শোভা পর্ব-১৭

0
575

#শোভা
#পর্ব_১৭

সকাল থেকে শোভার খুব ব্যস্ততা। ‘আলোর বাহন’ থেকে তাকে এ বছরের শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সম্মাননা দেয়া হবে। নতুন বাসায় উঠেছে কয়েকদিন হলো। নতুন বললে ভুল হবে এটা তো তার চিরচেনা সেই আবাসস্থল! বাসার অন্যান্য ফ্লাটের পরিচিত জনেরা শোভাকে দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েছে। কত চেনা এ বাসার প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি কর্ণার! কত স্মৃতি, কত কথা, কত গাঁথা এ বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে। পারভিন আর জামিল ও অনেক সাহায্য করেছে বাসা গোছাতে। শোভা জহিরের সাথে যে রুম টাতে থাকতো সেই রুমেই তার খাট বিছিয়েছে! মেয়েদের নিয়ে ওই রুমেই থাকে। রুমের চারদিকে দেখে আর তার বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠে। রুমের যেদিকে তাকায় সেদিকেই শুধু জহিরের সাথে তার মধুর স্মৃতিগুলি চোখের সামেনে ভেসে উঠে। মনে হয় জহিরের ঘ্রাণ আজও সারা ঘরে বাতাসে মিশে আছে। রাতের আধারে মেয়েরা ঘুমিয়ে গেলে অশ্রুজলে স্মৃতি হাতরাতে হাতরাতে সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে প্রতিটি রাত।

শোভার বাসায় জিনিসপত্র খুব বেশি না। পুরো বাসা ফাকাই পড়ে আছে। মেয়েরা খুব খুশি। এতবড় বাসায় ইচ্ছেমত খেলছে, দৌড়াচ্ছে। মেয়েদেরকে ভালো স্কুলে ভর্তি করছে। শোভার বাসায় বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য তার ছোট বোন আভা তার শশুরবাড়ির পাশ থেকে একজন মুরুব্বি মহিলাকে পাঠিয়েছে। শোভা বাইরে গেলে উনিই বাচ্চাদের দেখাশুনা করেন। শোভার ব্যবসা বেশ ভালো চলছে। সে তার বাসার ফাকা রুমগুলিতে মেয়েদের দিয়ে বিভিন্ন ধরণের হাতের কাজ করায়। সে নিজেও জামিলের সাহায্যে একটা শোরুম দিয়েছে। নিজের শোরুম ছাড়াও বিভিন্ন শোরুমেও সে তার তৈরিকৃত পণ্য বিক্রি করে । ব্যাংকের ঋণও শোধ করে ফেলেছে। তার এই সাফল্যগাথা নিয়েই আজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন আলোর বাহনের চেয়্যারম্যান রুখসানা বেগম। যাতে তার দেখাদেখি অন্যরাও উৎসাহী হয়।
বিল্ডিং এর সবাই শোভাকে পেয়ে আর তার এই ঘুরে দাঁড়ানো দেখে খুবই খুশি।

এদিকে রিনা, কণা, বীনা সবাই তার মা যে ফ্লাটটি জামিলের নামে লিখে দিয়েছে এখন সবাই জানে। তার কারণেই আজ রিণার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।মুহিব তার বাবাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে। তার মা জামিলের এই ট্রাপে পা দেয়ার আগে কেন তাদের জানায় নি এজন্য সারাদিন ই মাকে গালমন্দ করতে থাকে। আর জহিরের মাও তার বোকামির জন্য আর মেয়েদের অবহেলা আর অবজ্ঞার জন্য মানসিক ভাবে দিনদিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তার বোকামির জন্য দিনরাত তারা মাকে কথা শোনায়। তার মাকে শুধু পারেনা হাতে মারতে, আর কোনো কিছুই করতে বাকি থাকেনা । ঘরে চব্বিশ ঘণ্টা ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগেই থাকে। যাদের জন্য এত্তসব করেছে সেই রিনা আর মুহিব ও তাকে সারাদিন হাজারটা কথা শোনায়।

এদিকে রিণার সাথে কণা আর বীনার সম্পর্কও খুব বেশি ভালো যাচ্ছেনা। তারা তার মাকে বারবার শোনাচ্ছে যে এ বাড়িতে রিনা কোনো ভাগ পাবেনা। রিনার ভাগের টা রিনাকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে যদি একান্ত কিছু পায়ও তবে সেটা হবে যথাসামান্য। এ নিয়ে রিনার সারাদিন ওদের সাথে ঝগড়া ফ্যাসাদ করতে থাকে। তার মায়ের সাথেও তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছেনা। তবে তারা আজও জানেনা যে তাদের ফ্লাট এখন শোভার নামে। তারা কষ্টে আর ওমুখো হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে তাদের বাসার পরিস্থিতি অনেক খারাপ। সেই আগের মতো সবার সাথে সবার মিল মহব্বত নেই।

কণার সাথে গভীর প্রেম তাদেরই বেতনভুক্ত ম্যানেজার হেলালের সাথে। হেলাল গ্রাম থেকে এসেছে। বয়স কণার থেকে কমপক্ষে নয় দশ বছর কম। তারা এক বিছানায় থাকে মাঝেমাঝে হেলালের বাসায়। হেলাল তাকে বিয়ে করবে সামনের বছরেই। কণার সাথে তার এই সম্পর্কের কথা গার্মেন্টেসের উপরের লেভেল থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মচারী পর্যন্ত জানে। কিন্তু কণার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়না।

হঠাৎ করে তাদের গার্মেন্টেস একটা বিশাল বড় অর্ডার পায়। বেশ কয়েক কোটি টাকার অর্ডার। এত বড় অর্ডার পাওয়া তাদের গার্মেন্টেসের জন্য স্বপ্নসমান। তারা কোনোদিনই এত বড় অর্ডার পাবে কল্পনাও করেনি। অর্ডারটা এনেছে ক্ণাই উত্তরা একটা বায়িং হাউজ থেকে । এক ইন্ডিয়ান কোম্পানির অর্ডার! ওই কোম্পানি অনেক বড় অর্ডার পেয়েছে ইউরোপ থেকে। সেখান থেকে বেশ বড় একটা অংশ কণাদের গার্মেন্টেসে কন্ট্রাক্ট দিয়েছে। শিপমেন্টের সময় খুবই কম। এই সময়ের মধ্যে কমপ্লিট করা তাদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। এজন্যই বাংলাদেশে তারা সাবকন্ট্রাক্টে দিয়েছে। এত বড় কাজ কমপ্লিট করতে কণাদের গার্মেন্টসের ও বেগ পেতে হবে। আর এত বড় কাজ করতে অনেক খরচের ও ব্যাপার। কিন্তু তারা কোনোভাবেই এই কাজ টা হাতছাড়া করতে চায়না। যে করেই হোক কাজটা শেষ করতে পারলে তারা একবছর বসে যে ইনকাম করে তা এই এক কন্ট্রাক্টেই করতে পারবে। তারা সব হিসেব নিকেশ করে দেখেছে যে কাজটা ভালোভাবে শেষ করতে পারলে তাদের প্রায় ফরটি পার্সেন্ট এর মত লাভ হবে। কিন্তু সমস্যা হলো এই অল্প সময়ের মধ্যে এটা করার জন্য তাদেরকে প্রত্যেকটি মেশিন কাজে লাগাতে হবে। তাতেও যে টাইমের মধ্যে শেষ করতে পারবে কিনা সন্দেহ। তাই তারা তাদের পাশে আরো দুইটা গার্মেন্টেসে কিছু কিছু কাজ সাব কন্ট্রাক্টে দিয়েছে। এত বড় শিপমেন্টের কাজ আগে কখনো না করায় তারা ভিতরে ভিতরে খুব নার্ভাস ছিল। ইন্ডিয়া থেকে তাদের কোম্পানির নামে একটা বিশাল এমাউন্টের এলসি এসেছে। কিন্তু এই বিগ এমাউন্টের এলসি পার্চেজ করার জন্য তাদের কে আবার ব্যাংকে কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। বেশ কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। আপাতত এত টাইম তাদের কাছে নেই। তাই তারা তাদের মার্কেটে যত টাকা ছিলো সব একত্র করে গুছিয়ে, যেখানে যা কিছু আছে হ্যান্ড ক্যাশ, ব্যাংক ব্যালান্স সব একত্র করে চায়না থেকে কাচাঁমালের অর্ডার করলো। তারা কাজ শুরু করে দিলো। লোকাল যত অর্ডার ছিলো সব কাজ তারা ছেড়ে দিলো। কারণ টাইমের মধ্যে কাজ শেষ করতে হলে তাদের কে অন্য কাজ করার টাইম হবেনা। দেশের বিভিন্ন পরিচিত বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে ধার করে আবার বাকীতে আনুষঙ্গিক সকল খরচের ব্যবস্থা করে ফেললো।

দুই মাসের মধ্যে তাদের শিপমেন্ট প্রায় রেডি। সবাই খুব খুশি। এই দুমাস দিন রাত চব্বিশঘণ্টা পরিশ্রম করেছে উপর মহল থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত সবাই। শিপমেন্ট প্রায় রেডি হওয়ায় সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলো।

এদিকে কণার দুলাভাই এলসি পার্চেজ এর জন্য ব্যাংকে জমা দিয়েছে। লোকাল পাওনাদার রা টাকার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। তাই তারা ব্যাংকে এলসি জমা দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকে এল সি জমা দেয়ার পরে তারা বিদেশি ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানায় যে তাদের ওখানে এরকম কোনো এলসিই ওপেন হয়নি। এটা সম্ভবত ফেক এলসি। এ কথা শোনার সাথে সাথে বীনার হাজবেন্ডের মাথা গরম হয়ে গেল।

– আরে আপনারা ভালো করে দেখুন! কি সব উল্টোপাল্টা কথা বলছেন? কয়েক কোটি টাকার ব্যাপার আমাদের শিপমেন্ট রেডি আর আপনি এখন বলছেন ভুয়া এলসি। এসব মজা করার মানে কি? আপনি ভালো করে খবর নেন!

– স্যার, খবর নেয়ায় কোনো ভুল হয়নি। যেটা বলেছি ওইটাই। তবে আপনার কথা অনুযায়ী আরেকবার ট্রাই করে দেখি।

এসির ভিতরে বসেও বীনার হাজবেন্ড দরদর করে ঘামছে। তার হাত, পা,মাথা সারা শরীর ঝিমঝিম করছে। সোজা হয়ে দাড়াতে পারছেনা। তারাতারি পাশেই একটা চেয়ারে বসে পড়লো। কি খবর শুনছে সে!

বারবার চেক করার পরেও একই উত্তর। কি হবে? কয়েক কোটি টাকার শিপমেন্ট। সর্বস্ব বিনিয়োগ করে এটি রেডি করেছে। পাগলের মত হয়ে গেছে কণার দুলাভাই। সে ফোনে সবাইকে জানিয়েছে। এদিকে তাদের অবস্থাও খারাপ। কি করবে, কার কাছে যাবে?

কণা, বীনা আর বীনার হাজবেন্ড তিনজনে মিলে দিগ্বিদিক শুন্য হয়ে ছুটছে উত্তরার সেই বায়িং হাউজে।

সেখান থেকে ও কোনো আশাব্যঞ্জক উত্তর নেই। তারা ও কিছুই জানেনা। তাদের কেমন যেন দায় সারা একটা ভাব। তাদের কথা আমাদের কাজ অর্ডার এনে দেওয়া। আর আপনারা এলসি সেই প্রথমেই পেয়ে গেছেন আপনারা কেন চেক করেননি। এটা তো আপনাদের দোষ। এটা তো দেখার দায়িত্ব আমাদের না। তারপরে ও খোঁজখবর করে দেখছি। তবে খুব বেশি উপকার করতে পারবো বলে মনে হচ্ছেনা।
অনেক বাক বিতন্ডা হলো দুই পক্ষে। হাতাহাতি ও হলো। কিন্তু কোনো লাভ হলোনা।

পাগলের মত হয়ে ছুটতে লাগলো ব্যাংকের হেড অফিসে, এ শাখায় ও শাখায়। কিন্তু কোনো উত্তর নেই।

থানায় যেয়ে ওই বায়িং হাউজের নামে মামলা ঠুকে দিলো। থানার ওসি তাদের পরিচিত। সে তাদের বুদ্ধি দিল যে, এভাবে এদিক ওদিক ছুটেও কোনো লাভ হবেনা। আর বায়িং হাউজ এর লোকজনের নামে মামলা দিয়েও লাভ নেই। ওরা অফিস গুটিয়ে খবর নেন আজই ভেগে গেছে। অন্য কোথাও অফিস খুলে বসবে। নাম ঠিকানা সব চেঞ্জ। এরকম বর্তমানে অহরহ ঘটছে। আমাদের কাছে অনেক কেস আসে এমন। কিন্তু কোনো ফল মিলেনা। আসলে ওদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। ওরা কমিশনের লোভে কাজ পাইয়ে দেয়। ওই পর্যন্তই ওরা করে খালাস। আসল নকল দেখার টাইম কই! ওদের ধরে কোনো লাভ নেই।
এরচেয়ে বরং শিপমেন্টের রেডকৃত প্রোডাক্ট গুলি অন্য কোথাও বিক্রির চেষ্টা করুন। তাতেও যতটুকু পান ওইটাই লাভ। থানা পুলিশ করে কিছুই হবেনা। শুধু শুধু মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তো লাভ নেই।

কণা জানতে চাইলো, তাহলে আমাদের এরকম ক্ষতি টা আসলে কেন করলো আর কারা করলো। আর এতে ওদের লাভ টাই বা কি?

– আসলে বাংলাদেশের গার্মেন্টেস ব্যবসার ধস নামানোর জন্য আমাদের আশেপাশের প্রতিযোগী দেশগুলি আমাদের গার্মেন্টেসে এরকম ফেক এলসি দিয়ে তাদেরকে সর্বস্ব হারাতে বাধ্য করে। তখন এদেশের রেগুলার ক্লায়েন্ট গুলি আমাদের হাতছাড়া হয়ে ওদের ধর্ণা ধরে। ওদের বায়ার এর পরিমাণ বেড়ে যায়। ওদের পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এজন্যই এ রকম বেশি লোভ দেখিয়ে ট্রাপে ফেলে। আর আপনারাও না বুঝে শুনে ট্রাপে পা দেন। আপনাদের এমন ভাবে প্রেসারে রাখে যে আপনারা এলসি চেক করার টাইম ও পান না।

সব কিছু খুইয়ে তারা পাগলপ্রায়। এই গরমের সিজনে এত পরিমাণ শীতের পোশাক কোথাও নিচ্ছেনা। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। এদিকে সব পাওনাদার রা পাগলের মত তাদেরকে বিরক্ত করা শুরু করেছে। তার উপর ব্যাংকের বিশাল লোনের বোঝা!

মাস গড়িয়ে যায়।এদিকে সব লোকাল কোম্পানি গুলি তাদের এই দেউলিয়া হওয়ার খবর শুনে আর কোনো কাজও দিচ্ছেনা। ঘরে বাজার চলেনা এরকম অবস্থা। কোনোরকম নাম মাত্র দামে লোকাল বাজারে কয়েকটি পার্টির কাছে কিছু পণ্য বিক্রি করে দু একজন পাওনাদার বিদায় করেছে। অনেকে তাদের নামে মামলা ও দিয়েছে। শেষে জেলের ঘানি টানার হাত থেকে বাচঁতে ধীরেধীরে মেশিন পত্র সব বিক্রি করে কিছু কিছু দেনা শোধ করলো। ঘরের দামি আসবাবপত্র, গহনাপত্র সব বেচা শেষ। এখন আর বেচার কিছুই নাই। তারপরে ও দেনার দায়ে মাথা তুলতে পারছেনা। এদিকে কয়েকমাস ধরে ব্যাংক লোন ও শোধ করতে না পারায় ব্যাংক থেকে নোটিশের পর নোটিশ! দেনার দায়ে হাবুডুবু অবস্থায় পুরো পরিবার কারো সামনে মুখ দেখাতে পারছেনা। এরকম খারাপ অবস্থা হয়েছে যা জীবনে চিন্তাও করেনি তারা।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে