প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৫১+৫২

0
312

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫১
জাওয়াদ জামী জামী

জয় মাটিতে শুয়ে গোঙ্গাচ্ছে সেই সাথে ছটফট করছে। ওর নাক-মুখ দিয়ে র’ক্ত ঝরছে। কপাল ফে’টে গেছে। র’ক্তে ওর পুরো শরীর জবজব করছে। মা’রে’র চোটে ওর পুরো শরীরে ব্যথারা রাজত্ব শুরু করেছে। ওর মুখাবয়ব ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। দুই হাতে পেট চেপে ধরে ব্যথা কমানোর বৃথা চেষ্টা করছে।

” আর কুনজর দিবি আমার পাখির দিকে? এক মিনিট, তোর কুনজর দেয়ার সকল রাস্তা আমি বন্ধ করে দেব। প্রথমে তোর চোখদুটো উপড়ে ফেলব। এরপর কা’ট’ব তোর জিহ্বা। যাতে কাউকে আমার কথা বলতে না পারিস। আর আমার পাখির প্রতি কোন খারাপ কথা তোর এই জিহ্বা না ছুঁয়ে বের হতে পারে। ” তাহমিদ জয়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ওর চুল হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল।

জয় নিভুনিভু চোখে তাহমিদের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু চোখ দুটো প্রায় বন্ধ থাকায় পুরোপুরি তাহমিদের চেহারা দেখতে পেলনা।মুখ খুলতেই মুখের ভেতরে র’ক্তে’র স্বাদ পেল।

” ভা..ভা…ভাইয়া, আ..মার ভুল হয়ে গ..গ..গেছে। আ..আমি আ..র ক…ক…কোনদিন তো.….মার স্ত্রী’র দি..দিকে ন..ন…নজর দেব…না। আ..আ…মাকে ছে..ড়ে দাও। প্র.…মি..স ক..কর..ছি আ..আ..মি আ..র কখ..নো রা..জশাহী আ..সব..না। ” জয় কোনরকম তোতলাতে তোতলাতে বলল।

” তোকে আমি এক বিন্দুও বিশ্বাস করিনা। তুই হইলি চরম লেভেলের বেয়াদব। তোকে বিশ্বাস করা আর কালসা’পকে বিশ্বাস করা একই কথা। আজ তোকে আমি কোনভাবেই ছাড়বনা। ” তাহমিদের চোখ দিয়ে যেন আ’গু’ন ঝরছে।

জয় কোনমতে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে তাহমিদের পা জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওর চোখের পানি র’ক্তে’র সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

” ভা..ভা…ইয়া, আ..মি প্র…মি…স ক..কর..ছি, জীব…নেও ত..তোমার লা..ই..ফে নজর দ..দিবনা। আ..মি ক..কোন..দিন র..র…রাজশা..হী আ…স…ব…না। তোমার ক..কথা ক..কাউ..কে ব.ল..ব..না। প্রমি..স করছি। আ..ই স..সয়্যা..র, ভা..ই..য়া। ”

জয়ের দিকে তাকিয়ে তাহমিদের দয়া হল। এই ছেলেটা ছোটবেলায় ওর পিছে ঘুরঘুর করত। প্রশ্নবানে জর্জরিত করত তাহমিদকে। বড় হওয়ার সাথে সাথে ওর স্বভাব-চরিত্র পাল্টে যায়। ধীরে ধীরে বাজে ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতে শুরু করে। মাদকাসক্ত হয়ে পরে। সেই সাথে নারীদের প্রতি আসক্তি বেড়ে যায়। জয় যতই নষ্ট হোকনা কেন তাহমিদের মনের কোনে কোথাও ওর জন্য ভালোবাসা আছে। যতই হোক একটা সময় তাহমিদ ওকে সত্যিই ভালোবাসত।

” ঠিক আছে, আজ তোকে ছেড়ে দিলাম। তবে ভুল করেও যদি এসব কথা কাউকে বলেছিস, তবে সেদিন তোর প্রতি সামান্যতম দয়াও আমি দেখাবনা। তোকে সাথে সাথে খু’ন করব। আমার হাত থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবেনা। এমনকি তোর কোটিপতি বাবাও না। ”

তাহমিদের ইশারা পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলো জয়কে নিয়ে গাড়িতে তুলল। এরপর ওকে নিয়ে তাহমিদের নির্দেশিত জায়গায় রওনা দিল।

নায়লা আঞ্জুম মেজো বোনের ফোন পেয়ে উদগ্রীব হয়ে বেরিয়ে যায়। কুহু জিজ্ঞেস করায় শুধু বলল, জয় অসুস্থ। ও মেডিকেলে আছে। নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে কুহু একটু অবাকই হয়। কালকেই যে জলজ্যান্ত অসভ্য ছেলেটা ওর সাথে অসভ্যতামি করেছিল, আজকে সে হঠাৎ অসুস্থ হল কেমন করে! ও তারাতারি তাহমিদের কাছে গিয়ে তাকে সংবাদটা দিতে চাইল। রুমে এসে দেখল তাহমিদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে রাত প্রায় দুইটার দিকে বাসায় এসেছিল৷ এতরাত পর্যন্ত কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিয়েছিল, সজলের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। কুহু আর কোন প্রশ্ন করেনি।

” এই যে শুনছেন? উঠুননা, আর কত ঘুমাবেন! ”

” কি হলো বউ, এভাবে আমার সাধের ঘুম ভাঙ্গাচ্ছ কেন! আরেকটু ঘুমাতে দাও। ” তাহমিদ ঘুম জড়ানো গলায় কথা বলে, সাথে সাথেই আবার ঘুমিয়ে পরে।

” জয় ভাইয়া অসুস্থ। সে মেডিকেলে অ্যাডমিট আছে। আপনি গিয়ে তাকে দেখে আসুন। চাচিও চিন্তা করতে করতে বেড়িয়ে গেল। ”

” জয় যেখানে খুশি সেখানে থাকুক। ওর জন্য তোমার এত চিন্তা কেন! যার যেখানে স্থান, সে সেখানেই থাকবে। তাই ওর জন্য তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। ওর কর্মের ফল ও ভোগ করছে। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু ধন্দে পরে যায়। তাহমিদের কথা শুনে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে জয়ের বিষয়ে সে কিছু জানে।

” ঘটনা কি বলুনতো? জয় ভাইয়ার কথা শুনে আপনি এমন নিউট্রাল আছেন কেন! আবার আপনার কথার ধরনও আমার ভালো লাগছেনা। সত্যি করে বলুন ঘটনা কি। ”

” জয়কে আমিই উদোম ক্যালানি দিয়েছি। ও আমার হলদে পাখিকে ফ্ল্যার্ট করবে, আর আমি ওকে হুজুর হুজুর করব! তাই অল্পস্বল্প থেরাপি দিয়েছি মাত্র । ”

তাহমিদের কথা শোনামাত্রই কুহু ধপ করে বিছানায় বসে পরল। একটা মানুষ কি পরিমান নির্দয় হলে আরেকজনকে মা’রা’র পরে এমন নিস্পৃহ থাকতে পারে! আবার তাকে মা’রা’র কথা এমন ঠান্ডা মাথায় বলতে পারে! তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে কুহু আরেক দফা ঝটকা খায়। সেই মানুষটা ভোলাভালা মুখ করে চোখ বন্ধ করে আছে। যেন সে গভীর ঘুমে মগ্ন। এই চেহারা দেখে কে বলবে, এই মানুষটা এত জেলাস!

কুহু আর কোনও কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ তাহমিদের পাশে বসে থাকল। ও রুম থেকে বেরোনোর কথা ভুলে গেছে। ওর মনে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, যদি সবাই জানে জয়ের এমন পরিস্থিতির জন্য তাহমিদ দায়ী তবে কি হবে? আর বিষয়টার সাথে কুহুও জড়িত আছে, তবে কি ঘটতে পারে ওর সাথে! ভয়ে কুহুর হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। আসন্ন বিপদের কথা মাথায় আসতেই ওর শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এভাবে আর বসে থাকতে পারলনা মেয়েটা। বসে থাকার মত শক্তি ওর নেই। তাই চুপটি করে শুয়ে পরল তাহমিদের পাশে। ও শোয়ার সাথে সাথেই তাহমিদ ওকে নিজের কাছে টেনে নিল। তাহমিদের এমন কাজে কুহু চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে। কিন্তু আগের মতই তাহমিদ চোখ বন্ধ করে আছে। তাহমিদকে এই অবস্থায় দেখে একটা ভাবনাই কুহুর মাথায় খেলে যায়, এই মানুষটা ওকে এত ভালোবাসে কেন?

জয়কে নিয়ে সেদিন বিকেলেই ওর মা ঢাকায় যায়। সেখানে থেকেই সে জয়ের চিকিৎসা করাবে। প্রয়োজনে ইন্ডিয়া অথবা সিঙ্গাপুর নিবে। জয়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তবে গতবারের মত এবার হাত-পা ভাঙেনি। কিন্তু ইন্টারনাল প্রবলেম হয়েছে। এদিকে জয়কে অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। ওর সাথে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেই সে উত্তর দিচ্ছে এ্যাকসিডেন্ট করেছে। কিন্তু কিভাবে কি হয়েছে সেটা বলছেনা। দুপুরে তাহমিদ জয়কে দেখতে গিয়েছিল। ওকে দেখামাত্রই জয় ভয়ে কুঁকড়ে যায়। ঘুমিয়ে পরার ভান করে। যা তাহমিদ ঠিকই বুঝতে পেরেছে।

আরও তিনদিন রাজশাহী কাটিয়ে তাহমিদ ঢাকায় ফিরে। কুহুর পরীক্ষা চলছে। ওর পরীক্ষা শেষ হলেই তবে সৃজনকে নিয়ে ও ঢাকা যাবে। ওদের সাথে কুহুর বড় ফুপুও যাবেন। তাহমিদ ঢাকা যাওয়ার আগে তাকে রাজি করিয়েছে। তিনিও তাহমিদের কথা ফেলতে পারেননি। তবে তিনি বলেছেন, তিনি তিনদিনের বেশি ঢাকা থাকতে পারবেননা।

কুহুর বড় ফুপুও গ্রামে ফিরে গেছেন। তার মেয়ের বিয়ের সম্মন্ধ এসেছে। তাহমিদই পাত্রের খোঁজ দিয়েছে। পাত্র একটা বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। ছেলের স্যালারি খারাপ নয়। এছাড়াও তাদের পারিবারিক অবস্থা ভালো। ছেলের বাবার গ্রামে অনেক সম্পত্তি আছে। তাহমিদের কাছ থেকে সব শুনে তারা এই সম্মন্ধ এগোতে রাজি হয়েছে। কুহুর ফুপু ঢাকা থেকে আসলেই তারা মেয়েকে দেখতে আসবে। এই কয়দিনের মধ্যেই তাকে সব কিছুর জোগাড় করতে হবে। যদিও তাহমিদ বলেছে, সে-ই সব ব্যবস্থা করবে। তবে এতে তার মন সায় দিচ্ছেনা। বিয়ের পর থেকেই তাহমিদ তার পরিবারের জন্য অনেক কিছু করছে। তিনি আর ছেলেটাকে এসবের ঝামেলায় জড়াতে চাইছেননা।

পরীক্ষা শেষে কুহু সৃজন আর ফুপুকে নিয়ে ঢাকা
যায়। ফুপু তার কথামত তিনদিন পরই বাড়িতে ফিরে যান। সৃজন থেকে যায় বোনের নতুন সংসারে।

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫২
জাওয়াদ জামী জামী

পনের দিন পর তাহমিদ কুহুর বড় ফুপুকে জানাল, পাত্রপক্ষ তিনদিন পরই আতিয়াকে দেখতে যাবে। কুহুর ফুপু চাইছেন কুহু আর তাহমিদ যেন সেখানে থাকে। তাহমিদ ওর ফুপু শ্বাশুড়ির অনুরোধ ফেলতে পারলনা। তাহমিদ তাকে জানিয়ে দিল, দুইদিন পরই ওরা গ্রামে যাবে।

বিশ দিন পর তাহমিদ কুহুদের নিয়ে রাজশাহী ফিরল। সেইদিনই আবার ওরা বড় ফুপুর বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়। ওদের সাথে রায়হান আহমেদের পরিবারও যাচ্ছে। নায়লা আঞ্জুমের ইচ্ছেতেই তারা সেখানে যাচ্ছে।

ফুপুর বাড়িতে গিয়ে কুহুরা দেখল সাইদ আহমেদও এসেছেন। তবে তার স্ত্রী-সন্তানেরা আসেনি।

নায়লা আঞ্জুম এই প্রথমবার ননদের বাড়িতে এসেছে। তাকে দেখে বাড়ির সকলে অবাক হয়ে গেছে। শাকিলা সুলতানা ভাইয়ের বউকে দেখে সত্যিই বিস্মিত হয়েছেন। রায়হান আহমেদ আসার সময় অনেকরকম বাজার করে এনেছেন। মেহমানদের জন্য তার বোনের আর নতুন করে কিছু কিনতে হবেনা। তাহমিদও অনেক কিছুই এনেছে। সাইদ আহমেদও বাদ যাননি।

পরদিন দুপুরে মেহমান আসলে তাহমিদ, রায়হান আহমেদ আর সাইদ আহমেদ মিলে তাদের তদারকি করছে। মেয়েরা রান্নাঘরে ব্যস্ত।

আতিয়াকে দেখেই পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে যায়। তারা সাথে সাথেই বিয়ের কথা তোলে। এবং চায় আজই বিয়ে হোক। ছেলের বাবার অনুরোধে সেদিন বিকেলেই বিয়ের কাজ সারতে হয়। যেহেতু শাকিলা সুলতানা আগেই ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন তাই তিনিও দ্বিমত করেননি। হুট করেই বিয়ে হয় আতিয়ার। সন্ধ্যার আগেই পাত্রপক্ষ বিদায় নেয়। একমাত্র মেয়েকে বিদায় দিয়ে কান্নায় ভেঙে পরলেন শাকিলা সুলতানা। নায়লা আঞ্জুম আর কুহু মিলে তাকে শান্তনা দেয়।

ফুপুর বাড়িতে তিনদিন কাটিয়ে ওরা সবাই রাজশাহী ফিরল। পরদিন বিকেলেই তাহমদি ঢাকা ফিরে যায়। ও আগামী একমাস রাজশাহী আসতে পারবেনা। একমাস পরীক্ষা চলবে, এই একমাস ও কোথাও বেড়োতে পারবেনা। সৃজনেরও পরীক্ষা শুরু হবে, তাই কুহুর ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও তাহমিদের সাথে ঢাকা যেতে পারলনা। তবে সৃজনের পরীক্ষা শেষ হলেই ওরা ঢাকা যাবে।

কুহু এই একমাস ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন ভার্সিটিতে গেল। প্রতিটা ক্লাস মনযোগ দিয়ে করল। ল্যাবও মিস দেয়নি। প্রতি শুক্রবার রায়হান আহমেদের বাসায় গিয়েছে। নায়লা আঞ্জুমের সাথে ওর একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নায়লা আঞ্জুমের ইচ্ছেতে ওরা এক শুক্রবারে গ্রামে গিয়ে সারাদিন কাটিয়ে আসল। কুহু এতদিন যেমন জীবন চেয়েছে, তা ও পেয়ে গেছে। চাচারা সেই আগেরমত ভালোবাসে ওদের দুই ভাইবোনকে। নায়লা আঞ্জুমও তার দ্বায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছে। যদিও শিরিন আক্তার এখনও ওদেরকে পছন্দ করেনা। অবশ্য এতে কুহুর কোনও দুঃখ নেই। এতজন মানুষের ভালোবাসা পেয়ে একজনের ভালোবাসা না পাওয়ায় কোনও আফসোস নেই ওদের।

সৃজনের পরীক্ষা শেষ হতেই পরদিন ওরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ওরা যে ঢাকা যাচ্ছে সে কথা তাহমিদকে জানায়নি। ওরা দুপুর সাড়ে বারোটায় বাসায় পৌঁছে। ওর কাছে এক্সট্রা চাবি থাকায় বাসায় ঢুকতে সমস্যা হয়না। কুহু ফ্রেশ হওয়ার পর দেখল বাসায় খাবার কিছুই নেই। ও বুঝতে পারছে তাহমিদ না খেয়েই ভার্সিটি গেছে। ও রাজশাহী থেকে আসার সময় কিছু খাবার নিয়ে এসেছে, সৃজন সেগুলো খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে। আর কুহু পুরো ফ্ল্যাট পরিষ্কার করে তারপর রান্না করতে গেছে। রান্না করতে করতে শাহানা আক্তারকে ফোন দিয়ে জানতে পারল, তিনি এখন রাশেদ কুরাইশির বাসায় আছেন। সাতদিনের মধ্যে তিনি এখানে আসতে পারবেননা। ডেইজি কুরাইশি হঠাৎই অসুস্থ হয়ে গেছে। তাই তাকে কিছুদিন সেখানে থাকতে হবে।

রাত নয়টায় তাহমিদ বাসায় আসল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই ওকে অবাক হতে হয়। পুরো বাসা আলোকিত হয়ে আছে। কিন্তু সে-তো বাসার সব লাইটই বন্ধ করেই গিয়েছিল! দরজা খোলার শব্দ পেয়ে কুহু রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবার তাহমিদ আরেক দফা অবাক হয়। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে একমাসের অতৃপ্ত আঁখিদ্বয়ে যেন তৃপ্তির ছোঁয়া লাগে। আবেশে ছেয়ে যায় তনু-মন। উচ্ছ্বসিত হিয়া আহলাদীত হয়ে বলে ওঠে, তোর হৃদয়েশ্বরী এসেছে। যাকে কল্পনা করে তোর দিবারাত্রি কেটেছে সে আজ তোর আঁখির সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে প্রানভরে দেখে তোর এতদিনের তৃষ্ণা মেটা। হৃদয়কে সিক্ত কর তার হাসির পরশে।

তাহমিদকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে কুহু তার দিকে এগিয়ে যায়। ওর একটু চিন্তা হচ্ছে। তাহমিদ ওকে দেখে তো বিরক্ত হয়নি!

কুহু ধীর পায়ে তাহমিদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর বুক ধুকপুক করছে।

” আমার পাখিটা এভাবে আমাকে সারপ্রাইজ দেবে আমি সেটা কল্পনাই করতে পারিনি! আমার হলদে পাখির কি জন্মই হয়েছে তার প্রেমিক জামাইকে চমকে দিতে? ” তাহমিদের কথায় কুহু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ও কিছু বলতে গেলেই লক্ষ্য করল তাহমিদ নিজের বাহুডোরে ওকে বেঁধে নিয়েছে।

” শুধু জড়িয়ে ধরার সুযোগ খোঁজেন? দয়া করে ছাড়ুন। সৃজন রুমে আছে। ও দেখলে লজ্জায় পরে যাব। ” কুহু তাহমিদের থেকে ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করছে।

” শালাবাবু দেখলে দেখবে। আমি ওর বোনকেই জড়িয়ে ধরেছি। অন্যের বোনকে ধরিনি। কিন্তু তুমি নিষ্ঠুর রমনী, এতদিন পর একমাত্র জামাইকে চোখের সামনে দেখেও এমন উদাসীনতা দেখাতে পারছ! কোথায় দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে, সেটা না করে আমার হাত থেকে ছাড়া পেতে চাচ্ছ? ব্যাড, ভেরি ব্যাড। কিন্তু তোমার নিস্তার নেই মোটেও। ”

” দোহাই লাগে এবার ছাড়ুন। সৃজন দেখলে আমি লজ্জায় ম’রে যাব। আপনি এত নির্লজ্জ কেন বলুনতো? ”

” আমি যদি নির্লজ্জ হয়েও থাকি,তবে সেটা আমার বউয়ের কাছে। এতে আমার গর্ব হয়। যে পুরুষ তার বউয়ের কাছে নির্লজ্জ হতে পারেনা, তবে সে পুরুষই নয়। এই বিষয়ে আমি একশোতে একশো। বউয়ের কাছে বিয়ের আগে থেকেই নির্লজ্জ তকমা পেয়েছি। পুরুষ হিসেবে আমি স্বার্থক। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দিনদিন এই মানুষটার নির্লজ্জতার সীমা পেরোতে দেখে ওর ভয় হচ্ছে। কোনদিন না বাহিরের মানুষের সামনেই ওকে লজ্জায় ফেলে দেয়।

” কইরে শালাবাবু, কই গেলি তুই? তোর অভাগা দুলাভাই সেই কখন থেকে বাসায় এসে দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে তোর খেয়ালই নেই! দুলাভাই হিসেবে আমি পারফেক্ট হলেও শালা হিসেবে তুই জিরো। ” কুহুকে ছেড়ে দিয়ে তাহমিদ আরেকবার কথা বলল।

তাহমিদের গলা পেয়ে সৃজন বাহিরে আসল।

” ভাইয়া, আমি জানি তুমি দুলাভাই হিসেবে পারফেক্ট। নিয়ম করে প্রতিদিন একবার করে এই কথা ফোনে শুনতে শুনতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই প্রথম কাউকে নিজের ঢাক নিজেকে পেটাতে দেখলাম। ” সৃজনের কথা শুনে কুহু খিলখিল করে হাসতে থাকে।

এদিকে তাহমিদ ওদের দুই ভাইবোনের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এই একরত্তি ছেলেটা যে ওকে ঘোল খাওয়াবে সেটা বেচারা বুঝতেই পারেনি।

” দুই ভাইবোন একজোট হয়েছিস দেখছি! ওক্কে, আমারও দিন আসবে। তখন তোদের দুই ভাইবোনকে আমি সবুজ পাতার নির্যাস খাওয়াব। ”
সৃজন এগিয়ে এসে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরল। ওর ঠোঁটে তখনও তাহমিদকে হারিয়ে দেয়ার খুশিতে হাসি লেগে আছে।

রাতে তিনজন মিলে গল্প করতে করতে খাবার খেল। এরপর অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে তবে ঘুমাতে গেল।

সকালে কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে কুহু হেসে ফেলল।

” আসসালামু আলাইকুম বাবা। কেমন আছেন? আমি কিন্তু জানতাম আপনি আজ সকালেই আসবেন। ভেতরে আসুন। ”

রাশেদ কুরাইশি কুহুর সালামের উত্তর দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন।

” ছেলের মনোভাব যে একমাত্র মা-ই বুঝতে পারে সেটা তুমি আরেকবার প্রমান করলে, মা। এই যে দেখ, তোমার ছেলে তোমার পছন্দের বাজার করে এনেছে। সেই সাথে ঐ উজবুকের পছন্দেরও মাছ এনেছি। তুমি মজা করে রান্না কর দেখি। ”

তাহমিদ রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার কথা শুনে বিরক্ত হয়। মানুষটা ওকে সব সময়ই উজবুক বলে ডাকে যা ওর পছন্দ নয়।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে