মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৭

0
232

মন গহীনের শব্দ
| ৭ |
শেষ রাতের দিকে প্রচন্ড শীতে কাঁপুনি উঠে গেল শরীরে। বুঝতে পারলাম জ্বর আসছে। পাত্তা দিলাম না তেমন। ভাবলাম হালকা পাতলা জ্বর হয়ে দুই একদিনের মধ্যেই সেরে যাবে। কিন্তু টানা পাঁচ দিন ভুগিয়ে অবশেষে জ্বর বিদায় নিল। পড়াশোনা এই কদিনে হয়নি বললেই চলে। কোচিং-এর অনেকগুলো লেকচারও মিস হয়ে গেছে। সেগুলোর ব্যাকাপ দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম আমি।

এরমধ্যে আলতাফ ভাইয়ের সামনে যাইনি একবারও। আজও তার সাদা গাড়িটি বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখলাম ব্যালকনি থেকে। দূর থেকেও আমি বুঝতে পারলাম, তিনি আমার ব্যালকনির দিকেই তাকিয়ে আছেন। আমি রুমের মধ্যে চলে এলাম।

কিছুক্ষন পরে সুলেখা আন্টি এলো কেক আর চকলেট নিয়ে। বলল, “আলতাফ এনেছে তোমার জন্য। খেয়ে নিও।”
হঠাৎই আমার রাগ লাগল খুব। সেদিন যা তা বলে অপমান করে একবার স্যরি বলার প্রয়োজনবোধ করলেন না তিনি, এমনকি জ্বরের মধ্যে একটা টেক্সট করে খোঁজ অব্দি নিলেন না। আজ হঠাৎ এই আদিখ্যেতা আমার আর সহ্য হলো না। আমি চিৎকার করে রুনিকে ডাকলাম৷ রুনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করল, “এমুন চিল্লাফাল্লা করে ডাকেন ক্যান আপা। আমি তো ডরাইয়া গেছিলাম।”
“এই কেক আর চকলেটগুলো তোর। খেয়ে নিস এগুলো। আর খাওয়া হলে তোর আলতাফ ভাইজানকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে আসিস। এগুলো উনিই এনেছেন।”
“আইচ্ছা।”

সুলেখা আন্টি হতাশ চোখে তাকিয়ে বসে আছেন পাশে। কিছুক্ষন পড়েই ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকলেন আলতাফ ভাই। সবসময়ের মতো আজ আর অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না। রুমে ঢুকেই সুলেখা আন্টিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “চাচি, আমি কি সুজাতাকে কিছুক্ষনের জন্য আমার সাথে নিয়ে যেতে পারি?”
“অবশ্যই, নিয়ে যাও। না যেতে চাইলে জোর করে নিয়ে যাও।”
“ধন্যবাদ, চাচি।”
একপ্রকার টেনে হিঁচড়েই আমাকে রুম থেকে বের করলেন তিনি। একেবারে গাড়ির সামনে এনে হাত ছাড়লেন। গাড়ির দরজা খুলে বললেন, “উঠে পড়ো।”
আমার তখন রাগে শরীর কাঁপছে। আমি বললাম, “যাবো না।”
“যেতে তো হবেই। তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
আমি মুখ ভার করে উঠে বসলাম গাড়িতে। গাড়ি এসে থামল তার বাসার সামনে। তিনি আমার হাত ধরেই ভেতরে নিয়ে গেলেন। লিভিংয়েই বসলাম আমরা। তিনি গলা ছেড়ে ডাকলেন, “ফুপু, এদিকে এসো। দেখে যাও, কাকে নিয়ে এসেছি।”
বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে এক দুঃসম্পর্কের ফুপু থাকেন তার সাথে। নিঃসন্তান এবং বিধবা বলে আর কোনো পিছুটানও নেই তার। ফুপু এসে কিছুক্ষন কুশলাদি বিনিময় করে চলে গেলেন। ফুপু চলে যাওয়ার পর আলতাফ ভাই চেয়ার টেনে একেবারে আমার মুখোমুখি বসে প্রশ্ন করলেন, “এবার বলো, তোমার জন্য নেওয়া খাবারগুলো রুনিকে কেন দিয়েছ?”
“আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।”
“ইচ্ছে হলেই সব করতে হবে?”
” হ্যাঁ, হবে।”

“ওগুলো আমি আমার হবু বউয়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো সব তুমি রুনিকে দিয়ে দিয়েছ। নিজের অধিকার নিজেই ছেড়ে দিয়েছ। এবার তাহলে রুনিকেই বিয়ে করে ফেলি, কী বলো?”
“করুন। তাতে আমার কী।”
“আরেকবার বলো প্লীজ। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে তোমার সত্যিই কোনো সমস্যা নেই? যা বলবে ভেবে চিন্তে বলো কিন্তু। আমি এটাকেই তোমার মনের কথা বলে ধরে নেব।”
আমি কোনোরকমে কান্না চেপে বললাম, “আপনি ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করছেন, তাই না?”
সে বরাবরের মতোই স্বাভাবিক, “কাঁদছ কেন? তুমি তো আগে থেকেই জানতে আমি এরকম। একেবারে ছোটোবেলা থেকেই তো দেখে এসেছ আমার স্বভাব। জেনেশুনেই আমার মতো কঠিন হৃদয়ের মানুষকে পছন্দ করেছ। চাচার কাছে যখন তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম, তখনও তো তোমার সম্মতি নেয়া হয়েছিল। তাহলে এখন কেন কাঁদছ?”
“আপনি আসলেই খুব খারাপ একটা মানুষ।”

তিনি হেসে দিলেন। আমার একটা হাত আলতো করে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিচু এবং নরম গলায় বললেন, “স্যরি। সেদিন তোমার সাথে খুব রুড বিভেভ করে ফেলেছিলাম, তাই না?”

ব্যাস, তার এই একটুখানি আহ্লাদে আমার অশ্রু আর বাঁধ মানল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। তিনি যেন কৈফিয়ত দিয়ে যাচ্ছেন,
“কী করব বলো। অন্য কেউ তোমার দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকিয়েছে সেটা ভাবলেই মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছিল।”
“তাই বলে আপনি যা নয় তাই বলবেন আমাকে? আমি সেজেগুজে ছেলেদের সিডিউস করি?”

“কখনও না। আমি জানি, আমার সুজাতা একটা পবিত্র ফুল। সেদিন অফিসিয়াল কিছু ঝামেলাও ছিলো। সব মিলিয়ে মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত ছিল বলেই ওরকম করে ফেলেছি। তাছাড়া তোমাকে নিজের সামনে থেকে সরাতেও চাইছিলাম।”

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করাল্ম, “কেন?”

“এরকম আবেদনময়ী হয়ে সামনে এলে নিজেকে সামলানো মুশকিল। যেহেতু আমি একজন পুরুষ, স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদাগুলো আমারও আছে। তুমি আমার জন্য হালাল নও এখনও। বিয়ের আগে হারামভাবে ঘনিষ্টতাও চাইছিলাম না। এজন্যই চেয়েছিলাম, বিয়েটা করে ফেলতে। কিন্তু চাচা আর চাচি কিছুতেই তোমার ভার্সিটি জয়েন করার আগে অব্দি বিয়ের প্রেসার দিতে চান না। এদিকে আমি প্রতিনিয়ত তোমার শূন্যতায় তড়পাচ্ছি, ওদিকে তুমি বিধ্বংসী রূপে আমার সামনে আসছো। এভাবে নিজেকে সামলে রাখা যায় না।”

তার কথা শুনে আমি চট করেই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। নিচের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলাম প্রচন্ড রকমের লজ্জা পাচ্ছি।

আলতাফ ভাই বললেন, “এরপর চকলেট দিলে যদি রুনিকে দাও, তাহলে সত্যি সত্যিই ওকেই বিয়ে করে ফেলব।”
আমি বললাম, “আমি করতে দিলে তো।”
তিনি হাসলেন। বললেন, “অবশেষে মেঘ কেটেছে। চলো, এবার তাহলে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“আরেকটু থাকি প্লিজ।”
“এখন না। বিয়ের পরে যত খুশি থেকো।”
“আশ্চর্য, আমি একটু থাকতেও পারব না। তাহলে এখানে আমাকে নিয়ে এসেছেন কেন?”

“নিজের অপরাধবোধ হালকা করতে। সেদিন তোমাকে কঠিন কথাগুলো শোনানোর পর থেকে নিজেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। তোমাদের ঘর অথবা পাবলিক প্লেস কথাগুলও বলার জন্য সুইটেবল ছিল না। সেজন্যই এখানে এনেছি। কথা বলা শেষ তাই এখন বাসায় দিয়ে আসবো।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, “বেরসিক কোথাকার।”
উত্তরে আবারও সেই হাসি।

এরমধ্যে কেটে গেছে আরো কয়েকমাস। আমার এইচএসসির রেজাল্ট বেরিয়েছে। জিপিএ ফাইভ পেয়েছি শুনে সবাই খুব খুশি। রিলেটিভ, বন্ধুবান্ধব সবাই শুভকামনা জানাতে কল করছে। শুধু একজন মানুষেরই কোনো খবর নেই৷ আমি জানি, সে এমনই তবু অকারণ অভিমান করে থাকলাম সারাদিন।

কাঙ্ক্ষিত মেসেজটি এলো রাত এগারটার দিকে। স্ক্রিনে শুধু একটা শব্দই ভাসছে, “কংগ্রাচুলেশনস।” এই একটা শব্দই আমার কাছে মনে হলো অনেক অনেক দামি।

এদিকে এডমিশন টেস্টের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। আলতাফ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ৷ না হয় কথা আর না কোনো টেক্সট। শুধু মাঝে মাঝে চোখের দেখা দেখি। দেখতে দেখতে দিন পার হয়ে গেল। পরপর কয়েকটা ভার্সিটির জন্য এক্সাম দিলাম। অনেকগুলোতে দিলেও এখানকার পাবলিক ভার্সিটিতেই অ্যাডমিশন নেওয়ার ইচ্ছে আছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ওয়েটিং লিস্টে এসে আটকে গেলাম। বাকি সবগুলোতেই চান্স পেয়েছি। রেজাল্ট পেয়ে মন খারাপ হয়ে গেলা আমার।

রাতে বাসায় ফিরে বাবা ডাকলেন তার রুমে। আমি খোলা দরজায় নক করে বললাম, “ডেকেছিলে, বাবা।”।
” হ্যা, আম্মা। এদিকে এসো। তোমার আন্টির কাছে শুনলাম সব। মন খারাপ করে আছো নাকি সারাদিন। বেশি টেনশন নিও না। পাবলিকে না হলে প্রাইভেটে ভর্তি হয়ে যাবে। আর তাছাড়া, ওয়েটিং লিস্টে তো আছ, যা হবে ভালোই হবে ইনশাআল্লাহ। ”
বাবার সাথে কথা বলে মন কিছুটা হলেও হালকা হলো।

পরেরদিন সকাল সকালই এলো আলতাফ ভাই। দুপুরে আমাদের বাসাতেই খেলেন। বিকেলে একপ্রকার জোর করেই আমাকে নিয়ে বের হলেন। আমি গাড়িতে উঠে বললাম, “প্রত্যেকবার আমার হাজার অনুরোধেও একটু সময় দিতে চান না আমাকে, তাহলে আজ সেধে কেন নিয়ে যাচ্ছেন?”

“দাদি বললেন, তার নাতনির মন ভালো নেই। তাই মন ভালো করতে নিয়ে যাচ্ছি।”
উত্তর শুনেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তারমানে দাদি বলেছেন বলেই আজ আমাকে নিয়ে বের হয়েছেন৷ তাইতো বলি, যে মানুষ খুব দরকার ব্যতীত আমার সাথে একটা কথাও বলে না, সে কিনা নিজে সেধে আমাকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।

আমি বললাম, “আপনার আমাকে নিয়ে যেতে হবে না। আমি যাবো না কোথাও।”
তিনি গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললেন, “রেগে যাচ্ছো কেন?”

“রেগে যাওয়া উচিৎ না বলছেন? আজ পর্যন্ত নিজে থেকে একদিন কোথাও আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছেন? কখনও পাশাপাশি বসে ভালো করে দুটো কথা বলেছেন আমার সাথে? আজকেও দাদি বলেছে বলে আমাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিজের কোনো ইচ্ছে নেই আপনার? থাকবেই বা কী করে। আমার প্রতি আপনার কোনো অনূভুতিই তো নেই। আমি একাই শুধু…।”
“একাই শুধু কী?”
“কিছু না।”

“আচ্ছা, তোমাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে কেন নিয়ে যাবো আমি? পাশাপাশি বসে কথাই বা কেন বলব? ধর্মীয় বল কিংবা সামাজিক, কোনো দিক থেকে কি আমাদের মধ্যে কোনো বৈধ সম্পর্ক আছে?”
“মানে! আপনি কি বলতে চান? আমাদের দুজনেরই দুজনের প্রতি যে অনুভূতিগুলো রয়েছে সেগুলোর কোনো দাম নেই?”
“না, আপাতত নেই। তুমি আমার জন্য হালাল নও এখনও। আমাদের ভবিষ্যত সবসময়ই অনিশ্চিত। ধরো,আজকে তোমাকে নিয়ে আমার ফিলিংসগুলোকে বাড়তে দিলাম। কাল তো তোমার সাথে আমার বিয়ে নাও হতে পারে। যতক্ষন পর্যন্ত তোমাকে বিয়ে না করছি, ততক্ষন পর্যন্ত তথাকথিত ভালোবাসার আলাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

“আমি আপনাকে ভালবাসি। তার কি বিন্দুমাত্র দামও নেই আপনার কাছে?”
আলতাফ ভাই হাইওয়ের পাশেই গাড়ি থামালেন। তারপর বললেন, “সুজাতা, হয়তো তুমি আমার কথায় হার্ট হচ্ছো। তবে সত্যি এটাই যে বিয়ের আগেই ভালোবাসায় আমি বিশ্বাসী নই৷”

“আপনি খুব খুব খারাপ একটা মানুষ।”
তিনি হাসলেন, “আমি জানি। কী আর করা বলো, এই খারাপ মানুষটাকেই তুমি শেষ পর্যন্ত পছন্দ করে ফেললে। এরজন্যই তো, সুদর্শন ডাক্তারটিকেও রিজেক্ট করে দিয়েছিলে একসময়। বেচারা অনেক কষ্ট পেয়েছিল।”
“আপনাকে বলেছে। তামিম ভাই কোনো কষ্ট পায়নি।”

“তুমি তার কষ্টটা দেখতে পাওনি। দেখবেই বা কি করে, তুমি তো ভালো করে তার দিকে কোনোদিন তাকাওনি অব্দি। তুমি তো আগেই একটা খারাপ মানুষকে নিজের মনের মধ্যে জায়গা দিয়ে রেখেছো।”

“হ্যা, শুধু আমিই রেখেছি। আমাকে তো কেউ তার মনে জায়গা দেয়নি এখনও।”
“একটু ভালো করে চোখ কান খুলে বোঝার চেষ্টা করো, তাহলেই বুঝতে পারবে কেউ তোমাকে মনে জায়গা দিয়েছে কী দেয়নি।”

আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। চোখ কান খুলে কি বোঝার ইঙ্গিত দিলেন তিনি? কিছু কি মিস করে যাচ্ছি? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার ইঙ্গিত দেয়ার কারন বুঝতে পারলাম আমি। সাথে সাথেই ফিক করে হেসে দিলাম। তার ঠোঁটের কোনেও মুচকি হাসি লেগে আছে।

সেদিন শপিং মলে পছন্দ করে একটা শার্ট কিনেছিলাম তার জন্য। সরাসরি কখনোই গিফট আদান প্রদান যেহেতু হয় না আমাদের মধ্যে, তাই ইচ্ছে করেই শার্টের প্যাকেটটা তার গাড়িতে ফেলে এসেছিলাম। সেই শার্টটাই আজ পড়ে আছেন তিনি। মুখে কিছু না বলেও তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে তার মনেও আমার জন্য একটা সফট কর্নার আছে। এজন্যই এই ব্যক্তিত্ববান মানুষটার প্রেমে বার বার পড়ি আমি। হতে পারে তামিম ভাইয়ের মতো তার গায়ের চামড়া ততটা সাদা নয়। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের কাছে একশ তামিম ভাইও মূল্যহীন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে