ফারাহ পর্ব-০৪

0
1386

#ফারাহ
#পর্ব:৪
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৭,
“ফারাহ চলে গেছে দাদী?”

আদিবা বেগম শুয়ে ছিলেন নিজের ঘরে। সজীব এসে দাদীর শিয়রে বসে প্রশ্নটা করে। খেয়েদেয়ে বিকালের আগে আগে দম নিচ্ছিলেন আদিবা বেগম। সজীবের গলার স্বর শুনে চোখ খুলে তাকালেন। শিয়রে সজীবকে দেখে বললেন,

“হ দাদুভাই। ফারাহরে আদিব আইসা নিয়ে গেছে। তুই তো বাড়িতে আছিলি না৷ তাই দেখোস নাই।”

“কখন গেলো দাদী?”

“তুই যখন মাঠে গেলি, তহনই আইসা নিয়ে গেছে।”

“ওহ।”

সজীব নিঃশব্দে উঠে চলে গেলো। আদিবা বেগম আবার চোখ বুজলেন বয়স তো কম হলো না। এখন শরীরে অসুখের শেষ নেই৷ কোমড়ের ব্যথায় উঠতে পারেন না। নড়াচড়া করাও কঠিন উনার পক্ষে৷ আজিমা বেগম শাশুড়ির জন্য তেল গরম করে নিয়ে উনার ঘরে আসলেন। এসে শাশুড়িকে ডেকে বললেন,

“মা আপনার জন্য তেল গরম করে এনেছিলাম। একটু উপুর হয়ে শুয়ে পরুন। আমি মালিশ করে দিই?”

আদুবা বেগম ছেলের বউয়ের কথা শুনে ওভাবেই শুয়ে পরলেন। আজিমা বেগম উনার কোমড়ে তেল মালিশ করায় মনোযোগ দিলেন। তারমাঝেই আদিবা বেগম বললেন,

” বউমা কিছু মনে না করলে তোমারে একখান কথা বলতাম।”

আজিমা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

“আমায় কি এমন বলবেন আম্মা? যে আমার অনুমতি নিতে হচ্ছে! আপনি বলুন না! এভাবে বলে আমায় লজ্জায় ফেলবেন না।”

“ফারাহ কে তোমার কাছে কেমন লাগে বউমা?”

“কেমন লাগবে মা? ভালোই তো আছে। শুধু জিদটা বেশি। তাছাড়া সুন্দরী, আচার-ব্যবহার সবই সুন্দর।”

“আমি ওভাবে কথাটা বুঝাইনি।”

“তাহলে কি বুঝিয়েছেন মা?”

আদিবা বেগম এবার বিছানায় দুহাত ভর দিয়ে উঠে বসলেন। আজিমা বেগম শাশুড়ি কে উঠতে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলেন। আদিবা বেগম বউমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“সজীবের বউ হিসেবে কেমন লাগবে ওকে?”

আজিমা বেগম অবাক হোন আদিবা বেগমের কথায়। উনু চমকে বলেন,

“এটা আপনি কি বলছেন মা? এটা কি করে সম্ভব? ওরা ভাই বোন তো!”

“ভাইবোন কিন্তু আওন তো নয়। আর মামাতো ফুফাতো ভাইবোনদের মাঝে বিয়ে জায়েজ আছে৷ সমস্যা কোথায়?”

আমিজা বেগম একটু নিরব থাকলেন এবার৷ পরে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললেন,

“আপনার কথা আমি বুঝতে পারছিনা মা। তাছাড়া সজীব কি ভাববে?”

আদিবা বেগম বললেন,

“সজীব দাদুভাইকে মানানোর দায়িত্ব আমার। তুমি কি করবে? তোমার মতামত কি রকম এটা তো বলো।”

“আমার কিছু বোধগম্য হচ্ছে না মা।”

“এতোটা ভেবো না মা। আমার মেয়েকে তো চিনোই! ঐ বাড়িতে থাকলে ফারাহ হতাশায় তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে৷ সবই তোমার জানা বউমা। কিরতো অজানা না৷ উপরে উপরে মেয়েটা নিজপকে ঠিক দেখালেও ভেতরে ভেতরে ও শেষ হয়ে গেছে। আমি মেয়েটাকে আগের মতো হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল দেখতে চাই বউমা৷ তুমি অমত করিও না৷ দয়া করে আমার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করো।”

আজিমা বেগম চোখ নামিয়ে নিলেন এবার। মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“সবই তো বুঝলাম মা। কিন্তু আমার ছেলেটা কি মানবে? পরিবারের এই অবস্থা। সজীব এখনও পড়াশোনা শেষ করতে পারলো না। এখন বিয়ে করালে বিষয়টা কেমন দেখাবে না? এছাড়া সাইমারও এখনও পড়াশোনা সবে দশম শ্রেণীতে উঠলো। বিয়ে দেওয়া বাকিই রয়েছে। এরমাঝে ছেলের বউ আনলে বিষয়টা কেমন একটা হয়ে যাবে না? আমার কথাগুলো ভুল ভাবে নিবেন না মা। আমি শুধু সব দিকটা ভেবে বলছি।”

আদিবা বেগম পুত্রবধুর সব কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। এরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

“বিয়ে টা এঝনই না বড়ো বউমা। এখন শুধু কথাবার্তা বলে রেখে বছর দুয়েক পর করাতাম। কারণ ফারাহ নিজেও এখনও ছোটো। সামনের বছর এইচএসসি পরিক্ষা। বিয়ে করিয়েই বা হবে এখন? কিন্তু আমার মাইয়ারে ভরসা নাই আমার। মেয়ে বড়ো না হতেই বিয়ে দেওয়া তার স্বভাব। এক নাতিনীরে হারাইছি বউমা। ফারাহরে হারাইলে আমি বাঁচতেই পারমু না রে মা।”

আজিমা বেগম শাশুড়ির কাধে হাত রাখলেন। আশ্বাস দিলেন, বললেন,

“আমি আছুয়ার সাথে কথা বলবো মা। আমি চিন্তা করবেন না। তার আগে সজীবের সাথে একটু কথা বইলা নিই। ওরও মত অমত আছে।”

আদিবা বেগম সম্মতি জানালেন। আজিমা বেগম নিজের কাজ সেরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

৮,
পরদিন সকালবেলায়, নিজের কবুতরের খোয়ার থেকে কবুতর ছেড়ে দিয়ে উঠোনে গম ছিটিয়ে দিয়ে দাড়িয়ে কবুতর দেখছে ফারাহ৷ মুখে ব্রাশ ঢুকিয়ে দাড়িয়ে আছে। ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে তার। কবুতর গুলো দাফাদাফি করে খাচ্ছে, দেখতে সুন্দর লাগে। দাড়িয়ে সেটাই দেখছে। ঘরের বাকি কাজগুলোর দিকে তার ধ্যান নেই। আদিব ফারাহর পাশে এসে দাড়িয়েছে প্রাইভেট পরে এসে। বোনকে একধ্যানে কবুতর দেখতে দেখে সে বললো,

“বুবু? ব্রাশ নিয়ে দাড়িয়ে আছিস? মুখ ধুয়ে নে।”

ফারাহ আচমকা কারোর গলার স্বরের শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে। আদিবকে দেখে সস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে,

“তুই! আমি ভাবলাম কে না কে।”

“এতোটা উদাসী হয়ে গেছিস! ভাইয়ের গলার স্বরও চিনিস না?”

“না একটু অন্য ধ্যানে চলে গেছিলাম। খেয়াল করিনি।”

“কি নিয়ে এতো ভাবছিলিস?”

“তেমন কিছু না৷ তুই হাত মুখ ধুয়ে নে। স্কুলে যাবি তো! আমারও কলেজে যেতে হবে। চল চল।”

আদিবকে তাড়া দিয়ে ফারাহ বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়। কলপাড়ে গিয়ে চাপকল চেপে মুখ ধুয়ে এসে রান্নাঘরের কাছে গিয়ে দাড়ায়। আড়াল থেকেই বলে,

“খাবার দাবার কিছু দিবেন? কলেজে যেতে হবে।”

ভেতর থেকে আছিয়া বেগম মেয়ের কথার ধরণ দেখে আবারও মন খারাপ করেন। আজ নতুন নয়, ফাতিহা মারা যাবার পর থেকে ফারাহ উনাকে মা ডাকটা যতোটা সম্ভব এড়িয়ে গিয়ে কথা বলা যায়! সেভাবেই
কথা বলে। আছিয়া বেগম উত্তর দেন,

“তরকারী হয়েই আইছে। তুই তৈরি হয়ে আয়। আমি ভাত তরকারী বেড়ে ঠান্ডা করে আনতেছি৷”

ফারাহ উত্তর দেয় না কথাটা শুনে। ঘরে গিয়ে রেডি হয়ে নেয়। আদিবও তৈরি হয়ে নিয়েছে দেখে বলে,

“২ভাই বোন আজ একসাথে যাবো। তাড়াহুড়ো করে দৌড় জানি মারিস না।”

আদিব বোনের কথা শুনে খুশিতে বলে,

“কত্তোদিন পর আবার আমরা একসাথে পড়তে যানু তাইনা বুবু? আগে তো!”

আদিব থেমে যায়। ক্ষীণ হয় তার কন্ঠস্বর। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে পরে। ফারাহর মনে পুরোনো স্মৃতি তাজা হতেই বুকের মধ্যিটায় তার চিনচিন করে উঠে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে সে হাসার চেষ্টা করে বলে,

“জীবনটা হয়তো আগের মতো নেই। কিন্তু হাসিখুশি থাকতেও বারণ নেই। এরকম আমায় ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি। আমি তোর বড়ো বোন ঠিকই। কিন্তু ততোটাও বড়ো নই যে আমায় ভয় পেতে হবে।”

“বুবু, তুই ইদানীং খুব গম্ভীর হয়ে গেছিস। সেজন্য ভয় করে আমার।”

আদিব মাথা নিচু করা অবস্থাতেই কথাটা বললো। ফারাহ মুচকি হাসলো। বোরখার উপর হিজাবটা ঠিক করে নিলো। এরপর বললো,

“হয়েছে গম্ভীর হতে দেখতে হবে না। চল খেয়ে নিবি। খেয়ে বের হতে হবে। সময় নেই৷”

ফারাহর কথামতো ওরা দু ভাইবোন খেয়ে নেয় একসাথে। আছিয়া বেগম ছেলেমেয়েকে খাইয়ে দিয়েই স্বামীর জন্য গামলায় ভাত বেধে নেন গামছা দিয়ে। জগভর্তি পানি এনে, ভাতের গামলা নিয়ে মাঠে রওনা দেন। আজ নিজেদেরই ক্ষেতেই কাজ করছেন আজমল আলী। সেজন্য ভাত মাঠেই নিয়ে যাচ্ছেন আছিয়া বেগম। জমিটা বেশ খানিক দূরে। এসে খেয়ে যাওয়া সময় নষ্টের মতো। সেজন্য তাকেই ভাত নিয়ে যেতে বলেছেন আজমল আলী। আছিয়া বেগম স্বামীর কথামতো ভাত নিয়ে যান। স্বামীর খাওয়া শেষে ভাত নিয়ে বাড়ি ফিরতেই দেখেন বাহির বারান্দায় পিড়ি বসে আছেন বড়ো ভাই বউ আজিমা বেগম আর উনার মা আদিবা বেগম। বাড়িতে ঢোকায় গেট টায় তালা মারা ছিলো আর সাথে দরজাতেও। সেজন্য উনারা ঘরে ঢুকতে পারেননি। আছিয়া বেগম মা আর ভাই বউকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় উনাদের কাছে এসে অবাক স্বরে বলেন,

“তোমরা এখানে? হঠাৎ কোনো খবর না দিয়ে আসলে যে?”

কথাটা বলেই উনি দরজা খোলায় ব্যস্ত হয়ে পরেন। আদিবা বেগম বললেন,

“এমনি একটু দরকার ছিলো তোর সাথে।”

“যা দরকার পরে দেখা যাবে। এখন ঘরে আসো আগে।”

আছিয়া বেগম মা আর ভাই বউকে ঘরে বসিয়ে বলেন,

“তোমরা বসো, আমি আসতেছি একটু।”

আজিমা বেগম আছিয়াকে থামিয়ে বললেন,

“এতো তাড়াহুরো করো না আছিয়া। আমরা শুধু একটু কথা বলেই চলে যাবো। যদি আমাদের সাথে বসতে, ভালো হতো।”

আছিয়া বেগম ফের একটু অবাক হলেন। আজিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“কি কথা?”

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে