প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৫৫+৫৬

0
301

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫৫
জাওয়াদ জামী জামী

” বাবা, আপনি ভেতরে এসে বসুন। সকালে কি বাসা থেকে খেয়ে বেরিয়েছেন? আপনি রুমে চলুন। সেখানে কিছুক্ষণ রেস্ট নিন। ততক্ষণে আমি খাবার নিয়ে আসছি। ” রাশেদ কুরাইশিকে স্বাভাবিক করতে কুহু ঠোঁটের কোনে জোর করে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল।

নাহিয়া কুহুর কথা শুনে অবাক হয়ে গেছে। ও তো জানে কুহুর বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। তবে ইনাকে কুহু বাবা বলছে কেন!

” বউমা, তুমি এত অস্থির হয়োনা। আমার ক্ষুধা নেই। আমি শুধু তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। এখান থেকে সরাসরি অফিসে যাব। তুমি ভালো আছ, মা? আমার ছেলেটা ভালো আছে? ”

রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে নাহিয়া বুঝতে পারল ইনিই তাহমিদের বাবা। বিষয়টা জানার সাথে সাথেই ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে নাহিয়ার ভিষন লজ্জা লাগলো। ভদ্রলোক না জানি ওর সম্পর্কে কি না কি ভাবছে। তাই ও ড্রয়িংরুমে আর দাঁড়ায়না। রুমের দিকে পা বাড়ায়।

” এই যে, মামনি ? তুমি কোথায় যাচ্ছ? এস তোমার সাথে পরিচিত হই। ” রাশেদ কুরাইশি নাহিয়াকে চলে যেতে দেখে কি মনে করে ডাক দিলেন।

নাহিয়া ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ায়। ওর ঠোঁটে মলিন হাসির রেশ। ও কিভাবে মানুষটার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবে? ওর যতই খারাপ লাগুক, ভদ্রলোকের সাথে ওকে কথা বলতেই হবে।

” জ্বি, আংকেল। ” নাহিয়ার কন্ঠা থেকে আর কোন শব্দ বেরোলোনা।

রাশেদ কুরাইশিও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে অতীতের হাজারো স্মৃতি। এই মুহূর্তে তার মিথিলাকে ভিষণ মনে পরছে। মনে পরছে সেই ছোট্ট তাহমিদের কথা। একটা সময় কতইনা সুখের ছিল তাদের সংসার! কিন্তু তিনি নিজ হাতে সব ধ্বংস করেছেন।

কুহু রাশেদ কুরাইশিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে তার মনে অবস্থা বুঝতে পারছে। সে নীরবে হাত রাখল রাশেদ কুরাইশির বাহুতে। কুহুর স্পর্শ পেয়ে ধ্যান ভাঙ্গল রাশেদ কুরাইশির। তিনি বুঝলেন চোখের কোনে পানি জমেছে। সযতনে তিনি মুছলেন চক্ষুদ্বয়।

” তোমার মা-বাবা কেমন আছে, মামনি? তারা দেশে আসেনি? ” ফ্যাসফেসে গলায় তিনি নাহিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন।

রাশেদ কুরাইশির প্রশ্নে নাহিয়া ঠোঁট কা’ম’ড়ে হাসল। ওর কাজল কালো চোখজোড়ায় মুক্তার ন্যায় অশ্রুকনারা চিকচিক করছে।

” তারা ভালো থাকার জন্যইতো সব ছেড়েছিল, আংকেল। আর যারা একবার অতীতকে পায়ে ঠেলতে পারে, তারা কি কখনো খারাপ থাকে? ”

নাহিয়ার কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি বুঝলেন মেয়েটা নিশ্চয়ই মায়ের অতীত নিয়ে খুশি নয়। তিনি ভালোভাবে নাহিয়ার মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটার চেহারায় বড্ড মায়া। তিনি ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই দেখলেন, মেয়েটার ঠোঁট থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। ওর দীঘির ন্যায় আঁখিদুটি টলটলে জলে পরিপূর্ণ। মেয়েটার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল বক্ষের গভীর থেকে। মেয়েটার দুঃখ তার হৃদয় ছুঁয়েছে।

” তুমি কিসে পড়ছ, মামুনি? কবে এসেছ দেশে? ”

” আগামী বছর ভার্সিটিতে ভর্তি হব। আমি গতকালই দেশে এসেছি আংকেল। ” নাহিয়া কেন যেন স্বাভাবিক হতে পারছেনা।

” তোমাদের দেশেতো অনেক বড় বড় ইউনিভার্সিটি আছে। কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাও? ”

” ভাইয়া যে ভার্সিটির টিচার সেই ভার্সিটিতে পড়তে চাই। ”

নাহিয়ার হেয়ালিপূর্ন কথা শুনে রাশেদ কুরাইশি প্রশ্নোবোধক চোখে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি নাহিয়ার কথার অর্থ বুঝতে পারেননি। কুহুও রাশেদ কুরাইশির ন্যায় অবাক হয়ে গেছে। কি বলতে চাইছে মেয়েটা?

নাহিয়া রাশেদ কুরাইশির দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বুঝতে পারে। এই মুহূর্তে ভদ্রলোকের চেহারা দেখার মত হয়েছে। তিনি যে ওর কথার মানে কিছুই বুঝতে পারেননি, সেটা নাহিয়া বেশ বুঝেছে। তাই ও হেসে আবারও মুখ খুলল।

” আমি তাহমিদ ভাইয়ার ভার্সিটিতে পড়ার কথা বলছি, আংকেল। আমি হাইস্কুল শেষ করে দেশে আসতে চাই। আর এখানেই পড়াশোনা করতে চাই। এই সুযোগে ভাইয়ার সংস্পর্শে এসে, নিজেকে তার মত করে গড়ে তুলতে চাই। ”

এবার রাশেদ কুরাইশি সত্যিই বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। একটা মেয়ে হঠাৎ করেই দেশে এসে তাহমিদের সংস্পর্শে নিজেকে গড়ে তুলতে চাইছে! অথচ তিনি এর আগে কখনোই মেয়েটার সম্পর্কে শোনেননি। কিংবা তাহমিদের কাছ থেকে জানতে পারেননি মেয়েটার কথা। যদিওবা তাহমিদ কখনোই তাকে এসব কথা বলতনা। কিন্তু শাহানা আক্তারকে ঠিকই বলত। আর শাহানা আক্তারের মাধ্যমে কথাটা ঠিকই তার কানে পৌঁছাত।

” তুমি সত্যি বলছ, মামুনি! তুমি দেশে এসে পড়াশোনা করতে চাও? তোমার বাবা-মা এই সিদ্ধান্ত মানবে! ”

” ভার্সিটিতে ভর্তি হবার আগেই আমি এডাল্ট হয়ে যাব। তখন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে কোন সমস্যা হবেনা। তাই অন্য কেউ আমার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার আগে অবশ্যই দুইবার ভাববে। তাই এই বিষয় নিয়ে আমার কোন চিন্তার কিছু দেখিনা। ”

” তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয়, মামনি। আমি তোমাকে দেখে সত্যিই অভিভূত হয়ে গেছি। ”

” আংকেল, আপনি একবারও কিন্তু আমাকে আপনার বাসায় যেতে বললেননা। আমরা এতক্ষণ গল্প করার সুবাদে এইটুকু ফর্মালিটি আপনার কাছ থেকে আশা করতেই পারি। ” নাহিয়া রাশেদ কুরাইশিকে কথাটা বলেই কুহুর দিকে তাকিয়ে ওকে চোখ মারল। নাহিয়ার এমন কাজে কুহু হতভম্ব হয়ে গেছে।

রাশেদ কুরাইশিও নাহিয়ার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেছেন। মেয়েটা যে সুযোগ বুঝে তাকে জব্দ করেছে এটা স্বীকার করতেই হবে।

” সত্যিই তুমি আমার বাসায় যেতে চাও! সেখানের অভিজ্ঞতা যে তোমার কাছে সুখকর হবেনা, এটার গ্যারান্টি আমি দিতে পারি। আর একজন আমার অতিথি হিসেবে তোমার সম্মান রক্ষা করার দ্বায়িত্ব আমার। সেজন্যই আমার বাসায় যেতে বলিনি তোমাকে। ”

” বুঝলেন আংকেল, আমি বড্ড লোভী একটা মেয়ে। তাই সুখকর অভিজ্ঞতার কোন প্রয়োজন নেই আমার। আমি শুধু সেই মানুষটাকে দেখতে চাই, যার জন্য ভাইয়ার শৈশব মধুর হয়নি। কিংবা তার কৈশোর নষ্ট করেছে যে, আঘাতে জর্জরিত করেছে যে, তাকে দেখার বড় সাধ হয়। এতদিন ভাইয়ার পুরো জীবন নষ্টকারীদের সাথে জীবনের অনেকটা বছর কাটিয়ে এসে আবার তার শৈশব-কৈশোর নষ্টকারীকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ”

” তাহলে তোমার সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দু-চোখ ভরে দেখে নাও। তারও কিন্তু তাহমিদের জীবন নষ্ট করার পেছনে যথেষ্ট অবদান আছে। ” রাশেদ কুরাইশি হাসিমুখে বললেন।

” পাপ করে মন ক্ষমা চাইলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও ক্ষমা করে দেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে, আপনি নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। আর যে ব্যাক্তি তার সকল ঘৃণিত কৃতকর্মের জন্য লজ্জা পায়, তাকে ক্ষমা করে দেয়া মনুষ্যত্বের লক্ষ্যণ। এটা একান্তই আমার মত। তাই অপরাধীর খাতা থেকে আপনার নাম কেটে দেয়া যেতেই পারে। ” নাহিয়ার কথা শুনে রাশেদ কুরাইশির মন নিমেষেই ভালো হয়ে যায়। তিনি মেয়েটাকে মন থেকেই ভালোবেসে ফেলেছেন। মেয়েটা স্পষ্টবাদী, তার মনের মধ্যে কোন প্যাঁচ নেই। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মেয়েটিকে ভালোনাবেসে থাকাই যায়না।

” কবে যেতে চাচ্ছ আমার বাসায়? তোমার বিখ্যাত ভাইয়া তোমাকে কিন্তু সে বাসায় নিয়ে যাবেনা। তোমাকে হয় আমার সাথে যেতে হবে, নয়তো একা যেতে হবে। ”

” আমি একাি যাব। আপনার অনুমতি যখন পেয়ে গেছি, তখন যেকোন একদিন হুট করেই সেখানে পৌঁছে যাব। ”

কুহু চুপচাপ দাঁড়িয়ে দুজনের গল্প শুনছে। কি সুন্দর তারা দু’জন কথা বলছে! অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে রান্নাঘরে পা বাড়ায়।

তাহমিদ বাসায় এসে দেখল নাহিয়া আর রাশেদ কুরাইশি হেসে হেসে গল্প করছে। ওদের সাথে সৃজনও আছে।

কুহু তাহমিদের দিকে তাকিয়ে বুঝল বেচারা কম অবাক হয়নি। সে ইশারায় তাহমিদকে চুপ থাকতে বলল। তাহমিদ কুহুর কথা মেনে চুপচাপ রুমে চলে যায়।

রাতে খাবার পর রাশেদ কুরাইশি বাসায় গেলেন। আজ তিনি অফিসে যাননি। সারাটাদিন ছেলেমেয়েদের সাথে আড্ডা দিয়ে গল্প করে কাটিয়েছেন।

রাশেদ কুরাইশি চলে যেতেই তাহমিদ কুহুকে নিয়ে রুমে আসল।

” তোমার শ্বশুর আজও কেন এসেছিল? আর নাহিয়ার সাথে তার কিসের এত কথা? ”

” আপনি এভাবে বলছেন কেন! তিনি আমার শ্বশুর ঠিক আছে। তবে তার আগে তিনি আপনার বাবা। তাকে বাবা বলবেন এখন থেকে। আর ছেলের বাসায় বাবা এসেছে এখানে এত প্রশ্ন কিসের? ”

” বউ, তুমি আমাকে ঘোল খাওয়ানোর চেষ্টা করোনা। তোমার এই স্বামীটি কিন্তু কম ঘোরেল নয়। আমাকে ঘোল খাওয়াতে গিয়ে, নিজেই কখন খেয়ে বসে থাকবে, সেটা টেরও পাবেনা। ”

” বিয়ের আগে থেকেই আমি ঘোল খেয়ে অভ্যস্ত। আপনি সময়ে-অসময়ে আমাকে ঘোল খাইয়েছেন। তাই এখন আর ঘোল খেতে ভয় পাইনা। ”

কুহুর কথা শেষ হতে না হতেই, তাহমিদ ওকে টেনে নিজের বুকে জরিয়ে নেয়। তার অধরে অধর মিশিয়ে দেয় চোখের পলকেই।

” ঘোল খাওয়াতে পেরেছি জন্যই আজ তুমি আমার হয়েছ। আমার ভালোবাসায় নিজেকে সঁপে দিয়েছ। এটা কি ঘোলের ক্রেডিট নয়? ” কুহুর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল তাহমিদ।

তাহমিদের হাঁটুতে বসে তার দু’হাতের শক্ত বাঁধনে বন্দীনি কুহু তাকিয়ে আছে তার একান্ত পুরুষের ঠোঁটে। তার কালচে খয়েরী পুরুষ্ট ঠোঁট সব সময়ই কুহুকে এক অমোঘ আকর্ষনে টানে, তা কি সে জানে? দু’জনের কপাল এখনো একে-অপরের সাথে আলিঙ্গনরত।

চলবে…

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫৬
জাওয়াদ জামী জামী

” ম্যাম, আপনার সাথে একজন দেখা করতে চাচ্ছে। আমি অনেকবার নিষেধ করেছি কিন্তু সে কিছুতেই শুনতে চাচ্ছেনা। ” ডেইজি কুরাইশি স্বামী-সন্তানদের সাথে লাঞ্চ করছে। ঠিক তখনই কেয়ারটেকার এসে বলল।

” কে এসেছে, রুবেল? তুমি তাকে চেন? ” ডেইজি কুরাইশি জিজ্ঞেস করল।

” না ম্যাম, চিনিনা। অল্প বয়সী মেয়ে। তার পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই বলল, আপনার কাছে সে নিজের পরিচয় দেবে। ” ডেইজি কুরাইশির প্রশ্নের জবাবে বলল রুবেল।

” ওকে। তাকে ওয়েটিংরুমে বসতে দাও। আমাদের লাঞ্চ হলে পাঠিয়ে দিও। ” ডেইজি কুরাইশি খাবারে মনযোগ দেয়।

কেয়ারটেকার বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
রাশেদ কুরাইশি মনে মনে আন্দাজ করেছে মেয়েটি কে হতে পারে। তিনি ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজনা বোধ করছেন। একটু পরে কি হতে পারে ভেবেই তার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে।

” আমি তোমাকে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছেনা। কে তুমি? কি চাও আমার কাছে? ” ডেইজি কুরাইশি তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

” আপনি আমাকে চিনবেননা। আমিও আপনাকে চিনিনা। তাই ভাবলাম, যখন কেউই কাউকে চিনিনা, তবে সেক্ষেত্রে পরিচিত হতে অসুবিধা কোথায়। তাই আপনার সাথে পরিচিত হতে আসলাম। আমি নাহিয়া সারোয়ার। এসেছি সুইজারল্যান্ড থেকে। মিথিলা আরজুমান্দের মেয়ে আমি। ” নাহিয়ার কথা শুনে ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত। শুধু রাশেদ কুরাইশি নির্বিকার রয়েছেন। তিনি শুধু শেষটা দেখার অপেক্ষায় আছেন।

” হোয়াট! তুমি সেই চরিত্রহীনার মেয়ে! তোমার সাহস তো কম নয়, আমার বাসায় এসে এমন বুক ফুলিয়ে কথা বলছ? সেই বেয়াদব মহিলা কি তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে? তার মতলব কি? সে কি আবার ফিরে আসতে চায়? তাই তোমাকে প্রতিনীধি হিসেবে পাঠিয়েছে? ”

” আমার মা যদি চরিত্রহীনা হয়। তবে আপনিও কিন্তু তাই। একজন পুরুষের স্ত্রী, সংসার, সন্তান থাকা অবস্থায়ই আপনি কিন্তু তার সাথে পরকীয়ায় জড়িয়েছিলেন। আপনার জন্যই আমার মা নিজের পথ বেছে নিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আপনারা সমান দোষী। আপনি আংকেলের জীবনে আসার পরই, আমার মা নতুন জীবন খুঁজে নিয়েছে। এবার আশা করি আপনার গলার জোর কমবে? ” নাহিয়া কথাগুলো বলেই এদিক ওদিক তাকিয়ে বাড়িটা দেখায় মনযোগ দিল।

রায়ান ফুঁসে উঠে নাহিয়ার দিকে তেড়ে আসতেই রাশেদ কুরাইশি ওকে ধরে ফেললেন। রাশেদ কুরাইশির চোখের দিকে তাকিয়ে রায়ান থেমে যায়।
এদিকে জাহিয়াও রাশেদ কুরাইশির চোখমুখ দেখে ভয় পেয়ে গেছে। ওরা আজ পর্যন্ত ওদের বাবাকে এমন গম্ভীর রূপে দেখেনি।

” তোমার এতবড় সাহস, আমার বাসায় এসে আমাকেই অপমান করছ? একেই বলে লজ্জাহীন মা’য়ের লজ্জাহীন মেয়ে। বেরিয়ে যাও এখুনই আমার বাসা থেকে। ”

” আমি নিজেকে কখনোই লজ্জাহীন মনে করিনা। বরং এই মুহূর্তে আপনাকেই আমার লজ্জাহীন মনে হচ্ছে। আমি এসেছি আপনার সাথে পরিচিত হতে, আর আপনি আমাকে তখন থেকেই অপমান করে যাচ্ছেন। একটা সংসার নষ্টের কারিগর হয়ে, আপনিই আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলছেন। আর এমনভাবে আমার বাড়ি, আমার বাড়ি করছেন, যেন বাড়িটা আপনার বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছেন! কিন্তু আমার জানামতে, আপনি আংকেলের সেক্রেটারি ছিলেন। কোন ধনী বাড়ির মেয়ে কখনো সেক্রেটারির জব করবেনা৷ তাই ধরে নিচ্ছি বাড়িটা আংকেলেরই।”

” রাশেদ, তোমার সামনে এই মেয়েটা আমাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করছে, আর তুমি চুপচাপ দেখছ? আমি তোমার স্ত্রী। অন্যের অপমান থেকে আমাকে রক্ষা করার দ্বায়িত্ব তোমার।”

” মেয়েটা তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে। কিন্তু তুমি ওর পরিচয় পাওয়ার পর থেকেই, ওর সাথে দুর্ব্যবহার করছ। এতে আমি করতে পারি? ”

” বাই এনি চান্স, তুমি কি ওকে চেন? ওকে দেখেও তুমি এমন স্বাভাবিক আছ কেন? এক মিনিট, তোমার আদরের ছেলে আবার ওকে নিয়ে আসেনি তো? ও নিজে যখন কোন ফায়দা লুটতে পারেনি, তখন এই মেয়েকে এনেছে। একে দিয়েই নিজের কার্যসিদ্ধি করতে চাচ্ছে? ”

” সবাইকে নিজের মত মনে করোনা, ডেইজি। আমার প্রপার্টির ওপর তাহমিদের বিন্দুমাত্র লোভ নেই। আর ও এমন কোন ঘৃণ্য কাজ কখনোই করবেনা। এটা তুমি নিশ্চিত থাকতে পার। ”

” আপনারা ঝগড়া পরেও করতে পারবেন। আমি যা দেখতে এসেছিলাম, দেখে নিয়েছি। এবং জেনেছি, আপনার মত মা যেখানে থাকবে সেখানে তাহমিদের মত মানুষকে কষ্ট পেতেই হবে। এবং এটাই স্বাভাবিক। আরেকটা কথা শুনে রাখুন, এখানে আমি নিজের ইচ্ছেতেই এসেছি। আপনাকে দেখার সাধ আজ আমার পূরন হয়েছে। আসছি এখন। ভালো থাকবেন। ” নাহিয়া আর সেখানে দাঁড়ায়না। কয়েকজনের চিল চক্ষু উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।

রাশেদ কুরাইশিও ডেইজির রা’গকে পাত্তা না দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ান।

” বউ, এভাবে মনযোগ দিয়ে কি দেখছ? তোমার আশেপাশে আমি ছাড়া কোন সুদর্শন পুরুষ আমার চোখে পরছেনা। চোখের সামনে আস্ত একটা সুপুরুষ থাকতে তোমার নজর অন্য দিকে, এটা কি আদৌও মানা যায়! ” কুহু বেলকনির গ্রিল ধরে সামনের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাহমিদ রুমে বসে ভার্সিটির কাজ করছিল, তাই কুহু ওকে বিরক্ত না করে এখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। সুজন রাজশাহী ফিরে গেছে, নাহিয়াও সুইজারল্যান্ড ফিরে গেছে। তাই ওর একা একা রুমে থাকতে বিরক্ত লাগছিল। সেজন্যই এখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎই তাহমিদ এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তাহমিদের স্পর্শে কুহু কেঁপে উঠল। মানুষটা যতবারই ওকে জড়িয়ে ধরে, ততবারই মনে হয় এই প্রথমবার তাহমিদ ওকে জড়িয়ে ধরেছে। এই মানুষটার ছোঁয়া পেতে ও হাজারবার জন্ম নিতে পারে দুনিয়ায়।

” আমি মোটেও অন্য কোন পুরুষকে দেখছিনা। আমিতো সামনের বেলকনিতে থাকা ঐ পিচ্চিটাকে দেখছিলাম। দেখুন কত আদুরে ঐ পিচ্চিটা। এমন একটা বাবু বাসায় থাকলে আর কি লাগে। বাসা মাতিয়ে রাখার জন্য এমন একটা আদুরে সোনাই যথেষ্ট। ”

” এমন একটা আদুরে সোনা আসতে আরও পাঁচ বছর লাগবে। তাই পাঁচ বছরের আগে এসব চিন্তা ভুলেও মন এবং মস্তিষ্কে আনবেনা। ” কুহুর কাঁধে থুতুনি রেখে বলল তাহমিদ।

” এমন করে বলেন কেন! আগেই একটা গুলুমুলু সোনা আসলে ক্ষতি কি! ”

” ক্ষতির কিছুই নেই। বরং তুমি ফাঁকিবাজি করবে। গুলুমুলু সোনা আসলে তুমি পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি করবে। আগে পড়াশোনা শেষ কর, তারপর একটা নয় দুই-তিনটা গুলুমুলু সোনা আসবে। যদি আরও বেশি চাও আমি তাতেই রাজি হব। ইচ্ছে পোষন করবে তুমি, এবং দ্বায়িত্ব পালন করব আমি। মনে রেখ, এই বিষয়ে আমি উদারহৃদয়ের জামাই। ” তাহমিদের কথার ধরনে কুহু হেসে উঠল। এই লোকটার মুখে কোন কিছুই আটকায়না।

” এই আপনি চুপ করবেন? একেতো আমার মন ভেঙে দিচ্ছেন তারওপর মজা করতেও ছাড়ছেননা! আর কিসব কথা বলছেন! একটুতো লজ্জা করেন। ”

” বউয়ের কাছে লজ্জা কি! নাকি তুমি চাও আমি লজ্জায় সারাদিন মুখ লুকিয়ে রাখি? আর সত্যি কথা বলতে লজ্জা নেই। তারপরও যদি তুমি চাও আমি লজ্জা পাই, তবে আজ থেকে মিথ্যা লজ্জা পাওয়ার ভান ধরব। বউয়ের সাথে কথা বলতে গেলে লজ্জা পাব, তার সাথে খেতে বসলে লজ্জা পাব, এমনকি তাকে আদর করতে গেলেও লজ্জা পাব। তখন মানতে পারবেতো? ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু এবার তার পেটে চিমটি কে’টে হাসল।

” আপনি কি জানেন, আপনি দিনদিন উচ্চমাপের নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছেন? আগেতো এমন ছিলেননা। ”

” তোমার কাছে নির্লজ্জ উপাধি পেয়েও শান্তি আছে, বউ। যাকে ভালোবাসা যায়, তার কাছ থেকে পাওয়া নির্লজ্জ উপাধিও মনে প্রশান্তি আনে। আর যেখানে তুমি নামক পুরো মানুষটাই আমার প্রশান্তির কারন। তাই সেখানে তোমার মুখে নির্লজ্জ ডাকটাও আমাকে প্রশান্তি দেয়। তোমাকে আরও বেশি ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করে। ”
তাহমিদের কথার উত্তর না দিয়ে কুহু ওর বুকে নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দেয়। তাহমিদও ওকে পরম আদরে আগলে নেয় বুকের মাঝে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে