ফারাহ পর্ব-০৩

0
1502

#ফারাহ
#পর্ব:৩
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৫,
“দেখো নানী, এমনি এক কথা বলবেনা। আমি ঐ বদ লোককে কখনও বিয়ে করবোনা। ওনার মতো তিতা করোলাকে কে বিয়ে করবে? কথায় কথায় ধমক। একদম বিরক্তিকর।”

ফারাহ নানীর কথার জবাব দিয়ে পুকুর ঘাটে ছোটো মামীর কাছে।চলে আসে। সজীব মাত্রই বাড়িতে ঢুকেছে। সেজন্য আর সে বাড়িতে ঢুকলো না। আদিবা বেগম ফিচেল হাসেন। আনমনে বলেন,

“জীবনে যাদের সহ্য হয়না, তারাই জীবনসঙ্গী হয়ে ধরা দেয়। আজ হয়তো সজীবের কথা শুনে রাগ করলি! কিন্তু একদিন আসবে, ওকে না পেলে রেগে বাড়িঘর মাথায় তুলবি। আমি সেইদিনের অপেক্ষায় আছি ফারাহ। উপরওয়ালা হায়াত রাখলে আমি তোদের বিয়ে দেখেই চেখ বুজবো।”

আদিবা বেগম বাড়ির ভেতরে ঢুকেন। ঢুকতেই দেখতে পান সজীব হাত পা ধুয়ে মায়ের সাথে তরকারি কে”টে এগিয়ে দিচ্ছে। এটা দেখে উনি তারাহুরো করে বলেন,

“কি করছিস দাদুভাই? আমি আছি তো! আমি এগিয়ে দিচ্ছি তোর মা-কে। ঘরে বাইরে এতো কাজ করতে হবে না তোরে।”

“তুমি এতো ব্যস্ত হইও না দাদী। আমি আমার মা-কেই এগিয়ে দিচ্ছি। এতে কষ্টের কিছু নেই। তুমি বসো, এতো উত্তেজিত হইও না।”

সজীব দাদীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে। আদিবা বেগম উত্তরে বললেন,

“তোর মতো পাগল ছেলে দুটো দেখিনি রে দাদুভাই।”

“দেখবে কি করে! তোমার নাতী একপিসই।”

“হ্যাঁ সেই তো। একপিস, একেবারে গরিলার বংশধরদের বংশ। সারাক্ষণ রাগ আর রাগ। অসহ্য লোক। আচ্ছা মামী আপনার ছেলের মুখে কি জন্মের পর মধু দিতে ভুলে গিয়েছিলেন?”

ফারাহ উঠোনে প্রবেশ করতে করতে কথাটা বললো। আদিবা বেগম আর আজিমা বেগম হেসে উঠলেও সজীব দাঁতে দাঁত পিষে ফারাহর দিকে তাকায়। এই মেয়ে সবটা সময় তার মেজাজের পিণ্ডি চটকে দেয়। কোন জন্মের শ’ত্রুতা কে জানে! সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

“রাগ তো আর কারোর সাথে করিনা। তোর সাথেই আমার যতো রাগ দেখাতে হয়! তাহলে বোঝ তুই কোন লেভেলের খাচ্চোর মেয়ে!”

“দেখলেন মামী! আমায় কিভাবে অপমান করে!”

আজিমা বেগম এবার মুখ খুললেন। উনি ভাতের পাতিলের ঢাকনা একটু সরিয়ে মাড় উঠতে দিয়ে বললেন,

“তোরা সেই বোধ বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখি ঝগড়া করেই যাস। বলি তোদের এ ঝগড়া কি তোদের বিয়ের পর বাচ্চাকাচ্চার সামনেও করবি?”

“আমাদের বিয়ে মানে?”

সজীব আর ফারাহ একসাথে চমকে প্রশ্নটা করে। আদিবা বেগম পরিস্থিতি সামলাতে বলেন,

“কেনো তোদের কি বিয়ে হবে না নাকি? নাকি সজীব বাড়িতে বিয়ে করে বউ আনবেনা?”

ফারাহ হেটে এসে নানীর পাশে পিড়ি পেতে বসতে বসতে বলে,

“মামী, আপনার ছেলেকে বিয়ে করাবেন না দয়া করে। যে মেয়ে আসবে! তার কপালের সুখ শান্তি অযথা নষ্ট করার দরকার নেই। এনার মতো তিতা করোলার বউ হয়ে সে মেয়ে সারাজীবন তিতা সহ্য করে থাকতে পারবেনা।”

“মা ওকে থামতে বলো।”

সজীব ফারাহর কথা শেষ হতেই থমথমে গলায় কথাটা বললো। তহুরা বেগম তখন হাড়ি পাতিল নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। বাড়ির ভেতর বারান্দায় একপাশে মই টাঙিয়ে রাখা হয়েছে হাড়ি পাতিল রাখার জন্য। ওখানে পাতিল রাখতে রাখতে উনি বললেন,

“তোরা বাপু জীবনেও মিল হবিনা। সারাটা সময় দেখি শুধু একে অপরের পিছে লাগতে। বলি তোরা বড়ো হয়েছিস এখন। সে হুশ আছে?”

“আপনাদের ভাগ্নীকে থামতে বলুন চাচী। ও মেয়ে মানুষ, বড়ে হচ্ছে কিন্তু লাজলজ্জার বালাই ওর মাঝে নেই।”

সজীব হেঁশেলপাড় ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে কথাটা বললো। দুই ঘরের রান্নার জায়গা একটাই। উপরে টিনের ছাউনি দেওয়া বাশের খুটি দিয়ে। তার নিচেই দুই জায়ের মাটির চুলো দুটো করে চারটে। ওখানেই সবাই বসেছিলো এতোক্ষণ। সজীব উঠে যেতেই ফারাহ ভেঙচি কাটে। আদিবা বেগম ফারাহর চোখমুখের অবস্থা দেখে মিটমিট করে হাসেন। আজিমা বেগম সজীবের যাওয়া দেখে বললেন,

“কামলাদের ভাত মাঠে(ফসলি জমির মাঠ) নিয়ে যাবি? নাকি ওনারা বাড়ি আসবেন?”

“রান্না হলে খবর দিও। এতোজনের খাবার বেধে মাঠে নিয়ে যাওয়া যাবে না।”

সজীব উঠোন ছেড়ে যেতে যেতে কথাটা বললো। ফারাহ বড়ো মামীর হাতে হাতে কাজকর্ম এগিয়ে দিতে শুরু করলো।

৬,
“কই গো ফাতিহার মা! একগ্লাস পানি দাও তো! বড্ড পানি তেষ্টা পেয়েছে। ”

বাড়ির ভেতর উঠোনের বারান্দার বাঁশের খুটির সাথে হেলান দিয়ে বসতে বসতে কথাটা বলেন ফারাহর বাবা আজমল আলী। ফারাহর মা আছিয়া বেগম গরুকে ধানের গুড়ো খুদ সিদ্ধ মিশিয়ে পানি খাওয়াচ্ছিলো। স্বামীর হাঁকডাক শুনে গরুর রাখার গোড়াপাড় থেকে বেরিয়ে এসে বলেন,

“তুমি কাজ থেকে এতো তাড়াতাড়ি ফিরলা! কেবল তো বেলা গড়িয়ে দুপুর। আসরের আজান তো দেয় নাই।”

“বইলো না আর। বাজারে যাওয়া লাগতো মালিকের সাথে। ধানের জমিতে সার দিবো, সারের বস্তা টানতে হইবো। শরীর চলে না, আবার মণখানেকের বস্তা টানা। ঘাড়ের ব্যথায় আজ বাচলে হয়।”

আছিয়া বেগম অসহায় চোখে স্বামীকে দেখেন। কবে দুদণ্ড শান্তি পাবে লোকটা! খোদা জানে। আছিয়া বেগম পাটখড়িতে দেওয়া ছোট্ট রান্নাঘর থেকে গ্লাস জগ নিয়ে আসে। কলপাড়ে গিয়ে চাপকল চেপে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসেন। স্বামীর সামনে জগ গ্লাস রেখে ফের রান্না ঘরে যান। রান্নাঘরে রাখা জালের র‍্যাক থেকে মুড়ি বাতাসা বাটিতে করে এনে স্বামীকে দেন। আজমল আলী হাত বাড়িয়ে মুড়ির বাটি নিয়ে মুড়ি মুঠো করে মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলেন,

“মেয়েটা ফিরেনি?”

“না আসেনি। সজীব বাবারে বলছিলাম দিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কাজের চাপে হয়তো আসতে পারেনি।”

“তোমার পোলারে পাঠাইলেই হয়। মাইনসের বাড়িতে এতো থাকা! বাড়িতে বিয়ের যোগ্য ছেলে আছে। মানুষ কথা রটাবে! ওরে তোমার মায়ের বাড়ি কম যাইতে দিও এখন।”

“আসতে না দেখে মায়ের কাছে ফোন দিছিলাম। মা না জানিয়েই নিয়ে গেছে। আমি তো যাইতে দিই নাই।”

“আবিদ স্কুল থেকে ফিরলে ওরে পাঠায় দিও। আমি গেলাম।”

কথা বলতে বলতে আজমল আলী খেয়ে উঠে চলে যায় উঠোন ছেড়ে। আছিয়া বেগম হাফ ছাড়েন। আবিদ ফারাহর ছোটো ভাই। স্কুলে ক্লাস নাইনে পরে এবার৷ ফারাহদের গ্রামেরই হাইস্কুলে পড়াশোনা করছে সে। আছিয়া বেগম হাতের কাজ সারতে লেগে পরেন। মেয়েটা বাড়ি আডলে অগোছালো কিছু দেখলেই তো বাড়িঘর চেচিয়ে মাথায় তুলবে। একটুও অগোছালো কিছু দেখতে পারেনা৷ পরে রাতের আবার রান্নার কাজ। একা হাতে কুলোতে পারেন না আছিয়া বেগম। গরুকে পানি খাওয়ানো শেষ করে ঘর-উঠেন ঝাড়ু দিয়ে আলনার কাপড় গুছিয়ে নিয়ে গরুকে খড় আর ছাগলের জন্য আনা ঘাস কেটে দিয়ে রান্নার জোগার ধরেন আছিয়া বেগম। তখনই আবিদ স্কুল থেকে ফিরে। বাড়িতে ঢুকেই চিৎকার করে মা বলে ডাক ছাড়ে। আছিয়া বেগম তরকারী কা’টছিলেন। হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে এসে বলেন,

“এসে গেছিস বাবা? চট করে গোসল দিয়ে এসে খেয়ে তোর বোনকে আনতে যা তো তোর নানীর বাড়ি।”

“আগে আমায় স্কুল ড্রেস খুলতে তো দাও মা৷ আসতে না আসতেই তোমার কাজের বহর শুরু! এটা কর, ওটা কর।”

আদিব বিরক্ত হয়ে বললো। আছিয়া বেগম দমে গেলেন। আস্তে ধীরে বললেন,

“তোর বাবার কথা তো জানিসই! মেয়েকে চোখের আড়াল করেন না উনি৷”

“করবেই বা কোন ভরসায়? তোমার মতো মা যে ঘরে, সে ঘরে সন্তানের কখন কি হয়! ভরসা থাকে কোনো?”

আদিব স্কুল ব্যাগ বারান্দার একপাশে রাখা টেবিলে স্কুল ব্যাগ রাখতে রাখতে কথাটা বলে। আছিয়া বেগমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ছেলের এহেন কথায়। তিনি কাপা গলায় বলেন,

“সব দোষ কি শুধু আমারই আদিব? পুরো দোষের ভাগীদার সবসময় আমাকেই বানিয়ে গেলি তোরা?”

“দোষ তোমার পুরো না হলেও, কম নয়তো দোষ। সবকিছু তুমি বোধহয় ভুলে গেছো। আমি ভুলিনি মা। আর ফারাহ বুবুও ভুলেনি৷ তোমায় মা ডাকতেই গা ঘিনঘিন করে বিশ্বাস করো। গতকাল ফাতিহা বুবুর মা”রা যাবার একবছর হলো! আমরা আজও কষ্ট পাই। আর তোমাকে দেখো! একটু অনুশোচনায় ভুগতেও দেখিনা৷”

আছিয়া বেগম শাড়ির আচল মুখে চেপে ডুকরে কেদে উঠেন। আদিব ঘরে ঢুকে যায়। স্কুল ড্রেস পাল্টে আলনায় রেখে, লুঙ্গি পরে গামছা হাতে যায় বাড়ির পাশে পুকুরে গোসল দিতে। আছিয়া বেগম ছেলের জন্য ভাত তরকারি সাজিয়ে নেন স্টিলের থালায়। আদিব গোসল সেড়ে এসে খেয়ে মায়ের থেকে ২০টাকা ভ্যান ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পরে বোনকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে৷

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে