প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৫৩+৫৪

0
288

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫৩
জাওয়াদ জামী জামী

তিনদিন সৃজনকে নিয়ে পুরো ঢাকা চষে বেড়িয়েছে তাহমিদ। সাথে অবশ্য কুহুও ছিল। ও ভার্সিটি থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছিল। ছুটির অপব্যবহার মোটেও করেনি। এবার কুহু বেশিদিন ঢাকা থাকতে পারবেনা। সৃজনের ক্লাস শুরু হবে। তাই তারাতারিই ওদের যেতে হবে।

সন্ধ্যায় রুমে বসে তাহমিদ আর সৃজন আড্ডা দিচ্ছিল। কুহু ব্যস্ত রান্নাঘরে। কলিং বেলের শব্দে তাহমিদ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এই অসময়ে কে আসতে পারে! কুহুও রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।

দরজা খুলে তাহমিদ রা’গে এদিকওদিক তাকায়। কুহু তাহমিদের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে, সে রে’গে গেছে। বাহিরে কে দাঁড়িয়ে আছে! কুহু কৌতুহলবশত সামনে এগিয়ে আসে। দরজার বাহিরে দাঁড়ানো আগন্তুককে দেখে ওর ভয় হয়। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে মাত্রই দেশে এসেছে। তার হাতে শোভা পাচ্ছে ধূসর রংয়ের ন্যাপসাক। মেয়েটা ভয়ে ভয়ে তাকায় তাহমিদের দিকে। তাহমিদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে প্রানপনে চেষ্টা করছে নিজের রা’গ সামাল দেয়ার।

” আমি কি ভেতরে আসতে পারি? ” মৃদু গলায় বলল আগন্তুক।

তাহমিদের কোনও উত্তর না পেয়ে সে উত্তরের আশায় কুহুর দিকে তাকায়।

” ভেতরে এস, নাহিয়া। ” কুহুর কথা শুনে তাহমিদ ঝট করে চোখ তুলে তাকায় কুহুর দিকে। কুহু তাকে ইশারায় শান্ত থাকতে বলে।

তাহমিদ সরে দাঁড়ালে কুহু নাহিয়ার হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে আসে।

ড্রয়িং রুমের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে নাহিয়া পুরো বাসায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। তাহমিদ নিজের রুমে চলে গেছে।

” আমি কি এখানে এসে ভুল করেছি, ভাবি? ” নাহিয়া কান্না চেপে বলল।

” মোটেও ভুল করনি। তুমি দেশে এসেছ কবে? ”

” যদি ভুলই না করি। তবে কেন ভাইয়া আমাকে দেখেই রে’গে গেল! আবার রুমেও চলে গেল। আমার মা’য়ের করা অন্যায়ের শাস্তি ভাইয়া আমাকে দিতে চায়? কিন্তু আমিতো তার কাছে বোনের দাবী নিয়ে এসেছি। ” এবার নাহিয়া চোখের পানি আটকাতে পারলনা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তাই কুহুর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলনা।

কুহু ওর কাছে এগিয়ে এসে, ওর হাতের মুঠোয় নাহিয়ার হাতদুটো নিল। নিজে চুপচাপ থেকে নাহিয়াকে কাঁদতে দিল। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা যাচ্ছে, অনেক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সে।

” তোমার ভাইয়া তোমার ওপর কখনোই রা’গ’তে পারেনা। তার রা’গ শুধু তার কালো অতীতের ওপর। তোমার মত স্বাভাবিক জীবন পায়নি সে। এ পর্যন্ত আসতে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ”

নাহিয়া মুখ তুলে তাকায় কুহুর দিকে। মেয়েটা কত অনায়াসেই তার স্বামীর পক্ষে কথা বলছে! কত সহজেই তার স্বামীর সেই কালো অতীত মেনে নিয়েছে। নাহিয়া ভালো করে কুহুকে লক্ষ্য করল। সে স্পষ্ট দেখল, তার সামনে বসা তরুণীকে। এক বছর আগে যখন তাকে প্রথম দেখেছিল, তখন এই মেয়েটিকে একটা সাধারণ কিশোরী বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে আজ সে তরুণীতে পরিনত হয়েছে। তার চেহারার সুখী ভাব কারও নজর এড়াতে পারবেনা। তার শরীরের খাঁজে খাঁজে পরিপূর্ণ রমনীর চিহ্ন। এই মেয়েটার দিকে একবার তাকালে সহসাই চোখ ফেরানো দায়।

” ভাইয়া আমার সাথে কথা বলবেনা, ভাবি? আমি তার সাথে কথা বলতেই এতদূর এসেছি। ”

” কেন কথা বলবেনা? তুমি ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা করে নাও। এরপর তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলো। এস আমার সাথে। ” কুহু নাহিয়ার হাত ধরে তাকে সৃজন যে রুমে থাকে সেখানে নিয়ে যায়। ওকে ফ্রেশ হওয়ার সুযোগ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সৃজনও রুমে ছিলনা। সে তাহমিদের সাথে আছে। কুহু প্রথমে রান্নাঘরে গিয়ে নাস্তা রেডি করে, ট্রেতে নাস্তা সাজিয়ে নাহিয়ার জন্য নিয়ে যায়। এরপর সে নাস্তা নিয়ে তাহমিদের কাছে যায়। সৃজন তাহমিদের পাশে চুপচাপ বসে আছে। সে তাহমিদের মনোভাব বুঝতে পারছে। কিন্তু তাকে শান্তনা দেয়ার সাধ্য ওর নেই। কুহু রুমে আসলে সৃজন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে যায়। ও চাইছে, কুহু তাহমিদের সাথে কথা বলুক। তাই ওদেরকে কথা বলার সুযোগ করে দিতেই ও বাহিরে গেছে।

তাহমিদ পা ঝুলিয়ে খাটে বসে আছে। দুই হাত দিয়ে বিছানার দুই পাশ আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কুহু ধীরে ধীরে গিয়ে বসল তাহমিদের পাশে। হাত রাখল তাহমিদের কপোলে।

” এভাবে মন খারাপ করে থাকবেননা। আপনার শুকনো মুখ দেখলে আমার বুকের পাঁজর ভেঙে যায়। আমি জানি আপনার দুঃখের কোন তল নেই। তবুও জীবনের একটা সময় সবাইকে এই দুঃখ-কষ্টের সামনাসামনি হতে হয়। দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে হয় দুনিয়ায় টিকে থাকতে। আপনি পেরেছেন, সব বাঁধা পেরিয়ে সমাজের বুকে নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। সেই আপনাকে এমন রূপে মানায়না। ” কুহুর কথা শুনে তাহমিদ কান্নায় ভেঙে পরে।

কুহু তাহমিদকে শক্ত করে ধরে রাখল। বেশ কিছুক্ষণ পর তাহমিদ স্বাভাবিক হয়।

” আমার সাথেই কেন সব সময় এমন হয় বলতে পার? যে কালো অতীত থেকে আমি বেরিয়ে আসতে চাই, সেই অতীতই কেন বারবার আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে? অতীত কেন বারবার আমার জীবনে ফিরে আসে? তবে কি এর থেকে আমার মুক্তি নেই! ”

” আজ শেষবারের মত একবার সেই অতীতের একটা অংশের মুখোমুখি হয়ে দেখেন। আমি কথা দিচ্ছি এরপর আপনার জীবনে কালো অতীতের ছায়া পরতে দেবনা। মেয়েটা অনেক দূর থেকে বড় আশা নিয়ে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। সে কি বলতে চায় সেটা একবার শুনুন। আপনার যদি মনে হয় সে অহেতুক কিছু বলছে, তবে শুনবেননা। এরপর আর কখনোই আপনাকে আমি নাহিয়া কিংবা তার পরিবার রিলেটেড কোন অনুরোধ করবনা। ”

তাহমিদ কিছুক্ষণ কুহুর দিকে তাকিয়ে থাকল৷ এরপর ওর ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

” মনে থাকে যেন শেষবারের মত। শুধু তোমার কথার মান রাখতে আমাকে রাজি হতে হচ্ছে। ”

” আপনি নিজেকে শক্ত করুন। আর ঐ রুমে চলুন নাহিয়ার সাথে কথা বলবেন। মনে রাখবেন, পুরো দুনিয়াও যদি আপনার বিপক্ষে যায়, তখনও আমি আপনার পাশে থাকব। ” কুহু তাহমিদের বাহু জড়িয়ে ধরল।

” হুম, চল। তুমি সবটা সময় আমার পাশে থাকবে। ”

” আমার থাকাটা নাহিয়ার পছন্দ না-ও হতে পারে। ও যদি আমার সামনে আপনার সাথে কিছু বলতে না চায়? শুনুন আমি রান্নাঘরেইই থাকব। আপনি রুমে গিয়ে নাহিয়ার সাথে কথা বলবেন। এবার চলুন। ” কুহু তাহমিদের হাত ধরে তাকে নিয়ে নাহিয়ার কাছে চলল।

” নাহিয়া, ভেতরে আসব? ” কুহু দরজার সামনে এসে নাহিয়াকে ডাকল।

” এস, ভাবি। ”

কুহু তাহমিদকে নিয়ে ভেতরে আসল।

” এই যে তোমার ভাইয়াকে নিয়ে এসেছি। তোমরা কথা বল। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। রাতের খাবার বানাই। ”

” তুমিও থাকোনা, ভাবি। তোমার সামনে কথা বলতে আমার কোন আপত্তি নেই। ”

” আমি এখানে থেকে তোমাদের গল্প শুনলে রান্না করবে কে শুনি? নাকি তুমিও বাকিসব ননদীনিরদের মত ভাবির খুঁত ধরতে চাও? ” কুহু হাসিমুখে কথা বলল।

” মাফ চাই, ভাবি । তুমি রান্না কর গিয়ে। আমি বাকিসব ননদীনিদের মত হতে চাইনা। ”

কুহু হাসিমুখে বেরিয়ে যায়। আসলে ও চায়না কথা বলার সময় ওদের দু’জনের মাঝে কোন জড়তা থাকুক। কুহু থাকলে নাহিয়া হয়তোবা মন খুলে কথা বলতে পারবেনা।

রুম জুড়ে নিরবচ্ছিন্ন নিরবতা বিরাজ করছে। তাহমিদও কিছু বলছেনা। আবার নাহিয়াও মনে মনে কথা সাজাচ্ছে। এতদিন যেসব কথা মনে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিল, সেগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেছে। তারপরও ওকে কিছু বলতেই হবে। নতুনভাবে কথাগুলোকে সাজাতে হবে।

” ভাইয়া, প্রথমেই আমি সরি বলছি। এভাবে হুটহাট তোমার বাসায় আসা আমার উচিত হয়নি। ”

তাহমিদ নাহিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে চুপ থাকল। নাহিয়া বুঝল যা বলার ওকেই বলতে হবে। অপরপক্ষ থেকে কোনরূপ উৎসাহ সে পাবেনা।

” আমি সবকিছুর জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। যেহেতু আমার মা তোমার সাথে অন্যায় করেছে এবং সেজন্য তার বিন্দুমাত্রও অনুশোচনা নেই, সেই মা’য়ের সন্তান হিসেবে আমার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আমি স্বীকার করছি, তোমার শৈশব কৈশোর তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবনা। তবে তোমার ভবিষ্যতের দিনগুলি হয়তো মসৃণ করতে সহায়তা করতে পারব। ”

তাহমিদ চমকে তাকায় নাহিয়ার দিকে। এই মেয়ে বলছে কি!

” তোমার কথা বুঝলামনা। কিভাবে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাও, আর কেনইবা চাও! হতো আর আমার মত পরিবার হারাওনি। শৈশব কৈশোর হারাওনি। তুমি তো বাবা-মা’র রাজকন্যা হয়ে বেড়ে উঠেছ। নাকি তোমার মা তোমাকে পাঠিয়েছে আমাকে আরেকবার আঘাত দিতে? ”

” আমি মিথিলা আরজুমান্দকে মা বলে মনে করিনা। তাদের বাড়ি ছেড়েছি বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাওয়ার পরই। যে মা একটা ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারে, আর যাইহোক তাকে মা বলতে আমার ঘৃণা হয়। ”

” কেন এসেছ? ”

” তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে। হাজার হলেও মিথিলা আরজুমান্দ আমাকে জন্ম দিয়েছে। সব দায় এড়ালেও, এই দায় কিছুতেই এড়াতে পারবনা। তাই মেয়ে হওয়ার দায় এড়াতেই তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তুমি তাকে ক্ষমা করে দিও। আর প্রায়শ্চিত্ত এটাই, আমি তাকে মা হিসেবে অস্বীকার করেছি। একজন মা’য়ের জীবনে এর থেকে বড় আঘাত কখনোই হয়না। সে তোমার জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিয়েছে, বিনিময়ে আমি তার কাছ থেকে তার একমাত্র মেয়েকে কেড়ে নিয়েছি। ”

” কিন্তু কেন? তুমি আমার জন্য কেন এতবড় পদক্ষেপ নিতে চাও?” তাহমিদের গলায় অবিশ্বাস লুকিয়ে থাকলনা।

” পদক্ষেপ নিতে চাইনা, নিয়েছি। একজন সন্তান হিসেবে তার সেই ঘৃণিত কাজের পক্ষ আমি কিছুতেই নিতে পারবনা। অপরাধী সব সময়ই ক্ষমার অযোগ্য হয়, হোকনা সে বাবা কিংবা মা। ”

তাহমিদ চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে নাহিয়ার দিকে। ওর কথা তাহমিদের বোধগম্য হচ্ছেনা।

বিঃদ্রঃ আগামীকাল আমার ননদকে সি সেকশনে নিবে। এই কয়দিন ওকে ক্লিনিকেই থাকতে হয়েছে ডক্টরের তত্ত্বাবধানে। সব ঠিকঠাক থাকলে কাল সন্ধ্যায় আসতে চলেছে টুইন বেবি। আপনারা অনেকেই ইনবক্সে নক দিয়ে আমার ননদের অবস্থা জানতে চেয়েছেন। আমি ব্যস্ততার দরুন রিপ্লাই দিতে পারিনি। আমি কাল থেকে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে যাব। হয়তো কয়েকদিন নিয়মিত লিখা হয়ে উঠবেনা। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫৪
জাওয়াদ জামী জামী

” জার্নি করে এসেছ, নিশ্চয়ই তুমি টায়ার্ড। এখন কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। এরপর সবাই একসাথে খাব। ” তাহমিদ নাহিয়ার সামনে থেকে পালানোর পথ খুঁজছে। ও কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই নাহিয়া খপ করে ধরে ফেলল তাহমিদের হাত।

” আমার কথা এখনও শেষ হয়নি, ভাইয়া। আমি কয়েকদিন পর সুইজারল্যান্ড ফিরে যাচ্ছি ঠিকই, তবে সেখানের পড়াশোনার পার্ট চুকিয়ে এখানেই কোন একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হব। এবং হোস্টেলে থাকব। এবং তুমিই সব ব্যবস্থা করে দেবে। ”

” হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলে কেন! জন্ম থেকেই দেশের বাহিরে কাটিয়েছ, হুট করে দেশে এসে মানিয়ে নিতে পারবে? তোমার বাবা-মা সেটা মেনে নেবে! ” তাহমিদের কন্ঠে নিখাঁদ বিস্ময়।

” আগেই বলেছি, আমি তাদের সাথে থাকিনা। এমনকি তাদের সাথে একই দেশে থাকতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। এছাড়া আমি এ্যাডাল্ট, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নিজের আছে। আর আমি নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাব। তাই তাদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছিনা। এবার বল তুমি আমার পাশে থাকবে কিনা? ”

তাহমিদ নাহিয়ার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মেয়েটার কথার জোর দেখে তাহমিদ কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায়না। তবে মেয়েটা যে সত্যিই ওকে আপন ভেবেছে এটা বলার অপেক্ষাই রাখেনা।

” পরেরটা পরে দেখা যাবে। এখন তুমি ওঠ। চলো খেয়ে নিই। ”

” না। তুমি আগে আমাকে কথা দাও। আমি তোমার ওপর ভরসা করেই দেশে এসেছি। আমি দাদুর বাড়িতে না গিয়ে তোমার কাছে এসেছি। ” নাহিয়ার জোড়াজুড়িতে তাহমিদ দোটানায় পরে যায়। সে নাহিয়ার কথার কি জবাব দেবে!

” ঠিক আছে, তোমার যখন খুশি তখনই দেশে এস। আমি তোমার পাশে থাকব। ”

নাহিয়াকে আর পায় কে। ও তাহমিদের কথা শুনে এক লাফে উঠে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরল।

” ধন্যবাদ, ভাইয়া। এতদিন একটা বড় ভাইয়ের অভাব ছিল। আজকে সেই অভাবও আর রইলনা। আজ তুমি সত্যিকারের ভাইয়ের কাজ করলে। ” নাহিয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

তাহমিদও ওকে জড়িয়ে ধরল। এই মেয়েটা একদিনের দেখায়ই যে ওকে এভাবে আপন করে নিবে, সেটা ওর ধারনায়ই ছিলনা! যেখানে বছরের পর বছর রায়ান, জাহিয়ার সাথে কাটিয়েও ওরা তাহমিদকে ভাইয়ের মর্যাদা কখনোই দেয়নি, সেখানে একদিনের পরিচয়ে এই মেয়েটা ওকে এতটা আপন ভেবেছে, সেটা তাহমিদের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। অথচ তাহমিদ ছোট্ট রায়ান আর জাহিয়াকে সব সময়ই নিজের ভাইবোন ভেবে এসেছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ওরা তাহমিদকে পছন্দ করে উঠতে পারেনি। অবশ্য এসবের পেছনে ডেইজি কুরাইশির পরোক্ষ ইন্ধন ছিল। যেটা তাহমিদ সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পেরেছে। একটা সময় পরে তাহমিদও আর রায়ান, জাহিয়ার জন্য ভালোবাসা রাখেনি। সময়ের সাথে সাথে ওদের প্রতি ভালোবাসাও ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু আজ চোখের সামনে এই মেয়েটাকে দেখে , তাকে ছোট বোন ভেবে আরেকবার ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। হয়তো জাহিয়ার শূন্যস্থান পূরণ করতেই নাহিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে।

” ভাবি, আমি যখন তোমাকে প্রথম দেখি, তখন বোধহয় তুমি ভাইয়ার বউ হওনি তাইনা? ” রাতে এক বিছানায় শুয়ে নাহিয়া কুহুকে জিজ্ঞেস করল। নাহিয়া আর কুহু একসাথে শুয়েছে। আর সৃজন শুয়েছে তাহমিদের সাথে। নাহিয়া যে কয়দিন দেশে আছে, সে কয়দিনের বেশিরভাগ সময়ই তাহমিদের বাসায়ই থাকবে। এরপর ও যাবে দাদুর বাসায়।

” তুমি কিভাবে জানলে? রিশার কাছ থেকে শুনেছ নাকি? ” কুহু শান্ত গলায় জবাব দেয়।

” নাহ্। রিশার কাছ থেকে শুধু তোমাদের বাসার ঠিকানা নিয়েছি। রিশাকে ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই ও বলেছে, তুমি ভাইয়ার বউ। তোমরা নানুর বাসায় আর থাকোনা এমনকি ঢাকায়ও আলাদা বাসা নিয়েছ। প্রত্যেকেরই ব্যাক্তিগত কিছু বিষয় থাকে যা সবার শুনতে নেই। তাই আমি তোমাদের বিষয়ে রিশাকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। তবে যেদিন প্রথম তোমাকে দেখলাম, সেদিন তুমি নিতান্তই সাধারন এক তরুণী ছিলে। যে সবেমাত্রই কিশোরীর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলে। তোমার মধ্যে তখনও কারও স্ত্রী হবার কোন চিহ্নই ছিলনা। ”

কুহু নাহিয়ার কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। এই মেয়েটা স্বল্প সময়ের মধ্যে কতকিছু লক্ষ্য করেছে!

” তোমরা সেদিন রাজশাহী থেকে চলে যাবার অনেক পরেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। তবে তোমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পর্কে জানতে পেরে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। অতটুকু সময়ের মধ্যে তুমি আমাকেও পরখ করেছ! ”

” আমি ঐ বাসার প্রত্যেককেই কমবেশি পরখ করেছিলাম। সেদিন তোমাকে আর রাজিয়া খালা নামক সেই মহিলাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছিলাম। তাই তোমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। তারপর যখন মঞ্চে ভাইয়ার আবির্ভাব ঘটল, তার সব কথা শুনে, তার চোখের পানি দেখে আমার সকল বিশ্বাস টলে গেল। সেদিন থেকেই বাবা-মা’ র প্রতি ঘৃণা জন্মেছে৷ দিনের পর দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি। ভাইয়ার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করেছি। বুঝতে পেরেছি তাহমিদ নামক মানুষটার চলার পথ মসৃন ছিলনা। তাই জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট হয়নি। বেরিয়ে আসতে পেরেছি বাবা-মা নামক স্বার্থপরদের ছায়া থেকে। ”

কুহু অবাক হয়ে শুনছে নাহিয়ার কথা। মেয়েটা অল্প বয়সেই অনেক কিছু বুঝে গেছে। দেখেছে মুখোশের আড়ালে মানুষের আসল চেহারা। স্বার্থপর বাবা-মা ‘ র সাথে থেকেও সে হয়নি তাদের মত। তার মন হয়েছে আকাশের মত বিশাল। সে গড়ে উঠেছে খাঁটি মানুষ হয়ে। যে মেয়ে তার বাবা-মা ‘র নিকৃষ্ট অতীত জেনে যে তাহমিদকে ভাইয়ের মর্যাদা দিয়েছে, সেই সাহসী মেয়ের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে কুহুর।

” তোমাকে শান্তনা কিংবা সহমর্মিতা জানালে তোমাকে অপমান করা হবে। একটাই দোয়া করি, তোমার মত সন্তান যেন বাংলার প্রতিটি ঘরে জন্ম নেয়। ”

নাহিয়া কুহুর কথার উত্তর না দিয়ে কুহুর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল।

সকালে তাহমিদ ভার্সিটিতে চলে গেলে কুহু, নাহিয়া আর সৃজন মিলে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়৷ এরপর কুহু সোজা রান্নাঘরে যায়। কুহু রান্না করছে আর নাহিয়া মনযোগ দিয়ে কুহুর রান্না দেখছে। মাঝেমধ্যে নাহিয়া কুহুকে টুকটাক কাজ করে দিচ্ছে। নাহিয়া কুহুকে ওর হাইস্কুলের গল্প শোনাচ্ছে। ওদের গল্পের মাঝেই বেজে উঠল কলিং বেল। কুহু দরজা খুলতে চাইলেই নাহিয়া ওকে নিষেধ করে নিজে খুলতে যায়।

রাশেদ কুরাইশি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে একটু থমকান। এই মেয়েটাকে তিনি কখনোই দেখেননি। কে এই মেয়ে? পরক্ষনেই তিনি ভাবলেন, এটা হয়তো তাহমিদের মামার বাড়ির দিকের কেউ। কিংবা কুহুর কোন আত্মীয়।

” কাকে চাচ্ছেন? ” রাশেদ কুরাইশিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাহিয়া জিজ্ঞেস করল।

” কুহু মা বাসায় আছে? আর তাহমিদ সে কোথায়? ”

রাশেদ কুরাইশির কথার ভঙ্গিতে নাহিয়া বুঝল ইনি তাহমিদ, কুহুর পরিচিত কেউ। তাই সে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।

” ভেতরে আসুন। ভাইয়া ভার্সিটিত গেছে। ভাবি বাসায়ই আছে। ”

এই সময় রাশেদ কুরাইশিকে বাসায় দেখে কুহুর ভয় হচ্ছে। তিনি যদি নাহিয়ার পরিচয় জানতে চান, তবে ও কি উত্তর দেবে?

রাশেদ কুরাইশি নাহিয়ার কথা শুনে বুঝে নিলেন, মেয়েটি নিশ্চয়ই তাহমিদের কোন খালামনির মেয়ে। তিনি হাসিমুখে এগিয়ে গেলেন নাহিয়ার দিকে। তিনি ধরেই নিয়েছেন মেয়েটা নায়লা আঞ্জুম অথবা শায়লা হাসানের মেয়ে হবে।

” তোমার নাম কি, মা? তোমার আম্মুর নাম কি? ”

” আমি নাহিয়া সারোয়ার । মিথিলা আরজুমান্দ আমার আম্মু। আপনি কে আংকেল? ” নাহিয়া রাশেদ কুরাইশির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল নাহিয়াকে।

নাহিয়ার কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি দুই পা পিছিয়ে যান। আহত চোখে তাকিয়ে থাকেন নাহিয়ার দিকে। বহু বছর আগে যদি তিনি মিথিলা আরজুমান্দে অবহেলা না করতেন, তবে সে এখন তার সংসার করত। এই মেয়েটা তার সন্তান হতে পারত। পরক্ষণেই রাশেদ কুরাইশির মনে একরাশ অভিমান এসে হানা দেয়। তবে কি মিলিথার সাথে তাহমিদের যোগাযোগ আছে? মিথিলার মেয়ে এখানে আছে, তার মানে তাহমিদ মিথিলাকে মেনে নিয়েছে! তবে কি তাহমিদও মিথিলার মত তাকে ছেড়ে সুইজারল্যান্ড চলে যাবে! তাহমিদ কি আরেকবার তার পর হয়ে যাবে? কুহুর মত ছেলের বউকেও শেষ পর্যন্ত হারাতে হবে!

কুহু রাশেদ কুরাইশির দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের কোনে পানির অস্তিত্ব কুহুর অগোচরে থাকেনা। ও যেন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে