শোভা পর্ব-০৫

0
453

#শোভা
#পর্ব_৫

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা গন্তব্যে এসে পৌছালাম। চারদিকে থৈ থৈ পানি। আমরা একটা নৌকা ভাড়া করলাম। দেখে মনে হচ্ছে আমরা সাগরে এসে পৌঁছেছি।

আমাদের কাছে অবশ্য এটা নতুন কিছু নয় এর আগেও আমরা চলনবিলে ঘুরতে এসেছি কয়েকবার। ছোটমামার বন্ধু মানে জহির চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলো আর অবাক হতে লাগলো।

চারদিকে অনেক পর্যটক দেখতে পেলাম।

– এখানে দেখছি অনেক লোকজনের ঢল, সাদেক!

– হুম! বর্ষায় এখানে লোকজনের ঢল থাকে। এখন পর্যন্ত বর্ষা ভালোভাবে শুরু হয়নি তাতেই এই অবস্থা। বর্ষায় বিস্তৃত জলরাশি আর অজস্র পাখ-পাখালীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার পাশাপাশি নৌকা ভ্রমণের আনন্দ পেতে প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু মানুষের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে উঠে চলনবিল। যথাযথ তত্ত্বাবধান ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে উত্তর জনপদের ঐতিহ্যবাহী এই চলনবিল একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা নৌকায় ঘুরে বেড়ানো যায়।

– কিরে শোভা, আভা কেমন লাগছে তোদের?

– হুম, মামা খুবই ভালো লাগছে।

দুপুর পর্যন্ত আমরা নৌকায় ঘোরাঘুরি করলাম। নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে জহিরের সাথে আমার ধীরে ধীরে কথা শুরু করতে করতে অনেক কথাবার্তা হল।

দুপুরের দিকে আমরা বাড়িতে ফিরে আসলাম। সপ্তাহখানেক এরও বেশি সম্ভবত দশ দিন জহির নানু বাড়িতে থাকলো। মামা আমাদের সবাইকে নিয়ে নাটোর এর আশেপাশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলো। ধীরে ধীরে জহির এর সাথে আমার আর আভার সাথে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হলো। কিন্তু মজার কথা হল জহির মামার বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও আমি এই কয়েকদিনের মধ্যে তাকে কখনোই কিছু বলে সম্বোধন করতাম না। আপনি আপনি করে কথা বলতাম। কিন্তু, কিছু বলেই ডাকতাম না।

তিন-চারদিন যেতেই খেয়াল করলাম জহির ও আমার সাথে যেচে যেচে কথা বলতে চাইতো। আর আমারও তার সাথে গল্প করতে খারাপ লাগত না, ভালোই লাগত। সে ঢাকার বিভিন্ন ধরনের মজার মজার গল্প শোনাতো। শুনতে শুনতে আমি আর আভা হেসে কুটি কুটি হয়ে পড়তাম। প্রথম দিন তাকে দেখে মনে করেছিলাম যে সে অল্পভাষী। কিন্তু তারপরে মনে হলো সে আসলে অপরিচিত দেখেই সেদিন তেমন কথা বলেনি। কিন্তু তাকে দেখে যে আরেকটা অনুমান করেছিলাম তা হল সে খুবই ভদ্র সৌম্য এবং শান্ত।কেউ কষ্ট পেতে পারে এরকম কথা সে কখনোই বলতো না। তার ছোট ছোট অনেক বিষয় দেখে আমি যেটা ধরেই নিয়েছিলাম যে সে প্রয়োজনে নিজে কষ্ট করতে রাজি আছে কিন্তু কাউকে ঠকাতে বা কাউকে কষ্ট দিতে সে কখনোই পারতোনা। এ যুগে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। মনে মনে আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম। জহিরকে আমার ভালো লাগতে শুরু করলো। কিন্তু সেটা ঐরকম ধরনের ভালোবাসা ছিল না।

জহির আর মামা চলে যেতে আর দুদিন বাকি। নানু মামার জন্য বিভিন্ন ধরনের শুকনো খাবার তৈরি করছিলেন, বিভিন্ন ধরনের পিঠা বানাচ্ছিলেন, যাতে মামাকে সাথে দিয়ে দেওয়া যায়। মামা অনেকদিন ধরে খেতে পারবে সেজন্যই নানু এগুলোর ব্যবস্থা করছেন। চাল কুমড়ার মোরব্বা বানাচ্ছেন, শুকনো পিঠা, খই, মুড়ি এটা-সেটা খাবারের অভাব নাই। মনে হচ্ছে এক মাসের খাবার পারলে সে মামার সাথে দিয়ে দেন। মামা তো রেগে মেগে আগুন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। নানু ঠিকই তার মত করে মামার জন্য বিভিন্ন ধরনের রংবেরঙের খাবার তৈরি করেছিলেন। আমি আর আভা দুবোন মিলে নানুকে সাধ্যমত সাহায্য করছিলাম। হঠাৎ করে, ছোট মামা এসে আমাকে ডাক দিলেন।

– শোভা মা, এদিকে একটু আয় তো! তোর সাথে একটু কথা ছিল।

– কি খবর মামা বলো!

– চল, বৈঠক ঘরে চল! ওখানে গিয়ে বলব!

আমরা বৈঠক ঘরে ঢুকতেই মামা দরজাটা লাগিয়ে দিলেন।

– কি ব্যাপার মামা! কোন টপ সিক্রেট বিষয় মনে হচ্ছে! আভা যাতে টের না পায় তাই দরজা দিচ্ছো?

– হুম! বিষয়টা অনেকটাই সেরকম। তোকে আমি এখন একটা কথা বলব । কথাটা মামা হিসেবে ভাগ্নিকে বলা যায় না! তারপরও আমি তোকে বলছি। মা, তোর মা বেঁচে নাই! হয়তো তোর মা বেঁচে থাকলে কথাটা সেই তোকে বলতো। আমি আম্মাকে দিয়েও কথাটা তোকে বলাতে পারতাম, কিন্তু মুরুব্বীদের জানানোর আগে ভাবলাম আগে তোর থেকেই কোন একটা মতামত নিয়ে নেই। তারপরে আমি আম্মাকে জানাবো। কারণ আম্মা কেমন তা তো তুই জানিস। ছোটখাট বিষয় নিয়ে তুলকালাম ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। অবশ্য এক্ষেত্রে আম্মার দোষ দিয়ে লাভ নেই। বয়স হয়েছে তো! এই বুড়ো বয়সেও কত কাজ করতে হয়! সংসারের কত ঝামেলা তাকে টানতে হয়। তার উপর আব্বা হচ্ছে আরেক পাগল। এই পাগল টাকেও তাকেই সামলাতে হয়। আর বড় আপাকে হারানোর শোক তো আছেই! যখনি বড় আপার কথা উঠে কাঁদতে কাঁদতে তখনই অস্থির হয়ে পড়ে!

– তাতো বুঝতে পেরেছি, মামা। কিন্তু, কি বলবে বলো! এতকিছু বলার কি দরকার! কি বলবে, সেটাই বলে ফেলো!

– মা রে, আমিতো তোর শুধু মামাই নই। একজন ভালো বন্ধুও। বন্ধু হিসেবে তোর সাথে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম। জানিনা, কথাটা তুই কিভাবে নিবি। কিন্তু গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখিস! তোর কোন সমস্যা হলে আমার সাথে আলাপ আলোচনা করে তুই সমাধান করতে চাইলে করতে পারিস! কিন্তু বিষয়টি নিয়ে খুব গভীরভাবে ভেবে তারপর উত্তর দিবি! হুট করেই কিছু বলবি না !

– ঠিক আছে মামা! বলো! তুমি আমাকে একটা কথা বলবে তার জন্য এত চিন্তা করার কি আছে? তুমি যেটা বলবে সেটাই তো! এর জন্য তুমি এতো ভয় কেন পাচ্ছো, বলে ফেলো!

– ঠিক আছে মা! জহির আমার বন্ধু হয় সেদিক থেকে সম্পর্কে তোর মামাই হয় বলা যায়। কিন্তু, ওর সাথে আমাদের তো কোন রক্তের সম্পর্ক নেই, তাই না! ছেলেটা খুবই ভালো এবং অনেক ভদ্র, শান্ত। ওর সাথে আমি অনেক বছর ধরে মিশছি। ওকে আমি চিনি। ও অন্য কাউকে কষ্ট দেবার কথা স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারে না । ওর বাবা নেই। ওর ছোট তিনটে বোন আছে আর ওর মা। ওদের কে ও জান দিয়ে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। ওর বোনদের মুখে আর ওর মায়ের মুখে ওর কথা যতটুকু শুনেছি তাতে ওর মত ভালো ছেলে পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই যে দেখ আমি মাঝে মাঝে তোর নানুর সাথে অনেক সময় রুড বিহেভ করি। কিন্তু, জহির কোনদিন ওর মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোরই সাহস পায় না। এমনকি তার সাথে সে কোনদিন জোরে চিৎকার করে কোন কথাও বলে না। আমাদের বন্ধু মহলেও জহিরের খুব সুনাম। ঢাকায় ওদের নিজেদের বাড়ি আছে। তাছাড়া ও নিজেও গার্মেন্টস এর বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবসা করে।

মামা এসব কথা কেন আমাকে বলছিল আমার মাথায় তখন ঢুকছিল না। আমি অবাক হয়ে গেলাম। অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলাম,

– মামা, তুমি তোমার বন্ধুর এত গুনগান আমার কাছে কেন করছো? আমি তো দেখছি উনি অনেক ভালো মানুষ! এই কদিনে আমি বুঝতে পেরেছি যে আসলেই সে একজন ভালো মানুষ! তোমার মত দুষ্টু না। বলেই আমি হেসে উঠলাম!

– শোভা, এটা হাসার সময় নয়। আমি একটা সিরিয়াস বিষয় তোর সাথে কথা বলছি। ভালো করে শোন। যেহেতু তুই বুঝতে পারছিস না, আমি কেন তোকে এসব কথা বলছি। তাহলে লজ্জা শরম ভেঙে বলতেই হয়। জহির তোকে পছন্দ করে। আর ও তোকে বিয়ে করতে চায়। মানে জহির আমার বন্ধু থেকে জামাই হতে চাচ্ছে। এখন বল, তোর কি মতামত? জহির অনেক সরল মনের মানুষ। ও তোকে পছন্দ করেছে কথাটা তোর কাছে কিন্তু বলেনি। কথাটা আমার কাছেই বলেছে। আমি যদি রাজি থাকি তাহলে ওর ফ্যামিলির সাথে এবং তোর সাথে কথা বলবে। আমি যদি রাজি না হতাম তাহলে ও কাউকেই জানাতো না। ওর কথা শুনে প্রথমে আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ওরা অনেক বড়লোক আর সেখানে আমরা বা তোরা কিছুই না। সেদিক থেকে ওর সাথে আমাদের মানায় না। কিন্তু পরক্ষণেই আমি ভেবে দেখলাম ওর মত একটা ভালো ছেলে পাওয়া আজকের জামানায় খুবই কঠিন। ও কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে আজ পর্যন্ত চোখ তুলে তাকায় নি। আর তাছাড়া আমিতো তোর কথা জানি তোরা দুই বোন যে কিভাবে ওই সংসারে টিকে থাকছিস! তোর ছোট মা কেমন সে তো আমি জানি! ওখানে থাকাটা তোর জন্য খুবই কষ্টের! আর আজ হোক বা কাল হোক তোর বিয়ে তো দিবই। তাছাড়া তোকে অনার্স পড়ার জন্যও তো ঢাকা যেতে হবে। জহির তোর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। এটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান। এখন তুই ভেবে দেখ। এখন বড় হয়েছিস নিজের ভালো মন্দ নিশ্চয়ই বুঝবি। আর আমি দুলাভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলেছি। তিনি ও আমার সাথে একমত।

মামার কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। লজ্জাও পাচ্ছিলাম।

– মামা, মেয়ে যখন হয়েছেি তখন আজ হোক বা কাল হোক পরের ঘরে তো যেতেই হবে! সে আমি জানি। কারণ ছোট মা উঠতে বসতে বাবাকে কথা শুনায়। মেয়ে এত বড় হয়ে গেছে এখনো কেন বিয়ে দেয় না! এখনো কেন তাকে জ্বালাচ্ছি, আরো নানা ধরনের কথা শুনে শুনে আমি একথা বুঝতে পেরেছিলাম যে ওই বাড়িতে আমি আর বেশিদিন থাকতে পারবো না। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? উনি তো তোমার বন্ধু? তাছাড়া আমার এখনই বিয়ে হয়ে গেলে আভার কি হবে? ও এখনো অনেক ছোট।

– ও নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না তুই শুধু বল জহিরকে তোর কেমন লাগে ?

– উনি ভালো মানুষ। যতটুকু দেখেছি উনি অনেক ভদ্র আর নিরীহ টাইপের একজন মানুষ। কিন্তু তাই বলে!

– মা, আমি তো কিছুই বলিনি। ও নিজে থেকে বলেছে। এটা আমাদের সৌভাগ্য। এত ভালো ছেলে!
আর ওকে বিয়ে দেয়ার জন্য ওর পরিবার থেকেও মেয়ে খুঁজছে। তুই রাজি থাকলে ও তোর সাথে কথা বলতে চায়। যা! পুকুরঘাটে অপেক্ষায় আছে তোর।

– কিন্তু, মামা!

– আবার কিন্তু কিসের? যা! আর কথা বলতে তো কোনো দোষ নেই। যা! আমি আশেপাশেই থাকবো। ভয় নেই।

কেন যেন সেদিন মামাকে না করতে পারলাম না। হয়তো বা জহিরের প্রতি আমার মন থেকেও কোন টান অনুভব করছিলাম । গুটিগুটি পায়ে আমি পুকুর ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি আগে থেকেই জহির সেখানে বসাই ছিল। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো।

– বসো!

আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ পুকুরঘাটে বসলাম।

প্রায় মিনিট পাঁচেক দুজনের কেউই কোন কথা বলছি না। দুজনেই নিরব হয়ে বসে আছি। আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, জহির লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে যেন কি বলবে, বলবে, কিন্তু বলতে পারছেনা।

মিনিট পাঁচেক পরে নীরবতা ভেঙ্গে জহির বলে উঠলো, তোমাকে নিশ্চয়ই সাদেক সব কথাই বলেছে। অবাক হয়েছো নিশ্চয়ই। বিষয়টা ভাবতে আমার কাছেও অবাক লাগে যে আসলে কি দিয়ে কি হয়ে গেল। অবাক হয়ে ভাবি, আমি কি করে ফেললাম। কিন্তু, তারপরে মনে হয় এটাই বুঝি আমার নিয়তি! এটাই আমার প্রথম ভালোলাগা আর ভালোলাগা থেকেই বুঝি ভালোবাসা। কাউকে এত তারাতারি এভাবে ভালোবেসে ফেলবো বুঝতেই পারিনি।

আমি যেন লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। কতক্ষণ আবার নিরবতা। কেউ কিছু বলছিনা। অনেক সাহস সঞ্চার করে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বললাম, এটা তো আপনার ক্ষণিকের আবেগ বা ভালোলাগা ও হতে পারে!

– উহু! কাউকে ভালোলাগা আর ভালবাসার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে l ভালবাসা আসে মন থেকে, আর ভালোলাগা চোখ থেকে। তুমি একজনের বাইরের সৌন্দর্য দেখে তার প্রতি যে টান অনুভব করবে সেইটাই ভালোলাগা l আর তুমি যদি কারো মন-মানসিকতা, গুন দেখে মুগ্ধ হও এবং তুমি যে কোনো মূল্যে তার ভালো চাও তবে আমার মতে সেটা হবে ভালবাসা l ভালবাসা কারো বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে হয় না l তাছাড়া ভালোলাগা থেকেই ভালবাসার সূত্রপাত হয়

তার কথা শুনে আমি কিছুই যেন বলতে পারছিলাম না। স্তব্ধ মতন হয়ে গেছি এটুকু সময়ের মধ্যে সে কখন আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে এটাতো আমি টেরই পাইনি।

– জানো, ভালোলাগাতে প্রত্যাশা থাকে, তবে ভালোবাসার সাথে প্রত্যাশার কোনো সম্পর্ক নাই l ভালোবাসার পরিধি মহাবিশ্বের মতোই বিশাল।‘ভালোবাসা’ নামক বস্তুটিতে যতটা আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়, তা শুধু ‘ভালোলাগা’ থেকে মেলে না l খুব তুচ্ছ কারনে যে কারো প্রতি ভালো লাগা তৈরি হতে পারে, আবার ঠুনকো কারণেই সেই ভালোলাগার মৃত্যু হতে পারে l ভালোবাসার মৃত্যু হয় না, ঠিক যে একই কারণে আত্মার মৃত্যু নেই l

অনেক কথা বলে ফেললাম, তাইনা! ভাবছো, কেনো
এত বকবক! তুমি আমার থেকে বেশ ছোট হবে। কিন্তু,মোটামুটি নিজের ভালো মন্দ বোঝার বুদ্ধি হয়েছে। জানিনা, আমাকে নিয়ে তুমি কেমন মনোভাব পোষণ করছো? আমি হয়তো বর্তমান যুগের অন্য ছেলেপেলেদের মতো অত ইনিয়েবিনিয়ে সুন্দর করে ভালোবাসি শব্দটি বলতে পারবোনা। তবে, তোমাকে ভালোবাসার মধ্যে কোনো ঘাটতি থাকবেনা। আমি যখনই অনুভব করলাম যে, আমি তোমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি, তখন থেকেই টেনশনে ছিলাম। এটা কি করে সম্ভব! তুমি আমার বন্ধুর ভাগ্নি। কিন্তু যখন নিজের মনের সাথে বিবেক হেরে গেলো তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি সাদেককে সব কিছু জানাবো। ওর সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত হবে। ওর সাথে কথা বলার পরে আমি কিছুটা টেনশন মুক্ত হলাম। এখন আমাকে পুরোপুরিভাবে টেনশন মুক্ত করার দায়িত্ব তোমার।
আমি কি কোনো ভুল করলাম , শোভা?

– আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা। প্রেম ভালোবাসা বা পছন্দ করা এগুলো নিয়ে চিন্তা করার কখনোই সময় হয়নি আমার? আমি কেমন পরিবেশে বা কিভাবে বড় হচ্ছি কিছুটা হলেও মামার কাছে আপনি শুনেছেন। স্বাধীনভাবে বা মৌলিক ভাবে কোন কিছু চিন্তা করার অধিকার বা ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই। মেয়ে হয়ে যখন জন্ম নিয়েছি তখন পরের ঘরে তো যেতেই হবে! আজ হোক বা কাল হোক। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন অধিকার নেই। আমার ভালো মন্দ এগুলো দেখার দায়িত্ব আমার বড়রা আছে তাদেরই। তারা আমার জন্য যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই আমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু যেখানেই আমার বিয়ে হোক আমার শুধু তাদের কাছে একটাই দাবি থাকবে, আমি যেন পড়াশুনাটা শেষ করতে পারি। মিনিমাম গ্রাজুয়েশন টা হলেও যেন আমি শেষ করতে পারি। আর কোন চাওয়া নেই আমার।

– আমি তোমার ব্যাপারটা কিছুটা হলেও জানি। সৎ মায়ের সংসারে ছোটবেলা থেকেই বড় হয়েছো। তোমার চলার পথটা যে খুব একটা মসৃণ ছিল না সেটা আমি বুঝি। বড়দের সাথে কথা বলার আগে আমি তোমার মতামত টা একটু জানতে চাই। আমাকে তোমার কেমন লাগে মানে তোমার কাছে আমি কেমন ধরনের মানুষ শুধু এতটুকু জানালেই আমি বুঝতে পারবো।

– আপনার সম্পর্কে আসলে কি মতামত দিব! আপনাকে আমি অল্প সময় দেখেছি! আপনি মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। আপনার কথা মামার কাছ থেকে যতটুকু জেনেছি তাতে আপনি মন্দ নয় বললে ভুল হবে, আপনি যথেষ্ট ভালো মানুষ।

– যাই হোক! উত্তর পেয়ে গেলাম। আমি তোমাকে যত দেখছি মুগ্ধ হচ্ছি। আর তোমার সরলতা আমাকে আরো মুগ্ধ করেছে। আমি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি ঢাকাতে যেয়েই মাকে দিয়ে তোমাদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাবো। অপেক্ষায় থেকো!

আমার কি যে হলো বুঝতে পারলাম না। যেন ঘোরের মধ্যে আছি। আমি লজ্জায় মাথা অবনত করে শুধু মাথা হেলিয়ে হ্যা সূচক সম্মতি দিয়ে এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে লুকালাম।

এই ঘটনার প্রায় দুমাস পরে ওরা আমাদের বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে আসলো। আমার ছোট মা তো এতই খুশি পারলে সেদিন ই আমাকে তাদের সাথে বিদায় করে দেয়। বাবা, চাচা, আত্মিয়- স্বজন, মুরুব্বীরা তাদের খোঁজখবর নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট। সবার একই কথা, মা মরা মেয়ে এত ভালো ঘর পাবে সে নাকি আমার রাজ কপাল। একমাসের মধ্যে ঘরোয়া পরিবেশে আমার বিয়ে দিয়ে দেন জহিরের সাথে। আর নানা, নানু আর ছোট মামা বাবাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আভাকে নিয়ে যান তাদের কাছে। বাবা প্রথমে রাজি না হলেও পরে আমি বুঝিয়ে বলার পরে আভাকে তাদের সাথে দিতে রাজি হন। আভাও যেন মুক্তি পেলো। আমার ছোট মা একসাথে দুই মেয়েকে বিদায় করে ঘর খালি করতে পেরে সে কি খুশি তার চেহারায় সেদিন। খুশিতে আবেগ আপ্লুত হয়ে নিজের কানের দুল টা খুলে আমাকে উপহার দেন। আমিতো অবাক! যে কোনোদিন দুইটা টাকা টিফিন খরচ এর জন্যও হাতে দেয়নি। বাবার কাছ থেকে চেয়ে লুকিয়ে নেওয়ার পরে টের পেলে আমার আর বাবার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতো! সে তার আট আণা ওজনের কানের দুল আমাকে দিয়ে দিলো। অবশ্য দুল টা আমার মায়েরই ছিলো। কিন্তু, আমার মায়ের কোনো গহনাই উনি উনার হাতছাড়া করেনি। সব উনার! আমি কোনোদিন শখ করে স্কুল কলেজের ফাংশনে পড়ার জন্য চাইলে সে যে কথা শুনাতো তা আর মুখে নেয়া যায়না!

চলে এলাম শ্বশুড়বাড়ি। শুরু হলো জীবনের তৃতীয় অধ্যায়! তৃতীয় অধ্যায় বললাম, কারণ প্রথম আর দ্বিতীয় অধ্যায় তো শেষ করেছি আমার মা আর ছোটমার সাথে। এবার শ্বাশুড়ি আর ননদিনী দের সাথে শুরু হলো জীবনের সবচেয়ে কঠিন ধাপ!

চলবে………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে