মন গহীনের শব্দ পর্ব-০৩

0
265

মন গহীনের শব্দ
| ৩ |
বাসার গলি থেকে বের হয়ে কিছুদূর এগিয়ে মেইন রোডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। রিকশার খোঁজে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিলাম, ঠিক তখনই আপাদমস্তক কালো কাপরে আবৃত একজন মহিলা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

অনেকদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় এই মহিলার সাথে আমার দেখা হচ্ছে। তিনি নিজেই সম্ভবত আমাকে ফলো করছেন। প্রত্যেকবার আমার সাথে দেখা হলে সেই একই প্রশ্ন করেন তিনি, “কেমন আছ, মা?”

প্রথমে মনে হতো তিনি নিশ্চই বাবার শত্রুপক্ষের কেউ যে আমার ক্ষতি করতে চায়। কিন্তু যতবার তার চোখের দিকে তাকাতাম ততবার নিজের ভাবনাকে নিজের কাছেই ভুল মনে হতো। এমন দরদ ভরা কন্ঠ আর মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে তার পক্ষে আমার ক্ষতি করা কি আদৌ সম্ভব? অন্যান্য দিনের মত আজও সেই একই প্রশ্ন। এর আগে দায়সারা জবাব দিয়ে সরে গেলেও আজ আর তা করলাম না৷ বরং হেসে বললাম, “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো আছি, মা।”

আমি কিছুটা কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম, “আজ আমি একেবারে নতুন একটা বোরখা পড়ে আছি। শুধু চোখদুটোই দেখা যাচ্ছে আমার। তারপরেও আপনি আমাকে কীভাবে চিনলেন?”
“তোমার চোখ দেখেই তো চিনলাম। আমার তুলন মায়ের চোখ চিনতে আমার কখনও ভুল হতেই পারে না। এই চোখ যে আমার খুব পরিচিত।”

আমি চমকে উঠলাম তার কথা শুনে। দাদি বলতেন, গায়ের রং আর চেহারা বাবার মত পেলেও আমার চোখ একেবারে আমার মায়ের মতো। এমনকি আমার তুলন নামটাও মায়ের দেওয়া। মা চলে যাওয়ার পর সুলেখা আন্টি আমাকে নিজের মেয়ের মতই আগলে নিয়েছিলেন। তার উদ্যোগেই আমার তুলন নাম বাদ দিয়ে তার নামের সাথে মিলিয়ে নতুন করে রাখা হয়েছিল সুজাতা। নিজের এই বাতিল হয়ে যাওয়া নাম টা অনেকদিন পরে কারো মুখে শুনলাম। মুহুর্তেই আমার মনটা বিষিয়ে উঠল। তার মানে এই মহিলাটি মায়ের পরিচিত।

আমি কঠিন গলায় তাকে বললাম, “আপনি আর কখনও আমার সামনে আসবেন না।”
তারপর তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। পিছন থেকে তিনি কথা বলে চলেছেন, “তোমাকে একজন খুব দেখতে চায়, একদিন আমার সাথে যাবে, মা?”

আমি তার কথার কোনো জবাব না দিয়েই রিকশায় উঠে বসলাম। তুলিদের বাড়িতে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত আমার কানে তার বলা শেষ কথাগুলো বাজতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে বলতে থাকলাম, “আমি কারও সাথে দেখা করতে চাই না।”

তুলিদের বাসায় পৌঁছে কলিং বেল চাপলাম। দরজা খুলে দিল তুলির বড় বোন। তুলি ওর রুমেই শুয়ে ছিল। তুলিকে দেখে আমি আবার চমকালাম। গত কয়েকদিনে তুলির ওজন কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে একটা মেয়ের মনের অবস্থা ঠিক কেমন হতে পারে, সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছিলাম। ভুল মানুষকে ভালোবেসে এবং অন্ধের মতো বিশ্বাস করে তার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার মত মারাত্মক ভুলটা করেছে তুলি।

আমি তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তুলি আমকে জাপটে ধরে শব্দ করে কাঁদল। তারপর একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল।

আমি বললাম, “নিজেকে শক্ত কর তুলি।”

“কেন যে তোর কথা শুনলাম না। কাজিনের বার্থডে পার্টিতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল ওর সাথে। গিটারে সুর তুলে আমার দিকে পুরোটা সময় তাকিয়ে ও গাইল, ‘ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় নয়।’ জানিস সেদিন কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। চোখে তখন রঙিন চশমা। সেদিন এই গানের প্রত্যেকটা লাইনকে মনে হলো বেদবাক্য। তাই ও প্রপোজ করার সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম সেদিন। বোকার মত নিজের দুর্বলতাগুলো একের পর এক প্রকাশ করতে থাকলাম ওর কাছে। তখন তো আর জানতাম না, ওটা যে একটা মানুষের মুখোশ পড়া অমানুষ। ওর সাথে যতক্ষন থাকতাম ততক্ষনই নানা অজুহাতে আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করত। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার চেহারা আর শরীরের সৌন্দর্য বর্ণনা করত। আর আমিও এমন গাধা ছিলাম, ওর ঐ কথাগুলোকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ মনে করতাম। যখন ওর সাথে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলাম, তখনই শুরু করল ইমোশোনাল ব্লাকমেইল। তাকে সত্যিকারের ভালোবাসি কি না সেই পরীক্ষা দিতে হলো আমাকে। বন্ধ রুমের মধ্যে আমাকে নিরাবরণ করতে করতে ও বলেছিল, -এইতো জান, আর কিছুদিন পরেই বিয়ে করব আমরা।
আমিও তখন রঙিন স্বপ্ন দেখছিলাম। টানা তিন ঘন্টা পরে যখন আমরা রুম থেকে বের হলাম, তখন বাইরের রুমে বসা ওর বন্ধুটি মিটিমিটি হাসছিল। ওই মুহুর্তে হঠাৎ করেই প্রথমবার আমার মনে হলো, আমি হয়তো ভুল করে ফেলেছি৷ তারপরে কিছুদিন পরপরই ওর ডাকে সারা দিতে হতো আমার। আস্তে আস্তে সংশয় বাড়তে লাগল আমার। একসময় বললাম বিয়ের আগে এভাবে আর সম্ভব না। সেদিনই ওর আসল রূপটা আমার সামনে এলো। নিজের স্মার্টফোন বের করে একের পর এক ভিডিও দেখিয়ে যাচ্ছিল আমাকে। ওর সাথে আমি যে কয়দিন ইন্টিমেট হয়েছি, তার সব ভিডিও রেখেছে ও। ওর কথা যতবারই তোকে বলেছি ততবারই তুই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিস। তুই ওকে দেখে অনেকবার বলেছিলি, ওকে তোর সুবিধার মনে হচ্ছে না। আমি বিরক্ত হওয়া সত্বেও তুই বারবার বোঝাতে চাইতি আমাকে। শেষে তোর সাথেও একচোট হয়ে গেল এসব নিয়ে। আমার এখনও বিশ্বাস হয় না যে এই জঘন্য কাজগুলো আমি করেছি। সেদিন যখন বাসায় এসে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে গেল, তখন আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। তারপর থেকে বাবা মা কেউ আমার সাথে কথা বলে না। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে সু। তুই কি আমাকে একটু বিষ এনে দিতে পারবি?”

আমি আর কোনো সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম না ওকে। এই পরিস্থিতিতে কোনো সান্ত্বনাতেই মনকে বোঝানো যায় না।

তুলির বাসা থেকে ফেরার সময় সারাটা পথ আমি ভাবতে ভাবতে এলাম। আমি নিজেও কোনো ভুল বা অন্যায় করছি নাতো? নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলাম, “না, আমি যা করছি ঠিকই করছি।”

এরমধ্যে চলে গেছে আরও ছয়দিন। এই ছয়দিনে আবির স্যারের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকটাই গভীর হয়েছে। সন্ধার পরের দেড় দুই ঘন্টা আমরা একেবারেই নিজেদের মত করে সময় কাটাই।

এই ছয় দিনে অবশ্য আরও একটা ব্যাপার ঘটেছে। দাদি এবার সিরিয়াসলি রাগ করেছে। সেই যে সাতদিন আগে নিজেকে ঘরবন্দি করেছে, তারপরে একবারের জন্যও নিজের রুম থেকে বের হয়নি। প্রত্যেক বেলার খাবার রুনি গিয়ে তার রুমে দিয়ে আসে। এমনকি রুনি ছাড়া বাকী সবার সাথে তিনি কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছেন। বাবা, আমি এবং সুলেখা আন্টি প্রত্যেকদিনই তার রুমে গিয়ে নানা কথা বলে তার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ।

আজকের অবশ্য মনে মনে অন্য ছক কষেছি আমি। দুপুরের দিকে কথা বলার জন্য দাদির রুমে গেলাম আজ। তার প্রায় সাথে সাথেই রুনি এলো তার দুপুরের খাবার নিয়ে। দাদি কিছুক্ষন আমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থেকে অন্য দিকে ঘুরে বসলেন। রুনিও আয়েশ করে বসল খাটের পাশে। আমার আর দাদির কথোপকথন শোনার জন্য প্রবল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে। আমি রুনিকে ধমক দিয়ে বললাম, “খাবার দেয়া শেষ। এখনও এখানে কী করছিস তুই? বের হ এখনই।”
রুনি হতাশ হয়ে রুম ছেড়ে গেল। আমি দাদিকে বললাম, “তুমি ওদিক তাকিয়ে আছো কেন? আমার দিকে তাকাও।”

দাদি নড়েচড়ে আরো শক্ত হয়ে বসল। কিন্তু একবারও আমার দিকে তাকাল না। আম কঠিন গলায় বললাম, “তুমি যদি ভেবে থাকো যে আমি তোমার রাগ ভাঙ্গাতে এসেছি, তাহলে তুমি ভুল ভাবছ। আমি আজ শুধু আমার সিদ্ধান্ত জানাতে এসেছি, আজ যদি তুমি আমার সাথে কথা না বলো, তাহলে কাল সকালে আমার দুচোখ যেদিকে যায় আমি সেদিকেই চলে যাব। তখন আর হাজার বার ডাকলেও ফিরব না। শোনো বুড়ি, আমি কিন্তু তোমারই নাতনি। যা বলেছি তাই করব কিন্তু।”

কথাগুলো বলেই রুম থেকে বের হয়ে এলাম আমি। দাদির সাথে নরম গলায় কথা বললেই আরও পেয়ে বসে। সমানে সমানে তেজ দেখিয়েই জব্দ করতে হবে একে। রেগে থাকলেও দাদির সবচেয়ে দুর্বলতা হলাম আমি। আজ যেটুকু ডোজ দিয়েছি আশা করি সেটুকুতেই কাজ হয়ে যাবে।

দাদির রুম থেকে বের হয়ে ফুরফুরে মেজাজে খেতে বসলাম আমি। সন্ধ্যার পরে আবির স্যারের সাথে সময়টুকুও ভালো কাটল আজ। পড়াশোনার চাপে আজকাল সুলেখা আন্টির সাথে কথা হয় না তেমন। তাই স্যার চলে যাওয়ার পর আজ সুলেখা আন্টিকে সময় দিলাম ঘন্টাখানেক। তারপর রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষন পড়ার পর দরজা খোলা রেখেই ঘুমাতে গেলাম। ঘুমের ভান করে কিছুক্ষন শুয়ে থাকার পরেই পাশে দাদির উপস্থিতি টের পেলাম। আমি চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে রইলাম। দাদি কিছুক্ষন অপেক্ষা করে প্রশ্ন করলেন, “ও ময়না, ঘুমাইছোস?”
আমি কোনো জবাব দিলাম না। দাদি আবার কথা বললেন, “আমি ভালো কইরাই জানি যে তুই ঘুমাসনাই। চুপ করে থাইকা আর ঢং করিস না।”

আমি বললাম, “তোমার সাথে আমার কথা নেই। না হয় রাগের মাথায় দুটো কথা শুনিয়েছি তোমাকে। তাই বলে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবে তুমি?”

“রাগ করিস না বোন, মাথাটা ঠিক ছিল না সেদিন। রাতেই তোর মাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম। হাসতে হাসতে বলল,- আম্মা অনেকদিন হয় আপনাকে দেখি না, তাই আসলাম। আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিন তো। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তারপরেই তোর কান্না করল। আমারে জিজ্ঞাসা করল, -আমারে আপনারা কীভাবে ভুলে গেলেন। তখনই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তোর মায়ের সেই দুঃখী চেহারা মনে পড়ছিল বারবার।। তারমধ্যেই ওই ন/টী বেডি পিঠা নিয়া ঢং করতে আসলো।”

“দাদি, সুলেখা আন্টিকে তুমি এত অপছন্দ কেন করো? আমি বুঝি মায়ের জন্য তোমার মনে এখনও একটা সফট কর্নার আছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক, তোমাদের স্নেহ ভালোবাসার কোনো মূল্য না দিয়ে জঘন্য ভাবে এই বাড়ি ছেড়েছিলেন তিনি। স্বামী, শাশুড়ি তো দূর, চার বছরের অবুঝ মেয়েটির কথাও ভাবেনি সে। তারপরেও তার প্রতি তোমার এত মায়া। আর সুলেখা আন্টিকে দেখো, নিজের সব সখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে ছোট থেকে বড় করেছে আমাকে। কখনও মায়ের অভাবটুকু বুঝতে দেয়নি। তারপরেও কেন তার সাথে একটু ভালো করে কথা বলো না তুমি?”

দাদি নিশ্চুপ। আমি আরও কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ নাক টানার আওয়াজ এল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম, দাদি কাঁদছেন। সাথে আরও বুঝলাম, এই কান্নাটা মায়ের জন্যই। আমার মনে হলো, মা আসলে খুব ভাগ্যবতী। ভাগ্যবতী বলেই এরকম নিকৃষ্ট কাজ করার পরেও সবাই তাকে এত ভালোবাসে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)

#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে