ফারাহ পর্ব-০৬

0
1286

#ফারাহ
#পর্ব:৬
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

১১,
“সজীব তোকে একটা কথা বলবো?”

রাতের খাবার খেতে বসেছে সজীব, সাইমা আর আদিবা বেগম। আজিমা বেগম খাবার বেড়ে দিয়ে উক্ত কথাটা বললেন। সজীব ভাতের গ্রাস মুখে তুলে চিবুতে চিবুতে উত্তর দিলো,

“কি কথা মা?”

“তোর বিয়ের বয়স হয়ে আসলো তো! তোর বিয়ের কথা ভাবছি। তোর মতামত কি?”

সজীব মায়ের কথায় অবাক হয়ে যায়। তারমাঝে মা হয়ে বিয়ের কথা বলছেন! একটু শরম পায় সজীব। সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,

“মা অনার্সই শেষ করে উঠতে পারলাম না। সাইমার বিয়ে দিলাম না, একটা ভালো চাকরি হলো না! আর তুমি বিয়ের কথা বলছো? বউকে এনে আমি খাওয়াবো কি? পড়াবো কি?”

“কেনো? তোর বউ কি রাক্ষ”স বংশের কেউ হবে? যে তাকে খাওয়াতে পরাতে তোর একেবারে ধনী হতে হবে?”

আজিমা বেগমের কথায় সাইমা আর আদিবা বেগম মিটমিট করে হাসছে। সজীব মায়ের কথার উপর কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

“মা একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি এখনও সেই জায়গায় পৌছাইনি, যে জায়গায় পৌছালে পরের মেয়েকে ঘরে এনে তার চাহিদা ঠিকঠাক পূরণ করতে পারবো।”

“আমি সব ভেবেচিন্তে বুঝেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি সজীব। তোর কি মনে হয়? না ভেবেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া তোর দাদীরও ইচ্ছে উনার হায়াত ফুরোবার আগে নাত-বউয়ের মুখ দেখে যাবেন। আর তুই নাতী হয়ে সেই কথা রাখবি না? তোর বউ মানুষই হবে, কোনো রাক্ষ”” সী না যে এখানে এসে কষ্ট পাবে খাবার দাবারের, সুখের জীবনের৷ আমরা যথেষ্ট স্বচ্ছল ভাবে চলছি। তাতে আমাদের যখন কষ্ট হচ্ছে না, পরের মেয়েরও হবে না৷ ”

সজীব মাকে যখন বুঝাতে না পেরে শেষ একটা চেষ্টা করতে বললো,

“কিন্তু মা? একটু চিন্তা করো! আমরা যেভাবে চলছি, আমাদের সেভাবে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলে কষ্ট হয়না। কিন্তু পরের ঘরের মেয়ে তো এভাবে চলে নাও অভ্যস্ত থাকতে পারে। অযথা কোনো মেয়েকে এনে কষ্ট দেওয়ার মানে হয়?”

“সব ছেলেই পরের ঘরের মেয়ে বিয়ে করে সজীব! কোনো নিজের ঘরের না। তাই বারবার এই পরের ঘরের মেয়ে কথাটা টানিস না। তোর কথা শুনলে রা”গ উঠছে আমার। ”

“কিন্তু মা!, সবটা তো একটু ভাবো। ”

আদিবা বেগম এবার মুখ খুললেন, বললেন,

“তুই তোর দাদীর আশা পূরণ করবিনা দাদুভাই? তোর বউরে দেখার ভাগ্য কি আমি বেচে থাকতে হইতোনা?”

সাইমা দাদীর সাথে তাল মেলালো। বললো,

“মা আর দাদী তো ঠিকই বলছে ভাইয়া। আমি যদি বিয়ে করে পরের বাড়ি চলেই যাই, তাহলে নিজপর একমাত্র ভাইয়ের বউয়ের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ কই পেলাম! তার থপকপ ভালো তুমি বিয়েটা করে নাও। আমিও ভাবীকে দেখে জ্বা”লিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবো। দারুণ হবে। প্লিজ রাজী হও। ”

সজীব কি করবে এখনও দ্বিধায় পু’ড়ছে তার মন। সে সংকোচ নিয়ে বললো,

” তেমরা শুধু নিজেদের দিকটা ভাবছো! আমার দিকটা ভাববে না? ২৪বছর বয়সে বিয়ে কে করে!”

“ঠিক সময়ে বিয়ে করলে বাচ্চার বাপ হইতি ভাইয়া! আবার বলিস এই বয়সে বিয়ে কে করে?”

সাইমা ফাজলামি করে কথাটা বলে। সজীব বোনের দিকে চোখ গ”রম করে তাকায়। এমনি মা বিয়ের কথা তুলে তাকে লজ্জা দিচ্ছে, আবার এর মাঝে বোনটাও নির্লজ্জের মতো কথা বলছে! সে আড়ষ্ট স্বরে বলে,

“দয়া করে তুই চুপ থাক। কথা বলবিনা একটাও। ”

আজিমা বেগম ওদের কথার মাঝে থালায় ভাত নিতে নিতে বললেন,

“বলছি কি সজীব! তোর পছন্দের কোনো মেয়ে আছে? থাকলে বল, তার সাথেই বিয়ে করাই?”

সজীব মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,

“না আমার পছন্দের কেউ নেই। কিন্তু তোমরা কার সাথে বিয়ে দিতে উঠে পরে লাগলে?”

১২,
আদিবা বেগম আর আজিমা বেগম সজীবের থেকে আশানুরূপ উতর পেয়ে মনে মনে খুশি হলেন। রবের কাছে শুকরিয়া জানিয়ে আজিমা বেগম বললেন,

“ফারাহর সঙ্গে আমি তোর বিয়ে দিতে চাচ্ছি।”

সজীব মায়ের মুখে ফারাহর নাম শুনে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিস্মিত হয়। সে উত্তেজিত হয়ে বলে,

“মা এটা কি করে সম্ভব? ফারাহকে বিয়ে করবো! সেটাও আমি? পাগল হলে তুমি?”

আদিবা বেগম সজীবকে উত্তেজিত হতে দেখে বলেন,

“এতো অবাক হচ্ছিস কেনো দাদুভাই? ফারাহকে তো চিনিসই! চেনাজানা মেয়ে ঘরের বউ হয়ে আসলে অসুবিধা কোথায়? এতো অবাক হচ্ছিস কেনো তুই?”

“দাদী! তুমি জানো, ঐ মেয়ের সাথে আমার ঝ”গড়া ছাড়া কখনও ভালো করে দু’টো কথা হয়না। তার সাথে বাকি জীবন কা”এানো তো অসম্ভব রকমের কাজ দাদী।”

“অসম্ভব বলে কোনো কথা নেই সজীব। আমি আর মা মিলে ফারাহকে পছন্দ করেছি। তোমারও পছন্দের কোনো মেয়ে নেই। আমরা চাই বিয়েটা হোক। ফারাহর মাশের সাথে মানে তোমার ফুফির সাথেও বিষয়টা আলোচনা করে এসেছি। এখন এই সম্পর্ক থেকে পিছু হটার কোনো রাস্তা নেই।”

বললেন আজিমা বেগম। সজীব গম্ভীর হয়ে বললো,

“যা করেছো, তার আগে আমায় একবার জিগাসা করা দরকার ছিলো মা। ”

“আমরা তোমার ভালো চাই সজীব। তাই বেশি কথা বাড়িও না।”

“ইয়ে ফারাহ বুবু আমার ভাবী হবে। কতো মজা হবে, ফারাহ বুবুকে আর আমাদের বাড়িতে এডে চলে যেতে হবে না। দুজনে অনেক গল্প করবো,
আমাদের কেউ আর বকা দিবে না।”

সাইমা খুশিতে গদগদ হয়ে কথাটা বললো। সজীব হাত খাওয়া শেষে হাত ধুতে ধুতে বললো,

” ও আমার ফুফাতো বোন হয় মা। বিয়ে কি করে সম্ভব? মানুষ তো বলবে, বিয়ের আগেই আমরা সম্পর্কে ছিলাম বলে কোনো ঝামেলা হয়েছে, যে কারণে বিয়ে হচ্ছে। নিজের খেয়ে মানুষের কথা শুনতে পারবো না মা।”

আজিমা বেগম ছেলেকে আশস্ত করতে বললেন,

“তুমি আমার ছেলে। তাই তুমি কেমন, আমি জানি, আমরা জানি। তাই তোমার এসব নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। তুমি বিয়েতে রাজী, এটাই আলহামদুলিল্লাহ।”

সজীব ভাতের থালা সরিয়ে রেখে উঠে যায়। আদিবা বেগম হাফ ছেড়ে বলেন,

“যাক বাপু, সহজেই রাজী হলো। তোমার যা ছেলে! তাতে ভয় ছিলো বউমা, তুলকালাম না বাধিয়ে দেয় বাড়িতে।”

“এখন ফারাহ রাজী হলো কিনা! এই বিষয়টা দেখা জরুরূ মা। ফাতিহা চলে যাওয়ার পর মেয়েটার মনে বিয়ে নিয়ে যে বাজে ভাবনা হয়েছে, সেটা দূর করা জরুরী। ও তো ভাবে শ্বশুরবাড়ি মানেই যৌতুকের জন্য অত্যাচা”র আর বউ রেখে অন্য কোথাও সম্পর্ক।”

“পরিবেশ পরিস্থিতি একটা মানুষের উপর দারুণ ভাবে প্রভাব ফেলে মা। সেটা ভালো হোক বা মন্দ। মনে একবার ভয় বা আতংক ঢুজলে সেটা কাটিয়ে বের হয়ে আসা অনেক কঠিন। তাই ফারাহ বুবুর ভয়টা নেহাত নিরর্থক নয়। তোমরা তবু চেষ্টা করো ভাইয়া আর আপুর বিয়েটা দিতে। ওরা নিজেরাও জানেনা, বোঝার চেষ্টা করে না, ঝ”গড়ার মাঝেই ওরা একে অপরের প্রতি একটু দুর্বল। নয়তো ভাইয়া এতো সহজে রাজী হতো না।”

সাইমা খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে যেতে যেতে কথাটা বললো। সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই আদিবা বেগম বললেন,

“সাইমা ঠিকই বলছে বউমা। এবার তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা টা করলে হয়। ফারাহকে ঐ বিতৃষ্ণা, ভয় সবকিছু কা”টিয়ে সুন্দর একটা জীবনে ফিরিয়ে আনা জরুরী। ”

“সবই তো বুঝলাম মা, ফারাহর ভালে চাইতে গিয়ে সজীবের কোনো খা”রাপ করছি না তো মা!”

“তোমার মায়ের মন বউমা। ভয় লাগবেই, তবে আমায় ভরসা করো একটু। দেখবে, সজীব আর ফারাহ ভালো থাকবে।”

আদিবা বেগমও হাত ধুয়ে উঠে চলে যান। আজিমা বেগম লম্বা শ্বাস নিয়ে খাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে ঘরের দিকে চলে যান ঘুমানোর জন্য।

১৩,
পরেরদিন সকালবেলায়,

কলেজের জন্য বের হতে তৈরি হচ্ছে ফারাহ। আছিয়া বেগম কাজ ফেলে ফারাহর পিছন পিছন ঘুরছেন। উদ্দেশ্য মেয়েকে বিয়ের জন্য রাজী করানো। ফারাহ মায়ের কথা শুনে গতকাল রাতে তার ঘর থেকে যে ঘরে তার মা বাবা থাকে টেনে নিয়ে রেখে দরজা আটকে শুয়ে পরেছিলো। বিয়ের জন্য তার বর কে! কাকে পাত্র হিসেবে পছন্দ করেছেন আছিয়া বেগম, নামটাও শুনার মানসিকতা তার হয়নি। ফারাহ আয়নার সামনে দাড়িয়ে হিজাবে লাস্ট পিন লাগিয়ে পিছনে অবস্থানরত আছিয়া বেগমকে বলেন,

“আপনার কি সকাল সকাল আমার মাথা নষ্ট না করলে ভালো লাগছেনা? কি শুরু করেছেন আপনি? আমি বলেছি তো আমি বিয়ে করবো না।”

আছিয়া বেগম মুখ খুললেন, বললেন,

“মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি তো যেতেই হবে মা।”

ফারাহ মায়ের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। বললো,

“এরপর স্বামীর অত্যাচারের সাথে বাকি সবার অত্যাচার মেনে নিয়ে পরে থাকবো। সহ্য না হলে আপনার বাড়ি আসলে ম”রতে বলবেন। আমিও ফাতিহা বুবুর মতো চলে যাই এটা চান আপনি?”

আছিয়া বেগম নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। মেয়ের কথার কি উত্তর দুবেন বুঝতে পারলেন না। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,

“সব ছেলেই যে এক! সব শ্বশুরবাড়ির মানুষ যে এক হবে এমন তো কথা নেই ফারাহ! তোর বাবার অবস্থা তুই জানিস ভালোমতোই। আর কতোদিন এভাবে খাটবেন উনি! বিয়ের যোগ্যি মেয়ে ঘরে রেখে চিন্তার অন্ত থাকে না ফারাহ। বোঝার চেষ্টা কর। ”

“ফাতিহা বুবুকেও এসব বলে বিয়ে দিয়েছিলেন আপনি। আমি কিছুই ভুলে যাইনি।”

কলেজ ব্যাগে বই গুছিয়ে তুলতে তুলতে কথাটা বললো ফারাহ। আছিয়া বেগম বিরক্ত হলেন এবার। মেয়ে মানুষের জিদ অকারণ, এটা উনার পছন্দ না। তিনি তবুও নিজেকে যথেষ্ট নরম রেখে বললেন,

“আগে পাত্র কে এটা তো শুন।”

ফারাহ কলেজ ব্যাগ কাঁধে তুলে কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,

“কে শুনি আপনার মহান সুযোগ্য পাত্র?”

“সজীবের মা এসেছিলো। তোর মামী তোকে সজীবের বউ করে নিয়ে যেতে চায়।”

মায়ের মুখে সজীবের নাম য়ুনে ফারাহর মুখের কথা ফুরিয়ে আসে। মনের মধ্যে হিম শীতল স্রোতের ধারা বয়ে যায়। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে,

“সজীব ভাই! উনি আমার স্বামী হবেন? অসম্ভব।”

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে