প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৪

0
302

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪
জাওয়াদ জামী জামী

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘাসের ওপর সটান হয়ে শুয়ে আছে তাহমিদ। মাথার নিচে দুইহাত দিয়ে রেখেছে। তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ওর কাছে বরাবরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আকর্ষনীয় লাগে। তাই নানার বাড়িতে আসলেই ও ছুটে আসে এখানে।
তাহমিদের পাশে বসে ওকে খুঁটিয়ে দেখছে ওরই বন্ধু সজল। সে বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক। সে তাহমিদের ছোটবেলার বন্ধু। এইচএসসি পর্যন্ত ওরা একসাথে পড়াশোনা করেছে। এরপর তাহমিদ চান্স পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সজল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রেজাল্ট ভালো হওয়ায় এখানেই শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছে সজল। আর তাহমিদ জয়েন করেছে দেশের নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে।

” ঐ ব্যাটা, চোখ সরা। এভাবে কি দেখিস? এই মুহূর্তে আমাকে কি কোন রমনী মনে করছিস? ” তাহমিদের কথা শুনে হেসে উঠল সজল।

” আমার বাসায় একটা সুন্দরী বউ আছে। তাই তোকে রমনী মনে করার কোন ভুল আমি করবনা। আমি তোর ত্বক দেখছিলাম। বয়স তো কম হলোনা বিয়ে করবি কবে? আর দুই বছর গেলেই চামড়া কুঁচকে যাবে। তখন বিয়ে করার মত মেয়ে পাবিনা। ”

” তুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হয়েছিস জন্যই অকালে বউ পেয়েছিস। তাই বলে নিজেকে এভাবে জাহির করতে হবেনা, বুঝলি? সারাজীবন তোকে দেখে এসেছি রোড সাইড রোমিও হিসেবে। কোন মেয়ে পাত্তা দেয়নি, কিন্তু নিজেকে একাই একশো ভাবতিস। আজ সেই তুইও আমাকে ক্রিটিসাইস করছিস! তোর মত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হতে পারিনি জন্যই অকালে কোন বউ পাইনি। আর ভবিষ্যতে বোধহয় পাবোওনা। তাই বিয়ের কথা আপাতত চিন্তা করছিনা। ”

” ফাঁপড় নিচ্ছিস, মামুর ব্যাটা! তুই ছিলি আমাদের স্কুলের সেরা স্টুডেন্ট। এমনকি কলেজেও তাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের টপার ছিলি তুই। কর্তৃপক্ষ তোকেও সেখানেই রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তুই তাদের কথার কর্ণপাত করেছিস? যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলি, সেখানে তুই কি করলি? সেই প্রস্তাব নাকোচ করে দিলি। আর গিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করলি। আবার কত ভালো ঘরের মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসছে কিন্তু তুই একবারও সেদিকে নজর দিয়েছিস? আমাকে উল্টাপাল্টা বুঝ দিলেই যেন মেনে নেব! ”

” আরে সজল, তুইও মামুর ব্যাটা বুলছিস? এখানকার ভাষা বুঝি আয়ত্ত করে নিয়েছিস? চালিয়ে যা, দোস্ত। ”

সজল বুঝতে পারছে তাহমিদ প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু ও সেটা হতে দেবেনা।

” আমি এখানে একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছি। সে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী। বাবা ব্যাংকার, মা সরকারি কলেজের টিচার। মেয়েরা এক ভাই, এক বোন। তোর সাথে মানাবে। তুই আগামী সপ্তাহে রাজশাহীতে আসলে, মেয়েটার সাথে দেখা করবি। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব। ”

সজলের কথা শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল তাহমিদ। ওর চোখমুখ থমথমে হয়ে গেছে। ওর সামনে অন্য কেউ থাকলে এতক্ষণ তার গালে
সপাটে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিত সে। নেহাৎ সজল ওর বন্ধু তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সজলও তাহমিদের মনোভাব বুঝতে পেরেছে। তাই সে আবার কথা বলল।

” কি আমাকে থা’প্প’ড় মা’র’তে ইচ্ছে করছে? অসুবিধা নেই মা’র’তে পারিস। তুই মে’রে আমার হাত- পা ভেঙে দিলেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকব। ”

সজলের কথার ভেতর একগুঁয়ে ভাব দেখে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ।

” সজল, তুই সবকিছু জানার পরও কেন এমন করছিস! সারাজীবন আমি মানুষের উপহাসের সম্মুখীন হয়েছি, কখনোবা হয়েছি করুণার পাত্র। তুই আবার নতুন করে আমাকে উপহাসের পাত্র বানাতে চাস? আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, সজল। আমাকে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে দে। থাকিনা একা। বেশ তো আছি। নাকি আমার সুখ তোর সহ্য হয়না? ”

” শা’লা, দিব এক লা’থি। তোর একটুখানি সুখের জন্য আমি এতকিছু করছি, আর তুই বলছিস আমি তোর সুখ সহ্য করতে পারিনা? আমার একটা বোন থাকলে, তোকে এভাবে রিকুয়েষ্ট করতামনা। ঘাড় ধরে সোজা কাজী অফিসে নিয়ে যেতাম। ”

” তোর একটা বোন থাকলে আমার থেকে তাকে লুকিয়ে রাখতি। কোন পরিবারই চায়না, একটা ভ্যাগাবন্ডের নিজের মেয়েকে জড়াতে। ”

” তুই শা’লা নিজের দোষে ভ্যাগাবন্ড হয়েছিস। মানুষের জীবনে কতরকম চমক থাকে, দুঃখ-দুর্দশা থাকে। তাই বলে কি সব মানুষই স্বঘোষিত ভ্যাগবন্ড হয়? তুই গুটিকয়েক মানুষের জন্য নিজেকে এভাবে গুটিয়ে নিবি তা আমি কল্পনাও করতে পারিনা। অথচ তুই ছিলি আমার দেখা সবথেকে দৃঢ়চেতা মানুষ। তোর কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করা যায়না। এটা দুঃখজনক। ”

” মাস্টার, তালুকদার সাহেবকে কোথাও দেখা যায়না যে? সে কি তার বন্ধুর সাথে ক্যাম্পাসের বাহিরে গেছে নাকি? ”

তাহমিদকে আবার প্রসঙ্গ পাল্টাতে দেখে হতাশ হয় সজল। ও তাহমিদকে কিভাবে রাজি করাবে তা ভেবে পায়না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়,

” অনেকদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে, তাই হয়তো কোথাও আড্ডা দিচ্ছে। তুই কি এখনই বাসায় যাবি? প্রতি সপ্তাহে রাজশাহী আসিস, আমার সাথে দেখা করিস, অথচ একদিনও আমার বাসায় গেলিনা। তুই আমাকে এত পর ভাবিস কেন বলতো? ”

সজলের কথায় স্পষ্টই অভিমানের ছাপ। তাহমিদ হেসে ফেলল। এই ছেলেটা ওকে এত ভালোবাসে কেন বুঝতে পারেনা তাহমিদ। ছোট থেকেই সজল ওর একনিষ্ঠ ভক্ত। তাহমিদের কোন দোষ কখনোই ওর চোখে পরেনা। তাহমিদ ওর সাথে রা’গ করলেও ও কিছু মনে করেনা। তাহমিদ ভাবে, ওর জন্য যারা চিন্তা করে, ওকে যারা নিঃসার্থভাবে ভালোবাসে তাদের মধ্যে সজলও একজন। হঠাৎ করেই তাহমিদের ইচ্ছে জাগে সজলকে রা’গি’য়ে দেয়ার।

” তোর বাসায় আমি এ জন্মেও যাবনা। আর তুইও আমাকে কখনো জোর করিসনা। নিজের পায়ে নিজে কু’ঠা’র মা’রি’স’না। ”
তাহমিদের কথার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে সজল। এদিকে সজল কথা বলেই চলেছে।

” তোর বউ আমাকে দেখলে নির্ঘাত আমার প্রেমে পরে যাবে। তখন তোকে দু-চোখেও দেখতে পারবেনা। সব ছেড়ে আমার কাছে আসতে চাইবে। কোনভাবেই তাকে তুই আটকে রাখতে পারবিনা। তুই তো জানিসই, মেয়েরা আমাকে দেখলে কেমন হুমড়ি খেয়ে পরে। তোর বউও তার ব্যাতিক্রম হবেনা দেখিস। ”

তাহমিদের কথা শুনে সজল ওর পিঠে ধুপধাপ কয়েকটা বসিয়ে দেয়। ও ভালো করেই জানে তাহমিদ ওর সাথে ঠাট্টা করছে।

” তাহলে থাক, আমার বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। একসময় মেয়েরা তোর পেছনে যেভাবে ঘুরঘুর করত! আমার বউ যে তোকে দেখে মত পাল্টাবেনা সেটা আমি বলতে পারিনা। সিরিয়াস বিষয় মনে করিয়ে দেয়ার জন্য তোকে ধন্যবাদ দেবনা। ”

সজলের কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠল তাহমিদ। ওর সাথে সজলও তাল মেলাল।

রাতে বাসায় আসতেই স্ত্রী’র রোষানলে পড়তে হয় রায়হান আহমেদকে। নায়লা আঞ্জুম বেডরুমে তার অপেক্ষায়ই ছিল।

” তুমি এতক্ষণ যাবৎ কোথায় ছিলে? তোমার কি একবারও মনে চায় উইকেন্ডে স্ত্রী-সন্তানদের সময় দিতে? আর তোমার কি মিনিমাম চক্ষু লজ্জাটুকুও নেই! তাহমিদ তোমার ছেলের বয়সী। আর ছেলের বয়সী কারও সাথে আড্ডা দিতে তোমার লজ্জা লাগলোনা? ”

” বাব্বাহা হঠাৎ বউয়ের মত আচরণ করছ যে! আমাকে নিয়ে এত চিন্তার কারণ কি? এতদিন জানতাম আমার টাকা, যোগ্যতা আর পজিশন নিয়ে তুমি চিন্তা কর। আজকে দেখছি সেগুলোর সাথে লজ্জাও যুক্ত হয়েছে! তোমার সমস্যা কোথায় আমাকে বলতো? আমি কি নিজের মত করে চলতেও পারবনা? এখন থেকে কার সাথে বাহিরে যাব, আড্ডা দেব সেটাও তুমি ঠিক করে দেবে? ”

” রায়হান, তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন? তুমি ভুলে যেওনা আমি কে? সমাজের আমার পজিশন কি। হঠাৎ করেই সাহসী হতে চাইছ নাকি? ”

” তুমিও ভুলে যেওনা আমি কে। সমাজে আমার পজিশন কি। আর একটা কথা মনে রেখ, তোমার বাবা অনেক আগেই মা’রা গেছে। তাই অযথাই সবখানে বাবাকে টেনে এনে নিজেকে পরিহাসের পাত্রী করোনা। তুমি বিয়ের পর থেকে সব জায়গায় আমার পরিচয়ে পরিচিত। সবাই তোমাকে সম্মান করে আমার জন্য। কথাটা মনে রাখলেই তোমার জন্য ভালো হবে। ” রায়হান আহমেদের বেশি কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছেনা। তাই সে কাপড় পাল্টে বিছানায় যায়। আজ অনেকদিন পর নিজের জন্য সময় বের করেছে। বন্ধুর সাথে অতীত রোমন্থন করেছে। এজন্য তার মন-মেজাজ বেশ ফুরফুরে আছে। তাই স্ত্রী ‘ র সাথে বিতণ্ডায় জড়িয়ে তার রেশ নষ্ট করতে চায়না।

নায়লা আঞ্জুম স্বামীর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে। যে মানুষটা আজ পর্যন্ত তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনি, আজ সে হঠাৎ এভাবে রিয়্যাক্ট করল ভাবতেই রা ‘গে সে ফুঁসছে। সে চাইছে স্বামীকে আরও দু-চার কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু স্বামীকে পাশ ফিরে শুতে দেখে হাতের কাছে থাকা দামী ফুলদানি আছাড় মা’র’ল।

রায়হান আহমেদ বুঝতে পারল নায়লা আঞ্জুম কিছু একটা ভেঙেছে। সে কোনও প্রতিবাদ না করে ঠোঁটের কোনে ব্যাঙ্গের হাসি নিয়েই ঘুমের চেষ্টা করছে।

কলেজ থেকে বাড়ি ফিরতে আজকে কুহুর একটু দেরিই হয়েছে। ক্লাস শেষ করে ফিজিক্স স্যারের কাছে বসে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেখিয়ে নিয়েছে। এরপর দুইটা কোচিং করে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। দুইটা কোচিং-এর স্যারই ওর বাবার ছাত্র ছিল। তারা কুহুর বাবাকে খুব সম্মান করে। তারা কুহুদের বর্তমান পরিস্কার জানে। তাই কুহু কলেজে ওঠার পর তারা বিনা বেতনে কুহুকে কোচিং-য়ের সুযোগ করে দিয়েছে। অবশ্য প্রথমে কুহু রাজি হয়নি। কিন্তু সেই স্যারেরা কুহুর বাবার কাছে গিয়ে বলেছে, অনেক অনুরোধের পর কুহুর বাবা তার প্রাক্তন দুই ছাত্রের কথা মেনে নিয়েছিলেন। তারপর থেকে কুহু সেই দুই কোচিং-য়ে গিয়ে ক্লাস করে।

কোচিং থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। এই পথটুকু কুহু অটোতে যাতায়াত করে। আজও কুহু অটোর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু একটাও অটো চোখে পরছেনা। বাধ্য হয়ে ওকে সেখানেই দাঁড়াতে হয়।

” কুহু মা, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে? ” কারও গলা শুনে কুহু পেছনে তাকিয়ে ওর ছোট চাচাকে দেখল।

” অটোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি, চাচা। ”

” আমার বাইকে ওঠ। আজ অটোতে করে যেতে হবেনা। ”

” আজ তুমি এত তারাতারি বাড়ি যাচ্ছ যে? ব্যাংক তো এত তারাতারি ছুটি হয়না? ”

” আজকে মাথাটা ভিষণ ধরেছে, মা। তাই আজকে আগেই বেরিয়েছি। তুই বাইকে উঠে বস। আজকে আমরা সাড়া রাস্তা গল্প করতে করতে যাব। ”

কুহুও দেখল প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অটো পেতে হয়তো আরও সময় লাগবে। স্যারের কাছে না বসলে হয়তো এত দেরি হতোনা। তাই ও চাচার কথায় রাজি হয়। কিন্তু ওর মনে ভয় থেকেই যায়। সেই ভয় ওকে বারংবার বাঁধা দিচ্ছে।

” চাচা, তোমার সাথে আমাকে দেখলে চাচি কিছু বলবেনাতো? ”

” তুই সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে বাইকে উঠে বস। সন্ধ্যা হতে চলল। ”

কুহু আর কথা বাড়ায়না। বাইকে উঠে বসে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে