ফারাহ পর্ব-০৫

0
1269

#ফারাহ
#পর্বঃ৫
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৯,
মাটির চুলোয় রান্না করার জন্য লাকরি খড়ি রান্নাঘরে জমা করছে ফারাহ। তার মা ধানের কাজের জন্য বাইর উঠোনে কাজে ব্যস্ত। আমন ধানের মৌসুম, ধানের ঢিবি হয়ে আছে উঠোনে। সেগুলোই ঝাড়ছে তার মা। অপটু হাতে চুলোয় আ”গুন জ্বা”লাতে গিয়ে ধোয়া করে একনাগারে কেশে চলেছে ফারাহ৷ অভাবের সংসারে মানুষ হলেও তার মা সেভাবে কাজে হাত লাগাতে দেয়নি। সেজন্য রান্না সেটা সে আগে কখনও করেনি বলে এই দশা। ফারাহ তবুও কোনোমতে ভাতের চাল ধুয়ে চুলোয় তুলে দিয়ে কাঠের খড়ি লাগিয়ে দিয়ে তরকারি কা”টতে শুরু করে। আনাচ আর আলু ভাজবে, সাথে মাসকলাইয়ের ডাল রান্না করতে বলে গেছে তার মা। রান্নার নিয়ম কানুনও বলে দিয়ে গেছে। কিন্তু সে তো সব শুনেও ভুলে বসে আছে। আগে তরকারী কে”টে নিক। তারপর মা-কে ডেকে ফের জেনে নেওয়া যাবে। এই বুঝে সে আলু আনাচ কে”টে নেয়। এরপর ধুয়ে গামলায় তুলে রেখে ভাতের খড়ি কমিয়ে দেয়। ভাত প্রায় হয়ে এসেছে। এরপর সে ছুট লাগায় উঠোনে। মায়ের থেকে সব শুনে আসতে হবে আবার। ভাজিটা তো কোনো রকম করতে পারবে, কিন্তু ডাল তো পারবেই না৷ সে উঠোনে গিয়ে দাড়াতেই দেখতে পায় তার বড়ো বোন ফাতিহা মাথা নিচু করে তার মায়ের সামনে দাড়িয়ে আছে। আর তার মা রাগী স্বরে আঙুল উঁচিয়ে মেয়েকে শাসনের সুরে গা”লিগা”লাজ করছেন।
ফাতিহাকে দেখে ফারাহ যতোটা না খুশি হয়েছে তার থেকে বেশি কষ্ট পেলো বোনকে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে কাঁদতে দেখে। ফারাহ জানপ এটা নতুন না। ফাতিহার বিয়ে হয়েছে তিনবছর হয়ে এলো। কিন্তু সে সে ছুট লাগিয়ে বোনের পাশে দাড়িয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রেগে গিয়ে বলে,

“বুবু আসলো, আর তোমার রাগারাগি শুরু মা। ঘরে তো ঢুকতে দিবে এবার!”

আছিয়া বেগম এবার বড়ো মেয়েকে রেখে ছোটো মেয়ের দিকে কড়াচোখে তাকালেন। বললেন,

“একদম বোন দরদী হওয়ার দরকার নেই তোর। তোর বোনের ভুল তোর চোখে পরে না? সংসার ফেলে ১৫দিন না যেতেই দৌড়ে বাপের বাড়ি আসে। লজ্জা করে না তোর বোনের?”

“আমার বোন সবার আগে তোমার মেয়ে। এটা ভুলে যাচ্ছো কেনো?”

ফারাহ দাত কিড়মিড়িয়ে বলে। সে বরাবরই একটু জেদি আর রাগী স্বভাবের। ফারাহকে এভাবে কথা বলতে দেখে ফাতিহা ফারাহর হাত ঝাকিয়ে ভীতু স্বরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“চুপ কর ফারাহ। মা মা”রবে তো তোকে। ”

ফারাহ বোনের কথা শুনে ফাতিহার দিকে তাকিয়ে বলে,

“উনি আমায় মা’রলে এখানে কি হবে! সেটা তুমিও জানো বুুবু। এতো সহজ সরল আর বোকা কেনো হয়েছো? একটু তেজী হতে পারোনি? বোকার মতো সংসার ফেলে এখানে এসে কষ্ট পাচ্ছো শুধু শুধু। জানো তো এই মহিলার যতো সমস্যা তোমায় নিয়ে! বিয়ে তো দিয়েছে এক গাঁ’জাখোরের সাথে না দেখে শুনে। এখন অন্তত ছাড়িয়ে এনে শান্তি যদি দিতো!”

আছিয়া বেগম দাড়িয়ে দাড়িয়ে রাগে ফুসছিলেন মেয়ের কথা শুনে। ফারাহর কথা শেষ হতেই উনি ফারাহর দিকে অ’গ্নি চাহনীতে তাকিয়ে বললেন,

“হ ছাড়াই আইনা মান সম্মান ডুবাই? এটাই তো চাও তাই না? বিয়া দিছিলাম কি ছাড়াই আনতে?”

“দয়া করে চুপ করো মা। আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা। বুবু ঘরে চল।”

ফারাহ মায়ের কোনো কথার অপেক্ষা না করে বোনের কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বোনের হাত ধরে বাড়ির ভিতর ঢুকে পরে। তখনই আছিয়া বেগম চেচিয়ে ফাতিহার উদ্দেশ্যে বলেন,

“দুনিয়ায় এতো মানুষ ম”রে, তুই ম”রতে পা”রোস না পো”ড়ামুখী। জন্ম থেকে জ্বা”লাই খাইলি। এখন কবরে গেলে কি শান্তি পাবি? মা বাবাকে খেয়ে দম নিবি তাইনা। তার আগেই ম”রতে পারিস না।”

মায়ের কথা শুনে ফাতিহার পা আটকে যায়। সে বারান্দায় পা দিতেই তার পা থেমে যায়। চৈত্রের খরায় আশার বৃষ্টি হয়ে তার চোখ বেয়ে টুপটুপিয়ে জল গড়িয়ে পরে। ফারাহ বোনের থমকে যাওয়া দেখে নিজেও দাড়ায়। বুঝতে পারে মায়ের বলা কথাগুলোর জন্য ফাতিহা থেমে গেছে। সে নিজে এবার রাগে দিক ভুলে মায়ের সামনে ছুটে গিয়ে বলে,

“একদম আমার বুবুকে উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না আপনি। আজ থেকে আপনাকে মা ডাকা আমি ভুলে যাবো। কেমন মা আপনি? মেয়েকে কোথায় সাহস দিবেন! উল্টো বাড়িতে আসায় ম”রতে বলছেন। লজ্জা লাগে আপনাকে আমার মা বলে ডাকতে।”

এরপর আবার দ্রুতপদে বোনের কাছে এসে হাত ধরে হেচকা টানে বোনকে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পরে।

১০,
ফাতিহা আর ফারাহ রাতের খাবার খেয়ে পাশাপাশি এক বিছানায় শুয়ে আছে। একটা ঘরেই তিন ভাই বোন থাকে। শুধু বিছানা আলাদা। ঘরের এক মাথায় এক খাট, অন্য মাথায় আরেকটা। সেটায় আদিব একা শুয়েছে। ফারাহ অনেকদিন পর বোনকে কাছে পেয়ে দুনহয়ার গল্প জোড়া দিয়ে বকবক করেই চলেছে। ফাতিহা একদম নিরব। লেপের নিচে দুবোনের মাথা একসাথে লাগিয়ে শুয়ে আছে। হঠাৎই গরম জলের আভাস পেয়ে ফারাহ মাথা বের করলো লেপের নিচ থেকে। ঝট করে ফাতিহার গালে হাত দিয়ে টের পায় সে কাঁদছে। ফারাহ ফাতিহার গাল মুছিয়ে দিয়ে বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

“বুবু তুমি ঘুমাও। আমি চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

ফাতিহা উত্তর দেয় না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরে। ফারাহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার ফুলের মতো বোনের জীবনে কি এক প্রলয় কারী ঝড় বয়ে চলছে। বাবা মা দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছে ভাবী পাগল, নেশাখোর একজন ছেলের সাথে। যে বউয়ের ভালোমন্দ বাদ দিয়ে সবার ভালো মন্দই দেখে। বড়ো ভাইয়ের স্ত্রীর প্ররোচনায় বউকে ধরে পি”টায়। ফাতিহা বিয়ের পর ৬মাস ভালো থাকলেও এরপর ওদের আসল রুপটা দেখতে পায়। যখন বাবা মাকে সবটা জানায়, বাবা তার মেয়ের আদরে ছাড়িয়ে আনতে চাইলেও বাধা হয়ে দাড়ায় মা। উনার কথা, মেয়ে হয়ে যখন জন্ম হয়েছে, এরকম একটু আধটু সহ্য করতেই হবে। বাচ্চা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এটা বলে বলে ৩টা বছর ধরে ফাতিহাকে ঐ বাজে পরিবেশে খারাপ মানুষ টার সাথে থাকতে হচ্ছে। বাচ্চা নেওয়ার কথা! চেষ্টা করেও যেখানে হচ্ছিলো না। সেটাও আছিয়া বেগম ফাতিহাকেই দোষ দিয়ে চলেছেন৷ সব দোষ যেনো মেয়েরই। মেয়ে জামাইয়ের কোনো দোষ নেই। ফাতিহার প্রতি তাদের অত্যাচার দিনদিন বাড়ছে বৈ কমছেনা। সেজন্য ফাতিহা ঘুরেফিরে কিছু দিন পরপরই সহ্য করতে না পেরে বাবার বাসায় আসে। আর সেটা নিয়েই আছিয়া বেগম শুরু করেন ঝামেলা। আহও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কবে তার মা মেয়েকে বুঝবে! চিন্তা করে কূল খুজে পায়না ফারাহ। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ বুঝে ঘুমানোর চেষ্টায় মত্ত হয় সে। কিছু সময় পর সফলও হয়।

পরদিন সকাল বেলায় ফারাহর ঘুম ভাঙে হইচই এর শব্দে। ঘর থেকে বের হয়ে শুনে মানুষের চাপা আর্তনাদ আর সবার মুখে এক কথা, মেয়েটা শেষে সইতে না পাইরা ম”ইরাই গেলো গো। আঙিনায় তখন বিরাট জটলা পাকিয়ে মানুষ দাড়িয়ে আছে। ফারাহ ঘুম থেকে উঠে বোনকে পাশে পায়নি। সে ভয়ে ভয়ে ভীর ঠেলে উঠোনের পশ্চিম দিকে তাদের বড়ো কাঠাল গাছ আছে, সেখানে যায়। মানুষের আড়ালে সবাই কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে। ভীড় ঠেলে সামনে যেতেই দেখে ফাতিহার মৃৃ”দ দেহ মাটিতে শোয়ানো। পাশেই দড়ি ছিড়ে কে”টে ফেলে রাখা। ফারাহর পা আর চলতে চায় না। তবুও বোনের লাশের পাশে বসে সে কেঁদে উঠে। তার গগনবিদারী আর্তনাদে সেদিন কেপেছিলো তাদের গ্রাম। এরপর থেকেই ফারাহ বিয়ে শব্দকে আর মা–কে প্রচুর ঘৃণা করে সে। যেই ঘৃণার ধারা বহমান আজও।

“কিরে, তোর কি বিয়েতে মতামত নেই?”

মায়ের ধাক্কায় হুশ ফিরে ধারার। রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় বসেছিলো সবে কলেজের বাকি পড়া তৈরি করতে। তখনই তার মা এসে জানায় ফারাহর ভালো বিয়ের সমন্ধ এসেছে। তার এখন বিয়েতে মতামত আছে কিনা! এক মেয়েকে হারিয়ে তাকেও হারাতে রাজী না আছিয়া বেগম। যেখানে তিনি জানেনই ফারাহ বিয়ে শব্দটাকে অপছন্দ করে। সেজন্য জিগাসা করা উনার। মায়ের ধাক্কায় অতীতের পাতা থেকে বের হয় ফারাহ। মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে সে তার বোনের চিন্তায় বিভোর হয়ে গিয়েছিলো। ফারাহ আছিয়া বেগমের প্রশ্নের উত্তরে বলে,

“বুবুকেও তো এই কথা বলেই বিয়ে দিয়েছিলেন তাইনা! আমার বুবু কোথায় তবে! আপনার কথায় দেখা না যায় ক’দিন পর বা বছর পর এসে আমারও বুবুর মতো এমন কাঠাল গাছে দড়ি দিয়ে ম’রতে না হয়! আপনি আবার অনেক ভালো মা তো! সন্তানদের বুঝেন বেশি!”

আছিয়া বেগম ফারাহর উত্তরে দমে যান। উত্তরে আর কি বলবেন বুঝে পেলেন না। উনার মা আর ভাবী এসে তো সজীবের সাথে ফারাহর বিয়ের বিষয়টা ভাবতে বলে গেলো, কিন্তু মেয়েই তো উনার ঘাড়ত্যাড়া। সজীবকে সহ্য করতে পারেনা এটাও জানেন তিনি। এখন কি করে বুঝাবেন ফারাহকে! চিন্তায় পরে গেলেন আছিয়া বেগম।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে