মন গহীনের শব্দ পর্ব-১০

0
247

মন গহীনের শব্দ
| ১০ |
আমি উপলব্ধি করলাম, এতগুলো বছর ধরে যে মানুষটা আমাদের পরিবারকে শুধু দিয়েই গেছে, সেই মানুষটার প্রাপ্তির ঝুলি একেবারেই শূন্য। সুলেখা আন্টির জীবনের প্রত্যেকটা কষ্টের মুহূর্ত আমি হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে পারছি। বারবার চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছি না।

সুলেখা আন্টিই কথা বললেন আবার, “সু, তোমার কাছে আমার আরও একটা আবদার আছে। আমি জানি না, আর কতদিন আল্লাহ আমার আয়ু লিখে রেখেছেন। কিন্তু যতদিনই বাঁচি, ততদিন আমি আমার সু কে হাসিখুশি দেখতে চাই ঠিক আগের মতো করে । কথা দাও, আজ থেকে আর কাঁদবে না।”
আমি হেঁচকি তুলে বললাম, “কথা দিলাম, আর কাঁদব না।”
“দেখ কান্ড। বলছ কাঁদবে না অথচ এখনও কেঁদেই যাচ্ছো। তুমি এভাবে কাঁদলে আমার আরও বেশি করে মনে পড়বে নিজের অসুস্থতার কথা। আজকের আবহাওয়াটা কী চমৎকার দেখ। কাল কী হবে না হবে সেটা না ভেবে চলো আজকের এই সময়টুকু উপভোগ করি আমরা। ওইযে সামনেই একটা ফুচকার স্টল দেখা যাচ্ছে। যাবে ওখানে?”
“চলো।”

পরের সময়টুকু আমরা আমাদের সমস্ত দুঃখ বিষাদ ভুলে গেলাম, অথবা বলা যায় ভুলে যাওয়ার অভিনয় করলাম। নিজেদের মতো করে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম।
বাসায় ফিরে আমিই সবাইকে রিপোর্টের কথাটা জানালাম। দাদি, বাবা দুজনেই হতভম্ব হয়ে শুনল আমার কথা। দাদি সব শুনে কাঁদল। বাবার চোখের কোনেও অশ্রুবিন্দু দেখলাম যেন। গুমোট একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল কিছু সময়ের ব্যবধানে। আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সুলেখা আন্টি উঠে রুমে চলে গেল। সে যাওয়ার পর আমিও চলে এলাম নিজের রুমে।

আমাদের দিনগুলো আগের মতোই চলে যাচ্ছে। বাবা রাজনীতি আর ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত, দাদি সারাক্ষন কোনো না কোনো দোষ ধরে চ্যাঁচামেচি করে যাচ্ছে। আমি ভার্সিটি জয়েন করেছি। আলতাফ আসছে মাঝে মধ্যে। সবই ঠিকঠাক চলছে তবু কোথাও যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের প্রত্যেকটা আনাচে কানাচে। এরমধ্যে অবশ্য পরিবর্তনও এসেছে অনেকটা, বিশেষ করে বাবা আর দাদির মধ্যে। দাদি এখন আর সুলেখা আন্টির সাথে রাগারাগি করে না। বাবাও অনেকটাই নমনীয়। এরমধ্যেই একদিন দেখলাম বাবা হাতে করে বেলীফুলের গাজরা নিয়ে এসেছে। বেলী সুলেখা আন্টির প্রিয় ফুল। এরপর থেকে রোজই তার প্রিয় কিছু না কিছু নিয়ে আসে বাবা। সুলেখা আন্টিকে ট্রিটমেন্টের জন্য কিছুদিন পরপরই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়। প্রথমে দুবার আমি নিয়ে গেলাম। তারপর হুট করেই একদিন বাবা বলল, “আম্মা, এখন থেকে আর ডাক্তারের কাছে তোমার যেতে হবে না। সুলেখাকে আমিই নিয়ে যাব।”
আমি সুলেখা আন্টির দিকে তাকালাম। তার চোখ ছলছল করছে।

ভার্সিটির দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছে। নিয়মিতই ক্লাসগুলো করছি। একদিন ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল সেই মহিলার সাথে। আজও নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে আছে কালো বোরখায়। এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছো তুলন মা।”
আজ আর আমি এড়িয়ে গেলাম না। বরং তার প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “আপনার নাম রাহেলা?”
তিনি চমকে উঠলেন ভীষনভাবে। কিছুক্ষন মৌন থেকে ছোট্ট করে জবাব দিলেন, “হ্যাঁ।”
“আমাকে জন্ম দিয়েছেন যে ভদ্রমহিলা, আপনিই তাহলে তার সেই বোন?”
আবারও একই জবাব, “হ্যাঁ।”
“এবার বলুন, আপনি আমার কাছে আসলে কী চান?”
“তোমার কিছুক্ষন সময় চাই, দেবে আমাকে?”
“এইযে আপনার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এতে কি সময় দেওয়া হচ্ছে না?”
“এভাবে না মা। আমার সাথে চলো একদিন। তোমাকে একজন খুব দেখতে চায়।”
“কে দেখতে চায়? আপনার সেই বোন।”

তিনি নিশ্চুপ।
আমি বললাম, “তা হঠাৎ তিনি এতদিন পর আমাকে কেন দেখতে চাইছে? তাকে এখন আর আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার বোনটিকে প্লিজ বলে দেবেন আমি তার সাথে দেখা করতে আগ্রহী নই।”

“তুলন মা, আমার কথা শোনো। জানি সে অনেক ভুল করেছে। তবুও বলছি, মৃতপ্রায় মানুষটার জন্য মনের মধ্যে এত ঘৃণা পুষে রেখ না। দয়া করে একদিন চলো আমার সাথে।”

আমি হঠাৎ করেই ধাক্কা খেলাম যেন। মৃতপ্রায় মানে? তার মানে মা কি অসুস্থ খুব। কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে খুব, কিন্তু আমি সামলে নিলাম নিজেকে। স্পষ্টভাবে তাকে জানালাম,”আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি।”
“তোমার মায়ের মতোই জেদি হয়েছ। যেতে না চাইলে আমি তো আর জোর করে নিয়ে যেতে পারব না। আমার মোবাইল নম্বরটা দিয়ে গেলাম তবুও। যদি কখনও ইচ্ছে হয়, আমাকে একটা কল কোরো শুধু। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব।”

তিনি চলে গেলেন। হাতের মুঠোয় কাগজের টুকরোটা নিয়ে কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ কাঁধে কারও স্পর্শে চমকে উঠলাম। আলতাফ কথা বলে উঠল পাশে থেকে, “কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে? সেই কখন থেকে হর্ন বাজাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছো না। গাড়ি থেকে নেমে ডাকলাম, তাও কোনো সারা নেই। ব্যাপারটা কী বলোতো?”
হাতের মুঠোয় বন্দি দুমড়ে মুচরে যাওয়া কাগজটা ব্যাগের সাইড চেম্বারে রাখতে রাখতে হেসে বললাম, “তেমন কিছু না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম আরকি।”

আলতাফ একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেল ওর বাসায়। ফুপু নাকি দুপুরে যেতে বলেছে আমাকে। বাসায় ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। সুলেখা আন্টিই দরজা খুলে দিল। তাকে দেখে আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললাম, “ও মাই গড!”
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে লজ্জা পেলো খুব। বলল, “এভাবে তাকিয়ে কী দেখছ?”
“লাল শাড়িতে তোমাকে অস্থির সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে তোমার বয়স বিশ বছর কমে গেছে।”
“ধুর, আমি এবার প্রচন্ড রেগে যাচ্ছি। তোমরা বাবা মেয়ে মিলে যা শুরু করেছ। একজন এসে শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলল, আজ এটাই পড়তে হবে।এদিকে তুমি আবার উলটাপালটা কথা বলা শুরু করেছ।”

যদিও সে মুখে রেগে যাওয়ার কথা বলছে, কিন্তু তার চেহারায় সামান্যতম রাগের আভাসটুকু নেই। বরং চঞ্চলা কিশোরী হঠাৎ লজ্জা পেলে যেমন দেখায়, এখন ঠিক তেমনই দেখাচ্ছে সুলেখা আন্টিকে। আমি বললাম, “মোটেও আমি উলটাপালটা কথা বলছি না। সত্যিই তোমাকে খুব প্রিটি লাগছে, ডিয়ার।”

“অনেক হয়েছে। এবার যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। দুপুরে তো শ্বশুরবাড়ি থেকেই খেয়ে এসেছো। বিকালের জন্য হাল্কা কিছু নাস্তা তৈরি করেছি। আমি সেগুলো রেডি করে নিয়ে আসছি। তারপর দুজনে আড্ডা দেব জমিয়ে৷”

আমি বললাম, “খাওয়া না ছাই। বদ লোকটা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল অন্য মতলবে। দিনে দুপুরে আমাকে নিয়ে দরজা আটকে দিল। ফুপুর সামনে যা একটা লজ্জায় পড়লাম, কিছুই খেতে পারলাম না। আমি পাঁচ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি, তুমি খাবার নিয়ে জলদি আমার রুমে এসো। ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে আমার।”

সুলেখা আন্টি শব্দ করে হেসে দিল। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখলাম সুলেখা আন্টি বাটিভর্তি বেগুনি, ফুলকপির চপ নিয়ে বসে আছে। খাবার পাওয়ার সাথে সাথেই হামলে পড়লাম আমি। টমেটো কেচাপে বেগুনি ডুবিয়ে কামড় দিতে দিতে বললাম, “এবার সিরিয়াসলি রান্নাটা তোমার থেকে শিখতে হবে। আমি খুব ভালো একজন গৃহীণি হতে চাই।”
সুলেখা আন্টি হাসতে হাসতে বলল, “আচ্ছা, সব শিখিয়ে দেব।”
আমি নিজ্ঞাসা করলাম, “দাদি কোথায়? ইদানিং তো বিকেলে তোমার সাথেই গল্প করে কাটায়, আজ তো দেখছি না তাকে।”

“শরীরটা বোধহয় ভালো লাগছে না। ঘুমাচ্ছে এখন। সত্যিই আজকাল সবাই খুব হাশিখুশি রাখতে চাইছে আমাকে। একদিকে অসুখটা ধরা পরে ভালোই হয়েছে বলো, অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও সবার ভালোবাসা পাচ্ছি। জানো সু, এই ভালোবাসাটুকু পাওয়ার জন্য বিয়ের পর থেকে চাতক পাখির মত অপেক্ষা করেছি আমি। কিন্তু সবার তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেয়ে একসময় নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, আমার ভাগ্যে ভালোবাসা নেই। অথচ আজ দেখ, সবাই আমাকে চোখে হারাচ্ছে। আমি খুব খুশি জানো, কিন্তু তবুও কোথাও একটা শূন্যতা আর হাহাকার। তাদের এই হঠাৎ পরিবর্তন আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, আমার জীবনের অন্তিমলগ্ন এসে গেছে।”

আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। যদিও তাকে কথা দিয়েছিলাম আর কখনও কাঁদব না। তবুও দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রু এলো আমার। সুলেখা আন্টি বললেন, “জানো সু, তোমার বাবা এখন আমাকে খুব করে বোঝার চেষ্টা করে। সময় দেয়৷ আমার সব পছন্দ অপছন্দের খেয়াল রাখে৷ এজন্য তোমাকে আমার বিশেষভাবে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ।”

আমি থতমত খেয়ে বললাম, “বাবা যেহেতু বদলে গেছে, ধন্যবাদ দিলে তাকে দেয়া উচিৎ। তাহলে আমাকে কেন ধন্যবাদ দিচ্ছ?”
“সু, আমি মানছি তুমি খুব বুদ্ধিমতী, তবে আমিও কিন্তু বোকা নই।”
আমি হেসে বললাম, “সত্যিই, মেয়েরা পৃথিবীর সবার সাথে চালাকি করলেও মায়ের কাছে ঠিক ধরা পড়ে যায়।”
সেও হাসল, “কথায় একদমই পেরে ওঠা যায় না তোমার সাথে। একেবারে বাবার মতোই হয়েছো। কথার পিঠে কথা সবসময় তৈরি করাই থাকে।”

“বাবার মেয়ে বাবার মতো হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।”
“বুঝলাম।”

আমাদের কথোপকথন চলতে থাকল। কিছুক্ষন পর হঠাৎ সুলেখা আন্টি সিরিয়াস কন্ঠে বললেন, “সু, তোমার কাছে একটা ব্যাপারে কনফেশন দেওয়ার আছে আমার।”
আমি কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করলাম, “কিসের কনফেশন?”
“বহুবছর আগে লোভে পড়ে আমি একটা অন্যায় কাজ করেছিলাম। আমি জানি, কাজটা আমার একদমই করা উচিৎ হয়নি। তবু আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। সবটা শোনার পর তুমি হয়তো রেগে যাবে আমার উপর, তবুও আজ তোমাকে আমি কথাগুলো আজ বলতে চাই।”
আমার মস্তিষ্ক তুমুল গতিতে চিন্তা করতে শুরু করল।কী এমন করেছে সুলেখা আন্টি যার জন্য আমি তার উপরে রেগে যেতে পারি।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে