শোভা পর্ব-০৪

0
552

#শোভা
#পর্ব_৪

শোভা ও আতিক আভার বন্ধু কাজলের মা রুখসানা বেগমের অফিসের ওয়েটিংরুমে বসে আছে। অপেক্ষা করছে তার সাথে সাক্ষাত করার জন্য। মিনিট বিশেক পরে একটা মেয়ে এসে বলল, আপনাকে ম্যাডাম ভিতরে ডেকেছে। শুধু আপনি একা যাবেন।

– তাহলে আমার বাচ্চা একজন কে রেখে যাই আর ছোটটা কে সাথে নিয়ে যাই।

– আপনার সাথে যে লোক আছে উনার সাথে থাকবে না। কারণ, ভিতরে যেয়ে বাচ্চা থাকলে কথা বলতে ডিস্টার্ব হয়। এজন্য বলছিলাম। আপনার ভালোর জন্যই।

– হ্যাঁ, হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, আমি চেষ্টা করে দেখি। ও যদি থাকে আমার ভাইয়ের কাছে তাহলে আমি একাই যাবো ভিতর।

শোভা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তার বাচ্চা দুটিকে আতিকের কাছে রেখে ভিতরে গেল।

– আসসালামু আলাইকুম! আসতে পারি?

– ওয়ালাইকুম আসসালাম! হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসো, আসো। তুমি তো আভার বোন শোভা?

– জ্বী, আপনি আভাকে চেনেন?

– হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনবো না কেন? ওকে তো অনেকবার দেখেছি। ও অনেক বার এসেছে আমাদের বাসায় কাজলের সাথে যখন হোস্টেলে থাকতো। অনেক ভালো বন্ধু ওরা দুজন। খুবই ভালো লাগে মেয়েটাকে। অল্প সময়েই মানুষের মন জয় করতে পারে। কেমন আছে ও? শুনলাম বেবি কনসিভ করেছে!

– জি ঠিক শুনেছেন ! ও ভালো আছে। আন্টি, কেমন আছেন আপনি?

– আলহামদুলিল্লাহ, ভালো! তুমি এবং তোমার বাচ্চারা কেমন আছে?
বাঁচা দুটি কোথায়? নিয়ে এসেছো নাকি রেখে এসেছো? ঢাকায় কোথায় উঠেছো?

– সবাই ভালো আছি। এখানে আমার চাচাতো ভাইয়ের শ্যালকের বাসাতে উঠেছি। আর বাচ্চারা বাইরে ওনার সাথেই আছে।

– ও! তোমার সব কথা আমি কাজলের কাছে আগেই শুনেছি। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে তোমার সাথে। এখন বলো তুমি আসলে কি করতে চাও? মানে আমি তোমাকে কোন ধরনের সাহায্য করতে পারি?

– আন্টি, আমি বাচ্চা গুলোকে নিয়ে যাতে কোনভাবে সম্মানের সাথে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি, সেই ব্যবস্থাটাই আপনি করে দিন। এটুকু হলেই আমার আপাতত চলবে। সৎ মায়ের সংসার, তার উপর বাবা অসুস্থ। সেখানে বাচ্চাদের নিয়ে থাকা কতটা জটিল সে হয়তো আপনি একজন মেয়ে হিসেবে বুঝবেন। আমাকে ছোটখাটো কোন একটা কাজ দিলেই চলবে । তাছাড়া স্বামীর সংসার থেকে আমি কোনো কিছুই পাইনি। আর পাবোও না। তাই একদম শূন্য হাতে মেয়ে দুটি কি সাথে করে নিয়ে এই শহরে পাড়ি জমিয়েছি। এখন আপনিই একমাত্র ভরসা। আমার যে কোন কাজ হলেই চলবে। সে যত ছোটই হোক না, যত কষ্টের কাজই হোক না কেন! আমি সম্মানের সাথে যাতে মেয়ে দুটির মুখে খাবার দিতে পারি সেই ব্যবস্থা হলেই চলবে। আমার আর কোন চাওয়া নেই।

– সে তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি তোমার অধিকারের জন্য তোমার শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সাথে লড়বে না? একদম এমনি এমনি ওদেরকে ছেড়ে দিবে ? তুমি যদি চাও আমি তোমার জন্য সেক্ষেত্রেও সাহায্য করতে পারি। প্রয়োজনে আমি আইনি সহায়তা দিতে পারব। আমার প্রতিষ্ঠান অসহায় মহিলাদের প্রয়োজনে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে ।
তুমি যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানের সাথে থাকবে, তাই তোমার। এই প্রতিষ্ঠান “আলোর বাহন “সম্পর্কে কিছু জানা প্রয়োজন। আমি এখানকার চেয়ারম্যান তুমি তো নিশ্চয়ই জানো সেটা।

– জি, আন্টি! আমি আভার কাছে শুনেছি এবং আপনার এই প্রতিষ্ঠানের অনেক সুনাম শুনেছি।

– “আলোর বাহন ” আমার একটি সন্তানের মত। আমি আমার মেয়ে কাজলকে যতটা ভালোবাসি আমার এই প্রতিষ্ঠানকেও ঠিক ততোখানি ভালোবাসি।

“আলোর বাহন ” একটি অলাভজনক অরাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে। যার মধ্যে জীবনমান উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক, সু-শাসন, মানবাধিকার, নারী ও শিশু অধিকার এবং নারীর ক্ষমতায়ন উল্লেখযোগ্য।

এই প্রতিষ্ঠানটি আমি তিল তিল করে গড়ে তুলেছি। এ প্রতিষ্ঠানের পিছনে অনেক শ্রম, অনেক ত্যাগ করেছি আমি এবং কাজলের বাবা। ছোটবেলা থেকেই আমি একটু স্বাধীনচেতা টাইপের। আমি যেখানে থাকতাম সেখানে এবং তার আশেপাশে বা কোথাও যখনই কোনো মহিলাদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন হতে দেখতাম, বা কারো সাথে কোনো অন্যায় হতে দেখতাম, তখনই প্রতিবাদ করতাম। আর এ কারণে আমি জীবনে বহুবার বহু মানুষের কাছে ছোট হয়েছি, অপমানিত হয়েছি। কিন্তু তারপরেও আমি থেমে থাকিনি। সারাজীবন আমার স্বপ্ন ছিল, আমি যদি এমন কিছু করতে পারতাম যার মাধ্যমে অসহায় নারীদের সাহায্য করতে পারবো। মহান আল্লাহ আমার সেই স্বপ্নকে সত্যি করেছে। আর আমার এই স্বপ্ন পূরণে আমাকে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে তোমার আংকেল। সে সবসময়ই আমার ক্রিয়েটিভ কাজগুলিকে উৎসাহ দিয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করতেও সাহায্য করেছে। বলতে পারো তাকে ছাড়া আমার এই স্বপ্নপূরণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অর্থ দিয়ে বলো,মেধা দিয়ে বলো আর শ্রম দিয়েই বলো সবদিক থেকেই সবসময় ছায়ার মতো আমার পাশে পেয়েছি। এজন্য আমার পাশাপাশি তাকেও পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের নানাদিক থেকে নানাভাবে তাকেও ছোট হতে হয়েছে। এখন আমার সংগঠনের অনেকগুলি শাখা। শত শত অসহায়া মহিলাদেরকে আমার সংগঠনের মাধ্যমে সাহায্য করছি। আমি যখন ওদের মুখের হাসি দেখি, মনটা ভরে যায়। এটাই আমার পরম তৃপ্তি।

আমাদের এই সংগঠনটিকে এখন অনেক সরকারি-বেসরকারি এছাড়া বিভিন্ন ধরনের দেশি বিদেশি দাতা সংস্থা সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে। এখানে যেসব মহিলাদের আইনি সহায়তা দরকার আমরা তাদেরকে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকি আবার যাদের কাজের প্রয়োজন আমরা তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের কাজের ট্রেনিং দিয়ে তাকে উৎসাহ দিচ্ছি। সেই কাজের মাধ্যমে ইনকাম করে তার সংসার চালাচ্ছে।

মেয়েদের কে বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এর চাহিদা অনেক। বিভিন্ন উৎসবে কাজের চাপ বেশি থাকে। তারপরেও বিশেষ একটি চাহিদার বাজার এই কাজের দখলে রয়েছে। এর মধ্যে নকশিকাঁথা, গিটভরাট, নিমপাতা, অ্যাবলিক, কাটোয়ার অ্যাবলিক, জড়ি, পুথি, ডালফোরন, সুতা বসানো, ক্রসজয়েন্ট, উল্টাক্রস, গুজরাটি, ফেব্রিক্স ও ডলার বসানো শাড়ি, থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, জিপসি, ফতুয়া ও কারুকাজসমৃদ্ধ শর্ট কামিজের চাহিদা বেশি। এছাড়া বুটিকস, কারচুপি, এমব্রোয়ডারি, বেডশিড, কুসনকভার, মশারির কভার, ওয়ালম্যাট, পার্টস, ব্যাগ, টিফিন ব্যাগ, কাপড় রাখার ব্যাগ, হ্যান্ড ব্যাগ, মোবাইল ব্যাগ এবং নকশি ফুল কাঁথা, বকুল ফুল কাঁথা, ক্রস ষ্টিজ কাঁথার ডিজাইন ও ম্যাচিং করে শোরুম মালিকদের ইচ্ছেমত বানিয়ে সরবরাহ করি আমরা। তুমি যে ধরনের কাজ করতে চাও করতে পারবে।

এখান থেকে কাজ শিখে তুমি চাইলে স্বাধীনভাবে ব্যবসাও করতে পারবে। অনেকেই করছে। আমরা ব্যাংক থেকে উদ্যোক্তাদের কে স্বল্পসুদে ঋণের
ব্যবস্থা ও করে দেই। তুমি আমার কাছে যখন এসেছো কিছু না কিছু ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর উপর ভরসা করো। তবে আমি তোমার পুরো কাহিনী আমি শুনতে চাই। তুমি আমার মেয়ের মতো। দেখি, তোমাকে কোন ভাবে সাহায্য করা যায়। এজন্য তোমার কাছ থেকে সব শুনতে চাই। এক কাজ করো তুমি তোমার বাচ্চাদের নিয়ে আমার বাসায় চলে আসো। আমার বাসা একদম খালি। তোমার আংকেল ব্যাংকক গেছে। আর কাজলও ওর শ্বশুর বাড়ি। আর আমার ছেলে সাজিদ ঘুরতে গিয়েছে বন্ধুদের সাথে খাগড়াছড়িতে। বাসার ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। কোনো ব্যবস্থা পাকাপোক্ত ভাবে না হওয়া পর্যন্ত আমার কাছেই থেকো। আর ও তোমার কাজিন কে ভেতরে ডাকি কি বলো। ওনার সাথে তোমার ব্যাপারে কথা বলি। আর বিকেলের চা নাস্তাটাও শেষ করা যাক। বলেই রুখসানা বেগম একজন পিয়নের মাধ্যমে আতিককে ডাকিয়ে নিলেন। তার সাথে শোভার ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের আলাপ আলোচনা সেরে নিলেন।

রুখসানা বেগমের বাসায় এসেছে শোভা এই দুদিন হয়ে গেলো। কিন্তু তার সাথে কথাই হচ্ছেনা। কি নাকি ঝামেলা চলছে অফিসে। সকালে ভোরে বের হয় আর রাত বারোটার আগে আর ফিরেনা। শোভা ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস ও করেনা। সারাদিন খালি বাড়িতে শোভার কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। মেয়ে দুটিকে নিয়ে সারাদিন বসে বসে সময় যেন কাটেনা। আসার পরদিন কাজল এসে তার সাথে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। অনেক ভালো একটা মেয়ে। কাজলকে কাছে পেয়ে শোভার মনে হলো সে যেন আভাকেই কাছে পেয়েছে। দুই বান্ধবীর মাঝে অনেক মিল। মাঝেমাঝে শোভা বুয়ার সাথে রান্নাবান্নায় সাহায্য করে। কিন্তু, তার নিজের কাছে লজ্জা লাগছিলো। এভাবে দুইটা বাচ্চা নিয়ে মানুষের বাসায় কতদিন থাকা যায়? আভার সাথে কথা হয় প্রায়শই ফোনে। আভা তাকে অভয় দিয়ে বলে, তুই কোনো চিন্তা করিস না। তুই আন্টির কাছে যখন গিয়েছিস, ব্যবস্থা একটা কিছু হবেই! উনি অনেক ভালো মানুষ।

মাঝেমাঝে আতিক ভাইয়ের সাথেও কথা হয়।

দেখতে দেখতে চারদিন পার হয়ে গেলো। রুখসানা বেগম আজ বাসায়ই আছেন। শোভাকে সে বুয়াকে দিয়ে তার রুমে ডাকিয়ে নিলেন।

– আন্টির সমস্যার সমাধান হয়েছে?

– সমাধান কি আর এত সহজে হয়রে মা! জোর করে করিয়ে নিতে হয়।

উনার মুখে মা ডাক শুনে শোভার বুকের মধ্যে কেমন যেন ভালোবাসা জেগে উঠলো। কত বছর পার হয়ে গেছে, কেউ এভাবে ডাকেনি তাকে।

– কিরে দাঁড়িয়ে কেনো! বস এখানটায়। এই কয়দিন তোর কোনো খোঁজখবর নিতে পারিনি। সরি। একটু ব্যস্ত ছিলাম। কোনো সমস্যা হচ্ছেনা তো?

– না, না, আন্টি। আমি ঠিক আছি। কোনো সমস্যা নেই।

– তোকে কয়েকটি কথা বলি। আর তোকে তুই করে বলে ফেললাম কিন্তু। আবার কিছু মনে করিসনি তো!

– না, না, আন্টি কি মনে করবো। আপনি বলতেই পারেন। আপনি আমার মা সমতুল্য।

– আচ্ছা, শোন। আমি গত দুইদিনব্যাপী তোর শ্বশুর বাড়িতে আসা যাওয়া করেছি। তোর ভাই আতিকের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছিলাম। সেদিন একটা ফর্মে তোর সাইন নিয়েছিলাম মনে পড়ে? ওটা ছিল তোর সম্মতিপত্র।

– হ্যা মনে পড়েছে ! কিন্তু, ওখানে কেন গিয়েছিলেন? ওরা আপনাকে খারাপ কিছু বলেনি তো!

– তুই কি করে বুঝলি?

– ও মা, কি বলেন ওদের সাথে সাতটি বছর ধরে থেকেছি। ওদের চিনবো না। ওরা উপর থেকে দেখতে মানুষের মতো। কিন্তু, ওরা আসলে মানুষ না। শুধুমাত্র আমার জান্নাত জিনাতের বাবা ছাড়া।

– হুম! ঠিক বলেছিস! একেক টা অমানুষ! সেদিন তুই চলে আসার পরে আতিক কে ডেকে ওর মুখ থেকে যতটুকু জেনেছি তাতেই আমার মন চাচ্ছিলো ওদের তখন ই চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াই। বেয়াদব প্রত্যেকটা। পরে তোর আর বাচ্চাদের ভরণ পোষণের জন্য লোক মারফত একটা আইনি নোটিশ পাঠাই। কিন্তু, ওরা আমার লোকের সামনেই নোটিশ টি ছিঁড়ে ফেলে। আর তোকে নিয়ে যতধরণের বাজে কথা আছে বলতে থাকে। আমি কোনোদিনই তেমন কোনো কেসে নিজে সামনে থেকে ফেস করিনি। কিন্তু, এবার চুপ থাকতে পারিনি। আমি ওদের স্পর্ধার কথা শুনে নিজেই গিয়েছিলাম। তোর শাশুড়ি থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি ননদই একেকজন একেকজন এর থেকে বেশি বেয়াদব। কি করে কাটিয়েছিস এত টি বছর এদের সাথে? নির্লজ্জ, বেয়াদব একেকটা। মানুষকে সম্মান দেয়া বোঝেনা।

– এজন্যই তো আজকে আমি ঘর হারা !

– আমি তোর লাইফের পুরো ঘটনা শুনতে চাই! একদম এ টু জেড। তোদের কি লাভ ম্যারেজ ছিলো নাকি অ্যারেন্জ? বল, আজকে আমি অফিসে যাচ্ছি না। আজকে বাসায় আছি সারাদিন।

– আমার কাহিনী আর কি শুনবেন! কোথা থেকে শুরু করব আর কোথা থেকে কি বলব আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা!

– জহিরের সাথে দেখা হওয়ার পরের থেকে বল।

– আমি সবেমাত্র এইচএসসি পাশ করেছি।বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে আমি আর আভা দুই বছর পরে নানুর বাড়ি নাটোরে বেড়াতে গেলাম। নানুর বাড়িতে যেয়ে দেখি ছোট মামাও ঢাকা থেকে এসেছে। আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেলো। সেই এস. এস. সি পরীক্ষার সময় তাকে দেখেছিলাম। মামা আমার থেকে সাত আট বছরের বড় হবে। মামার সাথে আমাদের দুবোনের বন্ধুর মতো সম্পর্ক। কিন্তু, মা বেচে না থাকার কারণে নানুদের আর আমাদের আসা যাওয়া কম। নানু বাড়ির কারো সাথে খুব বেশি যোগাযোগ হয়না। মামার সাথেও খুব বেশি দেখা হতোনা। মাঝেমধ্যে মামা বাড়িতে বেশি সময় ছুটি নিয়ে এলে যেতো আমাদের সাথে দেখা করতে। বিশেষ করে আভা মামার বেশি ভক্ত ছিলো। ও তখন সেভেন না এইটে যেন পড়ে। মামার সাথে মামার এক বন্ধুও সেইবার এসেছিলো। মামা বাড়ি থেকে চলন বিল খুব কাছেই। সেখানটায় ঘুরতে যাবার উদ্দ্যেশেই এসেছিলো সে। মামার সাথেই আবার একসাথে ফিরবে সে। মামা আমাদের দুবোন কে ডেকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।

– এদিকে আয় দুইজন!

– বলো, মামা।

– একে চিনিস! এ হচ্ছে তোদের আরেকটা মামা। ওর নাম জহিরুল হক। মানে তোদের জহির মামা। জহির, এইটা আমার বড় মা, শোভা! খুবই লক্ষী আর শান্ত। আর এই টা আমার ছোট মা, আভা। একটা শাঁকচুন্নি। জাস্ট বড়টার বিপরীত। আমি আমার যে আপার কথা বলেছিলাম না। ওই আপার স্মৃতি। শোভার চেহারা তো নাইন্টি পারসেন্ট ই আপার সাথে মিল। আর আপাও ওর মতো লক্ষী আর শান্ত ছিলো। এই পুচকি টা যে ক্যান এত ভেজাইল্লা হলো! মাথায়ই আসেনা।

আমরা তাকে সালাম দিলাম। সে ও আমাদের নাম, কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো তবে খুবই অল্প কথায়।
বুঝতে পারলাম আমার মামার বন্ধু মামার বিপরীত। আমার মামা সারাদিন বকবক করতে পছন্দ করে আর উনি শুনতে!

আভা মামার কথা শুনে ফোস ফোস করছে।

– তোরা এসেছিস ভালোই হয়েছে। আমি আর তোদের জহির মামা কালকে চলন বিলে যাবো ঘুরতে। তোরা মানে দুই পেত্নী ও যাবি কিন্তু আমাদের সাথে। অনেক ভালো লাগবে। সকাল সকাল বের হবো। তবে শর্ত হচ্ছে জ্বালাবি কম। বিশেষ করে আভা, তুই। তোকে দেখলেই ভয় হয়। রাস্তায় খাবার দেখলেই চাইতে পারবিনা। ছোঁচামি স্বভাবটা কি একটু কমছে নাকি বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরো বাড়ছে?

আভা জহিরের সামনে মামা ওকে বদনাম করায় খুব ক্ষেপে গেলো। ক্ষেপে মামার চুল টানা শুরু করলো।

– এজন্যই বলেছিলাম। যাহ! ছোট পেত্নীটাকে নিবোইনা।

– দেখা যাবে, আমাকে রেখে যাও কিভাবে! বলতে বলতে আভা কান্না শুরু করে দিলো। কে সামনে আছে, কে নাই এটা নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই।

– ঠিক আছে, ঠিক আছে! ক্ষমা চাচ্ছি! মা,ক্ষমা করে দিন। আপনি ক্ষমা না করলে যে আমি ওইপাড়ে যেয়ে বেহেশত পাবোনা। শত হলেও মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।

সাথে সাথেই আভা কান্না থামিয়ে মামার সাথে দুষ্টুমি শুরু করে দিলো। এতক্ষণ পরে আমি মামার বন্ধু জহিরের দিকে খেয়াল করলাম। উনি তেমন কোনো কথা বলছেনা। শুধু মামা আর আভার কাহিনী দেখে মুচকি হাসছে।

পরেরদিন সকালে হঠাৎ করে নানুর এক ভাইয়ের বউ অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পেয়ে তাকে দেখতে নানু আর নানা ভাই তার ভাইয়ের বাড়িতে যায়। ফিরতে ফিরতে তাদের প্রায় বিকেল গড়িয়ে যাবে। তাই চলনবিলে ওইদিন আর যাওয়া হলোনা। বাড়িতে আমি আভা আর মামা, মামার বন্ধু এই চারজন। রান্নাবান্না করার দায়িত্ব আমার। কারণ, আমি ছাড়া আর কোনো মেয়ে মানুষ নেই। আর আভা তো ছোট। তার উপরে কামচোর টাইপের। এর জন্য ওকে ছোটমার বকা খেতে হয় সারাদিন ধরে। আমি দুপুরবেলার খাবার রান্না করছি মাটির চুলোয়। মামা, আভা ওরা লুডু খেলছিলো নানুদের বৈঠক ঘরে। বৈঠক ঘরটা এখান থেকে বেশ দূরে রাস্তার কোল ঘেঁষে। আমি আনমনে কাজ করতে করতে কখন যে আমার গায়ের ওড়না চুলোয় দিয়ে দিয়েছি খবর নেই। দাউদাউ করে আগুন আমার শরীর পর্যন্ত চলে আসছিলো প্রায়। এমন সময় জহির হাতমুখ ধোয়ার জন্য পুকুরপাড়ে যাচ্ছিল। আমি আগুন দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে উনি দৌড়ে এলেন। উনি এসে কি করবেন বুঝতে না পেরে একটানে আমার আগুনে জ্বলতে থাকা ওড়না একটানে ধরে ফেলে দিলেন। আমি ভয়ে কাঁপছি। আর উনিও হতভম্ব হয়ে ঠায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যে ওড়না ছাড়া ওনার সামনে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছি আমার যেন হুশ নেই। কিছুক্ষণ পরেই আমার হুশ ফিরে এলো। লজ্জায় কি করবো বুঝতে পারলাম না। কাছাকাছি কোনো কাপড় ও দেখছিনা। আর ঘর রান্নাঘর থেকে একটু দূরে তাই তাড়াতাড়ি যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। আমি লজ্জা পাচ্ছি বুঝতে পেরে সে তার গায়ের শার্ট খুলে আমাকে নিজের হাতে পড়িয়ে দিলো।

– ভয়ের কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে গেছে, দেখ? আর রান্না করার সময় সাবধানে রান্না করবে। আগুন কিন্তু ভয়ংকর জিনিস। খেয়াল করবেনা! কি ভাবছিলে এত, যে পড়নের কাপড় চুলায় যায়? যাও আগে পুকুরপাড়ে যেয়ে হাতমুখ ধুয়ে নাও। ভয় কেটে যাবে। আমি তোমার বোন আর সাদেককে ডেকে দিচ্ছি।

কিন্তু, আমি ভাবলেশ হীন। আমাকে হত বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে নিজেই হাত ধরে পুকুরপাড়ে নিয়ে গেলো।

– নাও, হাতমুখ ধুয়ে নাও। বোকা! এত ভয় পেলে চলে।

এতক্ষণে আমি পুরোপুরিভাবে স্বাভাবিক হলাম। আমি তারাতারি করে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। তারপরে ঘরে গেলাম। মামা আর আভা আমার সব কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো।

– এতবড় বিপদ ঘটে গেলো আমরা টেরই পেলামনা। ভাগ্যিস জহির ওদিকটায় গিয়েছিলো। আল্লাহ জানেন কত বড় বিপদ হতে পারতো আজ। উহ!তোর কোথাও লাগেনি তো মা?

– না, না, ওর শরীর পর্যন্ত আগুন পৌছাবার আগেই আগুন সরাতে পেরেছি। না হলে আজ অনেক বড় বিপদ হতে পারতো।

আভা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। মামা জহিরকে ধন্যবাদ দিচ্ছে আমাকে আগুনের থেকে রক্ষা করার জন্য।

– আপা, তোর গায়ে শার্ট কেনো?

-আমি একটু লজ্জা পেয়ে তারাতারি একটা ওড়না গায়ে পড়ে জহিরের শার্ট ফেরত দিলাম।

-জহির ও যেন একটু লজ্জা পেয়ে তার শার্ট টি হাতে নিয়ে দ্রুতপায়ে সেখান থেকে চলে গেলো।

নানুরা ফিরে এলো সন্ধ্যা নাগাদ। তারা শুধুশুধু টেনশন করবে তাই আমরা তাদের কে আগুনের ঘটনা কিছুই জানালাম না। বিকেলে আমরা চারজন বসে চলনবিল নিয়ে গল্প করছি।

– জানিস, জহির এই চলন বিল আমাদের নাটোরের গর্ব। বরষায় চলনবিলের কি যে রূপ। এখনো তো পুরো বর্ষা শুরু হয়নি। হলে দেখতি। তারপরে এখনো কম কিছু নয়। নাটোর জেলার তিনটি জিনিস নিয়ে এরকম প্রবাদ আছে, গ্রাম দেখোতো কলম,শীব দেখোতো তালম আর বিল দেখোতো চলন।

– হয়েছে হয়েছে চলন বিল শুধু তোমাদের না। আমাদের পাবনার মধ্যেও কিন্তু পড়েছে। তাই তোমাদের নাটোর নিয়ে এত গর্ব করার কিছু নেই। বলে উঠলো আভা!

– বুঝছি রে, মা। আর আমি জানি তো। তবে চলনবিলের সবচেয়ে বড় অংশ পড়েছে নাটোরে। এই জেলার সিংড়া উপজেলায় রয়েছে চলনবিলের একটি অংশ। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে বনপাড়া পর্যন্ত দীর্ঘ সড়ক তৈরি হয়েছে চলনবিলের ওপর দিয়েই। সড়কের দুইপাশে যেদিকে চোখ যায় শুধু অথৈ জলরাশি। এ পথে চলতে চলতে চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় দু’চোখ ভরে

পরেরদিন সকালে আমরা চারজন বের হলাম চলন বিল দেখার উদ্দ্যেশে।

চলবে…………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে