মন গহীনের শব্দ পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
299

মন গহীনের শব্দ
| ১২ | (শেষ)
খুব সুন্দর একটা সাজানো গোছানো সংসার হতে পারত আমাদের। অথচ কোথা থেকে কী হয়ে গেল। ও বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই হেঁচকি তুলে কেঁদে উঠলাম আমি।

পরিচত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম হঠাৎ, “এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদলে লোকজন তাকিয়ে দেখবে আর মজা নেবে। তারচেয়ে বরং গাড়ির মধ্যে চলো। তারপর যত খুশি কান্না কোরো। প্রয়োজনে আমার বুক পেতে দেব মুখ লুকিয়ে কাঁদার জন্য। এখন চোখেমুখে একটু পানি দাও, বিধ্বস্ত লাগছে তোমাকে।”
আলতাফ একটা পানির বোতল আমার দিকে এগিয়ে দিল।

ধ্যাত, এই লোকটাকে লুকিয়ে কিছুই করা যায় না। ঠিক ফলো করে চলে এসেছে। আমি বললাম, “তোমার জন্য কোথাও গিয়ে শান্তি নেই।”
সে হেসে বলল, “ইচ্ছে করেই অশান্তি বেছে নিয়েছ, এখন তো আর আমার কিছু করার নেই। আজীবনই এই অশান্তি ভোগ করতে হবে।”
আমি চোখ গরম করে তার দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়িতে উঠে বসলাম। বাসার সামনে নামিয়ে দিয়েই চলে গেল সে।

বাসায় ফিরেও কেমন একটা ভোতা অনুভূতি আর বিষাদে মন ছেয়ে রইল আমার। তবুও সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। মধ্যরাতে হঠাৎ কোনো কারন ছাড়াই ঘুম ভেঙ্গে গেল। হঠাৎ এরকম অস্থির কেন লাগছে, বুঝতে পারলাম না। অনেকক্ষন হাসফাস করে আবার কখন জানি ঘুমিয়ে পড়লাম।

মোবাইলে কলটা এলো পরেরদিন খুব সকালে। ফজরের নামাজ আদায় করে ব্যালকনিতে বসেছি কেবল। কলটা করেছেন রাহেলা খালা। আমি ফোন রিসিভ করে চুপ করে থাকলাম। তিনি বললেন, “গতকাল তুমি বলে গিয়েছিলে, আর যেন কখনও তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা না করা হয়। আজকের পর থেকে সত্যিই তার আর প্রয়োজন পড়বে না। তোমার মা গতকাল রাতে ঘুমের মধ্যেই মারা গেছেন। আর কখনও কেউ আমাকে বলবে না, আমার তুলন মারে নিয়ে আয় রাহেলা, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে ওরে।
আমারও তোমার কাছে আর ছুটে যেতে হবে না বারবার”
রাহেলা খালা কাঁদতে কাঁদতে লাইন কেটে দিলেন। আমিও কাঁদলাম। সজ্ঞানে যেই মায়ের একটুখানি আদরও পাইনি কখনও, তার জন্য এত কষ্ট কেন হচ্ছে? না, নিজেকে সামলাতে হবে। বাসার কাউকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না।

সকালে নাস্তার টেবিলে বসে সুলেখা আন্টিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বাবা কোথায়? ব্রেকফাস্ট করতে আসেনি কেন এখনও?”
“কী যে হয়েছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কাল রাতেও ঠিকভাবে ঘুমায়নি। বারবার বলছিল অস্থির লাগছে। আমি তো শেষে তোমাদেরও ডাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার বাবাই বারণ করলেন। রাতে ঘুম হয়নি বলে এখন ঘুমাচ্ছেন।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমার মতো বাবাও অস্থিরতায় ভুগেছে। এটা কি শুধুই কাকতালীয় নাকি অদৃশ্য কোনো টান। নাস্তা করে বাবার রুমে গেলাম। বাবা দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, “কী করছ বাবা?”
“আরে আম্মা, আসো এদিকে। মাত্রই ঘুম ভেঙ্গেছে তাই এখানে এসে একটু দাঁড়ালাম।”
আমি বাগানের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কৃষ্ণচূড়া গাছটা খুব সুন্দর লাগছে আজ দেখতে। একেবারে ফুলে ফুলে ভরে আছে। তাই না বাবা?”

“হ্যাঁ। তোমার মায়ের খুব সখ ছিল, বাগানের ওই কোনায় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ থাকবে। মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে সময় কাটাবে সে। তোমার মা আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার পরেই গাছটা লাগিয়েছিলাম আমি। ভাবলাম, সে আমার পাশে না থাকলেও কিছু একটা অন্তত থাক যেটা আমাকে তার কথা মনে করিয়ে দেবে।”

আমার দুচোখ আবার ঝাপসা হয়ে আসছে। বাবা তাকিয়ে আছে গাছটির দিকে। নিশব্দে পিছন থেকে চলে এলাম আমি। একান্তই নিজের কান্নাগুলো কাউকে আমি দেখাতে চাই না।

দিন চলে যায়। কালেন্ডারের তারিখ বদলায়। মায়ের মারা যাওয়ার একমাস কেটে গেছে। আমাদের বাড়ি এখন আত্মীয়স্বজনে গিজগিজ করছে। এর অবশ্য বিশেষ একটি কারনও রয়েছে। আর ঠিক একসপ্তাহ পরেই আমার আর আলতাফের রিসেপশন। বাবা এলাহী আয়োজন করছে। শহরের সব গণ্যমান্য ব্যক্তিকে দাওয়াত করা হয়েছে। দেখতে দেখতে সেই বিশেষ দিনটিও এসে গেল। অফিশ্যালি আমি পা রাখলাম নতুন জীবনে এবং নতুন বাড়িতে। আলতাফদের বাড়িতেও প্রচুর আত্মীয়স্বজন আজ। সবাই এসে দেখা করে যাচ্ছে আমার সাথে। প্রচন্ড ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও হাসিমুখে সবার সাথেই কথা বলতে হচ্ছে। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে যখন আমাকে রুমে দেওয়া হলো তখন রাত প্রায় একটা। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম আমি। আধো ঘুমেই টের পেলাম একজোড়া শক্ত হাত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিচ্ছে আমাকে। আমি বিচলিত হলাম না। কারন এই হাতের স্পর্শ আমার খুব পরিচিত।

চলে গেল আরও কয়েক মাস। এরমধ্যে ঘটে গেছে আরও অনেক কিছুই। আলতাফের ফুপু হঠাৎ করেই স্ট্রোক করলেন। হসপিটালাইজড করা হলো সাথে সাথেই। দুইদিন আইসিইউতে থেকে মারা গেলেন তিনি। আলতাফ ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারাদিন। ফুপুর সাথেই তাই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটত আমার।

ফুপু চলে যাওয়ার পর কেমন একটা একা একা লাগতে শুরু করল ওই বাড়িতে। একসময় তাই আমাদের বাসাতেই বেশিরভাগ সময় থাকা শুরু করলাম। সুলেখা আন্টিও খুব খুশি হলো আমাকে পেলে। আমার এবাড়িতে এসে থাকার অবশ্য আরও বিশেষ একটি কারন রয়েছে। কিছুদিন আগেই আমি জানতে পেরেছি, আমার মধ্যে আরও একজন বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। এখনও কাউকেই জানাইনি খবরটা। আলতাফ ব্যস্ততার জন্য কয়েকদিন আমার সাথে দেখা করতে আসতে পারছে না। ভেবেছি ও আসলে ওকেই আগে জানাব। তারপর অন্য সবাইকে। কিন্তু আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুই হলো না। তার আগেই প্রেগন্যান্সি টাইমের সব লক্ষন দেখা দিতে শুরু করল। সারাক্ষন ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব, খাবারে অনীহা এবং বমি। দাদি আমার এই অবস্থা দেখেই বুঝে ফেলল সব। আলতাফকেও দাদিই কল করে জানাল৷ অভিনব কায়দায় আলতাফকে এই সুখবরটা দেওয়ার সমস্ত প্লান মাঠে মারা গেল আমার।

সবাই আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল আমাকে নিয়ে। কিন্তু আমাদের হাসিখুশি ঘরটায় আবারও শোকের ছায়া নেমে এলো। সুলেখা আন্টি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ল। হসপিটালাইজড করা হলো তাকে। তিনদিন পার হয়ে গেলেও তার অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। ডাক্তার বলে দিলেন, যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকতে। আমি বুঝতে পারলাম, সেই সময়টা এসে গেছে। আমি, বাবা এবং দাদি। আমরা তিনজনেই আড়ালে কাঁদি তার জন্য। কিন্তু তার সামনে গেলে স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করি। তারপরেও সুলেখা আন্টি বুঝে গেল সব। এক পড়ন্ত বিকেলে আমাকে একা পেয়ে বলল, “সু, আমার হাতে মনেহয় খুব বেশি সময় নেই আর।”
আমি চমকে উঠে বললাম, “এসব তুমি বলবে না আর।”

“বোকা মেয়ে। যেটা হওয়ার সেটা তো হবেই।”
হাসপাতালের বেডে ধবধবে সাদা বিছানায় রাখা তার হাতের উপর কপাল ঠেকিয়ে কাঁদলাম আমি৷ সুলেখা আন্টি বলল, “তবে আমার এখন আর কোনো আফসোস নেই জানো। খুব অল্পদিনের জন্য হলেও আমি তোমার বাবার ভালোবাসা পেয়েছি, আর পাঁচ দশটা স্বামী স্ত্রীর মতো একটা স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্ক পেয়েছি। পেটে না ধরেও তোমার মত একটা মেয়ে পেয়েছি। খুব ইচ্ছে ছিল, তোমার মধ্যে যে পুচকেটা বড় হচ্ছে তাকে দেখব, কিন্তু আল্লাহ বোধহয় সেটা আমার ভাগ্যে লিখে রাখেননি।”

আমি বললাম, “তোমাকে একটা কথা বলি বলি করেও বলা হয়নি কখনও। যেদিন নদীর পাড়ে বসে তুমি তোমার জীবনের সমস্ত বেদনা নিঙড়ে দিয়েছিলে আমার সামনে, সেদিনও বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সংকোচে বলতে পারিনি। মনে হয়েছে এতগুলো বছরেও যেটা করিনি সেটা এখন করাটাও অনুচিত। তবুও আজ সব সংকোচ একপাশে ঠেলে দিয়ে বলছি, আমি কি তোমাকে একবার ‘মা’ বলে ডাকতে পারি?”
“পাগলি একটা, মাকে মা বলে ডাকার জন্য কখনও অনুমতি নিতে হয় না।”

তার সাথে কথা বলা শেষ করে বাইরে বেরিয়েই চমকে গেলাম আমি। বাবা দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশেই। তার চোখের কোনের অশ্রুকনা বলে দিল, আমাদের কথোপকথন পুরোটাই শুনেছে সে।

সুলেখা আন্টি হাসপাতালে ছিল চারদিন। তারপর আর তাকে সেখানে রাখার প্রয়োজন হলো না। শুধু হাসপাতাল না, আমাদের বাড়ি সর্বোপরি পৃথিবী থেকেই বিদায় নিল সে। দাদি আর বাবা বাচ্চাদের মত চিৎকার করে কাঁদল। কিন্তু আমি শুধু নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলাম।

বছর চলে গেল। এই এক বছরে বদলেছে অনেক কিছুই। সবচেয়ে অবাক করা যে বিষয়টা ঘটেছে সেটা হলো, তামিম ভাইয়ের সাথে তুলির বিয়ে। ফুপু নিজে তুলিদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন ওকে পুত্রবধু করার জন্য। আমরাও নিজেদের মানিয়ে নিয়েছি সময়ের সাথে সাথে। নতুন অতিথি এসেছে আমাদের জীবনে। দাদি আর আমার সময় কেটে যায় এখন তাকে নিয়েই। আমরা সবাই নিজেকে সামলে নিলেও একমাত্র বাবাই আটকে আছে অতীতে। সুলেখা আন্টিকে কবর দেওয়া হয়েছে বাগানের এককোনে। অনেকদিন আগে বাবা বাগানে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগিয়েছিল। সুলেখা আন্টি মারা যাওয়ার কয়েকদিন পর বাবা তার কবরের পাশে আবার একটি গাছ লাগাল। বেলী ফুলের গাছ।

সেদিন দেখলাম, রুমের জানালা দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে একা একাই কথা বলছে বাবা, “সময় থাকতে কেন তোমার মর্ম বুঝলাম না, এই অনুশোচনায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। প্রত্যেকটা মুহুর্তে তোমার শূন্যতা অনুভব করছি এখন। সুলেখা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? তোমাকে ছাড়া আমরা কেউ ভালো নেই।”

আমাদের দিনগুলো চলে যাচ্ছে। দৈনন্দিন কাজ, হাসি আনন্দ সবই চলছে। তারপরেও কোথাও একটা শুন্যতা লেগে আছে ঘরের আনাচে কানাচে। আমরা প্রত্যেকেই মনের মধ্যে খুব যত্নে লালন করে চলেছি একজনের স্মৃতি।
(শেষ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে