শোভা পর্ব-০৩

0
578

#শোভা
#পর্ব_৩

জহিরের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার বয়স দুই মাস পূর্ণ হলো আজ। দিনগুলি অনেক কষ্ট করে সৎ মায়ের সংসারে অভাব-অনটনের মাঝে বাবার বাড়িতে পার করছে শোভা। মাঝে মাঝে চাচাতো ভাই বোনেরা যাদের অবস্থা একটু ভালো তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো টুকটাক বাজার সদাই করে দিয়ে যায়।

– শোভা, আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই!

– জি, ছোট মা! বলেন, আমি শুনছি।

– তোমার বাবার কি আছে কি নাই সেটা তো তুমি আমার থেকে ভালই জানো। মাস গেলে কয়টা টাকা বেতন আসে। তাই দিয়ে সংসার টা চলে, তোমার বাবার ওষুধ পত্রের খরচ চলে। ভাগ্যিস তোমার বাবার কিছু জমিজমা ছিল নইলে কি অবস্থা হতো আল্লাহ পাকই জানেন! জমিতে কিছু ফসল ফলে দেখে মনে করো বছরটা টেনেটুনে কোনরকম করে চলে যায়। তার উপর আমার দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ তো আছেই। সারাবছর কিভাবে চলে সে আমি জানি। তুমিই হয়তো সেটা বোঝ।

– হ্যাঁ আমি জানি। কিন্তু এসব কথা আপনি কেন এখন আমাকে বলছেন?

– এই তিন মাস ধরে তুমি আমার কাছে থাকছো। তোমার ছোট ছোট দুইটা মেয়ে আছে। সংসারে খাবারের মুখ বেড়েছে তো খরচের পরিমাণ যে বেড়েছে সেটা নিশ্চয়ই তুমি বোঝো। আমি বলতে চাইনি। ভেবেছিলাম তুমি নিজে থেকেই বুঝবে। গরীবের সংসারে আমার জন্ম হয়েছে। আমার বাবা ছিলেন না। মার একার পক্ষে যৌতুকের টাকা গোছানোর সামর্থ্য ছিল না । তাই ভালো কোনো ঘরে বিয়ে ও আমার হয়নি। বিয়ে হয়েছিল এসএসসি পাশ করার পরে তোমার বাবার সাথে। তোমার বাবা সরকারি চাকরি করে, জমি-জমা আছে, বাড়িতে পাকা ঘর আছে এটা দেখেই আমার মা,আমার চাচারা খুশিতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। তার উপর যৌতুকের কোন ঝামেলাও নেই। তার বয়স যে আমার ডবল, বড় বড় দুইটা মেয়ে আছে তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। দিয়ে দিলো এইখানে বিয়ে। তোমার আর আমার বয়সের পার্থক্য ও কিন্তু খুব বেশি না। আমার যখন বিয়ে হয় তখন তুমি ক্লাস সেভেনে পড়ো আর আভা সম্ভবত টু বা থ্রি তে।
তাই আমি মনে করি যে আমার সমস্যাটা তুমি ঠিকই বুঝতে পারছ। এত মানুষের খরচ চালানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

– আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি কোথায় যাব বলেন? আমার তো এই বাবার বাড়ি ছাড়া এই পৃথিবীতে যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। আর এমন কোন শিক্ষিত ও আমি না যে আমি কোন চাকরি বাকরি করে আমার বাচ্চাদের নিয়ে আমি চলবো। এইচএসসি পাস করার সাথে সাথেই তো আপনারা আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কথা ছিল শশুর বাড়ি যাওয়ার পরে আবার লেখাপড়া শুরু করবো কিন্তু আমার ভাগ্যে তো আর তা হলো না। আর কোথায় যাবো বলেন? কোথায় যেয়ে আমি ছোট ছোট বাচ্চা দুটি নিয়ে আশ্রয় নিব।

– সেটা তো আমি বলতে পারব না। কিন্তু আমার তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এইমাস শেষ হলে আমি তোমাকে আর রাখতে পারব না, বাপু। তোমাদেরকে রাখতে গেলে আমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছেনা আমার পক্ষে। বর্তমান যে যুগ আমি তো আর ওদের অশিক্ষিত রাখতে পারি না। তুমি এতদিন ঢাকায় থেকেছো। দেখো কোনো না কোনো উপায় করতে পারবা। ঢাকায় তো অল্পশিক্ষিতদের জন্যও কতো ধরনের চাকরি আছে।

– ছোটমা, ঢাকায় ছিলাম ঠিক আছে কিন্তু, আমি তো বন্দি কারাগারে ছিলাম। আমি ঢাকার ভিতরে কোনো কিছুই ঠিকমতো চিনিনা বা কাউকেই
চিনিনা যে কারো কাছে যেয়ে আমি আজকে একটা চাকরি চাইবো। তাছাড়া ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে দুটো কার কাছে রেখে আমি কোথায় যাবো, বলেন?
আর চাকরি তো চাইলেই পাওয়া যায়না?

– সেটা আমি জানি না, বাবা। আমি আর পারছিনা। তোমার বাবা সুস্থ থাকলে তবু একটা কথা ছিল।

– ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি বলে শোভা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আমি দেখি আভার সাথে একটু কথা বলি। তারপর আপনাকে জানাচ্ছি।

বিকেলবেলা শোভা হাঁটতে হাঁটতে তার চাচাতো ভাই আতিকদের বাড়িতে গেল। উনি বাড়িতেই ছিলেন।

– কি ব্যাপার শোভা! হঠাৎ করে তুই কোথা থেকে এলি?

– এইতো দাদা বাড়ি থেকেই এসেছি। কেমন আছো তোমরা সবাই?

– ভালো। তোর খবর বল। বাচ্চারা ঠিক আছে তো!

– হ্যাঁ, দাদা! সবাই ভালো আছি! এসেছিলাম তোমার সাথে একটু কথা বলতে! তোমার সময় হবে?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ! সময় হবেনা কেন! তুই কথা বলবি আর আমার সময় হবে না! এটা কেমন কথা! বল কি বলবি।

– দাদা, আমাকে একটা কাজ ঠিক করে দাওনা। কিছু তো একটা করতে হবে। এভাবে বসে বসে আর কতদিন খাবো। তাছাড়া বাচ্চা দুটো বড় হচ্ছে। ওদেরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে।
নিজের অসহায়ত্ব কার কাছে বলব কিছু বুঝতে পারছিনা।

– এটা কেন বলছিস? তুই অসহায় কেন হবি? আমরা আছি না!

– অসহায় কথাটা সুখী কিংবা দুঃখী যেকোনো মানুষের জন্য খুবই কাছের একটা বাংলা শব্দ I মানুষ হাজারো সুখে থেকেও অসহায়ত্বকে বাধা দিয়ে রাখতে পারেনা I অসহায় কথাটির সত্যিকার অর্থে রূপ,লাবন্য,আকৃতি বা রং বুঝা না গেলেও ওই পিরিয়ড টা যখন মানুষের জীবনে হানা দেয় মানুষ তখন ঠিকই বুঝতে পারে যে,অসহায়ত্ব তাকে ঘায়েল করেছে, অসহায়ত্ব মানেই হলো নিজেকে একা একা ভাবা, জীবন থেকে যা হারিয়ে ফেলেছি,বা অতীতের কোনো স্মৃতিকে মনে মনে ভেবে কষ্ট পাওয়ার নাম , এমন সময় খুব বেশি একা একা থাকতে মন চায়,নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়ালে রাখতে মন চায়, আমি ও তার ব্যতিক্রম নই ,দাদা।

– এভাবে কেন বলছিস, শোভা! আমি বুঝি তোর সমস্যাগুলো ! কিন্তু দেখ কি করবো আমি? কোন পথ তো দেখছি না। তাছাড়া আমাদের গ্রাম বা আমাদের মফস্বল এলাকায় তেমন কোন ভাল কাজ বাজ নেই যে আমি তোর জন্য সাজেস্ট করতে পারি। আমি তো তোর সমস্যার কোনো সমাধানই খুজে পাচ্ছিনা। অথবা হয়তো সমাধান আছে কিন্তু পথটা আমরা দেখছিনা।

– যে কোন সমস্যারই সমাধান আছে, দাদা! আমি হয়তো খুঁজে পাচ্ছি না কারণ আমি এনাফ ট্রাই করছি না কিংবা সমাধান করার ইচ্ছাটা প্রবল ছিলো না। দাদা, মানুষের সামর্থ্যর বাহিরে কোন কিছুই না। আমি জীবন যুদ্ধে হেরে যেতে চাইনা। আমি সারাজীবন হারতে হারতে ক্লান্ত হয়ে পরেছি। আর হারতে পারবোনা। এবার আমার অস্তিত্বের প্রশ্ন। এবার যদি আমি হেরে যাই তবে আমার অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে, আমার আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। আমি মরার মত আর বাচঁতে চাইনা। আমাকে আমার বাচ্চাদের জন্য বাচঁতে হবে। আমি চাইনা ওরাও আমার মতো এভাবে ধুকে ধুকে বাচুক। ওদের জন্য আমাকে দাড়াতেই হবে। হয়তো আজ আমি ব্যর্থ কিন্তু কাল সফল হবোই। ব্যর্থতা আমাকে অনেক কাঁদিয়েছে, তবুও বলবো আমি সফল কেননা ব্যর্থতা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। জীবনের মানে উপলব্ধি করতে বুঝিয়েছে। আমার চলার পথে যতই বাধা আসুক আমি সামনে যাবোই। দোয়া করো তোমরা।

– তুই ঠিকই বলেছিস শোভা! এবার তোকে উঠতেই হবে! দেখি তোর জন্য কি করা যায়।

– ঠিক আছে দাদা উঠি তাহলে।

পরের দিন সকালবেলা শোভা তার ছোটবোন আভাকে ফোন দিল।

– হ্যালো! আভা, কেমন আছিস ? নিহাল কেমন আছে?

– ভালো আপা, তুই কেমন আছিস? আমার পরী দুইটা কেমন আছে?

– সবাই ভালো। তোকে বিরক্ত করলাম না তো। তুই ফ্রি আছিস?

– কি যে বলিস! তুই আমাকে বিরক্ত করবি কেন? এই পৃথিবীতে একমাত্র তোর সাথে কথা বলার সময় আমি যতটা কম্ফোর্ট ফিল করি আর কারো সাথেই করি না! এমনকি নিহালের সাথে ও না। তুই হচ্ছিস আমার পৃথিবীর অর্ধেক। আর বাকি অর্ধেক জুড়ে আমার বাকি সব সম্পর্ক!

– হুম! বুঝতে পেরেছি! এবার বল তোর শরীরের কি অবস্থা? এখনতো শেষ মাস চলছে। এখন কিন্তু অনেক সাবধানে থাকতে হবে। কোনো ধরনের কোনো ভুল-ত্রুটি যেন না হয়। আর এ মাসে ডাক্তারের কাছে চেকআপের জন্য গিয়েছিলি?

– আপা, সব করেছি। তুই শুধু শুধু চিন্তা করিস না। ও হ্যা, এমাসে যে টাকাটা পাঠিয়েছিলাম বাবুদের দুধ আর কিছু খাবার দাবার কেনার জন্য, টাকা টা তুলেছিস? ওদের জন্য কিছু কিনেছিস?

শোভা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো তখনই তুলেছি। ওদের জন্য খাবার-দাবার কিনে ফেলেছি। ওরা অনেক খুশি হয়েছে।

– আপা, তুই তো বুঝিস ই আমি কোন চাকরি-বাকরি করিনা। নিহাল যেটা দেয় ওইটাই। ওই সামান্য কিছু টাকা আমি পাঠাই শুধুমাত্র আমার মা দুটির জন্য।

– ওটাকে তুই সামান্য বলছিস কেন? তোর ওই টাকাটা আমার কাছে এক পাহাড় সমান। আর তুই আমার জন্য এটুকুই যে করছিস এটাই তো অনেক। এই যুগে কে কার জন্য কি করে বল! তাছাড়া নিহালের আয় রোজগার ও তো খুব বেশি না আমি তো সবই জানি! সবেমাত্র একটা কলেজে ঢুকেছে তার উপর অত বড় সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করে। সেখান থেকে যে ও আমাকে এত টুকু দিয়ে হলেও মনে করে এটাই অনেক। এজন্য আমি সারা জীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।

– আপা, এভাবে বলিস না আমি লজ্জা পাই! ওইযে সামান্য কটা টাকা দেই ওটা তো দুলাভাই ওদের একজনের জন্য শুধু দুধ কেনার জন্যই মাসে খরচ করে ফেলত।

– সেই পিছনের কথা চিন্তা করলে তো হবে না, আভা! এখন কি আর সেই দিনের কথা ভাবলে হবে!

শোভা আভার সাথে কথা বলছে কিন্তু চোখ পানিতে ছল ছল করছে। আভা প্রতিমাসে তাকে দুই হাজার করে টাকা দেয় শুধুমাত্র বাচ্চাদের জন্য টুকটাক খাবার দাবার কেনার জন্য। কিন্তু শোভার পক্ষে কোনদিন সেই টাকা দিয়ে তার বাচ্চাদের জন্য কোন খাবার কিনে বা দুধ কিনে মুখে দেওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। হয়নি কারণ প্রতি মাসে যে টাকাটা আভা পাঠায় ওটা পাওয়ার সাথে সাথে তার মায়ের হাতে তুলে দিতে হয় সংসার খরচ চালানোর জন্য এমনকি বাচ্চা দুটি অসুস্থ হলেও তাদের চিকিৎসা করার জন্য কোন খরচের টাকা ও তার মা তার হাতে দেয় না। কোনোরকম ধুঁকে ধুঁকে চলছে তাদের তিনজনের জীবন।

– কিরে আপা তুই চুপ হয়ে গেলি যে! কিছু বলছিস না কেনো? তুই কি কাঁদছিস?

– নারে বোকা! কাঁদবো কেন তোর সাথে কথা বলছি সেখানে কাঁদার কি আছে বল?

– সত্যি করে বলতো, আপা তুই কেমন আছিস? ছোটোমা কি তোকে অনেক বেশি বলে?

– কি বলছিস! বেশি বলবে কেন? উনি আর উনার ছেলে মেয়েরা কোন সময় আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। ওরা সবাই আমাকে ভালবাসে।

– আপা, এই পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যারা বুকে হাজার কষ্ট চেপে রেখে ঠোঁটে হাসি ধরে রাখতে পারে। ওরা সত্যিই অসাধারণ মানুষ। আর তুই তাদের মধ্যে একজন।

– আভা, আমি হাসতে ভালোবাসি কারণ হাসিটাই তো একমাত্র দুঃখ লুকানোর অস্ত্র! যখন কেউ আমাকে প্রশ্ন করে, কেমন আছো! আমি দুই মিনিট ভেবে বলি, ভালোই আছি! কারন, চিন্তা করে দেখি যদি বলি, ভালো নেই বা মন খারাপ তাহলে হয়তো তারা আবার আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করবে কেন ভালো নেই। তখন ঐ কেনর উত্তর টা কেমনে দিব, কি দিব!
সত্যিই কি আমার কাছে কোন উত্তর আছে? আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে কোন জবাব পাই না! তাকে কি উত্তর দিব বল?

– একটা বিধ্বস্ত মনের সুন্দরভাবে জবাব দেয়ার জন্য একটা সুন্দর সময়ের প্রয়োজন। যেটা তোর কাছে এখন নেই।

– সেই সময়টা বেশ কঠিন যখন চোখের পানি ফেলতে হয় আর ওই সময়টা তার চেয়েও আরো বেশি কঠিন যখন চোখের পানি লুকিয়ে হাসতে হয়।

– তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস, আপা! তোর বিপদের সময় তোর জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি বা করতে পারছিনা!

– দূর বোকা! তুই ক্ষমা চাচ্ছিস কেন? তুই আমার জন্য কি আর করবি? যতটুকু করছিস বা করেছিস এটাই তো অনেক! আমার সাথে যা হয়েছে সবই আমার কপাল আমার দুর্ভাগ্য!

– আপা, তুই হচ্ছিস আমার মা। সেই পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারানোর পর থেকে তুই আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিস। তোর শত কষ্ট হলেও আমার উপরে কোন আচ লাগতে দিস নি। জান্নাত, জিনাতের আগে আমিই তোর প্রথম সন্তান কিন্তু সেই হিসেবে আমি তো তোর জন্য কিছুই করতে পারছি না।

– আরে পাগলি, এসব কথা চিন্তা করা বাদ দিয়ে নিজের জন্য চিন্তা কর। তুই অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার সোনা পাখিটা ও কষ্ট পাবে।

– সোনা পাখি টার জন্য অনেক চিন্তা না? আর আমি যে কষ্ট পাচ্ছি আমার মায়ের মত আপার জন্য সে জন্য তোর কোন চিন্তা হয় না! না?

– উহু! তোর জন্য আমি কেন চিন্তা করবো? তোর জন্য চিন্তা করার জন্য নিহাল আছে না! আমি তো আমার সোনা পাখি টার জন্যই চিন্তা করব।
আচ্ছা শোন যে জন্য ফোন দিয়েছি!

– হ্যাঁ বল!

– এখানে দুই তিন মাস কাটিয়ে দিলাম এভাবে বসে বসে আর কতদিন বল। জান্নাত আর জিনাত বড় হচ্ছে। খরচের পরিমাণ বাড়ছে আমাকে তো কিছু একটা করা দরকার! তুই না বলেছিলি তোর কোন এক বন্ধুর মা আছে উনি অসহায় মহিলাদের নিয়ে কি একটা নারী কল্যাণ সমিতি নাকি চালায়। আমার জন্য তোর বন্ধুর সাথে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করে দে না বোন, প্লিজ। ছোটখাটো যেকোনো ধরনের কাজ হলেই চলবে। কোনরকম ওদেরকে নিয়ে কোথাও মাথা গুজতে পারলেই আমার হবে।

– এভাবে বলছিস কেন? আর তুই বাড়ি ছাড়ার চাচ্ছিস কেন? ওরা কি তোকে কিছু বলেছে?

– আবার একই কথা। ওরা আমাকে কি বলবে, বল! আমি নিজে থেকেই চাচ্ছি আমি কিছু একটা করি।

– আপা, তুই না বললেও আমি বুঝি! আমি বুঝি দেখে ও বাড়িতে আমার যেতে ইচ্ছে করে না। ওরা যদি তোর সাথে বেশি কাহিনী করে ওদেরকে বুঝিয়ে দিবি যে ও বাড়িতে তুই ভেসে আসিস নি। ও বাড়ি আমাদের বাবার বাড়ি। ও বাড়িতে আমার আর তোর একটা ভাগ আছে।

– এসব কথা কেন বলছিস? ভাগাভাগির প্রশ্ন কেন আসছে। তুই তো বুঝিস বাবার পেনশনের ওই কয়টা টাকায় তো সংসারটা চলে। তার উপর ওদের দুই ভাই বোনের পড়াশোনার খরচ বাবার চিকিৎসার খরচ। খরচের তো অভাব নেই। আমি ওদের উপর কতদিন এভাবে বোঝা হয়ে থাকবো। তাছাড়া ওরা বড় হলে ওদের স্কুলে ভর্তি করতে হবে, তখন তো খরচ আরো বাড়বে। তো আমি যদি এখন থেকে কোন কিছু চেষ্টা না করি তাহলে ভবিষ্যতে আমি কিভাবে ওদেরকে নিয়ে বেঁচে থাকব।

– আপা, তুই অনেক আলাভোলা। এজন্য সবাই তোকে পেয়ে বসে। এজন্যই আজকে তোর জীবনের এই দুর্দশা। ভবিষ্যতের চিন্তা দেখা যাবে। আর আমিতো বসে নেই। আমি চাকরির জন্য চেষ্টা করছি। নিহাল যে কলেজে আছে আমি ও সেই কলেজে ঢোকার চেষ্টা করছি। আমার চাকরিটা হয়ে গেলে ওদেরকে নিয়ে তোর কোনো চিন্তা করতে হবে না। আমি নিহালের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে রেখেছি। যে আমি যদি কোনদিন ইনকাম করতে পারি অবশ্যই আমি তোদেরকে দেখবো। সে টাকা দিয়ে কখনোই আমি আমার সংসার চালাবো না। এটুকু বিশ্বাস আমার উপর করতে পারিস! আমি তোকে আর কোনো কষ্ট দিতে চাইনা। আমি চাইনা তুই কোন কষ্ট করিস। জীবনে অনেক কষ্ট করেছিস, আর কত! আমি যৌথ পরিবারে থাকি। যদি তা না হত তাহলে এতদিন তোকে ওই বাড়িতে থাকতে হতো না। তোকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসতাম। কিন্তু সেটাতো করার উপায় নেই কারণ আমার শশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর সবাই আমার সাথে থাকে। তবে আমার চাকরিটা হয়তো হয়ে যাবে। চাকরিটা হয়ে গেলে তোকে আমি এখানে নিয়ে আসব। এখানে বাসা ভাড়া করে আমার পাশেই তোকে রাখবো। আমার জান্নাত, জিনাত আমার চোখের সামনেই থাকবে। চোখের সামনেই বড় হবে। ওদেরকে নিয়ে তুই কোনো চিন্তা করিস না।

– এই জন্যই তোকে আমি পাগলি বলি। তুই ভাবলি কি করে যে তুই ডাকলেই আমি তোর কাছে যাব! এটা কোথায় শুনেছিস, যে ছোট বোনের সংসারে যেয়ে বড় বোন থাকে তার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। এটা কোথাকার নিয়ম। আমি তোর থেকে লেখাপড়া কম জানলেও তোর থেকে বড়! দুনিয়াটা তোর থেকে বেশিই দেখেছি। তাই আমি বুঝি আমার জন্য কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। তোকে আমি যেটা বলছি সেটা কর। তোর বন্ধু বা বন্ধুর মায়ের সাথে একটু কথা বল আমার জন্য ছোট হোক, যে কোনো কাজ হোক একটু ব্যবস্থা কর। আমি কিছু করতে চাই। তুমি জান্নাত জিনাতকে দেখবি, ঠিক আছে এটা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই, দেখিস। কিন্তু এজন্য আমি তো বসে থাকতে পারিনা। তুই কষ্ট করবি আর আমি বসে বসে শুধু তোর টাকা খরচ করবো। তুই ভাবলি কি করে? তোকে যা বলছি তুই তাই কর, প্লিজ! আমাকে নিয়ে চিন্তা করে করে তুই তোর প্রেশারটা হাই করিস না। এটা তোর জন্য খুবই ক্ষতিকর। এখন তোকে শান্ত থাকতে হবে ।

– ঠিক আছে, আপা। তোকে আমি আর কিছু বলবো না। তুই যেটা ভালো বুঝিস সেটাই কর। আমি ওদের সাথে কথা বলবো।

– এইতো বুঝেছিস, লক্ষ্মী বোন আমার! ভালো থাকিস! নিজের দিকে খেয়াল রাখিস আর নিহালের দিকেও খেয়াল রাখিস!

চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে