মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৪

0
249

মন গহীনের শব্দ
| ৪ |
আমার মনে হলো, মা আসলে খুব ভাগ্যবতী। ভাগ্যবতী বলেই এরকম নিকৃষ্ট কাজ করার পরেও সবাই তাকে এত ভালোবাসে।

দাদি বলতে শুরু করলেন, “হুট করেই একদিন তোর মারে বিয়া কইরা নিয়া আসলো তোর বাপে। বিয়াটা প্রথমে মানতেই পারলাম না। আমার চান্দের মত পোলা, এমন কালো মেয়ে বিয়া কইরা আনছে এটাই মানতে পারতাম না। অভাবের সংসার ছিল তখন তোর বাপের। সখ আহ্লাদ তো দূরের কথা, তিনবেলা খাবার যোগাইতেই কষ্ট হয়ে যাইতো। তার উপর সারাক্ষন আমি তোর মায়েরে কথা শুনাইতাম, খারাপ ব্যবহার করতাম। তারপরেও তোর মা কোনোদিনও টু শব্দ করে নাই। তোর বাপে মাঝেমধ্যে মানা করত তোর মায়ের সাথে এমন করতে। কিন্তু তোর মা হেসে বলত, মায়েরা এমন একটু বলে। মায়েদের শাসনের মধ্যেও ভালোবাসা থাকে। সারাদিন খারাপ ব্যাবহার করতে করতে কখন যে তোর মা রে ভালোবেসে ফেললাম, নিজেও জানি না। একসময় আমরা শাশুড়ি বউমা হইয়া উঠলাম প্রাণের সখি। সংসারে টাকা পয়সার অভাব থাকলেও সুখ শান্তির কোনো অভাব ছিল না আমার। টাকার অভাবও বেশিদিন রইল না তোর বাপের। ধারদেনা কইরা অল্প পুঁজি নিয়া ব্যাবসা শুরু করছিল, তারপরে কয়েক বছরের মধ্যেই লাখ লাখ টাকার মালিক হইয়া গেল। বাড়ি, গাড়ী সবই হইল। নতুন বাড়িতে আসার কয়দিনের মধ্যেই তোর মায় পোয়াতি হইল। জানোস ময়না, দিনগুলা যে কী আনন্দের ছিলো। কয়েকমাস পরে তুই জন্মাইলি। তোর বাপে সারাদিন ব্যস্ত থাকতো ব্যবসা নিয়া। বাড়িতে থাকতাম আমরা তিন জন। তোর বয়স যখন দুই বছর, তখন আসলো তোর মায়ের দুঃসম্পর্কের এক এতিম বিধবা বোন। ওর নাম ছিল রাহেলা। সেও তোরে খুব ভালোবাসতো। আমার সেই সুখের দিনগুলা আর বেশিদিন রইল নারে বোন। তোর বয়স তখন চার বছর। আমার আর রাহেলার কাছে তোরে রাইখা তোর মায় বাসা থেকে বের হইল একদিন। বলল, তার কী একটা জানি দরকার আছে। সারাদিন পার হয়ে গেল, কিন্তু সে ফিরল না। তোর বাপে অফিস থেকে বাসায় ফিরে এইসব শুনে পাগলের মত হয়ে গেল। সারারাত ধরেও তোর মাকে খুঁজে পাইলো না। আমার শক্ত মনের পোলাডাও সেদিন হাউমাউ কইরা কাঁদল তোরে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। তারপরে থাইমা গেল হঠাৎ। তোর মায়েরেও খোঁজা বন্ধ কইরা দিল। আমি আর রাহেলা অনেকবার বললাম, আরেকবার খুঁজে দেখতে কিন্তু তোর বাপে কোনো কথাই শুনল না। সেই থেকে পোলাডা আমার একেবারে অন্যরকম হইয়া গেল। একমাত্র তুই ছাড়া কারো সাথে ঠিকভাবে কথা পর্যন্ত বলত না। শুধু তোর মায়ের রুমটার মধ্যে ঢুইকা কাঁদতো সারাক্ষন। ব্যাবসা বানিজ্যও দিনদিন খারাপ হইতেছিল। এসব দেখে আত্মীয়স্বজনেরা আবার বিয়ে করানোর পরামর্শ দিল। কিন্তু কিছুতেই তোর বাপে আর রাজি হয় না। বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন তোর মা আর ফিরল না, তখন একরকম জোর কইরাই তোর বাপেরে বিয়ে করাইলাম। সুলেখা এই বাড়িতে আসার পর ভাবলাম এইবার আমার পোলা ঠিক হবে। কিন্তু কিছুই পরিবর্তন হইল না আর। সুলেখা সবরকম চেষ্টাই করল, কিন্তু কোনোটাতেই সফল হইল না। একসময় সুলেখার উপরে বিরক্তি আইসা গেল। ওরে দোষ দেওয়া শুরু করলাম। বউ আনার পরেও কেন আমার পোলা মনমরা হইয়া থাকব? এই নিয়া কথা শোনাতে শুরু করলাম। আমি জানতাম, সুলেখার কোনো দোষ নাই। তবু কেন জানি ওরে ভালো লাগতো না আমার। সুলেখারে নিজে পছন্দ করে আনলেও তোর মায়ের জায়গায় বসাইতে পারতাম না কিছুতেই। আমি জানি, দিনের পর দিন সুলেখার প্রতি অন্যায় হয়েই যাইতেছে। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে বদলাইতে পারি না তবুও।”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জড়িয়ে ধরলাম দাদিকে। মনে মনে মাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “আমাদের পুরো পরিবারটাকে তুমি এলোমেলো করে দিলে মা। অথচ তুমি চাইলেই খুব সুখী একটা পরিবার হতে পারতাম আমরা।” আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন জানি ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালের নাস্তা করে রেডি হয়ে নিলাম। আজ বাইরে তামিম ভাইয়ের সাথে দেখা করার কথা। তামিম ভাই হলো আমার একমাত্র ফুপুর ছেলে। তার অবশ্য আরো একটা পরিচয় আছে। তামিম ভাই একজন নামকরা হার্টের ডাক্তার। ডাক্তার হিসেবে এই শহরে তার যথেষ্ট নামডাক রয়েছে। তামিম ভাই অবশ্য আরো একটা কারনে বিখ্যাত, তবে সেটা শুধু সুন্দরী মেয়েদের কাছে। তার একটা মুচকি হাসিই শত রমণীর হৃদয়ে ঝড় তোলার জন্য যথেষ্ট।

ফুপুর বাসা কাছাকাছি হওয়া সত্বেও তামিম ভাইয়ের সাথে আজ রেস্টুরেন্টে দেখা করতে হচ্ছে। এর পিছনেও অবশ্য আরও একটা বিশেষ কারন রয়েছে। এক বছর আগে ফুপু তার পুত্রবধূ করার জন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন বাবার কাছে। বাবা পুরো সিদ্ধান্তটাই আমার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি রিজেক্ট করে দেওয়ায় ওখানেই ব্যাপারটা ফুলস্টপ করে দিতে হয়েছিল তাদের। আমার মতো একরত্তি মেয়ে তার ডাক্তার ছেলেকে রিজেক্ট করেছে, এটা ফুপু কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। সেই থেকে আমাদের বাড়িতে তার পা রাখা বন্ধ। আমি যদিও সেই ঘটনার পর কয়েকবার গিয়েছিলাম তার বাসায়। কিন্তু প্রত্যেকবারই তার সেই পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটার কারণে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তামিম ভাই অবশ্য এসব বিষয়ে একেবারেই নিরুত্তাপ ছিল। আমার হ্যাঁ বা না কোনোটাতেই তার মাথাব্যাথা ছিল না। তাই ফুপুর সাথে সম্পর্কটা ঠিক না হলেও তামিম ভাইয়ের সাথে সেটা আগের মতই রয়ে গেছে।

রেস্টুরেন্টে ঢুকে প্রথমেই তামিম ভাইয়ের দিকে চোখ গেল আমার। ভ্রু কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। আমি এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললাম, “স্যরি, একটু লেট হয়ে গেল।”
“ফর্মালিটি ছেড়ে কাজের কথা বল। আমি অনেক ব্যস্ত আজ।”
“ব্যস্ত কেন? তুমি তো বলেছিলে, আজ তোমার অফ ডে।”
“অফ ডে গুলোতেই ব্যস্ততা আরও বেশি থাকে আমার। আম্মার ঠিক করা তেইশ নম্বর পাত্রীটির সাথে আজ দেখা করতে হবে। দেখছিস না, কেমন সেজেগুজে বের হয়েছি। আম্মার মতে আগের বাইশ জন রূপে গুনে এই মেয়ের পায়ের নখেরও যোগ্য নয়।”

আমি হতাশ হয়ে বললাম, “বুঝলাম না, ফুপু সুন্দরী বউয়ের জন্যে এত পাগল হয়ে আছে কেন?”

“কারনটা তুই নিজেই। এখনও সেই পুরোনো ইগো নিয়েই বসে আছে। যেভাবেই হোক, তোর চেয়ে সুন্দর মেয়েকেই তার ছেলের বউ করে আনতে হবে। এবারের মেয়েটা তোকে টেক্কা দেওয়ার জন্য একেবারে পার্ফেক্ট। আম্মা নিজে গিয়ে দেখে এসেছে মেয়েকে। মেয়ের চোখ দেখতে একেবারে ঐশ্বরিয়ার চোখের মত। আর হাসি দেখতে অবিকল দিপিকা পাড়ুকোনের হাসির মত। বলতে পারিস, একজনের মধ্যেই বলিউডের সব নায়িকাদের গুন বিদ্যমান।”

তামিম ভাইয়ের বর্ণনার ফিরিস্তি শুনে আমি ফিক করে হেসে দিলাম। সে চোখ রাঙিয়ে বলল, “হাসছিস কেন? আমি কি হাসির মত কিছু বললাম?”
“একদমই না। হাসির মত কিছু বলনি। এখন আমরা কাজের কথায় আসি।”
“হ্যা, বল এবার। এত জরুরি তলব কেন?”

আমি পুরো ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বললাম। পরবর্তী ঘন্টাখানেকে একটা চমৎকার প্লানও বানিয়ে ফেললাম। কাজ শেষ করে আমি বললাম, “তোমার মুল্যবান সময়টুকু আমাকে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। হবু ভাবীর সাথে মিট করার সময় ও তো হয়ে এল তোমার। আসছি তাহলে।”
“এখনই হবু ভাবি বলছিস কেন? নাও তো হতে পারে।”
“তুমি চাইলেই হবে। প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো খুঁত ধরে রিজেক্ট করে দাও মেয়েগুলোকে। এবার অন্তত এটা করো না।”
“ধ্যাত, পছন্দ না হলে করবো টা কী? আচ্ছা সু, কখনও জানতে চাইনি এর আগে তবে আজ জিজ্ঞাসা করছি, আমাকে কেন রিজেক্ট করেছিলি তুই?”

“তোমাকে রিজেক্ট করার দুটি কারন ছিল৷ প্রথমত, তুমি সুন্দর। যেখানে যাও সেখানেই কোনো না কোনো মেয়ে তোমার সাথে ফেবিকলের মত চিপকে থাকে। তোমাকে বিয়ে করলে বিয়ের পরে আমার ইনসিকিউরিটিতে ভুগতে হবে। এই বুঝি কোনো মেয়ে আমার বরকে প্রপোজ করে ফেলল। এই টেনশন নিয়ে আমার পক্ষে চলা অসম্ভব। তারচেয়ে বরং আমি গড়পড়তা চেহারার কাউকে বিয়ে করব। যাকে নিয়ে মেয়েরা টানাহেঁচড়া করবে না। তোমাকে বিয়ে না করার দ্বিতীয় কারনটা কিছুটা হাস্যকর, তবুও বলছি। এটার মেইন পয়েন্ট ওই একই। তুমি সুন্দর। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল, সুন্দর একটা ছেলেকে রিজেক্ট করব। তোমাকে দিয়েই সেই ইচ্ছেটা পূরণ করলাম।”

তামিম ভাই কিছুক্ষন হতাশ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “সু রে, তোর রিজেক্ট করার কারন শুনে রাগ করব নাকি সুন্দর বলে প্রশংসা করেছিস বলে খুশি হব সেটাই বুঝতে পারছি না।”
“তুমি বসে বসে ভাবতে থাকো। আমি আসছি।”

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে রিকশার জন্য দাঁড়ালাম। তার প্রায় সাথে সাথেই গাড়িটা এসে একেবারে সামনে থামল। এই গাড়িটা আমার পরিচিত। গাড়ি থেকে নামল আলতাফ ভাই। আলতাফ ভাই হলো বাবার বাল্যকালের বন্ধুপুত্র। একইসাথে বাবার ডানহাত। আলতাফ ভাইয়ের বাবা-মা অনেক আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। তখন সম্ভবত তার বয়স পনের-ষোল হবে। আলতাফ ভাইয়ের বাবা মারা যাওয়ার আগে তার দায়িত্ব বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সম্ভবত নিজের বিশাল প্রপার্টি এবং ছেলের দায়িত্ব নিজের কোনো আত্মীয়স্বজনের কাছে দিয়ে যেতে ভরসা পাননি। সেই থেকেই আমাদের বাসায় আলতাফ ভাইয়ের অবাধ যাতায়ত।

আলতাফ ভাই আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার আলতাফ ভাই, আপনি এখানে?”

“চাচা নিতে পাঠালেন তোমাকে। তুমি গাড়ি নিয়ে বের হওনি শুনেছেন, তাই খুব দুশ্চিন্তা করছেন। চলো, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমার আবার অফিস যেতে হবে।”

আমি বললাম, “শুধু বাবা চিন্তা করছে? আর কেউ করছে না?”
তিনি নিশব্দে হাসলেন।আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। তারপর আলতাফ ভাইকে বললাম, “আগে সামনের শপিং মলটায় চলুন, আমার কিছু কেনাকাটা আছে।”
“ওকে।”

প্রায় দুই ঘন্টার মত চলে গেল শপিংয়ে। শপিং শেষে গাড়িতে উঠে আমি বললাম, “আলতাফ ভাই, পুরো শপিং মলে আপনি আমার পিছনে যেভাবে ঘুরেছেন, তাতে আপনাকে এতক্ষন আমার বডিগার্ডের মতো লাগছিল।”
আবারও হাসলেন তিনি। বাসার সামনে এসে গাড়ি থামল। আমি ইচ্ছে করেই একটা শপিং ব্যাগ গাড়ির মধ্যে রেখে নেমে গেলাম।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে