মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৬

0
243

মন গহীনের শব্দ
| ৬ |
গেট থেকে বাইরে বের হয়ে রাস্তার দিকে তাকাতেই চমকে গেলাম আমি। আলতাফ ভাইয়ের সেই গাড়িটি রাস্তার অপজিট সাইডে পার্ক করা। স্বয়ং তিনিই ড্রাইভিং সিটে বসে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। সাধারন সেই চাহনি, দৃষ্টিতে কোনো কঠোরতা নেই, না আছে চেহারায় কোনো কাঠিন্য। তবু আমার ভিতর পর্যন্ত কেঁপে উঠল তার চোখের দিকে তাকিয়ে। মাথায় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আলতাফ ভাই কীভাবে জানলেন যে আমি এখানে আছি? কতটা জানেন তিনি? আমি ভদ্র মেয়েটির মতো চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই তিনি প্রথম প্রশ্নটি করলেন, “মিশন সাকসেসফুল হয়েছে?”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কিসের মিশন?”
ওপাশ থেকে আর কোনো কথা নেই। আমি বুঝতে পারলাম, পরিস্থিতি যথেষ্টই উত্তপ্ত। মিনমিন করে বললাম, “স্যরি।”
“স্যরি ফর হোয়াট!”
“আপনি তো জানেনই তুলি আমার খুব কাছের বন্ধু। সেই স্কুল থেকে বন্ধুত্বটা শুরু। স্কুলে প্রায় সবাই মায়ের ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা করত। কেমন করে যেন তাকাত আমার দিকে। একমাত্র তুলিই নিঃস্বার্থভাবে মিশত আমার সাথে। সবার আগে ওই আমার দুঃখগুলোকে আমার মতো করে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছে। ওকে বিপদ থেকে বাঁচাতে আমার এই কাজটা করতেই হলো।”

“তুমি তুলিকে হেল্প করেছ, এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার আপত্তিটা অন্য জায়গায়। একটা নিকৃষ্ট লোককে ফাঁদে ফেলার জন্য তুমি নিজেকে আকর্ষণীয়ভাবে প্রেজেন্ট করেছ তার সামনে। তুমি জানতে সে নোংরা দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকাবে, তবুও তুমি…”
পুরো কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন তিনি। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলাম। এত নিস্পৃহ শীতল কন্ঠস্বর। এ যেন আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস। তিনিই বললেন আবার, “অথচ আমাকে বললেই এর সমাধান হয়ে যেত। ওই বাজে লোকটার সামনেই তোমাকে যেতে হতো না। নাকি আমাকে আজকাল আর তোমার প্রয়োজন পড়ছে না।”
“প্লিজ, এভাবে বলবেন না। আমি আসলেই এত কিছু ভাবিনি। ভয় হচ্ছিল, যদি লোকটা তুলির চরম ক্ষতিটা করে ফেলে। তখন মাথায় যা এসেছিল তাই করেছি।”
“ওকে, আজ থেকে তুমি নিজের মর্জি মতোই থেক তাহলে।”
আমি এবার কেঁদেই ফেললাম। কাতর কন্ঠে অনুরোধ করলাম, “প্লিজ।”
আমার চোখের পানি দেখেও মন গলল না তার। বললেন, “এখন আর কেঁদে কি হবে? যা করার তা তো করেই ফেলেছ। যতবারই ভাবছি, ওই নোংরা লোকটার সামনে তুমি দিনের পর দিন গিয়েছ, ততবারই তোমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই তিনি থামিয়ে দিলেন আমাকে, “তোমার বাড়ি এসে গেছে। যাও, ভেতরে যাও।”
আমি বলতে গেলাম, “আপনি একবার…”
“আমি এখন আর কিছুই শুনতে চাইছি না। তুমি বাসার ভেতরে যাও।”
আমি মলিন মুখে গাড়ি থেকে নামলাম। ইচ্ছে করল চিৎকার করে কান্না করি। নিজের করা কাজের জন্য নিজেরই অনুশোচনা হচ্ছে এখন। ঠিকই তো, সেজেগুজে দিনের পর দিন ওই নোংরা লোকটার সামনে গিয়েছি। না জানি কত কুৎসিত চিন্তা সে মনে মনে করেছে আমাকে নিয়ে। তাকে ফাঁদে ফেলতে নিজে থেকে তার হাত অব্দি ধরেছি। সেকথা মনে হতেই শুকনো ঢোক গিললাম আমি। আমি তার হাত ধরেছিলাম সেটা আলতাফ ভাই জানতে পারলে নিশ্চিত আমাকে মেরেই ফেলবেন। এতদিন নিজের প্লান সাকসেসফুল করার জন্য এতটাই মরিয়া ছিলাম যে অন্য কিছু ভাবার অবকাশই ছিল না। কিন্তু আজ আলতাফ ভাইয়ের কথাগুলো শোনার পর কেমন একটা লাগছে। মনে হচ্ছে আবিরের নোংরা দৃষ্টি এখনও গায়ে লেগে আছে। অনেকক্ষন সময় নিয়ে গোসল করলাম আমি। সেই নোংরা দৃষ্টিকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে চাইলাম। সুলেখা আন্টি দুপুরের খাবার খেতে ডাকতে এলো রুমে। আমাকে দেখে বলল, “একি সু? তোমার চেহারা এমন লাগছে কেন? চোখও তো লাল। শরীর খারাপ করেছে?”
“না, আন্টি। তেমন কিছু না। একটু বেশি সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়েছি, তাই আরকি।”
“এটা একদমই ঠিক করোনি৷ সিজন চেঞ্জের এই সময়টাতে এমনিতেই ঠান্ডা লাগার চান্সেস বেশি থাকে। তার উপর একমাস পরেই তোমার এক্সাম। এখন এমন লং টাইম শাওয়ার নিলে জ্বর হতে পারে।”
“আর এমন করব না।”
“গুড গার্ল। খেতে এসো এখন।”
সুলেখা আন্টি চলে গেল। কাল রাত থেকে পড়াশোনা হয়নি তেমন। দুপুরের খাবার খেয়েই আজ তাই পড়তে বসে গেলাম। তবে সেটা শুধু বসে থাকাই হলো। পড়া হলো না এক অক্ষরও। হবেই বা কী করে, আবিরের ব্যাপারটা সলভ হলেও মাথার মধ্যে এখন আলতাফ ভাই গেড়ে বসেছেন। আমি পড়ার টেবিল ছেড়ে বিছানায় এসে বসলাম। একটা ফ্রেশ ঘুম প্রয়োজন এখন। তাহলে যদি চিন্তাটা কিছুটা হলেও কমে। ঘুম ভাঙল শেষ বিকালের দিকে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। সুলেখা আন্টির কাছে গিয়ে বললাম, “একমগ কফি করে দাও তো।”
“দিচ্ছি, তুমি বসো এখানে। ও, তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে। আলতাফ এসেছিল বিকালে। তোমার জন্য ব্লাক ফরেস্ট কেক আর তোমার প্রিয় চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম এনেছে। সব ফ্রিজে রাখা আছে। খেয়ে নিও।”
“আমি প্রায় দৌড়েই ফ্রিজের কাছে এলাম। ফ্রিজ থেকে কেক বের করে রুমে চলে গেলাম সোজা। সেই দুপুর থেকে ফোনটা চেক করা হয়নি। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম স্ক্রিনে সেই কাঙ্ক্ষিত মেসেজের কিছু অংশ ভাসছে। মেসেজ ওপেন করলাম।
“জানি, টেনশন করে খাওয়াদাওয়া পড়াশোনা সবই এখন লাটে উঠবে। কিন্তু সামনেই যে একটা ইম্পর্টেন্ট এক্সাম, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। তোমার সাথে আমার বোঝাপড়াটা নাহয় এক্সামের পরেই হবে। এখন যদি আর কোনো উলটাপালটা চিন্তা মাথায় এনে পড়ায় গাফিলতি করা হয়, তাহলে তার ফলাফল কিন্তু ভয়ংকর হবে।”
স্পষ্টই হুমকি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে আমি ভয় পেলাম না মোটেও। বরং আজকের পড়াটা আরও ফুরফুরে মেজাজে হলো। দেখতে দেখতে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। একসময় এক্সামও শুরু হয়ে গেল। আমি দিগ্বিদিক ভুলে শুধু প্রিপারেশন নিচ্ছি আর একের পর এক এক্সাম দিচ্ছি। অবশেষে সবগুলো এক্সাম শেষ হলো। এক্সামের পর সপ্তাহখানেক রেস্ট নিয়ে এডমিশনের প্রিপারেশন নেয়া শুরু করে দিলাম। নির্বাচনের সময়ও কাছাকাছি এসে গেছে। আলতাফ ভাইয়ের যাতায়ত বেড়েছে বাড়িতে। কিন্তু বরাবরের মতই তার আচরণ নিস্পৃহ। একবার চোখ তুলে আমার দিকে ঠিকভাবে তাকিয়েও দেখেন না। তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রোজই নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করছি। কিন্তু সবকিছুর ফলাফল শূন্য৷ তবে আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেভাবেই হোক আজ আলতাফ ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করবোই। আচ্ছা, তার প্রিয় রঙের শাড়ি পড়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কেমন হয়? নিশ্চই চমকে যাবেন আমাকে দেখে। আমি আলমারি ঘেঁটে আমার প্রিয় সাদা শাড়িটা বের করলাম। সাদা সিল্ক কাপরের উপর সুক্ষ্ণ বুননে তৈরি করা হয়েছে শাড়িটা। খুব যত্ন করে শাড়িটা পড়লাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আজ প্রিয় এবং অপ্রিয়র কম্বিনেশনে সাজব। আলতাফ ভাইয়ের সবচেয়ে পছন্দের রং সাদা হলেও সবচেয়ে অপছন্দের রং লাল। ব্লাড রেড কালারের লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট রাঙালাম। তারপর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আলতাফ ভাইয়ের গাড়ি গেটের মধ্যে ঢুকতে দেখেই দৌড়ে ড্রয়িং রুমের দিকে গেলাম আমি। তিনি ঘরে ঢুকলেন ফোন স্ক্রল করতে করতে। একবার শুধু চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। তারপর আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন মোবাইলের দিকে। ঠিক যেন আমার কোনো অস্তিত্বই নেই, সেভাবে আমাকে এড়িয়ে সোফায় গিয়ে বসলেন। রাগে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল। আমি তার মুখোমুখি গিয়ে বসলাম। তিনি মোবাইলের দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু বলবে?”
“না।”
“তাহলে এখানে বসে আছো কেন?”
“কিছু না বললে এখানে বসা যাবে না?”
“না বসাটাই বোধহয় ভালো। একটু পরে চাচা আসবেন এখানে, দরকারি কথা বলতে।”
“আপনাদের সেই দরকারি কথায় আমার থাকা কি বারণ?”
“বারণ নয় ঠিক, তবে সেখানে নিজেকে মানানসই মনে হবে না তোমার। বোরিং লাগবে।”
“তবুও আমি থাকব।”
“অ্যাজ ইওর উইশ।”
আমার রাগের পারদ বেড়েই যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কথায়ও সেটা প্রকাশ পাচ্ছে স্পষ্ট৷ অথচ তিনি একেবারে নির্লিপ্ত। আমি বললাম, “কেউ সুন্দর করে সাজলে তাকে মিনিমাম কমপ্লিমেন্টটুকু দিতে হয়৷ এই ম্যানারটুকুও অন্তত দেখানো যেত।”
“এইযে তুমি সেজেছ, এটা যেমন তোমার ইচ্ছে। ঠিক তেমনি কমপ্লিমেন্ট দেব কী দেব না সেটাও আমার ইচ্ছে। আর তাছাড়া আমি তো সবসময়ই ম্যানারলেস। তুমি বরং এই রূপে তোমার আবির স্যারের কাছে চলে যাও। তিনি তোমাকে দেখে খুব সুন্দর সুন্দর কমপ্লিমেন্ট দিতে পারবেন। এর আগেও তো তুমি এরকমভাবে নিজেকে তার সামনে প্রেজেন্ট করেছিলে, তাই না? ভালো কথা, আজ হঠাৎ এতো সাজ কেন? আমাকেও কি তার মত ইমপ্রেস করতে চাইছ? এভাবে এখন পর্যন্ত কজনকে সিডিউস করেছ বলোতো?”
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলাম তার কথা শুনে। তারমানে এখনও সেই আবির স্যারের বিষয়টা নিয়ে রেগে আছেন উনি। এত ঠান্ডা গলাতেও এরকম ভাবে কাউকে অপমান করা যায়? আমার দুচোখ ছাপিয়ে জল এলো। আজ ইনডিরেক্টলি আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তিনি। অথচ এই কঠিন মানুষটার সাথে একটু কথা বলার জন্য আমি সারাক্ষন ছটফট করি। একবার তাকে দেখার জন্য সারাক্ষন হাপিত্যেশ করে বসে থাকি। আমি একছুটে রুমে চলে গেলাম। শাড়ি, অর্নামেন্টস সব খুলে বিছানায় ছুরে মারলাম। রাগে জেদে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে বসে থাকলাম ঘন্টার পর ঘন্টা। তার ফলও অবশ্য হাতেনাতেই পেলাম। শেষ রাতের দিকে প্রচন্ড শীতে কাঁপুনি উঠে গেল শরীরে। বুঝতে পারলাম জ্বর আসছে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে