শোভা পর্ব-০২

0
550

#শোভা
#পর্ব_২

পরের দিন আসরের নামাজের পরে আত্মীয়-স্বজনরা সবাই বসে জহির কে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্মৃতিচারণ করছে। জহিরের জন্য কেউ তসবিহ পাঠ করছে আবার কেউ দোয়া কালিমা পড়ছে । দরজা খোলাই ছিল। হঠাৎ করে চিৎকার চেঁচামেচি আর কান্নার আওয়াজ শুনে সবাই বসার রুমে আসলো।

– আরে, এ তো জহির ভাইয়ের বউ শোভা ভাবি ! ইনি কখন এলো?

– কি জানি! মাত্রই তো কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে আমিও তোমার মত এলাম। এসে দেখি চিৎকার করে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না কাটি করছে।

– আহারে বেচারী! সেই আশা আসলি। কিন্তু, সময় মত আসতে পারলি না। এই আসাটা যদি কালকে আসতি তাহলে জহিরকে শেষবারের মতো হলেও একবার দেখতে পারতি।

– শোভা ভাবি কি একা আসছে নাকি সাথে আর কেউ আছে? বাচ্চা দুটোকে একটু কাছে নেন পরিচিত কেউ? বাচ্চা দুটো মায়ের কান্না দেখে চিৎকার করছে। তাছাড়া ওর মায়ের কাছে এত ভিড় আর মানুষ জন দেখে ওরা ঘাবড়ে গেছে হয়তো!

– আহারে! কেউ একটু পানি আনেন না। বেচারি মনে হয় বেহুশ হয়ে পড়ছে? এমনিতে সারাদিন এত জার্নি করে এসেছে তার উপরে এই খবর?
আচ্ছা ও কি একাই এসেছে, নাকি ওর সাথে কেউ এসেছে একটু খুঁজে দেখতো!

– হ্যাঁ, হ্যাঁ, একজন এসেছে তো দেখলাম উনার সাথে। ওনার চাচাতো ভাই না খালাতো ভাই কি যেন বললো। ওই তো উনি দেখি ওনার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করি ওরা খবর জানলো কোথা থেকে?

– ভাই, আপনি শোভার কি হন?

– শোভা আমার ছোট চাচার মেয়ে। চাচা তো অসুস্থ আপনারা জানেন। আর ওর কোনো ভাইও নাই। তাই আমি নিয়ে আসলাম।

– আপনারা খবর পেলেন কি করে?

– গতকাল বিকেলের দিকে ফেইসবুকে শোভার যে মামা ইতালি থাকে সে জহিরের মৃত্যু সংবাদ দেখতে পেয়ে শোভার ছোট বোন আভার কাছে খবর জানায়। আভা থাকে সেই রংপুর, ওর শশুরবাড়ি। আভা আমাকে তখনই ফোনে জানায়। আর আমিও বাড়িতে ছিলাম না। একটা কাজে পাবনা সদরে গেছিলাম। আমি আর কাউরে কোনো ফোন না দিয়ে সরাসরি রাতে বাড়ি ফিরে ছোট কাকি মানে শোভার ছোট মায়ের কাছে জানাই। উনি বললেন যে, এখন তো রওয়ানা হয়ে লাভ নেই কাল সকালে যেও। আর শোভাকে কিছুই জানালাম না। সকালে ওকে বললাম, জহির খুব অসুস্থ হয়ে পরছে। ঢাকা থেকে ফোন আসছিল। চল ঢাকায় যেতে হবে। কিন্তু ও সাথে সাথে মনে হয় কিছু একটা বুঝে ফেলল। ও বললো, দাদা! জান্নাতের বাবা কি বেচে নাই? প্রতিদিন নফল নামাজ পড়ে তার সুস্থতার জন্য আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করি। আল্লাহ কি আমার ডাক শুনলোনা। বলেই শোভা চিৎকার দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো।

আমি বললাম, আরে নাহ! এরকম কিছু হয়নাই। তুই যা ভাবছিস তেমন কিছুই না। জহির আগের থেকে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যে কারণে ঢাকা থেকে ফোন এসেছে তোকে নিয়ে যেতে ওর সাথে দেখা করার জন্য। জহির বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে চায়। তুই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। বাচ্চাদের রেডি কর একটু পরেই আমরা বের হব। শুধু শুধু কান্নাকাটি করে নিজেও অসুস্থ হয়ে পরিস না অনেক দূরের জার্নি।

শোভা বলল, নারে, দাদা তুমি আর যাই বল আমার সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। উনি আর বেঁচে নাই ।গতকাল থেকে এমনিতেই আমার কেমন যেন লাগছে। কোন কিছুই ভালো লাগছে না। আমি এই দুদিন থেকেই বুঝতে পেরেছি কোন কিছু ঘটবে আমার সাথে। তুমি কি মনে করেছো আমি কিছুই বুঝি না! আই সি ইউ তে থাকা রোগী আর কি অসুস্থ হবে দাদা? এর থেকে আর কি খারাপ অবস্থা হবে? আমার জান্নাতের বাবা নেই দাদা, জান্নাতের বাবা নেই! ওরা কি খবর দেয়ার মানুষ! আমাকে বিনে দোষে বাসা থেকে বের করে দিল! আমি তার পরেও দুই তিনবার এতদূর থেকে জান্নাত এর বাবাকে একটু দেখার আশায় হসপিটাল এ যেয়ে যেয়ে ওদের হাত পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছি। কিন্তু আমাকে ওরা সেই সুযোগটুকুও দেয় নাই। ওদের কি মানুষ মনে করেছো? ওরা ফোন করে ওর অসুস্থতার খবর জানিয়েছে এইটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো, দাদা? দাদা, কে কি বলেছে আমি জানি না ! কিন্তু জান্নাতের বাবা নেই রে দাদা! তুমি তাড়াতাড়ি চলো। আমি জান্নাতের বাবাকে শেষবারের মতো একবার দেখব! কতদিন মানুষ টাকে দেখি না, দাদা! কত কথা তার সাথে আমার বাকি রয়ে গেছে। সব কথা না শুনে সে চলে গেল এভাবে। আমি কি অন্যায় করেছিলাম আল্লাহ কেন আমাকে এভাবে শাস্তি দিলো।

শোভার চিৎকার-চেঁচামেচিতে পুরো বাড়ির মানুষ এক জায়গা হলো। সবাই মিলে ওকে মিথ্যা স্বান্তনা দিতে শুরু করলাম। শোভার কান্না দেখে আমি নিজেও নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। আমি কি বলে সান্তনা দিব ভেবে পেলাম না। কিভাবে বলব, যে তুই যেটা ভেবেছিস সেটাই সত্যি! তোর জহির বেঁচে নাই! তুই ওকে শেষ দেখাও দেখতে পারবি না। ওকে কবর টা পর্যন্ত দেওয়া হয়ে গেছে। ওরা তোকে সেই সুযোগ টুকুও দেয়নি।

আমি নিজেকে সামলে ওকে বললাম, দুর বোকা! পাগলামি করিস না। জহির ভালো আছে। চল, তুই তাড়াতাড়ি চল।
সারাটা পথ কান্না করেছে। আমি ওকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এ পর্যন্ত নিয়ে এলাম।

কিন্তু আপনারা এটা কি করেছেন? বলেন তো! আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে। এখানে তো কারো কিছু করার নেই। কিন্তু,আপনারা কি কালকে পারলেন না একটু আমাদেরকে খবর দিতে! ওরা একটু ওর বাবাকে শেষ দেখা দেখত! আপনারা কি করেছেন, এটা কোন ধরনের মানুষের কাজ করেছেন? যদি শোভার মামা খবরটা না পেত বা না দিত তাহলে তো আমরা আজও জানতে পারতাম না যে জহির আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এটা কি কোন মানুষের কাজ? একজন স্ত্রীকে তার স্বামীর শেষ দর্শন আপনারা দেখতে দেননি! দুইটা মেয়েকে তার বাবার মুখখানা শেষ দেখাটা পর্যন্ত দেখতে দেননি, এটা কোন ধরনের মানবতা? এটা কোন ধরনের বিচার?এটা কেমন সমাজ? কেমন সংসার ?

– আমরা মানুষ না অমানুষ, তার পরিচয় তোমার কাছে আমরা দিতে চাই না। তুমি তোমার বোনরে নিয়া আসছো। বোনরে নিয়া এখনই এই বাড়ি থাইকা বাইর হইয়া যাও। তোমার বোনের কারনে আজ আমার জহির মারা গেছে। আমি আমার পোলা হারাইছি। তোমার বোনের নাকি কান্না আর চিৎকার-চেঁচামেচিতে তো আমি আমার পোলারে ফেরত পাব না।

– মাওই মা, আপনার সাথে আমার খুব বেশি পরিচয় নাই। সেই বিয়ের দিন দেখছিলাম। আমার নাম আতিক। আমি শোভার চাচাত ভাই।

যাইহোক এখন যেটা বলার জন্য আমি আসলে আসছি। জানিনা কোন দোষে আপনারা শোভার সাথে এরকম ব্যবহার করছেন! কিন্তু ওর যদি কোন অন্যায় হয়ে থাকে আমি ওর বড় ভাই হিসেবে আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এটা আপনাদের একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাদের পরিবার বিষয়ক সমস্যা। তারপরও আমি শোভার বড় ভাই হিসেবে কিছু কথা বলতে চাই আপনাদের সাথে। । জহিরের সাথে আমার খুব বেশি আলাপচারিতা না হলেও দুই একবার যা দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে তাতে বোঝা যায় যে জহির নিতান্তই একজন ভালো মানুষ ছিল।আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন। জহির অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলো মাসখানেক আগে। পর পর দুইবার ব্রেন স্ট্রোক করছে । তাকে হসপিটালে ভর্তি করলেন আপনারা ।
হসপিটালে ভর্তি করার পরে স্বাভাবিকভাবে আমরা যেটা বুঝি যে একজন স্ত্রী সবসময় তার স্বামীর পাশে সেবা-যত্ন করার জন্য থাকে কিন্তু আপনারা কি করছেন শোভা কে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। আমি কি জানতে পারি এর কারণটা কি? ওকে বাসা দিয়ে বের করে দেওয়ার পরেও কয়েকবার ওর বাচ্চাদের সহ জহিরকে এক নজর দেখার জন্য হসপিটালে অত দূর থেকে ছুটে আসছে। আপনারা ওকে সেখানে ও ঢুকতে দেন নাই। ও প্রায় প্রতিদিনই আপনাদের কারো না কারো ফোনে ফোন করেছে। কিন্তু আপনারা ওর নাম্বারটা ব্লক করে রাখছেন ও কারো সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারে নাই। জানতে পারেনি যে জহির এর কি অবস্থা! বাড়িতে বসে সারাক্ষণ ছটফট ছটফট করেছে আর কান্নাকাটি করেছে।

শোভার ভাই আতিকের কথা শেষ না হওয়ার আগেই জহির এর বোন রিনা চিৎকার করে উঠলো।

– আপনি প্রথমেই বলেছেন, এইটা আমাদের পারিবারিক সমস্যা। তাই আমি মনে করি এইখানে আপনি নাক না গলালেই আমরা খুশি হবো।

– এটা যেহেতু আমার বোনের সমস্যা। তাই আমাকে কথা বলতেই হবে। তাতে আপনারা যে যা খুশি মনে করতে পারেন! আসলে আমারই ভুল। প্রথমেই যদি একটু সচেতন হতাম তাহলে হয়তো এতদূর পরিস্থিতি গড়াতো না। আমরা আসলে সবাই নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে আপনজনের খোঁজখবর নেওয়ার সময় পাইনা।

– ওরে বাবা! আপনি খোঁজখবর নিলে বুঝি আমরা ভয় পেয়ে যেতাম?

– ভয় পেতে তো আমি বলছিনা। এটা কেমন কথা যে স্বামীর অসুস্থতার সময় স্ত্রী সন্তান পাশে থাকতে পারলোনা। এমনকি তার মৃত্যু সংবাদটা পর্যন্ত তাদের পাঠান নি। শোভার সাথে তো তার তালাক হয়নি। আর শোভার কথা বাদই দিলাম। মেয়ে দুইটার কথা ও ভাবলেন না। ওরা একসাথে এতগুলি বছর পাশাপাশি থেকেছে, কত মায়া আর টান একে অন্যের প্রতি। আপনারা তো শুধু আমার বোনের সাথেই নয় জহিরের সাথেও অন্যায় করেছেন। এই অন্যায়ের মাফ কোনোদিনই পাবেন না।

– আপনার বোনের কারণে আজ আমারা আমাদের ভাই হারাইছি। আমাদের ন্যায় আর অন্যায় শেখানো শেষ হইলে এখনি ওকে নিয়ে বের হন। ওর চেহারা দেখলে আমাদের মাথা ঠিক থাকেনা। উলটা পালটা অঘটন কিছু হয়ে যাবে পরে আবার আসবেন ন্যায় অন্যায় শেখাতে। আর কোনোদিন ও ওর এই চেহারা নিয়ে এই বাসার ত্রিসীমানায় আসতে নিষেধ করবেন। ওর আর ওর সন্তানদের জন্যই আমরা তিন বোন ভাই হারা হয়েছি। আর এখন আসছে ঢং দেখাতে। বেহুঁশ হওয়ার নাটক শুরু করছে।

– কি এমন অন্যায় করেছে, শোভা? কি করেছে যে কারণে সে আপনাদের কাছে এত বড় অপরাধী?

– সেটা আপনার বোনের কাছেই শুনে নিবেন । তবে সেইটা আপনাদের বাড়িতে যেয়ে। এখানে না।

– এসব কী বলছেন? শোভাকে কেনো নিয়ে যাবো?
এটা ওর স্বামীর বাড়ি। ওর স্বামী বেঁচে নাই এজন্য কি ওর এই বাড়িতে কোন অধিকার নেই। ওর দুটি সন্তান আছে। ও সন্তানদের জন্য এটা তাদের বাবার বাড়ি। আপনারা যে ওকে বারবার বলছেন এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে, ও কেন বের হয়ে যাবে? ওরা এ বাড়িতেই থাকবে।

– অধিকার কিসের অধিকার এই ফ্ল্যাট আমার মায়ের নামে। এখানে তো আপনার বোনের কোন অধিকার থাকার কথা না।

– শোনেন আপা, কালকে আপনার ভাই মারা গেছে। আপনাদের ভিতরে কি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তার মানে এই না যে আপনারা এভাবে আপনার ভাইয়ের স্ত্রী সন্তানদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন। এখন আমি মুখ খুলতে চাই নি কিন্তু পরিস্থিতি টা এমন ভাবে হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আমি এসব কথা না বলেই এখন পারছিনা । আমি তো যতদূর জানি এটা জহির এর কেনা ফ্ল্যাট। তাহলে জহিরের বৌ বাচ্চারা কেন এখানে থাকতে পারবেনা। তাছাড়া আপনাদের তো আরও একটা বাড়ির কাজ চলছে। তিন তলা পর্যন্ত আপনারা তুলে ফেলেছেন। সেখানেও তো জহির এর ভাগ রয়েছে। আর জহির এর ভাগ মানে সেখানে জহির এর বউ বাচ্চাদের ভাগ রয়েছে। স্বাভাবিক হিসাবে এটা বাংলাদেশের আইন আদালত বলেন বা যে কোন মানুষকে বলেন সবাই একই কথা বলবে। এটা শুধু আমার কথা না।

– আপনার কথা ঠিক আছে। আপনি যে আপনার বোনের অধিকার নেয়ার জন্য কোমরে গামছা বেঁধে এসেছেন সেটা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু, এই একটা মাস যে আমার ভাইকে আইসিইউতে রেখে আমরা চিকিৎসা করেছি কোনো দিন খোঁজ নিয়েছেন যে এর খরচ টা কোথা থেকে আসছে? কিভাবে দিচ্ছি?

– আপা,এ সব খবর আমরা রেখে কি করব? আমাদের কি কোন দিন সেই অবকাশ আপনারা দিয়েছেন? আমাদেরকে কেন! তার স্ত্রীকে পর্যন্ত দেন নি! আমরা তো দূরের কথা!

– আমরা কিন্তু কাঁচা খেলোয়ার না। এ ধরনের পরিস্থিতি হয়তো কোনদিন তৈরি হতে পেরে ভেবেই আমার ভাই সে কাঁচা কাজ টি করেনি। যে তিন তলা বাড়ির কথা বলেছেন এই তিন তলা বাড়িটার জমি ছিল মূলত আমার বাবার। আমার মাকে যাতে কেউ কোনদিন কোন ধরনের অবহেলা করতে না পারে; তাই আমরা চার ভাইবোন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি জমিটা আমার মায়ের নামে ট্রান্সফার করার। আমরা আমার মায়ের নামে ট্রান্সফার করে দিয়েছি। জমিটা এখন আমার মায়ের নামে। আর এই ফ্লাট টি জহির তার নিজের টাকায় কিনলে ও কিনেছে আমার মায়ের নামে। অতএব এখানে আমি মনে করি জহির এর বউয়ের আর বাচ্চাদের কোন অধিকার বা হক নেই। আপনার যদি বিশ্বাস না হয় বাড়ি এবং ফ্ল্যাট দুইটারই কাগজপত্র আমাদের কাছে আছে আপনি নিয়ে যাকে দেখানোর দেখান। আপনার সাথে আর আমাদের এই বিষয় নিয়ে কথা বলার কোন ইচ্ছা নাই। আপনার বোন বেহুশ হয়েছে নাকি ঢং ধরেছে ওটারে এখনি উঠান। উঠায় নিয়ে এখন এখান থেকে বিদায় হন।

– আপা, এসব কথা কেনো বলছেন? শোভা আপনাদের কেউ না হোক, বাচ্চা দুটো তো আপনাদেরই। ওদেরকে আপনি কোথায় তাড়িয়ে দিচ্ছেন? ওদের কি যাওয়ার মতো কোন জায়গা আছে? আমার চাচা কয় বছর ধরে প্যারালাইজড। তার উপর শোভার আপন মা বেচে নেই । সৎ মায়ের সংসার। ওখানে ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে পড়ে থাকা কতটা কষ্টের আপনি কি জানেন? আমি নিজের চোখে দেখি, আমি জানি। আর চাচার তেমন ইনকামও কিছু নেই যে তাই দিয়ে ওরা একটু ভালোভাবে চলবে। পেনশনের টাকায় কোন রকম করে দিন যায়। তার উপর শোভার কোন ভাই ও নেই। ওদেরকে বাড়ির কোণায় একটু জায়গা দিন। কোন রকম করে আপনার বাড়িতে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিবে। কমপক্ষে বাচ্চা দুটোর মাথার উপর একটা আশ্রয় তো থাকবে।

– দেখেন ভাই, এই সমস্ত কথাবার্তা আর ভালো লাগছে না। এখন রাত হয়ে গেছে। এখন আর কই যাবেন?আজকের রাতটা আপনারা চাইলে এখানে থাকতে পারেন। কিন্তু, কালকে সকালে কোনোভাবেই আমি আপনাদেরকে এখানে দেখতে চাই না। আপনারা সকালবেলায় এখান থেকে চলে যাবেন। কোথায় যাবেন, কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন এটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। আপনার বোন কি ভাবে থাকবে, তাদের টাকা পয়সা আছে কি না আছে ওটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। আপনাদের বোন, আপনাদের ভাগ্নি আপনাদের দেখার দায়িত্ব। আপনারা দেখেন। আমার ভাই ই বেচে নাই সেখানে ভাস্তি দিয়ে কি করবো?

– আপা, আমিও ছোটখাটো একটা চাকরি করি। আমাদের তো অঢেল নেই। অটল থাকলে অবশ্য আপনাদের এভাবে রিকোয়েস্ট করতাম না।
আপা, প্লিজ একটু চিন্তা করে দেখেন আপনি নিজেও একজন মেয়ে মানুষ। একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়ের কষ্ট আপনি কেন বুঝতে পারছেন না? ও স্বামী হারিয়েছে। তারপর ওর বাপের বাড়ি এমন কোন অবস্থা নয় যেখানে যেয়ে ও ওর বাচ্চাদের নিয়ে একটু ভালোভাবে থাকতে পারবে।

– এক কথা ভাই আপনি বারবার প্লিজ বলবেন না! আমরা কোনোভাবেই ওকে রাখবো না। আপনি যতই বলেন কোনো লাভ নাই।এত বড় পৃথিবী কোথাও না কোথাও ওর জায়গা ঠিকই হয়ে যাবে। আপনি ওকে নিয়ে এতো টেনশন করবেন না। ওকে আপনি যতটা আলাভোলা দেখেন ও ততটা আলাভোলা নয়। ও ওর অধিকার নিয়ে আজকাল খুব বেশি নাচানাচি করতো। এখন দ্যাখ, তোর অধিকার কোথায় আছে আর কোথায় নাই! বেয়াদব মহিলা।

জহিরদের আত্মীয় স্বজন যারা আছে তারা ওদের কে বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হলো না। ওরা শোভাকে বড়জোর আজকের রাতটা এখানে থাকতে দিবে কিন্তু কালকে সকাল থেকে এখানে কোন ভাবেই থাকার অধিকার নেই। যে সকল আত্মীয়-স্বজন শোভার পক্ষে সাপোর্ট দিয়েছিল তাদের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করল জহিরের বোনেরা।

– আপনাদের যদি কারো ভাইয়ার বউ আর বাচ্চার জন্য দরদ উথলে ওঠে তাহলে তাদের জন্য আমি বলব শোভা এবং তার বাচ্চাদের এই বাড়িতে কোন জায়গা নাই, আপনাদের যদি খুব বেশি ওর জন্য খারাপ লাগে আপনারা নিজ দায়িত্বে ওদেরকে নিয়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের বলার কিছু থাকবে না। তাই দয়া করে কেউ এসব কথা এখানে আর তুলবেন না। আপনারা মিলাদ শেষ হলে চলে যান। আমাদের পারিবারিক কোনো সমস্যা নিয়ে আপনারা নাক গলাবেন না ।

সারারাত ধরে শোভা কান্নাকাটি করলো। কিছুক্ষণ পরপরই বেহুশ হয়ে পড়ছিল। কিন্তু ভয়ে কেউই তার কাছে আসতে সাহস পাচ্ছিল না। শোভা বুঝতে পারলো যে এ বাড়িতে তার আর তার সন্তান দুটির কোনো দিনই ঠাঁই হবে না। শোভা তার রুমে যেতে চাইলো জহির এর আর তার কিছু স্মৃতি চিহ্ন স্বরূপ বিয়ের অ্যালবাম, ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার শাশুড়ি সেখানে বাধ সাধলো। তার রুমে তাকে এক মুহূর্তের জন্যও ঢুকতে দেওয়া হলো না। নেওয়া হলো না জহিরের কোন স্মৃতিচিহ্ন শোভার।

পরের দিন সকালে শোভা কাঁদতে কাঁদতে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় তার শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলল, আম্মা, আমি কোনো দামি বা মূল্যবান জিনিসপত্র আপনাদের বাসা থেকে নিয়ে যেতে চাইনি। আমি শুধু জান্নাতের বাবার ব্যবহার করা দু-একটা জিনিসপত্র নিতে চেয়েছিলাম। আপনারা আমাকে তার কোন স্মৃতি ও সাথে নিয়ে যেতে দিলেন না। কিন্তু, আপনারা জানেন না, আমি সবচাইতে মূল্যবান স্মৃতি আপনার ছেলের অংশ আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। তার আর কোন স্মৃতিচিহ্নর আমার আর প্রয়োজন নেই। দোয়া করবেন আপনার ছেলের আমানত যেন আমি রক্ষা করতে পারি। তার রেখে যাওয়া স্মৃতি তার মেয়ে দুটিকে আমি যেন মানুষের মতো মানুষ করতে পারি। আর আপনি জহির এর মা মানে আমারও মা। তার কাছে পৃথিবীতে সবচাইতে আপন মানুষ ছিলেন আপনি। সে বেঁচে থাকতে আপনাকে তার বেহেস্ত মনে করত। আপনার অবাধ্য হয়ে কোন কথা বলা জহির এর কাছে পৃথিবীর সবচাইতে ঘৃণ্য কাজ ছিল। আপনি যদি দিনকে রাত আর রাতকে দিন বলতেন জহির ও তাই বিশ্বাস করত। আপনার ছেলে বেঁচে নাই কিন্তু তার স্ত্রী হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব সারাজীবন পালন করব। আজ আমি ঘর ভরা মানুষের সামনে ওয়াদা করে গেলাম কোন এক সময় হয়তো আপনার আমার কাছে ফিরে আসতে হবে। আর যখন আসবেন, আপনি আমাকে আজ যেভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, আমি আপনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিব না কারন আপনি যে আমার জান্নাতের বাবার বেহেশত।

দাদা,আমার প্রহর গুলো সব আজ বেদনার স্রোতে ভেসে ভেসে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কি যে কষ্ট এই বুকটার ভিতর….! যদি কাউকে দেখাতে পারতাম!
আমার চোখ দুটিতে সুনামির বাঁধভাঙা ঢেউগুলি বারবার তীর ছাপিয়ে হৃদয়কে প্লাবিত করছে। কিন্তু আমার কষ্ট গুলো কে দেখার মত আজ আর কেউ এই পৃথিবীতে নেই! চলো ফিরে যাই। এখানে যতক্ষণ থাকবো কষ্ট বাড়া বৈকি কমবে না।

শুধু যাওয়ার আগে আমাকে একবার শুধু তার কবর টা দেখার সৌভাগ্য করে দিও। দূর থেকে তার কবরটা এক নজরে একটু দেখব। বলতে বলতে শোভা আবার কান্নায় ভেঙে পরলো।

হায়রে কষ্ট…..! আর কত! আর কত!

চলবে………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে