মা হয়ে আপনার অভাবটা পূরণ করতে পারবে না।

একটা কথা কি জানেন এই যে আপনাদের দুজনের মান-অভিমান রেষারেষি ডিভোর্স নিয়ে এত দৌড়াদৌড়ি এত কিছুর মধ্যে সবথেকে বেশি কষ্টকে পাচ্ছে বলুন তো? আপনাদের ওই ছোট্ট বাচ্চাটা।

একটা জিনিস ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। আজ আমি আপনাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করলাম। কাস্টাডি হিসাবে বাচ্চাটাও আমি আপনাকে দিয়ে দিলাম। তারপর তারপর কি করবেন?

আপনিতো পেশায় একজন ব্যবসায়ী। বিদেশ থেকে এসে ছোটখাটো একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন। অবশ্যই তার পেছনে আপনাকে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতে হচ্ছ। তাহলে আপনি বাচ্চাটাকে মানুষ করবেন কিভাবে? তখন আপনার কাছে একটা পথ খোলা থাকবে । সেটা হল দ্বিতীয় বিয়ে করা।

আরিশার কথায় সোহান চমকে তার দিকে তাকালো। আরিশা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল,

—- এতটাও চমকাবেন না মিস্টার সোহান। এটাই রিয়েলিটি। বিয়েটা আপনি করলেন কার জন্য? আপনার বাচ্চার জন্য। কি জন্য? যাতে মায়ের মতো টেক কেয়ার পায় আপনার বাচ্চাটা। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব? এক গাছের ছাল কি অন্য গাছে লাগে। আমি বলছি না সবাই একি রকম। কিন্তু 90 পার্সেন্ট মেয়ে ই অন্যের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা হিসাবে মেনে নেয়না।

তখন কে কষ্ট পাবে মিস্টার সোহান?আপনি তো আপনার প্রয়োজন মেটানোর জন্য একটা বউ পেয়ে গেলেন কিন্তু আপনার বাচ্চার প্রয়োজন কী তাতে মিটবে? মিটবে না। বরং তার কষ্ট দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

সৎ মায়ের মায়ের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার সহ্য করে তাকে বড় হতে হবে। না খেয়ে অথবা আধপেটা খেয়ে বাঁচতে হবে ওকে। তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা তো বাদই দিলাম। তখন যদি বেচারা এসব সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নে…

—- চুপ করুন ম্যাডাম আমি আর সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ চুপ করুন।

—- মিস্টার সোহান আপনি শুধু কানে শুনে সহ্য করতে পারছেন না। আর আপনার বাচ্চাকে এগুলো শারীরিক ও মানসিকভাবে সহ্য করতে হবে।

আরিশার কথাগুলো শুনে সোহান কাঁদছে। আরিশা তাকে কিছুক্ষণ সুযোগ দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,

—- একটা কথা ভেবে বলুন তো মিস্টার সোহান। আপনার স্ত্রী শাহানাকে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেওয়া হয়ে যাবে না। যেখানে অনেক কঠিন থেকে কঠিন পাপ করে চোখের পানি ছেড়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে মাফ চাইলে আল্লাহ মাফ করে দেন। সেখানে আমরা মানুষ হয়ে মেয়েটার ভুলের জন্য সবকিছু কেড়ে নিতে হবে তার কাছ থেকে। মেয়েটারও তো বয়স কম।

একবার দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখুন তো। দেখুন আপনার বাচ্চাটা কত নিশ্চিন্তে তার বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে। আপনার ওয়াইফ স্ত্রী হিসেবে হয়তো খারাপ হতে পারে কিন্তু মা হিসেবে মোটেও নয়। একবার তার চেহারাটা ভালো করে দেখেছেন।তার চোখমুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এই এক মাসে একদিন ও তার চোখের পাতা এক করতে পারিনি। দেখুন কেমন চোখ বুজে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করছে।

আপনারা পুরুষরা হয়তো বুঝবেন না। একজন মা যখন নয় মাস তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে প্রতিটা দিন তার কেমন কাটে সেটা একজন মাই ভালো বলতে পারবে। তারপর বাচ্চা পৃথিবীতে আসার পূর্ব মুহুর্তে একজন মায়ের প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তা আপনাদের কল্পনার অতীত। আর সেই মায়ের এই যন্ত্রনা লাঘব হয় কিভাবে জানেন, যখন সে তার নাড়ি ছেড়া রত্নটাকে নিজের বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে।

কিন্তু আপনি তো তার তার ব্যথা লাঘব হওয়ার কোনো সুযোগই দেননি। সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাটিকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে দেওয়া সেই মায়ের জন্য কত বড় শাস্তি তা তো আপনার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন তাই না। এই একমাস বাচ্চা ছাড়া কম কষ্ট পাইনি এরপর আপনি আর কি শাস্তি দিতে চান ওকে?

—- আমিও তো ওকে ভালোবেসি। ওর কষ্ট আমার সহ্য হয় না।কিন্তু কি করবো বলুন তো ওকে দেখলে ওর সব কর্মকাণ্ড আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ও এমনটা কীভাবে করতে পারল আমার সাথে?আর এরপরে যে ও আর এমন কর্মকান্ড করবে না তার গ্যারান্টি কি?

— মানুষ মাত্রই ভুল হয় মিস্টার সোহান। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনে এগিয়ে যেতে হয়। এতকিছুর পরেও যদি মিসেস সাহানা আবারও একই ভুল করেন? তার জন্য তো দেশে আইন আদালত আছে। তখন এই কারণটার উপর ভিত্তি করে বাচ্চার কাস্টডি আপনি নিজে পাবেন সম্পূর্ণ ভাবে। এবং শাহানাকে আপনি চরম শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু মনের মধ্যে একটা কাল্পনিক ভবিষ্যৎ কল্পনা করে বর্তমানের এই তিনটা জীবন নষ্ট করে দেওয়া যায় না। তাই না। বরং এখন যদি আমি আপনাদের আলাদা করে দেই

ভবিষ্যতে কিন্তু ওই বাচ্চাটির প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে? তখন ওকে কি জবাব দেবেন সেটা ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। এই সামান্য ভুলের জন্য তিনটা জীবন নষ্ট করবেন না। বাচ্চাটার কথা ভাবুন এবং নিজেদের মধ্যে সবকিছু ঠিক করে নিন। দেখবেন ভবিষ্যৎ টা কত সুন্দর হয় আপনাদের।

🌺🌼🌺

অবশেষে আরিশার বক্তব্যে সোহান এর শাহানার প্রতি মন নরম হলো। শাহানা ও স্বামীর পা জড়িয়ে ধরে মাফ চাইল এবং সবার সামনে প্রতিজ্ঞা করলো এরকম ভুল তারা দ্বিতীয় বার হবে না। বাচ্চাটার জন্য সোহান শাহানাকে মেনে নিলেও আরিশার দৃঢ়বিশ্বাস পরবর্তীতে তাদের সম্পর্কটা পূর্বের ন্যায় ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ আগে মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা শেষ করে এজলাস থেকে নেমে নিজের কক্ষে চলে আসলো আরিশা। কিছুক্ষণ পর তার মুহুরী এসে বলল ,

— তারা আপনার সাথে দেখা করতে চায় ম্যাডাম।

—-ঠিক আছে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।

আরিশা তৈরি হচ্ছিল বাড়িতে যাওয়ার জন্য। এমন সময় শাহানা এসে আরিশার পা জড়িয়ে ধরে বলল,

—+ ম্যাডাম আজ আপনি আমার জন্য যা করলেন। আমি সত্যি খুব ঋণী হয়ে গেলাম আপনার কাছে। কি করে ঋণ শোধ করবো আমি?

— এই কি করছো তুমি এগুলো? আমার পা ছাড়। সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছা। আমি শুধু তোমাকে একটু সাহায্য করেছি মাত্র।

শুধু একটা জিনিস মনে রেখো খুব কম মানুষ জীবন এরকম সুযোগ পায়। যা তুমি পেয়েছো। তোমার স্বামীর মত মানুষ হয় না। তোমাকে দেওয়া আল্লাহ সব থেকে বড় নেয়ামত হচ্ছে তোমার এই স্বামী। তার প্রতি তুমি যে অন্যায় করেছো এবং বিশ্বাসটা তুমি ভেঙ্গেছো? তার জন্য তোমার কঠোর শাস্তি প্রাপ্য ছিল।

কিন্তু তোমার বাচ্চাটার জন্য তুমি বেঁচে যাচ্ছ। তাই সে বিশ্বাসটা জোড়া লাগানোর দায়িত্ব কিন্তু তোমার। আর এই পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কোন ব্যাপার নেই। সবকিছুই সম্ভব। তাই তোমার সর্বস্ব দিয়ে আবার নিজের জায়গা ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করো।

আর তোমাদের ছেলেটাকে উচ্চশিক্ষিত করবে । আর এরপরে যদি আল্লাহ তোমাকে মেয়ে সন্তান দান করে। তাহলে তাকে উচ্চশিক্ষিত করবে তুমি। যেন সে তার জীবনে কোন ভুল পদক্ষেপ না নিতে পারে। কেমন। যাও সুখে শান্তিতে স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘর-সংসার করো।

আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ম্যাডাম সবকিছু আগের মত যেন হয়ে যায়। আল্লাহ যেহেতু আমাকে এতটা সাহায্য করেছেন। ইনশাল্লাহ তার সহায়তায় বাকিটুকু আমি অর্জন করতে পারব। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করব আমার মত ভুল যেন আর কোন মেয়ে না করে। কথাগুলো বলে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলো শাহানা।

আরিশা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন তার দিকে। তারপর নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।

— ম্যাডাম আপনার কয় ছেলে মেয়ে?

—- আমার একটা ছেলে। নাম আরশিয়ান আহমেদ আরাফ।

— আল্লাহ যেন আপনার ছেলেকে অনেক বড় করে।

— উহু। আল্লাহর কাছে দোয়া করো আমার ছেলে যেন মানুষের মতো মানুষ হয়।

শাহানা সাথে কথা শেষ করে আরিশা নিজের পক্ষ থেকে বেরিয়ে আসলো। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে ভাবতে লাগলো।

আমার জীবনের সমীকরণটা হয়তো এমন ভয়ানক হতো যদি না আমার মা ঐদিন অমন সিদ্ধান্ত না নিত।সত্যি বলতে সেদিনন মায়ের উপর খুব অভিমান হয়েছিল আমার । কিন্তু আজ বুঝতে পারছে মায়ের প্রত্যেকটা কথা ঠিক ছিল। মন খুলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করল। তাকে এমন একজন মা দেওয়ার জন্য। এখনো মনে আছে তার আম্মু বলেছিল?

👉আজ হয়তো তোর মনের ভিতরে ঘুরতে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবি না। কিন্তু একদিন এমন সময় আসবে ঠিকই তো সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।

সত্যিই আজ আরিশা বুঝতে পেরেছে। এ পৃথিবী একটা গোলকধাঁধার মতো। এখানের সবকিছুই মরীচিকার মধ্যে আবদ্ধমান।

আর ভালোবাসাটা আরো বেশি মরীচিকাময়। ফেসবুকে স্ক্রল করতে গিয়ে কাপল ফোটোগ্রাফি গিয়ে মনের ভেতরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

ইস….!কী কিউট কাপল! কিন্তু তাদের সম্পর্কে গভীরভাবে খোঁজ নিলে জানা যাবে সেই দু’জন কাপলদের এর মধ্যে যোজন-যোজন দূরত্ব। শুধু ক্যামেরার কারসাজি ছাড়া আর কিছুই না। হাহ্ পৃথিবীটা পুরো কৃত্রিমতায় ছেয়ে গেছে।

নিজের গাড়িতে এসে বসলো আরিশা।হঠাৎ কিছু মনে পড়াতে ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে শপিংমলের দিকে যেতে বলল। আবারও চিন্তার ডুব দিল আরিশা। মনে মনে ভাবতে লাগল

স্বামী হিসেবে আহনাফকে পেয়ে সত্যিই আরিশা ভাগ্যবতী। অত কিছু শোনার পরও আহনাফ তার এমন বিপদের সময় হাত ছেড়ে দেয়নি। বরং মেন্টাল সাপোর্ট দিয়ে আরিশাকে ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল আহনাফ। তারপর আহনাফের উৎসাহে আরিশা আবার পড়াশোনা শুরু করে মাস্টার্স কমপ্লিট করে বিজেএস পরীক্ষা দেয় সে। পুরোটা সময় আহনাফের পূর্ণ সাপোর্ট পেয়েছে সে। তাইতো আজ বিচারপতির মত এমন একটি সম্মানীয় পদে অবস্থান করছে সে।

কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর সে আজও পাইনি।সেদিন কেন অভি তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল? অভির কী সবুজের মত এমন কোন খারাপ ইন্টেনশন ছিল। হয়তো ছিল। কিন্তু তারপরে সে আর কখনো যোগাযোগ করেনি। এতই যদি জরুরি কোনো দরকার থাকত তাহলে তো অবশ্যই অভি পাঁচ বছরে আরিশার সাথে যোগাযোগ করত। কিন্তু না সে তো করিনি। তাহলে কি চেয়েছিল অভি?

এসব আকাশকুসুম চিন্তা ভাবনা করতে করতে গাড়ি এসে পৌছালো শপিং মলের সামনে। ড্রাইভার এর কথায় আরিশার ধ্যান ভাঙলো। গাড়ি থেকে নেমে তাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে সে ঢুকে পড়ল শপিংমলে। আজ তার জীবনে একটা বিশেষ দিন।

সকলের জন্য শপিং কমপ্লিট করে নিচে নামার জন্য চলন্ত সিঁড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে কেউ তার নাম ধরে ডেকে উঠল। প্রথমে শুনতে না পেলেও দ্বিতীয়বার তার ডাক স্পষ্ট শুনতে পেল আরিশা। থমকে গেল তার পা জোড়া। ডাক টা তার খুব পরিচিত। পাঁচ বছরে একটুও পরিবর্তন হয়নি সেই ডাক টা…..!

চলবে………🖤

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে