প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৩

0
336

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩
জাওয়াদ জামী জামী

” ভাবির আঁচল ধরে তো ঠিকই বসে থাক, ম’রা ভাইয়ের জন্য শোকে দু চোখ ভাসাও, কিন্তু তাদের মধ্যে যে শোকের ছিটেফোঁটাও নেই, তা কি জানো? তারা মুরগীর মাংস রান্না করে, মজা করে খাচ্ছে, তোমার ম’রা ভাইয়ের চিন্তা তারা আদৌ করছে কিনা সেই সন্দেহ আমার আছে। ” শিরিন আক্তার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।

পাশেই সাইদ আহমেদ বিরক্তি নিয়ে সব শুনছে। এই মুহূর্তে তার স্ত্রী ‘ র কথা শুনতে মোটেও ভালো লাগছেনা। কিন্তু সে নিরুপায়। তাই চুপচাপ থেকে সবকিছু শোনার সিদ্ধান্ত নেয়। কারন সে জানে তার স্ত্রী’র সম্পর্কে। যদিও তার বড় ভাইয়ের বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে এটা নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়। সে চায় তার ভাবি ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালো থাকুক।

” আমার কথার উত্তর তো দিবেইনা। সত্যি কথা কি কারও কখনো ভালো লাগে। দুইদিনের বিধবার তেজ কি! সেদিন তোমার বোন কিভাবে আমাকে অপমান করল, আর ঐ বিধবা চুপচাপ দেখে গেল। শেষে আমাদেরকেই দোষী করে বাড়ি থেকে বের করে দিল! ওর দুঃখের দিন তো কেবল শুরু হয়েছে। ওর কপালে আরও দুঃখ আছে। বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই তো নাই. তা-ও ফুটানি কমেনা। দুইদিন পর যখন ছেলেমেয়েকে নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে, তখন মজা বুঝতে পারবে। ”

স্ত্রী’র কথা শুনে সাইদ আহমেদ রে’গে যায়। সে তার বড় ভাইয়ের পরিবার সম্পর্কে এরূপ কথা শুনতে চায়না।

” শিরিন, তুমি চুপ করবে? সমস্যা কি তোমার? আমার ভাবি তোমার পাকা ধানে মই দিয়েছে, যে তুমি তার সম্পর্কে এভাবে বলছ? বেয়াদবির একটা সীমা থাকে বুঝলে? তুমি সীমা অনেক আগেই পার করে দিয়েছ। আজ যে তোমার মুখে এত বড় বড় কথা আসছে, চাকরি না করলে সেই কথাগুলো কি বলতে পারতে? একটা চাকরি কর জন্যই নিজেকে অনেক বড় মনে কর! ভুলে যেওনা, তোমার সেই চাকরিটা কিন্তু আমার ভাইয়ের বদৌলতেই হয়েছে। আমার জানামতে, ভাবি কোনদিন তোমাকে কটু কথা শোনায়নি। আর সে তার পরিবার নিয়ে গত তিন বছর ধরে যে কষ্ট করছে, তারপরও তোমার কাছে কোন সাহায্য চাইতে আসেনি। তবুও তাদের ওপর তোমার এত রা’গ কেন? নাকি চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়েছ? ”

” ভাবির নামে কিছু বললে, এত লাগে কেন? কি আছে ঐ ভাবির মধ্যে? আমাকে ভালো লাগেনা? এই জন্যই মানুষ বলে পুরুষ মানুষের স্বভাবই হলো ছোঁক ছোঁক করা। ” শিরিন আক্তার আর কিছু বলতে পারেনা। সাইদ আহমেদের থা’প্প’ড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কল্পনাই করতে পারেনি তার স্বামী তার গায়ে হাত তুলবে।

” তোমাকে বারবার করে বলেছি, আমার ভাই-ভাবীর সম্পর্কে কোন খারাপ কথাই আমি শুনতে চাইনা। আজকের পর থেকে যদি তাদের নামে কোন কথা আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে পাই, তবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেব। বড় ভাই-ভাবী আমার কাছে আব্বা-আম্মার থেকে কোনও অংশে কম নয়। ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কে কিছু বলার আগে আজকের থা’প্প’ড়ে’র কথা মনে রাখবে। ” সাইদ আহমেদ সেখানে আর দাঁড়ায়না। গটগটিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে যায়।

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শিরিন আক্তার রা’গে ফুঁসছে। আজকের অপমানের কথা সে কোনদিনও ভুলবেনা। সে মনে মনে পণ করল, এই অপমানের শোধ সে তুলবেই। সে ঐ পরিবারকে শান্তিতে থাকতে দেবেনা।

শনিবার সকালে নাস্তার টেবিলে বসে চুপচাপ খাবার খাচ্ছে রায়হান আহমেদ। তাহমিদ তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সে কিছু একটা চিন্তা করছে। তাহমিদও তাকে না ঘাঁটিয়ে চুপচাপ খেতে থাকে।

খাবার পর নায়লা আঞ্জুম নিজের রুমের দিকে চলে যায়। কিন্তু রায়হান আহমেদ ডাইনিং রুমেই ঠাঁয় বসে রইল।

” তালুকদার সাহেব, আজকে এত কি ভাবছেন? আপনাকে এমন ভাবুক দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগেনা। আপনি দেখতে হিরোদের মত। আর হিরোদের যেমন চুপসানো মুখে দেখতে ভালো লাগেনা, তাই আপনার চুপসানো মুখ দেখতেও ভালো লাগছেনা। হিরোরা সব সময়ই বুক চিতিয়ে চলাফেরা করে। আপনিও তাই করবেন। ” তাহমিদ টিপ্পনী কা’টে।

তাহমিদের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে রায়হান আহমেদ। তার চোখের নিচে কালি পরেছে। একটু শুকিয়েও গেছে। সে তাহমিদের কথায় কিছুই মনে মনে করলনা। কারন সে জানে তাহমিদ তার মন ভালো করার জন্যই কথাগুলো বলেছে।

” কখনো বিয়ে করোনা, তাহমিদ। বিয়ে করেছ তো ম’রে’ছ। বউ কখন তোমাকে জ্ব’ল’ন্ত চুলায় ফেলছে, আবার কখন ফু’ট’ন্ত পানিতে চুবাচ্ছে কিছুই টের পাবেনা। শুধু জ্বা’লা অনুভব করবে। কিন্তু স্ত্রী নামক রমনীটিকে কিছুই বলতে পারবেনা। যখন কিছু বলার চেষ্টা করবে, মনে রাখবে তুমি নির্ঘাত ধ্বংসের পথে। এবং সেই পথ নিজেই বেছে নিয়েছ। ”

” মহাশয়, আপনি ভুল বললেন। নারীরা হচ্ছে কাদামাটির মত। আমরা পুরুষরা তাদের যেভাবে গড়ব, তারা সেভাবেই গড়ে উঠবে। আমাদের পরিচালনায় ভুল রয়েছে, তাই মাঝেমধ্যে নারীরা লাইন ছেড়ে বেলাইনে হাঁটার চেষ্টা করে। সংসারের রাশ সব সময় পুরুষদের হাতেই থাকে। কিন্তু আপনাদের মত দুর্বল পুরুষদের জন্যই তারা নিজেদের জাহির করতে পারে। আপনারা যদি প্রথম থেকেই স্ত্রী এবং পরিবারের মাঝে সমতা রাখতে পারতেন, তবে দিনশেষে আপনারাই ভালো থাকতেন। ”

” আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভাবছি তোমার খালামনির সাথে সেটা নিয়ে আলোচনা করব। ”

” গুড। ”

” শুনতে চাইলেনা যে, কি সিদ্ধান্ত নিয়েছি? ”

” আপনাদের ব্যাক্তিগত আলোচনা শুনতে চাওয়ার মত বোকামি আমি করতে চাইনা। ”

” কিন্তু তোমাকে শুনতেই হবে। শোনার পর তুমি বলবে আমি ভুল করছি নাকি ঠিক করছি। ”

” আমাকে বিচারক মানছেন নাকি! এখনো আমি সেই পর্যায়ে যেতে পারিনি। সামান্য একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমি। তারউপর ব্যাচেলর। সংসারের আমি কি বুঝি! ”

” তুমি আমার থেকে বেশি বুঝ। তাই আমিও তোমার সাথে কথা বলে বুকে সাহস পাই। তুমিই পার আমার ঠিক ভুল ধরিয়ে দিতে। ”

” বলুন শুনি, কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ”

” আমি রাজশাহীতে একটা ফ্ল্যাট কিংবা জায়গা কিনতে চাচ্ছি। যদি রেডি ফ্ল্যাট পেয়ে যাই, তবে যত তারাতারি পারি এখান থেকে চলে যাব। তুমি কি বল? তুমি মত দিলেই তবে আমি নায়লাকে বলব। ”

” আমার ওপর রা’গ করে কি এই বাসা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? ”

” মোটেও না। তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ। এর আগেও ভেবেছি, এখান থেকে চলে যাব। কিন্তু সাহস করে কাউকে বলার কথা ভাবতে পারিনি। ”

” ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে আমি বলব, আপনি এখন এখানেই থাকুন। নানিমা অসুস্থ। সে বিছানা নিয়েছে। আপনারা চলে গেলে সে একা হয়ে পরবে। আপনারা ছাড়া রাজশাহীতে নানিমার আপন বলতে কেউই নেই। তাছাড়া নানিমাকে দেখার দ্বায়িত্ব এখন খালামনির। সে চায়নি জন্যই মামা একমাত্র ছেলে হয়েও নিজের বাড়িতে থাকতে পারেনি। আজ সে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এর দায় শুধু খালামনির। এবং একজন স্বামী হিসেবে সেই দায় আপনার ওপরও বর্তায়। সেদিন খালামনি বড় গলায় বলেছিল, তার মা’কে সে-ই দেখবে। সেদিন কিন্তু আপনিও চুপ ছিলেন। তাই আমি বলি কি যতদিন নানিমা বেঁচে আছে, ততদিন আপনারা এখানে থাকুন। ”

” এখন নিজেকে বারবার স্বামী হিসেবে অযোগ্য মনে হয়। আমার চোখের সামনে অনেক অন্যায় হয়েছে, কিন্তু আমি সব সময়ই চোখ বন্ধ করে থেকেছি। বিনিময়ে আজ আমি একূল-ওকূল দুকূলই হারিয়েছি। তুমি যখন বললে, আম্মা যতদিন বেঁচে আছে, ততদিন আমি এখানেই থাকব। ”

” আপনি পারলে জায়গা কিনে রাখুন। সময় সুযোগ বুঝে বাড়িও করবেন। নানিমার শারিরীক অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে। সে হয়তো বেশিদিন বাঁচবেনা। সারাজীবন সে যা যা অন্যায় করেছে, এখন তার ফল ভোগ করছে। ছেলে থেকেও নেই, একটা মেয়ে মা’রা গেছে, আরেকটা মেয়ে থেকেও নেই। এখন শুধু আপনারাই তার শেষ ভরসা। সে জীবনে দাপটের সাথে চললেও তার মনে ঠিকই অশান্তি ছিল। সুখ তার জীবনে ছিলনা। এখন আপনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে একটু ভালো থাকার রসদ পায়। তাই জীবনের শেষ কয়টা দিন তাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দিন। ”

” তোমার কাছে আমি প্রতিনিয়তই ঋণী হয়ে যাচ্ছি। তোমার এই ঋণ আমি শোধ করব কেমন করে! ”

” শোধ করতে হবেনা। নিজের কাছেই রেখে দিন। আমি এখন একটু বাহিরে বের হব, তালুকদার সাহেব। আপনি যাবেন নাকি আমার সাথে? চলুন কোথাও থেকে আড্ডা দিয়ে আসি। আপনার মন ভালো লাগবে। ”

” চল যাই। এই সুযোগে তোমার ফ্রেন্ডদেরও দেখার সুযোগ পাব। তুমি কি আজ রাতেই ঢাকা ফিরবে? ”

” হুম। এগারোটার গাড়িতে উঠব। ”

” একটা গাড়ি কিনে নাও। এভাবে কতদিন বাসে যাতায়াত করবে? ”

” আমার স্যালারি কি আপনার মত আকাশচুম্বী! সামান্য একজন শিক্ষক আমি। গাড়ি কেনার টাকা পাব কই! ”

” তোমার বাবাকে বললে দশটা গাড়ি তোমাকে কিনে দেবে। আর তুমি করছ টাকার চিন্তা! ”

” বাবা কিনে দিলে তার মালিক আমি হব কিভাবে? আর তাছাড়া আমি তার টাকায় কোন কিছু নিতে চাইনা। নিজের যেদিন সামর্থ হবে গাড়ি কেনার সেদিনই কিনব। এবার চলুন যাই। ”

রায়হান আহমেদ বুঝল তাহমিদ ঐ বিষয়ে আর কোন কথা শুনতে চায়না। তাই সে কথা বাড়ায়না। আঁড়চোখে তাকায় তাহমিদের দিকে। এই ছেলেকে দেখলে কে বুঝবে, ওর মনে পাহাড় সমান কষ্ট জমে আছে! সবকিছু থেকেও আজ তার কিছুই নেই, সে একা। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে, সমাজের সাথে যুদ্ধ করে ও বেড়ে উঠেছে।

সোহানী পারভিন আজ চলে যাবে। কিন্তু তার বড় বোন শাকিলা সুলতানা চাইছেন, আর কয়েকটা দিন তার ছোট বোন এখানে থাকুক। কিন্তু সোহানী পারভিন আপত্তি জানায়। তার বাড়িতে অনেক কাজ আছে, বিধায় সে আর থাকতে পারবেনা।

আইরিন পারভিন ছোট ননদকে যেতে দেখেও কিছুই বললনা। সে বুঝতে পারছে, সবাই তার সুসময়ের বন্ধু ছিল। তার দুঃসময়ের বন্ধু একমাত্র বড় ননদ। যেখানে তার নিজের ভাইয়েরাও বিপদে বোনের পাশে এসে দাঁড়ায়নি, সেখানে স্বামীর ভাই-বোনের কাছে সহানুভূতি আশা করা বোকামি।

কুহু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোট ফুপুর চলে যাওয়া দেখে চোখ মুছল। ও বুঝতে পারছে, ওদের দুঃখের সাথী কেউ হতে চায়না।

কেটে গেছে একমাস। কুহুর এইচএসসি পরীক্ষা সামনের মাসে। ও গ্রামের কয়েকজন ছেলেমেয়েকে প্রাইভেট পড়ায়। পাশাপাশি ভাইকেও পড়ায়। এবং নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং পড়াশোনায় বেশি মনযোগী হয়েছে সে। ওর লক্ষ্য সামনে এগিয়ে যাওয়া। মা,ভাইকে নিয়ে একটা সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখে ও। কিন্তু সুখ কি সহসাই ধরা দেয়? যদি মেয়েটা জানত, ওর জীবনে আরও দুঃখ এসে কড়া নাড়ছে তবে কি এমন নিশ্চিত থাকতে পারত?

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে